নন্দিত নরকে ৪র্থ ও শেষ পর্ব – হুমায়ুন আহমেদ

0
1134

৪র্থ ও শেষ পর্ব
#নন্দিত_নরকে – হুমায়ুন আহমেদ

বড়োমার গলা জড়িয়ে তার বিরফি-কাটা ছাপের ব্লাউজে নাক ড়ুবিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় আবদার, গল্প বলেন বড়োমা। ভূতের গল্প।
বড়োমা কোমল কণ্ঠে ধীরে ধীরে গল্প বলতেন, আমরা তখন ছোট। বারোতের বৎসরের বেশি বড়ো নয়। নানার বাড়ি যাচ্ছি। সবাই। ভাদ্র মাস, নদী কানায় কানায় ভরা। সারা দিন নৌক চলল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাঝিরা পুরান এক তালগাছের সঙ্গে নৌকা বেঁধে রান্না বসিয়েছে। এমন সময় রুস্তম বলে যে—বুড়ো মাঝিাঁটা ছিল, তার সে কি বিকট চিৎকার, কর্তা তালগাছে এটা কী? আমি শুনেই বাবাকে জাপ্টে ধরেছি। তালগাছের দিকে চাইবার সাহস নেই। বলতে বলতে বড়োমা থামতেন, আমরা ফুসে উঠতাম, থামলে কেন, বল শিগগির।
গল্প শুনে আতঙ্কে জমে যেতাম। কী অদ্ভুত তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি! বড়োমার মৃত্যুর দিনটিতে বাবার হৈচৈ আমার তাই ভালো লাগত না। আমার মনে হত আড়ম্বরের চেয়ে মৌন দুঃখানুভূতিই হয়তো ভালো হত। আমি মনে মনে বললাম, বড়োমা তোমার ছেলের আজ বড়ো বিপদ।
হ্যাঁ, আজ মন্টুর বড়ো বিপদ। বড়ো ভয়ঙ্কর বিপদ। মন্টু কি বড়ো মাকে ডাকছে? ফুটবলের খুব নেশা ছিল মন্টুর। খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ছেলেদের কাঁধে চড়ে বাসায় এল। হাঁটুর নিচে আধ-হাতখানেক জায়গা কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। হৈচৈ শুনে বড়োমা বেরিয়ে আসতেই মন্টু বলল, মা, আমি পা ভেঙে ফেলেছি।
বড়োমা বললেন, সেরে যাবে।
মন্টুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। এক্সরে করে দেখা গেল ভেতরে হাড়ের একটা ছোট ছুঁচাল কণা ভেঙে রয়ে গেছে, কেটে বের করতে হবে।
মন্টুকে সাদা বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। এনেসথেসিয়া করার বড়ো চৌকো। ধরনের যন্ত্রটা ডাওগার মন্টুর মুখের কাছে নামিয়ে আনলেন। ছোট্ট মন্টু আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, বল খোকা বল, এক দুই তিন চর। মন্টু বলল, মা, মা, মা।
আজ মন্টুর বড়ো বিপদ। দুৰ্গন্ধ কম্বলে মাথা চাপা দিয়ে আজো কি সে মা মা জপছে? না, মন্টু বড়ো শক্ত ছেলে। ইস্পাতের মতো তার নার্ভ। দারোগা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আকন্দকে খুন করেছ?
জ্বি।
কী দিয়ে?
বঁটি দিয়ে, মাছ কাটা বঁটি।
কটা কোপ দিয়েছিলে?
মনে নেই।
মরবার সময়ে তিনি কিছু বলেছিলেন?
জ্বি।
কী বলেছিলেন?
বাবা মন্টু।
আর কিছু বলেন নি?
না।
তিনি কি তোমাদের খুব শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন?
জ্বি, ছিলেন।
তুমি কী করা?
বি. এ. পড়ছিলাম।
দারোগা সাহেব কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। এবার শুরু করলেন আপনি করে।
কী জন্যে খুন করেছেন তাঁকে?
মন্টু চুপ করে রইল। দারোগা সাহেব বললেন, আমাকে বলতে কোনো অসুবিধা নেই। কোর্টে অন্য কথা বললেই হল। বাঁচার অধিকার তো সবারই আছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনাদের পারিবারিক কোনো স্ক্যাণ্ডাল–
ছিঃ!
আমার মনে হয় আপনি মিথ্যা বলছেন।
আমি মিথ্যা বলি না।
মন্টু খুব স্পর্ধার সঙ্গে বলল, আমি মিথ্যা বলি না। বলতে গিয়ে বুক টান করে দাঁড়াল।
দারোগা সাহেবের মাথা উপর একটা ফ্যান ঘুরছিল। ফ্যানের বাতাসে মন্টুর চুল কাপিছিল। আমি কাঁচুমাচু হয়ে ভদ্রলোকের সামনে একটা চেয়ারে বসেছিলাম। মন্টু কি কখনো মিথ্যা বলে না? মন্টুর সঙ্গে কথাবার্তা তেমন হয় না। সে জন্ম থেকেই নীরব। তাকে বোঝা হয়ে ওঠে নি। আমার। রুনু সম্বন্ধে আমি যেমন বলতে পারি, রুনুর একটু মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে। যখন সে মিথ্যা বলে, তখন সে মাথা নিচু করে অল্প অল্প হাসে। মন্টু সম্বন্ধে এমন কিছু বলতে পারছি না। আমি।
আপনি কি খুব ভেবেচিন্তে খুন করেছেন?
না, খুব ভাবি নি।
আমার মনে হয়, আপনি খুব অনুতপ্ত?
না।
তাঁকে খুন করার ইচ্ছে কি হঠাৎ আপনার মনে জেগেছে, না। আগে থেকেই ছিল?
হঠাৎ জেগেছে।
তিনি কোন ধরনের লোক ছিলেন?
ভালো লোক। বিদ্বান, অনেক জানতেন।
আপনাদের সঙ্গে তাঁর কী ধরনের সম্পর্ক ছিল?
ভালো। আমাদের খুব স্নেহ করতেন।
তাঁকে খুন করা কি খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল?
জানি না। আমার রাগ খুব বেশি।
হ্যাঁ, মন্টুর রাগ বেশি। ভয়ঙ্কর উন্মাদ রাগ। আমি জানি, এ সম্বন্ধে ভালো করেই জানি। দু বৎসর হয় নি এখনো। অনার্স পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছি, সময়ও মনে আছে, পৌষ মাস। দারুণ শীত। আমাদের সামনের বাসায় থাকতেন এক ওভারশীয়ার সাহেব। তাঁর মেয়ে এবং ছেলে সব মিলিয়েই এক জন, মীনা। বয়স আমার সমান কিংবা আমার চেয়ে দু-এক বৎসরের বড়ো। ওভারশীয়ার ভদ্রলোকের ভারি আদরের মেয়ে, সব সময় চোখে–চোখে রাখতেন। মেয়েটি বেশির ভাগ সময়ই কাটাত বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে। ওভারশীয়ার ভদ্রলোক এক দিন হাতে একটি চিঠি নিয়ে চড়াও হলেন আমাদের বাসায়। আমি বাইরেই বসে ছিলাম, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই চিঠি তুমি লিখেছ?
নামহীন একটি চিঠি তিনি আমার সামনে ফেলে দিলেন।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, কি বলছেন আপনি!
নিশ্চয়ই তুমি, এত বড়ো সাহস তোমার, এমন নোংরা কথা আমার মেয়েকে লিখেছি।
ভদ্রলোক গজাতে লাগলেন। আমি হতভম্ব এবং লজ্জিত। এমনিতেই আমি একটু লাজুক ধরনের ছেলে। এ ধরনের অভিযোগে একেবারে বোকা বনে গেলাম।
তুমি কি মনে করেছ, আমি ছেড়ে দেব? এ্যাঁ? ভদ্রলোকের মেয়েছেলের মান-ইজ্জত!
কথা শেষ হবার আগেই মন্টু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শান্ত গলায় বলল, যান। আপনি বাড়ি যান।
বললেই হল, যা ইচ্ছে তা লিখে বেড়াবে, আর আমি বসে বসে কলা চুষব?
মন্টু নিমিষের মধ্যে, আমার কিছু বোঝবার আগেই, ভদ্রলোকের কলার চেপে ধরল। হুঁঙ্কার দিয়ে বলল, চোপরাও ছোটলোক। মা বেরিয়ে এলেন। আশেপাশে লোক জমে গেল। আমি তটস্থ। মন্টু চেঁচাতে লাগল, দুনিয়াসুদ্ধ লোক জানে তোমার মেয়ের কারবার, আর তুমি এসেছ দাদার কাছে?
ওভারশীয়ার ভদ্রলোক বদলি হয়ে গেছেন রাজশাহী। মেয়েকে নিশ্চয়ই কোথাও বিয়ে দিয়েছেন। তিনি এখানে থাকলে মন্টুর উন্মাদ রাগের পরিণতি দেখে খুশি হতেন হয়তো।
মাস্টার কাকার বাড়ি থেকে লোক এল এক জন। দড়ি-পাকান চেহারা। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, ছুঁচাল দাড়ি। চোখে নিকেলের চশমা।
শরীফ আকন্দের ভাই আমি। বড়ো ভাই। তার জিনিসপত্র, টাকা-পয়সা যা আছে নিতে। এসেছি।
আমি বললাম, জিনিসপত্র বিশেষ নেই, তবে অনেক বই আছে।
টাকা পয়সা কী আন্দাজ আছে?
দু শ পনের টাকা ছিল।
মাত্র! তবে যে শুনলাম বহু টাকা। টাকার জন্যেই খুন করা হয়েছে।
লোকটি কুৎকুতে চোখে তাকাচ্ছিল। পান-চিবান ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে-পড়া লালা টেনে নিচ্ছিল মাঝে মাঝে। গলা খাকারি দিয়ে সে বলল, আপনারা যা বলবেন। এখন তো তাই সত্যি। তা সে টাকা কটাই দিন। আসতেই আমার পঁচিশ টাকা খরচ।
তাঁর সব কিছুই থানায়। আপনি সেখানেই যান।
কই?
থানায়।
অ।
ভদ্রলোক বিমর্ষ হয়ে চলে গেলেন। রুনু বলল, দাদা, ও কি সত্যি মাস্টার কাকার ভাই?
হুঁ।
কী করে বুলে?
এক রকম চেহারা।
মাস্টার কাকার চেহারা আমার মনে আছে। গত পরশু শেষ রাতে আমি তাঁকে স্বপ্নে দেখেছি। বড়োমাকেও দেখেছি। বড়োমা অবাক হয়ে বলছেন, তুই এই হলুদ রঙের শাড়ি আনলি আমার জন্যে, খোকা? এই শাড়ি পরার বয়স কি আছে রে বোকা?
বেতন পেয়ে সবার জন্যেই কিছু-না-কিছু কিনেছি। আপনি নেন এটা।
সবার জন্যেই কিনেছিস?
জ্বি।
কী কী কিনলি?
আমি নাম বলে চললাম। বড়োমা আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, সবার স্ট্রনৈা ২ কিিনলি, মাস্টারের জন্য কিনলি না? সে বাদ পড়ল বুঝি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, জানেন না, মাস্টার কাকা তো মারা গেছেন?
আহা, কী করে মারা গেল? বড়ো ভালো লোক ছিল।
বড়োমা মাস্টার কাকাকে খুব স্নেহের চোখে দেখতেন; প্রায়ই আলাপ করতেন তাঁর সাথে। মাস্টার কাকা বড়োমাকে বড়োবোনের মতো দেখতেন। আমার মাকে ভাবী বলে ডাকলেও বড়োমাকে ডাকতেন বড়োবুবু বলে। বড়োমা প্রায়ই বলতেন, ও মাস্টার, আমার ভাগ্যটা গুণে দিলে না?
বড়ো বুবু, আপনাদের সবার ভাগ্যই আমি গুণে রেখেছি।
ছাই গুণেছ। বল আমার ভাগ্য।
আপনার জন্মলগ্নে আছে মঙ্গল আর রবির প্রভাব। সৌভাগ্যবতী আপনি। ভাগ্যবান ছেলে হবে আপনার।
বড়োমা হো হো করে হেসে উঠতেন।
মাথার ঠিক নাই তোমার। এই তোমার ভাগ্য গণনা? এই সব বুঝি লেখা বইএ? পুড়িয়ে ফেল তোমার বই। না হয় আমাকে দিও, আমি আগুন করে তোমাকে চা বানিয়ে দেব।
কাকা বিমর্ষ হয়ে বই-এর পাতা ওন্টাতেন। এইখানেই তাঁর গণনা মিলত না। বাবা বড়োমার ছেলে হওয়ার কোনো আশা না দেখেই দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন।
আশ্চৰ্যভাবে কাকার গণনা মিলে গেল এক সময়। রুনুর জন্মের পাঁচ বৎসর আগেই বড়োমার কোলে এল মন্টু। বড় মা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন কাকার নির্ভুল গণনা দেখে। কাকাকে ডেকে বললেন, আমার ছেলের ভাগ্যটা একটু দেখি মাস্টার। আশ্চৰ্য, এসব শিখলে কী করে? আমার শিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
মাস্টার কাকা হেসে বলেছিলেন, এও এক ধরনের বিজ্ঞান বুবু। অন্ধকার বিজ্ঞান। আপনি যদি শিখতে চান…
বড়োমা অসহিষ্ণু হয়ে বলেছিলেন, আগে আমার ছেলের ভাগ্য বল। তারপর তোমার অন্ধকার বিজ্ঞান।
কাকা বললেন, জন্ম হয়েছে। মঘা নক্ষত্রযুক্ত সিংহ রাশিতে চন্দ্রের অবস্থানকালে। জন্মসময় আকাশে কুন্তলীন। জাতক শনির ক্ষেত্রে রবির হোরায় বুধের দ্রেক্কাণে শুক্রের সপ্তমাংশে…
আহা, কি আরোলতাবোল শুরু করলে, ফলাফলটা বল।
ছেলে বুদ্ধিমান,সাহসী, শক্তিমান আর প্রেমিক। সৌভাগ্যবান ছেলে আপনার। তাকে একটা গোমেন্দ পাথর দেবেন। বুকু, খুব কাজে লাগবে।
বড়োমা মন্টুকে এগারো বৎসরের রেখে মারা গেলেন। মন্টুর জন্যে গোমেদ পাথর আর নেওয়া হল না! সেই পাথর যদি থাকত, আরু বে কি এই বিপদ এড়াতে পারত মন্টু?
আদালতে কৌতূহলী মানুষের ভিড়। জজসাহেব মনে হল বিশেষ কিছু শুনছেন না। সিগারেটের ধোঁয়া, ঘামের গন্ধ, লোকজনের মৃদু কথাবার্তা–সব মিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ গুমোট গরম, যদিও মাথার উপর দুটি নড়বড়ে রং ওঠা। ফ্যান কা-ক্যা শব্দ করে ঘুরছে। কালো গাউন পরা উকিলরা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। মন্টু সরাসরি তাকিয়ে আছে সামনে। বাবা, আমি আর রুনু বসে আছি জড়সড় হয়ে। মন্টুকে দেখলাম মুখে হাত চাপা দিয়ে কয়েক বার কাশল।
আপনি বলছেন খুন করার ইচ্ছে হঠাৎ হয় নি, কিছুদিন থেকেই মনে ছিল?
হ্যাঁ।
কত দিন থেকে?
কত দিন থেকে আমার মনে নেই।
কিন্তু কী কারণে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার ইচ্ছে হল?
কারণ আমার মনে নেই!
আপনি অসুস্থ?
না, আমি সুস্থ।
ক্রস-একজামিনেশনের শুরুতেই বাবা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ তিনি শব্দ করে কেঁদে ফেললেন। সবাই তাকাল তাঁর দিকে। আদালতে মৃদু গুঞ্জন সরব হয়ে উঠল। জজ সাহেব বললেন, অর্ডার অর্ডার। তার কিছুক্ষণ পরই আদালত সেদিনের মতো মুলতবি হয়ে গেল। মা কাঁপা গলায় বললেন, বিচার শেষ হবে কবে খোকা?
চারদিকে বড়ো বেশি নির্জনতা। বড়ো বেশি নীরবতা। মন্টুর ঘরে বাবা একটা তালা লাগিয়েছেন। রুনুর বিছানায় রুনু এক-একা অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। বাতি জ্বালান থাকলে আগে ঘুমুতে পারত না সে। এখন সারা রাত বাতি জ্বলে। হ্যাঁরিকেনের আবছা আলোয় সমস্তই কেমন ভূতুড়ে দেখায়। ঘরের দেয়ালে আমার মাথার একটা প্রকাণ্ড কালো ছায়া পড়ে। মাঝে মাঝে বাবা গোঙানির মতো শব্দ করে কাঁদেন। রুনু আঁৎকে উঠে বলে, কী হয়েছে দাদা? আমি চুপ করে থাকি।
রুনু আবার বলে, দাদা, কী হয়েছে?
বাবা কাঁদছেন।
বাবা গোঙানির মতো শব্দ করে কাঁদেন। বারান্দায় কী অপরূপ জ্যোৎস্না হয়! হানুহেনার সুবাস ভেসে আসে। কুনু বলে, মরার পর কী হয় দাদা?
আমি উত্তর দিই না। মনে মনে বলি, কিছুই হয় না। সব শেষ। যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের-মানুষের হয়না কো দেখা-। অসংলগ্ন কত কথাই মনে ७ाटन!
দাদা, মন্টু ভাইয়ের কী হবে?
জানি না।
ঘরের দেয়ালের লম্বা ছায়াগুলির দিকে তাকিয়ে আমার বুক হুঁহু করে। নাহার ভাবী মৃদু ভলুমে গান শোনেন, বিধি ডাগর আখি যদি দিয়েছিল, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না। কান পেতে শুনি।
মাঝে মাঝে নাহার ভাবী আসেন আমার ঘরে। বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকেন। সেদিনও এসেছিলেন। আমি জানালা বন্ধ করে বসেছিলাম। বাইরে কী তুমুল বৃষ্টি! বিকেলের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে আগেভাগে। নাহার ভাবী রুনুর বিছানায় এসে বসলেন।
আমি পরশু চলে যাচ্ছি।
আমি চমকে বললাম, কোথায়?
প্রথমে বাবার কাছে যাব। সেখান থেকে বাইরেও যেতে পারি দাদার সঙ্গে, ও চিঠি লিখেছে। যেতে।
আমি চুপ করে রইলাম। নাহার ভাবী বললেন, আপনাদের কথা খুব মনে থাকবে আমার। আপনাদের সবাইকে আমার বড়ো ভালো লেগেছে। রাবেয়ার কথা খুব মনে হয় আমার।
নাহার ভাবী চোখ মুছলেন। রুনুচা নিয়ে এল দু কাপ। নাহার ভাবী চায়ে চুমুক দিয়ে ধরা-গলায় হঠাৎ করেই বললেন, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, মন্টু এমন কাজ কেন করল বলবেন? অনেকে অনেক কথা বলে। আমার খারাপ লাগে শুনে। আপনাদের আমি বড্ড ভালোবাসি।
মুম্বালাম, রাবেয়ার মৃত্যুর কারণটা তো আপনি জানেন ভাবী।
জানি।
কাকাই হয়তো দায়ী ছিলেন, মন্টু জেনেছিল। অবশ্যি মন্টু বলে নি কিছুই।
মন্টুর সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি সব সময় তার জন্যে দোওয়া করব। তাকে আমি ভালো করে দেখিও নি কোনো দিন।
ভাবী, মন্টু বড়ো চুপচাপ ছেলে।
আমার দোওয়ায় কিছু হবে না। তবু আমি তার জন্যে দোওয়া করব।
নাহার ভাবী মাথা নিচু করে বসে ছিলেন! আমার মনে হল, নাহার ভাবী আমাদের বড়ো আপন! বড়ো পরিচিত।
রাবেয়ার একটা ছবি দেবেন আমাকে?
ছবি?
জ্বি। আমি সঙ্গে নিয়ে যেতাম। ও খুশি হত দেখলে। রাবেয়াকে তার খুব ভালো লেগেছিল।
ওর তো কোনো ছবি নেই। আমাদের সবার শুধু একটা গ্রুপ ছবি আছে, মন্টুর জন্মের পর তোলা।
অ।
নাহার ভাবী চলে গেলেন। ট্রাঙ্ক খুলে ছবি বের করলাম আমি। পুরনো ছবি। হলুদ হয়ে গেছে। তবু কী জীবন্তই না মনে হচ্ছে! বাবেয়া হাসিমুখে বসে আছে মেঝেতে। রুনু বাবার কোলে। মন্টু চোখ বুজে বড়োমার কোলে শুয়ে। বুকে গভীর বেদনা অনুভব করছি। স্মৃতি-সে সুখেরই হোক, বেদনারই হোক–সব সময়ই করুণ।
সারা রাত ধরে বৃষ্টি হল। আষাঢ়ের আগমনী বৃষ্টি। বৃষ্টিতে সব যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। রুনু বলল, মনে আছে দাদা, এক রাতে এমনি বৃষ্টি হয়েছিল, তুমি একটা ভূতের গল্প বলেছিলে!
আমি কথা বললাম না। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে হ্যাঁরিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা হঠাৎ কবে বিকৃত গলায় ডাকলেন খোকা, ও খোকা!
কী বাবা?
আয়, তুই আমার কাছে আয়! মন্টুর জন্যে বুকটা বড়ো কাঁদে রে।
তিমিরময়ী দুঃখ। প্রগাঢ় বেদনার অন্ধকার আমাদের গ্রাস করছে। বাইরে গাছের পাতায় বাতাস লেগে হা হা হা হা শব্দ উঠল।
সতেরই আগষ্ট মন্টুর ফাঁসির হুকুম হল। মন্টু, যার জন্ম হয়েছিল মঘা নক্ষত্রযুক্ত সিংহ রাশিতে, রবির হোরায় বুধের দ্রেক্কাণে। কাকা বলেছিলেন, এ ছেলে হবে সাহসী, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও প্রেমিক।
মন্টুর জীবন ভিক্ষা চেয়ে আমরা মার্সি-পিটিশন করলাম। আমার মনে পড়ল ফাঁসির হুকুম হওয়ার আগের দিনটিতে রোগা, শ্যামলা একটি মেয়ে আমাদের বাসায় এসেছিল। তার মুখটা নিতান্তই সাদাসিধে, ছেলেমানুষী চাহনি। মেয়েটি রিক্সা থেকে নেমেই থাতমত খেয়ে বাসার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমায় দেখে ঢোক গিলল।
বললাম, কার খোঁজ করছেন?
মেয়েটি মাথা নিচু করে কী ভাবছিল। হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে বলল, আমার নাম ইয়াসমিন। আমি আপনার ভাইয়ের সাথে পড়ি।
মন্টুর সঙ্গে?
জ্বি।
আস, ভেতরে আস। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো না।
মেয়েটি হেসে বলল, আমি কত ছোট আপনার, তুমি করেই তো বলবেন।
বাবা, মা আর রুনু মন্টুকে দেখতে গিয়েছেন। আমি মেয়েটিকে আমার ঘরে এনে বসালাম।
বস।
এখানে কে শোয়?
আমি আর রুনু।
রুনু কোথায়?
মন্টুকে দেখতে গিয়েছে। বাবা আর মা-ও গিয়েছেন।
আরও আগে আসলে আমিও রুনুর সঙ্গে যেতে পারতাম, না?
তুমি যেতে চাও?
জ্বি না। ওর খারাপ লাগবে।
মেয়েটি চুপ করে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ঘর দেখতে লাগল।
আমি বললাম, চা খাবে?
জ্বি না।
কোথায় থাক তুমি?
উইখানে। মেয়েটি হয়তো বলতে চায় না। সে কোথায় থাকে। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। সে বলল, আমি সব জানতাম, অনেক ভেবেছি আসি। কিন্তু সাহস হয় নি।
এসে কী করতে? না, কী আর করতাম। তবু হঠাৎ ইচ্ছে হত। আমি আপনাদের সবাইকে চিনি। ও আমাকে বলেছে।
কী বলেছে?
মেয়েটি মুখ নিচু করে হাসল। বলল, আপনাদের একটা কুকুর ছিল, পলা।
হ্যাঁ, শুধু পলাতক হত, তাই তার নাম পলা।
আচ্ছা, ওর কী সাজা হবে?
বারো-তোরো বৎসরের সাজা হবে হয়তো।
ফাঁসি হবে না তো?
না। উকিল বলছেন কম বয়স, আর রাগের মাথায় খুন।
ওর বুঝি খুব রাগ?
তোমার কী মনে হয়?
মেয়েটি হাসল কথা শুনে। বলল, জানি না। আমি যাই।
আবার এস।
আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল আমার।
কেন?
ও আপনাকে খুব ভালোবাসত। আমার কাছে সব সময় বলত আপনার কথা।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, ও তো মিথ্যা বলে না।
মেয়েটি চলে গেল। মন্টু হয়তো আমাকে খুব শ্রদ্ধা করত। বড়ো চাপা ছেলে, বোঝবার উপায় নেই। তবে শ্রদ্ধা করত ঠিকই। না, শ্রদ্ধা নয়, ভালোবাসা বলা যেতে পারে।
মনে পড়ল এক দিন সন্ধ্যায়। রুনু এসে আমায় বলল, দাদা, মন্টু আজ বাসায় আসবে না, আমায় বলে দিয়েছে। সে কাঁঠালগাছে বসে আছে।
কেন রে?
ও শার্ট ছিঁড়ে ফেলেছে মারামারি করে। তাই আমায় বলেছে, তুমি যদি ওকে আনতে যাও, তবেই আসবে।
প্রবল ভালোবাসা না থাকলে সন্ধ্যাবেল বসে কেউ প্রতীক্ষ্ণ করে না।–কখন বড়ো ভাই এসে গাছ থেকে নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে।
মন্টুর চলে যাবার পরপরই বাবা মন্টুর ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। কত দিন আর হল মন্টু গিয়েছে, তবু মনে হয় অনেক দিন ধরেই এই ঘরে একটি মাস্টারলক ঝুলে আছে। একটু আগে যে-মেয়েটি এসেছিল, সে মন্টুর ঘর দেখতে চায় নি। কে জানে সে-ঘরের কোথাও হয়তো এই মেয়েটির লেখা দ-একটা চিঠি মলিন হয়ে পড়ে আছে। আমি মন্টুর ঘরের তালা খুলে ফেললাম। পশ্চিম দিকের জানালা খুলতেই এক চিলতে হলুদ রোদ এসে পড়ল ঘরে। পাশাপাশি দুটি চৌকি। কাকার জিনিসপত্র কিছু নেই। সমস্তই পুলিশ সিজ করে নিয়েছে। মন্টুর বিছানা, কভারছাড়া বালিশ, দড়িতে ঝোলান শার্ট-প্যান্ট সব তেমনি আছে। বাঁশের তৈরী ছাপড়ায় সুন্দর করে খবরের কাগজ সাঁটা। ঝুঁকে পড়ে তাকাতেই নজরে পড়ল টিপকলম দিয়ে লিখে রেখেছে দিন যায় দিন যায়। কী মনে করে লিখেছিল কে জানে!
সতের তারিখ মন্টুর ফাঁসির হুকুম হল। ঠাণ্ডা মাথায় খুন, অনেক আই উইটনেস। কলেজে পড়া বিবেক-বুদ্ধির ছেলে। জজ সাহেব অবলীলায় হুকুম করলেন।
সেপ্টেম্বরের নয় তারিখ মাসি-পিটিশন অগ্ৰাহ্য হল। আমি জানলাম আঠার তারিখ ভোর-রাতে তার ফাঁসি হবে। তার লাশ নিতে হলে সেই সময় জেলগেটের সামনে জেলারের চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
বাবা, মা আর রুনুকে নিয়ে মন্টুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
রোগা হয়ে গিয়েছে মন্টু। আমাদের দেখে অপ্রকৃতস্থের মতো হাসল। বলল, দাদা, মার্সি-পিটিশনটার কোনো জবাব এসেছে?
ওকে বুঝি সে-কথা জানান হয় নি? ভালোই হয়েছে। আমি বললাম, না রে, এখনো আসে নি।
মা, রুনু আর বাবা কাঁদছিলেন। মন্টু বলল, কাঁদেন কেন আপনারা? আমি জানি আমার ফাঁসি হবে না। কাল রাতে মাকে স্বপ্নে দেখেছি। মা বলছেন, খোকা ভয় পাস কেন? তোর ফাঁসি হবে না।
আমি বললাম, মন্টু, তোর কাছে একটি মেয়ে এসেছিল রোগী লম্বা মতো।
মন্টু বলল, ও ইয়াসমিন, আমার সঙ্গে পড়ে।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। মন্টু নীরবতা ভঙ্গ করে রুনুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, রুনু মিয়া মরতে ইচ্ছে হয় না।
বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তোকে কী খেতে দেয় রে?
ভালোই দেয় বাবা। আগে আজেবাজে দিত। কদিন ধরে রোজ জানতে চায়–আজি কী দিয়ে খেতে চান? এ জেলের জেলার খুব ভালো মানুষ বাবা, আমাকে শিবরামের একটা বই পাঠিয়েছেন, যা হাসির!
মা বললেন, মন্টু, বাসার কোনো জিনিস খেতে ইচ্ছে হয় তোর?
না মা, এখানে এরা বেশ রাঁধে।
সেপাই এসে বলল, অনেকক্ষণ হয়েছে তো, আরো কথা বলবেন?
বাবা বললেন, না। বাবা মন্টুর হাতে চুমু খেলেন কয়েক বার। মন্টু কাশল বার কয়। সে মনে হল একটু লজ্জা পাচ্ছে। বের হয়ে আসছি, হঠাৎ মন্টু ডাকল, দাদা, তুমি একটু থাক।
আমি ফিরে এসে মন্টুর হাত ধরলাম। মন্টু কিছু বলল না। আমি বললাম, কিছু বলবি?
না।
ইয়াসমিনের কথা কিছু বলবি?
না-না।
তবে?
মন্টু অল্প হাসল। বলল, তোমাদের আমি বড়ো ভালোবাসি দাদা।
গাছের নিচে ঘন অন্ধকার। কী গাছ এটা? বেশ ঝাঁকড়া। অসংখ্য পাখি বাসা বেঁধেছে। তাদের সাড়াশব্দ পাচ্ছি। পেছনের বিস্তীর্ণ মাঠে স্নান জ্যোৎস্নার আলো। কিছুক্ষণের ভিতরই চাঁদ ড়ুবে যাবে। জেলখানার সেন্ট্রি দু জন সিগারেট খাচ্ছে। দুটি আগুনের ফুলকি ওঠানামা করছে দেখতে পাচ্ছি। তাদের ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে ছায়া-ছায়া মূর্তি মনে হয়। জেলখানার মাথার গেটের ঠিক উপরে এক শ পাওয়ারের বাতি জ্বলছে একটা। বাতির চারপাশে অনেক পোকা ভিড় করেছে। বাবা বললেন, খোকা, কটা বাজে? বলতে বলতে বাবা বুকে হাত রাখলেন। তাঁর বুক-পকেটে জেলারের চিঠি রয়েছে। সেটি দেখালেই তারা মন্টুকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন। মন্টুকে আমরা ঘরে ফিরিয়ে নেব। ঘরে, যেখানে মা আজ সারারাত ধরে কোরান শরীফ পড়ছেন।
বাইরে স্নান জ্যোৎস্না হয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতরে চাঁদ ড়ুবে যাবে। আমি আর বাবা ঘোষাঘেষি করে বসে আছি সিমেন্টের ঠাণ্ডা বেঞ্চিতে। মাথার উপর ঝাঁকড়া অন্ধকার গাছ। বাবা নড়েচড়ে বসলেন। তাঁর দ্রুত শ্বাস নেওয়ার শব্দ পাচ্ছি। তিনি একটু আগেই জানতে চাচ্ছিলেন কটা বাজে।
আমরা সবাই মাঝে মাঝে এমনি ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে বাইরের জ্যোৎস্না দেখতাম। হামুহেনা গাছে কী ফুলই না ফুটিতা! আমাদের বাসার সামনে মাঠে একটা কাঁঠালগাছ আছে। সেখানে অসংখ্য জোনাকি জ্বলিত আর নিভত। জোনাকি ঝিকিমিকি জ্বালো আলো গান বাজিয়েছিলেন নাহার ভাবী।
আমাদের পলার নাকটা ছিল সিমেন্টের মেঝের মতোই ঠাণ্ডা। মন্টু বলেছিল, দাদা, কুকুরের নাক এত ঠাণ্ডা কেন?
মাস্টার কাকা বাইরে পসে বসে আকাশের তারা দেখতেন। বলতেন, খোকা, আমি তারা দেখে সময় বলতে পারি।
রাবেয়া এক দিন রাগ হয়ে বলেছিল মা আমি সবার বড়ো, কিন্তু কেউ ঈদের দিন আমাকে সালাম করে না।
আমি আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে আছি। আমার শীত করছে। বাবা ভারি গলায় ডাকলেন, খোকা, খোকা।
কি বাবা?
কটো বাজে রে? আমি বাবার হাত ধরলাম। কী শীতল হাত। বাবা থরথর করে কাঁপছেন। আমাদের মাথার উপরের ঝাঁকড়া গাছ থেকে আচমকা অসংখ্য কাক কা-কা ডেকে জেলখানার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ড়ুবে গেছে। কিন্তীৰ্ণ মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই
।।।সমাপ্ত।।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে