#ননদ
পর্ব-১+২+৩
লেখা- মিম
আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন আমি সবেমাত্র আঠারো তে পা দিয়েছি আর আমার স্বামী নাহিদের বয়স তেইশ। নাহিদ আমার বাবার বন্ধুর ছেলে ছিলো। আমাদের মাঝে প্রেম-টেম ছিলো না, সম্পূর্নটাই আমাদের মা-বাবার ইচ্ছাতেই হয়েছিলো। বিয়ের পর আমাকে শ্বশুড়বাড়ির দরজায় দাঁড় করিয়ে আমার শ্বাশুড়ি বরণ করছিলেন, সেসময় নাদিয়া আমার পাশে দাড়িয়ে আমার বিয়ের ওড়নার পুঁতি গুলো খুঁটেখুটে দেখছিলো। নাদিয়া আমার ননদ। তখন মেয়েটার বয়স ছিলো মাত্র সাত। আমার স্বামীর শুধু ঐ একটা বোনই ছিলো। আমাকে ঘরে বসানোর পর ও দৌঁড়ে আমার কোলে এসে বসে পড়ল আর জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “আমার ভাবী”। তখন খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই আমার কোলে বসে ওর এইআহ্লাদ করাটা আমার একটু অসহ্য লাগছিলো। কিন্তু করার কিছুই ছিলো না, কারণ আমি নতুন বউ। নাদিয়া সর্বক্ষন আমার সাথে থাকতে চাইতো। কিন্তু নাহিদ আমার সাথে থাকলে আমার শ্বাশুড়ি নাদিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। কারন আমার শ্বাশুড়ি বিষয়টা বুঝতেন যে আমরা সদ্য বিবাহিত দম্পতি আর আমাদের একান্তে সময় কাটানোটা দরকার। আমরা যেদিন হানিমুনে যাই সেদিনও নাদিয়া অনেক কান্নাকাটি করেছিলো আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য। নাদিয়া চাইতো প্রতিটা মূহূর্তই আমার সাথে থাকার জন্য।। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি যেভাবেই হোক ওকে সামলে নিতেন। শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি অসম্ভব ভালো ছিলেন। উনাদের নজরে আমি ছিলাম উনাদের বড় মেয়ে। শ্বশুড়বাড়িতে আমার কোন কষ্টই ছিলো না। শুধুমাত্র নাদিয়া ছাড়া। ওর আহ্লাদ, সর্বক্ষন আমার পেছনে ঘুরা, আমার ভাবি- আমার ভাবি করা এসব কেনো যেনো আমার অসহ্য লাগতো। অথচ সেখানে অসহ্য লাগার মত কিছুই নেই, তবুও লাগতো। বিয়ের আগে বান্ধবি, আত্মীয় সবার মুখে শুনতাম মাথাব্যাথার অপর নাম ননদ। হতে পারে ওদের কথা শুনে শুনে ননদ সম্পর্কে একটা খাররাপপ ধারনা হয়ে গিয়েছিলো তাই নাদিয়ার ভালো কথাও খারাপ লাগতো। বিয়ের ৪ মাস পর হঠাৎ একদদিন খবর আসে আমার শ্বশুড়ের গাড়িটা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। শ্বশুড় স্পটেই মারা গিয়েছেন আর শ্বাশুড়ি হসপিটালে আছেন। ছুটে গেলাম হসপিটালে। যাওয়ার পর উনাকে দেখে বুঝলাম উনিও বাঁচবেন না। আমার আব্বা- আম্মাও ছিলো সেখানে। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে আর নাদিয়াকে কাছে ডেকে নিলেন। আমার হাতে নাদিয়ার ছোট্ট হাতটা রেখে উনি বললেন, ” আমার নাদিয়াকে তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখে গেলাম।। আজকে থেকে তুমি ওর মা। আমার মেয়েটার তুমি আর নাহিদ ছাড়া আর কেউ নেই। যতকিছুই হোক না কেনো তুমি আমার নাদিয়ারর হাত ছাড়বে না। আমি যেভাবে ওকে আগলে রাখছি তুমিও ঠিক সেভাবেই রাখবা ওয়াদা। কর”। আমি ওয়াদা করব কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কেমন যেনো একটা দ্বিধায় ছিলাম। তখন আম্মা আমাকে ইশারা দিলো ওয়াদা করার জন্য। আমিও কোনো কিছু না বুঝেই ওয়াদা করলাম। এর আধা ঘন্টা পরই উনি মারা যান। উনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার আর নাদিয়ার হাত এভাবেই ধরে রেখেছিলেন। এক এক করে সবাই এসে লাশ দেখে যাচ্ছে আর যাওয়ার সময় আমাকে বলে যাচ্ছে ” তোমার শ্বাশুড়ি খুব যত্ন করে এই সংসার আর নাহিদ- নাদিয়াকে আগলে রেখেছিলো। এখন ঐ দায়িত্ব তোমার।” বিশেষ করে নাদিয়ার কথাটাই স বাই জোর দিয়ে বলছিলো। এমন একটা মানুষ বাদ পড়েনি যে নাদিয়ার কথা বলেনি। এমনকি আমার আব্বা- আম্মা-আপা সবাই ওর কথাই বললো। সারাদিন আমি কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছি। মানে এসব কিছু, এত বড় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বিশেষ করে নাদিয়ার মা হওয়ার জন্য তো একদমই না। সবাই বলতে গেলে আমাকে ধরে বেধে ওর মা বানিয়ে দিচ্ছিলো। মাত্র কয়েকঘনন্টার ব্যবধানে আমার জীবনের ধারা সম্পূর্নটাই বদলে গেলো। এরপরদিন থেকে শুরু হলো যুদ্ধ…..
(চলবে)
লেখা- মীম
#ননদ
পর্ব-২
পরদিন থেকে নাদিয়া আমার সাথে ফেভিকলের মতো আটকে গেলো।ও সর্বক্ষন আমার ওড়নার কোনার সাথে ওর আঙুল পেঁচিয়ে আমি যেখানে যেতাম ও সেখানে যেতো। ওর মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ও খুব ভয় পেতো। ওর এই ভয়ের জন্য শান্তিমতো গোসলও করতে পারতাম না। ওর জন্য দরজা খুলে গোসল করতে হতো। ওর গোসল খাওয়া ঘুম সব আমাকেই করতে হতো। সেদিনের পর থেকে ও আমাদের দুজনের মাঝে ঘুমাতো। ভেবেছিলাম ১০-১২দিন পর ও নরমাল হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা ছিল ভুল ধারনা। কিছুই বদলায়নি। খুব ভোরে সব রান্না শেষ করে নাদিয়াকে রেডি করিয়ে খাইয়ে স্কুলে নিয়ে যেতাম। ওর ক্লাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুলেই বসে থাকতে হতো। এরপর ওকে বাসায় এনে ওর গোসল খাওয়া শেষেঘুম পাড়ানো, ওর জন্য প্রতিদিন বিকালে নতুন নাস্তা বানানো, তারপর ওকে পড়ানো সবই করতাম। রাতে আবার ওর যন্ত্রনায় ঘুমাতে পারতাম না। উনারা মারা যাওয়ার পর থেকে নাদিয়া প্রতিদিন রাতে২-৩ করে চিৎকার করে উঠতো। এতো প্রেশারে আমি কখনো পড়িনি। একে তো নাদিয়া অন্যদিকে বাবার ব্যবসা সামলানোর ঝামেলায় নাহিদ একেবারেই আমাকে সময় দিতো না। সেই সকালে বের হতো অনেক রাতে ফেরত আসতো। আমার সাথে ঠিক করে কথাও বলতো না। সব মিলিয়ে নিজেকে কেমন যেনো পাগল পাগল মনে হচ্ছিলো। এরকম এক মাস যাওয়ার নাহিদকে বলেই ফেললাম,
-” নাহিদ আমি এভাবে আর পারছি না। এতো প্রেশারে আমি কখনো পড়িনি। কতদিন হয় তোমারর সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারি না। সবকিছু খুব অসহ্য লাগছে”।……….
(চলবে)
লেখা- মিম
#ননদ
পর্ব-৩
সেদিন নাহিদকে নাদিয়ার কথা কিছু বললাম না। শুধু আমাদের বিষয় নিয়েই কথা বললাম। আমার কথা শুনে নাহিদ বললো,
– ” সরি তানহা, আমি এতদিন তোমাকে একটুও খেয়াল করিনি তোমাকে সময় দেইনি। তুমি তো বুঝতেই পারছো আমার অবস্থাটা। হঠাৎ করেই এমন সিচুয়েশনে পড়ে যাবো কখনও কল্পনাও করিনি। যাই হোক এখন থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা করব তোমাকে সময় দেয়ার।”
সেদিনের পর থেকে নাহিদ প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতো। প্রতিদিন রাতে বাসায় ফিরে আমাকে নিয়ে ছাদে যেতো গল্প করতে। কিন্তুআমার যন্ত্রনার মাত্রা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেলো। কারণটা হলো আমাদের সাথে নাদিয়াও যেতো। হাজার চেষ্টা করেও ওকে ঘরে রেখে যেতে পারতাম না। তার উপর ওকে ঘরে রেখে যাওয়াটা নাহিদও অপছন্দ করতো। এক কথায় বলতে গেলে আমাদের জীবন থেকে প্রাইভেসি, রোমান্স সব উধাও হয়ে গিয়েছিলো নাদিয়ার জন্য। তবে অবশ্য এতে নাহিদের কোন আপত্তিই ছিলো না।। মাঝে মাঝে মনে হতো শ্বাশুড়ি তো মারা যাননি আমাকে উনি যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে দিয়ে গেছেন আর উপর থেকে বসে বসে বলছেন, ” নাও যুদ্ধ কর”। দিন দিন আমার রাগের মাত্রা বাড়তেই থাকলো। একদিন আম্মাকে ফোন দিয়ে সব কথা জানাই। আম্মা উল্টা আমাকেই শুনালেন। উনি বললেন, ” দেখ ওর মা তোর কাছে ওকে আমানত রেখে গেছে। বড় ভাইয়ের বউ আর মা একই। ওকে নিজের মেয়ে হিসেবে দেখতে শেখ। আর মাথা থেকে এসব বাজে কথা ঝেড়ে ফেল”। আম্মার সাথে সেদিন আমার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে নাদিয়াকে নিয়ে। এরপর ফোন দিলাম বান্ধবিকে আমার দুঃখগাঁথা শোনানোর জন্য। ও সব শুনে আমাকে বুদ্ধি দিলো নাদিয়াকে দূরে কোনো আত্মীয়ের বাসায় দিয়ে দিতে। আমি ওর বুদ্ধি শুনে মনে মনে একটু শান্তি পেলাম। সেদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন নাহিদ বাসায় আসবে আর কখন এই কথা ওকে বলবো। অবশেষে নাহিদ বাসায় আসলো। ও ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খেতে বসেছে। নাদিয়াও ওর সাথেই বসে ছিলো। আমি খাবার বেড়ে দিতে দিতে ওকে বললাম, ” নাহিদ আমরা নাদিয়াকে বড় খালার বাসায় পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? ও না হয় ওখানে থেকেই পড়াশুনা করবে”
নাহিদ আমার মুখের দিক হা করে তাকিয়েছিলো কিছুক্ষন। ওর তাকানো দেখে মনে হচ্ছে আমি ওর বোনকে খুন করবো বলেছি। এর মাঝে নাদিয়া টেবিল থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলছিলো, প্লিজ তুমি আমাকে পাঠিয়ে দিও না। আমি তোমার সাথেই থাকবো। আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারবো না”।
এতক্ষন তাকিয়ে থাকার পর এবার নাহিদ মুখ খুললো-
” এটা কি ধরনের একটা আবদার করলে তুমি? আমার বোনকে আমি আরেকজনের বাড়িতে কেনো দিবো? তুমি আমি কি মারা গিয়েছি?”
ও কখনোই আমার সাথে রাগ দেখিয়ে কথা বলেনি। সেদিন রাতে ও অনেক রাগ দেখিয়ে কথা বলতে লাগলো। ওকে আমি ঠান্ডা মাথায় অন্যভাবে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ওর রাগ মনে হয় বেড়েই চলছিলো। একটা পর্যায়ে ওর চেঁচামেচি দেখে আমারও খুব রাগ হয়। আমিও খুব জোরে চিৎকার করে বলে উঠি-
” তোমার বোন পুরাই একটা মাথাব্যাথা। আমি এই বাড়িতে আসছি পর থেকে ও আমাকে যন্ত্রনা দিয়েই যাচ্ছে। কথায় কথায় ওর আহ্লাদ, একেকদিন একেক খাবার খাবে, সর্বক্ষন আমার আঁচল ধরে ঘুরতেই থাকে, তোমার আমার প্রাইভেসি নষ্ট করে, ওর সবকিছুই বিরক্তিকর। রাতে ওর জন্য ঘুমাতে পর্যন্ত পারি না। আমি এত ঝামেলা পোহাতে পারবো না ব্যস। তুমি ওকে না পাঠালে আমি ওকে মেরেই ফেলবো।” মেরে ফেলবো কথাটা বলতে আমার দেরী হয়েছে কিন্তু নাহিদের আমাকে থাপ্পর মারতে দেরী হয়নি। নাদিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদছিলো আর আমাদের ঝগড়া দেখছিলো। থাপ্পর মারার পর ও আমাকে বললো-
” আমার মা তোমাকে বিশ্বাস করে নাদিয়াকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছে। আমি ওর বড় ভাই তবু আমাকে দায়িত্ব দেয়নি। আম্মু নিজে তোমাকে নাদিয়ার মায়ের স্থান দিয়ে গেছে আর সেই তুমি কিনা নাদিয়াকে যন্ত্রনা মনে করছো। আসলে আমার বোন যন্ত্রনা না আর যন্ত্রনা পাওয়ার মত কোন কাজ ও করেও নি। আসলে সমস্যা তোমার চিন্তা ধারায়। তুমি সম্পূর্নই অসুস্থ মস্তিষ্কের। এখানে সমস্যা তোমার হচ্ছে আমার বোনের না। তাই আমি মনে করি তোমারই চলে যাওয়া উচিত। আমি বাসায় ফিরে যেনো দেখি তুমি চলে গিয়েছো।” এই কথা বলে নাহিদ নাদিয়াকে কোলে নিয়ে বাহিরে চলে গেলো………..
(চলবে)