#ধারণার_অতীত [০৪]
আমি প্রথমবারের মতো হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছি। এদিকে আম্মুকে দেখে মনে হচ্ছে উনি যেন আমার চেয়েও বেশি খুশি৷ আম্মু আসলে জানে পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করতে পারাটা আসলে কতটা আনন্দের।
ইতোমধ্যে আব্বু ফোনে বলছে,
‘ একি আপা আপনি কি দয়া দেখাতে চাচ্ছেন? আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে কেন? আপনি সমন্ধ নিয়ে এসেছিলেন, আমরা যথাযোগ্য মনে করেছিলাম তাই মেয়ে দেখিয়েছি, তাই বলে এই না যে বিয়েটা হতেই হবে। আমার মেয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না!
আম্মু দেখছিলো আব্বু রেগে যাচ্ছে। রাগারই কথা, এভাবে দেখে গিয়ে এসব বলাটা অপমানজনক। কিন্তু আম্মু আব্বুর হাত চেপে ধরে ইশারা করছে রাগারাগি না করে ভেবে দেখার কথা বলতে!
আব্বু আম্মুর দিকে ভেবাচেকা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর কি যেন ভেবে বললো,
‘ আচ্ছা তবে আমার মেয়েকে আপনার কাছাকাছি রাখার যদি এতই ইচ্ছে থাকে তাহলে আপনি কথাবার্তা বলে রাখতে পারেন। তবে আপনার ছেলের মর্জি হওয়াটা মূখ্য। এবার ঠিকঠাক জিজ্ঞেস করে আনবেন আশা করি, পরে গিয়ে যেন না শুনি যে অন্য জায়গায় পছন্দ আছে।
রাফানের মা বললো,
‘ না না ভাই, আমার ছেলে এমন না। সে তার মা’র বাধ্য সন্তান। আমি একবার বললেই রাজী হয়ে যাবে। আর ওর কোনো পছন্দও নেই, শুধু চাকরির আগে বিয়ে করবে কিনা এটার জন্য জিজ্ঞাসা করবো। শুনেন রাফান তার বাবার বিজনেস দেখলেই আপনার মেয়েকে রাণীর হালে রাখতে পারবে। এ নিয়ে আপনাদের কোনো ভাবনা চিন্তার দরকার নেই।
আব্বু মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
‘ আচ্ছা আপনিও দেখেন আর আমরাও আরো ভেবে নিচ্ছি।
এইটুকু বলে আব্বু ফোন কেটে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এতো বড় অপমান করে এখন আবার ছেলের জন্য চাচ্ছে! যাই হোক মুনের আম্মু তুমি কি বলো?
আম্মু চকচকে চোখ বলে উঠলো,
‘ চোখ বন্ধ করে রাজী হয়ে যান। ছেলে খারাপ না, আর ওই আপার এতই যেহেতু আকাঙ্ক্ষা,আমাদের উচিত মূল্য দেওয়া। আমার বিশ্বাস আমার মেয়েও ওই পরিবারে দাম পাবে। আর উনি তো যথেষ্ট পরিমাণ অনুতপ্ত হয়েছেন।
আব্বু কেমন যেন চিন্তার মধ্যে মাথা ঝাকালেন, যেন উনার আরো ভাবা উচিত।
যাই হোক এবার সবকিছু ঠিক হবে। আম্মু যেভাবেই হোক আব্বুর ভাবনাকে স্থির করে নিবে।
এখন আমার যাওয়া উচিত, এই সংবাদটা রাফানকে জানানো দরকার।
আমি খুব দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেলাম। হাস্যজ্জ্বল মুখে আমি ফোন হাতে তুলে রাফানকে কল লাগালাম। রিং হওয়ার সাথে সাথে রাফান রিসিভ করলো, আর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ কি অবস্থা?
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
‘ একি তুমি জানোনা? তোমার মা আব্বুর কাছে ফোন দিয়ে কি বলেছে শুনোনি?
রাফান উত্তর দিলো,
‘ না কি বলেছে?
আমি এক নিঃশ্বাসে বললাম,
‘ বলেছে যে রাদিফ ভাইয়ার অন্যত্র পছন্দ আছে তাই উনি এই বিয়ে করতে পারবেন না, তার বদলে উনি চাচ্ছেন উনার ছেলেকে দিয়ে আমাকে বিয়ে করাবেন!
আমার কথা শুনে রাফান তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠলো,
‘ আম্মুর কথায় এতো ভরসা করে বসলে? এদিকে খালামনি বলে দিয়েছে একদিনের মধ্যে পছন্দের মেয়েকে উনার সামনে আনতে না পারলে রাদি ভাইকে উনার পছন্দেই বিয়ে করতে হবে। মানে তোমাকে। আমার মা বিশ্বাস করছে যে আসলেই কেউ আছে, তাই তোমাদেরকে এই কথা বলেছে, তোমাদের কাছে লজ্জা পাওয়ার ভয়ে।
কিন্তু রাদি ভাইয়াকে আন্টির সন্দেহ হচ্ছে, উনার ভাষ্যমতে রাদি ভাই মিথ্যে বলছে নাহলে হাসিমুখে কেউ পাত্রী দেখতে গিয়ে ফিরে এসে এসব বলে? আর আসলেই তো ভাইয়ার কোনো পছন্দের মেয়ে নেই। আর একদিনে কাকে ধরে আনবে? কি করবে ভাই? বুঝতে পারছো বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
আমি ঢোক গিলতে গিলতে বললাম,
‘ তোমার মা ঠিকি বলেছে, তোমার আন্টি স্মার্ট, ওভার স্মার্ট! এতো প্যাঁচালো চিন্তা একটা মহিলার মাথায় কি করে আসতে পারে উনার ব্যপারে না শুনলে আমি ধারণাই করতে পারতাম না।
রাফান আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ এসব বাদ দাও, বিশ্বস্ত, আর ভালোমনের সুন্দরী মেয়ে খুঁজে দাও। দ্রুত লাগবে।
আমি চুপ করে গেলাম। চোখ বন্ধ খুঁজছি আমার চেনাজানা কে আছে যার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই, দেখতে শুনতে ভালো!
নাহ এমন কাউকে পাচ্ছিনা, একজন আছে কিন্তু তাকে পছন্দ করবে কিনা কে জানে! অন্যদিকে তার পরিবারও আবার জটিল,এসব শুনলে খবর আছে।
আমি জবাব দিলাম,
‘ এই একদিনের বিষয়টা কি সারাজীবনের উপর নির্ভর করছে?
রাফান জোর গলায় বললো,
‘ আরে হ্যাঁ। খালামনি এমন আছে নিজে বসে থেকে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। শুনো দেখতে মোটামুটি হলেও হবে, শুধু ভালো চরিত্রের হওয়াটা জরুরী। আমার ভাই কিন্তু এমনিতে অনেক ভালো। আর এটা খেলার ছলেও বিয়ে হবে না, পারমানেন্ট হচ্ছে। আর নাহলে আমরা কিন্তু শেষ। ভাই আমাদের বাঁচিয়েছে এখন উনাকে আমাদের বাঁচাতে হবে, নাহলে তিনটা মানুষই একবারে শেষ হয়ে যাবো।
‘ আচ্ছা দেখছি আমি।
বলে আমি কেটে দিলাম।
এখন আমি মারাত্মক চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম। কি বলছে এসব? এটা কেমন বিপদ! ওই মহিলা এতো ডেঞ্জারাস আল্লাহ! একদিনের মধ্যে পছন্দের মেয়ে নিয়ে হাজির হবে, নাহলে উনি! না না আমি ভাবতে পারছিনা। যে করেই হোক আমার আশেপাশে যারা আছে তাদেরকে জিজ্ঞাস করতে হবে।
কিন্তু কাউকে কল্পনা করতে গেলেই আমার চোখে শুধু শ্রেয়ার মুখটা ভাসে। ও খুব ভালো মেয়ে, আমার জানামতে ওর বয়ফ্রেন্ড নেই, আর পরিবারের দিকেও বেশ ভালো। ও এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে বিয়ে করবে? একদিনে কি করে সম্ভব? তবুও আমি জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করলাম।
শ্রেয়াকে কল করে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ কিরে তোর পরিবার থেকে বিয়ে টিয়ে নিয়ে কথা বলে?
শ্রেয়া এটা শুনে হাসতে হাসতে বললো,
‘ রাতের বেলা বিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে তোর?
আমি সিরিয়াস মুডে বললাম,
‘ আরে বল না ভাই! তোরে বিয়ে দিবে কিনা?
শ্রেয়া কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
‘ তা দিতে পারে। বিয়ের বয়স তো হয়েছে। কিন্তু অতি ভালো জায়গা থেকে সমন্ধ আসলে আমাকেই পছন্দ করেনা। শ্যাম বর্ণ হওয়ার কি অভিশাপ দেখ! হাহাহা।
আমি বুঝতে পারলাম ও খুব কষ্ট নিয়ে কথাটা বলেছে, এই হাসিটাও মিথ্যে। আমি আস্তে আস্তে বললাম,
‘ একটা ছেলে আছে বুঝেছিস? খুব ভালো, পরিবারও ভালো। সমস্যা হলো সে একটা বিপদে পড়ে বলে ফেলেছিলো যে তার কাউকে ভালো লাগে। এখন তার মা উঠে পড়ে লেগেছে সেই মেয়েকে সামনে আনতে তাও কালকের মধ্যে। আচ্ছা তুই কি…
শ্রেয়া আমার মুখের উপর বলে দিলো,
‘ নারে এসব আমি জানিনা। আমার বাবা জানে।
আমি হতাশের সাথে ফোনটা রেখে দিলাম। এমনি আম্মু প্রবেশ করলো। কি হয়েছে জানতে চাইলে আমি বিস্তারিত বললাম। সব শুনে তো আম্মু পুরো বোকাবনে! আম্মুও বিশ্বাস করতে পারছেনা রাদিফ ভাইয়ার মা এতটা গুরুতর!
এরপর আম্মু আমাকে বললো,
‘ শুন শ্রেয়ার বাবার সাথে আমি কথা বলবো। পাত্রের সন্ধান তো শ্রেয়ার বাবাকে তুই দিতে পারবিনা, আমিই বলবো আমার কাছে একটা ভালো সমন্ধ আছে, তারা শ্রেয়াকে কালকেই দেখতে চায়৷
আর তুই রাফানকে বলে দে, রাদিফকে যেন তার মাকে বুঝায় যে মেয়ে পরিবারের বাধ্য সন্তান। তাই তাকে দেখতে হলে বাড়িতে গিয়ে দেখে বিয়ের দিনতারিখ করতে হবে। পছন্দ অপছন্দের কথা উল্লেখ করা যাবেনা।
আমি আম্মুর বুদ্ধি শুনে পুরো হতভম্ব হয়ে গেলাম। খুশিতে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম, আমার আম্মুও তো রাদিফ ভাইয়ার মা’র চেয়ে কম স্মার্ট না।
যেই ভাবনা সেই কাজ। আম্মুর পরিকল্পনা কাজ দিলো। রাদিফ ভাইয়া আমার কথামতো উনার মাকে সেই কথাগুলিই বললো। যদিও তখন আন্টির চেহেরা নাকি দেখার মতো ছিলো।
এদিকে আম্মু চাচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যপারটাকে আব্বুর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে। অন্যদিকে রাদিফ আর রাফানের পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগটাও শ্রেয়াদের পরিবারে আমরা গোপন রাখতে চাইলাম।
নাহলে সবকিছু একদম হযবরল হয়ে যাবে।
কিন্তু এই অবস্থায় হযবরল না হয়েও কি কোনো উপায় আছে? বিষয়টা কেবল জটিল থেকে জটিলই হচ্ছে।
না জানি আমাদের লুকোচুরি খেলার শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! আমার খুব ভয় লাগছে।
চলবে….
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার