#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১৪
ফরিদা অবাক হয়েছেন যে স্বামী মেয়ের বিয়ে নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা না করে তার সাথে করছে। রফিক সাহেব সাধারণত পারিবারিক সিদ্ধান্তগুলো মায়ের সাথে আলোচনা করে নেন। ফরিদাকে জানান না বিষয়টা তেমন নয় তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর। অথচ আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ফরিদার সাথে কথা বলছেন। আসলে তুলতুলের বিয়ের পর নানা ঘটনা আর পরিস্থিতি দেখে রফিক সাহেব আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন। তুলতুলের জন্য তিনি তো সব দেখে বিবেচনা করেই সায়েমের পরিবারকে ঠিক করেছিলেন। সায়েমের পরিবারের সবাই শিক্ষিত এবং সামাজিকভাবে সম্মানিত। সায়েম নিজেও ভালো একটি চাকরি করে। তাদের তেমন কোনো দাবি দাওয়াও ছিল না। রফিক সাহেব একটু হিসেবী মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন অল্প খরচের ভেতরেই মেয়ের ভালো বিয়ে দিতে। তাই সায়েমের পরিবারকে ভালোই মনে হয়েছিল। আর তা পেরেছিলে না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব হিসেব আসলে এভাবে হয় না। ঘর বর ভালো হলেই মেয়ে সুখী হবে এই নিশ্চয়তা নেই। তারা কিছু চায়নি, কিন্তু না পেয়ে খুশিও হয়নি। চাইতে হবে কেন? উপহার আসবে স্বতঃস্ফূর্ত। আর তা হয়নি বলে তুলতুলের শাশুড়ি যে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন তা তার আচরণ এবং কথায় বোঝা গিয়েছে। তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন, “আমরা কিছু চাইনি আপনারাও কিছু দেননি। ঠিকই আছে আমরা তো ঘরের এর জন্য ভালো একটা বউ চেয়েছিলাম জিনিস নিয়ে তাই আমাদের মাঝে কোন আক্ষেপ ছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমরা তো ঠকেই গেলাম না লক্ষী এলো, না লক্ষ্মীর মত বউ এলো।”
মিতুল আর তুলতুলের মাঝে বয়সের পার্থক্য খুব কম, তবু আরো কিছুদিন পর মিতুলের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। একসাথে দুই মেয়ের বিদায় বাবা হিসেবে তার জন্য কষ্টের। কিন্তু রাহেলা ফোন করেছিল। রাহেলা রফিক সাহেবের দূর সম্পর্কে আত্মীয়। রাহেলস বললেন বিয়ের অনুষ্ঠানে মিতুল কে দেখেছে ছেলে। ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে। যদিও রাহেলা আরেকটি কথাও বলেছে যে এই ছেলের প্রস্তাব রাহেলা দিয়েছে ফারহার জন্য। কিন্তু ছেলের পছন্দ হয়েছে মিতুলকে। নিঃসন্দেহে ছেলেদের পারিবারিক অবস্থা ভালো। আর কোন ভাই বোন নেই। একমাত্র ছেলে এবং ছেলের কথাই শেষ কথা। অর্থাৎ তুলতুলের স্বামীর মত মায়ের কথায় পরিচালিত হওয়ার ছেলে নয়। এই কথাটা জেনে রফিক সাহেবের মনে হচ্ছে আগেরবার এই বিষয়টাকে তিনি গুরুত্ব দেননি। সেবার সায়েম তো বিয়ের আগে তুলতুলকে দেখতেই আসিনি। সায়েমের মা আর বোন দেখে গিয়ে আংটি পরিয়েছে। মা বোনের উপর কথা বলে না, এমন ছেলে সমাজে ভদ্র নামে পরিচিত ঠিকই। কিন্তু তারা স্বামী হিসেবে আসলে খুব একটা ভালো হয় না। স্বামী হওয়ার জন্য উশৃংখল বা বেয়াদব ছেলে হতে হবে তা নয়। তবে অন্তত মেরুদণ্ড সোজা থাকা প্রয়োজন। আর এখানেই রফিক সাহেবের মনে হয়েছে সায়েম কখনোই তুলতুলের জন্য তার পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেনা। বরং সময়ে সময়ে সায়েম নিজেই তুলতুলের পথটা কঠিন করে দিবে। এবার তাই তিনি এমন পাত্র চান যার কথাই পরিবারে শেষ কথা হবে।
“ফরিদা, তুমি মা মেয়ের বিয়ের ভালো-মন্দ তোমার সাথে আমার আলোচনা করা উচিত। তুলতুলের বিয়ের সময় তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুলতুলের শ্বশুর বাড়ির লোকজন, বিশেষ করে শাশুড়িকে তোমার খুব একটা সহজ সরল মানুষ লাগছে না। অথচ আমি তোমার এই কথার গুরুত্বই দেইনি। আমার কাছে মনে হয়েছিল বিয়ের জন্য ছেলে কী চাকরি-বাকরি করে, ছেলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন সামাজিক মর্যাদা কেমন এসবই জরুরী। বাকি ছেলের মেজাজ মর্জি কেমন, শাশুড়ি ননদ কেমন এসব মেয়ালী বিষয়। এসবের কোনো গুরুত্ব নাই। আম্মাও বললেন মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে মানিয়েই চলতে হয়। এই মানানো যে এত জটিল বিষয়, মেয়ে বিয়ে না দিলে বুঝতাম না।”
“আপনি নিজেরে দোষ দিতেছেন কেন? এইটা তুলতুলের ভাগ্য। আর কম-বেশি শ্বশুর বাড়ি এমনই হয়। কারো একটু বেশি মানাইতে হয় কারো কম। আম্মা ভুল কিছু বলেন নাই। আমরা তুলতুলরে যদি কথায় কথায় এভাবে নালিশ করতে দেই সেটাই বরং ওর জন্য ক্ষতি। আম্মা ঠিকই বলছেন নতুন নতুন এত কথায় কথায় তুলতুলের জবাব দেওয়া ঠিক না। শ্বশুর বাড়িতে একটু মুখ কম চালানো ভালো। বোবার শত্রু নাই। আমি এত কইরা মেয়েরে বুঝাইলাম যে ওই বাড়িতে শুরুতেই যেন ঠাস ঠাস উত্তর না দেয়। প্রথমদিকে সবকিছুই একটু বেশি চোখে লাগে। কয়দিন মুখটা বন্ধ রাখলেই ভালো। কিন্তু মেয়েটা কথা বুঝলে তো। আরে পারিবারিক বিয়ে জামাইয়ের সাথে এখনো কোনো রকম ভাব ভালোবাসাই হয় নাই এখন তো জামাই মায়ের হয়েই কথা বলবে। তুলতুলের আগে নিজের জায়গা বানাইতে হবে। সেটা না করে তাই করল যা ভয় পাইছি। শুনেন ও যদি ফোন দেয় আমরা খোঁজখবর নেব। কিন্তু ওরে নালিশ করার সুযোগ দেয়া যাবে না। তা হইলে মেয়ের কোনদিনও শশুর বাড়িতে মন বসবে না। শ্বশুর বাড়িতে আমরা কি কম শুনছি? এমন কথায় কথায় বাড়ি চলে যাব বললে আর চব্বিশ বছর সংসার করা লাগতো না।”
“এখন মিতুলের ব্যাপারটা কী করা যায়? মিতুল কে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিব না ভাবছি। তাছাড়া প্রস্তাব নাকি ফারহার জন্য ছিল। শফিক আর জেসমিন রাগ করে যদি।”
“ভালো হইলে মানা করবেন কেন? খোঁজ খবর নেন। আর কথা তো হইতেই পারে। ফারহার সাথে তো কথা আগায় নাই। আগালে তো শুনতাম, জানতাম। ছেলে বিয়ের অনুষ্ঠানে মিতুলকে দেখে পছন্দ করছে। আমাদের তো কোনো হাত নাই। রাহেলার আত্মীয় স্বজন সব ধনী মানুষ। ভালোই হবে।”
“এই শুক্রবার ছেলের বাবা মা আমাদের বাড়িতে আসতে চায়। তাহলে হ্যাঁ করে দেই? আসুক সামনাসামনি কথা বলি। শফিক আর জেসমিনরে কী বলবা?”
“কিছু বলার নাই। এখনো তো কিছু ঠিক হয় নাই। শুক্রবার না, ওনাদের বৃহস্পতিবার আসতে বলেন। দুপুর বেলা আসুক। জেসমিন আর শফিক ভাই ওই সময় অফিসে থাকে। আগে আমরা কিছু কথাবার্তা বলি। শুধু শুধু তুলতুলের মত আগেভাগেই সবাইকে জানানোর কিছু নাই। যদি আপনি কিছু মনে না করেন তাহলে আম্মাকে একটু আপার বাসায় দিয়ে আইসেন। আম্মা থাকলে জেসমিন আর শফিক ভাই ও সব জানতে পারবে তখন দেখা যাবে আরেক ঝামেলা। এর চেয়ে আগে নিজেরা বসি, আমি ভাইজান আর ভাবিরে খবর দেব। ভাইজান মুরুব্বি মানুষ। ওনাদের সাথে কথা বলে ভালো লাগলে আগাবেন। তখন না হয় সবাই জানল। আমার পরামর্শ চাইলেন তাই বললাম এমনিতে তো কিছু বলার সুযোগই পাই না।”
রফিক সাহেব এবার স্ত্রীর কথাই রাখলেন। মেয়েদেরও কিছু বলেনি। বৃহস্পতিবার নিজের অসুখের বাহানা করে ফরিদা মিতুলকে বাসায় রেখে দেন। রাতুলকেও মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কথা ছিল অনানুষ্ঠানিক ভাবে কথাবার্তা হবে। তাই সবকিছু একদম ছোটো পরিসরেই রাখা হয়
দুপক্ষের অল্প কয়েকজন মানুষ আসেন। ফারহানের বাবা অবসরে গিয়েছেন। কোনো কাজের চাপ নেই এখন। তাই দুপুরে আসতে কোনো আপত্তি ছিল না। ফারহানের অফিস ছিল।নতাই আসা হয়নি। মিতুলও আন্দাজ করতে পারেনি কারা এলো। ফরিদা এবার কনে দেখা ধরনের কিছুই করেনি। মিতুল স্বাভাবিক ভাবে চা নাস্তা নিয়ে গিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি তার জন্য পাত্র দেখতে পারে সে ধারণাই তার নেই। ধরেই নিয়েছে বাবার ব্যবসা সংক্রান্ত পরিচিত কেউ। এমন মানুষেরা মাঝেমাঝেই মিতুলের মামার সাথে আসেন মিতুলদের বাসায়। মিতুলের মামা আর বাবা একই ব্যবসা করেন। বেশকিছু কমন পরিচিত মানুষ আছে ওনাদের।
(চলবে)