ধূসর অনুভূতি পর্ব-১১+১২

0
1072

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১১+১২
লেখক: শাপলা

ঝিনুক মেহেদীর দিকে তাকালো।
বললো,কি বলতে চান খোলাখুলি ভাবে বলেন।এতো ঢং আমি পছন্দ করি না।
~কেন?ঢং করার অধিকার শুধু তোমারই আছে?
– আবার ঢঙের কথা। বিরক্তিকর।
~ আচ্ছা, এতোই যখন রিকোয়েস্ট করছো তাহলে বলি,আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিনুক!
– এই যে মেন্দিপাতা আপনাকে আমি মোটেও রিকোয়েস্ট করি নি ।আর,কি বললেন ভালোবাসেন?অমন ভালোবাসি বলতে বলতে কত ছেলের যে ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছে হিসাব নেই তাও এই ঝিনুক খান কারো দিকে ফিরেও তাকায়নি হুহ…
~ আর আমি এই মেহেদীকে দেখছো না ব্ল্যাক শার্ট পরে আছি।এই ব্ল্যাক শার্টের হাতা খানিকটা ফোল্ড করলে শ খানেক মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় হুহ…
– জ্বি তাতো হবেই। আপনার হাতের পশম তো অ্যামাজনের জঙ্গলের টুইন।যেকোনো মেয়েই ভয় পেয়ে অজ্ঞান হবে স্বাভাবিক। অজ্ঞান হওয়ার আগে বলবে,এই গরিলা হাতওয়ালা আদমিকে কেউ চিড়িয়াখানায় নেও…
~ গরিলা বলো আর শিম্পাঞ্জি বলো তুমি তো আবার আমাকেই ভালোবাসো…
– আপনাকে আমি কেন ভালোবাসবো?আজব…
~ বাসোনা ভালো? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতো।
– হাহা. …. সিনেমার এসব ডায়লগ কপি করে ক্লাস নাইনের মেয়ে পটানো যায় ইউনিভার্সিটির না।
~ তাহলে তুমিই বলো ঝিনুকমালা তুমি কি করলে ইমপ্রেস হবা?
– হায়রে…সেটাও নাকি আমি বলে দিবো… গান শোনান একটা…
~ নরমালি গান তো পারি না সেরকম।তবে গোসলখানায় মাঝে মাঝে গাই।
– ওহ তাহলে আপনার গান শুনতে হলে গোসলখানায় ঢুকতে হবে?
~ছিঃ না।অন্য কিছু বলো।দেখি পারি কিনা..
-তাহলে একটু নেচে দেখান…
মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, পারিনা।নেক্সট ..
ঝিনুক বললো,অন্তত কবিতা তো আবৃত্তি করতে পারেন?
~ ইয়ে চল চল চল,ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল এইটাই শুধু মনে আছে।তোমাকে এই মুহূর্তে যুদ্ধের কবিতা শোনানো তো ঠিক হবে না।
– আপনি তো দেখছি কিছুই পারেন না।
মেহেদী এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,উমম দুইটা কাটা সুতা যদি পাইতাম তাহলে তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাতাম।
ঝিনুক অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললো,ঐ যে কাটা সুতা জোড়া লাগানোর ম্যাজিকটা?
~ হুম। কিভাবে বুঝলা?
– জনাব ঐটা আমিও পারি।আপনাকে একটা ফ্রি এডভাইস দিই। আপনি একটা ক্লাস নাইন-টেনের মেয়ের পিছনে ঘুরেন যান। তাহলে সেই মেয়ে আপনার এসব ছাতার মাথা ম্যাজিক দেখে পটে যাবে বলবে,ওএমজি ভাইয়া ইউ আর সো গ্রেট।ইউ আর জুয়েল আইচ। বুঝলেন?
~ হুম ঠিক ই বলছো। গার্লফ্রেন্ড হিসাবে অবশ্য নাইন টেনের মেয়েরাই পারফেক্ট।
ঝিনুক চোখ বড়বড় করে তাকালো। মেহেদী এটা বলবে সে ভাবে নি।
মেহেদী হেসে বললো, কিন্তু আমার পোড়া চোখে তো তুমি ছাড়া আর কাউকেই ভাল্লাগে না…..
ঝিনুক অন্যদিকে তাকিয়ে হাসলো।বললো,এই সস্তার বস্তাপচা ডায়লগ দিয়ে লাভ নাই।এখনো ইমপ্রেস হইনি। কিছুই পারেন না আপনি।
মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ভাবলো। এরপর বললো, ঝিনুক আমি প্যারেড করতে পারি।কলেজে বিএনসিসি তে যুক্ত ছিলাম তো।
ঝিনুক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
সত্যি সত্যিই মেহেদী খানিকটা দূরে সরে গিয়ে প্যারেড করতে করতে ঝিনুকের দিকে এগিয়ে আসলো। এরপর স্যালুট দিলো।
ঝিনুক আর হাসি আটকে রাখতে পারল না। জোরে হেসে ফেললো।বললো,এই লেফট রাইট দেখে আপনার প্রেমে পরবো আমি?সো ফানি… মেহেদী বললো,বাট আমার মনে হয় তুমি আরো আগে থেকেই আমার প্রেমে পরে আছো। ঝিনুক বললো,উহু ভুল ধারণা। আচ্ছা,চলেন ঐ পানির ফোয়ারা টার কাছে যাই।
খানিক টা দূরে একটা আধ ভাঙা পুরানো আমলের পানির ফোয়ারা।পানি নিচে পরে গ্রাউন্ড ভিজে আছে।
মেহেদী বললো, ওখানে কেন?
ঝিনুক বললো, আসেন তো।
ওরা দুইজন সেখানে গেলো। ঝিনুক বললো,আপনি হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করেন।
মেহেদী বললো,যথা আজ্ঞা মহারানী।আমি বুঝতে পারছি আপনার মাথায় একটা ফাজলামি করার ফন্দি এসেছে।
ঝিনুক হাসতে হাসতে বললো, আচ্ছা আপনার হাত বাড়ান…আমি হাত ধরবো।
মেহেদী বললো, তুমি এতো ভালো মেয়ে না যে ভালোবেসে আমার হাত ধরবা।আমি এখন বুঝতে পারছি তোমার মাথায় কি প্ল্যান এসেছে, তুমি আমার হাত ধরে টেনে আমাকে ফোয়ারার পানিতে ফেলতে চাচ্ছো….আমাকে পানিতে ভিজিয়ে কষ্ট দিয়ে তুমি মজা পাবা….
ঝিনুক ব্যঙ্গ করে বললো,তাই?এতো কষ্ট বুঝে থাকলে আবার হাত বাড়িয়ে আছেন কেন?
মেহেদী বললো, তার আগে বলো পতঙ্গ কেন পুড়ে যাবে জেনেও আগুনের কাছে যায়?
ঝিনুক আবার হাসলো।”আপনি আমার সব প্ল্যান আগেভাগেই বুঝে ভেস্তে দিলেন।হইছে উঠে আসেন।”
খানিক ক্ষন পর ঝিনুক আবার বললো, আচ্ছা আপনার টোটাল কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল বলেন তো…
মেহেদী চেঁচিয়ে উঠলো,কিহহ?? গার্লফ্রেন্ড??
ঝিনুক বললো, কেন ছিল না।এতো চমকানোর কি আছে আকাশ থেকে পরলেন মনে হয়?
মেহেদী মাথা নিচু করে বললো,যেই প্রশ্ন করেছো শুনে মনে হচ্ছে আকাশ থেকেই পরলাম…
ঝিনুক আবার ব্যাঙ্গাত্মক সূরে বললো,আহারে তাই?আকাশ থেকে পরে আবার হাত পা ভাঙেন নি তো?
মেহেদী হেসে বললো,ভাঙলে সমস্যা কি? তুমি আছো না সেবা করবা।বউ….
ঝিনুক নিজেও হাসলো।বললো,ভাই রে ভাই আপনাকে আমি কি ভাবছিলাম আর আপনি আসলে কি…কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করছেন ফ্লার্ট করার উপরে?
~ কেন তুমি ভর্তি হতে চাও নাকি?
– প্লিজ ফাজলামি না আর…
~ ওকে সিরিয়াস বিষয়।তুমিও এখন আমাকে আই লাভ ইউ টু বলবে।বাট, তুমি তো মেয়ে নিশ্চয়ই লজ্জা পাবা বলতে, আমি বুঝি।একটা কাজ করো মুখে বলতে হবে না ঐ যে বাগানবিলাস ফুল গাছটা দেখছো তুমি যাও, গিয়ে ঐ গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ো।তাহলেই আমি বুঝবো তুমিও আমাকে ভালোবাসো।
ঝিনুক হেসে ছুটে গাছটার কাছে চলে গেলো। মেহেদী আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।
ঝিনুক গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকালো। এরপর, মেহেদীর দিকে তাকিয়ে হাসলো এবং হাত বাড়িয়ে ফুল ছুঁলো,ছিড়ে ফেলার ভান করলো কিন্তু ছিড়লো না।
মেহেদী বিষন্ন হয়ে বললো,আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি এতো মজা পাও কেন? তোমার কি মায়া নাই?
হঠাৎ করে ঝিনুক ঘাসের উপর বসে পড়ল।
মেহেদী প্রথমে ভাবলো ও সবসময়কার মতো নাটক করছে। কিন্তু, পরক্ষনেই খেয়াল করলো ও কাঁদছে।
মেহেদী দৌড়ে এসে ঝিনুকের পাশে বসলো।বলতে লাগলো,এই ঝিনুক কাঁদছো কেন?
ঝিনুক আরো জোরে কেঁদে উঠলো।”আমি শুধু তোমার বউ হতে চাই আর কারো না।”
এই প্রথম মেহেদী কে তুমি করে বললো ঝিনুক।মেহেদীর বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল।
সে বললো,এর জন্য কাঁদতে হয় নাকি পাগল মেয়ে… তুমি যদি বলো আমি তোমাকে এখনই বিয়ে করে ফেলবো ‌।
ঝিনুক বললো,তাই?এখুনি?এই আকাশ,বাতাস সাক্ষী রেখে,আর এই গাছটাকে কাজী বানিয়ে?
ঝিনুক হেসে উঠলো চোখের পানি মুছে।”আপনি আসলে একটা পাগল মেহেদী গাছ”
মেহেদীর একটু মন খারাপ লাগলো।ও সত্যিই অনেক ইমোশনাল হয়ে পরেছিল ঝিনুকের কান্না দেখে। কিন্তু, ঝিনুকের কান্না হাসির কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।এই কাঁদছে,এই হাসছে।
মেহেদী বললো,আসো অন্য কোথাও যাই।
ঝিনুক বললো, কোথায়?
মেহেদী বললো, আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায়।
ঝিনুক চোখ বড়বড় করে বললো, আপনার ফ্রেন্ড কি ফ্ল্যাটে থাকে?
~ হুম।নয়তো কই থাকবে?
– আচ্ছা কিছু মনে করবেন না আপনার ফ্রেন্ডের নাম কি লিটন?হাহহা..
মেহেদী ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পরলো।
~ ঝিনুক শোনো,আমার ফ্রেন্ডের নাম সামিরা..না যেতে চাইলে বলো অন্য কোথাও নিয়ে যাবো..লিটন,ফ্ল্যাট এসব কি শুরু করছো?
– রাগ করছেন কেন?আমি বুঝাতে চাইছি আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানেই যাবো।এমনকি লিটনের ফ্ল্যাটেও যাবো।
ঝিনুক অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসছে।
মেহেদী বললো,চলো বাড়ি যাই। তোমার জ্বর আসছে মেবি আবার..
– মেবি বলছেন কেন?একটু ছুঁয়ে দেখেন না জ্বর আসছে কিনা…নাকি আমাকে ছুঁলে আপনার জাত যাবে?
~ ঝিনুক তোমার কি হইছে বলবা?
– আমি পাগল হয়ে গেছি অধিক শোকে।একে তো ভাইয়া অসুস্থ তার উপর….
~ তার উপর কি?
– তার উপর আমি মেন্দিপাতা কে পাবো না এই দুঃখে পাগল হয়ে গেছি।
~ তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ঝিনুক।খুলে বলো তো কি হইছে…

– দুঃখের খবর যত দেরীতে শোনা যায় ততোই ভালো…
বলতে বলতে হঠাৎ ঝিনুক ঢলে পরে গেল ঘাসের উপর।
মেহেদী ঝিনুক কে ধরলো। মেয়েটার গায়ে কি ভীষণ জ্বর।পুড়ে যাচ্ছে একদম।
মেহেদীর মায়া লাগলো খুব।
মেহেদী সারাদিনের একটা প্ল্যান করে এসেছিল। এখান থেকে সামিরাদের বাসায় যাবে। সেখানে ঝিনুকের জন্য সারপ্রাইজ গিফট ছিলো।সামিরার বেকারি আছে। সেখান থেকেই মেহেদী ঝিনুক কে প্রপোজ করার জন্য কেক কিনেছিলো। ফুল, বেলুন এসব দিয়ে ঘর সাজিয়ে রাখবে সামিরা বলেছিল।
এরপর, ঝিনুক-কে নিয়ে মেহেদীর প্রিয় রেস্টুরেন্টে আর বিকালে শপিং করতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো।
মেহেদী ডাকলো,এই ঝিনুক… ঝিনুক…এতো জ্বর তোমার তুমি আমাকে বলবা না? এতোক্ষণ এই জ্বর নিয়েই এতো হাসাহাসি করেছো তুমি?
……
……
আপুর এতো জ্বর কিন্তু মায়ের তাতে কোনো বিকার নেই।মা বাদশাহ ভাইয়ার রুমে বসে বসে কাঁদছে আর মালিহা ভাবীকে দোষারোপ করছে।
আমি বললাম,মা ডাক্তার তো বলছে ভাইয়া তো ঠিকই আছে। তুমি খামোখা চিন্তা করছো কেন? ঝিনুক আপুর দিকেও একটু তাকাও….
মা বললো,ঐ মুখপুড়ির ঢং আমি সহ্য করতে পারবো না।ঢং করার জায়গা পায়না। স্বার্থপর কোথাকার… নিজের পরিবারের চিন্তা না করে ছেলে নিয়ে ঘুরতে যায় নির্লজ্জ মেয়ে…
আমি বললাম,মা তুমি এইভাবে কেন বলছো?
– তোর বোনের সব নাটক। বিয়ে ভাঙার জন্য।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিয়ে মানে কার বিয়ে?
মা পরিষ্কার করে কিছু বললো না।আমি অনেক অনুরোধ করে সবটা জানতে পারলাম বাবার কাছে।
আসলে আমাদের বাড়িটা বাবা আর বড়চাচা মিলে করেছেন। তিনতলার মোট ছয় ইউনিটের তিনটি বাবার আর তিনটি বড়চাচার…তবে,বড় চাচারা অনেক বছর ধরেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।তাই,পুরো বাড়িটাই আমার বাবা দেখভাল করেন। বাড়িভাড়াও সবটাই বাবা রাখেন।বড়চাচা কখনো চান না। কিন্তু, এখন কিছু দিন আগে উনি উনার অংশের বাড়িভাড়া চেয়ে বসেছেন। এদিকে আমার ভাইয়ার ও জব চলে গেলো,তার উপর উনার চিকিৎসার জন্যেও টাকা লাগবে।এই মুহূর্তে এমনিতেই আমাদের চলতে হিমশিম খেতে হবে তার উপর যদি বাড়িভাড়াও পুরোটা না পাওয়া যায় তাহলে তো আর কথাই নেই।বাবা সবকিছু বড়চাচাকে বুঝিয়ে বলেছেন। উনি সব শুনে উনার ছেলের সাথে ঝিনুক আপুর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন বাবার কাছে।
উনার আচরনে বুঝাই গেল উনি তখনই আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন যখন বাবা উনার প্রস্তাবে রাজি হবেন।
আরো দুই বছর আগেও তিনি এই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন।বাবা তখন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।কারণ উনার ছেলে শাহীন একটা নেশাগ্রস্ত….দেশে থাকতেও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আজে বাজে কাজে মেতে থাকতো।বাবা খুব রাগ করেছিল বড়চাচার উপর যে সে কোন আক্কেলে এই প্রস্তাব টা দিলো।এখনো হয়তো উনি সেই রাগ পুষে রেখেছে।অবশ্য উনার দাবি উনার ছেলে এখন ভালো হয়ে গেছে বিদেশ এসে।
তবে, উনার কথায় সত্যতা আদৌ আছে কিনা আমি জানি না।
বাবা এইবার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।কারণ,বড়চাচা এও বলেছেন তিনি ভাইয়ার চিকিৎসার খরচ বহন করবেন।
এ ছাড়া বাবার কাছে হয়তো উপায়ও ছিল না।
আমার খুব কষ্ট লাগলো খুব….
ইচ্ছা করলো চিৎকার করে কাঁদি….
এই শাহীন ভাই লোকটা যে কতটা খারাপ সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।উনি যখন ছাদের ঘরটায় থাকতেন আমি কখনো ছাদে উঠতাম না ভয়ে….
এই ছেলের সাথে ঝিনুক আপুর বিয়ে দিতে চায় বাবা-মা…
আমি আমাদের রুমে আসলাম।
ঝিনুক আপু শুয়ে ছিল।আমি আপুর পাশে শুয়ে পরলাম।আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।
আপু বললো, এমনিতেই আমি জ্বরে মরুভূমি হয়ে আছি তুই আবার ধরাধরি করে গরম টা আরো বাড়াচ্ছিস।
আমি বললাম,আপু তুমি কোনো চিন্তা করো না।আমি বিয়ে ভেঙে দিবো।
ঝিনুক আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।”এখনো ছোটই রয়ে গেলি যুথি। সবসময় বোকার মতো কথা বলিস…

চারদিন হাসপাতালে থাকার পর বাদশাহ ভাইয়া বাসায় এসেছে। তার মধ্যে,আর কোনো পাগলামির চিহ্ন দেখা যায় নি।যদিও ডাক্তার-রা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু, বাদশাহ ভাইয়া এক প্রকার জোর করেই চলে এসেছে।
তবে, বাসায় আসার পর থেকে তেমন কারো সাথে কথা বলছে না।একা একা রুমে বসে থাকছে সারাক্ষন। মেহেদী ভাইয়া এসেছে আমাদের বাসায় বাদশাহ ভাইয়ার খোঁজ নিতে।আসলে সে ঝিনুক আপুকে দেখতেই এসেছে আমি বুঝতে পারছি।খালি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝিনুক আপুকে খুঁজছে।
একপর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস ই করে ফেললো, ঝিনুক কই?
আমি কিছু বলার আগেই ঝিনুক আপু গোসলখানার দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,বলে দে ঝিনুক সাগরে।
বলেই হাসলো। মেহেদী ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, তোমার মুখে কি হলুদ বাটা দিছো?
ঝিনুক আপু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মেহেদী ভাইয়া বললো, কেন?
ঝিনুক আপু বললো, কেন আবার মা বললেন রূপ চর্চা করতে।
~তোমার না জ্বর , এখন এই সবের কি দরকার…
ঝিনুক আপু বললো,জ্বর বলে কি বিয়ের কনে-কে অসুন্দর লাগলে চলবে?
মেহেদী ভাইয়া কিছু বললো না।সম্ভবত সে ভেবেছে আপু তার স্বভাব মতো উল্টা পাল্টা কথা বলছে।
বিকালে আমি আর ঝিনুক আপু ছাদে গেলাম।
মেহেদী ভাইয়া আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,যুথি তোমার আপুর সাথে আমার একটু কথা আছে।
আমি লজ্জা পেয়ে খানিকটা দূরে সরে এলাম।
মেহেদী ভাইয়া বললো, ঝিনুক তুমি আর আমার রুমে আসো না কেন?আমি তো চাবি রেখেই যাই।
ঝিনুক আপু বললো, আপনার ঘরে আমি ঢুকবো কিসের জন্য?
মেহেদী ভাইয়া বললো,প্লিজ মজা করো না তো। তুমি আমার সাথে দেখা করছো না,ম্যাসেজ দিলে রিপ্লাই দিচ্ছো না।এমন করছো কেন?
ঝিনুক আপু বললো,আজব তো আপনার সাথে আমার এতো কথা বলতে হবে কেন?
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর হাত ধরে ফেলল। বললো, তুমি এমন করে কি মজা পাও?একটু সিরিয়াস হও দয়া করে।
ঝিনুক আপু ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, আপনার তো সাহস কম না, আমার হাত ধরছেন কোন সাহসে? অসভ্য।
ঝিনুক আপু দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে নেমে গেলো। মেহেদী ভাইয়া উদ্ভ্রান্তের মতো আমার দিকে তাকালো,বললো, তোমার আপু সারাক্ষন আমার সাথে মজা করে…
আমি বললাম, ভাইয়া আপুর কিন্তু সত্যিই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
মেহেদী ভাইয়া মনে হয় বুঝলো না আমার কথা।হেসে বললো, তোমার বোনের এসব ফাজলামির সাথে তুমিও যুক্ত আছো দেখছি।
আমি আর কিছু বললাম না।নেমে চলে এলাম।
ঘরে ঢুকে দেখি আপু একটা বই মুখের সামনে ধরে কাঁদছে।আমার এতো মায়া লাগলো।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,স্যাড একটা উপন্যাস পড়ছি।প্রথম পেইজ পড়েই চোখে পানি চলে আসলো বুঝলি…
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আপু বইটা উল্টা ধরে আছে।
এমন সময় মা প্রবেশ করলেন রুমে। আপুকে কাঁদতে দেখে বললেন,তোর চোখে পানি কেন?
ঝিনুক আপু বললো,তোমাকে বলে কোনো উপকার হবে না তাই বলতে চাইনা মা।
মা রাগী চোখে তাকালেন,কি উপকার চাস তুই শুনি? মেহেদীর সাথে বিয়ে দিতাম তোকে?বল না বল। জবাব দিচ্ছিস না কেন?
ঝিনুক আপু মাথা নিচু করে বললো,হ্যাঁ আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
মা অদ্ভুত ভাবে হাসলো, বিয়ের দরকার কি তোর? বিয়ের পরের কাজ তো আগেই সাইরা ফেলছিস ঐ ছোকড়ার সাথে।মনে করিস আমি কোনো খবর রাখি না? সারাদিন তুই যে ওর ঘরে থাকিস আমি কি জানি না মনে করছিস?
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,ছিঃ মা তুমি এসব কি বলছো?
মা আমার দিকে তাকালেন,তোর সাথে কথা বলছি আমি?তুই বের হ এখান থেকে….
ঝিনুক আপুর চোখে পানি টলমল করছে।
-কিরে জানোয়ার তোর চোখে পানি আসে কেন এত?
তোর সাত কপালের ভাগ্য তুই শাহীন কে বিয়ে করে উন্নত একটা দেশে থাকবি বুঝছিস? দুই দিনের পরিচয়ের ছেলের জন্য কান্দিস? মায়ের থেকেও বেশি হয়ে গেলো এই ছেলে?
ঝিনুক আপু বললো, তোমার আচরণ দেখে তো মাঝে মাঝে ভুলেই যাই তুমি আমার মা।
মা হঠাৎই খুব হিংস্র হয়ে উঠলো।
কিছু বুঝে উঠার আগেই আপুর চুল ধরে এলোপাথাড়ি কয়েকটা চড়-থাপ্পড় মারলো।
বাদশাহ ভাইয়া পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে ঝিনুক আপুকে জড়িয়ে ধরলো।
নাহয় আজকে আপুর খবরই ছিলো।মা আপুর দিকে তাকিয়ে বললো, সুন্দর ভাবে সেজে গুজে হাসিমুখে থাকবি।কালকে তোর চাচারা আসবেন,কোনো ধরনের বেফাঁস কথা যদি তোর মুখ দিয়া বেরোয় আমি যে তোরে কি করবো ঝিনুক…
মা বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,কি করছিস তুই?মা কেন তোকে মারলো?
ঝিনুক আপু বললো, কেন ভাইয়া?মা কিছু করতে পারে না? তোমার কেন মনে হয় আমিই কিছু করছি…আগেও তুমি সবসময় এমনই করতা।মালিহা ভাবী কিছু বললেই…….
আমি আপুকে চুপ করিয়ে দিলাম।
বাদশাহ ভাইয়া আর কিছুই বললো না। নিজের ঘরে চলে গেল।
.
পরদিন বাসায় তোড়জোড় চলতে লাগল।মা রান্না বান্না করছে।আমিও মাকে সাহায্য করছি।
বড় চাচা,চাচি আর শাহীন ভাইয়া এলেন সন্ধ্যায়।
ঝিনুক আপুকে পরী আপু এসে সাজিয়ে দিলো।
বাবা মন খারাপ করে বসে রইলো বারান্দায়।আমি আর মা বাবাকে ডাকতে গেলাম।দেখি বাবার চোখে পানি।বাবা বললো, শেষমেশ এ ছিলো আমার ঝিনুকের কপালে।একটা আস্ত লম্পট ও….
মা চেঁচিয়ে উঠলেন, তোমার মেয়ে কি ধোয়া তুলসী পাতা?কত বড়লোক ওরা তোমার ধারনা আছে? তোমার মতো তো ফকির না। ঝিনুকের ভাগ্য যে শাহীন ওকে পছন্দ করে।
বাবা মিনমিন করে বললো, আমার মেয়েটাকে বিদেশে নিয়ে মেরে ফেললেও তো আমি জানবো না।
হঠাৎ,শাহীন ভাইয়া বারান্দায় আসলো।
হাসি মুখে বললো,কি চাচা,এখন থেকেই কান্না শুরু করে দিয়েছেন…এখনো তো বিয়েই হয় নি।
আমি অবাক হলাম খুব…এতো বছর পরে কথা বলছে,না সালাম না কোনো কুশল বিনিময়।
শাহীন ভাইয়া তাকালো আমার দিকে।যেন বিষধর সাপের চাহনি।
হুট করে একটা ভয়াবহ স্মৃতি মনে পরলো আমার।তখন আমি অনেক ছোট। বাসার সবাই অর্থাৎ আমাদের আর শাহীন ভাইয়াদের পরিবার ফুপুর বাড়িতে গেছে। ফুপুর বাড়ি বেশি দূরে না। আমার বোরিং লাগছিল দেখে আমি চাবি নিয়ে বাসায় চলে আসি। হঠাৎ দেখি বড় চাচাদের ফ্ল্যাটে তালা নেই,ভিতর থেকে লক। উনাদের ফ্ল্যাট নিচ তলায় ছিলো।তাই, কৌতুহল বশত জানালার একটা ছোট ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিই।দেখি শাহীন ভাই আর একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে।বুঝাই যাচ্ছে মেয়েটাকে উনি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে।মেয়েটার মুখ বাঁধা ছিল।আর, শাহীন ভাইয়াকে দেখাচ্ছিলো একটা পশুর মতো।
সেই দৃশ্য আমার ছোট মনে কত প্রভাব ফেলেছিল আমি বলে বুঝাতে পারবো না। শাহীন ভাইয়ার কুকীর্তির অনেকখানি ই তার বাবা মা জানতো কিন্তু, কিছুই বলতো না। আবার,বললেও শাহীন ভাই পাত্তা দিতো না।কয়েক বার পুলিশের হাতেও পরতে হয়েছিল তাকে। ছাদের ঘরে প্রায়ই বন্ধু বান্ধব এনে মদ্যপানের প্রতিযোগিতা চলতো।এইসবই তো মা দেখেছেন। সবাই দেখেছে।তবুও, এখন নাকি বিদেশে গিয়ে শাহীন ভাই পুরো বদলে গেছেন। একদম খাঁটি মানুষ হয়ে গেছেন।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কুকুরের লেজ কি সোজা হয় কখনো?
বড় চাচা,চাচি বসার ঘরে বাবা মায়ের সাথে কথা বলছেন। তাদের কি কি স্বয়-সম্পত্তি হয়েছে সেইসব শুনাচ্ছেন আরকি।
হঠাৎ দেখি শাহীন ভাইয়া আমাদের রুমে প্রবেশ করলো। আমার আর আপুর দু’জনের ই কলিজা কেঁপে উঠলো।
শাহীন ভাইয়া হাসলো।কি কুৎসিত সেই হাসি।
বললো,কি ব্যাপার তোরা দুই বোন আমাকে দেখে এমন চুপসে গেলি কেনো?
আমরা কিছুই বললাম না। শাহীন ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,যা তো আমার আর ঝিনুকের জন্য দুইকাপ কফি বানিয়ে আন…নাকি তোদের বাসায় কফি নাই?হাহাহ…
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না উনি আমাকে এই ঘর থেকে সরাতে চাইছে। ঝিনুক আপুরও বুঝতে বাকি রইলো না।আপু আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকালো।তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে আমাকে এঘর থেকে না যেতে।
শাহীন ভাইয়া অগ্নিগরম চোখে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু,মুখে ঠিকই হাসি আছে।”কিরে যুথি কফি অনতে বললাম না।যা…”
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে যেতে লাগলাম।
শাহীন ভাইয়া আমাকে পিছু ডেকে হেসে বললো,কফি নিয়ে আবার দুই মিনিটের মধ্যেই চলে আসিস না বোকার মতো কেমন?
আমি কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার কাছেই। কিচেন এ গেলাম না আপু কে ফেলে।
শাহীন ভাইয়া ঝিনুক আপুকে বললো,তো ঝিনুক তোকে তো আবার তুমি বলতে করে বলতে হবে রাইট?
আচ্ছা,ঠিকাছে বলো জান তোমার তেজ কি এখনো আছে?নাকি এখন নিস্তেজ হয়ে গেছো?অবশ্য মেয়ে মানুষের তেজ দেখতে আমার ভালোই লাগে।
ঝিনুক আপু বললো,মানে বুঝতে পারছি না।
– মানে না বুঝার তো কিছু নেই। আমার নামে পুলিশের কাছে সাক্ষী দিয়েছিলা আমি মেয়ে আনছি বাসায় ভুলে গেছো? আবার আমাকে বলছিলা আমি কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট মনে নাই? এখন তো সেই কুকুরের বউ হবা তুমি… তোমার জন্য মায়াই লাগছে ঝিনুক। হাহা।
ঝিনুক আপু চুপ করে বসে রইলো। কোনো প্রতিউত্তর করলো না।
শাহীন ভাইয়া-ই আবার বলে উঠলো, এই গরমের মধ্যে ওড়না পেঁচিয়ে আছো কিসের জন্য?ওড়না সরিয়ে বসো আমার সামনে লজ্জা করে লাভ কি….
এরপর এমন একটা কুৎসিত কথা বললো যেটা আমার কানে আসার পর আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।
আমি ছুটে বসার ঘরে চলে এলাম।
মা কে ডেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম,মা শাহীন ভাইয়া আপুর রুমে বসে আছে কেন? বের হতে বলো।
মা নিস্পৃহ ভাব নিয়ে বলে উঠল, বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।এখন বসে থাকুক নাহয় শুয়ে থাকুক তুই দেখতে যাস কিসের জন্য?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।”মা তুমি যে এমন আমি কল্পনাই করতে পারিনি।”
– কেমন আমি? খারাপ? তোর বোন ভালো? মেহেদীর সাথে রুমের মধ্যে ঢলাঢলি করছিল আর তুই বাইরে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিলি কই তখন তো এসে বলিস নি আমাকে….
আমি বললাম, চুপ করো মা। তোমার কন্ঠ শুনতেও আমার মন চাচ্ছে না।
– শোন যুথি। বিয়ের পর সুখে থাকতে হলে একটা জিনিস ই লাগে সেটা হলো টাকা।যেটা বিয়ের আগে তোদের বয়সী ছেলে মেয়েরা বোঝে না…
-প্লিজ তুমি যাও।
মা চলে গেলেন। হঠাৎ দেখি শাহীন ভাইয়া দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলাম।
বসার ঘরে সবাই কথা বলছিল ,সেখানে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। হঠাৎ করেই,দরজায় কে যেন পাগলের মতো বেল বাজাতে লাগলো।
মা গিয়ে দরজা খুললো। মেহেদী ভাইয়া হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো।মা বিরক্ত হয়ে বলল,এখন যাও তুমি মেহেদী।পরে এসো…
আমি ই মেহেদী ভাইয়া কে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম।
মেহেদী ভাইয়া চেঁচিয়ে উঠলো,”ঝিনুক কই?কই আমার ঝিনুক?”
.
চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে