#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“কিরে ধূসর আজ আসতে এত লেট হলো?”
“আর বলিস না ইশান। মিস প্রতিবেশী কে ভার্সিটি দিয়ে আসলাম। তাই একটু লেট হলো।”
“মিস প্রতিবেশী কে?”
“আমার এক প্রতিবেশী। যাই হোক কথা না বলে ক্লাসে মন দে।”
ধূসরের কথায় ধূসরের বন্ধু ইশান আর কিছু বললো না। আজকে ধূসরের একটু দেরি হয়েছে আসতে তাই ও আসতেই ওর বন্ধু ইশান জিজ্ঞেস করলো। সবগুলো ক্লাস শেষ হলে ইশান বলল,,
“ধূসর তোর কি কোন কাজ আছে? নাকি একেবারে বাড়ি যাবি।”
“কেন?”
“একটু শপিং মলে যেতে হবে আমাকে কিছু জিনিস কিনবো। তোর কাজ না থাকলে তুই ও চল না। একা একা শপিং করা যায় নাকি। চল তোকে একটা দামি আতর কিনে দিবো!”
“ঘুষ দিতে চাচ্ছিস?”আসতাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারীর উপর অভিশাপ করেছেন (ইবনু মাজাহ, সনদ ছহীহ, মিশকাত, হা/৩৭৫৩ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়)।
“আরে ভাই কুল আমি ঘুষ দিচ্ছি না। আমি উপহার দিচ্ছি তাও মন থেকে তুই আমার সাথে শপিংমলে যাবি এই জন্য নয়। আমি এমনিতেই ভেবে রেখেছিলাম তোর আতর পছন্দ তোকে একটা দামি আতর কিনে দেব। আজ যেহেতু শপিং মলে যাচ্ছি তাহলে আজকেই দিয়ে দেব। তাই বলছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা! এমনি উপহার তাহলে ঠিক আছে চল! শুকরিয়া দোস্ত।”
ওরা শপিং মলে গেল। ধূসর আর ইশান শপিং মলে ইশানের জন্য পাঞ্জাবি দেখছিল। হুট করেই সামনে মেঘদের পাঁচ বান্ধবী কে দেখতে পায়। কিন্তু ও এগোয় না। মেঘরা ইশানদের পাশের দোকানে ঢোকে। ধূসর ওর দিকে এগিয়ে যায় তখন জাবিন মেঘকে একটা হিজাব কিনে দেয়। মেঘ নিতে নারাজ তাই জাবিন বলল,,
“কি সমস্যা তোর নিচ্ছিস না কেন?”
তখন মেঘ বলল,,
“ধূর আমার এখন লাগবে না। যখন লাগবে তখন নেব না হয়। তাছাড়া তোর এখন টাকার দরকার আছে তো।”
“ধূর আমার এখন টাকা আছে আজকেই টিউশনির বেতন পেয়েছি । রাসুল (সা) হারাম না হলে কোন উপহার ফেরত দিতেন না।”
“হইছে আর বলতে হবে না।”
মেঘ জাবিনের জন্য একটা হিজাব দেখলো। তারপর জাবিনের হাতে দিয়ে বলল,,
“নে এটা আমার তরফ থেকে!”
“তুই আবার কেন?”
আইশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপহার নিতেন এবং বিনিময়ে উপহার প্রদান করতেন।
(সহীহ, ইরওয়া (১৬০৩) , বুখারী।)
তাই কথা না বলে চুপ চাপ নে। শুধু তুই সব জানিস না আমিও জানি।আর বাকিরা আপনারা চাইলে হিজাব নিতে পারেন আজকে। আমার কাছে বেশি টাকা নেই। নাহলে অন্যকিছু কিনে দিতাম।”
বাকি তিনজন মানা করলো। যেহেতু মেঘের ব্যাপারে সবাই অবগত। তাই চার বান্ধবী ঠিক করলো, সবাই আলাদা আলাদা জিনিস মেঘ কে উপহার দেবে। যাতে মেঘের কম টাকা খরচ হয়। জাবিনই প্রথম শুরু করলো। মেঘ উপহার নিল এবং ওকে উপহার দিলো। তা দেখে তিনজনের উপহার দেওয়া মাটি হয়ে গেল। এখন মেঘের টাকা খরচ কয়িয়ে লাভ নেই। তাই তারা মানা করলো দরকার নেই।
এদিকে ইশান ধূসর কে তার আতর কিনে দিল । তখন মেঘের কথা মনে পড়লো। ইশানের আবার আতরের থেকে পারফিউম বেশি পছন্দের তাই ধূসর ইশানকে একটা হালাল পারফিউম কিনে দিল। ইশান কিছু বললে ধূসর ওকে মেঘের বলা হাদিস শুনিয়ে দিল।
অতঃপর সবাই নিজেদের বাড়িতে ফিরলো। মেঘ বাড়িতে ঢুকেই দেখলো ওর আব্বা বসে আছে।তা দেখে মেঘ বলল,
“আব্বা এই সময় বাড়িতে। আপনি না রাতে আসবেন বললেন।’
“কিছুই ভালো লাগছে না।
“শরীর খারাপ লাগছে আব্বা?”
“না একটু আগে মায়মুনা কে ফোন দিয়েছিলাম। ও খুব রাগারাগী করলো। কেন ফোন দিয়েছি তাই। ওদের খবর নিতেই ফোন দিয়েছিলাম। ওদের থেকে দূরে থাকলেও আমি আমার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। ওরা আমার দায়িত্ব আমার পরিবার।আমি ওদের সাথে থাকতে চাই ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই না। ওরা আমার পরিবার ।
“আব্বা আপনার সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিৎ ও নয়।কারন তারা আপনার আপনজন আপনার পরিবার। তাছাড়া দাদুভাই আপনাকে বেরিয়ে আসতে বলেছে বলে। আপনি এসেছেন নাহলে আসতেন না।
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সমানুরুপ ব্যবহারের মনোভাব নিয়ে সম্পর্ক রক্ষাকারী আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয়, বরং কেউ কোন ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক নষ্ট করলেও সে যদি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে তবে সে-ই হচ্ছে প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনকারী।
{সহীহ, গাইয়াতুল মারাম (৪০৪) , সহীহ আবূ দাঊদ (১৪৮৯) , বুখারী, মুসলিম।}
“হুম আম্মা! তাছাড়াও আল্লাহ তায়ালা সম্পর্ক ছিন্ন কারীকে পছন্দ করেন না। যাই হোক ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন খাবার খেতে হবে তো। বেশ বেলা হয়ে গেছে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি তো।”
“হুম আব্বা যাস্ট পাঁচ মিনিট।”
মেঘ ওপরে চলে গেল হাতের ব্যাগপত্র নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ফ্রেস হয়ে নিচে আসলো। বাবা মেয়ে একসাথে দুপুরের খাবার খেল।
______________
বিকেলে নোলক আর নীলি আসলো রোহিনীকে নিয়ে। দরজা খুলে ওদের দেখেই মেঘ মুচকি হেসে বলল,,
“ভেতরে আসুন!”
তখন নীলি বলল,,
‘তুই না বললেও আসতাম এখন সাইড দে।”
মেঘ সাইড দিল নীলি ভেতরে ঢুকে গেল। মেঘ ওদের ড্রয়িংরুমে বসতে বলে কিচেনে গেল কফি বানাতে। কিছুক্ষণ পর কফি নিয়ে আসলো মেঘ। তখন নীলি কফির মগ উঠিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,,
“ভালোবাবা বাড়িতে নেই?”
“না!”
‘নোলক আর ভাবি আপনারা কিন্তু কিছু নিচ্ছেন না। আমার পেটুক বান্ধবী কে দেখুন কফি নিয়ে আসার পরেই কফি শুরু করে দিয়েছে।”
তখন রোহিনী বলল,,
“আহ হা মেঘ আমি কি বুড়ি নাকি । আমাকে তুমি করে বলো প্লিজ। আর আমি তো তোমারও ভাবি হই।”
‘আমার একটু সময় লাগবে।”
তখন নোলক বলল,,
“আমি কিন্তু তোমার থেকে অনেক ছোট আপু। তাই আমার ক্ষেত্রে সময় দেব না। আমি সবে সেভেনে পড়ি আমাকে আপনি বলা যাবে না।”
‘আচ্ছা ঠিক আছে পিচ্চি আপু। তো পিচ্চি বলো চকলেট খাবে আমার কাছে আছে কিন্তু।”
‘চকলেট তো আমার এত্তগুলা পছন্দ।”
‘তুমি কফি খাও আমি নিয়ে আসছি।”
“ওকে!”
তখন নীলি বলল,,
“আমার জন্য নিয়ে আসিস আমার ভালোবাসা!”
“তোর ভালোবাসার সাথে না বিচ্ছেদ করলি বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছিস দেখে।”
‘এখন তোর সাথে ঝগড়া করার মুড নেই। তাই কিছু বললাম না। যা নিয়ে আয়।”
“আমার ও মুড নাই।”
বলেই মেঘ চলে গেল। তখন রোহিনী বলল,,
“ওকে কালকে দেখে গম্ভীর মনে হলেও আজ মনে হচ্ছে ওর মাঝে একটা ছোট্ট দুরন্ত বাচ্চা মেয়ে আছে।”
“মেঘ সবসময় গম্ভীরতার আড়ালে থাকে। কিন্তু মেয়েটা সম্পর্ক রাখতে জানে ভালোবাসতে জানে। ওর সাথে কারো সম্পর্ক জুড়ে গেলে ও ওর সর্বচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করে। সেই জন্য এত বছরেও আমাদের সম্পর্কের কিছু হয় নি। ওর সাথে প্রথম আলাপ হয় যখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি। ও সবসময় একা থাকতো কারো সাথে কথা বলতো না। কিন্তু আমার ওকেই কেন যেন ভালো লাগতো একদিন গিয়ে বললাম,” আমার বন্ধু হবে!” ও কি বললো জানো আমার বন্ধুর দরকার নেই। আমি কেন বললাম ও বলল ওর বিচ্ছেদ এ ভয় বেশি। প্রথমে ওর সাথে সম্পর্ক তৈরি করবে তারপর যখন ওকে ভালো লাগবে না তখন ওকে ছেড়ে দেবে। তারওপর ও একজন বোরিং পার্সন ওর সাথে থাকতেও পারবে না সবাই। ও আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলবে না। ওর কোন গল্পও নেই যেটা ও অন্যের সাথে শেয়ার করবে। এরকম বন্ধু কেউ চাইবে না। সেই ওকে রেখে চলেই যাবে। তাই ও বন্ধুত্ব করবে না কারো সাথে। ওর কথাগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে গেছিল। সেদিনের মতো আমি চলে আসি। কিন্তু মনে মনে একটা জেদ চেপেছিল ওর সাথেই বন্ধুত্ব করবো। তারপর পরপর তিন দিন ট্রাই করলাম ওর সাথে মিশতে পারলাম না। আমি কথা বলতাম ও কিছু বলতো না। চারদিনের মাথায় ওকে আবার বললাম “প্লিজ আমার বন্ধু হয়ে যাও! কথা দিচ্ছি ছেড়ে যাবো না। তুমি যেমনই হও ছেড়ে দেব না। তোমার গল্প করতে হবে না আমি করবো। তুমি শুনবে আমার সাথে মাঝে মাঝে ফুচকা খাবে আইসক্রিম খাবে চকলেট খাবে। তুমি চাইলে মাঝে মাঝে আমাকে কিছু বলতে পারো। অতঃপর ও রাজি হলো। ওর সাথে মিশতে শুরু করলাম মাঝে মাঝে মনে হতো ও আমার থেকেও বেশী কথা বলতে পারে। ও আমার সাথে সহজ হয়ে গেল বন্ধুত্ব টাও গাঢ় হলো। তারপর আমার সামনে ওকে গম্ভীর হতে দেখি নি। নাইনে গিয়ে হির জাবিন আর লিয়ার সাথে বন্ধুত্ব হলো। মেঘ ওদের সাথে প্রথমে ফ্রি হচ্ছিল না আমার বান্ধবী হয়েই ছিল । টেনে উঠে ওদের সাথেও ফ্রি হয়ে গেল। এরপর থেকে আমরা পাঁচ বান্ধবী হয়ে উঠলাম। মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়েছে সব মেঘ সলভ করেছে। ওর সাথে কারো ঝগড়া লাগলে ও আগে সরি বলেছে ওর ভুল না হলেও কারন ও বিচ্ছেদ চায় না। সম্পর্ক জুড়ে রাখতে চায়। ও বিচ্ছেদ কে ভয় পায়। কিন্তু ও গম্ভীর বেশি তেমন মন খুলে হাসে না বলে। আমরা চারজন সবসময় চেষ্টা করি ওকে খুশি রাখতে। এটা অবশ্য অনেকের ন্যাকামি লাগে। একটা মেয়েকে সবাই এতো প্যামপার করে কেন? কিন্তু একটু প্যামপার করলে যদি আমার বান্ধবী ভালো থাকে খুশি থাকে তাহলে সেই টুকুই আমাদের কাছে অনেক।”
নীলি কথা শেষ করেই দেখলো ওর সামনে পানি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। নীলি মানুষ টার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“মেঘ তুই পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে কেন?”
“যে বড় স্পিস দিলি। গলা শুকিয়ে গেছে নে পানি খা। এই কফিতে হবে না।”
“মজা করছিস!”
“না!”
মেঘ পানি টেবিলে রেখে সবাইকে চকলেট দিল। তারপর নীলির সামনে এগিয়ে বলল,,
“নে খা তোর ভালোবাসা।”
ওরা কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেল। রাতে মেঘ একটা উপন্যাস এর বই নিয়ে ছাদে গিয়ে দোলনায় বসে পড়লো। তখন পাশের ছাদ থেকে কারো কথার আওয়াজ পেল। ফোনে কথা বলছে। মেঘ মাথা ঘুড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ধূসর । ও ভালো করে ওরনা দিয়ে মাথা ঢেকে নিল। তারপর নিজের কাজে মন দিল। তখন হুট করে কারো আওয়াজ আসলো,,
‘মিস প্রতিবেশী রাতে ছাদে কি করছেন? উপন্যাস পরছিলেন বুঝি।”
মেঘ মাথা ঘুড়িয়ে পেছনে ফিরে বলল,,
“দেখতেই যখন পাচ্ছেন তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? মিস্টার প্রতিবেশী।”
“এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। যাই হোক আজকের চাঁদ দেখেছেন মাশাআল্লাহ কতো সুন্দর।”
“আপনার যদি কথা শেষ হয়ে থাকে তাহলে আমি নিজের কাজে মন দিতে পারি।”
“আপনি এরকম কেন মিস প্রতিবেশী?”
“আমার কাছে তো মনে হয় আমি ঠিকই আছি। আপনার অন্যরকম লাগলে আমি কি করতে পারি। সবথেকে বড় কথা কাউকে অহেতুক প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করা উচিৎ নয়।”
কথাটা শুনে ধূসর একটু থমকে গেল। ও কি মেঘকে বিভ্রান্ত করছে । ও অবাক হয়েই বললো,,
“আমি কি আপনাকে বিভ্রান্ত করছি?”
“আপনার উপস্থিতিই আমাকে বিভ্রান্ত করে মিস্টার প্রতিবেশী।”
কথাটা শুনে ধূসরের খারাপ লাগলো।ওর উপস্থিতিই কাউকে বিভ্রান্ত করে এটা ওর কাছে লজ্জাজনক ছাড়া আর কিছু লাগছে না। কই কোন মেয়ে তো ওকে কোনদিন বলেনি এভাবে বরং ওর কাছাকাছি থাকতে চেয়েছে। ধূসর বলল,,
“সরি মিস প্রতিবেশী! সবকিছুর জন্য দুঃখিত। আমি বুঝতে পারি নি। আপনি আমার উপস্থিতিতে বিভ্রান্ত হবেন।”
মেঘ বুঝতে পারলো ধূসরের খারাপ লাগছে। কিন্তু ও কিছু বললো না বরং নিচে চলে গেল। সত্যিই ধূসরের উপস্থিতি ওকে সবসময় বিভ্রান্তই করেছে। তাই আজ মুখের ওপর বলে দিল। হয়তো এটা অসামাজিক কার্যকলাপ হয়েছে। তাতে ওর কি, ও এসবের ধার ধারে না। সবথেকে বড় কথা আব্বা ছাড়া কোন ছেলের সংস্পর্শে সে বিভ্রান্ত হয়। এটা আজ নতুন নয়।
মেঘ চলে যেতেই ধূসর মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের মতো ভাবতে লাগলো । ওর উপস্থিতি কাউকে বিভ্রান্ত করছে এটা ওর কাছে নতুন। ভার্সিটি তে কোন মেয়ে এটা নিয়ে ওকে বলে নি। বরং কিছু মেয়েরা ওর সংস্পর্শে থাকতে চায়। ও নিজেই কোন মেয়ের কাছাকাছি থাকে নি। কিন্তু এই মেয়েটা অবলীলায় বলে দিল। সব ভেবে ওর মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বের হলো,,
“নিষ্ঠুর মেয়ে একটা ” এভাবে কেউ মুখের ওপর সত্যি কথা বলে। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল নিষ্ঠুর মেয়ে উপাধির সুত্রপাত।
_______________
পরের দিন সকালে মেঘ আজও রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজ বেশ সময় বের করে মেঘ দাঁড়িয়েছে। ধূসর দেখলো মেঘ দাঁড়িয়ে আছে তবুও আজ কিছু বললো না। ও গাড়ি নিয়ে চলে গেল। এতে মেঘের কিছু যায় আসে না। কিছুক্ষণ পর রিক্সা পেতেই মেঘ চলে গেল নিজের গন্তব্যে। এভাবেই কেটে গেল এক মাস। ধূসর মাঝে মাঝে মেঘ কে দেখতো কখনো ছাদে, কখনো বারান্দায়,কখনো রাস্তায় আবার কখনো নীলির সাথে ওদের বাড়িতে কিন্তু সেদিনের পর ধূসর আগ বাড়িয়ে ওর সাথে কথা বলতে যায় নি। কিন্তু ওর সাথে কথা না বলতে পারা এটা ওকে অনেক ভুগিয়েছে। কিন্তু কেন সেটা ধূসরের জানা নেই। আর মেঘের ওর কোন হেলদোল নেই জীবন চলছে নিজের মতো। আজ মেঘ আর আয়মান চৌধুরী ধূসরদের পরিবার কে দাওয়াত করেছে। কারন এতদিন একটু ভালো রান্না করলেই দিলরুবা খানম ওদের দিয়ে যেত। কিন্তু ওরা বাবা আর মেয়ে তেমন রান্না করতে পারে না। খাওয়ার মতো কিছু রেঁধে খেয়ে নেয়। পনেরো দিন আগে একজন কাজের মেয়ে জোগার করেছে। দু’জনে ভাবলো ওদের দাওয়াত দেওয়া উচিৎ তাই আজকে দিল। যদিও আরেকটা কারনে আজকে দাওয়াত। দুপুর হতেই ধূসরের পরিবার চলে এলো। ধূসর একবার মেঘের দিকে চাইলো ধূসর রঙের থ্রিপিস টায় অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। কিন্তু আবার কি মনে করে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। আয়মান চৌধুরী আর মেঘ তাদের সাদরে গ্রহন করলো। নীলি আজ শ্বশুরবাড়ি তাই ও আসতে পারে নি। মেঘ খাবার রেডি করে সবাইকে ডাকলো। তখন নোলক বলল,,
“আচ্ছা আপু আজ কি উপলক্ষে দাওয়াত?”
তখন মেঘ হেঁসে বলল,,
‘আজ আমার আব্বা একটা ডিল সাইন করেছে। এটাই আমাদের কম্পানি খোলার পর প্রথম কাজ। ”
‘কি বললে আমি বুঝলাম না।”
তখন দিলরুবা খানম বললেন,,
“তোমার মাথায় চাপ দিতে হবে না নোলক। ওগুলো বিজনেসের ব্যাপার স্যাপার। তুমি চুপ করে খাও।তা এতকিছু কে রান্না করেছে মেঘ নাকি?”
তখন মেঘ হেঁসে বলল,,
“না আন্টি আমি তেমন পাকা রাঁধুনি নই। খালা রান্না করেছে আমি শুধু সাহায্য করেছি।”
“ওহ আচ্ছা সমস্যা নেই। রান্না করতে করতে শিখতে পারবে ।এটা বিশাল ব্যাপার না। আমার সাহায্য লাগলে বলো আমি রান্না শিখিয়ে দেব।”
“ঠিক আছে আন্টি।”
তখন মেঘ ধুসরকে দেখলো খাবার নিয়ে নাড়ছে কিন্তু খাচ্ছে না। তা দেখে মেঘ বলল,,
“মিস্টার প্রতিবেশী খাচ্ছেন না কেন? কিছু লাগবে?”
হুট করে মিস্টার প্রতিবেশী শুনে ধূসর ঝটপট মাথা তুললো। এটা ওর কাছে আশ্চর্যজনক ছাড়া কিছু নয়। এদিকে সবাই মেঘের মিস্টার প্রতিবেশী শুনে অবাক হলো। তখন ধূসর বলল,,
‘আসলে মিস প্রতিবেশী অনেক আইটেম তো! তাই কি দিয়ে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। বোঝেনই তো চয়েজ বেশি থাকলে বাছাই করতে কষ্ট হয়।”
তখন নোলক বলল,,
“মিস্টার এন্ড মিস প্রতিবেশী নামগুলো দারুন তো। কে রাখলো?
তখন মেঘ বলল,,
“আসলে নোলক তোমার ভাইয়া প্রথমদিন থেকে আমাকে মিস প্রতিবেশী বলে সম্বধোন করেছে। তাই আমি আর ওনাকে কি বলবো আমিও মিস্টার প্রতিবেশী বলি ।”
তখন ধূসর বলল,,
“তো কি বলবো। প্রথম দিন ওনার সাথে ছাদে দেখা কি বলে ডাকবো? পরে ভাবলাম উনি আমার প্রতিবেশী এটা ধরেই ডাকি। শুধু প্রতিবেশী কেমন যেন তাই সামনে মিস লাগালাম।”
“ওহ আচ্ছা তবে নামগুলো দারুন।”
ওরা সকলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। কিছুক্ষণ গল্প করে বাড়ি ফিরে গেল। বিকেলে ছাদে ধূসর মেঘের জন্য অপেক্ষা করছিল ওর মনে হচ্ছিল মেঘ আসবে। কারন মেঘ নিয়মিত আসে এই সময়ে ছাদে। কিছুক্ষণ পর এলোও তাই। মেঘ ছাদে আসতেই ধূসর বলল,,
“যার উপস্থিতি আপনাকে বিভ্রান্ত করে। তাকে কি নিজের সম্বোধন দেওয়া নামে ডাকা যায়!”
হুট করে ধূসর কে আর ধূসরের প্রশ্নে মেঘ অবাক হলেও বলল,,
“যাকে তার নাম ধরে কোনদিন ডাকা হয় নি। তাকে কি হুট করে নাম ধরে ডাকা যায়!”
‘আপনার কাছে সবসময় উত্তর রেডি থাকে তাই না।”
” এটা রেডি থাকা উত্তর নয় এটা ফ্যাক্ট। আপনি আজ আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। আপনার সুবিধা অসুবিধা দেখা আমার দায়িত্ব। আপনি খাচ্ছিলেন না,,তাই কি সম্বোধন করে আপনাকে ডাকবো বুঝতে পারছিলাম তাই এর আগে মিস্টার প্রতিবেশী বলে সম্বধোন করেছি তাই ওটাই করলাম।”
“লজিক টা ঠিক আছে।”
“তা আপনি এখন এখানে কেন? এতদিন তো বিকালে ছাদে দেখতে পাই নি।”
” নিজের কাজে গভীরভাবে ডুবে থাকলে আশেপাশে কিছু খেয়াল থাকে না। আমি তো মাঝে মাঝে ছাদে আসতাম কিন্তু পেছনদিকে থাকতাম এই জন্য বোধহয় দেখতে পান নি। আপনি বিভ্রান্ত হবেন বলে আমার উপস্থিতি জানতে দিই নি।”
‘হয়তো বা!”
“আপনি উপন্যাস পছন্দ করেন?”
“উপন্যাস কে না পছন্দ করে। কিন্তু আপনি শুনে কি করবেন?”
“আপনাকে মাঝে মাঝেই দেখতাম উপন্যাস পরতে তাই জিজ্ঞেস করলাম। তাছাড়া আমার কতোগুলো উপন্যাস এর বই আছে। আপনি পরলে আপনাকে দিতাম আর কি? আমার তো মনে হয় আপনি বইপ্রেমী।”
“সময় কাটানোর বেস্ট ওয়ে হচ্ছে উপন্যাস বা গল্প।”
“মিস প্রতিবেশী আপনি কি পরবেন আমার বইগুলো?”
‘আসলে আমি বই পরলেও সব ক্যাটাগড়ির বই পড়িনা।”
“আমার কাছে প্রিয়তমা বই আছে। ওটা পরবেন বেস্ট একটা বই।
“প্রিয়তমা বইটা পরেছি লাগবে না। আমারও প্রিয় একটা বই।”
‘ওকে আপনি নাম বলুন। দেখি আমার কাছে আছে কি না। যদি না থাকে আমি কালেক্ট করে দেব। নাহয় কিনে আনবো।”
“আমার জন্য এত কষ্ট কেন করবেন?”
“জানি না তবে আমার মনে হয় আপনার ভালো লাগবে। প্রতিবেশী হয়ে যদি প্রতিবেশীকে একটু ভালো লাগা না দিতে পারি তাহলে কিসের প্রতিবেশী।”
বলেই ধূসর হাসলো মেঘ মুচকি হেসে বলল,,
“আপনার কথাগুলো ভালো লাগলেও আমার বই লাগবে না মিস্টার প্রতিবেশী। বলার জন্য শুকরিয়া আসছি। আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই মেঘ চলে গেল। ধূসর মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“অদ্ভুত মেয়ে মিস প্রতিবেশী যে জিনিসটা কতজনে চেয়েও পায় না। সেই জিনিস টা সহজে পেয়েও নিল না। ওহো আমি তো ভুলে গেছি আপনি সবাই নন। আপনি আলাদা , আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
~চলবে,,
#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#পর্ব_১৬
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“ধূর উনি যেদিনই ছাদে আসেন। আমার ছাদে থাকা হয় না। উনি তো ওনার নিজেদের ছাদেই থাকে তাই কিছু বলাও যায় না। ভেবেছিলাম আজ একটা উপন্যাস পড়বো কিছুই হলো না।”
“আম্মা কি হয়েছে কি বিরবির করছেন?”
আয়মান চৌধুরীর কথায় মেঘের হুশ ফেরে। ও সিড়ি দিয়ে নিচে নামছিল আর একা একাই বিরবির করছিল। মেঘ হেঁসে বলল,,
“তেমন কিছু না আব্বা চলুন না একটু ফুচকা খেয়ে আসি।”
“হুম চলুন অনেক দিন হলো আব্বা আর মেয়ে মিলে ফুচকা খাওয়া হয় না। আজ শুধু ফুচকা না আইসক্রিম ও খাবো।”
“ঠিক আছে আপনি দুই মিনিট দাঁড়ান। আমি রেডি হয়ে আসি।”
“ঠিক আছে।”
মিনিট কয়েক পরে মেঘ বোরকা হিজাব নিকাব পড়ে বের হলো। আয়মান চৌধুরী সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পড়েছিল। মেঘ আসতেই আয়মান চৌধুরীরা বের হলেন। দুজনে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর রিক্সা পেতেই দুজনে উঠে পড়লো। এরপর একটা ফুচকার দোকানে গেল দু’জনে মিলে ফুচকা খেল । কতো জনে ওদের ঘুরে ঘুরে দেখলো ঠিকই কিন্তু তেমন কেউ কাছে এসে কিছু বললো না। তবে একজন যুবক বলল,,
“এই যে কাকু এরকম বয়সে ফুচকা খেতে এসেছেন ভালো কথা। কিন্তু পাশেরটা কে? দেখে তো আপনার থেকে অনেক বছরের ছোট মনে হচ্ছে।”
আয়মান চৌধুরী কিছু বলবেন তার আগে মেঘই বলল,
“কেন ভাইয়া? এ বয়সে ফুচকা খেতে আসা বারন নাকি। সবথেকে বড় কথা আমাকে কি মিন করে কথা বললেন? পাশের টা কে?অনেক বছরের ছোট মনে হচ্ছে। শুনুন কোন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ একসাথে ফুচকা খেতে বা রেস্টুরেন্টে গেলে যে সেটা স্বামী স্ত্রী কিংবা আপনাদের সো কল্ড প্রেমিক প্রেমিকা হবে এমন কোন নেই। তারা ভাই বোন ও হতে পারে কিংবা বাবা মেয়ে হতে পারে। অহেতুক প্রশ্ন করে তাদের বিভ্রান্ত করা ছাড়া আপনাদের মতো লোকদের কাজ নেই তাই না। নিজের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলান ভাইয়া আপনাদের মতো লোকদের জন্য আজকাল ভাই বোনেরা আর বাবা মেয়েরা একসাথে কোথাও যেতে ভয় পায়। ইশশ লোকে যদি আমাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে বসে এই জন্য।”
“মেঘ আম্মা শুনুন!”
“আপনি একদম এর মাঝে কথা বলবেন না আব্বা। এদের কাজ নেই অন্যদের সমালোচনা কিংবা বিশ্লেষণ করা ছাড়া। তো ভাইয়া আমার আব্বাকে কি মিন করে কথা বলছিলেন তার জন্য সরি বলুন। আর হ্যা কাকু মজা করে বলেছেন তাই না তার জন্যও সরি বলুন।”
“আম্মা আপনি থামেন?”
এবার মেঘ একটু চিৎকার করেই বলল,
“আমার আব্বাকে সরি বলুন!”
এবার ছেলেটা তাড়াতাড়ি করে বলল,,
“সরি আঙ্কেল আসলে আমি বুঝতে পারি নি। সরি আপু।”
মেঘ ওখান থেকে চলে গেল। তখন আয়মান চৌধুরী বললেন,,
“তোমরা দেশের ভবিষ্যৎ মাথা থেকে নোংরা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে একটু পজিটিভ চিন্তা ভাবনা রাখো। তাহলেই জীবনে সুষ্ঠু ভাবে এগুতে পারবে। আসলে এখানে তোমার দোষ কি দেব জেনারেশন টাই এমন। যদি পারো তাহলে নিজের খারাপ চিন্তা গুলো কে মেরে ফেলো। চিন্তা ধারা বদলাও।”
“সরি আঙ্কেল !”
“ইটস্ ওকে আমার মেয়েটা রেগে গেছে বুঝলে কিছু মনে করো না।”
বলে আয়মান চৌধুরী ও চলে গেলেন। সকলে এতক্ষন এদেরকেই দেখছিল। সকলে অবাক সাথে বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ। কেউ বোধহয় ভাবতেই পারে নি বাবা মেয়ের সম্পর্ক এমন হয়। এদিকে ধূসর এদিকে এসেছিল ইশানের সাথে দেখা করতে হুট করে এমন কিছু দেখবে ও বুঝতে পারে নি। ধূসর ছিল মেঘদের পাশের চায়ের দোকানে। ইশান বলল,,
“এই রকম মেয়ে এই প্রথম দেখলাম ভাই। প্রথমে তো বাবার সাথে ফুচকা খেতে এসেছে। আবার কেউ ওনার বাবাকে একটু অন্যরকম ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলাতে এই রকম করলো সবার সামনে সরি বলালো।”
“এটাই তো মিস প্রতিবেশীর ক্যারেক্টর। যা সত্যি একদম তাই মুখের ওপর বলে দেবে। এতে মানুষ কি ভাবলো তাতে উনার যায় আসে না।”
“মিস প্রতিবেশী? তার মানে এর কথায় বলেছিলি যে বলেছিল তার বিভ্রান্তির কারন তুই।’
“হুম উনিই মিস কাশফিয়া আয়মান মেঘ ওরফে মিস প্রতিবেশী।”
“ওহ আচ্ছা অবশ্য মেয়েটা ঠিকই বলেছে বিপরীত লিঙ্গের মানুষ দেখলেই স্বামী স্ত্রী বা প্রেমিক প্রেমিকা হতে হবে নাকি। তবে সো কল্ড প্রেমিক প্রেমিকা বললো কেন? মনে হয় ওনার রিলেশনশিপ পছন্দ নয়।”
“উনি বেশ ইসলামিক মাইন্ডের মানুষ। হারাম রিলেশনশিপ ওনার অপছন্দ থাকতেই পারে আমি জানি না। যাই হোক তোর জন্য আজ এটা দেখতে পারলাম শুকরিয়া। তুই ফোন না দিলে আমি তখন বেরুতাম না আর এই দৃশ্যটাও দেখা হতো না।”
“ইটস্ ওকে একা একা ভালো লাগছিল না। তাই ভাবলাম তোকে নিয়ে এখানের চা খাই।”
“হুম!”
দেখতে দেখতে এভাবেই কেটে গেল ছয় মাস। দুই মাস হলো মেঘ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে । এই ছয় মাসে ধূসরের অবস্থা পাগল পাগল। এই ছয় মাসে ধূসর মেঘের নানকাজের মাধ্যমে আকৃষ্ট হয়েছে। এই ছয় মাসে কখনো ছাদে দেখা হয়েছে কিন্তু কখনো সেরকম কথা হয়ে উঠেনি। কারন মেঘ তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে এসেছে। কখনো কখনো মেঘের অনেক লেট হয়েছে ধূসরের গাড়িতে গিয়েছে কিন্তু সেখানেও কথা হয় নি। একদিন তো ধূসরের গাড়ি থামিয়ে একজন অন্ধকে রাস্তা পার করে দিল যা ধূসরকে আরো মুগ্ধ করেছে। দিলরুবা খানম প্রায়ই মেঘকে ডেকে এনে রান্না শেখান। মেঘ ও মনোযোগ দিয়ে রান্না শিখতো। এখন তো মেঘ পাক্কা রাঁধুনি হয়ে গেছে। সাথে ধূসরদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে। খান বাড়ির সকলেই মেঘকে স্নেহ করে। মেঘ এখন দিলরুবা খানম কে মামনি বলে নোলক রোহিনী কে নিজের বোন মনে করে। এটাই যেন ওর ফ্যামিলি। এর মাঝে একটা সুখবর নীলি প্রেগন্যান্ট তিন মাসের যেদিন প্রথম জানলো ও মা হতে চলেছে। সেদিন মেঘকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। কারন মেঘকে নিয়েই ও ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। এতদিনে ধূসর মেঘের প্রতি কিছু ফিল করতে শুরু করেছে মেঘকে না দেখতে পেলেই কেমন ছটফট করে সবকিছু অসহ্য লাগে। তার জন্য ধূসরের আজকাল আয়মান চৌধুরীর সাথে বেশি থাকছে সুযোগ পেলেই আয়মান চৌধুরীর সাথে এমনভাবে মিশে যায় যেন দুই হারানো বন্ধু। আয়মান চৌধুরী ও এখন খুব ব্যস্ত সময় পার করছে ওনার বিজনেস টা কিছুটা দাঁড়িয়েছে তবে আরো কষ্ট করতে হবে।
ধূসরের মেঘের প্রতি ফিলিংস যেন কমছেই না। বরং বাড়ছে মেঘকে দেখলে মনে হয় কতোটা মুগ্ধতা এসে ভর করে মেঘের মুখে শুধু দেখতেই মন চায়। তাছাড়া মেঘের ব্যক্তিত্ব ধূসরকে সব থেকে টানে। কখনো মেঘ ধূসরের দিকে তাকায় না মুখের ওপর সত্যি কথা বলে দেয়। যেদিন মেঘ একা ছাদে থাকতে চায় সেদিন যদি ধূসর থাকে তবে বলে দেবে,,
“মিস্টার প্রতিবেশী আপনার জন্য আমি এই সুন্দর প্রকৃতির স্বাদ স্বাধীন ভাবে গ্ৰহন করতে পারছি না। আপনি আমায় আজ ও বিভ্রান্তিতে ফেলেন।”
ধূসরের আর কি চোখটা নিচে নামিয়ে সোজা নিজের রুমে। কিন্তু মেঘকে কে বোঝাবে ওর জন্য ছাদে যাওয়া ধূসরের অন্যকিছু তো বাহানা মাত্র। ধূসর ওর মনকে বুঝিয়েছে এগুলো ঠিক না অনেক বার নিজেকে কন্ট্রোল করতে চেয়েছে কিন্তু ও বরাবরই নিজের কাছে ব্যর্থ ।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেভাবেই হোক মেঘকে তার চাই। এই যে ওকে দেখার তৃষ্ণা ওকে তৃষ্ণার্ত করে তুলে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। চোখ বুঝলেই মেঘের কর্মকান্ড চোখের পাতায় ভেসে উঠে। না এভাবে আর সম্ভব না ও নফসকে সামলাতে পারছে না। অনুভূতি অন্য দিকে যাওয়ার আগেই ওকে বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ। এতদিন কয়েকবার পরিবার কে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে ও বিয়ে করতে চায় তাড়াতাড়ি বিয়ে করার হাদিস ও শুনিয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।তাই আজ রাতে খাওয়ার পর ধূসর সবাইকে ড্রয়িংরুমে থাকতে বলেছে। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আছে নীলিও আজ আছে কিছুদিন থাকবে এখানে। ধূসর অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে আছে । তা দেখে এহসান খান বললেন,,
“তা কিসের জন্য থাকতে বলেছো?”
ধূসর চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আসলে বাবা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।”
“কি এমন বলবে যে বুঝতে পারছো না?”
“বাবা আমি জানি না এটা আমার মুখে শুনতে তোমাদের কাছে শোভনীয় মনে হবে কিনা। ওকে ফাইনাল বলেই ফেলি আমি বিয়ে করতে চাই । আমি জানি তোমরা কি বলবে আমি সবে ইন্টার্নি করছি, এখনি কেন বিয়ে করবো। আমি তো ঠিক ভাবে মেয়েটার সব দায়িত্ব নিতে পারবো না। আসলে আমি একজন কে খুব পছন্দ করি তাকে নিয়ে অনুভূতি খারাপ দিকে যাওয়ার আগেই আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।”
হুট করে বিয়ের কথা শুনে সবাই অবাক চোখে ধূসরকে দেখলো তবে ধূসর আজ নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে। এহসান খান বললেন,,
“না তোমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলবো না। কারন রিযিকদাতা আল্লাহ তায়ালা। তুমি কিছু করছো না মানে এই না তুমি যাকে বিয়ে করবে তার ভরনপোষন তোমাকেই করতে হবে। সবকিছুর মালিক আল্লাহ এবং রিযিকদাতা ও তিনি। তার বান্দার রিযিক তিনি আগেই নির্ধারন করে রেখেছেন। তাছাড়া তোমার বাবা এখনো মরে যায় নি সে আছে তার ভরনপোষন এর চিন্তা তোমার করতে হবে না। সবথেকে বড় বিয়েশাদী তাড়াতাড়িই হয়ে যাওয়া ভালো এমনকি ইসলামে বিবাহ যোগ্য ছেলে মেয়েদের অতি তাড়াতাড়ি বিবাহ দিতে বলা আছে। তাই বিয়ের ব্যাপার নিয়েও কিছু বলবো না তোমার ক্ষেত্রে ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্যই কি কয়েকদিন ধরে এতো হাদিস শুনালে বিয়ের আমি সবই খেয়াল করেছি। আমি তোমার সরিসরি মতামত জানতে চাইছিলাম যাতে সরাসরি তুমি আমায় বলো তাই রিয়াক্ট করি নি। এখন বলো মেয়েটা কে?
ধূসর ওর বাবার কথা শুনে লজ্জা পেল। এতদিন বিয়ে করার জন্য সে কম কিছু করে নি। বারবার আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে সে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু এখন যখন ওর বাবা মত দিয়েছে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে তখন অস্বস্তি হচ্ছে কেন যেন এখন। কিভাবে বলবে তোমার বন্ধুর মেয়ে সাথে বোনের বান্ধবী। তবুও ধূসর সাহস যুগিয়ে বলল,
“মেয়েটা কাশফিয়া আয়মান মেঘ। ওরফে তোমার বন্ধুর মেয়ে বাবা।”
এ কথা শুনে সবার মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো । কারন সবার কাছের মেঘ স্নেহের পাত্রী। সবথেকে খুশি লেডিসগন কিন্তু এহসান খান মুখটাকে গম্ভীর করে ফেললেন। তা দেখে সকলের হাঁসি গায়েব হয়ে গেল। ধূসর বলল,,
“কি হয়েছে বাবা?”
তখন এহসান খান হেঁসে বললেন,,
“আমিও চেয়েছিলাম মেঘের সাথে তোমার বিয়ের কথা বলতে। কারন মেঘকে আমার খুবই পছন্দ। কিন্তু আয়মান কে কিভাবে বলবো তাই একটু চিন্তিত হয়ে উঠছিলাম। তবে আমার মনে হয় ধূসর আগে তোমার আয়ামানের সাথে কথা বলা উচিৎ। তুমি তার মেয়ের যোগ্য কিনা সেটা তো আয়মানকে পরখ করে নিতে হবে। তাছাড়া তোমার মেঘের মতামত ও তো নিতে হবে।”
“সমস্যা নেই বাবা আমি কালকেই মেঘের আব্বার সাথে কথা বলছি। তারপর মেঘের সাথেও বলবো।
‘এত তাড়া কিসের? একটু সময় নিয়ে করো।”
“তিন মাস ধরে আমি গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নাহলে নিশ্চয়ই এভাবে বলতাম না তাও বিয়ের বিষয়ে। আসলে বাবা যদি সত্যি কথা বলি আমি খুব করে মেঘকে চাই। আর খুব খারাপভাবে চাই। এই অনুভূতির ওপর আমার কন্ট্রোল নেই। বরং তাকে নিয়ে আমার যতো পাগলামি।”
ধূসরের কথা শুনে সকলেই হাসলো। তখন নীলি বলল,,
‘ধূর ভাইয়া তুমি যখন মেঘকে নিয়ে এতো ডেস্পারেট তাহলে মেঘকে আমার ভাবি হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না।”
তখন দিলরুবা খানম বললেন,,
‘আগে মেঘের সিদ্ধান্ত জেনে নিতে হবে ধূসর। কারন তুই ডেস্পারেট হলেও মেঘ যদি রাজি না হয়। তাহলে কিছুই করার থাকবে না।
হুট করেই এমন কথা শুনে ধূসরের ভয় হতে লাগলো। ধূসর তো এটার কথা ভাবেই নি। ও ভেবেছে খুব সহজেই ও মেঘকে পেয়ে যাবে। কারন এ বাড়ির সকলেই মেঘ কে অনেক পছন্দ করে। ধূসর নিজেকে সামলিয়ে ছোট করে বলল,,
“হুম! ঠিক বলেছো। তবে আমি চেষ্টা করবো যাতে মেঘ রাজি হয়।”
_____________
পরের দিন সন্ধ্যায় আয়মান চৌধুরী বাড়ি ফিরলেন। তা দেখে ধূসর কিছুক্ষণ পর আয়মান চৌধুরীর সাথে কথা বলতে গেল। ধূসর এসেছে দেখে মেঘ ওনাদের নাস্তা দিয়ে রুমে চলে গেল। হুট করে ধূসর বলল,,
“আঙ্কেল একটা কথা বলতে চাইছিলাম?”
তখন আয়মান চৌধুরী বললেন,,
“বলো কি বলতে চাও?”
‘আসলে আংকেল আমি জানি না কিভাবে শুরু করবো। আমি এটাও জানি না আপনি বিষয়টা কিভাবে নেবেন।”
‘এতো ফর্মালিটি করছো কেন? বলো না কি বলবে?
“আসলে আংকেল আমি বোধহয় মেঘ কে পছন্দ করি। এবং ভালোবাসি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি মেঘকে বিয়ে করতে চাই।”
আয়মান চৌধুরী হেসে বললেন,,
“পছন্দ করো নাকি ভালোবাসো আর বোধহয় টা কি?”
“আমি ওকে পছন্দও করি আবার ভালোবাসি। আপনার সামনে কিভাবে বলবো তাই বোধহয় ব্যবহার করেছি।”
“ওহ আচ্ছা। তোমার কেন মনে হলো তুমি মেঘকে ভালোবাসো। কারন তোমরা তো একেঅপরের সাথে তেমন ভাবে খোলাখুলি কথাও বলো নি।”
“তার সাথে কথা বললেই যে তার ওপর অনুভূতি আসবে এমন টা নয়। এক চোখের দেখায়ও কারো ওপর অনুভূতি অনুভব করা যায়। সত্যি বলতে আপনি ঠিক বলেছেন আমাদের খোলাখুলি কথা হয় নি। তবে তাকে দেখা হয়েছে ,তার কাজ কথা বলার ভঙ্গি, তার আচরন সবথেকে তার ব্যক্তিত্ব যা আমাকে প্রভাবিত করেছে। আমি জানি না এটাকে ভালোবাসা বলে কি না? তবে তাকে সবসময় দেখতে ইচ্ছে করে. তাকে দেখলে চোখটা শীতল হয়ে যায়। মনে হয় সারাদিন তাকেই দেখি। তার সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করে। যখন তার মন খারাপ হুট করে আমারও মন খারাপ হয়। সে যখন হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করে তখন তার মাথার ওপর ছাতা ধরতে ইচ্ছে করে। সে যখন বেখেয়ালি ভাবে নিজের অযত্ন করে জীবন যাপন করে। তখন খুব ইচ্ছে হয় তার একটু যত্ন করি তার জীবন টাকে রঙিনভাবে সাজিয়ে তুলি। কারন ধূসর রাঙা মেঘ এর জীবন বড্ড বেরঙিন। আমার খুব ইচ্ছে হয় এই ধূসর রাঙা মেঘকে রঙিন করতে।
এইটুকু বলে ধূসর থামলো। আয়মান চৌধুরী মুগ্ধ হয়ে ধূসরের কথা শুনছিল। এরকম ভাবে তার মেয়ের কথা তাকেই বলছে এটা বেমানান হলেও ধূসর তার জীবন সঙ্গী কে পাওয়ার অবলীলায় বলে দিল। আবার এটাও বলল তার মেয়ের জীবন কে রঙিন করে তুলতে চায়। সে একবার ও বলে নি তার জীবনে সে আসলে এটা করবে ওটা করবে খুব সুখে রাখবে। সে শুধু বলল তার ইচ্ছে করে। আয়মান চৌধুরী বললেন,,
‘যদি আমি রাজি না হই তো?”
হুট করেই ধূসরের চোখ ছলছল করে উঠলো ।সে অসহায় চোখে আয়মান চৌধুরীর দিকে তাকালো। আর বলল,,
“আঙ্কেল আমি মেঘকে খুব করে চাই । ওর প্রতি আমার অনুভূতি খুব গভীর। প্লিজ এরকম করবেন না। আমি কথা দিচ্ছি আপনার মেয়েকে সবসময় অনেক খুশি রাখবো। পৃথিবীর সব সুখ ওকে দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর সারাজীবন ওকে আগলে রাখবো।
বলতে বলতে ধূসরের চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। এ যে হারানোর ভয়। বুকটা হাহাকার করছে। আয়মান চৌধুরী ধূসরের চোখে পানি দেখে অবাক হলো। সে তো এখনো কিছু বলেই নি। কিন্তু ছেলেটার চোখ থেকে পানি পরছে। এরকম ছেলে কি সে তার আম্মার জন্য কোনদিন পাবে। আয়মান চৌধুরী ধূসরের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,,
“ধূসর আমি তোমাকে শক্ত পোক্ত মানুষ ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি তো দেখি ইমোশনাল ফুল। যে ছেলেটা আমার আম্মাকে হারানোর ভয়ে কাঁদছে তার থেকে আমার আম্মাকে আর কে বেশি ভালোবাসবে? আর তার সাথে আমার আম্মাকে তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে কি?”
হুট করেই ধূসরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। চোখে পানি নিয়ে মুখে হাসি এই অনুভূতি আর মুহুর্ত ও না অসম্ভব সুন্দর। ধূসর হেসে বলল,,
“আপনি রাজি আঙ্কেল?”
“হুম আমি আর এহসান তোমাদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আরো কয়েকবছর আগে কথা বলেছিলাম। তোমরা যদি রাজি থাকো তাহলেই তোমাদের বিয়ে দেব। তাছাড়া তোমার কালকের কথা এহসান আমাকে জানিয়েছিল। ও দেখতে চেয়েছিল তুমি সত্যি মেঘের কথা বলতে আমার কাছে আসো কি না। কিন্তু তুমি দেখি এহসান এর কথা মতো মেঘকে নিয়ে খুব সিরিয়াস। তুমি তো রাজি এখন দেখতে হবে মেঘ রাজি কি না।”
“আমি এ ব্যাপারে ওনার সাথে কথা বলতে চাই আঙ্কেল?”
“ঠিক আছে তুমি যা মনে করো তাই। যদি আমার আম্মা রাজি হয় তাহলে আমার পক্ষ থেকেও কোন বাঁধা নেই।”
“শুকরিয়া আঙ্কেল আমি আজি ওনার সাথে কথা বলবো। উনি যখন ছাদে যাবে।”
“ঠিক আছে।”
“আল্লাহ হাফেজ আঙ্কেল আমি যাই এখন।”
“আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।”
ধূসর খুশি মনে নিজের বাড়িতে চলে গেল। রাতে মেঘকে কিভাবে বলবে সেটা নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেল। এটা একটা কঠিন বিষয়। অতঃপর ধূসর নিজেকে সাহস যুগিয়ে ছাদে গেল। কারন এই সময়টায় মেঘ ছাদে যায়। ধূসর যেতেই দেখলো মেঘ দোলনায় বসে চাঁদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। ধূসর এগিয়ে গিয়ে বলল,,
“আজকের চাঁদ টা সুন্দর তাই না মিস প্রতিবেশী!”
মেঘ প্রথমে ধূসরের কথা শুনে একটু চমকালেও পেছনে তাকিয়ে বলল,,
“চাঁদ বরাবরই সুন্দর!”
“তো চাঁদের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছিলেন বুঝি?”
মেঘ একবার চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবার ধূসরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“হুম ভাবছিলাম এই চাঁদ কে নিয়ে কতো ঘটনা আছে। এই যে এতো দূর থেকে পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখছে। অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে এই চাঁদ বিরাজ করছে। কতোশত কবিদের লেখকদের কতো শত বর্ননা এই চাঁদ কে নিয়ে। কতো শত প্রেমিক প্রেমিকা কে তুলনা করে এই চাঁদের সাথে। অথচ দিনশেষে একটাই কথা চাঁদের কলঙ্ক আছে। চাঁদের কলঙ্ক আছে তাতেও মনে হয় চাঁদের সৌন্দর্যের কোন ঘটতি নেই। অদ্ভুত সুন্দর এই চাঁদ।
সব শুনে ধূসর বলল,,
“তবে আজকে চাঁদের মাঝে কিছু তো আছে। নাকি আমিই অন্য চাঁদের সাথে গুলিয়ে ফেলছি।”
‘মানে?”
“একটু এগিয়ে আসবেন মিস প্রতিবেশী!”
‘কেন?”
“আসুন না একটু আপনার সাথে একটু কথা আছে।”
মেঘ এগিয়ে গেল তবে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। তখন ধূসর এর হার্টবিট বেড়ে গেল হুট করেই বড্ড ভয় হচ্ছে। ধূসর আর হেয়ালি না করে বলল,,
“মিস প্রতিবেশী আপনি আমার ঘরণী হবেন?”
হুট করে ধূসরের এমন কথায় মেঘ চমকে উঠলো। কি বলছে ধূসর, মেঘ বলল,,
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?”
“আমি বোধহয় আপনাকে ভালোবাসি মিস প্রতিবেশী। আমি আপনাকে আমার ঘরণী করতে চাই। আপনার প্রতি এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয়েছে। আমার অজান্তেই আজকাল যা আমাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। আপনি আমার স্বপ্নে এসে রোজ জ্বালাতন করেন।আমার অনুভূতি কে আমি কন্ট্রোল করতে পারছি না। এই অনুভূতি কে স্বীকৃতি দিয়ে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
মেঘ ধূসরের কথা মন দিয়ে শুনলো তারপর বলল,,
“আমার মতো বোরিং পার্সন কে বিয়ে করতে চাওয়ায় কারন?”
“কারন একটাই আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
“বুঝলেন কি করে ভালোবাসেন?”
“জানিনা শুধু জানি আমি আপনার প্রতি আমার অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে। আর আপনাকে আমার করে পেতে চাই।”
“দেখুন ধূসর আমার জীবনের প্রতি এক্সটেনশন কম থাকলেও। আমার মনে হয় না আপনার জীবনে আমার মতো এক্সপেক্টেশন নেই। সব মানুষের তাদের লাইফ পার্টনার এর থেকে এক্সটেনশন থাকে। আপনি নিশ্চয়ই আপনার অর্ধাঙ্গিনী কাছে থেকে কিছু আশা রাখেন । আপনি আমার সাথে সুখী হবেন না। কারন আমি সাধারন হলেও আরো একটু বেশিই সাধারন।”
“উহু তুমি সাধারণ নও তুমি একটু বেশিই অসাধারণ।
তুমি শুধু রাজি হয়ে যাও মেয়ে বাকিটা আমি দেখে নেব। আমার সুখ আমি খুঁজে নেব।”
হুট করে আপনি থেকে ধূসরের তুমি শুনে মেঘ অবাক হলেও এখন কিছু বললো না । শুধু বলল,,
“তবুও আমার মনে হয় আমাকে বিয়ে করা আপনার উচিৎ নয়।”
“এই যে নিষ্ঠুর মেয়ে তোমাকে বলতে হবে না আমার কি উচিৎ,আর কি উচিৎ নয়। আমার ভালো আমি বুঝি।”
“নিষ্ঠুর মেয়ে বলছেন আবার বিয়েও করতে চাইছেন।”
“তোমার কর্মকান্ডে নিষ্ঠুর মেয়ে একদম পারফেক্ট উপাধি হয়েছে। কারন তুমি আমার সাথে বারবার নিজের নিষ্ঠুরতা দেখাও। যাই হোক এসব তোমার বুঝতে হবে না। এখন বলো বিয়ে করবে কি না?”
“যদি না করি তো?”
“তোমার আব্বা রাজি আছে তোমায় তুলে নিয়ে বিয়ে করবো।”
‘কি আব্বা রাজি? তার মানে আপনি আব্বার সাথে আগে কথা বলেছেন।”
‘তা নয়তো কি তোমায় নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল তুমি কোন ভাবে যদি না করে দাও।তাই আগে ওনার সাথে কথা বলেছি।”
“আব্বা আমাকে না জানিয়েই রাজি হয়ে গেল এটা আমি বিশ্বাস করি না।”
“তোমার আব্বা বলেছে তুমি রাজি থাকলে তার পক্ষ থেকে বাঁধা নেই এখন বলো রাজি কি না।”
মেঘ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ও নিজের মতো ভাবতে লাগলো। এদিকে ধূসরের ভয়ে বুক কাঁপছে। তবুও আশা রেখেছে ধূসরের বিশ্বাস মেঘ ওর আব্বার কথা শুনে না বলবে না। মেঘ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,,
“আব্বা যেহেতু রাজি সেহেতু আমার কোন আপত্তি নেই। ”
বলেই মেঘ নিচে চলে গেল। এদিকে ধূসরের খুশি দেখে কে। ধূসর তিনবার আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠলো। তারপর খুশি মনে গেল সবাইকে জানাতে।
এদিকে মেঘ সরাসরি মেঘের আব্বার রুমে গেল। আয়মান চৌধুরী বোধহয় মেঘেরই অপেক্ষা করছিল। মেঘ গিয়েই বলল,,
“আব্বা আপনার কি মনে হয় আমার এখন বিয়ে করা উচিৎ?”
আয়মান চৌধুরী মেঘের এমন কথায় হাসলেন। সে যে তার বাবা তাতে কোন দেয়াল নেই। সব সরাসরি বলবে কোন ইতস্তত নেই। আয়মান চৌধুরী হেসে বললেন,,
“আপনার এই সময় বিয়ে করাটা পারফেক্ট বয়স বলেই মনে হচ্ছে।”
“আপুর বিয়ে হয় নি তো এখনো, সে আপনার বড় মেয়ে।”
“তার হয় নি কারন সে চায় নি। তাছাড়া আমরা এখন তাদের থেকে আলাদা রয়েছি। আপনি কি রাজি আম্মা। ধূসর ভালো ছেলে আপনাকে খুশি রাখবে ভালো রাখবে।”
“ড্রয়িংরুমের সব কথাই আমি শুনেছি আব্বা। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম তখন শুনেছি। আপনার যেহেতু কোন আপত্তি নেই আমারও আপত্তি নেই। তবে আমি এখনি সংসার জীবনে পদার্পণ করতে চাই না। আমার কিছুটা সময় লাগবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আপাতত আকদ করে রাখি। পরে না হয় একেবারে আনুষ্ঠানিকতা করা যাবে।”
“ঠিক আছে আব্বা! আপনি যেমনটা ভালো মনে করেন তবে আমি কিন্তু অনুষ্ঠান চাই না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আসলে মেঘ ড্রয়িংরুমে ধূসরের সব কথাই শুনেছে। তার ও ভালো লেগেছে এরকম লাইফ পার্টনার কে না চায়। তবুও ধূসরের সাথে একটু বাক্যল্যাপ করলো। মেঘ দেখতে চাইছিল ধূসর ওকে কিভাবে জানায় আর ওর ব্যাপারে কি মতামত। এদিকে ধূসর গিয়ে সবাইকে জানালো এহসান খান খুশি মনে আয়মান চৌধুরী কে ফোন করলেন এবং ডেট ঠিক করার জন্য কালকে বাড়িতে আসতে বললেন। তিনি মেঘের কথা জানালেন এতে কারো আপত্তি নেই। সামনে শুক্রবার আকদের অনুষ্ঠান রাখা হলো। আয়মান চৌধুরী সমশের চৌধুরী ও মায়মুনা চৌধুরী কে জানালেন কিন্তু তারা কেউ আসবে না বলে জানালেন। মেঘের সম্পর্কে তাদের কোন ইন্টারেস্ট নেই। ধূসর ভিশন খুশি। যেহেতু এখন আকদ হবে সেহেতু তেমন আনুষ্ঠানিকতা নেই। এহসান খান তার কাছের আত্মীয়দের জানালেন তারা আসবে বলে জানালো। মেঘের পক্ষে কেউ নেই তাই আয়মান চৌধুরী মেঘের বান্ধবীদের মেঘের পক্ষে থাকার জন্য বললেন। অতঃপর দেখতে দেখতে সেই কাঙ্খিত দিনের আগমন। সন্ধ্যায় ধূসর আর ধূসরদের আত্মীয় স্বজন এসে পরলো মেঘদের বাড়িতে। ধূসর নরমাল একটা সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছে। ধূসর মেঘের জন্য সাদা রঙের শাড়ি হিজাব নিকাব পাঠিয়েছে তাই ওগুলোই পরানো হয়েছে। প্রথমে সাদা রঙের শাড়ি শুনে অনেকে একটু কথা বললেও তখন ধূসর বলে দিয়েছে আমার বউকে আমি যে সাজে দেখতে চাইবো সেটাই সাজবে তাতে অন্য মানুষের কি। তারপর এটা নিয়ে কেউ কোন কথা বলেনি। ধূসরের পাগলামি দেখে ধূসরের পরিবার হেসেছে। অতঃপর মেঘকে আয়মান চৌধুরী নিয়ে এসে ধূসরের পাশে বসালেন। আজ মেঘের অন্যরকম ফিলিংস হচ্ছে। অদ্ভুত আনন্দ দিচ্ছে মেঘকে। তখন ধূসর ফিসফিস করে বলল,,,
“শুনছো নিষ্ঠুর মেয়ে আজ আমাদের বিয়ে!”
মেঘের কি হলো কে জানে? সে মাথানত করে মুচকি হাসলো। আর কেউ না দেখলেও ধূসর দেখলো। মেঘের পাশে আজ ওর আব্বা ছাড়া কেউ নেই। মেঘ এর খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ও প্রকাশ করছে না। আয়মান চৌধুরী মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে মেঘের হাত ধরলো মেঘ অসহায় চোখে ওর বাবার দিকে তাকালো। তারপর উঠে আয়মান চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরলো। দুই ফোঁটা বাবা মেয়ের চোখ থেকে পানি ও গড়িয়ে পরলো। কিন্তু দুজনে নিজেদের সামলিয়ে নিল। অতঃপর তিন কবুলের মাধ্যমে ধূসর আর মেঘ একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেল। সবাই আজ ভিশন খুশি সবথেকে বেশি ধূসর। তবে মেঘ খুশি কি না বোঝা যাচ্ছে না। অতঃপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সবাই ধূসর আর মেঘ কে রেখে চলে গেল। আজ ধূসর ওর শ্বশুরবাড়ি থাকবে। মেঘের বান্ধবীরাও থাকবে কারন এ বাড়িতে মেয়ে নেই। আজ নীলি ও মেঘের বান্ধবী হিসেবে মেঘদের বাড়িতে থাকবে। সবাই প্রথমে মানা করলেও নীলির বাচ্চামোর কাছে হার মেনেছে। মেঘ বসে আছে নিজের রুমে ধূসরের জন্য অপেক্ষা করছে। মেঘ আয়নায় নিজেকে পরখ করে নিল। সাদা শাড়ি আর সাদা হিজাব পরে আছে। নিকাবটা এখন নেই আর মুখে তেমন প্রসাধনী নেই। মেঘ এই দিনটাকে ভাবেও নি কোনদিন। অতঃপর ধূসর মেঘের বান্ধবীদের আবদার মিটিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। রুমে প্রবেশ করতেই বিছানায় সাদা শাড়ি আর হিজাব পরিহিতা মেয়েকে দেখতে পেল । ধূসর সালাম দিল মেঘ সালামের উত্তর নিল। ধূসর এগিয়ে গিয়ে মেঘের দিকে একটা খাম দিল মোহরানার টাকা। মেঘ ওটাকে নিয়ে একটা ড্রয়ারে রেখে দিল। ধূসর বলল,,
“ওযু করে আসো আমরা আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে আমাদের নতুন জীবন শুরু করবো।”
‘আমি ওযু করেই এসেছি জনাব আপনি ওযু করে আসুন।”
ধূসর ওযু করে আসলে দেখতে পেল মেঘ দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে রেখেছে । ধূসর গিয়ে সামনের টায় দাঁড়ালো তারপর দুজনে মিলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লো। রবের নিকট নিজের দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয় এই দোয়া করলো অতঃপর সবার জন্য দোয়া করে নামাজ শেষ করলো। মেঘ জায়নামাজ যথা স্থানে রেখে দিলো। ধূসর মেঘের মাথায় হাত রেখে রসুল (সা) এর দোয়া পড়ে ফুঁ দিল। মেঘ মনে মনে হাসলো। সকল কার্যক্রম শেষ। মেঘ এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। অনুভূতিরাও অদ্ভুত ভাবে দলা পাকাচ্ছে। ধূসর মেঘের হাত ধরলো তা দেখে মেঘ একটু চমকে উঠলো। তারপর ধূসরের দিকে তাকালো তখন ধূসর মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,,
“আমার অনেক দিনের শখ বউকে নিয়ে চন্দ্রবিলাস করবো। আমার কাঁধে মাথা রেখে আমার বউ চাঁদ দেখবে আর আমি আমার বউকে।”
~চলবে,,