(সামান্য ১৮+ পর্ব আজ)
ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৩
মাহিম বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজেছে। এসেই চন্দ্রিমার রুমে গিয়েছে। চন্দ্রিমার বাবা জালাল আবেদিন এবং মা জেরিন সুলতানা মেয়েকে দেখতে এসেছেন সন্ধ্যায়। তারা চন্দ্রিমার রুমেই আছেন। জোবাইদা বেগম ওনাদের জন্য চন্দ্রিমার রুমে জলখাবার পাঠিয়েছেন। সৌজন্য সাক্ষাৎও করে এসেছেন। মাহিমের বিয়ের বিষয়টি তারা সহজ ভাবে নেননি। কিন্তু চন্দ্রিমার সম্মতিতে হওয়ায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আজ এসেছেন চন্দ্রিমাকে কিছুদিনের জন্য নিয়ে যেতে।
“চন্দ্রিমা যেতে চাইলে আমার বলার কিছু নেই। তুমি যেতে চাও?”
“নাহ্। আমি ঠিক আছি।”
“মাহিম তো বললো ওর কোন সমস্যা নেই। তাহলে তুমি না কেন করছো চন্দ্রিমা? তোমার চেক-আপের সময়ও হয়েছে।”
জালাল আবেদিন সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন। জেরিন সুলতানাও মাথা নাড়েন।
“মাম্মি, আমি গেলে তোমারই কষ্ট হয়ে যাবে। দুস্থ মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য যে হাতের কাজের কারখানা শুরু করেছ, তা দাঁড়া করাতে সময় দিতে হবে। বুটিক হাউজের কাজেও সময় দিতে হয় তোমার। বাপিও নিজের কাজে ব্যস্ত। আমি এখানেই ঠিক আছি। ডাক্তারের কাছে মাহিম ফলো আপে নিয়ে যাবে।”
“ওনাদের সাথে গিয়ে দু’দিন থেকে আসো চন্দ্রিমা। তোমারও ভালো লাগবে বাবা মায়ের সাথে। ওনাদেরও ভালো লাগবে। দু’দিনে মেয়ের জন্য ওনাদের কাজের এমন কোন ক্ষতি হবে না।”
জোবাইদা বেগম এসে দরজায় দাঁড়িয়েছেন। জেরিন সুলতানা বেয়াইনের সামনে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। চন্দ্রিমার বিয়ের আগে যতটুকু কথা হয়েছে, ততটুকুতে বড় বাড়ির বড় বৌ হিসেবে নিপাট ভদ্রমহিলাই মনে হয়েছে। জেরিন সুলতানার মতো জোবাইদা বেগম সরাসরি বাহিরে কোন কাজে জড়িত নয়। পেছন হতে অবশ্য অনেক কিছুই করেন। বিয়ের পরও বেয়াইনকে অপছন্দ করার সরাসরি কোন কারণ পাননি। চন্দ্রিমাকে জোবাইদা বেগম ভালোবেসেই বাড়িতে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে যে তাদের সম্পর্ক শীতল হয়েছে এ বিষয়টা জেরিন সুলতানা বোঝেন। কিন্তু মেয়ে সরাসরি কিছু বলে না, জোবাইদা বেগমও পুত্রবধূকে নিয়ে কখনো কোন নালিশ করেননি। চন্দ্রিমার অসুস্থতাও সহজ ভাবে গ্রহণ করেছেন। অসুস্থ মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে গছিয়ে দিয়েছে বলে কোন অভিযোগও করেননি। জোবাইদা বেগমকে কখনোই রেগে চেঁচামেচি করতে দেখেননি। বরং ঠান্ডা স্বরে, নিচু গলায় কথা বলতে দেখেন। তার সমস্ত কার্যকলাপ ঘটে চুপচাপ। আজ ওনাদের এখানে ডেকে এনেছেনও জোবাইদা বেগম। ফোনে বলেছেন চন্দ্রিমার শরীরটা ভালো না। কিছুদিন বাবার বাড়ি থেকে আসলে ভালো হবে। ফোন রাখার আগে নিচু স্বরে ঠান্ডা গলায় বলেছেন, অসুস্থ স্ত্রীর দিকে নজর দিতে গিয়ে মাহিম নববধূকে সময় দিতে পারছে না। এতে চন্দ্রিমাও কষ্ট পাচ্ছে, মাহিমও কষ্ট পাচ্ছে। কিছুদিন গেলে চন্দ্রিমা আর মাহিম সবাই সম্পর্কের এই পরিবর্তনে মানিয়ে নিতে পারবে। সে পর্যন্ত চন্দ্রিমা তার বাবা মায়ের কাছে থাকলেই ভালো।
****
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। চৈতালীর জন্য সখিনা রুমে দুধ নিয়ে এসেছে। সখিনার ঠোঁটের কোণায় দাগ দেখেই বুঝতে পেরেছে যে জোবাইদা বেগম রুমে ডেকে নিয়ে সখিনাকে কী শাস্তি দিয়েছেন।
“থাপ্পড় খেয়েছ সখিনা?”
সখিনা চুপ করে থাকে। চৈতালীকে খুবই হালকা ভাবে নিয়েছিল সখিনা। তাদের চেয়ে খুব বড় অবস্থানের কেউ ভাবেনি। সেই চৈতালীর কথায় জোবাইদা বেগমের হাতে এমন বিরাশি সিক্কার চড় খাবে তা ভাবতেও পারেনি সখিনা।
“চুপ করে আছ কেন সখিনা? এমনিতে তো অনেক কথা বলো। তবে ভালো চুপ থাকাই ভালো। এখন থেকে প্রয়োজন ছাড়া কম কথা বলবা। কথা শুনবা, পেটে নিয়ে ঘুরবা। কিন্তু বলবা না। আজ চড় দিয়ে ঠোঁট কাটছে। কোনদিন টান দিয়ে জিহ্বটাই না ছিঁড়ে নেয় কেউ। বুঝেছ?”
সখিনা মাথা নেড়ে সায় দেয়। কেন জানি চৈতালীকে তার ভয় লাগছে। অথচ চৈতালী হাসিহাসি মুখ করে কথাগুলো বলছে। খুবই নিচু স্বরে। কেউ দেখলে ভাববে কাজের মেয়ের সাথে চমৎকার করে কথা বলছে চৈতালী।
“নাও, এটা রাখ। আমার সাথে ভালো করে চলবে। ভেজালে যাবে না। তাতে তোমার লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি।”
এক জোড়া কানের দুল সখিনার হাতে দেয় চৈতালী। আজ বিকেলে জোবাইদা শপিং এ নিয়ে গিয়েছিল। তখন টুকটাক এটা সেটা কেনার সময় এমন বেশকিছু দুল, চুড়ি কিনেছে। জোবাইদা বেগম অবাক হলেও মানা করেনি। দুলগুলো দামী না, কিন্তু সুন্দর। সখিনার সাজগোজের শখ আছে। নতুন দুল পেয়ে মন ভালো হয়ে যায় সখিনার। বোঝে চৈতালীর মন মতো চললে ভালোই থাকবে। সকালে দামী শাড়ি, এখন কানের দুল।
চৈতালী দুধ খেয়ে গ্লাস দিয়ে দেয়। সখিনা চলে গেলে পরনের সালোয়ার কামিজ বদলে নেয়। জোবাইদা বেগম চৈতালীকে পছন্দ করে নিজের চাহিদা অনুযায়ী অন্তর্বাস কিনতে বলেছেন। তখন এই রাত পোশাকটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে চৈতালীর। চন্দ্রিমাকে নিয়ে জালাল আবেদিন আর জেরিন সুলতানা বের হয়ে গিয়েছেন। মাহিম এখনও চন্দ্রিমার রুমেই আছে। এ রুমে আসবে কিনা জানে না চৈতালী। তবু রাত পোশাকটা পরে নেয়। এমন রাত পোশাক সিনেমার নায়িকাদের পরনে দেখেছে। চন্দ্রিমার পরনেও দেখেছে সুন্দর একটা রাত পোশাক। একদিন রাতে পানি খেতে উঠে দেখেছিল চন্দ্রিমা নিচে নেমে এসেছে রাত পোশাকে। গোলাপী গাউনের উপর ফুল হাতা কটি টাইপ ছিল, কোমরে ফিতে দিয়ে বাঁধা। চন্দ্রিমাকেও সিনেমার নায়িকাই মনে হচ্ছিল চৈতালীর কাছে। সেদিনের কথা মনে হলে চৈতালীর ইচ্ছে হতো যদি কখনো সুযোগ পায় এমন একটা পোশাক পরে দেখবে ওকে কেমন লাগে। কিন্তু এ ও ভাবতো, কোথাকার কোন ছাপোষা ঘরে তার বিয়ে হবে। সেখানে এসব জিনিসের চলই থাকবে না। মায়ের মতো সারাদিন যে সুতোর শাড়ি পরে কাজ করবে, তাই পরে ঘুমাতে হবে। আজ দোকানের মেয়েটাই ওকে বের করে ড্রেসগুলো দেখালো। এই কালো গাউনটা চৈতালীর খুব পছন্দ হয়েছে। তার গায়ের রঙ শ্যামলা, চন্দ্রিমার মতো সাদা নয়। কিন্তু কালো পোশাকে চৈতালীকে খুব মানায়।
আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখে চৈতালী। গলার কাছে পারফিউম স্প্রে করে। হাতে পায়ে লোশন মেখে নেয়। এসির হাওয়ায় রুমটা ঠান্ডা হয়ে আছে। তাও হাতকাটা গাউনের উপর কটিটা পরে না। রুমের আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে চৈতালী। আয়নার সামনে নিরালঙ্কার সাজে বসে থাকে। কার জন্য কিসের জন্য জানে না।
*****
মাহিম অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে চন্দ্রিমার খাটে শুয়ে ছিল। বাইরের পোশাকটা বদলে ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে নিয়েছে। জোবাইদা বেগম একবার এসে পাশে বসেছিলেন।
“মাহিম, তুমি বাচ্চা নও। যথেষ্ট প্রাপ্ত বয়স্ক একজন। চৈতালী বলা যায় তোমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো একটা মেয়ে। কিন্তু সেই মেয়ের মাঝে আমি তোমার আর চন্দ্রিমার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচুরিটি দেখতে পেয়েছি। তুমি আর চন্দ্রিমা যদি এমনই করবে, তবে এই বিয়েটা না করলেই হতো। আমরা কেউ তোমাদের গলায় ছুরি ধরিনি। এমনকি এই মেয়েকে তোমরাই পছন্দ করেছ।”
“তুমি ছুরি ধরোনি ঠিক। কিন্তু চন্দ্রিমাকে মানসিক চাপ দিয়েছ। বাধ্য করেছ এমন কিছুতে রাজি হতে। ও বাধ্য করেছে আমাকে। এখন কাকে কিভাবে গ্রহণ করবো সে বিষয়ে আর বাধ্য করো না। এইমাত্র বললে আমি ছোট ছেলে না। নিজের মতো থাকতে দাও প্লিজ।”
“আমি কোন চাপ দিচ্ছি না। তুমি পুরুষ মানুষ। নিজের চাহিদা, অধিকার সম্পর্কে ভালোই জানো বুঝ। বাকি আমার কিছু বলার নেই।”
****
খুট করে একটা শব্দ হয় দরজায়। চৈতালী চমকে উঠে তাকিয়ে দেখো মাহিম রুমে ঢুকছে। মাহিম ধরেই নিয়েছে চৈতালী ঘুমিয়ে গিয়েছে। রোজ তো আর এত রাত জাগবে না। এতক্ষণ চন্দ্রিমার রুমে বসে ভিডিও কলে ওর সাথে কথা বলছিল। রাত প্রায় একটা। রুমে ঢুকে আলো আঁধারিতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে যায় মাহিমও। অবচেতন মনে লাইট জ্বালিয়ে দেয়।
কালো রাত পোশাকে চৈতালীকে অচেনা এক নারী লাগছে মাহিমের। কালো চিকন ফিতার দু’পাশে উন্মুক্ত বাহু, পরিশ্রম করা মেদহীন শরীর, সদ্য তরুণী বয়সে পা রাখা চেহারার লাবণ্য, কালো দীর্ঘ লম্বা চুল, বড় বড় চোখ সবকিছু মিলিয়ে অন্য রকম সুন্দর। সৌন্দর্যে চন্দ্রিমার কোন তুলনা হয় না। কিন্তু এই রূপে চৈতালীর মতো মোহনীয় যেন নয় আর কেউ। কালো লেইস ভেদ করে চৈতালীর কণ্ঠহার যেন মাহিমকে আহ্বান করছে কাছে আসার জন্য।
নিজেকে সামলে নেয় মাহিম।
“তোমার ঠান্ডা লাগছে না?”
“জ্বি। ঠান্ডায় মনে হচ্ছে জ্বর এসে যাবে।”
মাহিম এগিয়ে এসে চৈতালীর বাহুতে হাত দেয়। প্রাণহীন শীতলতা বাহু জুড়ে।
“তবে এভাবে আছ কেন? গাউনের উপরের অংশ পরে নিতে। নাকি আমাকো আকর্ষণ করার জন্য?”
“আগে কখনো এমন পোশাক পরিনি। নিজেকে দেখতে ভালো লাগছিল। ঘোরের ভেতর ছিলাম। বুঝিনি এত ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ঠান্ডা বাতাস, না মাহিমের স্পর্শে, কেমন কেঁপে ওঠে চৈতালী। বুঝতে পারছে না, হঠাৎ এত ঠান্ডা লাগছে কেন? দাঁতে দাঁত কপাটি লেগে যাবে যেন ঠান্ডায়।
মাহি দু’হাতে জড়িয়ে নেয় চৈতালীকে। অবনত মাথাটা তুলে ধরে গভীর ভাবে চুমু বসায় চৈতালীর ঠোঁটে। চৈতালীর ঠান্ডা শরীর হঠাৎ মোমের মতো গলে যাচ্ছে। বাইরে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে তাদের ডাক। আরেকটা অদ্ভুত শব্দে গভীর রাত নামছে খান বাড়িতে।
(চলবে)
ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৪
মাহিন ধূমপায়ী না। না এলকোহলিক। এক হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস আর অন্য হাতে ধূম্র শলাকা নিয়ে উঁচুতলার মানুষদের যে দুঃখ বিলাসের ইমেজ আঁকা হয় নাটক, নভেলে। তাতে মাহিমের ইমেজ বসে না। এই যেমন এখন আঁধার বারান্দায় বসে হৃদয়ের জ্বালাপোড়ায় সে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বেদনা প্রকাশ করতে হাতে জ্বলন্ত শলাকা বা লাল পানীয়র পেয়ালা কিছুই নেই। আছে শুধু জ্বালা করতে থাকা শুষ্ক চোখ, অস্থির মন আর লিংকিং পার্ক ব্যান্ডের প্রিয় গান ” I tried so hard and got so far. But in the end it doesn’t even matter”
চোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে আধশোয়া হয়ে কানে ব্লুটুথ ইয়ারবাড গুঁজে গান শুনছে মাহিম। চৈতালী নাইটির উপর আলাদা গাউন চাপিয়ে নিয়েছে। যদিও সে চন্দ্রিমার মতো সুন্দরী নয়, তবু তার এই আঠারো উনিশ বছর তরুণী বয়সে নিজেকে এতটা ফেলনাও মনে হয়নি যে কোন পুরুষ এতটা কাছাকাছি পেয়েও তাকে গ্রহণ করবে না। নিজেকে কেমন জানি সস্তা আর অপাংক্তেয় মনে হচ্ছে। জোবাইদা বেগম, শিউলি দু’জনই তাকে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে মাহিমকে কাছে টানতে হবে তারই, মাহিমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে মাহিমের জীবনে নিজের জায়গা বানাতে হবে। সত্যি বলতে চৈতালীও তাই ই ভেবেছে। চন্দ্রিমার বরাবর নিজের অবস্থান বানাতে মাহিমের অধিকার আগে পেতে হবে এমনটাই তার ধারণা ছিল। শুরুটা হয়েছিলও চমৎকার ভাবে। মাহিম তাকে যখন গভীর ভাবে চুমু খেয়েছিল, তখনও এক মুহূর্তের জন্য চৈতালীর মনে হয়নি তার আর মাহিমের মাঝে এই শীতল কামরায় আর কেউ আছে। তারপরই মাহিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“রাত অনেক হয়েছে। ঘুমাও চৈতালী। এভাবেও কাছে আসা যায়। কিন্তু সেই কাছে আসায় শুধু শরীর থাকে। মন না। আমাকে এভাবে নিজের দিকে টানার চেষ্টা, আমার শরীরি আকর্ষণ সবই তোমার আমার, আমাদের দু’জনেরই মনের পরাজয় হয়। মনকে ছাপিয়ে শরীরের জয় হওয়াটা উচিত নয়। সেই আকর্ষণ সাময়িক।”
তারপরই বারান্দায় চলে যায় মাহিম। আকস্মিক প্রত্যাখ্যানে সংবেদনশীল তরুণী হৃদয় অপমানে জর্জরিত হয়েছে। গত কয়েকদিনে জীবনের এত পরিবর্তন মেনে নেওয়া চৈতালীর জন্য সহজ নয়। তবু কান্না করেনি। আজ যেন সব বাঁধ ভেঙে গেল। তারই ফলাফল চাপা কান্নার শব্দে রাত গভীর থেকে গভীর হয়েছে। কিন্তু যার জন্য এই চাপা অভিমান তাকে চুপচাপ বারান্দায় আধশোয়া হয়ে থাকতে দেখে একসময় নিজেকে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় চৈতালী। মুখে পানি ছিটিয়ে, কাপড় ঠিক করে বারান্দায় এসে মাহিমের মুখোমুখি বসে। চোখ খুলে তাকায় মাহিম।
“আই এম স্যরি চৈতালী। আমি তোমার নারীত্বের অহংকারে আঘাত করেছি। এভাবে রিজেকশন পাওয়াটা কারও জন্য সুখকর নয়। আমি তোমার জায়গায় হলে আমিও এটা মেনে নিতে পারতাম না যে আমার সঙ্গী আমাকে গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করছে।”
“আমি আসলে এত কঠিন কথা বুঝি না। আমার এত বয়স হয়নি যে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝবো। বা এতটা শিক্ষিতও এখনো হয়নি যে পড়ালেখার জ্ঞান থেকে বুঝবো। তবে হ্যাঁ অপমান লেগেছে। তাত্ক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল আমি কী এতটাই অসুন্দর। কিন্তু এখন ঠান্ডা মাথায় ভেবে বুঝেছি বিষয়টা সৌন্দর্যের নয়।”
“ঠিক তাই। তুমি নিঃসন্দেহে সুন্দর। ততটাই সুন্দর, যতটা সৌন্দর্যের জন্য বহু যুবক জীবন নামক এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জান বাজি রাখতে প্রস্তুত হবে। কিন্তু শুধু সৌন্দর্যের জন্য তো জান বাজি রাখা যায় না। তার জন্য ভালোবাসা প্রয়োজন। যার জন্য জীবন দেব, তাকে জানা বোঝা প্রয়োজন।”
“আমি যে সমাজ থেকে এসেছি, সেখান এসব কথা চলে না। তাই আমি জানি না। আমি যে সম্ভবত আমার বাবার আগের পক্ষের মেয়ে এটা কি আপনি জানেন?”
মাহিম একটা ধাক্কা খায়। এই কথা মাহিম জানতো না।
“কী বলো? তুমি শিউলী চাচীর মেয়ে নও?”
“নাহ। এই কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। এ বাড়িরও কেউ জানে বলেও আমার মনে হয় না। আমরা তো আপনাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নই। আমার ছোটোবেলায় আপনাদের সংস্পর্শে ছিলাম না। বিষয়টা সত্যি কিনা আমি নিশ্চিতও না। কারণ আব্বা আম্মা এই কথা আমার কাছে চেপে গিয়েছেন। আমি নিজে অনেক অনুসন্ধান করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। উপযুক্ত প্রমাণ নেই। তবে ধারণাগুলো ভুল নয়। আমার ছোটোবেলা থেকে আমি অনুভব করতাম আমাকে আমার নানাবাড়িতে সহজ করে গ্রহণ করে না। কিন্তু শফিক, শাহীনকে খুব আদর করে। আমি ছোটোবেলায় ভাবতাম হয়তো আমি মেয়ে বলে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় নদী ভাঙনে আব্বার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার বাহানায় আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। শফিক শাহীন ঠিকই স্কুলে যেত। আমি ঘরের কাজের পাশাপাশি মাঠেও সময় দিতাম। দুপুরে আব্বার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। তখন একদিন তেমনি এক দুপুরে খাবার নিয়ে একটু আগে বের হয়েছি। ক্ষেতের কাছাকাছি এসে আব্বাকে বোরখা পরে নেকাবে মুখ ঢেকে রাখা এক মহিলা সাথে গাছের আড়ালে কথা বলতে শুনি। মহিলা আব্বাকে বলছিল আব্বার বাকি দুটো সন্তানের সাথে আমার পার্থক্য করতে না। আমি কাজকর্ম করি, শিখি ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে একদম অশিক্ষিত করে রাখতে না।
মহিলার কথাবার্তায় মনে হলো সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ। আব্বা বললেন অনেক খরচ লেখাপড়া করানোয়। সেই মহিলা তখন আব্বাকে কিছু টাকা দেয়। জানি না তিনি কে ছিলেন। আব্বার সাথে সম্পর্ক কী। কিন্তু আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি সেই পরিবারে আমি হাতের একটা বাড়তি আঙ্গুলের মতো। রাখাও যায় না, ফেলাও যায় না। রাখলে বাজে লাগে দেখতে, কাটতে গেলেও খুব একটা লাভ নেই। আমি জানতাম, আজ হোক কাল হোক আমাকে এভাবেই বিয়ে দিয়ে পিছু ছাড়ানোর কাজ করবে। অনেক চেয়েছি এরপর খুব ভালো করে পড়ালেখা করতে। যেন আমাড পড়ালেখার খরচের জন্য আমাকে বিয়ে দিয়ে না দেয়। নিজের টিউশনির টাকায় পড়তাম, বাড়তিটা আম্মার হাতে দিতাম। কারণ মাথার উপর ছাদ আর পরিচয় দরকার। আপনার সাথে বিয়ের খবরে প্রথমে মনে হয়েছে পালিয়ে যাই। স্যারের আশ্বাসে পালালামও। কিন্তু সেখানেও দেখলাম একই ঘটনা। সবাই আমার শরীরের সর্বোচ্চ ব্যবহারই করতে চায়। আর কিছু না। যখন আপনি আমাকে ফিরিয়ে আনলেন, এবং বিয়ে করলেন তখন এই রুমে একা বাসর কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সারা জীবন এভাবে বাড়তি অংশ হয়ে কাটাতে পারি না। আপনার জীবনেও আমি সেই বাড়তি অংশ হিসেবেই যুক্ত হয়েছি। চন্দ্রিমা আপা আর আপনার জীবনে আমার গুরুত্ব হয়তো সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্তই। বাচ্চা হলে আমাকেই হয়তো সরিয়ে দিবেন জীবন থেকে আপনারা। তাই এক মুহুর্তে মোহে পড়ে গিয়েছি। ভেবেছি আপনাকে এমন কিছু দেই যা এখন আপা দিতে পারছে না। তাহলে আপনি আমাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন। শরীর দিয়ে তৈরি হওয়া সম্পর্ক ঠুনকো। আমি হয়তো সারাজীবন এমন উচ্ছিষ্ট রূপেই রইবো। আমার ধূসর কাবিনের মতো, আমার প্রণয় জীবনও ধূসরই রবে।”
পূব আকাশে ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কথায় কথায় রাত ভোর হতে চললো। এতক্ষণ মাহিম মন্ত্রমুগ্ধের মতো চৈতালীর কথা শুনছিল। আসলেই যার জুতো নেই, সে জুতোর শোকেই বিহ্বল থাকে। অপরের পদ না থাকাটা তার চোখে পড়ে না। মাহিম, নিজের আর চন্দ্রিমার জীবন নিয়ে এতটাই নিমগ্ন ছিল, চোখের সামনে চৈতালীর ভাঙাগড়া তার চোখেই পড়েনি।
“চৈতালী ভোর হতে চললো। সারারাত না ঘুমিয়ে থাকাটা অবশ্য বৃথা গেল না। তোমার গল্প আমি শুনলাম। আরেকটা রাতে আমার গল্পটা তোমাকে শোনাবো। কোন একদিন চন্দ্রিমার গল্পটাও শুনবে। তবে হয়তো আমাদের তুমি বুঝতে পারবে। চৈতালীর কোলের উপর থেকে হাতটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় নেয় মাহিম। একটা শ্বাস নিয়ে বলে,
” তুমি ভীষণ যোগ্য একটা মেয়ে। তোমার প্রতি আমার মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা বাড়ছে। কিন্তু সেই মুগ্ধতা এত বেশি নয় যে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলবো। আমার প্রতি তোমার রয়েছে ইনসিকিউরিটি, তোমার ভয় আমি তোমাকে যেকোন সময় জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলবো। তুমিও কিন্তু আমাকে ভালোবাসো না। সুতরাং আজকের এই ভোর থেকে আমরা নতুন শুরু করতে পারি। আমি তোমার বিশ্বাস অর্জন করি আগে। তারপর তোমাকে এমন কিছু কথা এভাবেই জানাতে চাই, যা জেনেশুনে বুঝে তুমি আমাকে গ্রহণ করবে, আমি তোমাকে। সে পর্যন্ত আমি আমার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করে যাব। আমি মন থেকে না পারি, বাহ্যিক ভাবে অবশ্যই তোমার আর চন্দ্রিমার মাঝে পার্থক্য করবো না। তুমিও নিজের লক্ষ্য ভুলো না। পড়ালেখা করতে চেয়েছ, তা করো। আমার সর্বাত্মক সাহায্য পাবে। চলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই। অন্ততঃ দু ঘন্টা না ঘুমালে আমি ফ্রেশ মাথায় কাজ করতে পারবো না। তোমারও বিশ্রাম প্রয়োজন।”
(চলবে)।