ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৫

0
5

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১৫

শর্মিলা আহমেদ বাসায় ফিরে স্বামী জুলফিকার আহমেদের সাথে মিতুলের বিষয়ে আলোচনা করলেন। মিতুল কে জুলফিকার আহমেদের খুব ভালো লেগেছে। মিষ্টি একটা মেয়ে। নম্র হাসিখুশি।সে তুলনায় ফারহাকে খুব একটা ভালো লাগেনি। দেখতে দু’জনই সুন্দর। কিন্তু একমাত্র ছেলের বৌ হিসেবে মিতুলের জন্যই মন টানে ওনার। শর্মিলা আহমেদ অবশ্য স্বামীর সাথে একমত নন। ওনার মনে হচ্ছে ফারহান যেমন ছেলে, যেমন তার পছন্দ তার সাথে ফারহাই ঠিক হবে। নিজের ছেলেকে চিনেন তিনি। সাধারণ কিছু তার পছন্দ না। সবকিছুই একটু বিশেষ চাই। যদিও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তার ছেলের জেদ, একগুঁয়েমি এই সব কিছু মানিয়ে নিতে মিতুলের মতোই একটা মেয়ে প্রয়োজন। কিন্তু শর্মিলা আহমেদ ভালোভাবেই জানেন একদিকে ফারহান যেমন চৌকস তেমনি দ্বিধায় ভোগা একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকেই ফারহানের প্রতিটি জিনিস দু তিনটি করে লাগতো। দোকানে নিয়ে গেলে যা কিনতে চায় তা একটার জায়গায় দু তিনটে তার পছন্দ হতো। শেষ পর্যন্ত তার পছন্দেই একটি কিনে দেওয়া হলেও বাসায় এনে সেটাই আর ভালো লাগতো না। কখনো সুযোগ পেলে বদলানো হতো কখনো বা ফারহান বদলাতেই চাইতো না। তার সবগুলোই লাগবে। হোক একই ডিজাইনের আলাদা আলাদা রঙ। একমাত্র ছেলে হিসেবে ফারহানের এই জেদগুলো তিনি পূরণ করেছেন। দুটি সন্তান গর্ভে মারা যাওয়ার পর ফারহানকে পেয়েছেন তিনি। তাই হয়তো শাসনের চেয়ে আদরের পরিমাণটা অনেক বেশি হয়েছে। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে তিনি বুঝতে পারছেন পরিমিত শাসনও ভালোবাসার অংশ। জীবনসঙ্গী তো কোন বস্তু নয় যে একই রকম দু তিনটে রাখবে। তিনি ভালভাবে বুঝতে পারছেন ফারহান মিতুলের সারল্যে আটকে গিয়েছে কিন্তু ফারহার মোহ থেকে এত সহজে ফারহান বের হতে পারবে এই বিশ্বাসও ওনার নেই।

“মিতুলের সমস্যা কী?”

“কোনো সমস্যা নাই।”

“তাহলে?”

“তোমার ছেলে যে পরিমাণ স্ট্যাটাস, পশ জীবন যাপন করতে ও দেখাতে অভ্যস্ত। তোমার মনে হয় না তার পাশে মিতুলকে বড়ো সাধাসিধা লাগবে। শুধু দেখতে মিষ্টি হলেই তো হলো না। বাকি আর কিছুই কি ফারহানের টেস্টের? ফারহান এখন শুধুই একই বাসার দুটো সমবয়সী মেয়ে দেখে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে। যে সিদ্ধান্তহীনতায় ও সারা জীবন ছিল। তুমি নিজেই আমাকে কয়দিন আগে কী বলেছিলে? বলেছিলে ফারহানের সব জিদ, আহ্লাদ মেনে নিয়ে ওকে আমি এমন বানিয়েছি।।আজ তুমি নিজেও ওর একগুঁয়ে জিদের কাছে বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছ না? গত একবছরে ও কতগুলো মেয়ে দেখলো নিজেই বলো? মিতুলের মতো মেয়ে কি বাকিদের তুলনায় একদম আলাদা যে ওর জন্য ফারহান মরিয়া হয়ে যাবে? নাহ্ এটা শুধুই একটা আকর্ষণ। মিতুলকে পেয়ে গেলেই ও আকর্ষণ হারাবে।”

“আমার মনে হচ্ছে ফারহানের সমস্যা না। সমস্যা আসলে তোমার। তুমি রফিক সাহেব আর শফিক সাহেবের ভেতর তুলনা করছ। তুমি তাদের স্ত্রীদের ভেতর তুলনা করছ। তাই মিতুলের চেয়ে ফারহা তোমার উপযুক্ত লাগছে।”

“আমার এখন কাউকেই উপযুক্ত লাগছে না। এখানে কোনো রকম সম্পর্কে জড়াতেই আর আমি আগ্রহী না। হ্যাঁ শফিক সাহেবের সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক অবস্থা ভালো। ওনার স্ত্রী জেসমিনও ভালো পজিশনে চাকরি করেন। একমাত্র মেয়ে ফারহার জন্য তারা সবকিছুই অনেক বেশি করবেন যা মিতুলের পরিবার করবে না। রফিক সাহেব চাইবেন যত সহজে মেয়ে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়ে পার করা যায়। এর জন্য ওনারা ছোটো ভাইয়ের পরিবারের সাথেও ছল করলেন। দেখ না শুক্রবারের বদলে বৃহস্পতিবার যেতে বললেন। ওনাদের মা ও বাসায় ছিল না। বোঝাই যাচ্ছে ফারহার বিষয়টা ওনারা জানেন। তাই ইচ্ছে করে অপরপক্ষকে অজানায় রাখলেন। এই জানা সামনে আসলে কখনোই তা মেনে নেওয়া সহজ হবে না। পারিবারিক কোন্দলের কারণ হবে।”

জুলফিকার সাহেব আধশোয়া থেকে উঠে বসেন।

“তাহলে তুমি মিতুলের বাসায় যেতে রাজি হলে কেন?”

“ছেলের জন্য।”

“মানে?”

“ছেলে চেয়েছে মিতুলের বাসায় যেন প্রস্তাব যায়। আমি আমার মতো বোঝাতে চেয়েও বোঝাইনি। কেন জানো?”

“কেন?”

“এতে তার পাওয়ার জিদ আরও বাড়বে। ও ভাবুক নাটাই ওর হাতে আছে। ছেলের জিদে খেলনা বাড়িতে এনে দিয়েছি। কুকুর পালতে চেয়েছে, রাজি হয়েছি। ছেলের বৌ ছেলের জিদে হবে না। বৌ আমি তেমনই চাই যে ঘরসংসার বুঝবে না। স্বামী আগলে রাখা বুঝবে না। ছেলের বৌ দরকার। আমার দরকার ছেলের জন্য একটা পুতুল পুতুল মেয়ে। সাজবে, ঘুরবে, ফিরবে, আমার ছেলেকে সঙ্গ দিবে। কিন্তু ছেলে আমারই থাকবে। দিনশেষে আশ্রয়, যত্ন পেতে তাকে মায়ের কাছেই আসতে হবে। ছেলের বৌয়ের জন্য আমার কোনো বিধিনিষেধ নাই। বরং সে মুক্ত পাখি হয়ে ঘুরুক, সংসার করা না বুঝুক। তাতেই আমার চলবে। পাখি হয়ে উড়লেও উড়বে আমার করা এই সোনার সংসারের খাঁচায়। আমার ছেলেকে নিয়ে ফুড়ুৎ হওয়ার ইচ্ছেও করবে না। আর ফারহা তেমনই হতো। ছেলেকে সঙ্গ দিত, সেজেগুজে ঘোরাঘুরি করত, আরাম-আয়েশে থাকতো। সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার ঝামেলায় ও যেত না। ওর এসবে মাথাব্যথা থাকত না। মিতুল সংসারে এসেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের মতো স্বামী সংসার নিজের করে পেতে চাইবে। স্বামীর যত্ন করবে। যত্নে রত্ন মিলে। আমার একটা মাত্র সন্তান। ও বৌকে নিয়ে সুখী হোক। তা আমি অবশ্যই চাই। কিন্তু বৌ আসলে মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে না যাক। ওর পছন্দের খাবারের আব্দার আমার কাছেই করুক। ওর ছোটো ছোটো বিষয়গুলো জন্য আমার কাছেই আসুক। আমি তাই ইচ্ছে করে শেষ পর্যন্ত ওর জেদ মানার অভিনয় করলাম। যেন আমার উপর অভিমান না থাকে যে আমি ওকে ওর পছন্দের মেয়ে বিয়ে করালাম না। আমি চাই আজকের এই ঘটনা মিতুল এবং ফারহা দুজনকেই আমার ছেলের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিক। কেননা যদি মিতুলের উপরে ফারহাকে বিবেচনা করে আমি এ বাড়ির বউ করি তখন ফারহানের মনে হবে আমি ওর পছন্দ গুরুত্ব দেইনি। আবার মিতুল কেও আমি বাড়িতে আনতে চাইনা। তাছাড়া যাকেই আনবো অপরপক্ষ আত্মীয় হয়েই থাকবে। আমি আর তা চাই না। আমি অন্য কোথাও আমার ছেলের জন্য পাত্রী দেখবো।”

“আজকের ঘটনা কিভাবে এসব করবে?”

“তোমার মনে হয় এসব চাপা থাকবে? দু’পক্ষই ফারহানকে হবু জামাই ভাবছে। নিজেরা যখন নিজেদের মুখোমুখি হবে তখন সম্পর্কের হৃদ্যতা ভাঙার পাশাপাশি স্বপ্নও ভাঙবে।”

“মেয়েটা কিন্তু লক্ষীমন্ত। তুমি ভেবে দেখ। অনেক সময় আমরা পরিকল্পনা করি এক,আল্লাহ করেন আরেক। তুমি কী করে নিশ্চিত যে সব যাচাই করে যে শ্বেত শুভ্র ফুল তুমি ঘরে তুলবে। দিন শেষে তাই ধতুরা হয়ে তোমার প্রাণ নিবে না? সবকিছু ক্যালকুলেশন করে হয় না শর্মিলা। লক্ষী একটা মেয়ে হয়তো ফারহানকে আরও ঘরমুখো করতে পারে।।আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারে। সুতো ধরে রাখতে গিয়ে যেন এমন না হয় যে সুতোই ছিঁড়ে গেল।”

***

ফারহান মিতুলকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। মিতুল লোকটাকে চিনতে না পেরে রিকুয়েষ্ট ক্যানসেল করবে ভাবে। কিন্তু চেহারা চেনা লাগছে। কই যেন দেখেছে। নামটাও পরিচিত। “ফারহান, ফারহান” মনে মনে আওড়ায়। মনে পড়ে, ফারহার যে ছেলের সাথে বিয়ের কথা চলছে, সে ছেলের নাম ফারহান বলেছিল ফারহা। মিতুল কৌতূহলী হয়ে প্রোফাইল খুলে। হ্যাঁ, কমন ফ্রেন্ডে ফারহার নাম। পাবলিক কয়েকটা ছবি স্ক্রল করে দেখে। একটা কমিউনিটি সেন্টারে তোলা কিছু ছবি। চিনতে পারে মিতুল। এটা সেই কমিউনিটি সেন্টার যেখানে তুলতুলের বিয়ে হয়েছিল। ওনারাও সেই কমিউনিটি সেন্টারে গিয়েছিল। একটা ছবিতে লেখা ‘বাবা মায়ের সাথে’। ছবির লোকগুলোকে চিনতে পারে মিতুল। আজই এসেছিলেন ওনারা এই বাসায়। শর্মিলা আহমেদ এবং জুলফিকার আহমেদ। মিতুল অবাক হয়ে যায়। এই যদি ফারহাকে পছন্দ করা পাত্র পক্ষ হয়, তাদের বড়োমামা কী করে চিনেন! আজ এবাসায়ই বা এলেন কেন! মিতুলকে পাশে বসিয়ে অনেককিছু জিজ্ঞেসও করেছিল। মিতুল অবাক হলেও রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নেয়। মায়ের সাথে কথা বলার আগে তুলতুলের সাথে কথা বলবে ভাবে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে