নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০১

0
16

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা

নৈঋতা রিহানের জন্য অপেক্ষা করছে একরাশ বিরক্তি নিয়ে। এই ছেলের কোনো সময়জ্ঞান নেই। একটা মেয়ে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, ওদিকে নবাবজাদার ঘুমই এখনো ভাঙেনি। নৈঋতা কল করতেই ঘুমঘুম গলায় বলল,

“এত ভোরবেলা কল দিয়েছিস কেন?”

“তুই ঘড়িটা একবার দেখ। এরপর কথা বল।”

কিছুক্ষণ নীরবতা ওই প্রান্তে। এরপর আরেকবার গলাটা ভেসে এলো, “আরে, মাত্র তো দশটা তেইশ বাজে।”

“রিহান, এগারোটায় হাদী স্যারের ক্লাস। তোর এ্যাসাইনমেন্ট করে এনেছিলাম। এগারোটার পাঁচ মিনিট আগে তুই এসে না পৌঁছালে এটাকে আমি দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দেব।”

“তুই সিগারেট ধরেছিস নাকি?”

“উদ্ভট কথা কেন বলছিস?”

“দেশলাই সাথে রাখছিস, তাই ভাবলাম…”

“আমি জব্বারে আছি, করিম মামার দোকানের সামনে। দেশলাই পাওয়া আমার জন্য কোনো সমস্যা না। আমি পেট্রোলও জোগাড় করতে পারব। তোর এসাইনমেন্টের সাথে সাথে সেটা তোর মাথায়ও ঢেলে একটা কাঠি জ্বালব।”

রিহান জানে এই মেয়ের মাথায় কিঞ্চিৎ ছিট আছে। ওর মাথায় পেট্রোল না ঢাললেও এসাইনমেন্ট যে রক্ষা পাবে না দেরি হলে, এই ব্যাপারে ওর কোনো সন্দেহ নেই।
এবার ওই প্রান্তে রিহানের ব্যস্ততার আভাস পাওয়া গেল,
“এই না, নীরু, আমি আসছি তো। এক্ষুণি বেরুচ্ছি তো।”

“দশটা পঞ্চান্ন, মনে রাখিস।’’

“আরে, আমি রেডি হব তো।”

“ছেলেদের রেডি হতে আধাঘণ্টা লাগে না-কি।”

“আরে, কত মেয়েরা তাকায়, বল? একটু মাঞ্জা না মারলে হয়!”

নৈঋতা কল কেটে দিয়েছে। এই ছেলে শোধরাবে না। একফোঁটা সিরিয়াসনেস নেই রিহানের মধ্যে। দেখতে সুদর্শন, আড্ডা জমাতে ওস্তাদ, চমৎকার গানের গলা, গিটার বাজায়, শুধু পড়াশোনাটাই করতে ইচ্ছা করে না নাকি। ওর সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ছেলাটার হাসি। ভীষণ সুন্দর করে হাসে রিহান। এসব কারণেই সে বেশ ভালোই পরিচিত, আবার কিছু মেয়ের কাছে আরাধ্য। তবে রিলেশনশিপ নিয়ে রিহান কখনো খুব একটা সিরিয়াস নয়।

মেয়েদের সাথে কথা যতক্ষণ হয়, খুব মধুমুখ করে কথা বলে, তবে যখনই বুঝতে পারে মেয়েটা বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে, রিহান সরে আসতে থাকে। তবে মেয়েদের নজর নিজের উপরে পড়ুক, সেই ব্যাপারে আবার সে খুব সচেতন। ওর ভালো লাগে এটেনশন পেতে।

ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত দম আটকে সে পড়াশোনা করেছে, ভালো রেজাল্ট ছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স হবার পর প্রথম সে গণ্ডির বাইরে আসে। মাকে দেখানোর জন্য যেটুকুও বা পড়াশোনা করত, নৈঋতার সাথে বন্ধুত্ব হবার পর থেকে সেটুকুও ছেড়ে দিয়েছে।

রিহানের ভরসার জায়গা নৈঋতা। দু’জনের আইডি নাম্বার পাশাপাশি। লেভেল ওয়ানের প্রথম সেমিস্টারে ওদের কোনো আলাপ হয়নি। কেবল নামে আর চেহারায় চিনত একে অপরকে। প্রথম সেমিস্টার ফাইনালের প্রথম পরীক্ষার দিন কথা হয় ওদের। নৈঋতা নিজের জীবন আর লক্ষ্য নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। তাই ক্লাসে রিহানের কথাবার্তা খুব বিরক্ত লাগত ওর।

ফিশারিজ জ্যুলজি পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি একজনেরও। সেদিন খাতা জমা দেবার আগে আগে রিহান ওকে ডেকে বলেছিল,

“তোমার ফোন নাম্বারটা দিও তো। একসাথেই যেহেতু এক্সাম দিতে হবে, পড়াশোনাটাও একসাথেই করা যাবে।”

নৈঋতা রাজি হয়েছিল। গ্রুপ স্টাডি করলে ভালোই হয়। টপিকগুলো মাথায় থাকে। সেই থেকে টুকিটাকি কথাবার্তা শুরু। আগে ক্লাসে ওকে বিরক্ত লাগত, ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, এই রিহান ছেলেটা আসলে এমনই। চলছে, চলুক টাইপ। অগোছালো, ফুর্তিবাজ, কোনো লক্ষ্য, উদ্দেশ্যহীন নৌকার মতো। এসবের কিছুই নৈঋতার পছন্দ নয়, সে অত্যন্ত সিরিয়াস নিজের লক্ষ্যে। তবুও বন্ধুত্ব যে জমেছে, তা রিহানের আকর্ষণীয় চেহারা আর এপিয়ারেন্সের জন্য নয়, রিহানের ভেতরে একটা ছোট্ট শিশু বাস করে, তার জন্য। এই ছেলের সহস্র ফাঁকিবাজি, ছেলেমানুষি আবদার নৈঋতা মেনে নেয়।

ভাবনায় ছেদ পড়ল নৈঋতার। রিহান চলে এসেছে।

“যাক, এখনো অক্ষত আছে, জ্বালাসনি!”

নৈঋতা ঘড়ি দেখল, তিন মিনিট আগেই এসেছে রিহান। তবে সেজেগুজে আসতে ভুলেনি।

“দে আমার এসাইনমেন্ট, তোর উপরে ভরসা নেই।”

নৈঋতা হাতের ফাইল ফোল্ডার দিয়ে রিহানের পিঠে দুই-তিন ঘা বসিয়ে দিয়ে বলল,
“শয়তান, এগুলো তোর জন্য আমি কত কষ্ট করে করেছি, আর তুই…”

রিহান নিজের পিঠ বাঁচাতে বাঁচাতে বসল, “তোর হাতে এত জোর ক্যান! কী খাস তুই?”

নেঋতা রিহানের এসাইনমেন্ট বের করে ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “আজকের পর আমার আশেপাশে আসবি না।”

কোনোরকমে এসাইনমেন্টটা ধরে রিহান ছুটল নৈঋতার পিছে। অবস্থা বেগতিক। আজ বোধহয় ফাজলামোটা একটু বেশি হয়ে গেল কি-না।

“নীরু, আরে দাঁড়া না, তুই তো জানিস আমি এরকম। কেন রেগে যাস তবুও। এ্যাই…”

***
রেললাইন ধরে হাঁটছিল নৈঋতা আর রিহান। আজ বেশ রোদ্রতপ্ত দিন। আকাশ ঝলমলে, গেল কিছুদিন টানা বৃষ্টি ছিল। তাই এই রোদটা খারাপ লাগছে না। সহনীয় মনে হচ্ছে।

“তোকে রাতে কল দিয়েছিলাম। নাম্বার বিজি ছিল।”

“কখন?”

“কখন, এই তো নয়টার দিকে হবে হয়তো।”

রিহান বলল, “ও, হৃদি ফোন দিয়েছিল। কথা বলছিলাম ওর সাথে।”

“কোন হৃদি?”

“আরে, ওই যে ডিভিএম এর মেয়েটা। চশমা পরে, চিনিস তো। তোর হলেই থাকে।”

“আচ্ছা, কোন হলে থাকে, তাও মুখস্ত? কয় তালায় থাকে? রুম নম্বর জানিস?”

“তিনশো কত যেন বলল। ভুলে গেছি। চিনছিস তো, তাই না?”

“হ্যাঁ। তা কী আলাপ হলো?”

“ওই আর কী। আমার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। মেয়েটাকে একটু অন্যরকম মনে হলো।’’

“তা নিজেকে জানালি?” সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষার কাঁটা নৈঋতাকে খোঁচাতে লাগল কেন যেন। রিহান তো সবসময়ই এমন, তবুও আজ হঠাৎ ওর এমন লাগছে কেন! হয়তো কিঞ্চিৎ মুগ্ধতার আভাস পেয়েছে বলে।

কোনোমতে বলল, “এবার তুই সিরিয়াস রিহান?”

“কথা বলি আগে, জানাশোনা আরও হোক। যদি মনে হয় ঠিকঠাক, তারপর সিরিয়াস কিনা বলা যাবে। চলুক আপাতত।”

নৈঋতার কিছুই ভালো লাগছে না। সে বলল, “আমি হলে যাই আজ। মাথাটা ব্যথা করছে।”

“সে কী, মাথা ব্যথা, চল, আগে চা খাবি৷ এরপর হেলথ্ সেন্টারে গিয়ে ডক্টর দেখাবি আগে, ওষুধ নিয়ে এরপর হলে যাবি।”

“এসবের দরকার নেই। আমি যাই।”

“যাই বললেই হলো নাকি! তুই নিজের দিকে খেয়াল রাখবি না? চল, চল।”

নৈঋতার আপত্তি ধোপে টিকল না, অগত্যা রিহান সাথে থেকে সমস্ত প্রসিডিওর শেষ করে ওকে হলের সামনে দিয়ে গেল।

নৈঋতা হলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, রিহানের যাওয়া দেখল। ছেলেটা ওর প্রতি সবসময়ই এমন কেয়ারিং। ওর প্রতি এত যত্নশীল আগে কোনোদিন কেউ ছিল না। ওর তিন বছর বয়সে মা মারা গেছেন। ওর বাবা এরপর আরেকটা বিয়ে করেছেন। টাকা দিয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেন, অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখান, কিন্তু ভালোবেসে দুটো কথা, পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া এসব স্নেহ কখনো পায়নি সে।

রিহানকে সে বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ছেলেটা সম্পর্কের ব্যাপারে একেবারেই সিরিয়াস নয়। কোনো কিছুর প্রতিই নয়। একটা ভুল মানুষের জন্য এমন প্রগাঢ় অনুভূতি কেন জমছে ওর! এর কী আদৌ কোনো পরিণতি আছে! জেনে শুনে বিষ পান করেছে সে! নাহ্, নিজেকে সামলে নিতে হবে!

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে