#ধারণার_অতীত [০৫]
রাফান নিজেও ভীষণ ভয় পাচ্ছে। কারণ সে তার মাকে খুব ভালো করে চিনে। যদি আমাদের পরিকল্পনায় কোনো প্রকার ভুল হয় আর উনি সেটা টের পান তাহলে আমাদের দুজনকেই আজীবনের জন্য বিচ্ছেদ বরণ করে নিতে হবে। দুজন দুজনকে ভালোবেসেও হারাবো।
শ্রেয়াকে দেখার জন্য রাদিফ ভাইয়া তার আম্মু আর আব্বুকে সাথে নিলো। এইবার আর রাফানের মাকে নেয়নি। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে আসার কারণ একটাই ছিলো, উনি নিজে সেখানে ঘটকালির দায়িত্ব নিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেটা তো হয়েই উঠেনি।
এদিকে আমার আম্মুকে শ্রেয়ার মা খুব জোর করছিলো যাতে সেখানে উপস্থিত থাকে। কিন্তু আমার আম্মু যায়নি, আম্মুরও ভয় ছিলো ধরা পড়ে যায় কিনা? রাদিফ ভাইয়ার মা আমার আম্মুকে শ্রেয়াদের বাসায় দেখলে অনেক বড় তোলপাড় কান্ড হতে পারে আমাদের ধারণা ছিলো। নিশ্চিত উনি বুঝে যাবেন দুই ঘটনায় কোনো চক্রান্ত আছে। আগের পাত্রীর মা আবার সেখানেও উপস্থিত, কেমন না বিষয়টা?
তাই আম্মু অনেক অজুহাত দেখিয়ে বারণ করেছেন আমাদের পরিবার থেকে কেউ পাত্রী দেখার দিন যেতে পারবেনা, এমনকি শ্রেয়াদেরকে বলে দিছে আমাদের পরিবারের কথা যেন উল্লেখও না করে। শ্রেয়ার মা এর কারণ জানতে চাইলে আম্মু বললো, কোনো একটা গোপন সমস্যা আছে। শ্রেয়ার মা আর কিছু বলতে পারেনি, যেমন বললো তাতেই সম্মতি দিলো। মানুষের মধ্যে অনেক প্রকার দ্বন্ধই তো থাকে। বিষয়টা নিয়ে আর সমস্যা হয়নি৷
আর ভালো মতোই ব্যপারটার সমাধান হলো!
রাদিফ এবং রাদিফের পরিবার শ্রেয়াকে দেখলো, তাদের পছন্দ হলো। রাদিফের মা শ্রেয়ার পরিবার দেখে খুব পছন্দ করলেন। খান্দানী বংশের ভালো মেয়ে, হোক না একটু কালো।
তবে রাদিফ ভাইয়ার ভাষ্যমতে উনার মা নাকি বারবার বলছিলো শ্রেয়ার সাথে আলাদা করে কথা বলবে। কোনোভাবেই উনাকে মানিয়ে রাখা যাচ্ছিলোনা। শেষ পর্যন্ত নাকি উনি বাধ্য হয়ে উনার বাবাকে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন, পরে উনাকে রাদিফ ভাইয়ার বাবা নিজে আটকেছেন। উনার বাবা মানুষ হিসেবে অনেক সরল আর ফ্রেন্ডলি।
আমি বুঝতে পারছিলাম এমন একটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিলো, উনি উনার সন্দেহ দূর করতে হলেও মেয়েকে উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করে প্রমাণ চাইবেন৷ কিন্তু সেটা আর পারেন নি৷ তার আগেই বিয়ের তারিখ ঠিক করে আসতে হয়েছে। যেমনটা ভেবেছিলাম,তেমনটাই হয়েছে। শ্রেয়ার বাবাও সুন্দরমতো দ্রুতই বিয়ের জন্য রাজী হয়ে গেছে।
না হওয়ার কোনো কারণও নেই, পাত্র বেশ যথাযথ বটে। আগামী ৫ দিন পরেই বিয়ের তারিখ ফিক্সড হয়েছে৷
একদিন যাওয়ার পরেই রাফানের মা আমাদের ঘরের নাম্বারে ফোন দিলো, আমি আর আম্মু একসাথে ছিলাম। আব্বু অন্য রুমে থাকাতে আম্মু আব্বুকে না ডেকে নিজেই রিসিভ করলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পরেই রাফানের মা বলতে লাগলো,
‘ আসলে একটা সংবাদ দিতে আসলাম। ওই রাদিফ ছেলেটা অবশেষে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেই নিচ্ছে। চলুন না আমরাও বিয়ের কাজটা এগিয়ে ফেলি? আপনার মেয়েকে খুব দ্রুত আমার ঘরে নিয়ে আসতে চাই।
আমার আম্মু দ্রুত আব্বুকে ডাকলো, আম্মুর ডাকডাকিতে আব্বু সন্ধ্যার সংবাদটা শেষ না করেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। আম্মু ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ এবার তো আপাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানান।
নেন কথা বলেন।
আব্বু গলা ঝেড়ে ফোন ধরলেন। তারপর উচ্চশব্দে বললেন,
‘ জ্বী জ্বী আপা! আমাকে জানানোর পরে আমি বসে ছিলাম এমন না। আমি তো গোপনে আপনার ছেলের অনেক খোঁজ নিলাম। তার ইউনিভার্সিটি, ক্যাম্পাস, যেখানে থাকে সবখানে সমান গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ নিয়েছি। কারণ এবার কাউকে ভরসা করে মেয়ে দেখাবোনা। আগে ছেলে দেখবো এরপর মেয়ে দেখাবো।
রাফানের মা জবাব দিলো,
‘ আমার ছেলেকে আপনি দেখেছেন, তাহলে আমি শিউর আপনার সম্মতি হ্যাঁ হবে । কারণ আমার ছেলেকে খারাপ বলবে এমন মানুষ নেই।
আব্বু নাক উপরে তুলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। মা আর আমি পুরো ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম কোনো গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ মিথ্যা হলোনা, বাবা বলে উঠলো…
‘ হ্যাঁ ভালো করেই জেনেছি আপনার ছেলে ৪ বছর যাবৎ একটা সম্পর্কে জড়িত আছে। সেই মেয়েকে সে পৃথিবী বদলে গেলেও ছাড়তে পারবেনা। না মানে ওর বন্ধুরা সেভাবেই আমাকে বললো। আরো বললো সেই মেয়েকে তার মায়ের যথাযোগ্য করার যাবতীয় চেষ্টা সে করছে। এমনিতে খারাপ বলেনি কেউ।
রাফানের মা নিশ্চুপ। উনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছেন। আমার আব্বু হাসতে হাসতে বললেন,
‘ আপা ছেলেকে ভালো করে জিজ্ঞাসা করেন। এতো ভরসা করে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিবেন না। পরিণতি ভালো হবে না। তবে আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে আপনার ছেলে সম্পর্কে যা শুনেছি সব মিথ্যা, তাহলে আমি নির্দ্বিধায় মেয়ে তুলে দিবো। কিন্তু বাবা হয়ে মেয়ের জীবনের ঝুঁকি নিতে আমি রাজী নই। দেখা যাবে বিয়ে দিলাম আর মেয়ের জামাই পরকীয়া করছে।
রাফানের মা সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলো।
আমি আর আম্মু পুরো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বু এইসব খবরাখবর কখন নিলো? আমরা কিচ্ছু জানলাম না পর্যন্ত।
ওর ইউনিভার্সিটির কোন বন্ধু বাবাকে এসব বলেছে? আর সম্পর্ক তো ৪ বছর ধরে আমার সাথেই! এখন এই কথা কীভাবে বাবাকে বুঝাই? আমি আম্মু দিকে তাকাতেই আম্মু আমাকে চিন্তা না করার ইশারা করলো। আমি আস্তে আস্তে রুমে চলে গেলাম।
আমার মনে হচ্ছে রাফানের উপর দিয়ে খুব ঝড় যাবে। উনি খুব বকা দিবেন। এই সময় ফোন দিলে যদি আবার উনি ধরেন আরো ফেঁসে যাবো। এমনও আছে ফোন নিয়ে বসে থাকবেন কোন মেয়ের সাথে প্রেম সেটা পরখ করার জন্য।
চিন্তায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।
শুধু বারবার আম্মুর কাছে গিয়ে বসছিলাম আর নিজের রুমে আসছিলাম। রাফানও আমাকে একটা কল করলোনা।
বাধ্য হয়ে আমি ১২ টায় নক দিলাম,
‘ রাফান তুমি ঠিক আছো?
কিন্তু কোনো জবাব নাই। ১২ টায় তো রাফান সবসময় ফোনে থাকে। আজকে কি এমন হলো? এখনো আন্টি ফোন চেক দিতে বসে নেই তো? ভয়ে সরাসরি কল করছিনা।
সারারাত গেলো রাফানের কোনো খোঁজ পেলাম না। পরেরদিন সকাল ১১ টায় অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো, আমি রিসিভ করতেই রাফান বলে উঠলো,
‘ আমার ফোনটা গতকাল বাজার থেকে ছিনতাই হয়ে গেছে। আমি তোমার সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ হঠাৎ ছিনতাই? তোমার আম্মু নেয়নি তো?
রাফান হাসতে হাসতে বললো,
‘ আম্মু নিবে কেন? অবশ্য আম্মুকে ছিনতাই হওয়ার কথা বলার পরে কিছু বলেনি। থানায় একটা জিডি করেছি। আগের নাম্বারটা এখনো তুলিনি, এটা নতুন নিলাম। ফোনও নতুন।
আমি বিরবির করে বললাম,
‘ তোমার আম্মু কি কালকে একটু অন্য রকম আচরণ করেছিলো?
রাফান জবাব দিলো,
‘ নাতো। কেন এই প্রশ্ন?
আমি জবাব দিলাম,
‘ এমনি। আচ্ছা দেখা হলে কিছু বলবো। তুমি শ্রেয়ার বিয়েতে তো আসছো তাইনা?
রাফান বললো,
‘ অবশ্যই আসছি। আম্মুও আসবে।
আমি একটু ভয় পেলাম। রাফান সেটা বুঝতে পেরে বললো,
‘ আরে তুমি শ্রেয়ার বন্ধু এটা জানলে কিচ্ছু হবে না। বন্ধু তো কতজনই হতে পারে তাইনা? পাত্রী দেখার সময় চিনলে সমস্যা ছিলো, সন্দেহ করার প্রবণতা ছিলো। এখন কিচ্ছু হবে না। আর জানো রাদি ভাই শ্রেয়াকে মন থেকেই অনেক পছন্দ করেছে, বলে ওই মেয়েটা শ্যাম বর্ণের হলেও নাকি প্রথম দেখাতেই দৃষ্টির মায়ায় ভাইকে আবদ্ধ করে ফেলেছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছে ভালো কাউকে এতো দ্রুত বের করে দেওয়ার জন্য।
আমি মুচকি হাসলাম।
অবশেষে বিয়েরদিন। রাফানের কথামতো ওর পছন্দের রঙের লেহেঙ্গা কিনেছি। গায়ে হলুদেও আমি শ্রেয়াদের বাসাতেই ছিলাম।
কয়েকটাদিন খুব ব্যস্ত যাচ্ছে। রাফান রাদিফের পরিবারেও খুব ব্যস্ততা। ওরা এত তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন করেছে যে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় জুটছেনা এখন।
তাই রাফানের মা সময় এর মধ্যে আমাদের সাথেও আর কথা বলেনি, আর রাফানকেও কিছু বলেনি। আবার বলেনি হয়তো রাফান মিথ্যা বলতে পারে এই আশংকায়! উনার মনে কি আছে উনিই কেবল জানেন! এদিকে আমিও আর রাফানের বোনকে পড়াতে যাইনা। আব্বু মানা করছে যেতে।
অপেক্ষা করতে করতে,
দুইটায় বরযাত্রী আসলো। রাফান অভয় দেওয়া সত্ত্বেও আমি আমাকে যারা চিনে তাদের সামনে গেলাম না। বিশেষ করে রাদিফ ভাইয়ার পরিবার এবং রাফানের পরিবারের কারোর সামনে!
রাফানও আমাকে এসে দেখেনি।
কয়েকবার এসএমএস করেছে আমাকে দেখার জন্য। কিন্তু আমার সাহস হচ্ছিলোনা। মনে হচ্ছিলো কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
আমি অনেকটা সময় ধরে শ্রেয়ার কাছেই ছিলাম।
এরপর যখন বর কনের বিভিন্ন নিয়ম পালনের মূহুর্ত আসলো, আমি রাফানকে এসএমএস করে বললাম ওইদিকে সবকিছু রেখে পেছনের বারান্দায় চলে আসতে। আমিও সেখান থেকে বের হয়ে গেছি। কারণ ওখানে সবাই উপস্থিত। বাইরে কিংবা আশেপাশে তেমন কেউ নেই।
রাফান আমার কথামতো বাড়ির পেছনের বারান্দায় আসলো। আমাকে দেখতে পেয়েই আচমকা আমার হাত ধরে বললো,
‘ আঠারোদিন পরে আমার পরীর সাথে দেখা।
হিজাব করেও এতো সেজেছো বাহ! পুরো বউ বউ লাগছে, ইচ্ছে করছে আমিও আজকে বিয়ে করে ফেলি।
আমি লজ্জায় হাসলাম। এমন সময়ই হৃদপিণ্ডে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে এক আওয়াজ এলো,
‘ রাফান কে এই মেয়ে? তুই সামনে থেকে সরে যা। আমি দেখতে চাই!
রাফান ভেবাচেকা খেয়ে আমার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরেছে। আর আমার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আমতা আমতা করে শব্দ হচ্ছে,
‘ আ আ আন্টি!
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার