#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা
নৈঋতার আজ একেবারেই ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সোবহান স্যারের খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা লেকচার আছে। মিস করা যাবে না। অগত্যা সে তৈরি হলো। প্রতিদিন বেরুবার আগে রিহানকে কল করে সে, কিন্তু আজ কেন যেন নিজেকে বিরত রাখল।
প্রচণ্ড রোদ আজ বাইরে, ছাতা নেয়া হয়নি। দুই মিনিট হাঁটলেই কেয়ার মার্কেট, তার পাশে পশু পালন অনুষদ ধরে নিজের ফ্যাকাল্টিতে গেল সে। রিহান তখনও আসেনি, বোরহান স্যারের ক্লাস চলছিল। সে কল না দিলে রিহানের ঘুম ভাঙবে না। এর পরেই সোবহান স্যারের ক্লাস। অগত্যা কল করল। দুইবারের সময় রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“বল, নীরু।”
রিহানের ঘুম জড়ানো ভরাট গলায় কথাটা শুনতে ওর কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে। সে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কয়টা বাজে আগে দেখ।”
“কয়টা বাজে?”
“তোর চোখ নেই? সময় চিনিস না?”
“তা, তুই বললে কী হয়?”
স্যারের নজর বাঁচিয়ে কল করেছে, কানে এয়ারফোন দিয়ে। ধরা পড়া যাবে না, তাই এই মুহূর্তে বচসায় গেল না।
“নয়টা তেইশ।”
“তুই না আমাকে সোয়া আটটার দিকে কল দিস। আজ দেসনি কেন?”
“তুই এলার্ম সেট করে রাখতে পারিস না? আমাকেই কেন প্রতিদিন জাগিয়ে দিতে হবে?”
“তুই আমার এলার্ম ঘড়ি রে। তুই কত সুন্দর করে গালি দিয়ে আমাকে জাগিয়ে দিস। এলার্ম তোর চাইতে কর্কশ গলায় ডাকতে পারবে না, আর আমার ঘুমও ভাঙবে না।”
“তুই মর, ফাজিল।”
বলে কল কেটে দিল, রিহান সবসময় এভাবেই কথা বলে। তবুও আজ কেন যে কথাটা এত খারাপ লাগল!
স্যার হঠাৎ করে ওকে বললেন, “তুমি কী করছিলে?”
সে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু না স্যার।”
“বলো তো, এতক্ষণ কী বলছিলাম?”
পাশ থেকে শৈলী ফিসফিসিয়ে টপিকটা বলে দিল বলে এযাত্রায় বেঁচে গেল সে। রিহানের জন্য আরেকটু হলেই ঝাড়ি খেতে হতো। নৈঋতা অত্যন্ত মনোযোগী থাকে ক্লাসে। কিছু ক্লাস থাকে বিরক্তিকর। তখন খাতায় লিখে লিখে রিহানের সাথে গল্প করে।
গতবার একটা ক্লাসে রিহান এমন হাস্যকর ফাজলামো করছিল স্যারকে নিয়ে, যে সে প্রায় উচ্চস্বরে হেসে ফেলেছিল। ভাগ্যিস সামলে নিতে পেরেছিল।
আজ সে ক্লাসে একেবারেই মনোযোগ দিতে পারছে না। ওর বছর দেড়েক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন লেভেল টু, সেমিস্টার টু চলছিল। ওদের ডিপার্টমেন্টেরই সিনিয়র বড় ভাই নাহিদ ওকে প্রপোজ করেছিল। সে সাথে সাথে রিজেক্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু নাহিদ ভাই কিছুদিন বেশ বিরক্ত করেছে ওকে।
রিহানকে কথাটা জানাতেই ভীষণ রেগে গিয়েছিল সে, “নাহিদ ভাই? ওইটা তো পাক্কা প্লে বয়। ও তোর পেছনে ঘুরবে কেন? ওর তো খবর আছে!”
“মাথা গরম করে ঝামেলায় জড়াস না রিহান। আমি হ্যান্ডেল করতে পারব বিষয়টা।”
“তোকে কিছু করতে হবে না। আমি ঝামেলা করব না। তুই চিন্তা করিস না। আমি ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলব।”
রিহান নাহিদকে কী বলেছে নৈঋতা জানে না, কিন্তু এরপর আর নাহিদ ভাই বিরক্ত করেনি ওকে। রিহান আর নৈঋতা সবসময় একসাথে থাকে বলে, ওদের ফ্যাকাল্টির বেশিরভাগই মনে করে ওরা প্রেম করছে। ওরা চেষ্টা করেছে ভুল ভাঙাতে, কিন্তু কেউই বিশ্বাস করেনি।
রিহান ওর সকল বিষয়ে ভীষণ প্রটেক্টিভ। রিহান যেমন চোখ বন্ধ করে ওকে ভরসা করে, সে-ও রিহানকে নিজের সমস্তটা দিয়ে বিশ্বাস করে। সে সাথে থাকলে নিরাপদ অনুভব করে। রোল কলের সময় শৈলী ওকে ধাক্কা না দিলে, খেয়ালই করত না।
স্যার বেরিয়ে গেলে শৈলীকে বলল,
“থ্যাংকস রে।”
“আজ তোর কী হয়েছে বলবি?”
“কিছু না তো। শরীরটা একটু খারাপ।”
“রিহান আসবে না?”
“আসবে।”
বলতে বলতেই দেখল নবাবজাদা বীরদর্পে ক্লাসরুমে প্রবেশ করছে।
চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ফোলা, “রাতে ঘুমাসনি?”
“হৃদির সাথে কথা বলেছি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। তারপর… নেটফ্লিক্সে একটা জোস সিরিজ এসেছে। ভাবলাম একটা এপিসোড দেখেই ঘুমাব। এমন টুইস্ট আর থ্রিল, মাথা নষ্ট। পুরো আটটা এপিসোড শেষ করে ঘুমিয়েছি।”
“মহান কাজ করেছিস।”
“তোর মাথা ব্যথা কমেছে।”
“হুম।”
“তুই আজ আগে কল করিসনি কেন?”
“ব্যালেন্স ছিল না।” মিথ্যা কথা বলল নৈঋতা। সত্য কথা বললে অনেক প্রশ্ন আসবে।
“তুই না কালকেই রিজার্জ করলি। ফোনে তো আমার সাথে ছাড়া কারোর সাথে কথাও বলিস না তেমন। বাসায় হয়তো এক দুই মিনিট। তাও আঙ্কেলই কল দেন৷”
“আজাইরা প্যাঁচাচ্ছিস কেন, রিহান? আগে বলিনি বলে বলতে পারব না?”
“তোর কী হয়েছে রে নীরু? তাকা তো আমার দিকে।”
নৈঋতা রাগী গলায় কিছু বলতেই যাচ্ছিল, এরমধ্যে সোবহান স্যার ক্লাসে চলে এলেন। রিহান তখন বিস্মিত দৃষ্টিতে নৈঋতার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলল,
“জায়গায় গিয়ে বোস। ক্লাসে মন দে।”
***
বাবার সাথে কথা বলতে গেলেই নৈঋতার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ওকে বাড়ি যেতে বলছেন৷ সে দুই ঈদের ছুটি আর সেমিস্টার ব্রেকের সময় ছাড়া বাড়ি যায় না। তখন পুরো হল ফাঁকা হয়ে যায় বলে বাধ্য হয়ে যেতে হয়। নইলে তাও যেত না।
আফজাল স্যারের প্রেজেন্টেশন রেডি করছিল। চারজন করে একটা টিম। ওর টিমে রিহানও আছে আইডি নম্বর পাশাপাশি হবার সুবাদে। ওইদিনই এসাইনমেন্টও জমা নেবেন তিনি৷ টিম এক হলেও তিনি সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে সাবমিট করতে বলেছেন৷
রিহানের কল এলো, “কী করছিস নিরু?”
“ঘাস কাটছি।”
“খাওয়ার জন্য?”
“তোকে খাওয়ানোর জন্য। গরু কোথাকার। আফজাল স্যারের এসাইনমেন্ট করেছিস?”
“ওহ্! মনেই ছিল না। ডেডলাইন কবে যেন?”
“পরশু৷ তোর কোনটা মনে থাকে? খালি মেয়েদের বায়োডাটা মনে থাকে?”
“কোন মেয়ের বায়োডাটা মনে রেখেছি?”
“সেটা তুই জানিস। প্যারা দিস না। আমাকে কাজ করতে দে, তুইও এখন এসাইনমেন্ট করতে বস।”
“শোন না নিরু, তুই না আমার একমাত্র বেস্ট দোস্ত, আমারটাও একটু করে দিস কেমন?”
“একদম না রিহান। মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবে না। নিজের কাজ নিজে কর এবার।”
“আরে আজকে লা লিগার হাই ভোল্টেজ ম্যাচ আছে, এল ক্লাসিকো। নইলে আজ আর তোকে প্যারা দিতাম না। একটু হেল্পই তো চাইছি।”
“ম্যাচ তো পৌনে দুইটায়৷ এখন বাজে আটটা এগারো। এরমধ্যে শেষ হয়ে যাবে৷ সিরিয়াস হ।”
“আজকে আমি পারব না রে। আচ্ছা যা, বিনিময়ে তোর সাথে শপিংয়ে গিয়ে ব্যাগ টেনে দিব। তাও করে দে প্লিজ। আফজাল স্যার কাঁচা চিবিয়ে খাবে নাইলে। আমাকে কেন যেন সহ্যই করতে পারে না ব্যাটা। ক্যারি দিয়ে দেবে নির্ঘাৎ। তুই কি তাই চাস?”
“তুই ভালো করে জানিস আমি শপিংয়ে খুব একটা যাই না। এইজন্য এটা বললি। এমন বিনিময় চাই না।”
“আচ্ছা যা, কেয়ারে শফিক মামার দোকানের নান আর চিকেন চাপ খাওয়াব তোকে, পাক্কা প্রমিজ।”
নৈঋতার মনে পড়ল একবার এরকম একটার বিনিময়ে রিহান ওকে ট্রিট দিতে নিয়ে গিয়েছিল। খাবার শেষে ওকে বলেছিল, “দোস্ত, বিলটা দে তো।”
“তুই না ট্রিট দিলি!”
“আমার দেয়া আর তোর দেয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে! একই তো!”
সেবার স্টিলের স্কেল ওর পিঠে পড়েছিল, পরে অবশ্য নৈঋতাও ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে দ্বিগুণ বিল রিহানের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল। কত খুঁনসুটিতে মাখা মিষ্টি মধুর স্মৃতি সব।
“এসব ভুজুংভাজুং এ কাজ হবে না। তুই যে ট্রিট দেয়ার বান্দা না, সেটা আমি জানি।”
“আমার জন্য এটুকু করতে পারবি না? সবসময় করে করে এখন এভাবে অথৈ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিবি আমাকে?” নাটুকেপনায় এই ছেলে ওস্তাদ।
“পারব না।”
“থ্যাংক ইউ প্রাণের দোস্ত।”
“পারব না বলেছি, করে দেব বলিনি।”,
“আমি একটা ক্যারি খাই এটা তুই চাইবিই না। আমি জানি৷ গুড নাইট। তোকে আজ আর বিরক্ত করব না দোস্ত। গুড নাইট। মন দিয়ে এসাইনমেন্ট কর।”
“শয়তান একটা।” কল কাটার পরে বলল নৈঋতা৷ রিহানের এসাইনমেন্ট শেষ পর্যন্ত ওকেই করতে হবে এটা সে আগে থেকেই জানত। তাই ওরটাই আগে করে রেখেছিল। এই বান্দা এসব করার মানুষ নয়!
কিছুক্ষণ পরে সে নিচে গিয়েছিল পানি আনতে৷ দেখল হৃদি ফোনে কথা বলছে। সে নিজের রুমে এসে কৌতূহল বশত রিহানকে কল দিল, ওয়েটিং।
কেন জানে না একটা দম বন্ধ করা কষ্ট ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। সবকিছু হঠাৎ অসহ্য হয়ে উঠল। ল্যাপটপ বন্ধ করে কাঁথায় মাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
(ক্রমশ)
রিচ ফিরিয়ে আনতে সবাই বেশি বেশি কমেন্ট করে সাহায্য করবেন, এই অনুরোধ রইল।