দ্বিতীয় ফাগুন পর্ব-২৫+২৬

0
826

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২৫
#লেখিকা_Esrat_Ety

মিটিং রুম থেকে এম্প্লয়িরা সবাই একত্রে বেড় হয়। আজ তাদের জন্য বিশেষ ছুটির ঘোষণা করে দিয়েছেন এমডি স্যার। সবাই বেশ প্রফুল্ল চিত্তে রয়েছে। অফিসের গুমোট ভাবটা আর নেই,কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ চারদিকে।‌ তাশরিফ নিজের কেবিন লক করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার চোখ খুজছে রোদেলা আমিন কে। মেহেরিন এসে তাশরিফের পেছনে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে,”কাউকে খুজছো?”
তাশরিফ কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে,”না তো আপা।”

_ওহহ, তোমার হাবভাব দেখে মনে হলো কাউকে খুজছো। যাই হোক। এমডি তো নতুন জিএম আনবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এই নতুন জিএম কেমন হয় কে জানে!

“শুনছেন।”
রোদেলা তাশরিফকে ডাকে। তাশরিফ ঘুরে তাকায় রোদেলার দিকে। মেহেরিন চলে যায় ওখান থেকে। তাশরিফ বলে,”বলুন।”
রোদেলা এগিয়ে আসে। তাশরিফের বুক ধুকপুক করছে,তার পেঁচা মুখী তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
_কথা ছিলো।
_বলুন।
_আপনাকে ধন্যবাদ দিলে ছোট করা হবে। আপনি অনেক বড় উপকার করেছেন আমার। আপনার জন্য আমি এতো বড় একটা সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

তাশরিফ ম্লান হাসে। মনে মনে বলে,”আর আপনার জন্য আমার যে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে তা কি দেখতে পান না! কেনো অন্ধ হয়ে বসে আছেন!”

রোদেলা বলতে থাকে,”ধন্যবাদ সব কিছুর জন্য।”

তাশরিফ মজা করে বলে,”এতো সাদামাটা ধন্যবাদ জীবনে কখনো দেখিনি, সরি শুনিনি।”
রোদেলা আড়চোখে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”তা ধন্যবাদ কিভাবে দিতে হয়? গানের সুরে? বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে?”

তাশরিফ কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। রোদেলা পিছু পিছু হাটছে। হঠাৎ করে বলে ওঠে,”বাড়িতে যাচ্ছেন?”
_হ্যা,আর কোথায় যাবো। আমার তো শশুর বাড়ি নেই।

_বৃষ্টিকে আজ চেক আপের জন্য নিয়ে যাবো আমি। আপনাদের বাড়িতে যেতে চাচ্ছিলাম।
তাশরিফ মুচকি হাসে। তারপর বলে,”ঠিকাছে চলুন। বাইকে উঠুন।”

_আমি আপনার সাথে যাবো কে বলেছে! আপনার সাথে যাবো আর আপনার মা বলবে আমি আপনাকে লাই দিচ্ছি। তার আর দরকার নেই।

তাশরিফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়,বলে,”যাবেন না তাহলে আমি বাড়ি যাচ্ছি কি না কেনো জানতে চাইছেন?”

_আপনি যদি এখন বাড়িতে যান তাহলে আমি বাড়িতে যাবো না। নয়তো আপনার মা বলবে তার ছেলে যখনি বাড়িতে থাকে আমি হ্যাংলার মতো তখনি বাড়িতে যাই।

তাশরিফ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর বলে,”ঠিকাছে। আপনি বাড়িতে যান। আমি এখন যাবো না।”

_আপনি কোথায় যাবেন?
_রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।

তাশরিফ বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে চলে যায়। রোদেলা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। তারপর একটা সিএনজি ঠিক করে উঠে পরে।

বাইরে আচমকা বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। এজন্যই আগষ্ট মাস টা রোদেলার পছন্দ নয়। হাতের ব্যাগটা মাথার উপর ধরে দৌড়ে এপার্টমেন্টের গেইট দিয়ে ভিতরে ঢোকে, ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে কলেজ পড়ুয়া ছয় সাতজন ছেলেদের একটা দল। সবাই মিলে ক্যারাম খেলছে। এখানে রোদেলা যে কয়বার এসেছে এদেরকে এখানে বসে ক্যারাম খেলতেই দেখেছে। কি একটা অবস্থা! এদের কি আর কোনো কাজ নেই! এদিক দিয়ে আদিলের প্রশংসা করতেই হয়, এতটুকু বয়সেই এতো এতো দায়িত্ব কাঁধে উঠিয়ে পালন করার চেষ্টাও করছে যথাসাধ্য। একে তো নিজে স্টুডেন্ট, তারপর বিয়ে করলো। এখন আবার বাচ্চা নিয়ে বসে আছে,কদিন পর বাচ্চার স্কুল এডমিশন। সবকিছু মিলিয়ে আদিলকে বোকা এবং নির্বোধ বলা যেতে পারে অথবা দায়িত্বশীল তকমাও দেওয়া যেতে পারে।

পুরোটা না ভিজলেও আংশিক ভিজে গিয়েছে রোদেলা। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

লিফটে চড়ে রোদেলা হাত ঘড়িতে সময় দেখে। বেলা তিনটা বেজে গিয়েছে। ডাক্তারের কাছে এপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখা হয়নি এতো ব্যস্ততার মাঝে। ভুলেই গিয়েছিল সে। এই বৃষ্টিতে বৃষ্টিকে নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে কি না তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে সে।

কলিং বেল টিপে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ সে। দরজার নব ঘোরার শব্দ হতেই সে চোখ তুলে তাকায়। তাশরিফ দরজা খুলেছে। রোদেলা কিছুটা চমকে যায়। এ তো বলেছিলো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে,এখন তো রোদেলার আগে এসে বাড়িতে বসে আছে ! তাশরিফ কিছু একটা বলতে যাবে অমনি রোদেলা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হনহন করে বৃষ্টির ঘরের দিকে চলে যায়। তারপর এক মিনিট পরেই আবার ফিরে আসে। তাশরিফ লিভিং রুমে দাড়িয়ে আছে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রোদেলা,”বৃষ্টি কোথায়?”

_মা বৃষ্টিকে নিয়ে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে। সকালে গিয়েছে তারা। বাড়িতে এসে ফোন দিয়েছিলাম,তখন জেনেছি।

রোদেলা বিরক্ত হয়ে যায়,বলে,”আমাকে বলেননি কেনো?”
_বলতেই তো যাচ্ছিলাম,আপনি তো হনহন করে চলে গেলেন ভেতরে।
_আমি এখনকার কথা বলছি না। আমাকে ফোনে জানান নি কেনো?

রোদেলা ধমকের সুরে বলে কথাটি। তাশরিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে,”আমি কেনো জানাবো? আমার কি? ফোন দিলেই তো ভাবতেন ছ্যাবলার মতো ফোন দিচ্ছি!”

রোদেলা চুপ হয়ে যায়। সত্যিই তো! তাশরিফকে সে বকছে কেনো! এখানে তো সব দোষ বৃষ্টির। দেখা হলে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারবে মেয়েটিকে। কোনো বোধ বুদ্ধি নেই।

তাশরিফের দিকে একবার তাকিয়ে রোদেলা ঘুরে সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে তাশরিফ বলে ওঠে,”বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি পরছে। সাথে ঝড়ো হাওয়া। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যান।”

রোদেলা দাঁড়িয়ে পরে। তাই তো! এখন কি করে সে বের হবে। বিরক্তিতে রোদেলা মুখ দিয়ে “চ” কারন্ত শব্দ করে। যা তাশরিফের চোখ এড়ায় না। সে রোদেলাকে দেখে বাঁকা হাসি হাসে। মনে মনে বলে,”প্রকৃতি সবসময় আমাদের কাছাকাছি এনে দিচ্ছে দেখেছেন। যেখানে আপনি সেখানে আমি,যেখানে আমি সেখানে আপনি রোদেলা আমিন। আসলে প্রকৃতির আমাদের জুটিটা বেশ পছন্দ হয়েছে,অথচ আপনি তা বুঝতে পারছেন না।”

রোদেলা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে দুমিনিট। ধুর,এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বরং আজ বৃষ্টিতে ভিজবে সে। তাছাড়া কোনোমতে একটা সিএনজি পেলেই হলো। এসব ভেবে রোদেলা সামনে পা বাড়াবে তখনি তাশরিফ বলে ওঠে,”বাইরে কিন্তু প্রচুর ঝড়ো হাওয়া বইছে। কোনো গাড়ি যে আপনি পাবেন না তা লিখে রাখুন। আর হেটে হেটে বেশিদূর যেতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না ‌। ঝড়ো হাওয়া এসে আপনার টিংটিঙে শরীরটাকে অনেক দূরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।”

রোদেলা প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাশরিফের দিকে তাকায়। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,”টিংটিঙে মানে?”

তাশরিফ উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। রোদেলা হঠাৎ রাগ ভুলে গিয়ে তাশরিফের সেই হাসি দেখতে থাকে। অদ্ভুত সুন্দর এই লোকের হাসি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তাশরিফ কিছুক্ষণ হেসে হাসি থামিয়ে বলে,”বৃষ্টির ঘরে গিয়ে চেইঞ্জ করে নিতে পারেন। এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

রোদেলা গম্ভীর হয়ে বলে,”আমি বুঝে নেবো। আপনি আপনার কাজ করুন।”
_ওকে !

তাশরিফ নিজের ঘরে চলে যায়। রোদেলা চুপচাপ সোফাতে বসে থাকে। এরকম বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে নির্ঘাত। সে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টির ঘরে গিয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে বেরিয়ে এসে দেখে তাশরিফ রান্নাঘরে। রোদেলাকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”চা বানাতে এসেছি। আমি অনেক ভালো চা বানাই জানেন? আপনি খাবেন?”

_না, ধন্যবাদ।
কথাটি বলে রোদেলা সোফাতে বসে পরে। তাশরিফ দু’টো কাপে দুই কাপ চা নিয়ে এসে একটা কাপ রোদেলার সামনে রাখে। রোদেলা বলে,”বললাম তো লাগবে না।”
_শোধবোধ করছি।
_মানে?
_সেদিন চা বানিয়ে খাইয়েছিলেন না? আজ আপনি খান। আমি কারো ঋন রাখতে চাইনা।
রোদেলা চায়ের কাপটা নেয়। তাশরিফ একটা সোফায় বসে পরে। রোদেলা আমতা আমতা করে বলে,”আংকেল কোথায়?”

_বাবা তো খুব ব্যস্ত মানুষ। তাকে বাড়িতে কমই পাওয়া যায়।
রোদেলা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,”চা টা ভালো হয়েছে। মনে হচ্ছে কোনো মেয়ে লোক বানিয়েছে। একেবারে পারফেক্ট।”

তাশরিফ মুচকি হেসে বলে,”আমার মা প্রায় সবকিছুই শিখিয়েছেন আমাকে। আমি আর আদিল প্রায় সব কাজ জানি। রান্নাবান্নাও মোটামুটি পারি। আমাকে যে বিয়ে করবে সে খুব লাকি হবে!

রোদেলা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলে,”বুঝলাম।”

_অবশ্য বরিশালের ছেলে বলে কথা। এরা হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল হয় জানেন?
_না, আপনার কাছে শুনলাম। এতদিন জানতাম বরিশাল চিটার বাটপারদের বিভাগ।

তাশরিফ চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও দেয়না। কপাল কুঁচকে বলে,”মুখস্থ কথা। চোর বাটপার তো সব বিভাগেই আছে।”

_তা ঠিক,তবে পারসোনালি আমার বরিশালের লোকজন পছন্দ না। এরা খুব ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়। আমার অনেক বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড গুলো ছিলো বরিশালের। খুব বাটপার টাইপের। বরিশালের লোক দেখলেও এড়িয়ে চলি,আই যাস্ট ইগনোর দেম!

_ছোটো বেলায় দাদীর কাছে একটা প্রচলিত প্রবাদ শুনতাম।‌ প্রবাদ টা হচ্ছে,”যে যারে নেন্দে,হেই হ্যারে পেন্দে!”

রোদেলা অবাক হয়ে বলে,”মানে?”
_এটা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা। এর মানে হচ্ছে যে যাকে ঘৃণা করে দিনশেষে তার কপালে সেই জোটে। দেখতে থাকেন আপনার সাথে কি হয়।

রোদেলা কয়েক মূহুর্ত তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,” বাইরে বৃষ্টি বোধ হয় থেমে গিয়েছে। আমি উঠি।”

_এসেছেন যখন বৃষ্টির সাথে দেখা করে তারপর না হয়……

তাশরিফ বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে সে কিছু একটা দেখে। রোদেলা তাশরিফের দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে,”কি হয়েছে?”

_তেলাপোকা।
_হ্যা। অসুবিধা নেই। আমি তেলাপোকা ভয় পাই না।
_আমি পাই।

রোদেলার মনে হলো এই মাত্র সে শতাব্দীর সবচেয়ে আশ্চর্য কথাটি শুনে ফেলেছে। কিছুটা হতভম্ব, কিছুটা আশ্চর্য,কিছুটা হতবাক এবং কিছুটা হতাশ দৃষ্টি দিয়ে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তাশরিফ বলে,”দেখছেন কি? ছেলে বলে তেলাপোকা ভয় পাওয়া যাবে না এটা সংবিধানের কোথায় লেখা আছে?”

রোদেলা উঠে দাঁড়ায়,তারপর একটা টিস্যু পেপার নিয়ে তেলাপোকা টাকে চেপে ধরে কুচলে দেয়। নোংরাটা বিনে ছুড়ে ফেলে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই আপনি কি না রাশেদুজ্জামানের নাক ফাটিয়ে দিয়ে এসেছিলেন?”

_রাশেদ আর তেলাপোকা দুটো আলাদা জিনিস। তেলাপোকা দেখলেই আমার ঘেন্না লাগে। ছিহহঃ

রোদেলা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সে তার হাসি যথাসাধ্য চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলে,”আচ্ছা উঠি তাহলে….”

রোদেলা উঠে দাঁড়াতেই তাশরিফও উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় তাহমিনা বৃষ্টিকে নিয়ে আধভেজা হয়ে ঘরে ঢোকে। রোদেলাকে দেখতে পেয়েই সে তার ভ্রু কুঁচকে ফেলে। রোদেলাও তাই। তাহমিনা অবাক হয়ে একবার তাশরিফের দিকে তাকায় আর একবার রোদেলাকে দেখে। রোদেলা স্বাভাবিক গলায় সালাম দিলে সে সালামের উত্তর দেয়। যত যাই হোক, পুত্রবধূর বড় বোন। বৃষ্টি আপুকে দেখে ভীত কন্ঠে বলে,”সরি আপু। তোমাকে জানাতে পারিনি। আসলে খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম। আদিলও ভার্সিটিতে,ওদের একটা প্রেজেন্টেশন আছে আজ তাই মা দেরী না করে নিয়ে গেলো। সরি আপু তুমি কষ্ট করে এলে!”

রোদেলা ভেবেছিলো বৃষ্টিকে বকবে খুব কিন্তু বোনের কাঁচুমাচু মায়াবী মুখ টা দেখে ওর খুব মায়া হয়। নরম গলায় বলে,
_ইটস ওকে সোনা। কি অবস্থা তোর? সব ঠিকঠাক তো?

বৃষ্টি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। তাহমিনা টি টেবিলের উপরে রাখা চায়ের কাপ দুটোকে দেখছে। দুজনে মিলে চা খাওয়া হচ্ছিলো তবে!

রোদেলা বোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”একটু সময় করে পড়তেও বসবি কেমন? মনে রাখবি সবাই তোকে ছেড়ে যাবে কিন্তু এই পড়াশোনা তোকে ছেড়ে যাবে না। বুঝলি?”

তাহমিনা রোদেলার দিকে না তাকিয়ে রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার বংশে নাতী আসতে চলেছে। সুখবর টা বেয়াইকে জানিয়ে দিও।”
রোদেলা বৃষ্টির পেটের দিকে তাকায়। একটা ম্যাক্সি ধরনের পোশাক পরে আছে সে। তারপর চোখ তুলে বৃষ্টির মুখ দেখে। লজ্জামাখা মুখটা চোখ নামিয়ে রেখেছে। রোদেলা মৃদু হেসে বলে,”আসছি। ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস।”

কথাটি বলেই রোদেলা চলে যায়। বৃষ্টি নিজের ঘরে যায়। বসার ঘরে তাহমিনা আর তাশরিফ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিনা তাশরিফের দিকে তাকায়। তাশরিফ মায়ের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

***
“আপনি কি সবসময় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে এপার্টমেন্টের ভাবীদের যাওয়া আসা দেখেন ভাইয়া?”
সাদাফ তার মেজো শ্যালিকার কথায় মজা পেয়ে হেসে ফেলে।

রোদেলা বলে,”আপু কই? সরুন আপনি। আপুর কাছে আপনার নামে বিচার দিয়ে যাই।”
সাদাফ সরে দাড়াতেই রোদেলা ভেতরে ঢোকে। সাদাফ পেছন থেকে বলে,”বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে বোধ হয়। তুমি বসো।”

_কেনো ডেকেছিলেন?
_তোমার আপু আসুক। তারপর বলবো।

রোদেলা বসে। সাদাফ তার মুখোমুখি সোফায় বসে পরে। রোদেলা হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে বলে,”আপুকে নিয়ে আপনি খুব খুশি তাই না?”
সাদাফ মুচকি হাসে। রোদেলা বলে,”বলতে হবে না,আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। আমার আসলে মাইনুল কুত্তাটার জন্য আফসোস হয়। আপুর মতো খাটি ঘি ওর পেটে হজম হলো না।”

সাদাফ হাসে। তারপর বলে,”খুশি না অখুশি তার ব্যখ্যা না দিয়ে শুধু বলবো আমার ধ্বসে যাওয়া জীবনটা পরিপূর্ণ হয়েছে।”

রোদেলা তৃপ্তির হাসি হাসে। সাদাফ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”যদিও একটু পাগলি টাইপের। তবুও বেশ!”

_পাগলি টাইপের মানে?
_অতিরিক্ত সেনসিটিভ। মজা করলে দুমিনিট পরে বুঝতে পারে। এতো সরল মেয়ে আমি জীবনে দুটো দেখিনি। সেদিন হয়েছে কি শোনো। ইলেকশন নিয়ে অনেক প্যাড়ায় আছি,তারপর আবার অপজিশন পার্টির কুত্তা গুলোর জালাতন। মুড ভালো ছিলো না তাই বারান্দায় বিরস মুখে বসেছিলাম। এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসে দিলো, বললাম খাবো না। আমার এই “খাবো না” বলা তার কাছে ধমক লেগেছে। কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলেছে। সুহা সিরাতের চেয়েও অবুঝ। অথচ এর বয়স নাকি ত্রিশ!

রোদেলা হাসছে। সাদাফের চোখে মেঘলা আপুর জন্য অপরিসীম ভালোবাসা, মুগ্ধতা দেখে হাসছে।

মেঘলা চুলে খোপা বাঁধতে বাঁধতে বসার ঘরে এসে দাঁড়ায়,”কি কথা বলা হচ্ছে ফিসফিসিয়ে? গোপন কিছু?”

সাদাফ হেসে বলে,”হু।”
রোদেলা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কেনো ডেকেছো আপু এতো রাতে?”
মেঘলা বসে। সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি বলবেন না আমি বলবো?”
সাদাফ বলে,”তুমি বলো।”
মেঘলা ভয়ে ভয়ে বলতে শুরু করে,”দুদিন পরে জানাবি বলেছিলি। কিছুই তো জানালি না। এদিকে ছেলে তোকে পছন্দ করে বসে আছে। তোকে দেখার পরে অন্য কোথাও মেয়ে দেখেনি। তাদের তো কিছু একটা বলতে হবে। কথা বার্তা এগোবো? ”

সাদাফ আর মেঘলা দুজনে কৌতুহলী হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা একবার সাদাফ আর একবার মেঘলার মুখের দিকে তাকায়। হঠাৎ করে তাশরিফের কথা মনে পরে যায় তার। নিজের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায় সে। কি বিচ্ছিরি অবস্থা! এই মুহূর্তে ওই লোকটাকে কেনো মনে পরবে! তার সাথে তো রোদেলার প্রেম ছিলো না! প্রেম ছিলো জাহিনের সাথে,মনে পরলে জাহিনের কথাই মনে পরা উচিত,ওই লোকটা কেনো! রোদেলার অফিসে,জীবনে, মস্তিষ্কে সব যায়গায় এসে ছ্যাবলার মতো রোদেলাকে বিরক্ত করতেই হবে? অসভ্য অভদ্র লোক একটা!

সাদাফ বলে,”কি হলো! ঘুমিয়ে পরলে নাকি! জবাব দিচ্ছো না কেনো?”
রোদেলা চুপচাপ বসে থাকে। সে কি বলবে? তার কি বলা উচিত? বিয়ে টা কি করতেই হবে? জাহিন একটা কচি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। এই তাশরিফ লোকটাও দুদিন পরে মায়ের পছন্দ মতো ক্লাস টেনে পড়ুয়া একটা ফরসা দেখতে মেয়েকে বিয়ে করে নেবে। রোদেলা কি করবে! বিয়ে না করারও তো কোনো কারণ নেই তার। বাবা,আপু খুব করে চাইছে। মেঘলার দিকে রোদেলা তাকায়। মেঘলা বলে,”জাহিনের জন্য এখনো অপেক্ষা করছিস নাকি আবার? ও কিন্তু বৌ নিয়ে এখন নেপাল ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
রোদেলা হাসে। সাদাফ বলে,”আরে এই মেয়ে তো দেখছি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলছে। বলেন না আপা আমরা কথা বার্তা এগোবো কি না প্লিজ!”

রোদেলা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আপনি আর আপু যা ভালো মনে করেন ভাইয়া!”

***
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। শুধু মাঝেমধ্যে তাহমিনা বৃষ্টিকে “এটা খাও,ওটা খাও” বলে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। তাশরিফ এক মনে খাচ্ছে। আদিল খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু ফোন ঘাটছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় একটু ফেইসবুক ব্যবহার করা সময় পায়না সে। রুমে ঢুকলেই বৃষ্টিকে সময় দিতে হয়। আদিলের হাতে ফোন দেখলেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। তাই পাঁচ মিনিট কি ছয় মিনিট যতটা পারে একটু ঢু মেরে আসে খেতে খেতে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আদিল বলে,”বৃষ্টি এই ছবিটা কার? এই লোকটা কে? মেঘলা আপু ছবি পাঠিয়েছে,বলছে তোমাকে পাঠাতে গিয়ে ভুলে আমাকে পাঠিয়ে ফেলেছে। কে লোকটা?”
বৃষ্টি আদিলের দিকে তাকায়। তারপর আমতা আমতা করে বলে,”রোদেলা আপুর জন্য এই লোকটাকে ঠিক করেছে দুলাভাই। পুলিশ ইন্সপেক্টর।”

কথাটি বলেই বৃষ্টি তাশরিফের দিকে তাকায়। আদিল একবার মা আর একবার তার ভাইকে দেখে। দু’জনেই এক মনে খাচ্ছে। আদিল নিচু স্বরে বলে,”দেখতে ভালোই। সিমেন্ট আপু সরি মেজো আপুর সাথে মানাবে।”

আদিল কথাটা শেষ করার আগেই তাশরিফ প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পরে। তারপর সোজা গিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।

বৃষ্টি এবং আদিল চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তাহমিনা চুপচাপ খেতেই থাকে। আফতাব হাসান সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

তাহমিনা লাইট নেভাতে গিয়েও নেভায় না। আফতাব হাসান ঘুমিয়ে গিয়েছে। সে ঘর থেকে বের হয়ে তাশরিফের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাশরিফের ঘরের দরজা এখন খোলা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে চায়। ভেতরে তাশরিফ নেই। তাহমিনা জানে তাশরিফ কোথায় আছে। সে সোজা হেটে পশ্চিমের টানা বারান্দায় চলে যায়। গিয়ে দেখে তার বড় ছেলে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাশরিফের পিঠের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”তাশরিফ।”

তাশরিফ মাথা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তাহমিনা এগিয়ে গিয়ে তাশরিফের পাশে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কথা বলে না।
তারপর তাহমিনাই বলে,”এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো। মশা কামড়াবে তো। নিজের ঘরে যা।”
তাশরিফ মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”মা।”
_বল।
_রোদেলা আমিনকে এনে দাও আমায় , প্লিজ মা!

তাহমিনা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ মাথা নিচু করে রেখেছে। তাহমিনা দেখছে তার ত্রিশ বছরের সুঠামদেহী,লম্বা, সুদর্শন ছেলেটা কেমন হঠাৎ করে আট বছরের একটা শিশু হয়ে গিয়েছে। যে তার মায়ের কাছে আবদার করছে একটা খেলনা কিনে দেওয়ার জন্য!

চলমান….

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২৬
#লেখিকা_Esrat_Ety

একটা প্রেম কাহিনী,সেখানে নায়ক থাকবে,নায়িকা থাকবে অথচ সাইড নায়ক থাকবে না তা তো হতে পারে না। আমার প্রেমের কাহিনীতে সাইড নায়ক এসে গিয়েছে। যাকে মোকাবেলা করে আমার নায়িকাকে আমার পেতে হবে। কংগ্রাচুলেশনস তাশরিফ,তোমার সমস্যা নাম্বার সাত এসে গিয়েছে। সমস্যা নাম্বার সাত: গল্পে সাইড নায়কের এন্ট্রি।

নোট প্যাডে কথাগুলো তুলে তাশরিফ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তাশরিফের পিএ তনির ডাকে তার ঘোর কাটে। মুখ তুলে তাকাতেই তনি বলে,”স্যার রোদেলা ম্যাম ক্যান্টিনে।”

_ক্যান্টিনে তা তো আমিও জানি। তোমাকে দেখে আসতে বলেছি সে কি করছে।
_গল্প করছে,হাসাহাসি করছে অন্য সবার সাথে। ম্যামকে খুব খুশি খুশি লাগছে।

তাশরিফের রাগে গা জ্বলছে। বিয়ের কথা উঠতে না উঠতেই এতো আনন্দ! যত্তসব! ওই আনন্দে যদি ছাই না ঢালতে পারে তবে তার নামও তাশরিফ নয়। তনির দিকে তাকিয়ে বলে,”ওনাকে গিয়ে বলো এক্ষুনি আমি আমার কেবিনে ডেকেছি। ফাস্ট। যাও।”

তনি মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারছে না এই অফিসে তার কাজটা ঠিক কি। তাশরিফ স্যারের কাছে মিনিটে মিনিটে রোদেলা ম্যামের ইনফরমেশন দেওয়ার জন্যই কি পনেরো হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে সে! এছাড়া তো অন্য কোনো কাজ সে করেই না অফিসে এসে !
তাশরিফ বিরস মুখে বসে থেকে গতকাল রাতের কথা ভাবে। তাহমিনা ছেলের কথার কোনো জবাব না দিয়েই চলে গিয়েছিলো রাতে। তাশরিফ গভীর রাত পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন বেশ বিরক্ত লাগছে তার। দুটো নারী তাকে সমানে নাচিয়ে যাচ্ছে অথচ সে সিংহ পুরুষ হয়ে চুপচাপ তাদের নিগ্রহ সহ্য করছে। তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে রোদেলা আমিনকে তুলে এনে বিয়ে করে নিয়ে মাকে দিয়েও জোর করে বধূবরণ করাতো। দু’জনকেই ধমকের উপরে রাখতো সে। বাঘে মোষে এক ঘাটে জল খাইয়ে ছাড়তো সে। কিন্তু তাশরিফের সেই ক্ষমতা নেই। কাউকে জোর করার ক্ষমতা নেই তাশরিফের। তাশরিফ উপন্যাসের সবথেকে বিরক্তির নায়ক!

“ম্যাম। আপনাকে তাশরিফ স্যার তার কেবিনে ডেকেছেন।”

রোদেলা খানিকটা অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,”আমাকে? কেনো?”
_ম্যাম তা তো জানি না। বলেছে দ্রুত যেতে।

রোদেলা সবার দিকে তাকায়। সবাই ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। রোদেলা বিরস মুখে বলে,”এখন আবার কেনো ডাকবে আমায়!”

_আরে রোদেলা কোনো ইম্পরট্যান্ট কাজ থাকতে পারে। তুমি যাও।

রিয়াজ তাড়া দেয় রোদেলাকে। রোদেলা উঠে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে,”রাশেদুজ্জামানের থেকে কোনো অংশে কম না এই লোকটা!”

দরজা ঠেলে ভেতরে মাথা বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাশরিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আসুন।”
রোদেলা ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে। তাশরিফ একমনে একটা ফাইল দেখছে। একটাবার রোদেলার দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। ফাইল থেকে চোখ না সরিয়েই পাশ থেকে আরেকটা ফাইল উঠিয়ে রোদেলাকে দেয়।
“এটা দেখে দিন।”
_এটা কিসের ফাইল স্যার।
_সিরামিক ফ্যাক্টরির হিসাব।
_স্যার,আমি তো আমার কাজ শেষ করেছি লাঞ্চ টাইমের আগে। এটা তো আমার কাজ নয়।

_এটা আমি আপনাকে যখন করতে বলেছি তার মানে এটা আপনার কাজ। নিন দেখে দিন। ফাস্ট।

রোদেলা কপাল কুঁচকে ফাইলটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাশরিফ বলে,”কোথায় যাচ্ছেন?”
_ফাইল দেখতে স্যার।
_এটা এখানে আমার সামনে বসে দেখবেন। আমাকে দেখিয়ে নেবেন প্রত্যেকটা হিসাব। ভুল হলে কোম্পানির লস।

রোদেলা কয়েক মূহুর্ত তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধপ করে বসে পরে চেয়ারে। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। মাঝে তাশরিফ একপলক রোদেলাকে দেখে। এভাবে এই হৃদয়হীনাকে হালকা শাস্তি দিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছে সে। রোদেলা ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”স্যার এখানে লাস্ট মান্থের ইমপোর্ট হিসেবের চার্ট টা খালি পরে আছে।”
_খালি পরে থাকলে হিসেব করে সংখ্যাটা বসিয়ে দিন। এটাও বলে দিতে হবে?

রোদেলা কিছুটা অবাক হয়ে তাশরিফের দিকে তাকায়। এই লোকটা এভাবে কেনো কথা বলছে তার সাথে! হলো টা কি এর!
তাশরিফ ক্যালকুলেটর এগিয়ে দিয়ে বলে,”নিন। হিসাব টা করে ফেলুন।”
রোদেলা হাত বাড়িয়ে ক্যালকুলেটর নেয়। এসব কোন ধরনের অত্যাচার রোদেলা বুঝতে পারছে না। তাকেই কেনো সহ্য করতে হবে সব! রোদেলা একমিনিটের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় চাকরি টা সে ছেরে দেবে, আপু দুলাভাইয়ের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করে নেবে।

“এতো অন্যমনষ্ক ভাব কেনো? কি ভাবছেন? বিয়ের কথা?”
রোদেলা চমকে ওঠে। এই লোকটা মনের কথা শুনে ফেললো কিভাবে তার!
তাশরিফ গম্ভীর হয়ে বলে,”এখন কাজ করার সময়। এসব ভেবে কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। কাজ করুন।”

***
আফতাব হাসান বেশ কিছুক্ষণ ধরে কয়েকবার ঘরে ঢুকছে এবং বেড়িয়ে যাচ্ছে। সে তার স্ত্রীর মুড বোঝার চেষ্টা করছে আসলে। তাহমিনা কাঁথা সেলাই করতে থাকলেও আফতাব হাসানের কর্মকাণ্ড তার চোখ এড়ায়নি। একসময় ধমকের সাথে বলে ওঠে,”এতো লম্ফ ঝম্প করছো কেনো? সমস্যা কি?”
আফতাব হাসান দাঁড়িয়ে পরে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার সাথে একটা বিষয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করতে চাই।”

তাহমিনা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”আমার সাথে কখনো পর্দাশীল আলোচনা করেছো নাকি যে আজ খোলামেলা আলোচনা করতে চাইছো? নটাঙ্কি না করে ঝেড়ে কাশো!”
আফতাব হাসান আমতা আমতা করে বলে,”রোদেলা মেয়েটা কিন্তু খারাপ না,এটা তো তুমি অস্বীকার করতে পারবে না বলো?”

_খারাপ না,কিন্তু ভালোও তো না।
_ভালো না কোথায়? কত চমৎকার একটি মেয়ে, সুন্দর, শিক্ষিতা বুদ্ধিমতি।
তাহমিনা কাঁথা রেখে আফতাব হাসানের দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”বেশ তো। এক কাজ করো, তুমি আজই গিয়ে তাশরিফের সাথে ওই মেয়েটার বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসো। আমি ভাইয়ের বাসায় চলে যাচ্ছি। তোমার পছন্দের বুদ্ধিমতি বড় বৌমা এসে রোজ তোমায় তার বুদ্ধি রান্না করে খাওয়াবে। ভালো হবে না বলো?

আফতাব হাসান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,”তুমি কেমন যেন নিষ্ঠুর ধরনের হয়ে যাচ্ছো তাহমিনা। আগে তো এমন ছিলে না!”

_তাই নাকি? তা আমি নিষ্ঠুর হলে সহৃদয়বান কে? আট তলার আর্কিটেক্ট সাহেবের ডিভোর্সী বোন তাইনা?
আফতাব হাসান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তাহমিনার দিকে। তাহমিনা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো? খুব তো দেখা হলেই একেবারে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলো ওই মহিলার সাথে। ছেলে একটা ভুল করতে চাচ্ছে,আর তুমি তার মদদ দিচ্ছো। কারন আমি বাড়ি ছাড়া হলেই তো তোমার সুবিধা হয়। আসলে আমারই নিজে থেকে চলে যাওয়া উচিত। ছেলেরা সবাই শিক্ষিত বৌ আনবে,তুমিও ওই শিক্ষিত মহিলাকে নিকাহ করে নিয়ে আসো তারপর সবাই মিলে এই বাড়িটাকে একটা “জাগো নারী” সংঘ বানিয়ে ফেলো।

_তাহমিনা উল্টো পাল্টা কথা না বলে ভেবে দেখো। সংসার তো আর আমরা করবো না। তাশরিফ যদি ভালো থাকে তাহলেই তো হলো!

_নিষেধ করেছে কে ওকে? যাক না,গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসুক আদিলের মতো।

আফতাব হাসান চুপ করে থাকে। তাহমিনাকে কিছু বলা বৃথা।

তাহমিনা কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,”একটা সুন্দর দেখে বৌ এনে দিলে বৌয়ের ভালোবাসায় দুদিনেই ওসব ভুত মাথা থেকে নেমে যাবে। ওসব নিয়ে ভাবছি না আমি। ভাবার দরকারও নেই।”

***
“বৃষ্টি মেঘলা আপুর সাথে তোমার কথা হয়েছে?”

বৃষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসে। আদিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”না তো। কেনো?”
_আপু আজ একটু দেখা করতে বললেন আমাদের।
বৃষ্টি কিছুটা অবাক হয়। তখনি তাশরিফ এসে ওদের দরজায় নক করে। আদিল দরজা খুলতেই তাশরিফ বলে,”মেঘলা আপু ফোন দিয়েছিলো। আমাকে বললো তোর সাথে যেতে বিকেলের দিকে। জানিস কিছু এ ব্যাপারে? কিসের জন্য যেতে বলেছে? আর কোথায়?”
_বললো বড় দুলাভাই নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তাই ট্রিট দিতে চাচ্ছে সবাইকে।‌

তাশরিফ এক মিনিট চিন্তা করে বলে,”আর কে কে আসবে জানিস?”

আদিল বেশ বুঝতে পেরেছে ভাইয়া রোদেলা আমিন আসবে কিনা জানতে চাইছে। তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে বলে,”মেজো আপু ব্যস্ত ভীষণ…..”
তাশরিফ আদিলকে পুরোটা বলতে না দিয়ে বলে,
_আমিও একটু ব্যস্ত। আমিও যেতে পারবো না।

আদিল বলে,”মেজো আপু ব্যস্ত ভীষণ তবুও আসবে।”

তাশরিফ থতমত খেয়ে যায়, তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,”মেঘলা আপু এতো করে যখন বলছে এখন আমি না গেলে খারাপ দেখাবে তাই না? আচ্ছা আমিও যাবো তাহলে।”
কথাটি বলে তাশরিফ চলে যায়। আদিল আর বৃষ্টি দু’জনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে উচ্চশব্দে হেসে ফেলে।

***
আদিল আর বৃষ্টির সাথে তাশরিফকে দেখতে পেয়ে রোদেলার চোখ কপালে উঠে যায়। মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”উনি এসেছে কেনো?”
মেঘলা কপাল কুঁচকে ফেলে, রোদেলাকে ধমক দিয়ে বলে,”একটা চড় খাবি। তাশরিফ কি বাইরের কেউ?”
রোদেলা বিড়বিড় করে বলে,”ঘরের কেউও তো না।”

মেঘলা রোদেলাকে চোখ রাঙানি দেয়। রোদেলা মনে মনে বলে,”তুমি বুঝতে পারছো না আপু ওনাকে দেখলে আমার খুব অস্বস্তি হয়!”

তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলারা বসে আছে রেস্টুরেন্টের ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্টে। তাশরিফরা খুব কাছে চলে গেলে মেঘলা উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাদের স্বাগত জানায়। বৃষ্টি একটু হেঁটেই হাঁপিয়ে উঠেছে, আদিল ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তাশরিফ একটা চেয়ারে বসে সুহা সিরাতের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া কোথায় আপু?”
_আছে,একজনকে রিসিভ করতে গিয়েছে।
_কে?

রোদেলা মনে মনে বলে,”এতো প্রশ্ন করবেন না,জানতে পারলে নিজেই আহত হবেন।”

মেঘলা কিছু বলে ওঠার আগে সুহা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”ছোটো আন্টি, তোমার পেটটা এতো ফুলে আছে কেনো? তুমি অনেক বেশি খাও নাকি?”
ওখানে বসে থাকা সবাই বিব্রত হয়ে যায়। সিরাত বলে,”গাধা,আন্টির পেটে বাবু আছে। রোশনি ম্যামকে দেখিসনি? তার পেট এরকম ফুলে গিয়েছিলো আর সবাই বলছিলো ম্যামের পেটে বাবু আছে।”

সুহা হা করে তাকিয়ে থাকে, অবাক হয়ে বলে,”পেটের ভেতর বাবু কিভাবে থাকে?”
মেঘলা ঘাবড়ে যায় তার ছেলে মেয়ের অতিরিক্ত কৌতুহল দেখে। এখন এদের কি বলবে সে!

বৃষ্টি ভীষণ লজ্জা পেয়ে ওড়না দিয়ে পেটটা ঢাকে,ভাসুরের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হলো তার সেজন্য লজ্জা লাগছে খুব!

আদিল বিড়বিড় করে বলে,”আল্লাহ এদের মুখ বন্ধ করি কিভাবে?”
তারপর সুহা সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই গেমস খেলবে সোনারা?”
দু’জনেই মাথা নাড়ায়। আদিল ওদেরকে নিজের ফোনটা দিয়ে চুপ করিয়ে রাখে।

তাশরিফ মেঘলাকে বলে,”কাকে রিসিভ করতে গিয়েছে ভাইয়া? ভাইয়ার কোনো রিলেটিভ?”

মেঘলা আনন্দিত গলায় বলে,”আজ তোমাদের ভাইয়া তোমাদের শুধু ট্রিট দেওয়ার জন্য ডেকে আনেন নি, আজ আর একটা বিশেষ কারন রয়েছে তোমাদের ডাকার। আজ রোদেলাকে কেউ দেখতে আসবে, তোমার ভাইয়ার পরিচিত। ছেলে এখন একা এসে রোদেলার সাথে পরিচিত হবে। তারপর ঠিক করবো বিয়ের কথা এগোবো কি না।”

এটা যদি কোনো ড্রামা সিরিয়াল হতো তাহলে ক্যামেরা তাশরিফের মুখে ফোকাস করে পরিচালক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে গুড়ুম গুড়ুম বজ্রপাতের শব্দ লাগিয়ে দিতেন‌।

রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল পানি খেতে নিচ্ছিলো,মেঘলার কথা শুনে কাশতে কাশতে তাশরিফের দিকে তাকায়। তাশরিফ একবার রোদেলা, একবার মেঘলাকে দেখে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,”আপু এটা তো আপনাদের পারিবারিক বিষয়। আমাকে কেনো…?”

_আরে ধুর ভাইয়া। তুমি কি পরিবারের বাইরে নাকি? এই শহরে আমাদের রিলেটিভ বলতে তো শুধু তোমরাই আছো। আর তাছাড়া তুমি তো আমাদের তিন বোনের ভাইয়ের মতো।

আদিল আবারো পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো,মেঘলার এই কথাটি শুনে আদিল এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। বিষম খেয়ে কাশতে থাকে অনবরত। বৃষ্টি বিরক্ত হয়ে তাকায় আদিলের দিকে।

তাশরিফ কঠিন দৃষ্টিতে রোদেলাকে দেখে। এতো সেজে এসেছে পাত্রকে দেখানোর জন্য তবে! ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি! সবকিছুই পাত্রকে ইমপ্রেসড করার জন্য!
তাশরিফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। গিরগিটি একটা! খুব তো বলতো বিয়ে করবে না,বিয়ে করবে না। এখন যেই সরকারি চাকরি ওয়ালা পাত্র পেয়েছে অমনি দুই পায়ে দাঁড়িয়ে রাজি হয়ে গিয়েছে। গিরগিটি রোদেলা আমিন!

সাদাফ এসে দাঁড়ায় তাদের পেছনে। রোদেলা সাদাফের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়,সাথে সাথে বলে ওঠে,”আপনি?”

তাশরিফ মাথা ঘুরিয়ে দেখে লোকটাকে। এটা তো সেই পুলিশ ইন্সপেক্টর ! এ এখানে কেনো!

মিহির মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,”জ্বি। আমি। আমি মিহির।”

সাদাফ হেসে রোদেলাকে বলে,”মিহিরের সাথে তোমাদের অফিসে নাকি দেখা হয়েছিলো তোমার। মিহির বলেছে আমাকে।”

রোদেলা বিব্রত হয়ে পরে,এই লোকটা তাকেই এ্যারেস্ট করতে গিয়েছিলো সেটা বলে দেয়নিতো সাদাফ ভাইয়াকে!

তাশরিফ উঠে দাঁড়ায়। সাদাফ মিহিরের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে। তাশরিফের দিকে মিহির হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”হাই তাশরিফ! আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
তাশরিফ কঠিন দৃষ্টিতে দেখে মিহিরকে,মনে মনে বলে,”ইঁদুর মুখো বনবিড়াল কোথাকার! তুই কোত্থেকে উদয় হলি রে! একটা ঘুষি মেরে তোর চেহারার অবকাঠামো চেইঞ্জ করে দেবো!”

মুখে বলে,”জ্বি।”

সাদাফ মিহিরকে একটা চেয়ারে বসতে বলে নিজেও বসে। রোদেলা মাথা নিচু করে রেখেছে। তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি রোদেলাকে বলছে,”এই লোকটার দিকে তাকাবেন না আপনি খবরদার।”
রোদেলা সে কথা শুনতে না পেলেও মিহিরের দিকে তাকায় না সে।সেও মনে মনে তাশরিফকে বলে,”কেনো এসেছেন নাচতে নাচতে এখানে? এখন দেখতে থাকুন নাটক।”

কিছুক্ষণ সবাই কথা বলে। চুপচাপ আছে শুধু তাশরিফ আর রোদেলা। মেঘলার মিহিরকে বেশ পছন্দ হয়েছে। কয়েক মিনিট হলো এখানে এসেছে অথচ এমন ভাবে কথা বলছে যেন কতদিনের পরিচয় তাদের সাথে মিহিরের।
সাদাফ খাবার অর্ডার দেওয়ার আগে একবার রোদেলাকে দেখে। তারপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”মেঘলা। আমি একটা কাজ করেছি।”
_কি কাজ?
_ওদের জন্য মানে রোদেলা আর মিহিরের জন্য আলাদা টেবিল বুক করেছি। ওদেরকে আলাদা কথা বলতে দেই বরং।

মেঘলা হেসে বলে,”ভালোই করেছেন। ওদের তো আলাদা কথা বলতে দেওয়াই উচিত।”
তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা সাদাফের কথা শুনে তাশরিফের দিকে তাকায়। সে কেনো তাশরিফের দিকে তাকিয়েছে সে নিজেও জানে না।
তাশরিফের দৃষ্টি তাকে অস্বস্তি দিচ্ছে খুব। ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পরছে রোদেলা। তার কারন তার জানা নেই।

সাদাফ মিহির আর রোদেলাকে খানিকটা দূরে একটা টেবিল দেখিয়ে গিয়ে বসতে বলে। রোদেলা আবারো তাশরিফের দিকে তাকায়।

***

মিহির রোদেলাকে দেখছে। রোদেলা একবার মিহিরের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। পরক্ষনেই রোদেলা চোখ তুলে তাকায় তাশরিফের দিকে। রোদেলা যেখানে বসে আছে,তাশরিফ কে সেখান থেকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। তাশরিফ তার দিকে কটমট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টি দেখে রোদেলা নার্ভাস হয়ে পরছে কেনো রোদেলা বুঝতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে তাশরিফ তাকে বলছে,”খবরদার যদি ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন তো!”
না চাইতেও বারবার চোখ চলে যাচ্ছে তাশরিফের দিকে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে খাবার সার্ভ করে যায়। মিহির হালকা কেশে রোদেলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। রোদেলা মিহিরের দিকে না তাকিয়ে তাকে বলে,”বলুন।”

মিহির রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”সেদিন আপনাকে ওভাবে আমি আশা করিনি। বিয়ের পাত্রীকে এরেস্ট করতে গিয়েছিলাম! হাহা !”

রোদেলা মাথা তোলে, কিন্তু দৃষ্টি তাশরিফের দিকে রেখে বলে,”আপনি সাদাফ ভাইয়াকে বলে দিয়েছেন এসব কথা?”

_না, বিয়ের পরে বলে দেবো। সবাই চমকে যাবে শুনলে।

রোদেলা অবাক হয়ে যায়। কথা বার্তা এখনো কিছুই ঠিক হয়নি অলরেডি বিয়ের কথা চিন্তা করে রেখেছে!

মিহির বলে,”আপনার আর আমার নামের বেশ মিল দেখেছেন। আপনি রোদ,আমি সূর্য। দু’জনেই উত্তপ্ত। আচ্ছা আপনার রাগ কি খুব বেশি? সাদাফ ভাইয়া বললো। আমার রাগ কিন্তু আপনার তিন গুণ। যেসব ঘুঘুদের রিমান্ডে নিয়েছি তারা বলতে পারবে।”

রোদেলা কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ওই তাশরিফ হাসান তার দিক থেকে চোখই ফেরাচ্ছে না। রোদেলার ইচ্ছা করছে গিয়ে তার পা ধরে বলতে,”অনেক হয়েছে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে খুব।এবার চোখ নামান। আমি এই মিহির লোকটার সাথে একটুও হেসে কথা বলবো না।”
কথাটা ভেবেই রোদেলা চোখ বড় বড় করে ফেলে। কি আশ্চর্য ! সে তাশরিফকে কৈফিয়ত কেনো দেবে! কে ঐ লোকটা! নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে রোদেলার। ইচ্ছে করছে রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে।

মিহির বলে,”সেদিন রাশেদুজ্জামানকে কি সুন্দর গালি দিলেন। আচ্ছা আপনি এতো চমৎকার গালাগাল কোথায় শিখেছেন?”
রোদেলা চুপ করে আছে। মিহির রোদেলার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকায়। তারপর মাথা ঘুরিয়ে রোদেলাকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি ওদিকে কি দেখছেন বারবার?”

রোদেলা চমকে ওঠে,”না। নাতো,কাউকে দেখছি না।”

মিহির হেসে বলে,”খাচ্ছেন না কেনো। খান।”

রোদেলা এক চামচ স্যুপ মুখে দিতে নিয়েও দেয়না। তার এখন প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।

“তাশরিফ খাচ্ছো না কেন?”
মেঘলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ আমতা আমতা করে বলে,”খেতে ইচ্ছে করছে না আপু। আপনারা খান,আমি বরং দেখি।”
_শরীর খারাপ নাকি তোমার ভাই?
সাদাফ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে।
তাশরিফ কপাল কুঁচকে ফেলে,মনে মনে বলে,”আপনার আর দরদ দেখাতে হবে না বেঈমানের বেঈমান। এতো পোংটামি করতে কে বলেছে? রোদেলা আমিন কি আপনার অন্ন খাচ্ছিলো যে ওনাকে বিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছেন।”

মুখে বলে,”জ্বি না ভাইয়া।”

সাদাফ রোদেলা আর মিহিরকে দেখিয়ে মেঘলাকে বলে,”দুজনকে কি সুন্দর মানাবে দেখেছো?”

তাশরিফ মনে মনে বলে,”বাল মানাবে।”
কথাটি বলে সে অবাক হয়ে যায়। রাগের চোটে এসব কি কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার। ছিঃ ছিঃ।

মেঘলা বলে,”ঠিক বলেছেন। খুব মানাবে।”

তাশরিফ মনে মনে মেঘলাকে বলে,”আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। এখন থেকে আই হেট ইউ আপু।”

আদিল আর বৃষ্টি খাওয়া থামিয়ে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি আদিলকে খোচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভাইয়ার হাবভাব একটুও ভালো ঠেকছে না,কেমন থম মেরে আছে। এখন কি হবে?”

“কি হবে তা জানিনা। তবে কিছু একটা হবে!”

***
“কি ব্যাপার। তোমরা চলে এলে এখানে,কথা বলা হয়ে গিয়েছে?”

মিহির একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,”স্বল্প আলাপই থাকুক। সব কথা এখন বলে শেষ করে ফেলার তো মানে হয় না।”

রোদেলা মাথা নিচু করে রেখে। একবার আড়চোখে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে দেখে তাশরিফ আর তার দিকে তাকিয়ে নেই। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে রোদেলা তার বৌ আর পরপুরুষের সাথে কথা বলার অপরাধে রোদেলার থেকে অভিমানী মুখ সরিয়ে রেখেছে।

মিহির সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া এবার যে উঠতে হবে আমার। ডিউটি ফেলে এসেছি।”
_ওহহ,হ্যা শিওর। যাও তুমি। তোমার ভাইয়ার সাথে আমি কথা বলে নেবো। রোদেলার ফোন নাম্বার নিয়েছো?
_জ্বি ভাইয়া।

মিহির সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমি আসছি। আপনারা ভালো থাকুন।”
তারপর শুধু রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসছি।”

রোদেলা কোনো জবাব দেয়না। সে বুঝতে পারছে না তাশরিফের অভিমানী মুখ দেখে তার এতো খারাপ লাগছে কেনো। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে।

মিহির চলে যেতেই তাশরিফ উঠে দাঁড়ায়। মেঘলা আর সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমারো এখন উঠতে হবে।”

_তুমি তো কিছু খেলেই না তাশরিফ।

তাশরিফ তার কোনো উত্তর না দিয়ে বিরস মুখে বেড়িয়ে যায়। সাদাফ আর মেঘলা কিছুটা অবাক হয় তাশরিফের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে। আদিল তাদের আশ্বস্ত করে বলে,”ভাইয়ার মাথা ব্যথা রোগ আছে। হুট হাট হয়। তাই ভাইয়া এমন করছে।”

রোদেলা চুপচাপ বসেছিলো। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আপু আমিও বাড়িতে যাবো।”

***
আদিল বৃষ্টিকে নিয়ে আজ শশুর বাড়ীতে এসেছে। রাতটা এখানে থাকবে তারা। বসার ঘরে বাবার পাশে বসে বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে বৃষ্টি। আদিল দূর থেকে তাদের দেখছে। তার বেবীটা পৃথিবীতে এলে সেও এভাবেই আদরে রাখবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবতে থাকে সে। ফোনের রিংটোনে তার ঘোর কেটে যায়। স্ক্রিনে তাশরিফের নাম্বার দেখে দ্রুত রিসিভ করে কানে ধরে সে, ওপাশ থেকে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ বলে ওঠে,”এই ফোনটা যার আপনি তার কি হন?”
আদিল অবাক হয়ে বলে,”ভাই। কিন্তু আপনি কে? ভাইয়ার ফোন আপনার কাছে কি করছে?”
লোকটা তাশরিফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,”আপনার ভাইয়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি শিঘ্রই আসুন।”

আদিল ফোন কেটে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা বিকট চিৎকার দেয়।

রোদেলা নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়েছিলো। হকচকিয়ে উঠে বসে ঘরের দরজার দিকে চায়। বৃষ্টি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দরজায় এসে দাড়িয়ে বলে,”আপু ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে!”

চলমান…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে