#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৪
মিহিকা নিজের মতো চলে গেল। এদিকে তালগোল পাঁকিয়ে গেল আরহামের মাথায়। আরহামকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাওন ভ্রুকুচকে এগিয়ে এসে বলল,
“কিছু কি হয়েছে আরহাম!”
আরহাম শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে ভাই বইলো না তোমার বোন দেখ আমার কি অবস্থা করেছে?”
পাঞ্জাবীর দিকে ইশারা করে বলল আরহাম। শাওন সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“আল্লাহ কি অবস্থা? এখন কি করবে!”
আরহাম ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“চেন্স করতে হবে।”
“তাই না হয় করো। আর কি করার।”
আরহাম নিচে চলে গেল।
কিছুসময় পর খাওয়া দাওয়া শেষে বড়রা চলে গেল। আরহামও ড্রেস চেন্স করে এসেছে। একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে সে। ইরাকে একপাশে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে হিয়া নাচলো। এবার মাহি আর মিহিকা নাচবে। মাহি চোখ ঘুরিয়ে আরহামকে খুঁজতে লাগলো। আরহামকে খুঁজে পেতে বেশি একটা বেগ পেতে হলোনা মাহির। আরহাম একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছিলো। মাহি মুচকি হাসি দিয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল।
মিহিকা আর মাহি গানের তালে তালে নাচতে লাগলো। ওদের নাচ শেষে সবাই হাততালি দিতে লাগলো। দুইজনই স্টেজ থেকে নেমে এলো। মাহি আরহামের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। কারণ আরহাম তাদের দিকে তাকায়নি।
মিহিকা হাসি মুখেই হিয়ার পাশে এসে বসলো। মাহি মুখটা ঝুলিয়েই রাখলো। হামিম উঠে এসে বলল,
“এবার আরহাম গান গাইবে।”
আরহাম ভ্রুগুটিয়ে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকালো হামিমের দিকে। হামিম বলে উঠলো,
“কোনো না শুনবোনা। তাড়াতাড়ি আয়।”
মিহিকা মুখ বাঁকিয়ে নিজ মনেই বলল,
“বন মুরগি থুক্কু হালায় তো ব্যাটা মানুষ মোরগা কককক করতে যাবে স্টেজে।”
মিহিকা আস্তে বললেও কথাগুলো কানে গেল আরহামের। আরহাম বাঁকা হেসে মিহিকার কানের কাছে গিয়ে বলল,
“কককক করি নাকি তা না হয় নিজ কানেই শুনে নিয়ো, মিস কচুগাছের পেত্নি।”
মিহিকা ঝট করে ফিরে তাকালো। আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার তো মুখেই ফটরফটর। কামের নামে দায় নাই।”
মিহিকার কথায় আবারো আরহাম বাঁকা হাসলো। মিহিরকে হাক ডাক দিয়ে বলল,
“মিহির আমার গিটারটা এনে দেও তো।”
মিহির গিয়ে গিটার নিয়ে এলো। আরহাম একটা চেয়ার টেনে স্টেজ নিয়ে গিটার হাতে নিয়ে বসলো তাতে। গলা পরিষ্কার করে গাইতে লাগলো,
♪♪বাগিচায় বুলবুলি তুই
ফুল শাখাতে, দিসনে আজই দোল।
আজো তার
ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি,
তন্দ্রাতে বিলোল।
আজো হায়
রিক্ত শাখায়
উত্তরী বায়
ঝুরছে নিশিদিন।♪♪
ছাদের নিরব পরিবেশে আরহামের মুগ্ধ করা গানের সুর যেন আরো মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মিহিকা তাকিয়ে আছে আরহামের দিকে। সে কল্পনাও করেনি ছেলেটা এতো ভালো গাইতে পারবে। মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো সে। মনে মনে বলল,
“ভালো গান গাইছে তো কি হয়েছে ড্রেনে গিয়ে মরুক গে তার কি?”
বলেই মুখ ভেংচি কাটলো।
অন্যদিকে মাহি একদৃষ্টিতে হা হয়ে তাকিয়ে আছে আরহামের দিকে। আরহাম চোখ বন্ধ করে গান গাইছিলো। গান শেষ হতেই চোখ খুলে তাকাতেই সবাই হাত তালি দিলেও মিহিকা বুকে হাত গুজে অন্যদিকে মুখ ঘুরে বসে আছে। আরহাম কপালকুচকে এক পলক ওরদিকে তাকিয়ে আবারো সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে নিচে নেমে এলো। মিহিকা আর মিহিরের মাঝের ফাঁকা চেয়ারটায় বসে বলল,
“কককক লাগলো নাকি মিস কচুগাছের পেত্নি।”
মিহিকা চোখ ছোট ছোট করে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তা নয় তো কি?”
আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো মিহিকার দিকে। মিহিকা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উঠে গেল মেহেদী দিতে। মিহিকা যেতেই মাহি খুশিতে গদোগদো হয়ে আরহামের সামনে এসে বলল,
“আপনার গানের গলা অনেক সুন্দর।”
আরহাম ছোট্ট করে বলল,
“ধন্যবাদ।”
মাহি কিছু বলার আগেই আরহাম ফোন হাতে নিয়ে নিচে চলে গেল। মাহি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো আরহামের যাওয়ার দিকে।
মিহিকা নিজে নিজেই মেহেদী দিতে লাগলো। পাশেই ইরাকে একটা মেহেদী আর্টিস্ট মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। একহাতে মেহেদী দিয়ে উঠে পড়লো সে। রাত অনেক হয়েছে। সবাই এতক্ষণে নেমে গিয়েছে। মাহি, আরিশা, হিয়া, রোদেলা অনেক আগেই মেহেদী দিয়ে নিচে নেমেছে। মিহিকা মাহি আর আরিশাকে দিয়ে নিজে দিতে গিয়ে দেড়ি হয়ে গেছে। ইরার তো অনেক আগেই মেহেদী দেওয়া শেষ। মিহিকা উঠে দাঁড়ালো। নিচে যেতে নিবে তখনি একটা ঠান্ডা হাত মিহিকার কোমর পেঁচিয়ে অন্ধকারে নিয়ে এলো। মিহিকা চিল্লাতে যাবে তখনি একটা পুরুষালি হাত তার মুখ চেপে ধরলো। মিহিকা ভয়ে গুটিয়ে গেলেও হাল ছাড়লো না। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলো। নিজেকে যত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ততো যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। গা বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। অজানা আতঙ্কে হাত পা কাঁপতে লাগলো। আলোর বিপরীতে হওয়ায় ছেলেটা কে বুঝতেও পারছেনা মিহিকা।
হুট করেই ছেলেটা মিহিকার কপালে একটা গাঢ় চুমু খেল। মিহিকা ছোটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো তার। সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসছে তার। হাত পা অবশ হয়ে আসছে।
হঠাৎ করেই মিহিকা নিজের ঘাড়ে কিছু একটা ফুটে যাওয়ার মতো অনুভব করলো। মিহিকা ছটফট করতে লাগলো। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বুজে আসতে লাগলো। মিহিকা আর পেরে উঠতে পারলো না। গা ছেড়ে দিলো সামনের মানুষটার উপর।
সামনে থাকা মানুষটা হাসলো। নরম গলায় বলে উঠলো,
“মেঘনন্দিনী আর কিছুদিন তারপরেই তুমি আমার হবে।”
———————
মাহির ডাকে পিটপিট করে চোখ খুললো মিহিকা। কিছুক্ষণ পরেই লাফ দিয়ে উঠলো মিহিকা। নিজেকে বিছানায় দেখে বেশ অবাক হলো সে। মিহিকার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। তার মনে পড়লো রাতের সেই ঘটনা। কে ছিল সেই অন্ধকারের মানুষটা? সে তো ছাদে ছিলো সেখান থেকে কীভাবে এখানে এলো? মাথার ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
মাহি চিন্তিত মুখে বলল,
“তুমি ঠিক আছো তো মিহি আপু? কখন থেকে ডাকছি, কোনো সাড়া দিচ্ছো না!”
মিহিকা ঘাড় নাড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,
“হ্যাঁ, ঠিক আছি। কিছু হয়নি।”
মাহি অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকালো মিহিকার দিকে। সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
“তোমার মুখ দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। কিছু হয়েছে কি?”
মিহিকা তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
“না, তেমন কিছু নয়।”
মাহি কিছু বলতে যাবে, এমন সময় বাইরে থেকে শাওনের ডাক শোনা গেল।
“মাহি, এদিকে আয়। সবাই খুঁজছে তোকে।”
মাহি আর কিছু না বলে চলে গেল। মিহিকা দ্রুত ওয়াশরুমে গেল। ওয়াশরুমের আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। না সব ঠিকঠাকই লাগছে। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন জাগতে লাগলো। কে ছিলো রাতের লোকটা? হেনা খানের ডাকে ভাবনায় ছেদ ঘটলো মিহিকার।
মিহিকা চোখমুখে পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে রুমে এলো।গায়ের ওড়না ঠিক করে রুমের বাহিরে বের হলো। সবাই উঠে পড়েছে অনেক আগেই। নাস্তার টেবিলে বসেছে সবাই। মিহিকা চুপচাপ টেবিলের কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। সবাই যে যার মতো কথা বললেও মিহিকা কোনো কথা বলল না। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লো মিহিকা। মাহিও উঠে পড়লো মিহিকার সাথে। মিহিকার পিছু পিছু মাহি আসতে আসতে বলল,
“মিহি আপু কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
মিহিকা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“একবার বললাম না কিছু হয়নি আমার। তারপরেও কেন বিরক্ত করছিস মাহি।”
মিহিকার কথায় মাহি দমে গেল। এমন করে কখনোই মিহিকা কথা বলে না তার সাথে। কিছু যে হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই মাহির। তাও সে চুপ করে গেল।
সকালের খাবারের পর্ব শেষ করে মেয়েরা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে পার্লারে যাওয়ার। ইরা মিহিকাকে জামা কাপড় গোছাতে না দেখে কপাল কুচকে বলল,
“কিরে মিহি বসে আছিস কেন, যাবি না!”
মিহিকা আলতো হেসে বলল,
“ইরাপু তোমরা যাও। আমি না হয় বাসায় সেজে নিবো।”
মিহিকার কথায় ইরাসহ সবাই বেশ অবাক হলো। ইরার বিয়েতে সবথেকে বেশি প্লানিং করেছে মিহিকা। তার কত শখ ইরার সাথে গিয়ে সাজবে। আর সে নাকি এখন যাবেনা।
ইরা সবকিছু বিছানার উপরে রেখে সোফায় মিহিকার পাশ ঘেষে বসে বলল,
“মিহি তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”
মিহিকা নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলল,
“না ইরাপু আসলে মাথা ধরেছে একটু তাই যাবো না।”
ইরা মিহিকার কাধ আঁকড়ে ধরে বলল,
“ওও ঔষধ খা তাহলে।”
মিহিকা হাসিমুখেই বলল,
“না আমি ঠিক আছি।”
মাহি ওদের সামনে এসে বলে উঠলো,
“মিহিপু না গেলে আমিও যাবো না।”
ইরার মন খারাপ হলো খুব। কোথায় ভাবলো সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে যাবে তা না।
হুট করে তাদের কথার মাঝে রুমে শাওন আসলো। মিহিকা, মাহি, ইরা সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। ওদের এভাবে দেখে বলল,
“কিরে তোদের আবার কি হলো সবগুলো মুখ এমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস কেন?”
সবাই চোখ তুলে তাকালো শাওনের দিকে। শাওনকে ওদের দিকে কপালকুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইরা বলে উঠলো,
“দেখনা মিহি নাকি যাবেনা ওর মাথা ব্যথা। মিহি যাবেনা বলে মাহিও যাবেনা।”
শাওন ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
“এই সামান্য কারণে সব এমন করে আছিস যেন আমার বউ মরছে।”
ইরা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ভাইয়া আমি সিরিয়াস কথা বলছি।”
শাওন কিছু একটা ভাবার ভঙ্গি ধরে বলল,
“পার্লারের কাজ যদি বাসায় হয় তাহলে কেমন হয়?”
আরিশা এগিয়ে এসে বলল,
“মানে!”
শাওন আরিশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“পার্লারের মেয়েরা যদি এখানে আসে!”
হিয়া লাফিয়ে উঠে বলল,
“তাহলে তো সেই হবে শাওন ভাই।”
ইরা কপাল গুটিয়ে শাওনের সামনে এসে বলল,
“তা এগুলোর ব্যবস্থা কে করবে?”
শাওন দাঁত বের করে হেসে বলল,
“কেন তোর জামাই।”
#চলবে