#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২১
#লেখিকা_Esrat_Ety
তাহমিনা কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তাশরিফ আমতা আমতা করে বলে,”তোমাকে কয়েকদিন পরে জানাতেই যাচ্ছিলাম মা।”
_তুই কি আমার সাথে মজা করছিস? একটু পরিষ্কার করে বলতো।
_না।
একশব্দে জবাব দেয় তাশরিফ। তাহমিনা চেঁচিয়ে ওঠে,”খবরদার যদি আর একবার তোর মুখে এসব কথা শুনি তো। খুব খারাপ হয়ে যাবে তাশরিফ।”
_মা সমস্যা কোথায়? তুমিই তো বলতে আমার পছন্দ থাকলে তোমাকে জানাতে। তুমি মেনে নিবে,তাহলে এখন এমন করছো কেনো?
_পছন্দ করতে বলেছি বলে রোদেলা আমিনকেই করবি? দুনিয়ার আর কোনো মেয়ে নেই?
_রোদেলা আমিনের মধ্যে কি সমস্যা দেখলে তুমি? ওনাকে কেন পছন্দ করা যাবে না?
_তুই কি আমাকে জেরা করছিস?
_একটা আপত্তি তুললে অথচ কারন জানাবে না?
_কারন হচ্ছে ওই মেয়ের কোনো যোগ্যতা নেই আমার বড় ছেলের বৌ হবার। চাল চলন ঠিক নেই, আদব কায়দা জানেনা, অহংকারী।
_মা এগুলো তোমার মনে হচ্ছে। উনি খুব ভালো মনের মেয়ে মা, তুমি বিশ্বাস করো।
ছেলের কথায় তাহমিনা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে।
_বাহ! এরই মধ্যে ওই মেয়ের হয়ে সাফাই গাইতে শুরু করেছিস তাও মাকে ধমক দিয়ে।
তাশরিফ নরম গলায় বলে,”ভুল বুঝছো মা তুমি।”
_শোন,ওই মেয়ে আর যাই হোক আমার সংসারের বৌ হবার অযোগ্য।
_তাহলে বাদল চাচার ছেলের জন্য কেনো পছন্দ করেছিলে?
_কারন তোর চাচা চাচী জীবিত নেই। ছেলে এতিম। আর রোদেলাকে দেখলে তোর মনে হয় যে ও শশুর শাশুড়ি নিয়ে সংসার করার মতো মেয়ে? ও তো পরিবার কি তার মানেই জানে না। কথায় কথায় বৃষ্টিকে আদিলের থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়, আমাদের থেকে দূরে নিয়ে যেতে যায়। আর শুনেছি তো আমি,ওর বড় বোনের ডিভোর্স টাও তো ও দায়িত্ব নিয়ে করিয়েছে। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া পরিবারের মেয়েদের মানসিকতা এমনই হয়।
_মা আন্দাজে একটা কথা বলে দিলে না? আচ্ছা,রোদেলা আমিন কে নিয়ে এতো সমস্যা,তাহলে বৃষ্টিকে মানতে পারলে কেনো?
_কারন বৃষ্টি ওর মতো না। বৃষ্টির বয়স কম,আমি গড়ে নিয়েছি বৃষ্টিকে আমার মতো। ওই মেয়েটা তো ভাব করে যেন পৃথিবীর সব জ্ঞান নিজেই মাথায় করে বয়ে বেড়ায়, আর বয়স টা? তোর কাছাকাছি বয়স। এই বয়সী মেয়েরা খুব ধূর্ত হয়, সংসারে বেশি চালাকি করে। আমার তো মনে হয় বয়স তোর চেয়েও বেশি।
তাশরিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিনা মেজাজ দেখিয়ে বলতে থাকে,”শোন তাশরিফ। ফের যদি আমি এ ধরনের কথা শুনি তাহলে আমি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। মনে রাখিস।”
তাশরিফ চুপ করে থাকে। তাহমিনা বলে,”কি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? এখন এটা বলবি তাই না যে রোদেলাকে না পেলে আর কাউকে বিয়ে করবি না? ঠিকাছে,করিস না। ওমন মেয়েকে বৌ বানিয়ে সংসার টা ভাসিয়ে দেওয়ার চেয়ে তোর বিয়ে না করাই ভালো।”
মাকে এই মুহূর্তে আর রাগিয়ে দিতে চাচ্ছে না তাশরিফ। তাই চুপচাপ শুনতে থাকে সব কথা। তাহমিনা প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়েছে। গটগট করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। তাশরিফ বিছানার উপর ধপ করে বসে পরে। এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে তা সে জানতো। মা যে কোনোভাবেই রোদেলা আমিনকে মানবে না, সবটাই তো তাশরিফের জানা। তবুও তার বিশ্বাস সে একদিন ঠিকই রোদেলা আমিন নামের ওই অহংকারী,বদমেজাজি মেয়েটিকে পাবে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হবে সেটা!
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে তাশরিফ বলতে থাকে,”সমস্যা নাম্বার পাঁচ। তোমার মা রোদেলা আমিনকে রিজেক্ট করেছে তাশরিফ হাসান।”
***
“মন খারাপ নাকি তাশরিফ?”
খলিলুর রহমান,মেহেরিন এবং আরো কয়েকজন জুনিয়র এম্প্লয়ি তাশরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে কৌতুহল।
তাশরিফ টিফিন বক্স সামনে নিয়ে বসে আছে। রোদেলা খেতে খেতে একপলক তাশরিফের দিকে চায়। তারপর আবার খেতে থাকে।
মেহেরিন বলে,”তাশরিফ স্যার? আপনাকে বলছি! আপনার কি মন খারাপ?”
তাশরিফ মেহেরিনের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,”প্লিজ মেহেরিন আপা! স্যার বলবেন না। এটা ক্যান্টিন। এখানে অফিশিয়াল কথা আমরা বলি না। আর আমার মন খারাপ নেই। আমি ঠিক আছি।”
_ঠিক নেই। তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে তুমি কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। সবসময় ক্লিন শেভ করা তাশরিফ হাসানের মুখে খোচা খোচা দাড়ি দেখতে পাচ্ছি!
খলিলুর রহমান হাসতে হাসতে বলে।
তাশরিফ চুপ করে আছে। খলিলুর রহমান বলতে থাকে,”প্রেম ঘটিত ব্যাপার? প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? প্রেমিকা ছেড়ে চলে গিয়েছে? কোনটা? বলো!”
তাশরিফ একপলক খলিলুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে,”বিষয়টা খুবই কম্প্লিকেটেড! আচ্ছা খলিল স্যার,আপনার কাছে শুনেছি আপনার লাভ ম্যারেজ ছিলো, আপনার মা প্রথমে নাকি ভাবীকে মেনে নেয়নি। পরে কিভাবে মেনে নিয়েছিলো?”
_একথা জিজ্ঞেস করছো কেনো? আছে নাকি কেউ? তোমার মা মানছে না?
_হু।
মৃদু স্বরে জবাব দেয় তাশরিফ।
সবাই অবাক হয়ে দেখে তাশরিফকে। রোদেলাও কিছুটা অবাক হয়। খাওয়া থামিয়ে রেখে তাকিয়ে আছে।
খলিলুর রহমান বলে,”মানছে না কেনো? কি সমস্যা? কি নিয়ে আপত্তি তুলেছে?”
_মায়ের মতে সে রাগী, অহংকারী, তার বয়স বেশি হয়ে গিয়েছে।
“বয়স বেশি” শব্দটা শুনেই রোদেলার রাগ উঠে যায়। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”বয়স কত তার?”
তাশরিফ থতমত খেয়ে রোদেলার দিকে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,”সাতাশ।”
_আর আপনার?
_ত্রিশ।
_তার সাতাশ,সে বুড়ি। আর আপনার ত্রিশ,আপনি কচি খোকা?
তাশরিফ চুপ করে আছে। রোদেলা বলে,”এক কাজ করুন। আপনি বরং আপনার মাকে নিয়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। দেখবেন ওখানে আপনার মা আপনার জন্য তার মনের মতো পুত্রবধূ খুজে পাবে। একদম কচি, আপনার মতো কচি।”
তাশরিফ রোদেলার কথা শুনে তাজ্জব বনে যায়। অন্য সবাই একটু রোদেলার প্রতি বিরক্ত হয়,এভাবে অপমান করে দিলো বসকে! রোদেলা খাওয়া শেষ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে উঠে চলে যায়। তাশরিফ তার টিফিন বক্সের দিকে তাকিয়ে আছে।
মেহেরিন বলে,”কিভাবে পরিচয় হলো তাশরিফ? কতদিন হয়েছে? কেমন দেখতে?”
বিরস মুখে তাশরিফ জবাব দেয়,”সম্পর্ক হয়নি আপা। এক তরফা। সে জানেই না।”
খলিলুর রহমান বলে,”যাকে বিয়ে করবে সেই জানে না। আর তুমি মা মানছে না বলে খাবি খাচ্ছো! ধূরর মিয়া! তুমি এতো কাচা কাজের জানতাম নাতো। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।”
তাশরিফ মুখ কালো করে ফেলে। সত্যিই তাকে দিয়ে কিছু হবে না। কিছুই না!
***
বৃষ্টি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। তাকে ভীষণ মোটা লাগছে। চেহারায় আগের সেই লাবন্যতা নেই। কেমন ফ্যাকাশে লাগছে মুখটা। আদিল আড়চোখে তার বৌকে একবার দেখে।
“কি দেখছো এভাবে?”
_আমাকে খুব বাজে লাগছে দেখতে তাই না?
_হু ,তা লাগছে। কোচিং-এ এমন রুপে তোমাকে দেখলে আমি কখনোই ক্রাশ খেতাম না।
বৃষ্টি মুখ কালো করে ফেলে। বাচ্চা হয়ে গেলে তার সৌন্দর্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে,মোটা হয়ে যাবে সে। তখন আদিল আর তার মাঝে মুগ্ধতা খুজে পাবে না। তার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যাবে। আজ ক্লাসে গিয়ে শুনেছে তাদের এক বান্ধবীর সাথে ঠিক এমনটাই হয়েছে। বৃষ্টির নিজেকে দেখে খুব খারাপ লাগছে।
আদিল বৃষ্টির দিকে তাকায়। তারপর উঠে এসে বৃষ্টিকে জরিয়ে ধরে বলে,”তোমাকে খুব বিশ্রী লাগছে দেখতে। কিন্তু একজন মাকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। দেখবে তুমি?”
বৃষ্টি আদিলের দিকে তাকায়। আদিল বৃষ্টিকে ধরে ঘুরিয়ে দেয়। আয়নায় বৃষ্টির প্রতিবিম্বের দিকে আঙুল তুলে বলে,”ওই দেখো,কি চমৎকার দেখতে একজন মা।”
বৃষ্টি ঘুরে আদিলের বুকে মুখ লুকায়। তাহমিনা দরজায় নক করে ডাকে বৃষ্টিকে। আদিলের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় বৃষ্টি। ওড়না দিয়ে পেটটা ভালোভাবে ঢেকে নেয়। পেটটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। তার লজ্জা লাগে কাউকে দেখাতে। আদিল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তাহমিনা ঘরে ঢোকে, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”ফল যা কেটে দিয়েছিলাম খেয়েছিলে?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। তাহমিনা এসে বিছানার উপর বসে। বৃষ্টিকে বলে,”তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। জানিনা কথাটা কিভাবে নেবে। কিন্তু আমার বলা জরুরি।”
বৃষ্টি নিচু স্বরে বলে,”আপনি বলুন মা।”
তাহমিনা কোনোরকম ভনিতা না করে বলে,”তোমার ভাসুর কাল আমায় জানিয়েছে সে তোমার মেজো বোন রোদেলা আমিনকে বিয়ে করতে চায়।”
বৃষ্টির মুখ হা হয়ে যায় শাশুড়ির কথা শুনে। তাহমিনা বলে,”ব্যক্তিগত ভাবে আমি রোদেলা আমিনকে পছন্দ করিনা। তাই আমি চাইও না ছেলের এই আবদারকে প্রশ্রয় দিতে। তুমিও তোমার বোনকে বলে দিও দয়া করে সে যেনো আর আমার ছেলেকে প্রশ্রয় না দেয়। তাহলে খুব উপকৃত হব। এতটুকু বলতে পারবে না বোনকে? আমি চাচ্ছি না তোমার বোনের সাথে সরাসরি কথা বলতে এই ব্যাপারে।”
বৃষ্টির হতভম্ব ভাব কাটছে না। তাশরিফ ভাইয়া রোদেলা আপুকে পছন্দ করে! কি আশ্চর্য কথা!
তাহমিনা উঠে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে আদিল ঘরে ঢুকে বলে,”মায়ের কি হয়েছে বলোতো! কেমন থমথমে মুখ নিয়ে ঘুরছে। তুমি জানো কিছু?”
বৃষ্টি মৃদু স্বরে বলে,”তাশরিফ ভাইয়া তোমার সিমেন্ট আপুকে পছন্দ করে। সেটা জানতে পেরে মায়ের এই হাল হয়েছে।”
_ওও
আদিল প্রথমে বৃষ্টির কথাটা বুঝতে পারেনি। পরক্ষনেই চোখ বড়বড় করে চেঁচিয়ে ওঠে,”মানে? কি বললে তুমি? ভাইয়া সিমেন্ট আপুকে পছন্দ করে?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়।
“শুধু তাই না। কাল নাকি মাকে জানিয়েছে আপুকে সে বিয়ে করতে চায়।
আদিল ধপপ করে বিছানার উপর বসে পরে। তার হতভম্ব ভাব যেন কাটছেই না। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”আমি ভাইয়ার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। কত বড় কলিজা হলে কেউ ওই ভয়ংকর মহিলাকে বৌ বানানোর শখ করতে পারে।”
বৃষ্টি আদিলের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। আদিল বলে,”সিমেন্ট আপুকে সিমেন্ট ভাবী হিসেবে কিছুতেই মানতে পারবো না আমি। অসম্ভব!”
***
দরজার নব ঘোরানোর আগে রোদেলা ভাবতে থাকে আজ কি গল্প শোনাবে সে যাতে ওই লোকটার সামান্য হলেও শিক্ষা হয়, লজ্জা হয়।ভেতর থেকে রাশেদুজ্জামানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তিনি মুঠোফোনে কারো সাথে “হাহা হিহি” টাইপ কথা বলছেন। নিশ্চয়ই কোনো প্রেমিকা হবে। অন্যদের কাছ থেকে শুনেছে রোদেলা,এই রাশেদুজ্জামান বলে লোকটার নাকি অসংখ্য প্রেমিকা আছে। এজন্যই নাকি লোকটার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে। আর সব প্রেমিকাই নাকি বিশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সী ভার্সিটি পড়ুয়া। রোদেলার কাছে বিদঘুটে লাগে শুনতে,এই মেয়ে গুলো এই বুড়ো লোকটার ফাঁদে আটকায় কিভাবে! দামী উপহার পেলেই এভাবে আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিতে হবে? এদের মা বাবা কি এজন্য এদের পড়াশোনা করায়!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ায় সে। রাশেদুজ্জামান ফোনে কথা বলতে বলতে রোদেলাকে হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বলে।
রোদেলা বসে। ফোন রেখে রাশেদুজ্জামান কয়েক পলক রোদেলাকে দেখে। মেয়েটা আরো সুন্দরী হয়ে গিয়েছে ! এতো পারফেক্ট শারীরিক গঠন খুবই কম দেখেছে রাশেদুজ্জামান। রোদেলা রাশেদুজ্জামানের দৃষ্টি দেখে নিজেকে গুটিয়ে নয়। রাশেদুজ্জামান গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”মিটিং এ আপনাদের যা কাজ দেওয়া হয়েছে আশা করি তা বুঝতে পেরেছেন?”
লোকটা আবার আপনি আপনি করে বলতে শুরু করেছে। রোদেলা কিছুটা স্বস্তি পায়। সেদিনের অপমান কিছুটা হলেও গায়ে মেখেছে তাহলে। রোদেলা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,”জ্বি স্যার।”
রাশেদুজ্জামান টেবিল থেকে একটা ফাইল উঠিয়ে রোদেলাকে দিয়ে বলে,”এটা দেখবেন। ধীরে সুস্থে দেখবেন,কোনো চাপ নেই। আর ফাইলটা সাবধানে রাখবেন।”
রোদেলা হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নেয়। তারপর উঠে চলে যায়। রাশেদুজ্জামান পেছন থেকে দেখছে রোদেলাকে। তার মুখে পৈশাচিক হাসি!
বিড়বিড় করে বলে উঠলো,”তোমাকে খুব শীঘ্রই পেতে চলেছি আমি রোদেলা আমিন! অপেক্ষা করো।”
***
“কি? মুখটাতো শুকনো লাগছে। এই সময়ে একটু হরমোনাল চেইঞ্জ আসে , তাই বিষন্নতায় ভোগে মেয়েরা আমি জানি।”
বৃষ্টির দিকে একবার তাকিয়ে কথাটি বলে একগ্লাস কমলার রস তার দিকে এগিয়ে দেয় রোদেলা। বৃষ্টি কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না রোদেলাকে কথাটা সে কিভাবে বলবে,আপু কিভাবে রিয়েক্ট করবে। রোদেলা বলে,”আচ্ছা আমি এখন উঠবো,তুই নিজের খেয়াল রাখিস।”
রোদেলা উঠে দাড়াতেই বৃষ্টি বলে,”আপু একটা কথা বলবো?”
_হ্যা বল,কি কথা?
বৃষ্টি একটা ঢোক গিলে বলে,”তাশরিফ ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে,বিয়ে করতে চায় তুমি জানতে?”
রোদেলার মনে হলো সে ভুলভাল কিছু শুনছে। আবারো জিজ্ঞেস করে,”বুঝলাম না। কি, আবার বল!”
_তাশরিফ ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে,ভালোবাসে, তোমাকে বিয়ে করতে চায়। তুমি জানতে?
রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি বলে, “ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করার কথা মাকে জানিয়েছে। মা সাফ মানা করে দিয়েছে। ভাইয়ার সাথে কথা বলছে না মা। মা তোমাকে বলে দিতে বলেছে তুমি যেন ভাইয়াকে আর লাই না দাও।”
হুট করে রোদেলার মাথায় রক্ত উঠে যায়,”আর লাই না দেই মানে কি? আমি ওই লোকটাকে কখন লাই দিলাম যে উনি “আর” শব্দটা ব্যবহার করলেন?”
রাগে কেঁপে ওঠে রোদেলা। অফিসে যে মেয়েটির কথা তাশরিফ সবাইকে বলেছে সেদিন সেটা তার মানে রোদেলা ছিলো! রোদেলার বয়স নিয়ে তাহমিনা কথা শুনিয়েছে সেটা ভাবতেই তার রাগ বাড়তে থাকে।
বৃষ্টি ভয় পেয়ে যায় রোদেলার রাগ দেখে। আমতা আমতা করে বলে,”আপু তুমি……”
রোদেলা বৃষ্টির কথা না শুনেই উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টি বলে,”কোথায় যাচ্ছো আপু?”
_তোর শাশুড়ির কাছে।
হনহন করে বৃষ্টির ঘর থেকে বের হয় রোদেলা। বৃষ্টি বিছানা থেকে নেমে রোদেলার পিছু নেয়। আজ একটা কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে সে নিশ্চিত!
দ্রুত পায়ে হেঁটে বসার ঘরে এসে দাঁড়ায়। তাহমিনা তখন বসার ঘরের সোফায় বসে তার হবু নাতী নাতনির জন্য নকশিকাঁথা সেলাই করছিলেন। তাশরিফ এবং আদিল বসার ঘরের সাথে লাগোয়া ডাইনিং রুমে বসে খাচ্ছিলো।
“আপনি বৃষ্টিকে কি বলেছেন? আমি আপনার ছেলেকে লাই দিয়েছি? এটা বলতে চেয়েছেন?”
তাহমিনা হতভম্ব হয়ে মাথা তুলে তাকায়। তাশরিফ খাওয়া রেখে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে।
রোদেলা বলতে থাকে,”শুনুন। একটা কথা আপনাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি। আমি কখনোই আপনার ছেলেকে লাই দিইনি আর তাকে লাই দেওয়ার নূন্যতম ইচ্ছেও আমার নেই । বুঝতে পেরেছেন আপনি?”
রোদেলার ধমকে তাহমিনা উঠে দাঁড়ায়। তাশরিফ হাত ধুয়ে উঠে পরে। আদিলও উঠে দাঁড়ায়।
রোদেলা বলে,”কি ভাবেন কি আপনারা ছেলের জন্ম দিয়ে? আর আপনার ছেলে একটু সুন্দর বলে ভেবেছেন সব মেয়ে তার জন্য পাগল হয়ে যাবে তাইনা,ভেসে যাবে তার জন্য?”
তাশরিফ মৃদু স্বরে কিন্তু দৃঢ় ভাবে বলে,”রোদেলা আপনি এভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে পারেন না। উনি আপনার গুরুজন।”
রোদেলা তাহমিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি কখনোই কোনো মায়ের আঁচল ধরা “সন্টু মন্টু” ধেরে খোকাকে বিয়ে করতে,তাকে লাই দিতে ইচ্ছুক না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
তারপর তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে নিয়ে এই সমস্ত ভাবার?”
রোদেলার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে তাশরিফ। রোদেলা বলতে থাকে,”আপনার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আপনাকে বিয়ে করারও আমার ইচ্ছে নেই। এটা আপনিও বুঝে নিন আর আপনার মাকেও বুঝিয়ে দিন,এই বিষয়ে তিনি আমার বোনকে যেন ফের কোনো কথা না শোনায়।”
রোদেলা চলে যাওয়ার পরে তাশরিফ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আদিলও চিন্তিত ভঙ্গিতে মাকে দেখে। এতো কান্ডের পরে মায়ের আক্রোশ যদি বৃষ্টির উপর গিয়ে পরে! যদি মা বৃষ্টিকে কথা শোনায়!
কিন্তু তাহমিনা বৃষ্টিকে কিছু না বলে তাশরিফকে বলে,”দেখলি? কতো চমৎকার একটি মেয়ে পছন্দ করেছিস দেখলি?”
তাহমিনা হাতের নকশিকাঁথা ফেলে রেখে নিজের ঘরে চলে যায়। তাশরিফ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”সমস্যা নাম্বার ছয়: রোদেলা আমিন তোমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে তাশরিফ হাসান!”
চলমান…..
#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২২
#লেখিক_Esrat_Ety
“কি শ্যালিকা? কি অবস্থা? মুখটা এমন অমাবশ্যার ঘুটঘুটে কালো রাতের মতো লাগছে কেন?”
রোদেলা দাঁড়িয়ে পরে সাদাফের ফ্ল্যাটের সামনে। ম্লান হেসে বলে,”আমার চেহারাই তো এমন ভাইয়া।”
সাদাফ হেসে বলে,”ঠিকাছে বুঝলাম। তোমার আপু বিরিয়ানি রান্না করেছে। খাবে এসো। তারপর ঘরে যাও।”
_ইচ্ছে করছে না ভাইয়া। শরীর টা ভালো নেই । আপনার বৌয়ের হাতের বিরিয়ানি আপনি খান।
রোদেলা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। মেঘলা সাদাফের পেছনে দাঁড়িয়ে বলে,”কে? কার সাথে কথা বলছেন?”
_রোদেলা। বিরিয়ানি খেতে ডাকলাম, শরীর খারাপ বলে চলে গেলো।
_অফিস থেকে কত ক্লান্ত হয়ে ফেরে ! বিশ্রাম নিক,আমি ওদের জন্য আলাদা তুলে রেখেছি। গিয়ে দিয়ে আসবো।
সাদাফ দরজা লাগিয়ে বলে,”ওর বিয়ের ব্যাপারে ভাবছো না কেনো?”
_আমরা ভাবলে কি? ওর নিজের ভাবতে হবে তো। ও কারো কথা শোনে?
_কিন্তু এভাবে আর কতদিন? বিয়ে তো করতেই হবে তাই না? আমার কাছে একটা সম্মন্ধ আছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছোটোভাই, পুলিশ ইন্সপেক্টর । তার জন্য উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে খুঁজছে আমার বন্ধু। রোদেলাকে আমার উপযুক্ত মনে হয়েছে।
মেঘলা আতংকিত মুখে বলে,”অসম্ভব! কোনো পুলিশের সাথে আমি আমার বোনের বিয়ে দেবো না।”
সাদাফ কিছুক্ষণ মেঘলার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উচ্চশব্দে হেসে ফেলে,”তোমার কি মনে হচ্ছে সব পুলিশ মাইনুলের মতো? আর মাইনুলের মতো হলেও সমস্যা কি? রোদেলা তো আর মেঘলা নয় যে মুখ বুজে লাত্থি উষ্ঠা খেতে থাকবে।”
মেঘলা চুপ করে থাকে। সাদাফ বলে,”বাচ্চামো করো না। রোদেলাকে আমি বোনের মতো দেখি। ওর ভালোটাই আমি চাই। ছেলেটি অসম্ভব ভালো। ছোটো থেকে চিনি ওকে। আমি রোদেলার ছবি আর বায়োডাটা পাঠিয়ে দেবো কালকে।”
_রোদেলা কিন্তু আপনার ওপর রেগে যাবে।
_রাগবে না। আমার শ্যালিকাকে আমি মানিয়ে নেবো।
হাসতে হাসতে কথাটি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে সাদাফ।
***
“তাশরিফ হাসানকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা হচ্ছে না। আমার মাথা ব্যথা হচ্ছে বারবার লোকজন আমার বয়স নিয়ে কটুক্তি করে সেজন্য! বয়স বেশি হলে একটা মেয়ে কি পচে যায়? কি অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা এই ছেলের মা গুলোর। সে যাই হোক,তাশরিফ হাসানের প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই,কখনো হবেও না এটা ওই তাশরিফ হাসানকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি এতেই আমার শান্তি।”
ডায়েরীতে এতটুকু লেখে রোদেলা। বিছানায় উপুড় হয়ে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে সে লিখছিলো। জানালাটা খুলে রেখেছে তাই লিখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে কারন বাতাসে ডায়েরীর পাতা গুলো উড়ছে খুব।
আরো কিছু লিখতে যাবে তখনই ডায়েরীর পাতা উল্টে একটা লেখা তার চোখে পরে। সে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। ডায়েরীর শেষের দিকে একটা পাতায় অচেনা একটা হাতের লেখা। কি অদ্ভুত! কার এতো বড় সাহস রোদেলার ডায়েরীতে হাত দেয়!
সে লেখাটা পড়তে শুরু করে,
“প্রথম কথা হচ্ছে আমাকে দেখতে ক্রিমিনালদের মতো মনে হলেও আমি ক্রিমিনাল নই। আমি একজন অত্যন্ত ছাপোষা মানুষ। একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি না জোটাতে পেরে একটা কোম্পানিতে গাধার সার্ভিস দিচ্ছি। নয়টা-ছয়টা অফিস। খারাপ অভ্যাস বলতে একটু সিগারেট খাওয়া হয়। কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। জীবনে কখনো ক্লাস ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বোর্ডে আমার নাম লেখেনি পর্যন্ত, স্যারের কাছে বলতে পারেনি আমি অন্যায় করেছি,এমন একটা মানুষকে দেখে বলে দিলেন দেখতে ক্রিমিনালদের মতো? বাহ রোদেলা আমিন। সে যাই হোক,এই ক্রিমিনাল একেবারেই যে কোনো অপরাধ করেনি তা নয়। অপরাধ করেছে। আসুন আজ আপনাকে আমার দুইটা অপরাধের কথা বলি। অপরাধ নাম্বার এক হচ্ছে,আমি আপনার ডায়েরী পুরোটা পড়ে ফেলেছি। এবং আপনার অবগতির জন্য লেখা হলো যে এই অপরাধের জন্য আমার কোনো অনুশোচনা হচ্ছে না।
এবং অপরাধ নাম্বার দুই হচ্ছে, আমি……..
কি কৌতুহল বেড়ে যাচ্ছে তাই না? আচ্ছা আর নাটক করলাম না,এই নিন বলে দিলাম। আমার দুই নাম্বার অপরাধ হচ্ছে আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। জানেন খুব অনুভব করি তাকে আমি। তাকে নিজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাবতে শুরু করেছি। এটাকে অপরাধ কেন বলছি জানেন? কারন যাকে ভালোবেসেছি সে আমার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের মানুষ। আর এই পৃথিবীতে নিজের থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের প্রেমে পড়া একটা অপরাধ,,তার শাস্তি প্রতিনিয়ত পেতে হয়। আমিও পাচ্ছি। এখন শুনবেন কে সেই মানুষ?
সেই মানুষটা আপনি রোদেলা আমিন। হ্যা,আমি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে ফেলেছি। আপনাকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছি আমি। আপনাকে ভেবেই আমার দিন চলে যাচ্ছে।
অবাক হচ্ছেন না? ভাবছেন আমি কবে আপনার প্রেমে পড়লাম। বলছি তবে শুনুন, যেদিন দেখলাম এই বদমেজাজি,রাগী,মুডি ভদ্রমহিলার খোলসে নিজেকে লুকিয়ে রাখা মেয়েটি একজন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মেয়ে,যার আবেগ আছে, অনূভুতি আছে , প্রিয়জনের জন্য মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে তখনই ধপপপপপ করে পরে গেলাম সেই মেয়েটির প্রেমে। সেই যে প্রেমে পরলাম,আর উঠতেই পারলাম না। উঠতে চাইও না।
জানিনা এই লেখাটা কবে আপনার চোখে পরবে। আদৌও পরবে কি না জানিনা। তবে খুব সাহস করে লিখলাম জানেন।
ইতি,
তাশরিফ হাসান,
সরি,,,ক্রিমিনাল তাশরিফ হাসান।”
রোদেলা স্তব্ধ হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে,পাতা টা ছিঁড়ে দলা পাকাতে থাকে।
***
ধপ করে কেবিনের দরজা লাগিয়ে দিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাশরিফের দিকে তাকায় রোদেলা। তাশরিফ তার পেঁচা মুখীর আগমনে খুশি হলেও মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। তাকিয়ে আছে তার পেঁচা মুখীর চোখের দিকে। রোদেলা তার হাতের মুঠোয় থাকা দলা পাকানো কাগজটা তাশরিফের মুখের উপর ছুড়ে মারে। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলে,”আপনার সাহস কি করে হয় আমার ডায়েরীতে হাত দেওয়ার??”
তাশরিফ চুপচাপ বসে থাকে। রোদেলার প্রশ্নের পিঠে তার কিছুই বলার নেই।
“ব্যক্তিগত ডায়েরী হচ্ছে একটা মানুষের গোপন অনুভূতি জমা রাখার লকার। আর কারো পারমিশন না নিয়ে তার অনুভূতি ঘাঁটাঘাঁটি করা,তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা জানা একটা ভয়ংকর অপরাধ,তা জানেন না আপনি? অসভ্য অভদ্র লোক!”
তাশরিফ নড়েচড়ে বসে,”আপনি এভাবে চেচাবেন না। এটা অফিস। এখানে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি না করে বরং আমরা অফিস ছুটির পরে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি? ঠিকাছে?
শান্ত ভাবে জবাব দেয় তাশরিফ।
রোদেলা শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ শুকনো হাসি হেসে বলে,”শান্ত হোন। ছুটির পরে কথা হবে।”
রোদেলা ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। তাশরিফ দলা পাকানো কাগজটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা যত্ন নিয়ে তার অনুভূতিকে দলা পাকিয়েছে পেঁচা মুখী, সে সেটাই দেখছে বসে বসে।
ডেস্কে এসে চেয়ার টেনে বসে পরে রোদেলা। মাথাটা হঠাৎ করে খুব ধরেছে। যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যেতে চাইছে যেন। একটু চা খেতে পারলে ভালো হতো। বেল টিপে অফিসের পিয়ন ছেলেটাকে ডেকে চায়ের কথা বলে ফাইলে হাত দেয়। অনেক কাজ পরে আছে। ওই তাশরিফ হাসানকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কাজে মন দিতে হবে এখন। তাকে রোদেলা পরে দেখে নেবে।
রাশেদুজ্জামানের পিএ শিরিন এসে রোদেলার ডেস্কের সামনে দাঁড়ায়। রোদেলা মাথা তুলে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”এসে গিয়েছে চামচী কোথাকার!”
মুখে বলে,”কিছু বলবেন শিরিন আপা?”
_তোমাকে স্যার সেদিন যে ফাইলটা দিয়েছিলো সেটা নিয়ে ডেকেছেন,কয়েক যায়গায় কিছু কাগজ সংযোজন করতে হবে।
কথাটি বলে শিরিন চলে যায়। রোদেলা “ধ্যাতত!” বলে তার ডেস্কের লকার খোলে। বিরক্তিতে মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছে। লকার খুলে হাত বাড়িয়ে একটা ফাইল উঠিয়ে দেখে সেটা অন্য ফাইল। সে নিচু হয়ে ফাইলটা খুঁজতে থাকে। দুমিনিট পরে সে টের পেলো তার ডেস্কের লকারে কোথাও সেই ফাইলটার অস্তিত্ব নেই। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে রোদেলা তন্নতন্ন করে খোজে, পুরো ডেস্ক উল্টে পাল্টে ফেলে। কোথাও সে খুজে পায় না ফাইলটাকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। হাত পা কাঁপছে। আজ তার খবর হবে ! তার অবচেতন মন বলছে, খুব সাংঘাতিক বিপদে সে পরতে চলেছে !
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা। রাশেদুজ্জামান একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে রোদেলাকে স্বাগত জানায়।
“আসুন রোদেলা। বসুন। ফাইলটা এনেছেন?”
রোদেলা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কথা সাজাচ্ছে। রাশেদুজ্জামান নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”আরেহ। আপনাকে তো এখানে চেহারা দেখতে ডেকে আনিনি। ফাইলটা কোথায়?”
_স্যার ফাইলটা খুজে পাচ্ছি না।
রোদেলা আমতা আমতা করে বলে। রাশেদুজ্জামান একটা বাকা হাসি দেয়। তারপর ধমকে উঠে বলে,”ফাইলটা খুজে পাচ্ছেন না মানে? ফাজলামি করছেন? হাউ কেয়ারলেস ইউ আর! জানেন ওটা কিসের ফাইল? জানেন?”
রোদেলা কেঁপে ওঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”না স্যার!”
_ওটাতে এই কোম্পানির আপকামিং প্রজেক্ট গুলোর ব্যাংক ডিটেইলস, ট্রেড লাইসেন্স সব ছিলো। আর সেটা আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। আশ্চর্য!
রোদেলা যথেষ্ট নমনীয় হয়ে বলে,”স্যার আমি ওটা আমার লকারে রেখেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে।”
_এতো কথা তো ভাই আমার জেনে কাজ নেই। আমার ফাইলটা চাই। আর এক্ষুনি চাই। নয়তো আমি এক্ষুনি ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নোটিশ দিয়ে দিবে। আর বাকিটা তারা দেখবে।
রোদেলার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। একটা ঢোক গিলে বলে,”স্যার আমি আরেকটু খুজে দেখবো? আমাকে একটু সময় দিন।”
_যাস্ট এক ঘন্টা। আপনাকে যাস্ট এক ঘন্টা দেওয়া হলো। আমার হাতে ফাইল টা এনে দিবেন নয়তো আই উইল মেইক ইউ ফায়ার্ড!
রোদেলা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। রাশেদুজ্জামান এবার সম্বোধন তুমিতে নামিয়ে বলে,”তুমি জানো ওখানে কত কোটি টাকার প্রোজেক্টের কাগজ আছে? হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া? লাইসেন্স এন্ড আদার্স ফর্মালিটিজ পুনরায় করতে কত টাকা যাবে জানো? ইনভেস্টররা ছেড়ে কথা বলবে? যদি ফাইলটা না পাই না রোদেলা, আমি তোমাকে ছেড়ে কথা বলবো না। এবং তুমি নিশ্চিত থাকো তোমাকে এর খেসারত দিতে হবে। কোম্পানীর রুলস নাম্বার বাইশ মনে আছে? এম্প্লয়ির গাফিলতির দায়ভার এম্প্লয়িকেই নিতে হবে। এবং এটা কত টাকার মামলা জানো? তাকিয়ে দেখছো কি? যাও এবং খোঁজো।”
রোদেলা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কেবিন থেকে ছুটে বের হয়। রাশেদুজ্জামান পৈশাচিক হাসি হেসে বিড়বিড় করে বলে,”এইবার? এইবার কি হবে রোদেলা আমিন?”
রোদেলা ডেস্কে ফিরে এসে পুরো ডেস্ক পুনরায় উল্টে পাল্টে ফেলে। সবাই রোদেলা আমিনের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আপা একটা ফাইল দেখেছেন লাল রঙের? খলিল স্যার আপনি দেখেছেন ? রিয়াজ ভাই আপনি দেখেছেন? শারমিন তুমি দেখেছো? লকারে রেখেছিলাম। কোত্থাও খুজে পাচ্ছি না।”
মেহরিন এসে রোদেলার সাথে খুঁজতে থাকে। খলিল বলে,”না তো রোদেলা। তোমার লকারে রাখা ফাইল কোথায় যাবে?”
_সেটাই বুঝতে পারছি না স্যার। সব শেষ স্যার। সব। আমার চাকরি টা মনে হয় শেষ, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
রোদেলা নিরবে কাঁদতে শুরু করে দেয়। সে কাঁদতে চায়না,কাউকে দেখাতে চায়না তার কান্না। কিন্তু কিছুতেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না সে। কত কষ্টে চাকরি টা জুটিয়েছিলো সে। বাবা যখন অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছিলো তখন এই চাকরিটাই রোদেলাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলো। চাকরিটা তো যাবেই সেই সাথে রোদেলাকে জরিমানা করতে হবে। রোদেলা তো সর্বশান্ত হয়ে যাবে তবে!
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে রোদেলা। কেউ কেউ সেই কান্না দেখে মজা নিচ্ছে। তবে অধিকাংশই দুঃখ পাচ্ছে রোদেলার জন্য। মেহেরিন এসে রোদেলার কাঁধে হাত রাখে। রোদেলা কান্নায় ভেঙে পরে।
কেবিনের বাইরে গণ্ডগোলের আওয়াজে তাশরিফ তার পিএ তনির দিকে তাকায়। তনি হন্তদন্ত হয়ে মাত্রই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। তাশরিফ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তনি চেঁচিয়ে বলে,”স্যার রোদেলা ম্যাম কাঁদছে। ম্যামকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”
তাশরিফ হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঁদছে মানে! তনিকে কিছু বলতে না দিয়ে দ্রুতপায়ে একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে চলে যায় তাশরিফ।
রোদেলা কাঁদছে। সত্যিই কাঁদছে। তাশরিফ রোদেলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“কি হচ্ছে? এখানে কি হচ্ছে?”
মেহেরিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে তাশরিফ। মেহেরিন তাকে সবটা খুলে বলে। তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা ঠিক কবেকার কথা?”
রোদেলা তাশরিফের প্রশ্নের জবাব দেয়না। তাশরিফ ধমকের সুরে বলে,”কাম অন রোদেলা আমিন। এটা অফিস। আমাদের কাজের যায়গা। এখানে ব্যক্তিগত ক্ষোভ নিয়ে বসে থাকবেন না। একজন কলিগ হিসেবে জানতে চাইছি। দেখি কোনো সাহায্য করতে পারি কি না।”
রোদেলার কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গিয়েছে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে জবাব দেয়,”পরশু দিনের কথা,স্যার ফাইলটা আমার হাতে দিতেই আমি ওটা এনে সরাসরি এখানে রেখেছি।”
তাশরিফ রোদেলার কথা শোনার সাথে সাথে অফিসে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে তাকায়। রিয়াজ বলে ওঠে,”স্যার ওটার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। তিনদিন হলো বন্ধ হয়ে পরে আছে। চেক করা হয়নি।”
তাশরিফ ধমক দিয়ে বলে,”হোয়্যাট ননসেন্স! এতো বড় একটা কোম্পানির অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরা তিনদিন বন্ধ হয়ে পরে থাকে! সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। স্টুপিড কতগুলো!”
তাশরিফ চেঁচিয়ে ওঠে। সবাই বেশ অবাক হয়। তাশরিফ হাসানকে কখনোই তারা এমন ব্যবহার করতে দেখেনি।
তাশরিফ মেহেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওনাকে নিয়ে আমার কেবিনে আসুন আপা। ফাস্ট !”
মেহেরিন মাথা নাড়ায়। তাশরিফ নিজের কেবিনে চলে যায়। তার মাথাও কাজ করছে না!
রোদেলা তাশরিফের কেবিনে একটা ডেস্কে বসে আছে। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাশরিফ মেহেরিনকে বলে,”সিসিটিভি ক্যামেরা তিনদিন ধরে বন্ধ হয়ে পরে আছে আর এখনই এই অঘটন ঘটলো। বুঝতে পারছেন আপা কিছু?”
_হু স্যার। আমারো সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু কাজটা কে করবে? মানে রোদেলার সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতা যতই থাকুক তাই বলে এতো বড় একটা রিস্ক নেবে? কোম্পানীর বিরাট লস হয়ে যেতে পারে। এতো বড় সাহস কার।
_আমার একজনকে সন্দেহ হচ্ছে।
_কাকে স্যার?
_সন্দেহের বসে নাম বলা ঠিক হবে না। আগে আমাকে একটু ভাবতে দিন। রোদেলা ওটা কিসের ফাইল ছিলো জানেন?
রোদেলা মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”আপকামিং প্রজেক্টের ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক ডিটেইলস,সব ফর্মালিটিজের পেপার।”
তাশরিফ বেশ অবাক হয়ে যায়।
“আপনার কাজ তো হিসেব দেখা। আপনাকে কেনো এসব কাজ দেওয়া হয়েছে? এগুলো তো খলিল স্যারের কাজ।”
রোদেলা কান্না থামিয়ে জবাব দেয়,”জানিনা স্যার। আমি কিচ্ছু জানিনা।”
তাশরিফ আর মেহেরিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। রোদেলা উঠে দাঁড়ায়। তাশরিফ বলে,”কোথায় যাচ্ছেন?”
_একঘন্টা হয়ে গিয়েছে। জিএম স্যারের কাছে যেতে হবে।
_স্যার কি বলেন আমায় এসে জানাবেন। ঠিকাছে?
রোদেলা মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে তাশরিফের কেবিন থেকে বিদায় হয়।
মেহেরিন বলে,”ও মাই গড তাশরিফ। রোদেলা তো সাংঘাতিক ভাবে ফেসে গিয়েছে!”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলে,”দু’বছর আগে কি হয়েছিল মনে আছে? ঠিক এরকমই ঘটনা ঘটেছিল শিপ্রা নামের হিন্দু মেয়েটার সাথে। মেয়েটা শেষমেশ সুইসাইড করতে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস বেঁচে গিয়েছিলো। রোদেলাকে আমি তো যথেষ্ট শক্ত মেয়ে মনে করতাম,ও কিভাবে ভেঙে পরেছে দেখো!
তাশরিফ চেয়ারে বসে পরে। তার পেঁচা মুখীর চোখের পানি দেখতে একটুও ভালো লাগছে না তার। সহ্য হচ্ছে না একদম!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ায় রোদেলা। জিএম মাথা তুলে তাকায়। তার খুব আনন্দ হচ্ছে কিন্তু সে কন্ঠস্বর গম্ভীর রেখে বলে,”কি? কিছু হয়েছে?”
রোদেলাকে চুপ থাকতে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে,”কিছু হয়েছে? আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি তো।”
রোদেলা কাতর কন্ঠে বলে,”পাইনি স্যার।”
_বেশ। তাহলে এবার বাড়ি যান। কাল ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানিয়ে দেবো। তারা যা করার করবেন।
রোদেলা না চাইতেও কেঁদে ফেলে। রোদেলার চোখের পানি রাশেদুজ্জামানের মনে আনন্দ দেয়। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,”ওটা কত টাকার ফাইল জানেন? কতটাকা দিয়ে কাগজ গুলো রেডি করতে হয়েছে জানেন? অর্ধ কোটি টাকা। আছে আপনার কাছে অর্ধ কোটি টাকা? আছে?”
রোদেলা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”স্যার কি হবে এখন?”
_কি আবার হবে। আপনাকে অর্ধ কোটি টাকা দিতে হবে নয়তো জেল। রুলস ইজ রুলস। কোম্পানী আপনাকে ছাড় দেবে না।”
রোদেলা নিরবে কাঁদতে কাঁদতে চেয়ারে বসে পরে। রাশেদুজ্জামান কিছুক্ষণ রোদেলার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে,”তেজ একটু বেশি দেখিয়ে ফেলেছিলি। তোকে কাঁদতে দেখে ভালো লাগছে।”
তারপর রোদেলাকে নরম সুরে ডাকে,”রোদেলা আমিন!”
রোদেলা মাথা তুলে তাকায়। রাশেদুজ্জামান কন্ঠে দরদ নিয়ে বলে,”আপনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমি বরং এমডি স্যারকে কে দুদিন পরে জানাই ফাইলের কথা।
দুদিন বরং আমরা বসে আলোচনা করে দেখি কোনো উপায় বের করা যায় কি না! ”
রোদেলা রাশেদুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে বলে,”মানে স্যার!”
_মানে আপনাকে সাহায্য করতে চাই। এক কাজ করুন, এটা তো অফিস। এখানে বসে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। আমরা বরং বাইরে কোথাও বসে আলোচনা করি। দেখি কোনো উপায় বের করতে পারি কিনা। আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো উপায় বেড়িয়ে যাবে।
অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে রাশেদুজ্জামান।
রোদেলা নির্বিকার,তার মুখে কোনো কথা আসছে না। রাশেদুজ্জামান একটা কার্ড রোদেলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা নিন। কাল বিকেল পাঁচটায় আমার সাথে দেখা করুন এখানে। আপনার সমস্যা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করবো।”
চলমান………