ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৬
“আমাদের বাসায় আগে কোনোদিন আসেননি। আজ হুট করে আসলেন। বড়ো মামা মামীও ছিলেন। আম্মু তোকে কলেজ যেতে মানা করেছেন। এই সবকিছু তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? মিতুল, তুই বোকা তো না। বুঝতে পারিস নি তোকে দেখতে এসেছিল।”
“তা কী করে হয় আপু? এই লোকের সাথে ফারহা আপু বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
” তুই কিভাবে জানিস বিয়ে ঠিক হয়েছে? চাচা চাচী কী বলেছেন?”
“না। কিন্তু ফারহা আপু ছাদে এই লোকের ছবিই দেখিয়েছিল। আমার মনে আছে। এক পলক দেখেছি কিন্তু এই লোকই ছিল। ফেসবুকেও তারা কমন ফ্রেন্ড। আমি তো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেললাম। এখন কি হবে? হয়তো আব্বু আম্মু জানতেন না যে ফারহা আপুর জন্য এই পরিবারের সাথে কথা হচ্ছে? হয়তো বড়ো মামার পরিচিত। তিনিই সাথে করে নিয়ে এসেছেন।”
“হতে পারে মামার পরিচিত। আব্বু আম্মুও হয়তো জানেন না। কিন্তু ওই পরিবারও কি জানতো না? তারা যদি;ফারহাকে দেখেই থাকে, তাহলে একই পরিবারের আরেকটি মেয়েকে কেন দেখতে আসবে? এটা কখন হয় জানিস? অনেক সময় পাত্রী দেখতে এসে মানুষ বড়ো বোন রেখে ছোটো বোনকে পছন্দ করে ফেলে। এমন হয়নি তো যে তারা ফারহাকে দেখতে গিয়ে তোকে পছন্দ করেছে? আর তাই তোকে সামনাসামনি দেখতে কোনো সূত্র ধরে বাসায় এসেছে।”
“ফারহা আপু বলেছিলেন তোমার বিয়েতেই ওনাদের দেখা। সম্ভবত নিচ তলার যে আরেকটা বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল তারা ওই বিয়ের অতিথি ছিল। আমাদের আত্মীয় হন। যদিও অনেক দূরের লতায় পাতায় সম্পর্ক। রাহেলা আন্টি আছে না, উনার শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়। আমরা এই জন্য চিনি না। কিন্তু উনারা সেদিন ওই বিয়েতে ছিলেন উপরের তলায় তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। এজন্যই ফারহা আপু এত সেজেগুজে বিয়েতে গিয়েছে। আপু তো দেখলাম খুব খুশি ছিল যেমন হাজব্যান্ড চায় তেমনি পাচ্ছে এমনটাই তো বলল। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না আপু। এখন নিজেকে বোকাই মনে হচ্ছে। ফারহা আপু দেখতে তো সুন্দর। আর চাচা চাচী আমাদের চাইতে ধনী। আমি বরং অতটা সুন্দর না। অন্তত ফারহাপুর তুলনায় না। তাহলে ফারহা আপুকে রেখে আমাকে কেন পছন্দ করবে!”
“তুই ফারহার চেয়ে কম সুন্দর? তোরা দু’জনই দু’জনের মতো সুন্দর। কারও হয়তো শরতের সাদা মেঘ ভালোলাগে, কারও বর্ষার ঘোর কালো। দুই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।”
“যাই বলো, তারপরও বললেই হলো? আমরা কি কোন পণ্য যে উল্টাপাল্টা দেখে যেটা পছন্দ হবে সেটা নিবে? আমি এসব মানি না।”
“তোর আমার মানা না মানায় কী আসে যায়? কারা আমাদের মতামত চায়? আমার বিয়ের সময় সায়েমের সাথে দুমিনিট কথা বলার সুযোগ কি পেয়েছিলাম? অবশ্য পেলেও হয়তো লাভ হতো না। এখনো মানুষ, ভাত কাপড়ে মারে না তল কথায় মারলে কী হইছে, ধারণা নিয়েই বাঁচে।”
“মানে আপু?”
“মানে বাদ দে। শোন, তবে তুই ফ্রেন্ডশিপ রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করছিস ভালোই হয়েছে। দেখ তো ছেলেটা তোকে কিছু বলে কিনা। আন্দাজ করতে পারিস কিনা। আম্মু কিছু না বললে তোর এখন কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। মিতুল তোর কোনো পছন্দ আছে?
মিতুল একমুহূর্ত চুপ থাকে। ভালোবাসার কোনো মানুষ নেই। আরমানকে মিতুলের ভালো লাগে। কিন্তু তাকে কি পছন্দের মানুষ বলা যায়। তাছাড়া আরমান তুলতুলের শ্বশুর বাড়ির মানুষ। এমন কিছু মিতুল ভাবেই নি।
” পছন্দের মানুষ বানানোর কোনো সুযোগ তো পাইনি আপু। আচ্ছা আপু, তুমি কবে আসবা?”
“কোথায়?”
“বাসায়।”
“আব্বুর বাসায়?”
“আমাদের বাসায়।”
“বাসার লোক তো আমাকে নিলো না মিতুল। এখন আমি আব্বুর বাড়ির মেহমান। দাওয়াত না দিলে মেহমান আসে না।”
“এভাবে বলো না আপু। সায়েম ভাইয়াকে বলে একদিন আসো।”
“এটাই তো ইচ্ছে করে না রে। বাদ দে। কলেজে যাব। তুই আসিস। কথা হবে। আমি কলেজ থেকে কিছু নোটস নেব। সামনে পরীক্ষা। ক্লাস তো করলাম না। মিতুল শোন।”
“বলো আপু।”
“তোর বয়সটা আমার চেয়েও কম। বিয়ের বয়স হয়নি বলব না। কিন্তু বিয়েটা পুতুল খেলায় যতটা সুন্দর। বাস্তবে তা না। মনে আছে রোমান্টিক নাটক দেখতাম আমরা। এলাকার গুন্ডা, জেদি, বখাটে ছেলেকেও বিয়ের পর ভালোবেসে কতটা বদলে দেওয়া যায় দেখাতো। সত্যিটা এমন না। বদলাতে হলে বদল হওয়ার মতো একটা মন থাকতে হয়। না হলে পাথরে মাথা ঠুকে শুধু নিজেরই মাথা ফাটে। আমার সাথে পুতুল খেলা খেলতে দিয়েছি। তোর সাথে দিবি না। সারা জীবনের সঙ্গী অন্ধ ভাবে বেছে নিস না। ভালোর সঙ্গার শেষ নেই। তোর জন্য কে কতটা ভালো তা বুঝেশুনে আগাবি।”
“মানুষ চিনব কিভাবে আপু? সবাই তো নিজের ভালোটাই দেখায়।”
“মানুষ বহুরূপী। তবু আমাদের চোখ-কান খোলা থাকলে আমরা বুঝি ভালো মানুষ আসলে শুধু নিজেকে ভালোবাসে না। তারা সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে ভালোবাসে। শুধু নিজেকে ভালোবাসে স্বার্থপর মানুষ।”
***
“কী করছো মিতুল? গত কয়েকদিন তোমার সাথে যোগাযোগ হয়নি। স্যরি মেসেজের রিপ্লাই দিতে লেট হয়ে গেল।”
“কোথায় ছিলেন আপনি? তিন দিনে একবারও মেসেজের রিপ্লাই দিতে পারেননি! অসুস্থ ছিলেন?”
“ঢাকার বাইরে ছিলাম।”
“কেন?”
“একটা কাজ ছিল।”
“চাকরিতে ঢুকেছেন বুঝি?”
“বারেহ! চাকরি ছাড়া কাজ হয় না?
“হয়। ব্যবসায়িক কাজে গিয়েছিলেন?”
“চাকরি ব্যবসা কিছুই নয়। আমাকে দিয়ে এসব হয় না।”
“তবে যে বললেন কাজ?”
“ভুল হয়েছে। একটা অকাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। সেখানে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুব খারাপ। ফোনে কথা বলা যায়। কিন্তু ইন্টারনেটের কানেকশন দুর্বল।”
“ফোন দিতেন।”
“তুমি ধরতে? তোমার বাসায় না খুব কড়াকড়ি।”
“ফোনে প্রেম করায় কড়াকড়ি। কথা বলতে নয়।”
“যাক।”
“কী?”
“আমার তাহলে প্রেম করার উপায় নেই। তুমি তো আমাকে আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিলে।”
“তা কোথায়?”
“তাহলে লিস্টে আছি?”
“আরমান ভাই, ফাজলামো করবেন না প্লিজ।”
“আচ্ছা স্যরি। তবে ধন্যবাদ।”
“কেন?”
“আমাকে মনে করার জন্য। সমাজের চোখে অকর্মা লোকজনকে সহজে কেউ মনে রাখতে চায় না। সেখানে তুমি তিনদিন খোঁজ না পেয়ে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক করলে। এই বদ্যানতায় আমি অভিভূত।”
“খুশি হলেন? না খোঁটা দিলেন?”
“খোঁটা কেন দেব? তোমার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক তো নাই যে তুমি আমাকে মিস করবা। মিস করে ফোন দিবা। হোয়াটসঅ্যাপে নক করেছ। এই তো বেশি।”
“আচ্ছা, বিদায় এখন। আম্মু ডাকছে।”
“বাই।”
মিতুল মনে মনে বলে, “আমি আপনাকে সত্যি মুস করছি। কিন্তু ফোন দেওয়ার মতো কোনো সম্পর্ক নেই সে কথা তো নিজেই বললেন। কী করে ফোন দেই।”
আরমানও ভাবছে, মিতুল অধিকার না দিলে, অধিকারের দাবি রাখা যায় না। মানানসইও না।
***
আনোয়ারা পারভীন, আরমানের অপেক্ষা করছেন। আরমান খেতে বসলে বিয়ের কথা তুলবেন। পাত্রী পরিচিত। দেখতে শুনতে ভালো। সবচেয়ে বড়ো কথা তারা আরমানের খামখেয়ালি স্বভাবের কথা জেনেও খুব আগ্রহী। আরনোয়ারা পারভীনের মন বলছে, বিয়ে হলে আরমান সংসারী হবে। সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল হবে। স্বাভাবিক ভাবে রাজি না হলে এবার তিনিও পিছু হটবেন না। একটা মাত্র ছেলে। এভাবে ছন্নছাড়া জীবন কাটাতে দিতে পারেন না।
***
তুলতুল স্বাভাবিক ভাবেই শ্বশুর বাড়িতে কাজ করে চলছে। জান্নাত আরা খুশিও, আবার কেমন জানি মন খচখচ করে। তুলতুল বাড়িতে যাওয়ার কথাও বলে না। তুলতুলের মা ফরিদা ফোন দিয়েছিলেন। তুলতুলকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে নিতে চান। বৌভাতের পর এতোদিনে আর যায়নি। তিনিও মানা করেননি। কিন্তু দেখা গেল তুলতুল নিজেই বেঁকে বসেছে। তার নাকি সামনে পরীক্ষা। এবাসা ওবাসা করলে পড়া হবে না। সিয়ামও তুলতুলকে ঘাটায় না ইদানীং। তুলতুলের ঠান্ডা ব্যবহারে প্রথমে খুব রাগ দেখালেও, এখন কেমন বিব্রত লাগে। সেদিন সেভাবে তামাশাটা না করলেই ভালো হতো মনে হয়। কিন্তু ইগোর জন্য ক্ষমাও চাইতে পারে না।
(চলবে)