ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব-১১

0
663

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১১

“এত খাবার কার জন্য চৈতালী?”

“আমাদের জন্য আপা। শুনলাম আপনি আর মাহিম ভাই..স্যরি আগের অভ্যাস। মাহিম সাহেব এখানে নাস্তা করবেন। তাই আমার জন্য সহ নিয়ে আসলাম। এক সাথে বসে খাই।”

চৈতালী স্বাভাবিক ভাবে চন্দ্রিমার বারান্দার টি টেবিলটায় খাবারগুলো সাজাতে থাকে। চন্দ্রিমা অবাক হলেও মাহিম কিছু বলছে না দেখে নিজেও কিছু বলে না। মাহিমও চুপচাপ আছে। চৈ কী চাইছে বোঝার চেষ্টা করছে। চন্দ্রিমার স্যুপটা বাটিতে করে এগিয়ে দেয় চৈতালী। চন্দ্রিমার খাবার আলাদা, তেল মশলা ছাড়া খাবার। মাহিমের জন্য খাসির মাথা দিয়ে রান্না করা বুটের ডাল বেড়ে দেয়।

“আমি নিয়ে নিতে পারবো চৈতালী।”

“আমি দিচ্ছি। সালাদ এনেছি। চামচ দেব? পরোটা খাবেন না রুটি?”

চন্দ্রিমা চামুচ মুখে নিয়ে ছোটো ছোটো চুমুক দেয়। চৈতালী পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে চায়ে ডুবিয়ে মুখে দেয়।
ঘন দুধের চায়ে গরম পরোটা ডুবিয়ে খেতে চৈতালীর দারুণ লাগে। চন্দ্রিমারও এখন রাগ উঠছে না। কেমন মজা নিয়ে চৈতালীকে দেখছে।।বিচিত্র মানবমন।

“চৈতালী, তুমি কিছু বলতে চাও? মনে হচ্ছে কিছু বলার জন্য অপেক্ষায় আছ।”

“খাওয়া শেষ করে চা খেতে খেতে বলি? সখিনাকে একটু পর আপনাদের জন্য চা নিয়ে আসার কথা বলে রেখেছি।”

বলতে না বলতে ট্রে নিয়ে ঢুকে সখিনা। মাহিমের জন্য ব্লাক কফি এবং চন্দ্রিমার জন্য রং চা। চন্দ্রিমাট জন্য আরেক কাপ দুধ চা। সফিনা নাস্তার ট্রে নিয়ে বরে হয়ে যেতে চন্দ্রিমা বলে,
“তুমি অনেক চা খাও নাকি? এত দুধ চা স্বাস্থ্যসম্মত না। তোমার গায়ের রঙ আরও চাপা হয়ে যাবে। স্কিন খারাপ হবে।”

“আমার রঙ এমনিই কালো। আর কালো কী হবে আপা। মাশাল্লাহ আল্লাহ আপনাকে এত ফর্সা করেছে। আপনি দুধ চা খাবেন না কখনো। গায়ের রঙ ময়লা হবে। আমার সে ভয় নেই। স্বাস্থ্যও আমার ভালো আছে। আমি বাবার বাড়িতে ভোরে উঠে অনেক কাজ করে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস শেষে দুটো টিউশনি করে বাসায় আসতাম। আর স্কিনও আলহামদুলিল্লাহ ভালো। লাক্স সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে তিব্বত স্নো লাগাই। আর কোন ঘষামাজা নাই।তাও আলহামদুলিল্লাহ কখনো ব্রণ উঠে নাই।”

“চৈতালী তুমি একটু বেশি কথা বলো এটা আগে কোনদিন কেন বুঝিনি! গত কয়েকবছর তোমাকে দেখে মনে হয়নি যে এত কথা বলো। আশ্চর্য।”

“গত চার বছরে কখনো আমার সাথে বসে আপনারা কথা বলেছেন যে জানবেন আমি কেমন কথা বলি? বাবা মায়ের সাথে আসলে আমাদের নাস্তা হতো রান্নাঘরের টেবিলে। বাহির ঘরের টেলিভিশনে নাটক অনুষ্ঠান দেখা হতো। আপনাদের কথা, জীবন যাপন কোথাও কি আমার কোন অস্তিত্ব ছিল কোনদিন যে জানবেন আমি কেমন। ছয়মাস আগে মাথা ফেটে যাওয়ার পর আপনি আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন, ডাক্তার বলে কতগুলো টেস্ট করলেন। তখনই আমি অনেক অবাক হয়েছি। কিন্তু আপনার মানবতা দেখে খুব ভালো লাগছিল। এরপর থেকে আপনি আমি আসলে ডাকতেন, টুকটাক কথাবার্তা বলতেন। সম্পর্ক আছে কিনা, কোন অসুখ বিসুখ আছে কিনা জানতে চাইতেন। আমার ভালো লাগতো, আমি আপনার শুনতাম। কিন্তু মাহিম সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে আমাকে যাচাই বাছাই করছিলেন তা বুঝিনি। বুঝলে হয়তো তখন থেকেই কথা বলা শুরু করতাম। তাহলে সতীন হিসেবে আমি কেমন হবো আপনি বুঝতে পারতেন।”

চৈতালীর কথায় না ব্ল্যাক কফির তিতকুটে ভাবের জন্য কে জানে মাহিমের ভ্রু কুঁচকে যায়। চোখাচোখি হয় মাহিম এবং চন্দ্রিমার। বেশি কথা বলার অভ্যাস মাহিমের নেই। তবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। চৈতালীর জন্য তার মনে শতভাগ সিম্প্যাথি আছে। চাইবে ওর কোন ক্ষতি না করেই ওদের যা প্রয়োজন তা নিতে। কিন্তু তাই বলে একটা ইঁচড়েপাকা মেয়ের বেয়াদবি সইবে তাও হবে না।

“চৈতালী, তুমি স্মার্ট মেয়ে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তোমার গ্রুমিং প্রয়োজন। কাগজে কলমে তুমি এখন মাহিম আলী খানের স্ত্রী। হোক দ্বিতীয় স্ত্রী। যেহেতু আমার সাথে নাম জড়িয়েছে তাই আমি চাই তুমি ভাষা ব্যবহারে সংযত হবে। চন্দ্রিমাকে তুমি আপা হিসেবে সম্বোধন কর, বিষয়টা ঠিক আছে। এটাই বলবে। সতীন শব্দটা নয়। চন্দ্রিমার কাছে তুমি ম্যানার শিখবে। শিখবে কিভাবে উঁচু তলার মানুষদের সাথে মিশতে হয়, কথা বলতে হয়, ভদ্র আচরণ করতে হয়। না হলে আমার সত্যি আফসোস হবে যে ঐ তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে আনাই ভুল হয়েছে বলে। যার ভরসায় বের হয়েছিলে আজ তার কথা মতো কোন হোটেলে থাকাটাই তোমার জন্য সঠিক নিয়তি হতো। এরপর সত্যিকারের সতীন সতীন খেলা কী, তা তুমি বুঝতে পারতে।”

“ঐ যে, ঐ পেছনের গেট দিয়েই আমি বের হয়েছিলাম। বোরখা পরা থাকলেও আমার সাথে শফিক ছিল। দেখে বোঝার কথা শফিকের সাহায্য নিয়ে লুকিয়ে কে বের হচ্ছে। আপনি বেশিরভাগ সময় এই বারান্দায় থাকেন আপা তাই না? আমাকে দেখেছেন বের হতে। আমার পিছু পিছু কে গিয়েছিল? কাকে পাঠিয়েছিলেন আপা? ইদ্রিস ভাইকে? তখন গেটে ডিউটিতে ছিল হামিদ ভাই। ইদ্রিস ভাই বাগানে ওনার রুমে থাকার কথা। আমার না একবার মনে হয়েছিল যে কেউ পিছু নিয়েছে। কিন্তু টেনশনে ভালো করে ধরতে পারিনি কে ছিল। বাস স্টেশনের চায়ের দোকানে জামিল স্যারের বলা কথাগুলো ইদ্রিস ভাই জানিয়েছে? না মাহিম সাহেব নিজেই ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিলেন? গাড়ি নিয়ে আপনার ওখানে পৌঁছানো, শপিং সব তো কাকতালীয় নয় আমি নিজেও বুঝেছি। তাতে বোঝা যাচ্ছে আমি আপনাদের জন্য প্রয়োজনীয়।”

চায়ের চুমুক দিতে থাকা মাহিম বিষম খায়। চন্দ্রিমাও। চৈতালী যে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী তা বুঝতে বাকি থাকে না।

“দেখেন মাহিম সাহেবের বয়স আছে, সম্পদ আছে। দুটো কেন, চারটা বিয়েও করতে পারেন। আমার বাবা মায়ের মতো বহু বাবা মা স্বেচ্ছায় মেয়ে নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন। তারপরও আমাকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসা, দাদাজান আর বড় আম্মির সামনে আমার অপরাধ ঢেকে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর কোন দরকারই ছিল না। দাঁড়িয়েছেন যখন, তখন বলা যায় আমি একদম ফেলনা কেউ না আপনাদের জন্য। বাচ্চা তো এই পরিবারকে অন্য বৌ আনলেও দিতে পারতো। বরং বড়আম্মি তো আপনার জন্য সমানে সমান ছোটবৌ দেখছিলেন। রূপে গুণে আভিজাত্যে যে আপারই সমানে সমান হতো। তা বাদ দিয়ে যখন আমার মতো গরীব ঘরের, ম্যানারলেস, আটপৌরে চেহারার মেয়েকে আপা সতীন বানালেন, আপনি স্ত্রী বানালেন। তখন সব জেনেশুনেই বানিয়েছেন। তা নিয়ে অভিযোগ করলে তো হয় না।”

চন্দ্রিমা চৈতালীর হাতটা টেনে নিজের হাতে নেয়।

“চৈতালী, তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমরা কথা বলিনি।।অবশ্যই আমরা সব জেনে-বুঝে তোমাকে আমাদের জীবনে এনেছি। এর বিনিময়ে তুমি আর্থিক নিরাপত্তা পাবে। তোমার বাবা মা, ভাইদের জীবন ঠিকঠাক হবে। বলো এটা তুমি চাও না। কাল তো তুমিই মাহিমকে বলেছ বিয়ে না ভাঙতে। তুমি আর কোন তামাশা করবে না। তবে এখন এমন উগ্র আচরণ করলে তো হবে না। মাহিম তোমাকে এটাই শিখতে বলেছে। ভদ্রতা, নম্রতা, সংযত আচরণ।”

“আগে আপনারা আমাকে আপনাদের সমপর্যায়ে ভাবুন। তারপর আমিও সব শিখবো। আমার ভাই, মা বাবা এখন আমার জীবনের অংশ ততটা না যতটা মাহিম সাহেব। আমারও তাকে ততটাই পাওয়া উচিত যতটা আপনি পাবেন। শুধু আর্থিক নিরাপত্তা, পড়ালেখার সুযোগ নিয়েই কেন আমি সুখী থাকবো? স্ত্রী হিসেবে আমিও স্বামীর অধিকার চাই। ভালো তিনি আপনাকে বাসতেই পারেন। কিন্তু শরীয়ত মোতাবেকও তিনি দুই স্ত্রীতে সমবণ্টন করতে বাধ্য। আমাকে যা দিবেন, তাই তো পাবেন আপা।”

চৈতালী উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে,

“মাহিম সাহেব আমার মা বাবা টেবিলে খেতে বসায় সবাই উঠে চলে এসেছে। যেন তারা অচ্ছুৎ কেউ। চোখের সামনে এই আচরণ দেখে আমি শিখবো বলুন তো? ভদ্রলোকের আচরণ বুঝি এমন হয়। আজ আপার মা বাবা আসলে উপরের ঘরের এসি রুম খুলে দেওয়া হবে।আর আমার মা বাবা ভাইয়েরা একরুমে ফ্লোরিং করে থাকবে। খান বাড়ির ভদ্রতা, আভিজাত্যের উদাহরণ বুঝি এই? সকালে বড় আম্মি আমাকে পাঁচটা ভারী শাড়ি দিয়েছে। যার সবগুলোই ওনার শাড়ি। এক বৌয়ের জন্য ইন্ডিয়া থেকে বিয়ের শাড়ি আসে। আরেক বৌয়র জন্য নিজের পুরানো শাড়ি বের করে দেওয়া বুঝি ম্যানার? আপনারা যা চান সেই আচরণ আমাকে শেখাতে হলে তার উদাহরণও আপনাদেরই তৈরি করতে হবে। আমি আলমারির একটা অংশ আপনার জন্য আলাদা করে রেখেছি। যে তিনদিন আপনি আমার রুমে থাকবেন, তার কাপড় যেন আপনাকে এই রুম থেকে বারবার টেনে নিতে না হয়। তারজন্য সেখানে কিছু রেখে দিতে পারেন।”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে