#ধারণার_অতীত [০৩]
রাদিফের হঠাৎ এই সত্য প্রকাশ সবাইকে চমৎকৃত করেছে। আমার আব্বুও বড় চোখ করে উঠে দাঁড়িয়েছেন, রাদিফের মা তো সবার আগে দাঁড়িয়ে গেছে!
শুধু আমি আর আমার আম্মু চুপচাপ জায়গা মতোই বসে আছি। কিন্তু আমি দেখতে চুপচাপ হলেও আমার বুকের কম্পন বেগতিক হারে বাড়ছে ৷ না জানি এসব শুনে ক্ষেপে গিয়ে রাফানের মা আমাকে অপমান করে চলে যায়! একবার মুখ ফেরালে তো আমি শেষ!
এর মধ্যে রাদিফের মা প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ মুনতাহা তোর কোন ছোট ভাইয়ের প্রেমিকা?তোর তো আপন কোনো ভাই নেই।
রাদিফ কেমন যেন একটা চোখে আমাকে একবার দেখলো। তারপর সামনের রাগান্বিত মুখটাকে খেয়াল করলো, সেটা হলো রাফানের মা। উনার হয়তো এসব শুনে এখন নাককান কাটা অনূভুতি হচ্ছে, কেননা আমার এতো প্রশংসা করে সমন্ধ নিয়ে আসছেন! এখন যদি এসে এসব শুনে, অপমানটা উনারই বেশি হওয়ার কথা।
কিন্তু রাদিফের কণ্ঠস্বর নিচু হলো৷ সে আমতা আমতা করে বললো,
‘ মানে আম্মু ইউভার্সিটির এক ছোট ভাই, আমার মনে আছে সে মুনতাহাকে অনেক পছন্দ করতো। কিন্তু মুনতাহা করতো কিনা আমি আসলে …
এই কথা শুনে রাফানের মার মুখে আবার হাসি ফুটে উঠলো। হিহিহি আওয়াজ তুলে বললো,
‘ দূর রাদিফ তুই যে এতো বোকা আমি আগে জানতাম না। মানুষ এভাবে আচমকা কিছু বলে উঠে? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম কোথাকার কোন ছোট ভাই! আরে তুই বস বস ,এই আপনারাও বসুন৷ একটা মেয়েকে কেউ পছন্দ করতেই পারে। তাই বলে সে কারো প্রেমিকা হয়ে যায় না।
এইটুকু শুনতেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নাহ রাদিফ অন্তত আমাকে ভাইয়ের খাতিরে হলেও বাঁচাবে, আর রাফান বোধহয় ওর আর আমার ব্যপারটা ওকে আগেই জানিয়েছিলো, এই যাত্রায় মনে হয় বাঁচলাম, সামনে আরো কি কি জানি আসে!
এর মধ্যে রাদিফের মা বললো,
‘ তুই মুনতাহার নামও জানিস, আবার দেখে চিনেও ফেলেছিস কি করে?
রাদিফ চোখ আওড়ানোর চেষ্টায় বললো,
‘ আরে আজকাল কাউকে দেখা ব্যপার নাকি? বললাম না ওই ছোট ভাইটা ওরে একটু বেশি পছন্দ করতো।
এতক্ষণে আমার আব্বু মুখ খুললেন। সামনে এগিয়ে এসে রাফানের মা’র উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ আচ্ছা আপা এসব বাদ দিয়ে এবার কাজের কথা আগান। এসবকিছু থাকেই টুকটাক ৷
রাফানের মা’র দিকে তাকিয়ে রাদিফ বললো,
‘ আচ্ছা আপনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলুন। আমি মুনতাহার সাথে কথা বলতে চাই, আন্টি যদি অনুমতি নিয়ে দিতেন!
রাফানের মা মুচকি হেসে জবাব দিলেন,
‘ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, ওর মা কিছু বলবেনা। তোমরা যাও ওইদিকের ঘরটায় বসে কথা বলো।
আমি এবার আস্তে আস্তে উঠে রাদিফ ভাইয়ার পেছনে পেছনে যেতে লাগলাম । সবার থেকে আড়াল হতেই উনি রেগে বললো,
‘ এসব কি? তুমি রাফানকে এভাবে ঠকাচ্ছো? তুমি ওর সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় কিনা পাত্রপক্ষের সামনে গেছো? জানো রাফান শুনলে কতটা কষ্ট পাবে?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
‘ আমি নিরূপায় ছিলাম ভাইয়া। আপনি প্লিজ আমাকে একটু ওর সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিবেন? দুপুর পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে ছিলো, আমি কিছু বলার সুযোগ পাইনি। আপনি তো ভালো করেই জানেন, আপনার আন্টি আজকে সকালেই আসার কথা আমাদের জানিয়েছে।
রাদিফ আশেপাশে পায়চারী করতে করতে মাথা নাড়লো, এরপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে ঠেকালো। ৩০ সেকেন্ডের মাথায় ভ্রু কুঁচকে রাগান্বিত স্বরটাকে আরো রুক্ষতর করে বললো,
‘ শালা তুই ঘুমিয়ে থাক। একদিন হঠাৎ করে শুনবি তোর প্রেমিকা অন্য বাড়ির বউ হয়ে গেছে।
রাফান বিস্তারিত জানতে চাইলে রাদিফ ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বললো,
‘ তুমি বলো সবকিছু।
আমি ভয়ে ভয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রাফান বলতে লাগলো,
‘ মুন! এসব কি?রাদি ভাই তোমাদের বাসায় কেন? আম্মু বলছিলো রাদি ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেছে।
আমি জবাব দিলাম,
‘ আরে এইটা জিজ্ঞাসা করা লাগে তোমার?পাত্রী হিসেবে তো আমাকেই দেখতে আসছে তোমার মা। আরো মন জয় করার কথা বলবে তুমি? বলবে? দেখো মন জয়ের প্রভাব কোনদিকে গিয়ে পড়েছে! আমি সকাল থেকে তোমাকে বলার জন্য এতো ট্রাই করছি, কিন্তু তোমার তো ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমানো লাগে! আর কতো কিছু হয়ে গেলে চোখ খুলবে তোমার? কতো জরুরী দরকার থাকতে পারেনা? রাদিফ ভাইয়ার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কি হতো?
রাফান গলা খাঁকরে বললো,
‘ মুন সরি। আর কখনো এটা করবোনা। তুমি প্লিজ মাকে কোনো কৌশলে আটকাও!
এই কথা শুনে আমি রেগে গেলাম। জবাব দিলাম,
‘আচ্ছা তুমি পাগল? তুমি কি চাও? আমি কিছু বলি আর তোমার মা আমাকে চিরদিনের জন্য ঘৃনার পাল্লায় তুলুক? এইটুকু হিতাহিত জ্ঞান তোমার নাই কেন রাফান? আমি কিছু করতে পারলে তো তোমাকে জানাতামই না। এটা যদি তোমার পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত না হতো আমি তোমার জন্য সমন্ধকে যে করেই হোক ফিরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আন্টিকে ফেরানো মানেই অপমান করা হবে, আর এই অপমানের আঘাতে আন্টি আমার থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিবে। প্লিজ বোকার মতো কিছু বলোনা। তুমি সবকিছু সামলাও! আমি জানিনা।
রাফান ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। সে কিছু বলার মতো পাচ্ছেনা, তাই বলে উঠলো,
‘ রাদি ভাইকে দাও।
রাদিফ ফোন নিয়ে বললো,
‘ ভেতরে এতো জড়তা থাকলে কোন হিসেবে সম্পর্ক করছিলি ভাই? যাহ তোরা কিছু না করলেও আমিও পারবোনা কিছু করতে, মা আন্টি যা করে আমিও তাই করবো।
বলে ফোন কেটে রাদিফ হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
এতটা অসহায়ত্ব আমাকে গ্রাস করবে আমি কল্পনা করিনি।
এরপর ওদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে আমি জানিনা, শুধু দেখেছি দুপুরের খাবার বিকেল সাড়ে তিনটায় খেতে বসছে। মা ফুফি সবকিছু এগিয়ে দিচ্ছে।
এরপর বিদায় নিলো সাড়ে চারটায়। তার আগে রাফান এবং রাদিফের মা আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে গেছে। বোধহয় এর মধ্যে টাকা আছে, কিন্তু আমি খুলে দেখিনি।
ওরা যাওয়ার পরেই আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম শেষে ওরা কেমন ইঙ্গিত দিয়েছে? বিয়ের আলাপ কতদূর?
মা চুপসানো চেহেরায় বললো,
‘ মতিগতি ভালো না। বিয়ে হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। আর তোকেও এটাই মানতে হবে। এই বিয়ে ভাঙলেও তুই রাফানকে পাবিনা, না ভাঙলেও পাবিনা।
আমি কাঁদো কাঁদো চেহেরায় রুমে চলে গেলাম। রাফান আজকে বাড়ি আসবে। জানিনা এসে কি করতে পারে! কিন্তু রাফান জানে সম্পর্কের কথা শুনলে ওর মা আমাকে মানবেনা, বলবে এই মেয়ে ছদ্মবেশী! আরো কি কি জানি ভেতরে ভেতরে করে রাখছে!
পরেরদিন দুই পক্ষ থেকেই স্থির সিদ্ধান্ত জানানোর কথা। রাতে রাফান তাদের বাড়িতে আসলো, কিন্তু সে অসহায়, আমাকে ফোন দিলেও আশাজনক কিছু বলতে পারলোনা, ওর মাকেও গিয়েও কিছু জানাতে পারলোনা। ওর মনে হচ্ছে আমাদের মধ্য থেকে কিছু হলেই সব শেষ। ওর মা ওর কথাতেও রেগে যাবে, আমাদের কথাতেও!
অতঃপর পরেরদিন সন্ধ্যায়। আব্বুর আগ্রহের সাথে পাত্রের বাড়িতে ফোন দিচ্ছে। আব্বু আমার আর রাফানের ব্যপারে কিছু জানেনা, তাই সমন্ধের প্রতি উনার বেশ টান। আম্মুও আব্বুর কাছে বসে আছে,কিন্তু কিছু জানায়নি।
আর আমি লুকিয়ে শোনার চেষ্টা করছি, ফোনে কি সিদ্ধান্ত জানায়। আমার হাত পা তরতর করে কাঁপছে। না জানি কি বলে বসে! বিয়ের তারিখ করার ঘোষণা দিয়ে দিলে তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণই হাতের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু দুইবার রিং হওয়ার পরেও কেউ রিসিভ করলো না।
আব্বু ফোন রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো।
তিন মিনিট পরে আব্বুর ফোনের রিং বেজে উঠলো। সাথে সাথে আমিও লাফিয়ে উঠলাম, কি জানি এখন শোনায়!
আব্বু ফোন কানে দিয়ে জোরে জোরে বললো,
‘ কি আপা আপনার বোনের জামাই আর বোনকে তো ফোন দিচ্ছিলাম রিসিভ করছেনা।
আম্মু আব্বুকে ইশারা করলো লাউড স্পিকার বাড়িয়ে দিতে। আব্বু লাউড বাড়াতেই আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। শুনলাম রাফানের মা বিষন্ন স্বরে বলছে,
‘ আসলে কীভাবে যে বলি ভাইসাব! ওই রাদিফ আছেনা? ওর নাকি এখন কোথা থেকে এক পছন্দের মেয়ে বের হয়েছে। আমি আপনাদের নিজের লোক বলে সরাসরি বলে দিচ্ছি, ও সরাসরি বলে দিলো সে মুনতাহাকে বিয়ে করতে পারবেনা। বিয়ে করলে ওই মেয়েকেই করবে। কিন্তু আমি আপনাদের আশাহত করবোনা। আপনারা আমাকে একটু সময় দেন, আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলে, মুনতাহাকে আমার ঘরের বউ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। চিন্তা করবেন না, আমার ছেলে চাকরি না করলেও কোনো অংশে কম না।
আম্মু বড় চোখ করে নিজের উচ্চশব্দে হাসিটাকে দুহাতে চেপে ধরলো। আর আমি কেঁদেই ফেললাম একদম।
চলবে….
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার