দ্বিতীয় অধ্যায় পর্ব-০১

0
2029

#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha
#Part_1

প্রচুর ভীড়ের মাঝে অদ্ভুত সুন্দর একটা বাচ্চা এসে আমায় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলছে ‘আন্টি আমাল বাড়ি কোথায়?
বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে আমি অবাকের মধ্যশিরা ছেদ করে একবারে তার উপরে উঠে গিয়েছি। বাচ্চাটার বাড়ি কোথায় এটা আমি কি ভাবে জানবো!
ভয়ংকর সুন্দর দেখতে বাচ্চাটা। ইচ্ছে হচ্ছে গাল দুটো টেনে দেই। গাল দুটো টানার আগে আমি আশে পাশে তাকালাম। তার বাবা বা মা কেউ আছে কিনা, এমন সুন্দর বাচ্চার সাথে মা বাবা লেগে থাকার কথা, দৌড়ে এসে বলার কথা ‘ এই আপনি আমার বাচ্চার কাছে কি করছেন! কিন্তু আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। আশে পাশের কেউই বাচ্চাটার দাবি নিয়ে আমার কাছে আসলো না,ওর বয়স তিন চার হবে।

বাচ্চাটা একটা মেয়ে, তার চুল গুলো বিনুনি করা কাধ অব্দি। পড়নে সাদা একটা গ্রাউন জামা। পুচকে পুচকে হাতে পরীদের জাদুর কাঠির মতো একটা কাঠি। সম্ভবত কোন অনুষ্ঠানে ছিলো মেয়েটা। কিন্তু আশে পাশে তো কোন অনুষ্ঠান বা তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। এইদিকে আমার বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।

আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে আমায়। আজকেও দেরি করে বাড়ি গেলে মা আমায় ঝাড়ফুঁক করে ছাড়বে। আমি নরম তুলতুলে মেয়েটির কাছে নিচু হয়ে বসলাম তারপর জিজ্ঞেস করলাম
‘ বাবু তোমার আব্বু আম্মু কোথায়?

মেয়েটি একবার মাথা নিচু করছে আরেকবার উঁচু করছে কিছুই বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে।

আবার জিজ্ঞেস করলাম
‘ বাবু তোমার সাথে কেউ নেই? আব্বু আম্মু কোথায়? এখানে একা একা কি ভাবে এসেছো? তোমার বাড়ি…

বাচ্চা আতঙ্কিত চোখে
‘ আমাল ( আমার) মাম্মাম লত্ত ( রক্ত)

মেয়েটা ভয় পাচ্ছে মনে হচ্ছে। রক্তের কথা বললো কেন? ওর আম্মু আবার এক্সিডেন্টে করেনি তো! মেয়েটা কি ভয় পেয়ে এখানে চলে এসেছে!

আমি আবার মেয়েটার চুল গুলো কপাল থেকে সরিয়ে বললাম
‘ কি হয়েছে মাম্মাম এর? উনি কোথায়? তুমি কি এখানে একা এসেছো? মাম্মাম আসেনি?

‘ মাম্মাম লত্ত।

কি বলতে চাইছে মেয়েটা বুঝতে কিছুই পারছি না। রক্ত মানে! ওর আম্মুর কি কিছু হয়েছে? এতো ছোট মেয়ে কিছু বলবেই বা কিভাবে! কিন্তু এটা বুঝতে পারলাম ওর মনের অবস্থা ভালো নেই। কি জন্য কিসব বলছে বুঝতেও পারছিনা। এখন আমি চলে গেলে বাচ্চাটা একা একা কোথায় যাবে!

মেয়েটাকে কোলে নিয়ে অনিন্দা একটা দোকানে গিয়ে দুটো আইসক্রিম কিনে পাশেই একটা বেঞ্চে বসলো। বাচ্চা মেয়েটা কুটকুট করে আইসক্রিম খাচ্ছে আর মুখে নাকে লাগছে একটু একটু করে। অনিন্দা হাসছে আবার ভাবছে হঠাৎ এমন পুচকে বাচ্চা এখানে কি করে আসলো। আশে পাশে কোথাও তো এক্সিডেন্টও হয়নি। অনিন্দার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বাচ্চাটাকে পুলিশের হেফাজতে দিয়ে দিলে ভালো হবে। ও তো আর একা এই বাচ্চার ফ্যামিলি কে খুঁজে বের করতে পারবে না। মেয়েটাও তো কিছু বলতে পারছে না।

অনিন্দা আরেকবার চেষ্টা করলো
‘ বাবু তোমার আম্মু আব্বুর নাম কি? কোথায় ওরা?

মেয়েটা আইসক্রিম সহ গলা জড়িয়ে ধরলো অনিন্দার। ফলে আইসক্রিম অনিন্দার চুল আর কাপড়ে লেগে গেছে। আর মেয়েটার মুখ থেকেও আইসক্রিম লেগে গিয়েছে অনিন্দার মুখে।
মেয়েটা অনিন্দাকে জড়িয়ে ধরেই
‘ মাম্মাম লত্ত ( রক্ত)

অনিন্দা আশ্চর্য না হয়ে পারছে না মেয়েটা বার বার একই কথা কেন বলছে! কি বুঝাতে চাইছে ও!

অনিন্দা কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা লোক এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে
‘ আয়ু তুমি এখানে! জানো আমি তোমায় কত জায়গায় খুঁজেছি?

কন্ঠটা শুনে মেয়েটা অনিন্দাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। অনিন্দা বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরেই লোকটার দিকে তাকিয়ে
‘ আপনি?

লোকটা অনিন্দা কি বলবে বুঝতে পেরে
‘ আমি আফাক আজওয়ার। আয়ুশি আজওয়ার আমার মেয়ে। আয়ু এই দিকে আসো পাপ্পা ডাকছে তোমায়।

আয়ুশি অনিন্দাকে জড়িয়ে ধরেই
‘ আমি যাবো না পাপ্পা। তোমাল সাথে আমি যাবো না।

আফাক চোখ রাঙিয়ে
‘ শাট আপ। চলো আমার সাথে এখনি। এমনিতেই আজকে অনেক পেরেশানি করে ফেলেছো পাপ্পাকে। কতো জায়গায় খুঁজেছি তোমায়।

অনিন্দা অবাক হচ্ছে এমন বাচ্চা মেয়ের সাথে কেউ এই ভাবে কথা বলে? এই ভাবে ধমক দেয়! আর মেয়েটাও ভয় পাচ্ছে নিজের বাবাকে, যেতে চাইছে না সে৷ এই জন্যই হয়তো বের হয়ে চলে এসেছে। আর বার বার রক্তের কথা-ই বা কেন বলছিলো?

আয়ুশি নড়ছে না একটুও। আফাক আয়ুশির দিকে তাকিয়ে একটু কাছে গিয়ে
‘ আয়ু পাপ্পার রাগ হচ্ছে। তোমার জন্মদিন রেখে তুমি চলে এসেছো। এখন আবার যেতে চাইছো না। এই আন্টিকে বিরক্ত করছো কেন?
বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য, তোমার দীদাও, চলো।

আয়ুশি দীদার কথা শুনে ছেড়ে দেয় অনিন্দাকে। তারপর মাথা নিচু করে দাঁড়ায় আফাকের সামনে। আফাক হাটু গেড়ে বসে আয়ুশির সামনে
‘ এখানে একা একা কেন এলে? যদি কেউ ধরে নিয়ে যেত?

আয়ুশি কিছু না বলে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। আফাক আয়ুশিকে কোলে নিয়ে অনিন্দার দিকে তাকিয়ে
‘ ওর খেয়াল রাখার জন্য ধন্যবাদ।

অনিন্দা কিছু বলতে নেবে তার আগেই আফাক আয়ুশিকে নিয়ে চলে যেতে শুরু করে। একটু দূরেই আয়ুশিকে একটা গাড়িতে বসিয়ে আফাকও গাড়িতে উঠে পড়ে।

অনিন্দা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন অদ্ভুত লোক, ওর কথা না শুনেই ধন্যবাদ দিয়ে ডিরেক্ট চলে গেলো! অনিন্দাও তো কিছু বলতো সেটার পাত্তায় দিলো না! এমন লোকের বউ কি ভাবে এডজাস্ট করে আল্লাহ জানে। আর বাবা হয়ে এতো ছোট বাচ্চার সাথে কেউ এমন করে? মেয়েটা কেমন ভয় পাচ্ছিলো উনাকে।

অনিন্দা আর কিছু ভাবতে পারছে না। অসভ্য একটা লোক। মধ্যে দিয়ে তার বাড়ি যেতে দেরি হয়ে গেলো। অনিন্দা হাতের ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়৷ তার মাথায় এখন শুধু এই বাচ্চা আর তার বাবার কথা-ই ঘুরছে।

বিকেলে
অনিন্দা আয়নার সামনে বসে আছে। বেশ লাগছে আজ তাকে। নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। লাল খয়েরী রঙের শাড়ি সাথে
হাতে এক মুঠো চুড়ি পড়েছে। আজ প্রথম কোন ছেলে পক্ষের সামনে যাবে সে। অনিন্দার পছন্দের কেউ নেই বিধায় ফ্যামিলির কথায় রাজি হয়ে গিয়েছে ছেলে পক্ষের সামনে যেতে। তার মামা এই বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। মামার দাবি এমন ছেলে আর দ্বিতীয় পাওয়া যাবেনা। অনিন্দাও দ্বিমত করেনি কোন। একটু ভয় লাগছে প্রথম এমন কারো সামনে সেজে যাচ্ছে তাই হয়তো।

অনিন্দার মা রুমানা বেগম অনিন্দাকে দেখে তার চোখে পানি চলে আসে।
‘ দেখেছিস কেমন সুন্দর লাগছে তোকে? কেমন বড় হয়ে গেলি ক’দিনে।

অনিন্দা মায়ের চোখে পানি দেখে উনাকে জড়িয়ে ধরে,
‘ এখন আবার ইমোশনাল ড্রামা শুরু করলে যাবোনা ছেলে পক্ষের সামনে। তোমরাই তো জোর করছো। এখন কি বিয়ে করতাম আমি!

রুমানা বেগম অনিন্দাকে ছাড়িয়ে
‘ ওরা চলে আসবে এখনি হয়তো। আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো। তোর বোন তো আর এলো না। নেহাল হয়তো আসতে দেয়নি। তুই তৈরি হয়ে বসে থাকিস।

রুমানা বেগম চলে যেতে নিলেই অনিন্দা মায়ের হাত ধরে
‘ আব্বু কি আমার সাথে এখনো রাগ করে আছে?

রুমানা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
‘ ঠিক হয়ে যাবে সব।

কিছুক্ষণ পর অনিন্দা নিচে তাকিয়েই পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে সালাম দেয়। অনিন্দাকে বসিয়ে রুমানা বেগম পাশে বসে।

অনিন্দা নতজানু হয়ে বসে রয়েছে। অস্বস্তি লাগছে তার। হঠাৎ একটা বাচ্চা এসে
‘ আন্টি তুমি আমাল নতুন মা হবে!!

বাচ্চাটাকে দেখে অনিন্দার চিনতে অসুবিধে হলো না। এই সেই আয়ুশি। কিন্তু ও এখানেও এলো কি করে!

অনিন্দা আর কিছু না ভেবে চোখ বড় বড় করে সামনে থাকা লোকজনের দিকে তাকিয়ে বড়সড় একটা ধাক্কা খায়, যা হজম করতে না পেরে বলে উঠে,
‘ আপনি এখানে!

রুমানা বেগম অনিন্দার হাত ধরে
‘ কি বলছিস চুপ কর।

অনিন্দা চুপ করার বদলে উঠে দাঁড়িয়ে
‘ আম্মু উনি একজন বিবাহিত পুরুষ, উনার একটা বাচ্চা মেয়ে আছে। আজকে যার কথা আমি এসে তোমায় বলেছি উনিই সে….

চলবে……..

বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে