ধোয়ার-নেশা পর্ব (১৭+১৮)

0
1779

#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (১৭+১৮)

অনিকশা কথা শেষ করার আগেই ওর বা গালে ঠাস জরে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে অরিদ। চোখ,মুখ লাল হয়ে গিয়েছে ওর। অনিকশাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে চিৎকার করতে করতে বললো,

“” বাপের বাড়ি যাবি নাকি পালকের কাছে যাবি সেটা তোর ব্যাপার। দাড়া আমি তোকে হ্যাল্প করছি!””

অরিদ রুমের সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। একটা লাগেজ বিছানায় ফেলে তাতে আশেপাশে যা পাচ্ছে সব ঢুকানো শুরু করে দিয়েছে!

অনিকশা গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। অরিদকে দেখছে অপলকে। কে এটা? এটাই কি তার সেই ভোলাভালা স্বামী? যে কিনা রাগ দেখাতেও জানতোনা?

অনিকশা পালকের এমন রুপে এতোটাই বিস্মিত যে কেউ চড় মারলে তাকে কাঁদতে হবে এটাও ভুলে গিয়েছে। শুধু মনে মনে এটাই ভাবছে,এটা তার অরিদ হতে পারেনা। নিশ্চয় অরিদের রুপে অন্য কেউ,ভুত নয় তো???

অরিদ হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই লাগেজে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। আলমারী খুলে নিয়ে সেখান থেকে যা পারলো ব্যাগে রেখে ভরে ফেলছে। চেইন লাগাতে না পারায় ঠাস করে একটা লাথি মারলো লাগেজে।

লাগেজ বিছানা থেকে নিচে পড়ার শব্দে অনিকশার হুশ এসে গেছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করা পানি নিয়ে অরিদের কাছে যাচ্ছে!

আকাশটা মেঘেরা ছেয়ে আছে। বৃষ্টি নামার কোনো নামগন্ধ নেই,বাইরের বাতাসে শীতলতার ছোয়া আছে,যা একটু পরপর অন্ত্রীশাকে ছুয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির পরে তার এই আবহাওয়াটাও ভিষন পছন্দের।

“” তুমি এখনো ওখানে দাড়িয়ে আছো যে? তোমাকে না বললাম আমরা বেরোবো?””

অন্ত্রীশা,পালকের দিকে না তাকিয়েই বললো,

“” ইচ্ছে করছেনা। আপনার বেলকনিটা খুব সুন্দর। দক্ষিন সাইডে হওয়ায় বাতাসেরা সারাক্ষনি লুকোচুড়ি খেলে।””

পালক নিজের শার্টের বোতামটা লাগাতে লাগাতে অন্ত্রীশার পেছনে এসে দাড়িয়েছে,

“” ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। সবসময় নিজের ইচ্ছে কে গুরুত্ব দিতে নেই।””

অন্ত্রীশা পেছনে ঘুরতেই পালকের মুখোমুখি হয়ে গেছে,দুরত্বটাও খুব বেশি যে তা নয়,আবার খুব কাছেও না। মেঘ কালারের শার্টটাতে পালককে মেঘের রাজপুত্রের মতো লাগছে। মাত্রই কি গোসল করে এসেছে? মুখটা এতো পবিত্র লাগছে যে। যেন সে এক গোসলেই তার ভেতরের সবটা অপবিত্র ধুয়ে এসেছে। বাতাসের ঝাপটাই সুন্দর স্মেল ভেসে আসছে অন্ত্রীশার নাকে। পারফিউম মেখেছে কি? কিন্তু উনি তো পারফিউম লাইক করেননা,তবে কি এটা তার পুরুষত্বের অধিকারে থাকা বিশেষ আহবানের সুবাস??

হঠাৎই বাতাসের দমকা ছোয়াই অন্ত্রীশার পেছনে ছেড়ে দেওয়া চুলগুলো সামনে চলে এসেছে। অন্ত্রীশার মুখ পুরো ঢেকে গিয়েছে,অনেকটা ছোটবেলায় মজা করে চুল দিয়ে ভুত সাজার মতো দেখাচ্ছে অন্ত্রীশাকে।

পালকের ইচ্ছে হচ্ছে অন্ত্রীশার মুখটাকে চুলের আড়াল থেকে বের করে নিয়ে আসতে। অমন মিস্টি মুখের অধিকারী নারীর মুখ চুল দিয়ে কেন ঢেকে থাকবে? এই চুলগুলোও এতো কেন বেহায়া হয়? যখন তখন নানানভাবে ছুয়ে দেয়। পালকের ডান হাতটা অজান্তেই অন্ত্রীশার মুখের কাছে চলে যাচ্ছে। কিন্তু হাতটাকে সামলিয়ে নিয়েই পালক শব্দ করে হেসে উঠলো,,,

অন্ত্রীশা দুহাত দিয়ে নিজের চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে বললো,

“” আপনাকে বেশ উৎফুল্ল লাগছে। কারনটা কি?””

পালক ঠোটে হাসি রেখেই বা হাতের দুটো আংগুল দেখিয়ে বললো,

“”দুটো কারন!””
“” দুটো?””

পালক ডান হাত দিয়ে বা হাতের একটা আংগুল ভাজ করে নিয়ে বললো,

“” হুম।নাম্বার ওয়ান,অনিকশা আমার পত্রীকন্যা নয় তাই। নাম্বার টু,যেহেতু অনিকশা পত্রীকন্যা নই সেহেতু পত্রীকন্যা এখনো আমার।””
“” কিভাবে বুঝলেন পত্রীকন্যা এখনো আপনার? আপনাদের মধ্যে কিন্তু বিশাল গ্যাপ রয়েছে। এমনও তো হতে পারে,এতোদিনে ও বিয়ে করে,দুকন্যার বাপ সরি,মা হয়ে গিয়েছে।

অন্ত্রীশার কথায় পালক মুচকি হেসে নিয়ে ওর হাত চেপে ধরেছে। ওকে রুমের ভেতরে নিতে নিতে বললো,

“” এটা কখনোই সম্ভব না অন্ত্রীশা। আমার পত্রীকন্যা আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারেনা। আর দুকন্যা কিভাবে আসবে?””
“” এতো আস্থা?””

পালক খাটের উপরে রাখা একটা শপিং ব্যাগ থেকে একটা শাড়ী বের করে অন্ত্রীশা হাতে দিয়ে বললো,

“” আমার প্রাণ ও। প্রাণের বিশ্বাস না রাখলে কিভাবে হবে বলো? এখন এতো কথা বাদ দিয়ে যাও এটা পড়ে আসো। উই আর লেইট!””

অন্ত্রীশা হাতের সাদার মধ্যে লাল পাড়ের সিল্কের শাড়ী দেখতে পাচ্ছে। এ রকম শাড়ীগুলো হিন্দুরা বেশি পড়ে থাকে। অবশ্য তারও মাঝে মাঝে পড়তে অনেক শখ হতো। কিন্তু সত্যি সত্যি পড়বে এটা কখনো ভাবেনি।

“” আমি বাইরে ওয়েট করছি,ইউ হেভ অনলি ৩০ মিনিটস।””

পালক চলে যেতে নিলেই অন্ত্রীশা পেছন থেকে বললো,

“” অন্যের জন্য কেনা শাড়ীটা আমাকে পড়তে দিচ্ছেন? কাগজ কলমের বউ হিসেবে এটলিস্ট একটা শাড়ীতো গিফট পেতেই পারি!””

অন্ত্রীশার এমন কথায় পালক দরজার কাছটাতে এসে থমকে গিয়েছে৷ পেছনে চট করে ঘুরতেই অন্ত্রীশাকে ওয়াশরুমে ঢুকে যেতে দেখতে পেলো। ও কিভাবে জানলো এটা ওর জন্য কেনা হয়নি? আমি তো ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলিনি। হ্যা মানছি এটা আমি আমার পত্রীকন্যার জন্য কিনেছিলাম। মেয়েটার হাজারও শখের মধ্যে এটিও একটি। তার খুব শখ ছিলো পহেলা বৈশাখে এমন একটা সাদার মধ্যে লাল পাড়ের শাড়ী পড়ে খোপা করবে৷ খোপাতে ফুলও দিবে বলেছিলো,কিন্তু কি ফুল দিবে সেটা জানায়নি।

অনিকশার সাথে দেখা করার পর মনটা হালকা করতেই আতিশের বাসায় যাওয়া পালকের। ওখানে গিয়েই জানতে পারে আতিশের চাকরী হয়েছে। আর ও অফিসেই আছে। চাকরী পাওয়ার সাথে সাথে আন্টিকেও নিয়ে এসেছে। আন্টির সাথে বেশ কিছুক্ষন গল্পে গল্পে সময় কাটিয়ে উঠতেই আতিশের আগমন ঘটে। অনিকশার সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা আতিশকে জানাতে জানাতে রাত হয়ে এসেছিলো। এতো রাতে শপিংমলে গিয়ে শাড়ী কেনা অসম্ভব তাও আবার একটা অজানা মেয়ের জন্য। যার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু সে জানেনা। তার কোন কালার ভালো লাগে,কোন ডিজাইন ভালো লাগে,কি ধরনের শাড়ী পছন্দ করে,আদৌ শাড়ী পছন্দ করে নাকি তাও জানেনা। তাই এতো রিস্ক না নিয়েই পালক বাসায় চলে এসেছিলো। নিজে ড্রেস চেন্জ করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াড্রবটা মেলতেই এই শাড়ীটা চোখে পড়েছিলো। যার জন্য অনিকশানামক এক বিরহ থেকে বের হতে পেরেছে সে, তাকে এই শাড়ীটা পড়তে দিলে কি তার পত্রীকন্যা রাগ করবে? কখনোই না আমার পত্রীকন্যা এতো ছোট মনমানসিকতার হতেই পারেনা৷ সেরকম চিন্তাভাবনা করেই পালক অন্ত্রীশাকে এই শাড়ীটা দিয়েছিলো। তাই বলে এভাবে অপমান করে দিবে? ওকে শাড়ী কিনে দেওয়ার জন্য স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তুলে আনার কি খুব প্রয়োজন ছিলো??

পালক কিছুটা মন খারাপ করেই বাইরে অন্ত্রীশার জন্য ওয়েট করছিলো। কিন্তু ত্রিশ মিনিটের জায়গায় এক ঘন্টা হতে চলাতেও যখন অন্ত্রীশার কোনো সাড়া পাচ্ছেনা তখন কিছুটা বিরক্তের ছাপ পড়েছে পালকের মুখে। টিভিটা অফ করে দিয়ে নিজের রুমের দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে উত্তর এসেছে,,

“” পরপুরুষের মতো অভিনয় না করলেও হবে। ভেতরে আসুন।””

অন্ত্রীশার এমন তিক্ত কথায় পালক কিছুটা থতমত খেয়েই ভেতরে ঢুকে হা হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

অন্ত্রীশা ব্লাউজ বিহিন শাড়ীটাকে পেচিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চুলগুলো এলোমেলোভাবে পেচিয়ে খোপা করে রাখায় কাধ আর গলার দিকটা বেশি নগ্ন লাগছে। আচ্ছা শুধু জামাকাপড়বিহীন হলেই মানুষকে নগ্ন বলা হয় নাকি বিশেষ বিশেষ জায়গায় কাপড় না থাকলেও নগ্ন বলা যায়??

অন্ত্রীশার এমন রুপ দেখে মনে হচ্ছে তার সামনে বসে রয়েছে সাদা আগুনের দেবী। যার দিকে তাকালেই সে ভস্ব হয়ে যাবে। সাদা আর লাল ভস্ব!

পালক অন্ত্রীশার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও পারছেনা। মনে হচ্ছে সাদা আগুনের দেবী তার আগুনী যাদুতে তার চোর দুটোকে স্থির করে ফেলেছে। সে চাইলেও চোখের পাতা ফেলতে পারবেনা। চাইলেও চোখ সরিয়ে নিতে পারবেনা।

“” আপনি কি অমন হা করে দাড়িয়ে থাকার জন্য এসেছেন?””
“” হুম!””
“” কি?””
“” না মানে,আপনি এখনো রেডি হোননি কেন?””

অন্ত্রীশা যেন পালকের এই প্রশ্নের জন্যই এতক্ষন গালে হাত দিয়ে ওয়েট করছিলো। পালক যত দ্রুত সে তার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে তার থেকেও দ্বিগুন গতিতে তার দিকে তেড়ে এসে বললো,,,

“” আপনি যা দিয়েছেন তা দিয়ে তো রেডি হয়েছি,চলেন যাওয়া যাক।””

পালক চোখ দুটো চোখ বড় বড় করে বললো,

“” এভাবে?””
“” হুম, চলুন।””
“” আপনি কি সবাইকে ভস্ব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?””

অন্ত্রীশা ভ্রু কুচকে বললো,

“” মানে?””
“” আপনি আর কিছু পড়বেননা?””
“” আপনি কি আর কিছু দিয়েছেন?””
“” আমি দেইনি বলে পড়বেননা?””

অন্ত্রীশা উল্টোদিকে ঘুরে হাতদুটো একটা আরেকটার উপর রেখে পেট ও বুকের মাঝখানে ভাজ করে নিয়ে বললো,

“” না।””
পালক অন্ত্রীশার পিঠের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

“” একটা মেয়ের কতগুলো জায়গা নগ্ন হতে পারে?””
“” গুনে দেখতে চান?””

অন্ত্রীশার আকস্মিক কথায় পালকের গলা শুকিয়ে এসেছে। চোখের কাজটা ঠিকমতো করতে গিয়ে কি মুখের কাজটা ভুল করে ফেলেছি? নাহলে মনে মনে কথা ও কি করে শুনলো???

“” অন্ত্রীশা,আসলে হয়েছে কি আমিতো এতোকিছু ভেবে শাড়ী কিনিনি তাই আর…..”””
“” ব্লাউজ কেনা হয়নি তাইতো? কেন আপনার কি মনে হয়নি উইথআউট ব্লাউজ শাড়ী কিভাবে পড়বে?””
“” কি করে কিনবো,আমি তো পত্রীকন্যার….””
“” পত্রীকন্যার কি?””

পালকের আরো বেশি গলা শুকিয়ে এসেছে,তার পানি খাওয়া বড্ড প্রয়োজন। এভাবে আর কিছুক্ষন অন্ত্রীশার সামনে থাকলে সে সত্যি সত্যিই ভস্ব হয়ে যাবে।

“” কিছুনা। আচ্ছা আপনি অন্যকিছু পড়ে নিন। আপনার শাড়ী পড়া লাগবেনা।””

পালকের এ কথায় অন্ত্রীশা তেলেবেগুনে জ্বলে যাচ্ছে। পালকের একদম কাছটাতে এসে বললো,

“” কেন পড়বোনা? অবশ্যই পড়বো,এই শাড়ীটাই পড়বো,এইভাবেই পড়বো,আর আপনার সাথে বাইরেও যাবো।””

পালক চোখ বুঝে কিছুটা পেছনের দিকে ঝুকে আল্লাহ আল্লাহ ঝপতেছে৷ সে কি করে এভাবে ওকে বাইরে যেতে দিবে? সামান্য রেগে যাওয়ার ফলেই যে শাড়ীটা খুলে যাওয়ার উপক্রম সে শাড়ী পড়ে বাইরে যাওয়া অসম্ভব!

“” কি পাগলামী করছো অরিদ? কি হয়েছে বলবে তো?””

অরিদ ছলছল নয়নে অনিকশার দিকে তাকিয়ে বললো,

“” তুমি চেয়েছিলেনা আমি তোমাকে মুক্তি করে দেই? তাই করছি। তোমাকে আজ মুক্তো করে দিবো আমি,তুমি একদম মুক্তো!””

অনিকশা অরিদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“” এমন করে বলছো কেন? আমার খুব ভয় হচ্ছে। তোমাকে দেখে আমার খুব ভয় লাগছে,অরিদ! আর কিসের মুক্তির কথা বলছো? আমি কোনো মুক্তি চাইনা,আমিতো আমার অরিদের খাচায় বন্দী হতে চাই।””

অরিদ একটানে অনিকশাকে সরিয়ে নিয়ে বললো,

“”তুমি কি চাও না চাও সব আমি জানি,তোমার থেকে ভালো করে জানি। আমাকে কাছে টেনে না নেওয়াতেও এতোটা কষ্ট ছিলোনা যতটা লুকিয়ে তুমি অন্যকারো বুকে পড়েছিলে।””
“” অন্যকারো বুকে মানে?””

অরিদ অনিকশার দিকে এগিয়ে ধমকাতে ধমকাতে বললো,

“”তুমি মানা করতে পারবে,পালক তোমাকে জড়িয়ে নেইনি?””
“” পালক!””
“” হ্যা! হ্যা!! হ্যা!!! পালক। তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড,সরি এক্স কেন হবে? প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার!””

অরিদ কথা শেষ করতেই অনিকশা ওর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,

“” তোমার কাছে আমি এটা কখনো আশা করিনি অরিদ,কখনোনা। এতোবছর তোমাকে আমি আমার হৃদয়ের সর্বোচ্চ জায়গায় যে সম্মান দিয়ে বসিয়েছিলাম আজ তুমি একটা আঘাতে শেষ করে দিলে। তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিলো,কিন্তু এখন মনে হয়না আর কিছু বলা প্রয়োজন!””

অনিকশা চোখের পানি মুছতে মুছতে দরজা মেলে বেড়িয়ে গেলো। কষ্ট হচ্ছে তার খুব কষ্ট। যে ছেলেটা একফোটা ভালোবাসা না পেয়ে,এতো অবহেলার মধ্যেও এত ভালোবাসা দিতে পেরেছে,সে কিনা ছোট্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে এমনটা করতে পারলো? একবার কি তার আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ হয়নি???

অনিকশা চলে যেতেই অরিদ হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। ঘরের সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে সে।

“” দুলাভাই,ঘরের এ অবস্থা কেন? আপনাকে এমন পাগল পাগল লাগছে কেন? আপু কোথায়? আমরাতো আপনাদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেরাই সারপ্রাইজ হয়ে যাচ্ছি। কি ঘটেছে এখানে? কিছু বলছেননা কেন??””

অন্ত্রীশা নিজের হাতের কেকটা খাটের উপর রেখে দিয়েছে। আজ অনিকশা আর অরিদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী। পালক তাকে এখানেই নিয়ে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। শুধু বিবাহ বার্ষিকির উইশ করার জন্যও পালক আসেনি। তার আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। যে সম্পর্কটা তার আর অনিকশার একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য নড়বড়ে হয়ে আছে তা ঠিক করার জন্য। এই এক বছরে সে অনিকশাকে যতটুকু বুঝেছে তাতে এটা স্পষ্ট এতোদিনেও সে অরিদের কাছে কিছুই বলেনি। আর এই না বলার ব্যর্থতার জন্যই হয়তো তারা এতোটা কাছাকাছি থেকেও অনেকটা দুরে। এই দুরত্বটাকে সরিয়ে দিয়ে ওদের দুজনকে মিশিয়ে দেওয়াই মেইন উদ্দেশ্য পালকের। সেটা কোনো বিশেষ দিনে হলে মন্দ হয়না তাই পালক আজকেই এসেছে,অরিদের সাথে কথা বলবে বলে।

অন্ত্র্রীশা অরিদের দিকে এগুতেই ও বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেছে। চোখের তীক্নদৃষ্টি পালকের দিকে।

অন্ত্রীশা অরিদের দিকে হাত বাড়াতেই ওকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে পালকের দিকে ঝাপিয়ে পড়ে। অরিদের এমন হঠাৎ আক্রমনে তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতেই উল্টিয়ে পড়ে গিয়েছে পালক। সাথে অরিদও।

অন্ত্রীশা ভয়ে দৌড়ে এসে অরিদের হাত থেকে পালককে ছুটানোর চেষ্টা করছে,,

“” কি করছেন,দুলাভাই? পালককে কেন মারছেন? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ছাড়ুন! ব্যথা পাবেন তো!””

পালক নিজেকে সামলে নিয়ে অন্ত্রীশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,,

“” অন্ত্রীশা তুমি ব্যথা পাবে সরে যাও। অরিদ ভাইয়ার এখন মাথা ঠিক নেই।””

অন্ত্রীশা পালকের কথা অগ্রাহ্য করেই অরিদের হাত ধরে টানতে থাকে। অরিদের দুটো হাতই পালকের গলা টিপে ধরে আছে।

পালক আবার চিৎকার করে বললো,

“” উনার পাগলামীর কারন হয়তো আমি বুঝতে পারছি,অন্ত্রীশা! উনাকে আমি সামলিয়ে নিচ্ছি। তুমি অনিকশাকে খুজো। দেরি হলে অনেক বড় কিছু ঘটে যেতে পারে। আমার কথাটা শুনো,প্লিজ অন্ত্রীশা!””

অন্ত্রীশা অরিদের কাছ থেকে সরে দরজার কাছে এগিয়ে আবার ওদের দুজনের দিকে তাকাতেই পালক চোখের ইশারায় বললো,

“” যাও!””

অন্ত্রীশা সেখানে আর এক মুহুর্তও দাড়ায়নি। পুরো ফ্লাটে অনিকশাকে খুজা শুরু করে দিয়েছে। কোথাও না পেয়ে ছাদের দিকে পা বাড়িয়েছে।

অরিদ রাগে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলেছে,চোখ,মুখ,নাক,গাল সব লালরং ধারন করে ফোলে উঠেছে। পালক অনেক কষ্টে নিজের গলা থেকে অরিদের একট হাত সরালেও সে থমকে যায়নি। ডান হাতটা মুঠো করে পালকের মুখের দিকে আনতেই পালক নিজের হাত দিয়ে আটকে বললো,

“” সেদিন যে কারনে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আজ সেই একি কারনে আমার গলা টিপে ধরেছেন,তাইনা বড় ভাই???””

চলবে
#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (১৮)

অরিদ রাগে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলেছে,চোখ,মুখ,নাক,গাল সব লালরং ধারন করে ফোলে উঠেছে। পালক অনেক কষ্টে নিজের গলা থেকে অরিদের একট হাত সরালেও সে থমকে যায়নি। ডান হাতটা মুঠো করে পালকের মুখের দিকে আনতেই পালক নিজের হাত দিয়ে আটকে বললো,

“” সেদিন যে কারনে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আজ সেই একি কারনে আমার গলা টিপে ধরেছেন,তাইনা বড় ভাই???””

পালকের প্রশ্নে অরিদের শক্ত হাতটা নরম হয়ে এসেছে,বন্ধ চোখ খুলে গিয়ে পালকের চোখের দিকে চেয়ে আছে। তবে এই চাওয়ার মধ্যে কোনো রাগ নেই রয়েছে অবাকতার ছোয়া।

অরিদের এমন নরম হয়ে আসায় কিছুটা খুশির রেখা ফুটে এসেছে পালকের মুখে। অরিদের হাত ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর উপর, ঠিক বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে পালক। কিছুটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে অভিমানের সুরে বললো,,,

“” বড় ভাই ছোট ভাইকে মারতেই পারে,এতে আমার কোনো রাগ,ক্ষোভ কিছু নেই। কিন্তু ভুল বুঝে মারাটা কি ঠিক?””

পালককে ছাড়ানোর চেষ্টায় অরিদ বলে উঠলো,

“” পালক ছাড়ো আমাকে,আমি কারো বড় ভাইনা।””
“” যাব্বাবাহ! ওইদিন তো আপনিই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,আজ থেকে আপনি আমার বড় ভাই। আর আজ যখন আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে মেনে নিলাম আপনি আমার বড় ভাই,অমনিই আপনি রং পাল্টে নিলেন?””
“” পালক,আমি সরতে বলছি। আমার কিন্তু প্রচন্ড…””
“” আপনি জানতেন আমার আর অনিকশার মধ্যে রিলেশন চলছিলো,তাও কেন ওকে বিয়ে করেছিলেন? খুব ভালোবাসতেন তাইনা? ভালোবাসার মানুষটিকে সারাজীবনের জন্য নিজের খাচায় বন্দী করতে চেয়েছিলেন? কি ভেবেছিলেন,আজ যদি আপনি ওকে ফিরিয়ে দেন তাহলে হয়তো আপনি ওকে আর কোনোদিনও নিজের করে পাবেননা? ভয় পেয়েছিলেন সেদিন,খুব ভয় পেয়েছিলেন তাইনা বড় ভাই?””

অরিদ পালককে নিজের থেকে সরিয়ে নিয়ে উঠে বসে পড়েছে। পালকের দিকে রাগরাগ চেহারা নিয়ে বললো,

“” না,এসব কিছুনা। আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও। এখনি যাবে,নাহলে আমি তোমাকে কি করবো আমি নিজেও জানিনা।””

পালক অরিদের কাছেই পাদুটো ভাজ করে আরাম করে মেঝেতে বসে নিয়ে বললো,

“” যে ছেলেটা তিন বছর ধরে একটা মেয়েকে দেখার জন্য গেইটের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে পারে সে ছেলেটা যে ঐ মেয়ের চলনগতি জানেনা এটা কি অসম্ভব কিছু নয়?””

পালকের কথায় অরিদ ওর দিকে অনুনয় নিয়ে তাকাতেই পালক হেসে উঠে বললো,,,

“” আমি জানি আপনি আমাকে মারবেন কি আমাকে ধমক দিয়ে কথাও বলতে পারবেননা। আপনার ভেতরে কঠিনতা নেই,রয়েছে শুধু নরমতা। নাহলে এভাবে এতো বছর অনিকশাকে নিয়ে আপনি কিছুতেই থাকতে পারতেননা।””
“” কে বলেছে নাই,অবশ্যই আছে। নাহলে ওর গালে আমি কি করে আমার হাতের দাগ বসালাম? বাসা থেকে বের করলাম? মুক্তি দিয়ে দিয়েছি আমি ওকে।””

অরিদ ফুপিয়ে কাঁদছে।

“” এতো ভালোবাসেন অথচ ছোট্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে এতো বড় কাহিনী করে ফেললেন? আমার সাথে ঘটা একটা ভুল নিয়ে মেয়েটা এতো কষ্ট নিয়ে এতোটা দিন পার করেছে। আর আজ যখন আমি সেই ভুল থেকে ওকে মুক্তি দিলাম তখনি আপনি আরেকটি ভুলের সূত্র নিয়ে ওকে কষ্ট দিচ্ছেন?””
“” ভুল?””
“” হুম,ভুল। আজকে আপনাকে দুটো ভুলের গল্প শুনাবো। তার আগে চোখের পানি মুছেন,একে তো ছেলে মানুষ তার উপর ছোট ভাইয়ের সামনে কাঁদছেন,আমার খুব লজ্জা লাগছে!””

অন্ত্রীশা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই বুকটা ধক করে উঠেছে। পুরো ছাদটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আশেপাশে তেমন লাইট না থাকায় ছাদে আলোর রশ্মিও পড়েনি,তার উপর আকাশে মেঘের ঘনঘটার ফলে তারা এবং চাঁদের ও কোনো দেখা নাই। আপু এখানে আছে তো? নাকি আবার বাইরে বের হয়ে গেছে। মন তো বলছে এখানেই আছে! অন্ধকারের মধ্যেই অন্ত্রীশা ধীর পায়ে এগিয়ে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু চারপাশটা কোথায়ও না পেয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কারো ফুপানির আওয়াজ কানে আসলো। অন্ত্রীশা চুপ করে দাড়িয়ে কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা করছে কোথা থেকে আসছে শব্দটা। বেশ কয়েক সেকেন্ড যেতেই ছাদের উত্তর দিকে পা বাড়িয়েছে সে। মনে হচ্ছে ঐদিক থেকেই শব্দটা আসছে। কিছুদুর যেতেই শব্দটা স্পষ্ট হয়ে আসে অন্ত্রীশার কানে। সাথে সাথে দৌড়ে সামনে এগুতেই অন্ধকারে একটা কালো ছায়া দেখতে পাচ্ছে। এই কালো অন্ধকারেও এবার অন্ত্রীশা নিজের বোনকে চিনতে পারছে। হাটুর উপর মুখ লুকিয়ে কাঁদছে অনিকশা!

অন্ত্রীশা অনিকশার পাশে বসেই ডাক দিলো,,

“” আপু!””

অন্ত্রীশা কন্ঠ পেয়েই অনিকশা ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,,

“” আমাকে তোর সাথে নিয়ে যা বোন,আমি আর এখানে থাকবোনা।””
“” আচ্ছা নিয়ে যাবো,কিন্তু কি হয়েছে সেটাতো আগে জানি। আর এভাবে কাঁদছো কেন? তোমার কান্না দেখেতো আমারও কান্না পাচ্ছে।””

অনিকশার মাথাটা তুলে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,,

“” অরিদ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করেছো?””
“” একটা থাপ্পড় খাবি,তোর কি মনে হয় আমি শুধু ওর সাথে ঝগড়া করি?””
“” তুমি করোনি? তাহলে কে করেছে?””
“” কে করেছে মানে? আমি ছাড়া ওখানে আরতো একজনই ছিলো। ওই করেছে।””
“” কে দুলাভাই?””
“” ওটা তোর দুলাভাই না।””

অন্ত্রীশা কপাল কুচকে বললো,,

“” দুলাভাই না মানে?””
“” মানে ওটা তোর দুলাভাই না। অন্য কেউ। তোর দুলাভাই আমার সাথে কখনোই ঝগড়া করতে পারেনা। আর এই টাতো আমাকে মেরেছে। দেখ আমার গালটা ফুলে গেছে।””

অন্ধকারে অন্ত্রীশা কিছুই দেখতে পারছেনা। তবুও মন খারাপ করে বললো,

“” কিন্তু কেন মারলো? পুরোটা খুলে বলো। নাহলে বুঝবো কিভাবে?””
“” আমার মনে হয় আজ সকালে পালক যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো তা অরিদ দেখে ফেলেছে।””

অন্ত্রীশার মন খারাপ মুছে গিয়ে মুখটা শক্ত করে বললো,

“” পালক তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে মানে?””
“” উফ! পুরোটা না শুনে রেগে যাচ্ছিস কেন,অনতি? চুপ করে শোন।””

অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে অনিকশা বলতে শুরু করেছে,,,

“” আজ সকালে পালককে আমি যখন সব খুলে বললাম,তখনি ও খুব কাঁদছিলো। ওর কান্না দেখে আমার অনেক মায়া হচ্ছিলো রে অনতি। আমি ওকে শান্ত্বনা দিয়ে যখন চলে আসবো তখনি ও আমার হাতটা আকড়ে ধরে,হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে বললো,,অনিকশা দোষ তোমার ছিলোনা,সবটায় ভুল বুঝাবুঝির মধ্যে ছিলো। আর এই ভুল বুঝাবুঝিটা আমার দ্বারায় শুরু হয়েছে। সেদিন যদি আমি ভুল করে তোমাকে পত্রীকন্যা না ভাবতাম,তোমাকে প্রপোস না করতাম তাহলে আজ এতোকিছু হতোনা। তুমি তো না বুঝেই আবেগের বসে সব করেছিলে। কিন্তু আমি? আমি শুধু তোমাকেই না পত্রীকন্যাকেও কষ্ট দিয়েছি। ওর বিশ্বাসটাও ভেঙে ফেলেছি। আমার ভালোবাসার উপর ওর পুরোপুরি বিশ্বাস ছিলো। হয়তো সেদিন আমি তোমাকে প্রপোস না করলে আজ সবকিছুই অন্যরকম হতো। এমনও হতে পারতো আমার জায়গায় তুমি অরিদের সাথে প্রেম করছিলে আর তারপর বিয়ে।

যা হয়েছে সব ভুলে যেও। ক্ষমা তোমাকে না তোমার আমাকে করা উচিত। আমার জন্যই এসব কিছু হয়েছে! সরি অনিকশা! আই এম রেলি সরি!!””
“” এসব পালক বলেছে?””
“” হুম।”
“” কিন্তু তোদের এই ক্ষমাক্ষমির মধ্যে অরিদ ভাইয়া কি করে এলো? উনি কিভাবে জানলো তোরা তখন জড়াজড়ি করছিলি?””

অন্ত্রীশার কথায় অনিকশা কিছু বলতে চাইলেও তার আগে অরিদ বলে উঠলো,,,

“” অনতি জড়াজড়ি আবার কি কথা? শুনতে বিচ্ছিরি লাগছে।””

অরিদের কন্ঠ পেয়ে অনিকশার চোখ আবার ভিজে এসেছে। বসা থেকে উঠে চলে যেতে নিলেই অন্ত্রীশা আবার টেনে বসিয়ে দিলো।

“” সেটা আপনাকে না শুনলেও হবে তার আগে বলেন আপনি কিভাবে জানলেন?””
“” আমি তো ওখানে একটা সারপ্রাই পার্টির আয়োজন করতে গিয়েছিলাম,আমার আর অনিকশার বিবাহ বার্ষিকীর উপলক্ষে। ভেতরে ঢুকতেই দেখি পালক ওকে জড়িয়ে ধরে আছে।””

অন্ত্রীশা অনিকশার পাশ থেকে সরে এসে অরিদকে বললো,,,

“” আমি আপনাকে সরল মানুষ ভেবেছিলাম,কিন্তু আপনি তো জটিল মানুষ। সহজ জিনিসকে এতো বড় জটিল করে দিয়েছেন? আপনার জন্য আমাদের সারপ্রাইজটাও মিস।””
“” সরি,শালিকা।””
“” আপনার সরি আপনিই খান।””

অন্ত্রীশা অনিকশার হাত ধরে বললো,,

“” আপু তুই আমার সাথে আয়। এমন জটিল মানুষ কখনোই আমার দুলাভাই হতে পারেনা।””

অনিকশাও অন্ত্রীশার কথায় তাল মিলিয়ে উঠে চলে যেতে নিলে অরিদ বললো,,,

“” তুমি আর এক পা ও যদি বাড়িয়েছো,অনি। তাহলে আমি সত্যি সত্যি এই ছাদ থেকে লাফ দিবো। উফ! আমি আর এসব নিতে পারছিনা। আমার একটু শান্তি চাই।””

অনিকশা থমকে যেতেই পালক অন্ত্রীশার হাত থেকে অনিকশাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। অন্ত্রীশার কানে কানে বললো,,,

“” ওদেরকে ছেড়ে দাও। ওরা ওদের মতো করে নিজেদের গুছিয়ে নেক! আমরা নাহয় আমাদেরটা নিয়ে ভাবি??””

পালকের কথায় অন্ত্রীশা হা করে ওর দিকে তাকাতেই পালক আবার বললো,,

“” আমি বাসায় যাওয়ার কথা বলছি। কত রাত হয়েছে দেখেছো? আমার খুব ঘুম পাচ্ছে!””

পালকরা চলে যেতেই অরিদ দুহাত দিয়ে দুকান ধরে বললো,,

“” সরি অনি। তোমার বুঝি খুব লেগেছিলো??””

অনিকশার চোখ আবার ভিজে এসেছে তবে কষ্টে নয়,সুখে। এই তো এটাই তো তার অরিদ। যে শুধু ভালোবাসতে জানে,কষ্ট দিতে নয়। তার ভোলাভালা স্বামী,নরম মনের মানুষ,নরম সুরের পাগল মানুষ! এই মানুষটাকে সে আর কষ্ট দিবেনা। কখনোও না। শুধু ভালোবাসা দিবো। ভালোবাসা আর ভালোবাসা!

অনিকশা অরিদকে জড়িয়ে ধরে বললো,,,

“” হুম,খুব পচা তুমি। আমাকে একদিনেই এতোগুলা কষ্ট দিছো!””

অরিদ অনিকশাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,,

“” আজ সব কষ্ট মুছে দিয়ে ভালোবাসায় মেখে দিবো তোমায়! মাখবেতো আমার ভালোবাসার রেনুতে???””

অনিকশা লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললো,,

“” হুম!””

আতিশ দুঘন্টাযাবত পালকদের বাড়ির পেছন সাইটে দাড়িয়ে আছে। চোখদুটো তাক করা পাপড়ির রুমের বেলকনিটায়। আজ চারদিন হতে চললো সে পাপড়িকে দেখেনা। ওকে দেখার জন্য বুকটা হাসফাস করছে আতিশের। কিন্তু বাড়ীর ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেনা। কোনো কারন ছাড়া সে কেন যাবে? তাই ভেবে পাচ্ছেনা। অথচ এতোদিন যখন তখন ঐ বাসায় ঢুকতেও কোনো প্রকার সংকোচবোধ হয়নি। তাহলে আজ কেন হচ্ছে?? এতো ভয়ই বা কেন পাচ্ছে সে? এখন পালককে তার কাছে বন্ধুর জায়গায় পাপড়ির ভাই হিসেবে মাথায় ঢুকে বেশি। ওকে দেখলেই বুকের ভেতরটা ভয় জায়গা করে নেয়। একেই হয়তো বলে ভালোবাসার ভয়!

দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আতিশের পা ব্যথা হয়ে এসেছে। তবুও পাপড়ির একবারও দেখা মেলেনি। মেয়েটা কি এখনো ঘুমুচ্ছে? এতো ঘুম কিসের ওর? এইখানে যে আমি অফিস রেখে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পা ব্যথা করে ফেলেছি সেটা কে দেখবে? দুদিন আগেও তো আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কেঁদে কেটে নাকের পানি,চোখের পানি এক করে ফেলেছিলো অথচ এখন আমাকে একটা কল দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনা?? আবার আমার কল কেটে দেওয়া হয়,ইচ্ছে করছে ওকে তুলে নিয়ে একটা আছাড় মেরে দেখাতে,ঘুম কাকে বলে,কত প্রকার ও কী কী!!!

আতিশ পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে পাপড়ির নাম্বারে কল দিলো। বেশ কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ঘুমঘুম কন্ঠে পাপড়ি হ্যালো বলেছে। তাতে যেন আতিশের মেজাজ আরো বেশি চটে যাচ্ছে,,

“” এতো ঘুম তুই কোথায় পাস? সারা দুনিয়ার মানুষের ঘুম কি তুই একাই ঘুমিয়ে দিস? রাতে কি ঘুম রেখে চুরি করে বেড়াস??””

আতিশের কন্ঠ পেতেই পাপড়ির ঘুম উধাও। শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,,

“” জ্বী,আপনি চাইলে আপনারটাও ঘুমিয়ে দিবো!””
“” থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো। পড়া রেখে শুধু ঘুমানো??””
“” আমার পড়া দিয়ে আপনার কি? আপনিতো আর এখন আমার টিউটর না আতিশ ভাইয়া। কেন কল করেছেন তাই বলেন!””

কেন কল করেছে সেটাও এখন ওকে বলতে হবে?? দুদিনেই এতো পরিবর্তন?

“” কি হলো বলছেন না যে?””
“” একটু নিচে আসবি?””
“” কেন?””
“” তোর জন্য কয়েকটা শীট বানিয়েছি। এগুলো পড়লেই পরীক্ষায় হুবহু কমন পাবি। তোর যে মাথা,পরীক্ষায়তো লাড্ডু ছাড়া আর কিছু পাবিনা।””
“” লাগবেনা,আমার নতুন টিউটরই আমাকে হাজারটা শীট বানিয়ে দিবে৷ শুধু শীট কেন আমি চাইলে উনি আমাকে আরো অনেককিছুও বানিয়ে দিবে।””
“” অনেক কিছু বানিয়ে দিবে মানে?””

আতিশের কথার উত্তর না দিয়েই পাপড়ি কলটা কেটে দিয়েছে। সাথে সাথে ফোনটাও অফ করে রেখেছে।

পালকের বন্ধু কাদিরের সামনে চা,বিস্কুট রাখতেই কাদির অবাক হয়ে বললো,,

“” অন্ত্রীশা তুমি?””
“” জ্বী,কেমন আছেন ভাইয়া?””
“” ভালো। কিন্তু তুমি এখানে? তারমানে পালকের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে? আই মিন তুমিই পালকের বউ??””
“” আপনার বন্ধুকেই জিজ্ঞেস করেন।””

অন্ত্রীশা সেখান থেকে প্রস্থান করতেই পালক বলে উঠলো,,

“” তুই ওকে চিনিস নাকি?””
“” আরে চিনি মানে,ওই তো আমার ক্রাস ছিলো।””
“” ক্রাস বলতে?””
“” আরে আমরা যখন থার্ড ইয়ারে ছিলাম তখন আমি তোকে আর আতিশকে নিয়ে একটা মেয়েকে প্রপোস করতে চেয়েছিলাম না? ঐ মেয়েটাতো অন্ত্রীশাই ছিলো।””

পালক কপাল কুচকে বললো,,

“” তুই সিউর ওটা অন্ত্রীশা ছিলো?””
“” সিউর হওয়ার কি আছে? আমি ওর পেছনে পুরো ১ বছর ঘুরে তারপর প্রপোস করেছিলাম।””

পালক কাদিরের দিকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করে বললো,,

“” তারমানে তুই ওর প্রেমিক? কিন্তু তোরে কোনদিক দিয়ে আমার মতো লাগে সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।””
“” আমি কেন ওর প্রমিক হতে যাবো? ও তো আমার প্রপোজাল এক্সেট করেনি। উল্টো ভাইয়া বানিয়ে দিয়েছিলো।””

পালক এবার একটু নড়েচড়ে বসে ভাবুক কন্ঠি বললো,,

“” কেন?””
“” তখন তো বলেছিলো ও নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে!””
“” কাকে?””
“” আমাকে জানায়নি””
“” কেন?””

কাদির বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,,

“” আমি কিভাবে বলবো ও কেন আমাকে জানায়নি?””

কাদিরকে বিদায় করে পালক নিজের রুমের দিকে এগুচ্ছে। মাথায় নানান প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে। একটারও উত্তর খুজে পাচ্ছেনা। কাদিরের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে অন্ত্রীশা আমাদের ভার্সিটির অন্তর্গত কলেজেই পড়াশোনা করেছে। এটা ও আমাকে কেন জানায়নি? তার উপর কাদিরতো এটাও বলেছে অন্ত্রীশা অন্য কাউকে ভালোবাসতো তাহলে ও কেন এতো সহজে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গিয়েছিলো?? তবে কি ওদের প্রেমটা ক্ষনস্থায়ী হয়েছিলো? নাকি অন্য কোনো কারন? এমন নয় তো কারো চাপে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে?? যদি এমনটাই হয় তাহলে ও এতো স্বাভাবিক আচরন কিভাবে করছে? আমি তো পারিনা আমার পত্রীকন্যা জায়গায় অন্য কারো কথা ভাবতে। ও কিভাবে ভাবছে??

পালক রুমে ঢুকেই দেখলো অন্ত্রীশাকে বিছানায় বসে রয়েছে। কোলে একটা বালিশ নিয়ে তার উপর বা হাতের কনুই ভর করে থুতনি ধরে কিছু একটা ভাবনায় ব্যস্ত। ভাবনার সাথে সাথে ঠোটে এক অমায়িক হাসি লেগে আছে। পালক ওর কাছে চলে আসাতেও ওর কোনো নড়াচড়া নেই। কি এতো ভাবছে? আর এভাবে হাসছেই বা কেন??

“” প্রিয় মানুষটির কথা ভাবছো তো?””

পালকের কথায় অন্ত্রীশা কিছুটা নড়ে উঠে। অনেকটা ভুত দেখার মতো ভয় পেয়ে গিয়েছে ও।

পালক অন্ত্রীশার পাশে বসে বললো,,

“” আমার সব তো তুমি জেনে নিয়েছো,তাহলে তোমার কি উচিত নয় তার বিনিময়ে তোমার ও আমাকে কিছু বলা উচিত?””

অন্ত্রীশা পালকের দিকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,,

“” কি শুনবেন?””
“” ভালোবাসো তাকে?””

অন্ত্রীশা নিজের হাতদুটো প্রসারিত করে বললো,,

“” হুম,অনেক। এই এতোটা!””
“” বাহ! এতোটা? তাহলে তাকে ছেড়ে আমার কাছে কেন এলে?””

“” আমিতো ছাড়িনি!””
“” তাহলে সে চলে গিয়েছে?””
“” না,সেও চলে যায়নি।””
“” তাহলে?””

অন্ত্রীশা নিজের কোল থেকে বালিশটা রাখতে রাখতে বললো,,,

“” ঐযে আপনার মতো ছোট্ট ভুল বুঝাবুঝিতে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।””
“” আমার মতো মানে? কি রকম ভুল বুঝাবুঝি?””

অন্ত্রীশা কিছু বলার আগেই পালকের ফোন বেজে উঠেছে। কল রিসিভ করে ওপাশ থেকে কিছু শুনেই সাথে সাথে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। অন্ত্রীশা পিছু ডাকতে গিয়েও ডাকেনি।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে অন্ত্রীশা নিজেকে ভালো করে পরখ করে দেখে নিচ্ছে। মিস্টি কালারের শাড়ী,আর ঠোটে হালকা গোলাপী কালারের লিপস্টিকে নিজেকে সাজিয়েছে। আজ আপনাকে সব বলবো আমি। যে কথা আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।

অন্ত্রীশা ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে ১১ টা বেজে ৩৫। এখনো উনি এলেননা কেন? সেই যে কার কল পেয়ে গেলো আর বাসায় আসার নাম নেই। কখন আসবেন আপনি? আমার যে আর তর সইছেনা। উফ! কখন যে আপনাকে সব কথা বলে পেটটা হালকা করবো!

অন্ত্রীশা বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে নিজের ফোনটা হাতে নিয়েছে পালককে কল দেওয়ার জন্য। লক খুলে ডায়াললিস্টে যেতেই পালকের আগমন।

অন্ত্রীশা পালকের দিকে তাকাতেই ওকে জড়িয়ে ধরেছে পালক। অন্ত্রীশাকে জড়িয়ে নিয়েই বললো,,

“” আমি আমার পত্রীকন্যাকে পেয়ে গেছি,অন্ত্রীশা।””
“” পত্রীকন্যা?””
“” হুম,স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধাই আমার পত্রীকন্যা।””
“” স্নিগ্ধা?””

পালক অন্ত্রীশাকে ছেড়ে খুশি খুশি কন্ঠে বললো,,

“” তোমাকে বলেছিলাম না আমার আর পত্রীকন্যার চিঠী আদান-প্রদান করতো বোরকা পড়া একটি মেয়ে? আসলে ও আর কেউ নয় ঐ আমার পত্রীকন্যা!””

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে