#নব্যদিনের সূচনা
হুমাইয়া হুর
(৭)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলাম নিজেকে। পেটটা কিছুটা ফুলে উঠেছে। মুখ গুলোও যেন আগের তুলনায় গোল গোল লাগছে।জীবনে কি থেকে কি হয়ে যায় তা আমাদের চিন্তায় উর্ধে। কখনো ভাবতে পারি নি আমার জীবনে এমন সুখের অনুভুতি আসবে।তবে সুখ কি টিকবে আমার জীবনে? নাকি কালবৈশাখীর সূচনা ঘটবে?
সময় বহমান।কারো জন্য অপেক্ষা করে না।মুগ্ধ এবং আমার বিয়ের পাঁচ মাস হতে চলল।আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।আগের মত ঝগড়া এখন আর হয় না।আমাদের সম্পর্ক টা আট দশটা স্বামী স্ত্রী মত হয়ে গিয়েছে।অবশ্য শুরুটা মুগ্ধ নিজেই করছিলো । মনের ভিতরে নতুন নতুন অনুভূতি তৈরি করেছিলো।ভালোবেসে ফেলেছিলাম মুগ্ধের পাগলামি কে।
এখন আমি আর কিয়া আপু হোস্টেলে থাকি না। বড় বাবা অর্থাৎ আমার বড় চাচ্চা আমাদের একটা ফ্লাট কিনে দিয়েছে। আমি মুগ্ধ আর কিয়া আপু সেখানেই থাকি। ভার্সিটি ও যাওয়া হয় না শারীরিক অসুস্থতার জন্য। তিন মাসে প্রেগন্যান্ট আমি।ছোট একটা জান আমার ভিতর বেড়ে উঠছে।আমি যেন অনুভব করতে পারছিলাম সেটা। সোহানের ভয়ে আমার এখনো ভার্সিটি যাওয়া হয়ে উঠেনি।কিয়া আপু আমার সব নোট নিয়ে আসতেন।আমার পড়াশোনায় হেল্প করতেন । মুগ্ধ বড় চাচার বিজনেসে জয়েন করেছে। কিন্তু দিন কয়েক পর সেমিস্টার ফাইনাল।তাই এখন ভার্সিটি যেতে হবে।মা হবো জেনে মুগ্ধ আমায় কোনো কাজই ই করতে দিতো না।এমনকি পরিক্ষা দিতেও দিবে না। কি পরিক্ষা না দিলে কি হয়। তাই রাজী করালাম।
এত দিন যাওয়ার পর মন থেকে সোহানের ভয় কমে গিয়েছিল ভেবেছিলাম সোহান হয়তো আমার পিছু ছেড়েছে। সেদিনের পর থেকে সোহানের সাথে আমার কোনো কথা হয় নি।
যেহেতু পরিক্ষা ভালো মতোই পড়া পড়তে হবে।কিয়া আপু আর মুগ্ধ মশাই যতটা পারত আমার খেয়াল রাখত।একা ছাড়তো না কখনো।
প্রথম দিন পরিক্ষায় ভার্সিটি যাওয়া সময় ভয়ে ভয়ে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম সোহান হয়তো আমায় খুজে পেয়ে যাবে।কিন্তু এমন কিছু মনে হয় নি।তবে মাঝে মাঝে মত হতো কেউ হয়তো গভীর ভাবে আমাকে দেখতে।চারপাশে কেউ ছিলো না তেমন।তবুও ভয় ভয়ে কাটত দিনগুলো।
সেমিস্টার ফাইনাল শেষ এক মাস আগে। প্রেগনেন্সি চার মাস চলছিলো।দিন গুলো হাসি তামাশার মধ্যেই যাচ্ছিলো আমার।তবে শরীর টা ভালো না তেমন। বাড়ি থেকে কল এসছিলো।বড় চাচা অসুস্থ। কিয়া আপু সেখানে গিয়েছে।আমার অসুস্থতার কারনে মুগ্ধ যেতে পারেনি।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশে ঘন কালো মেঘ।দিন চারেক যাবৎ বৃষ্টি যেনো থামছেই না।সকাল থেকে আকাশ যেনো অভিমান করে ছিলো।ধুম করে বজ্র পড়ার শব্দের মুহুর্তে মধ্যেই শুরু হলো তুমুল ঝড়। প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো আমার সেদিন।বাতাশের শব্দ, গাছপালার নড়াচড়ার শব্দ বিদ্যুৎ এর ঝলকানি যেন ভয়ানক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো সেদিন।এমনি সময় ভয় না লাগলেও সেদিন কেন জানি খুব ভয় পেয়েছিলা।বড় চাচা অসুস্থ।হার্ট এট্যাক এসেছিলো তার। তুমুল বর্ষনের কারনে মুগ্ধ সেদিন হসপিটালেই আটকা পড়েছিলো।বার বার আসতে চাইলেও আমি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম দরকার নেই।কে জানত এটাই কাল হয়ে দাড়াবে আমার জীবনে?
বিকেল পেড়িয়ে সন্ধা হয়ে আসল।কি করবো ভেবে পাচ্ছাছিলাম না।এমনি সময় হলে মুগ্ধ বা কিয়া আপু পাশে থাকে।মনেই হয় না যেনো একা আছি।কোনো কিছু ভালো লাগছিলো না।মুগ্ধ কে ফোন করছিলাম কিন্তু তার ফোন লাগছিল না। হয়তো বৃষ্টির কারণে নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়েছিল।কি করবো যখন ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই ভাবকাম কিছুক্ষন টিভি দেখি।হটাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।এ সময় আবার কে আসবে? মুগ্ধ নয়তো? ও আসবে আগে জানায় নি তো ? আসতেও পারে।ভাবতে ভাবতে দরজাটা আমি খুলে দিয়েছিলাম কিন্তু দরজার ওপরে যা দেখলাম তা দেখে আমার ভয়ে নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। সামনে মুগ্ধ নয় বরং দাঁড়িয়েছিল সোহান।যে দেখে আমার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সোহান এখানে কিভাবে আসলো? তার তো এখানে ঠিকানা জানার কথা নয়। এখন কি করবো আমি? হাগের শিরা উপশিরা যেনো ঠান্ডা হয়ে আসছিলো আমার।তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে দিতে চাইলাম।কিন্তু সোহান আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। দরজা টা লগিয়ে দিলো।ভয়ে আমার পা থরথর কাপছিলো। সোহান আমার কাছে আসতে লাগলে। আমার ওড়না টা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে নিল।আমি কোনোরকম সরে গিয়ে নিজেকে কিয়া আপুর রুমে আটকে নিলাম।প্রচন্ড বেগে কান্না শুরু করলাম। আল্লাহ এবার কি আমার সহায় হবে না?
রুমের ভিতর ফোন খুজতে থাকলাম। আমার ফোনটা টিভির রুমে। আসলে ভাগ্য পাশে না থাকলে যা হয় আর কি । ফোনে রুম ও ছিলো না। সোহান অনবরত দরজা ধাক্কাছে।এক পর্যায়ে ভেঙে ফেলল দরজা টা।আমার চুলের মুঠি বরাবর ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে।নিচে পড়তে যেয়ে বিছানার চাদদের কোনা ধরে ঠাই হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমার যা কিছু হয়ে যাক আমার বাচ্চা টা যেনো বেঁচে যায়।সোহান আমার দিকে তেড়ে আসলো।সোহানের নিশ্বাস যেন আমার ঘাড়ের উপর পড়ছিলো।মুখটা আমার কানের কাছে নিয়ে বলল,
`কি ভাবিয়াছিলা সুন্দরী। তুই আমার সামনে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়িয়া বেরাবি আমি চেয়ে চেয়ে দেখব? ওহ নো যদি ভেবে থাকো তাহলে সেটা তোমার ভুল।শুনলাম বিয়ে করে বাসর নাকি সেড়ে ফেলছো? এই এই আমার মধ্যে কি করতি ছিলো রে? তোর জন্য আমার এত বড় লস হয়ে গেলো।আমার ক্লায়েন্ট আমার থেকে সব টাকা নিয়ে গেলো,আর তুই ভাবলি এই সোহান তোকে ভুলে গিয়েছে? হা হা হাসালি।আমি ফাঁদ পেতেছিলাম।আর তুই নিজেই ধরা দিয়েছিস। দেখ আজ তোর সামনে আমি। ঐ দিন তো রীতি আমাকে তোর সাথে কিছু করতে দেয় নি।আজকে কে বাচাবে তোমায় খুকি? শেষ মেষ এই সোহানের হাতেই তো ধরা দিলি’
বলে আমায় ছেড়ে দিয়ে গড়া ফাটিয়ে হাসছিলো সেদিন।আমি যেন অসহায় ছিলাম।আমরা মেয়েরা যতই সাহসীকতার কথা বলি? কিন্তু একটা সময় দুর্বল হয়ে পড়ি।মুগ্ধ কোথায় আপনি।
সোহান আমার মুখ চেপে ধরল। আমি যেনো চেষ্ঠা করছিলাম তার থেকে নিজেকে বাঁচানোর।
,হাতের কাছে একটা কলম পেলে তা সোহানে চোখের বসিয়ে দিতে গেলে সোহান আমার হাত চেপে ধরে। ধস্তা`ধস্তির এক পর্যায়ে সোহান সোহানের হাত এ আমি কলমের নিপ বসিয়ে দেই। সোহান ব্যাথায় আমার হাত ছেড়ে দেয়।সুযোগ বুঝে আমি দৌড় দেই টিভির রুমে।ফোন টা হাতে নিয়ে অনবরত মুগ্ধের ফোনে কল দেই।কল ঢুকছিলো না।বৃষ্টির কারনে নেট ওয়ার্ক ও যেন পাচ্ছিলো না।এখন আমি কি করব?
ততক্ষণে সোহান চলে এসেছিলো আমার কাছে।তার নীলাভ চোখ যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিলো। নিজের বেল্ট খুলে আমায় মারতে শুরু করল। হটাৎ একটা বাড়ি লেগে উঠল আমার পেটের উপর। ব্যাথায় কুকড়িয়ে উঠলাম আমি। কোনো মতে সোহনের পা ধরে মিনতি করতে লাগলাম আমায় যেন ছেড়ে দেয়। আমার বাচ্চাকে যেনো মেরে না ফেলে।
বাচ্চার কথা শুনতেই সোহান থেকে গেলো।নিষ্প্রাণ নিস্তব্ধ চোখে আমার দিক তাকালো।ভাবলাম এবার হয় তো আমায় ছেড়ে দেবে। আমাকে ভুল প্রমাণিত করে সোহান ঘর কাপিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে লগলো।সোহানের হাসিতে যেন নৃশংসতা বিরাজ করছিলো।সোহান ধীরে ধীরে আমার কাছে আসতে লাগল।
ভোর রাত। রাতের বাবার শরীর বেশি খারাপ থাকায় আর তুমুল ঝড় হওয়ার কারণে মুগ্ধ বাসায় যেতে পারে নি।মেঘনাকে অনেক বার কল করেছে কিন্তু অপাস থেকে নট রিচেবেল শব্দটি ভেসে আসে। তাই বাবার শরীর কিছুটা ভালো হলে সোহান বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয়।বাসায় এসে দরজার এক্সট্রা চাবি থাকায় লক খুলতে সমস্যা হয়নি মুগ্ধের।বাসায় ঢুকে চার পাশ এলো মেলা হয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায় মুগ্ধ। তবে মেঘনার কিছু হলো না তো।সারা ঘরে মেঘনাকে খুঁজতে থাকে।মনে যেন তার কি ডাক গাইছিলো।রান্নাঘরে যেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মুগ্ধ। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মুগ্ধ। তার সারাপৃথিবী যেন উলটো হয়ে যায় এক মুহুর্তে।
রক্ত দিয়ে তলানো রান্না ঘরে মেঝে।মেঘনা..
সমাপ্ত।