#ধূসর_রাঙা_মেঘ
#পর্ব_৩৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
মেঘ চোখ খুলে প্রথমে ওর আব্বাকে দেখতে পেল। একহাত দিয়ে ওর হাত ধরে আছে আরেক হাত দিয়ে ওর মাথায় আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে। এটা ধূসরের ঘর। কিন্তু ঘরে আর কেউ নেই তা দেখে মেঘ বলে উঠলো,,
“আব্বা!”
মেঘ উঠে বসলো। আয়মান চৌধুরী মুচকি হেসে বলল,,
“তাহলে অজ্ঞান হওয়ার ওষুধ দ্বারা ঘুম কেমন হলো আম্মা!
এই মুহূর্তে আয়মান চৌধুরী মজা করা কথা শুনে মেঘ বিরস মুখে বলল,,
“কি জানি কোন অনুভুতি পেলাম না আব্বা! তবে শরীরটা বেশ ম্যাচম্যাচ করছে গোসল দিতে হবে। কেমন দূর্বল ও লাগছে।তা কয়ঘন্টা ঘুমালাম আব্বা?
“বেশি না আড়াই ঘন্টা। আপনাকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে আমরা সবাই ভিশন ভয় পেয়েছিলাম আম্মা। ধূসর তো পাগল প্রায় সব রেখে আপনাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়ায় ওখান থেকে জানতে পারলাম তেমন কিছু না অজ্ঞান করার ওষুধ দেওয়া হয়েছে যা আড়াই থেকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করবে।
“ওহ আচ্ছা! বাকিদের কি অবস্থা?”
“শেফালী খান কে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল গার্ডগুলো সেখান থেকেই পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে। আর অনিক এটার দায়িত্ব নিয়েছে। মূলত সব ধূসর করেছে।”
“ধূসর এখন কোথায়? তাছাড়া জাবিনরাও ওখানে ছিল।”
“সবাই এতক্ষন আপনার ঘরেই ছিল। সবাইকে জোর করে খেতে পাঠিয়েছি একটু আগে আর ধূসর গেছে নীলির একটা ইনজেকশন পুশ করার ছিল ওটা দিতে।এখনি আসবে।
“আপনি খেয়েছেন আব্বা?”
“আপনাকে এই অবস্থায় রেখে খাবো নাকি? তাছাড়া আমি আপনার সাথে খেতে চেয়েছি তাই আপনার ওঠার অপেক্ষা করছিলাম।’
“আমার ক্ষুদা লাগছে আব্বা!”
“আচ্ছা আমি নিচে গিয়ে আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি আজ আমি আপনাকে খায়িয়ে দেব। ”
“ধূসর ও খায় নি নিশ্চয়ই ওনার খাবার ও নিয়ে আসবেন সাথে ওনাকেও ডেকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু আব্বা এটা আপনার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এভাবে খাবার চেয়ে আনবেন এটা কেমন দেখাবে। এর থেকে আমি নিচে যাই ওখানেই একসাথে খাবো।
“বিছানা থেকে এক পা নেমেছো পা ভেঙ্গে রেখে দেব।”
হুট করেই ধূসরের গম্ভীর কথা শুনে মেঘ আর মেঘের বাবা দুজনেই চমকে উঠে। মেঘ হেঁসে বলল,,
“ওহ আপনি এসে পরেছেন আমি যেহেতু নামতে পারবোনা তাহলে আপনি খাবার নিয়ে আসুন আমার খুব ক্ষুদা লাগছে চারটা বাজে বুঝতে পারছেন।”
তখন ধূসর বলল,,
“আমাকে তোমার খাওয়ার তাড়া দেখিও না আমি জানি তোমার খাওয়া সম্পর্কে। তুমি এমন বলছো কারন তোমার আব্বা আর তোমার জামাই না খেয়ে আছে তাই।”
“তাহলে তো বুঝতেই পেরেছেন এখন যান খাবার নিয়ে আসুন!”
“দেখেছেন আব্বা আপনার মেয়ে আমাকে অর্ডার করছে?”
“এখানে অর্ডারের কি দেখলেন আপনিই তো নামলে পা ভেঙ্গে ফেলবেন বললেন। তাই আমি যাচ্ছি না তাছাড়া আব্বা মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এসে নিচে গিয়ে খাবার আনবে এটা কেমন দেখায় আপনার বাড়ি তাই আপনাকেই আনতে হবে তাই না, আমি তাই বলছিলাম।
“হয়ছে আর যুক্তি দেখাতে হবে না যাচ্ছি।”
ধূসর চলে গেল মেঘের হাসি খুশি মুখটা হুট করেই নিভে গেল আয়মান চৌধুরী মেঘকে পর্যবেক্ষন করে বলল,,
“আম্মা আপনি কি খুব কষ্টে আছেন আপনি তখন যে কথাগুলো বলে গেছিলেন তাতে আমি স্পষ্ট ভাবে বুঝেছি কিছু হয়েছে আম্মা কি হয়েছে আপনার।”
মেঘ বলল,,
“জীবনের এই কঠিন সমীকরনে আরো একবার হেরে গিয়েছি নিয়তির কাছে।”
“খুলে বলুন আম্মা!”
“আজ না আব্বা আজ থাক! এখন বলুন আমার ফোন ব্যাগ সব এনেছেন কি না?”
“জি সব এনেছি। আমি তো জানি আজ ফোন আপনার জন্য ইম্পোর্টেন্ট আর কেউ না জানুক আমি তো জানি আপনি কাজের জন্য কোথাও গেলে সবসময় অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং অন করে রাখেন।
“আজ ও করেছি তবে আজ শুধু অডিও না ভিডিও ও করেছি। তবে ওটা আমার ব্যাগের সাথে যুক্ত। অডিও আমার ফোনের সাথে যুক্ত সব মিলিয়ে পাকাপোক্ত প্রমান।”
“আজ কি হয়েছিল ওখানে?”
“ধূসর এসেও একই প্রশ্ন করবে তাছাড়া জাবিনরাও ছাড়বে না তাই সবাই আসুক একসাথে উত্তর দিই।”
তখনি ধূসর খাবার নিয়ে এলো সাথে দিলরুবা খানম মেঘের বান্ধবীরা আর বাকি সকলেই এলো। নীলি ঘুমাচ্ছে এখন ওষুধের জন্য নীল রিমঝিমের সাথে খেলছে তাই তারা আসেনি। সবাই ভেতরে ঢুকে একটাই প্রশ্ন এখন কেমন লাগছে আর এসব কি করে হলো?তখন মেঘ বলল,,
“নীলি সরি নীলাশা কোথায়?”
তখন দিলরুবা খানম বললেন,,
“নীলাশা তো ওষুধের জন্য ঘুমাচ্ছে ধূসর একটু আগে ওর ইনজেকশন দিয়ে এলো এখনো ঘুমে?”
“ভালো হয়েছে ! তা ও কি আমার ব্যাপারে কিছু জানে, না মানে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম আমি বিপদে আছি।”
“না তখন ও ঘুমাচ্ছিল জার্নি করে ক্লান্ত ছিল তাই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিল।”
“ওহ আচ্ছা তবে ঘুম থেকে উঠলে আমার ব্যাপারে ওকে কিছু জানাবেন না। এমনিতেও ও অসুস্থ আমি চাই না সব জেনে আরো অসুস্থ হোক।”
তখন ধূসর বলল,,
“ওখানে কি হয়েছিল সে টা তো বলো তোমার ফোন পেয়ে তো আব্বা আর আমরা সকলেই ভয় পেয়ে গেছিলাম। আব্বা প্রথমে না বলেই দিক বেদিক ছুটছিল বুঝতে পারলাম তুমি বিপদে আছো তাই আমি আর জাবিনরা পেছনে গিয়েছিলাম গাড়িতে আব্বা বলল তুমি শেফালী খানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে । কিন্তু ওখানে গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভয় পেয়েছিলাম কি হয়েছিল খুলে বলো?”
শেফালী খানের কথা মনে করতেই ওর ঘৃনায় শরীর রি রি করে উঠলো। নিজেকে যথা সম্ভব সংযত রেখে বলল,,
“আসলে শেফালী খান আমাকে কিছু বলবে বলে ডাকে আমিও যাই ওখানে গিয়ে জানতে পারি নিজের ছেলেকে বাঁচানোর জন্য উনি আমাকে পথ থেকে সরাতে চান । এতদিন ভালো মানুষের নাটক করতেন। উনিও আব্দুল কাদের এর সাথে অবৈধ ব্যবসা করেন। উনি আমার খাবারের ওষুধ মিশিয়ে দেন । কিছুক্ষণ পর আমি সেটা বুঝতে পারি তাই তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি নিই আর আব্বাকে কল করি। তখন উনি আরো দুজন লোক নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা ভেঙে আমাকে ধরতে আসে মাথায় পানি দিয়ে ওষুধের কাজ অনেকটাই কমে গেছিল আমি পরিস্কার সব দেখতে পাচ্ছিলাম।তাই তাদের দুজন কে মারতে থাকি তখন আরো কয়েকজন আসতে চায় শরীর দুর্বল তাই সবার সাথে ফাইট করা সম্ভব নয় তাই দৌড়ে গিয়ে রিভলবার বের করে সবাইকে ভয় দেখাই আর শেফালী খান কে শ্যুট করি আর তখনি আপনি আপনারা ওখানে পৌঁছান।”
মেঘ ইচ্ছে করে বাকি টুকু বললো না। শুধু পরেরটুকু বললো কারন এসব ওর মুখ দিয়ে সহজে বের হবে না। একজন নারী কতটা নিকৃষ্ট হলে এরকম কাজ করতে পারে । সব শুনে নোলক বলল,,
“বাপরে ভাবি তুমি তো বেশ সাহসী আমার সাথে এরকম হলে মাথায় পানি ঢালার কথা ভুলে আগেই অজ্ঞান হয়ে পরতাম।”
তখন দিলরুবা খানম বললেন,,
“আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া তুমি ঠিক আছো!”
তখন এহসান খান বলল,,
“কোন আব্দুল কাদেরের কথা বলছো?”
তখন ধূসর বলল,,
“ওহ বাবা তোমাকে বলা হয় নি তোমার বিজনেস পার্টনার আব্দুল কাদের। তোমার রোকনুজ্জামান এর কেসটার কথা মনে আছে ওনার সাথে মুখোশ পরে যে কথা বলছিল উনিই সে আমি আর মেঘ আমাদের বাড়িতে আসার পরেই হাতের ট্যাটু আর আংটি দেখে চিনে ফেলেছি তাছাড়া কন্ঠস্বর ও এক ছিল। মেঘ সেদিন নীলের ব্যাপারে কথা বলতে শেফালী খানের সঙ্গে দেখা করতে যেয়ে জানতে পারে ওনারা এখন হাজবেন্ড ওয়াইফ।”
“এতকিছু হয়ে গেলো আমাকে জানাও নি কেন?”
“এগুলো তো এই দুদিনের ঘটনা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।”
“ওহ আচ্ছা!”
এটুকু শুনে সবাই চলে গেল কারন মেঘরা খাবে এখন। জাবিনরা এখন বাড়ি যাবে তাই একেবারে বিদায় নিয়ে ওরা চলে গেল। সবাই যেতেই তখনি মেঘের ফোনে ফোন এলো। ধূসর দেখলো মেঘের এসিস্টেন্ট তাই ও ফোনটা মেঘের কাছে দিল মেঘ কথা বলে শেষে বলল,,
“ওয়েলডান!রাখছি কাল দেখা হচ্ছে।”
মেঘ ফোন নামিয়ে বলল,,
“সবকিছু একদিনে হবে ভাবতেই পারি নি আমি। পুলিশ আব্দুল কাদের কে ধরে ফেলেছে। কালকেই কেস কোর্টে উঠবে। তাছাড়া আকাশ এর কেসটাও কাল উঠবে সাথে আমারটাও। ”
“আব্দুল কাদের কে ধরলো কেন? না মানে তুমি?”
মেঘ হেসে বলল,,
“ব্যারিস্টার হওয়ার পর থেকে একটা বদ অভ্যাস হয়ে গেছে কারো সাথে কাজের কথা বলতে গেলে অডিও বা ভিডিও করছে রাখি। সেদিন শেফালী খানের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি আন্দাজ করেছিলাম ওখানে গিয়ে কিছু একটা জানতে পারবো তাই তাই অডিও রেকর্ডিং অন করে ওনার সাথে কথা বলি সব রেকর্ড হয়ে যায় এমনকি কাদের আকাশের ব্যাপারে বলে ওগুলোও। ওটার বেসিসে আমি এরেস্ট ওয়ারেন্ট বের করি কালকে আজ পুলিশ এরেস্ট করলো তাই।
“তোমার কোন জবাব নেই মেঘ ইউ আর এ জিনিয়াস।”
“এখন অনেক হয়েছে এবার খাওয়া শুরু করা যাক।”
“ওকে!”
আয়মান চৌধুরী মেঘের জন্য ভাত মাখিয়ে মেঘকে খায়িয়ে দিল।তা দেখে ধূসর বলল,,
“আব্বা শুধু কি আপনার মেয়েকেই খাওয়াবেন? আপনার ছেলেকে খাওয়াবেন না!”
তা শুনে আয়মান চৌধুরী বললেন,,
“তুমি কি আমার হাতে খেতে চাচ্ছো?”
“হুম মেঘের আব্বার হাতে খাওয়া যে পরম পাওয়া আর আমার শখ ও বলতে পারেন শ্বশুরের হাতে খাওয়া।”
আয়মান চৌধুরী হেসে ধূসরকেও খায়িয়ে দিলেন তখন মেঘ বলল,,
“ইতিহাসে কেউ কি দেখেছে কোন শ্বশুর তার মেয়ের জামাইকে ভাত মাখিয়ে খাওয়াচ্ছে !”
“দেখেনি বলেই তো দেখাচ্ছে লেখিকা!”
মেঘ হাসলো আয়মান চৌধুরী দু’জনকেই খাওয়াচ্ছে হুট করে ধূসর বলল,,
“শ্বশুর খায়িয়েছে জামাইকে! জামাইয়ের কি না খাওয়ালে চলে । আর আব্বা আপনি তো আমাদের দুজনকে শুধু খাওয়াচ্ছেন আপনি খাবেন কখন? হা করুন আমি আপনাকে খায়িয়ে দিচ্ছি।’
ধূসর ভাত মাখিয়ে সামনে ধরলো আয়মান চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠলো। এ অনুভুতির নাম নেই শুধু বোঝা যাচ্ছে খুব শান্তি অনুভূত হচ্ছে। অতঃপর তারা তিনজন একসাথে খাবার খেলো এতক্ষন মেঘ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি তার আব্বা আর তার জীবনসঙ্গী কে মুগ্ধ চোখে দেখছিল । প্রত্যেক জামাই শ্বশুরের সম্পর্ক যদি এমন হয় তবে বিষয়টা মন্দ নয়। খাবার খাওয়া শেষ করে মেঘ বলল,,
“হয়েছে আমি এখন গোসল করবো ভালো লাগছে না!”
আয়মান চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এখন উনি বাড়ি যাবেন। মেঘ উঠতে যাবে এমন সময় ধূসর বলল,,
‘আরে একা একা উঠছো কেন আমি তোমাকে সাহায্য করছি!”
‘আমি অসুস্থ নই ধূসর তাই এসব করতে হবে না আপনি এমন ভাব করছেন যেন আমি খুব অসুস্থ প্রথমটা মেনে নিয়েছি এখন আর মানতে পারলাম না।”
“আরে তুমি এমন কেন বলছো খুব কম সময় পাই বউয়ের সেবা করার আজ একটু করি না হয় বেশ তোমাকে ধরলাম না। তোমার জামাকাপড় বের করে দিচ্ছি ওটায় নিশ্চয়ই না করবে না।”
“আপনি এমন কেন ধূসর ?”
‘কেমন?”
“পাগল ডাক্তার!”
বলেই মেঘ হাসলো তখন ধূসর বলল,,
‘সারাজীবন এই পাগল ডাক্তার কেই সহ্য করতে হবে মেয়ে!”
মেঘ অস্ফুট আওয়াজ করে বলল,,
‘সারাজীবন!”
তা শুনে ধূসর বলল,,
“হ্যা সারাজীবন কেন তুমি কি আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে সংসার করার প্ল্যান করেছো নাকি এমন ভাবে সারাজীবন বললে মনে হলো সারাজীবন তুমি আমার সাথে থাকবে না।”
হুট করেই মেঘের ভেতরটা চমকে উঠলো মেঘ নিজেকে সামলিয়ে বলল,,
“বাজে কথা বন্ধ করুন বুঝলেন আমি যতদিন আছি ততদিন আপনার হয়েই থাকবো অন্য কারো না বুঝতে পারলেন। সরুন আমার জামাকাপড় বের করতে হবে না ওগুলো আমিই করে নিতে পারবো।”
মেঘ হনহন করে জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো তা দেখে ধূসর বলল,,
“আরে কি এমন বললাম যে রেগে গেল আমি না হয় একটু মজা করলাম তাই বলে সে রেগে যাবে। আরে তুই ও না ধূসর মজা করার জিনিস পেলি না তোর বউ তোকে ভালোবাসে তাই অন্যকারো কথা শুনে রেগে গেল তুই হলে তো আরো রাগ করতি। আচ্ছা যাই হোক মেঘ বেরুলে সরি বলতে হবে বউয়ের রাগ হয়েছে।”
বলেই মেঘ হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বউয়ের জন্য একটা স্ট্রং কফি বানানো যাক তারপর না হয় কফি দিয়ে আর ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে সরি বলা যাবে।
দশমিনিট পর মেঘ বের হলো ধূসর রঙের গোল জামা সাদা সালোয়ার আর সাদা রঙের ওরনা বেশ লাগছে। মেঘ গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালো হালকা বাতাস বইছে ও ভেজা চুল গুলো ছেড়ে দিল । চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবতে লাগলো হুট করে ধূসরের আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে পাশে তাকালো। ছোট্ট ট্রে তে একটা ছোট চিরকুট তার ওপরে গোলাপ তার পাশে দুই মগ কফি। ধূসর ট্রে টা মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,,
“দিস ইজ ফর ইউ মাই লাভলি ওয়াইফ!”
মেঘ হেসে বলল,,
“চিরকুট আর গোলাপ কেন?”
“চিরকুট টা খুলেই দেখো?”
মেঘ চিরকুট টা খুলে দেখলো তাতে একটা স্মাইল ইমুজি আঁকা তার নিচে SORRY লেখা। তার নিচে লেখা ‘তখন রাগানোর জন্য সরি ‘গোলাপটা নিয়ে এই বান্দা কে জানান আপনি তার সরি এক্সেপ্ট করেছেন।’
মেঘ হেসে গোলাপটা নিয়ে নাকে ধরলো গোলাপের সুবাস নিল তারপর ধূসরের দিকে হেঁসে বলল,,
“আমি তো রাগই করি নি সেখানে আবার সরি কেন?”
“তখন ওভাবে তাহলে চলে গেলে কেন?”
“ওটা তো এমনিই যাই হোক সবকিছুর জন্য শুকরিয়া জনাব।”
মেঘ এক মগ কফি নিল তারপর সেটা ধূসরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,
“দিস ইজ ফর ইউ! এটা নিয়ে আমাকে ধন্য করুন জনাব।””
“আরে বাহ তুমিও দেখছি ড্রামা করো!”
মেঘ ও আরেকটা মগ নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,,
“ড্রামা করতে পারি বলেই তো আমি একজন সুখী মানুষ।”
হুট করে মেঘের এমন কথায় ধূসর থমকে গেল কি আছে এই কথায় হুট করে ধূসর বলল,,
“তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো মেঘ!”
মেঘ ওর দিকে স্থির চোখে চেয়ে বলল,,
“যদি বলি হ্যা তাহলে?”
“কি হয়েছে মেঘ?”
“পথ শেষ হতে দিতে নাহি চাই তবুও যেন বিদায়ের হাতছানি!”
“মানে?”
তখন মেঘ হেসে বলল,,
“মানে কিছু না আপনি বিয়ের পর থেকে কিন্তু একটা জিনিস কমিয়ে দিয়েছেন?”
এ কথা শুনে ধূসর অবাক হয়ে বলল,,
“আমি আবার কি কমিয়ে দিলাম!”
“আজকাল মুখে ভালোবাসা প্রকাশ কমিয়ে দিয়েছেন নাকি এই নিষ্ঠুর মেয়েটার হাওয়া লেগেছে আপনার?”
“কি জানি বোধহয় নিষ্ঠুর মেয়েটার হাওয়াই লেগেছে আজকাল খুব কাছাকাছি থাকছে কি না।”
বলেই ধূসর হাসলো আর মেঘের হাত ধরে মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
জীবন মোহনার নীড়ে আমি চাই
থাকুক জীবন মেঘবালিকা জুড়ে,
ধূসর নামের তারারা আমি চাই
জরিয়ে থাকুক মেঘেরা।
ধূসর হাড়ায় ইচ্ছে ঘুড়ি
শুভ্রতা দিতে মেঘের সনে,
শোনো মেঘবালিকা তুমি,
যদি নাও মুখে করি ভালোবাসার প্রকাশ
তুমি তবুও সর্বদা থাকবে আমার মনে
হয়ে আমার প্রশান্তিময় বাতাস,
এই যে নিষ্ঠুর মেয়ে
আমি তোমায় খুব ভালোবাসি
সেটা প্রকাশ করি আর না করি
আমি সর্বদা তোমাকেই ভালোবাসি।
মেঘ মুগ্ধ চোখে ধূসরের কবিতা শুনলো ও যে এমন ভাবে বলবে ও ভাবতেই পারেনি। ধূসর হেসে বলল,,
“কি ম্যাডাম ওভাবে হা করে কি দেখছেন? নতুন করে প্রেমে পড়লেন নাকি?
মেঘ হেসে বলল,,
“কি জানি হঠাৎ করে ষোড়শী দের মতো অনুভূতি হচ্ছে বোধহয় নতুন করে আবার আপনার প্রেমে পড়লাম।”
“ও মাই আল্লাহ মেয়ে কি বলছে এই নিষ্ঠুর মেয়েটা আমার প্রেমে পড়েছে এ যে অবিশ্বাস্য!”
তখন মেঘ হেসে ধূসরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“ধূসর এহসান শুভ্র মানুষটাই এমন যার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখে এই নিষ্ঠুর মেয়েটা রোজ নিয়ম করে তার প্রেমে পড়ে।”
মেঘের কথা শুনে ধূসরকে অনেকটা মুগ্ধতা ঘিরে ধরলো।কিছু কিছু কথা মনকে একদম গলিয়ে দেয় ঠিক যেমনটা ধূসরের হলো এখন। ধূসর বলল,,
“আজ কফিতে বোধহয় মিষ্টি বেশি দিয়ে ফেলেছি তাই তো নিষ্ঠুর মেয়েটা এতো সুন্দর মিস্টি মিস্টি কথা বলছে।”
“উহু এটা কফির মিষ্টতা না এটা ধূসর এহসান শুভ্র এর মিষ্টতা। যার দরুন এই নিষ্ঠুর মেয়েটার মুখ থেকে এই মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হচ্ছে।”
মেঘ দুষ্ট হেসে বলল,,
“তাই বুঝি?”
মেঘ ওর দিকে তাকিয়েই বলল,,
“হয়তো আমি ধূসর রাঙা মেঘ
আপনি মেঘ রাঙা ধূসর গোধূলি!”
“বাহ বেশ বললে তো বিবিসাহেবা!”
“কথা বলতে বলতে কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। এখন যাই নীলির সাথে দেখা করে আসি। এতক্ষনে উঠে পড়েছে না উঠলে উঠাবো সমস্যা নেই।”
“আরো আরেকটু থাকো না বেশ লাগছিল তো!”
“একদিনে এত ভালোবাসা দেখালে ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে। দিন মগ দিন নাকি ঠান্ডা কফি খাবেন?
“সাধে তোমায় নিষ্ঠুর বলি শুনো মেয়ে ভালোবাসা বিস্তৃত এটা মানুষ টা সঠিক হলে কোনদিন ও কমেনা বরং ভালোবাসা বাড়ে। তোমাকে বলে লাভ নেই তুমি ,
ধূসর বলার আগেই মেঘ বলে উঠলো,,
“আমি নিষ্ঠুর মেয়ে কি না! জানি আমি আর বলতে হবে না মগ দিন।”
“দাঁড়াও একচুমুকে তোমার মতো ঠান্ডা কফি খেয়ে নিই। খাবার অপচয় ভালো না অপচয়কারী শয়তানের ভাই বুঝলে। তাছাড়া বউ আমার ঠান্ডা কফিই খেল যাতে খাবারটা অপচয় না হয় তাই আমারো খাওয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
“হুম আমাদের সবারই উচিত খাবার অপচয় না করা এমন কতো মানুষ আছে যারা তিন বেলা পেট পুরে খাবার পায় না। অথচ দেখুন কিছু কিছু মানুষ খাবারের অর্ধেক প্লেটেই রেখে দেয় খাবার অপচয় করে। তাছাড়া খাবার ও আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত আল্লাহর দেওয়া প্রদত্ত রিজিক। খাবার নষ্ট করা মানে নিজের বা অন্যের রিজিক নষ্ট করা। যাই হোক আসছি!
বলেই মেঘ মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে নিচে গেল। ধূসর শুধু দেখেই গেল। মেঘ নিচে গিয়ে মগ রাখলো তারপর নীলির ঘরে উঁকি মারলো নীলি উঠেছে মেঘকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে নিল তা দেখে মেঘ তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে ধরে বসিয়ে বলল,,
“আরে আস্তে আস্তে! তুই অসুস্থ ভুলে যাচ্ছিস!
নীলি বলল,,
“তুই তখন আমার ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলি তাই না।”
“ধূর পাগল তুই! তখন আমার একটা কাজ ছিল বুঝলি আমি কি এখন ছোট নাকি বড় হয়েছি শোরুম আছে একজন ব্যারিস্টার মানুষ কতকাজ থাকে এখন কি আগের মতো বেকার আছি নাকি। তুই তো জানিস না তোর এই বান্ধবী এখন বড় ব্যারিস্টার।”
“হুম জানি আমি জাবিনরা তুই যাওয়ার পর বলেছে।”
“ওহ আচ্ছা ভালো তা তোর ছেলে কোথায়?”
“মা একটু আগে এসেছিল বলল রিমঝিম এর সাথে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুই জানিস না তুই কি এখন বাড়ি ফিরলি নাকি?”
“হুম এখন ফিরে গোসল করলাম। তা মিস এখন আপনাকে কি বলে ডাকবো নীলি না নীলা?
“এক থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দেব । আমি সবার কাছে নীলাশা হলেও আমি তোর কাছে তোর বেস্ট ফ্রেন্ড নীলি হয়েই থাকতে চাই।”
“ওকে! তবে এখনো মারামারি ভুলিস নি দেখছি!”
“না ভুলিনি আচ্ছা তুই আমাকে সত্যি ঐ মিথ্যে বলার জন্য মাফ করে দিয়েছিস।”
মেঘ হেসে বলল,,
“ক্ষমা করা মহৎ গুণ আর মহান কাজ তোকে মাফ করে মহান মানুষ এর খাতায় নিজের নামটা লিখিয়ে নিলাম।”
“খুব কষ্ট পেয়েছিলি তাই না যখন বুঝতে পারলি আমি তোকে মিথ্যা বলেছিলাম।”
“একটু তো কষ্ট পেয়েছিলামই কারন নিজেকে বন্ধু হিসেবে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল কারন তুই আমাকে বিশ্বাস করতে পারিস নি। বন্ধুত্বের স্থাপনাটাই যে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে করা!”
নীলি মেঘকে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠল আর বলল,,
“তুই ব্যর্থ বন্ধু নোস ব্যার্থ তো আমি!”
“এই যে বোকা মেয়ে এখন আর কান্না শুরু করিস না অনেক কেঁদেছিস। আমি তো মাফ করে দিয়েছি এখন কাঁদলে কিন্তু বকা দেব!আর রাগ ও করবো।’
মেঘ নীলিকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,,
“কাল তোকে কোর্টে যেতে হবে কি কি হয়েছিল সেদিন রাতে সব বলতে হবে ।”
“কেন?”
মেঘ নীলিকে সব খুলে বললো। সব শুনে নীলি অবাক হয়ে গেল আর কেঁদে উঠল। আর বলল,,
“তার মানে ওরা আমার সোহেল কে মেরে ফেলেছে। আর আমি ভাবতাম ওটা এক্সিডেন্টে ছিল। আকাশ আমার ছেলেটাকে পিতৃহারা করেছে মেঘ ওকে ছাড়বি না ।”
মেঘ নীলিকে জরিয়ে ধরে বলল,,
“একদম কাঁদবি না ওকে শাস্তি দেব কঠিন শাস্তি শুধু ওকে না যারা যারা অন্যায় করেছে আমাদের সাথে সবাইকে কঠিন শাস্তি দেব।”
মেঘের কথা শুনে নীলি শান্ত হলো। মেঘ ওকে শান্ত করে বিভিন্ন পুরোনো কথা বললো যাতে নীলির মন ভালো হয়ে যায় তবে নীলি মেঘের হাসির মাঝে আগেকার সেই প্রান পেল না তা দেখে নীলি বলল,,
“কি হয়েছে মেঘ?”
মেঘ হেসে বলল,,
“আমার আবার কি হবে?”
“তোর এই হাসির মাঝে আমি প্রান কেন দেখতে পাচ্ছি না।আমাকে ভুল বুঝাবি না আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তোর সবকিছু আমার চেনা জানা এতবছর কাছে ছিলাম না দেখে এটা ভাবিস না আমি বুঝতে পারবো না তোর কোন হাসি জোর করে রে ফুটানো আর কোনটা প্রানবন্ত।”
মেঘের হাঁসি গায়েব হয়ে গেল ও নিজেকে সামলিয়ে বলল,,
“আসলে কালকের দিনটা নিয়ে টেনশন হচ্ছে তাই আর কিছু নয়!”
“সত্যি তো তাই!”
“হুম একদম সত্যি এখন তুই রেস্ট নে আমি আসছি! কিছু কাজ করতে হবে। নীল ঘুম থেকে উঠলে আমি তোর কাছে পাঠিয়ে দেব।”
“পালাচ্ছিস! আমি জানি আমার প্রশ্নের উত্তর এটা না। কারন তুই নিজে বলেছিস তোর কাছে সব প্রমান আছে।”
মেঘ হেসে বলল,,
“সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় দিতে হয় না সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।”
বলেই মেঘ চলে গেল। মেঘ নিজের রুমে আসলো ধূসর নেই রুমে হয়তো কোথাও গিয়েছে মেঘ আয়নায় নিজেকে দেখলো তখন বোধহয় আয়না থেকে কেউ ওকে বলল,,
“আমি অনেকরকম বোকা দেখেছি
কিন্তু তোমার মতো বোকা নয়,
যে যত্ন করে দুঃখ পুঁজি করে
ছোট নিজের মনিকোঠায়!”
~চলবে,,