দ্বিতীয় ফাগুন পর্ব-১৭+১৮

0
819

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৭+১৮
#লেখিকা_Esrat_Ety

(১৭)
দরজার ওপাশে সাদাফকে দেখে খানিকটা বিব্রত হয় মেঘলা। অস্বস্তি কাটাতে সাদাফকে বলে,”আন্টি কোথায়?”
সাদাফ দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়,বলে,”আমার বোন এসেছে বেড়াতে। মাকে নিয়ে আমার বোন একটু বের হয়েছে। কোনো দরকার?”

_সিরাতের কি অবস্থা?
_আজ একজন নার্স এসে সেলাইয়ের সুতা কেটে দিয়ে যাবে।

মেঘলা কয়েক মুহূর্ত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িতে সাদাফ আর সুহা,সিরাত ছাড়া আর কেউ নেই। এখন ফ্ল্যাটে ঢোকা টা কি ঠিক হবে?

মেঘলা ঢোকে। সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”সিরাত কোথায় আছে?”
সাদাফ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সিরাতের ঘর।

সুহা একটা পুতুল নিয়ে খেলছিলো। মেঘলাকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। কিন্তু সিরাত খুব খুশি হয়। সে দুদিনেই মেঘলাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে সে।
মেঘলা গিয়ে বিছানার এক পাশে বসে। সিরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”কি অবস্থা এখন আমার সিরাত বাবুর?”

সিরাত লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মেঘলা আন্টির মুখে “সিরাত বাবু” ডাকটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। মৃদু স্বরে বলে,”অল্প ব্যথা করছে আন্টি। বেশি ব্যথা করছে না।”
সাদাফ ঘরে ঢোকে। সিরাত মেঘলাকে বলে,”আমি চাউমিন খাবো আন্টি। আমাকে চাউমিন বানিয়ে দাও।”

সাদাফ সিরাতকে বলে ওঠে,”বাবা ফুপি এসে বানিয়ে দেবে। আন্টিকে বিরক্ত করো না।”

মেঘলা সাদাফকে বলে,”বিরক্ত হইনি আমি। বানিয়ে দিচ্ছি। আমার কোনো অসুবিধা নেই। দেখছেন না ভদ্রলোক অসুস্থ,তার আদেশ অমান্য করা ঠিক হবে না।”
তারপর সিরাতের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”ঠিকাছে জাহাপনা। এক্ষুনি আপনার সামনে আমি চাউমিন হাজির করছি।”

সিরাত মজা পেয়ে হোহো করে হেসে ফেলে। সাদাফ মুগ্ধ হয়ে সিরাতের হাসি দেখে। অনেকদিন পর সে তার ছেলেকে এভাবে হাসতে দেখছে।

সুহা দূরে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেঘলার দিকে। সিরাতকেই শুধু ভালোবাসে ওই মেয়েটা। তাকে কেনো ভালোবাসে না? সেও ভালোবাসবে না ওই মেয়েটাকে। রাগে ফুঁসছে সে।

মেঘলা রান্নাঘরের দিকে যায়। সুহা এসে তার বাবাকে বলে,”ওই আন্টিকে চলে যেতে বলো। ওকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো।”
সাদাফ বিরক্ত হয়ে বলে,”কি হচ্ছে সুহা? এমন করছো কেনো তুমি?”

_ও কেনো আমাদের কিচেনে ঢুকেছে। ওকে চলে যেতে বলো।

“শুনছেন। আমি টমেটো কেচাপ টা খুজে পাচ্ছি না। একটু কোথায় আছে বলবেন?”

মেঘলা রান্নাঘর থেকে গলার স্বর কিছুটা উঁচুতে তুলে সাদাফকে বলে।
সাদাফ সুহার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। আন্টির সাথে কোনো বেয়াদবি করবে না।”

তারপর সে রান্নাঘরের দিকে যায়। সুহা চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে।

সাদাফকে দেখে মেঘলা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”টমেটো কেচাপ টা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”

সাদাফ ফ্রিজ খুলে কেচাপের বোতলটা বের করে মেঘলাকে দেয়। মেঘলা হেসে বলে,”ফ্রিজের কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। আমি কেবিনেট গুলোতে খুঁজছিলাম।”
এমন সময় খট করে দরজা লক হবার শব্দ হয়। মেঘলা চমকে উঠে সাদাফের দিকে তাকায়। রান্নাঘরের দরজা সুহা লক করে দিয়েছে। সাদাফ দরজার কাছে গিয়ে ধমকের সুরে বলে,”এসব কি হচ্ছে সুহা! দরজা খোলো।”
বাইরে থেকে সুহা খিলখিল করে হাসে। মেঘলা বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কেন যে সে এখানে ঢুকতে গেলো! দরজা থেকেই সিরাতের খবর নিয়ে চলে যাওয়া উচিত ছিলো।

সাদাফ কিছুক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়ে মেঘলার দিকে তাকায়। মেঘলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ অপরাধী গলায় বলে,”এতো দুষ্টু হয়েছে! আপনি একটু অপেক্ষা করুন। দেখছি কি করা যায়।”

সাদাফ সুহাকে ডাকে,”সুহা দরজা খোলো‌।”
সুহা বাবাকে নকল করে বলে,”সুহা দরজা খোলো।”

এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ হয়। সাদাফ সুহাকে ডেকেই চলেছে। সুহা দরজা খুলছে না। কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার শব্দ হয়। দরজা খুলে জাহানারা মেঘলা আর সাদাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহানারার পেছন থেকে উকি দেয় সাদাফের ছোটো বোন সেতু। তারা অবাক হয়ে মেঘলা আর সাদাফকে দেখে। সাদাফ নিচু স্বরে বলে,”উনি সিরাতের জন্য চাউমিন বানাচ্ছিলেন‌। আমি টমেটো কেচাপের বোতলটা দিতে এসেছিলাম। সুহা বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।”

মেঘলা কয়েক মুহূর্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর এক দৌড়ে সাদাফদের ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে যায়।

ঘরে ঢুকে মেঘলা দরজা লাগিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটা বিরাট বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারতো। ভাগ্যিস সাদাফের মা বোন এসেছিলো,অন্য কেউ হলে তো কেচ্ছাকাহিনী রটিয়ে ফেলতো। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ইহ জনমে আর সালমান সাদাফের ফ্ল্যাট মুখো হবে না সে।

***
এপার্টমেন্টের গেইটের সামনে একটা কুকুর বসে আছে। দাঁড়োয়ান চাচাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটা তার যায়গা থেকে নড়ছে না। রোদেলা দাঁড়িয়ে কুকুর টাকে দেখে। কুকুরটা তারদিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা বলে,”কি? যেতে দিবি না আমায়?”
কুকুরটা লেজ নাড়ে। রোদেলা বলে,”সর বলছি।”
কুকুরটা যেন বাধ্য ছেলে হয়ে যায় রোদেলার ধমকে। উঠে একপাশে গিয়ে বসে পরে আবার। রোদেলা ভেতরে ঢোকে। আজ সে একটু বেশিই ক্লান্ত।

কলিং বেল টিপে রোদেলা দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘলা এসে দরজা খুলে দেয়। তার মুখ থমথমে হয়ে আছে। রোদেলা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”কিরে তোর কি হলো আপু!”
কথাটি বলেই সে তাকিয়ে দেখে তাদের বসার ঘরের একটা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে তাশরিফ হাসান।‌ রোদেলা ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলে,”আপনি?”

তাশরিফ ঠোঁট প্রস্বস্ত করে হাসে। একটা হাই তুলে বলে,”হুম আমি।”
_এখানে কি করছেন?
_বসে আছি।
_বসে আছেন তা তো দেখতে পাচ্ছি। এখানে কেনো এসেছেন?

মেঘলা রান্নাঘর থেকে এককাপ চা নিয়ে এসে তাশরিফের হাতে দেয়। তারপর বিড়বিড় করে রোদেলাকে বলে,”উনি মেহমান রোদেলা। এভাবে কথা বলছিস কেনো?”
তাশরিফ মেঘলার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে রোদেলাকে বলে, “আমার ভাইয়ের বৌয়ের একাডেমিক সব কাগজপত্র নিতে এসেছি। একটু কষ্ট করে সব গুছিয়ে দিন।”

রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘলা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”বৃষ্টি কেমন আছে? ও ভালো আছে তো? জ্বর বাধায়নি তো আবার?”

তাশরিফ হেসে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। চিন্তা করবেন না।”

রোদেলা মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”এতো জানতে হবে কেনো তোর? ভালো থাকবে বলেই তো এ বাড়ি ছেড়েছে তাইনা?”

কথাটি বলেই রোদেলা ঘরে চলে যায়। রুহুল আমিন এসে তাশরিফের কাছ থেকে বৃষ্টির ব্যাপারে খোজ খবর নিচ্ছে। তাশরিফ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে রুহুল আমিনের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে রুহুল আমিন তো তারও শশুর হবে। বিনয়ে সে যেনো নুয়ে যাচ্ছে।

মেঘলা তাশরিফকে বলে,”রোদেলার মুখে শুনেছি আপনি আমাকে রক্ত দিয়েছিলেন। সেজন্য আপনাকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই।”

তাশরিফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মেঘলা বলে,”বৃষ্টিকে একটু দেখে রাখবেন। রোদেলার অভিমান কবে ভাঙবে তা তো জানি না। চার মাস হয়ে গিয়েছে বোনটাকে দেখি না। ওকে একটু দেখে রাখবেন। খুব নাজুক একটা মেয়ে। একটু আগলে আগলে রাখবেন।”

_আচ্ছা আপনাকে আমি আপু বলে ডাকি? আপু আপনি চিন্তা করবেন না। বৃষ্টির কোনো অযত্ন আমি হতে দেবো না।

_হ্যা অবশ্যই আপু ডাকবেন। আপনি বৃষ্টির ভাইয়ের মতো, তবে তো আমার আর রোদেলারও ভাই হলেন। অবশ্যই আপু ডাকবেন।

মেঘলার কথায় তাশরিফ বিষম খেয়ে যায়। খুকখুক করে কাশতে থাকে। মেঘলা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। তাশরিফ পানি খেয়ে মনে মনে বলে,”আমি শুধু বৃষ্টি আর আপনার ভাই আপু,রোদেলা আমিনের নয়। এমন ভয়ংকর কথা আর কখনো বলবেন না।”

রোদেলা একটা ফাইল নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখে। গম্ভীর হয়ে বলে,”এই নিন। এখানে ওর জন্মনিবন্ধন সনদ থেকে শুরু করে পিএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট সবকিছু গুছিয়ে রাখা আছে।”

তাশরিফ ফাইলের থেকে চোখ সরিয়ে রোদেলার দিকে চায়। রোদেলা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তারপর রুহুল আমিনের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলে,”আমি উঠি আংকেল।”

_না না,রাতের খাবার খেয়ে তবেই যাবে বাবা। তুমি বসো।
রুহুল আমিন তাশরিফকে বাঁধা দিয়ে বলে।

মেঘলা বলে ওঠে,”আপনি বসুন ভাই। এভাবে তো যেতে দিতে পারি না আপনাকে।”

তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকায়। কতটা অভদ্র এই পেঁচা মুখী। একটিবার নিজের মুখে তাশরিফকে সৌজন্যতা করেও বলছে না খেয়ে যেতে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বাদ দিলেও তো তাশরিফ রোদেলার বস, একটি বার নিজের মুখে বললে কি হয়? একদিন তো ঠিকই সেবা যত্ন করতে বাধ্য থাকবে। আজ এভাবে মুখ ফিরিয়ে আছে,একদিন তো ঠিকই তাশরিফ এলে বলবে,”রাতের খাবার না খেয়ে যেতে পারবে না।”

তাশরিফ মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”না আপু। যেদিন বরফ গলে যাবে,সেদিন এসে কব্জি ডুবিয়ে ভাইয়ের শশুর বাড়ি খেয়ে যাবো। আজ উঠি।”

রোদেলা তাশরিফের দিকে আড়চোখে তাকায়। তাশরিফ রোদেলাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দেয়।

***
“তুই কি আর বিয়ে টিয়ে করবি না? সংসার টা ভেসে যাচ্ছে দেখেছিস?”

সেতু ভাইয়ের প্লেটে মাংস তুলে দিতে দিতে বলে। সাদাফ খাওয়া থামিয়ে সেতুর দিকে চায়,”ভেসে যাচ্ছে মানে? কোথায় ভেসে যাচ্ছে? সংসার তো সংসারের যায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।”

_ভাইয়া সব সময় মজা করে উড়িয়ে দিস না সবকিছু। আমাকে তো বিয়ে দিয়ে দিলি,মা বুড়ো হচ্ছে দিনকে দিন। তোর নিজের কথা না ভাব, রাজনীতি নিয়ে তো স্বর্গে যাবি। ছেলে মেয়ে দুটোর কথা তো ভাববি?

_ওদের কথাই তো সারাদিন ভাবি। উঠতে,বসতে,খেতে,ঘুমিয়ে।

সেতু চোখ রাঙানি দিয়ে তাকায়। সাদাফ হেসে বলে,”আমার মতো বুড়ো একজনকে কে বিয়ে করবে যার দুটো বাচ্চা আছে? আর সৎ মায়েরা কত খারাপ হয় জানিস? টিভিতে তো খবর-টবর কিছু দেখিস না। দেখলে বুঝতে পারতি পৃথিবী কত নির্মম হয়ে গিয়েছে। তার চেয়ে যেমন আছে সবকিছু তেমনি থাক। ওরা দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যাবে।

***
“কি হলো? খাচ্ছো না কেন?”
বৃষ্টি মাথা তুলে তাহমিনার দিকে চায়। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মিনমিন করে বলে,”কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা। কেমন বমি পাচ্ছে।”

_গ্যাস্ট্রিক আলসারের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছো দেখছি। স্বামী রোজ ফুচকা, আজেবাজে সব খাবার শখ করে নিয়ে আসে। সেগুলো নিশ্চিন্তে খেতে থাকো। স্বাস্থ্যের কথা তো চিন্তা করতে হবে না।

বৃষ্টি চুপ করে থাকে। আদিল খাওয়া শেষ করে উঠে বৃষ্টিকে বলে,”আজ আমার ক্লাস নেই। তোমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে আসবো,তুমি রেডি?”

বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”মা আসছি।”
বলেই ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে বৃষ্টির। তাহমিনা দাঁড়িয়ে যায়, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”শরীরটা বোধ হয় বেশি খারাপ,আজ যেও না বরং।”

_না মা,আজ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে একটা।
বৃষ্টি গুটি গুটি পায়ে সদর দরজার দিকে যায়। আদিল ঘরে ঢুকে বাইকের চাবি নিয়ে আসে।

***
সেদিনের পর থেকে রাশেদুজ্জামান রোদেলাকে বিরক্ত করছে না,এটা বেশ স্বস্তিদায়ক একটি ব্যাপার রোদেলার কাছে। কিন্তু সে স্বস্তি পাচ্ছেনা। এই তাশরিফ হাসান বলে লোকটা তার পিছু ছাড়ছে না। যখন তখন কেবিনে ডেকে নেয় এই কাজ – সেই কাজের বাহানায়। চায় কি আসলে? সে যে রাশেদুজ্জামানের মতো কফি খেতে নিয়ে যেতে চায়না তা জানে রোদেলা। ভদ্রলোককে রোদেলা পছন্দ না করলেও ভদ্রলোক তো প্রকৃত ভদ্রলোকই। এটা তো মানতেই হবে। কিন্তু রোদেলাকে এতো টর্চার কেনো করে।

“এই রোদেলা।”
মেহরিনের গলার আওয়াজে রোদেলা তার দিকে তাকায়।

_আজকের হিসাব টা দেখা হয়েছে?
রোদেলা মাথা নাড়ায়,”না আপা। এখনো হয়নি। খুব চিন্তা হচ্ছে, তাশরিফ স্যার আজ হাতে চেয়েছেন। দিতে না পারলে তো কথা শুনতে হবে।”
মেহরিন হাসে,বলে,”টেনশন করো না। আজ তো তাশরিফ আসেনি। লিভ নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ লিভ নিলো কেনো বুঝলাম না।”

_কোনো পাত্রী দেখতে গিয়েছে বোধ হয়। উনি তো এজন্যই লিভ নেয় মাসে তিনবার।

মেহরিন চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। রোদেলা জিভ কেটে বলে,”সরি আপা। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তাশরিফ স্যার আপনার পেয়ারের লোক।”

মেহেরিন রাগ নিয়ে বলে,”সবসময় তাশরিফকে ছোটো করে কথা বলো তুমি। সত্যিই বিরক্তিকর !”
রোদেলা হেসে বলে,”সরি আপা। আর বলবো না। আচ্ছা আপনার ননদের সাথে তাশরিফ হাসানের বিয়ের ব্যাপারে কতদূর এগোলেন?”

মেহেরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আর বলো না। ননদের রিলেশন আছে। একটা বাঁদরের মতো দেখতে ছেলের সাথে। তার জন্য হাত কেটে একাকার কান্ড করে ফেলেছে। বড় মুখ করে তাশরিফের মায়ের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম। এখন তো লজ্জায় কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

রোদেলার খুব হাসি পায়। এই সম্মন্ধটাও ভেস্তে গেলো! তাশরিফ হাসানের কপালে বোধ হয় বিয়ে লেখা নেই। বেচারা! এতো সুদর্শন পুরুষ হয়ে লাভ কি হলো!

***
“দাঁড়াও মেঘলা।”

অত্যন্ত পরিচিত পুরুষ কন্ঠটি মেঘলাকে নাড়িয়ে দেয়। পেছনে ঘুরে তাকানোর আগে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। তারপর ঘুরে তাকায়। ম্লান হেসে বলে,”তুমি! ঠিকানা কিভাবে খুজে পেলে নতুন বাসার! এসো আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই। চা খেয়ে যাও।”

মাইনুল ধমকে ওঠে,”ফাজলামি করছো? চা খেতে আসিনি আমি। এসেছি তোমার সাথে বোঝাপড়া করতে।”

_বোঝাপড়া মানে? সব বোঝাপড়া তো হয়ে গিয়েছে!

মাইনুল চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,”নাটক করা হচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছো না তাইনা? আমার হবু বৌয়ের বাপের বাড়ির লোকদের কাছে আমার ব্যাপারে কি বলেছো তুমি মেসেজ দিয়ে? কেনো বলেছো?”

মেঘলা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,তারপর মাইনুলের দিকে কঠিন দৃষ্টি রেখে বলতে থাকে,”বলেছি তুমি একটা ইতর,নারীবাজ, চরিত্রহীন।”

মাইনুল রাগে কাঁপতে থাকে। মেঘলা বলতে থাকে,”লজ্জা করে না? এখন একটা স্কুল পড়ুয়া স্টুডেন্টের জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছো বিয়ে বিয়ে খেলা খেলে? লজ্জা করে না?”

মেঘলা চেঁচিয়ে বলে কথাটি। মাইনুল দাঁত কিড়মিড় করে বলতে থাকে,”এসব তোর ঐ অসভ্য বোন শিখিয়েছে তোকে তাইনা? অসভ্য মেয়ে। আমার জীবনে নাক গলাচ্ছিস। একটা চড় দিয়ে তোকে……”

মাইনুল চড় দিতে হাত উঠাতে নিলে পেছন থেকে সালমান সাদাফ ডেকে ওঠে,”এক্সকিউজ মি।”

মাইনুল মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। সালমান সাদাফ এগিয়ে যায়। মাইনুল সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে, কেমন চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। সাদাফ গম্ভীর কন্ঠে বলে,”আপনি ওনাকে মারতে যাচ্ছিলেন কেনো?”

মাইনুল মেজাজ নিয়ে বলে,”আপনি কে? এভাবে অন্যদের মাঝখানে ঢুকে কথা বলছেন?”

_আমি কেউ না ‌। একজন পথচারী। আপনি ওনাকে মারতে যাচ্ছিলেন কেনো সেটা আগে বলুন।

মেঘলা ভীত চোখে সালমান সাদাফের দিকে তাকায়। এই লোকের মেজাজ বিগড়ে গেলে যদি মাইনুলকে মারধোর করে! পুলিশের গায়ে হাত তুললে তো উলটো তাকে হাজত খাটতে হবে! মেঘলা সাদাফের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,”উনি আমার পরিচিত। আপনি যান।”

_উনি আপনার স্বামী হলেও আপনার গায়ে হাত তোলার অধিকার নেই ওনার। এটা সালমান সাদাফের এলাকা,এখানে কোনো নারী নির্যাতন সালমান সাদাফ বরদাস্ত করবে না।

মাইনুল হা হয়ে যায়। তাহলে এই লোকের নাম সালমান সাদাফ! কিছুক্ষণ মেঘলাকে আর সাদাফকে দেখে তারপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”বাহ! ডিভোর্স হতে না হতে নাগরও জুটিয়ে ফেলেছো দেখছি! তোমাকে তো ভুল বুঝেছিলাম। তুমি তো যথেষ্ট চালু মহিলা!”

মেঘলা কেঁপে ওঠে কথাটি শুনে। সালমান সাদাফ তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”মুখে লাগাম টেনে এখান থেকে কেটে পরুন নয়তো……”

_সে তো আমি যাচ্ছি। আপনাকে বলে দিতে হবে না।
তারপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে একটা বিকৃত হাসি দিয়ে বলে,”তোমাকে একটা ফ্রি তে জ্ঞান দিয়ে যাই মেঘলা, এই ধরনের নেতাশ্রেনীর লোক কখনো তোমার মতো একটা ডিভোর্সী,বন্ধ্যা মেয়েকে বিয়ে করবে না। এরা যেটা করবে তা হলো কিছুদিন তোমাকে রক্ষিতা হিসেবে পালবে। তাই বুঝে শুনে পা ফেলো। বেশি খেতে গিয়ে সব গলায় আটকে ফেলো না।”

কথাটি বলে মাইনুল হাঁটতে শুরু করে। সাদাফ মেঘলার দিকে তাকায়। মেঘলা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে এপার্টমেন্টের গেইটের ভেতরে দৌড়ে যায়। সাদাফ দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।

***
ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই রোদেলার ঘোর কেটে যায়। সে এতক্ষন বসে বসে ঝিমাচ্ছিলো।
ফোনটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে দেখতে পায় তাশরিফ হাসানের নাম্বার। বিরক্ত হয়ে যায় রোদেলা। সমস্যা কি এই লোকের! নিজে ছুটিতে থেকেও রোদেলার হাড় জ্বালাচ্ছে !
রিসিভ করে বিরক্ত ভাব নিয়ে বলে,”বলুন স্যার।”

তাশরিফ ওপাশ থেকে বলে,”আপনি একটু লাইফ কেয়ার হসপিটালে আসতে পারবেন?”

_কেনো স্যার?
অবাক হয়ে জানতে চায় রোদেলা।

_বৃষ্টির একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে।

_মানে???
চেঁচিয়ে ওঠে রোদেলা। তার গলা কাঁপছে।

_ঘাবড়াবেন না। সামান্য এক্সিডেন্ট। আপনি চাইলে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি।

তাশরিফ ফোন কেটে দেয়। রোদেলা ধপ করে চেয়ারে বসে পরে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে।

সিএনজি থেকে নেমে তাশরিফের নাম্বারে ফোন দিতে থাকে রোদেলা। তাশরিফ ফোন রিসিভ করে বলে,”আপনি এসে গিয়েছেন?”
_হ্যা, বৃষ্টি কোথায়?
_আপনি দোতলায় ২০৯ নাম্বার কেবিনে আসুন।

ফোন রেখে রোদেলা দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ২০৯ নাম্বার কেবিনের কাছে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পরে সে।

বৃষ্টি বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। তার শরীরে স্যালাইন চলছে। নার্স ঠিক ঠাক করে দিচ্ছে সবকিছু।
সবাই রোদেলাকে দেখছে। বৃষ্টি বোনের দিকে তাকিয়ে আছে,তার চোখ ভিজে উঠেছে এতদিন পরে বোনকে দেখতে পেয়ে। কেবিনের মধ্যে বৃষ্টি ছাড়াও রয়েছে তাশরিফ আর বৃষ্টির শশুর, শাশুড়ি। যদিও রোদেলা তাদের চেনে না,আন্দাজ করে নিয়েছে। বৃষ্টির স্বামী কোথায়! এতোটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন যে বৌয়ের এই অবস্থায় পাশে নেই!

রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”কিভাবে হয়েছে এসব?”

_বাইক থেকে পরে গিয়েছে।
রোদেলা বৃষ্টির দিকে চায়। চেঁচিয়ে বলে,”এমন একটা আহাম্মককে বিয়ে করেছিস যে বাইক চালাতেও জানে না ঠিকভাবে।”

তাহমিনা কপাল কুঁচকে ফেলে,”এই মেয়ে! আহাম্মক কাকে বলছো? আমার ছেলে ঠিক ভাবেই বাইক চালাতে জানে। ক্লাস এইট থেকে সে বাইক চালাতে এক্সপার্ট।”
তাশরিফ মাকে থামিয়ে দিয়ে রোদেলাকে বলে,”বৃষ্টি মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলো।”
রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে নার্সের দিকে তাকায়, চেঁচিয়ে বলে,”এটা কিসের স্যালাইন চলছে ওর? কি হয়েছে ওর?”

নার্স মৃদু হেসে বলে,”আপনি রোগীর কি হন?”

রোদেলা বলে,”বোন।”

নার্স একটা প্রস্বস্ত হাসি দিয়ে বলে,”অভিনন্দন। আপনি খালামনি হতে যাচ্ছেন। আর এটা দুর্বলতা কাটানোর জন্য রোগীকে দেওয়া হচ্ছে। টেনশনের কিছু নেই।”

রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি মাথা নিচু করে রেখেছে। তাশরিফ রোদেলাকে দেখছে। রোদেলা হতভম্ব ভাব নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”বাহ!!! চমৎকার!!!!”

চলমান……

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৮
#লেখিকা_Esrat_Ety

“তুই এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছিস কেনো?”

আদিল ভাইয়ের ডাকে চমকে ওঠে। ভীত চোখে তাশরিফের দিকে তাকায়। লজ্জায় তার ভাইয়ের চোখে চোখ রাখতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এরকম একটা কান্ড ঘটে যাবে কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি সে ! এখন বৃষ্টির সামনেই বা কিভাবে যাবে! বাবা মা,বন্ধু বান্ধব সবাইকে কিভাবে ফেইস করবে দু’জনে। সমাজ দুটো খোঁচা মেরে কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়বে না!
তাশরিফ আদিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আদিলকে ধমকে বলে,”কি ব্যাপার। এখানে এভাবে লুকিয়ে আছিস কেনো?”

আদিল চুপ করে আছে। যে ভাইয়ার সাথে সে এতটা ফ্রি আজ তার চোখে চোখ রাখতেও পারছে না সে। তাশরিফ আবারো ধমকে ওঠে,”সমস্যা কোথায়?”

_মা বাবার সামনে যেতে খুব লজ্জা করছে ভাইয়া। আমাকে যদি মা জুতাপেটা করে?
তাশরিফ হেসে ফেলে,”তুই বাবা হতে যাচ্ছিস। এজন্য তোকে জুতাপেটা করবে কেনো? এটা কি জুতাপেটা করার মতো কোনো খবর? মা ভীষণ খুশি হয়েছে। মায়ের চোখ দেখে আমি বুঝেছি।”

আদিল মাথা নিচু করে রাখে। তাশরিফ বলে,”তোর শশুর বাড়ীর লোক এসেছে। তোর শশুর এসেছে। চল এখন। তারা কি মনে করছে বলতো? তোকে কান্ডজ্ঞানহীন ভাবছে সবাই।”

_ভাবলে ভাবুক। আমি ওই সিমেন্ট আপুর সামনে কিছুতেই যেতে পারবো না। আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আমাকে ছেড়ে দাও ভাইয়া। আমি ওই মহিলার সামনে যেতে চাইনা।

তাশরিফ ভাইয়ের হাত ধরে,”কিচ্ছু বলবে না। তুই আয় আমার সাথে।”
হাত ধরে টানতে টানতে বৃষ্টির কেবিনে নিয়ে যায় আদিলকে। মেঘলা বৃষ্টির বেডে বসে বোনকে আগলে ধরে রেখেছে,একটু পরপর চোখের পানি মুছছে,তাদের মান অভিমানের পালা শেষ হলো মাত্র। রুহুল আমিন সোফায় বসে মেয়ের দিকে স্নেহমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেদিনের সেই ছোট্ট বৃষ্টি আজ কতো বড় হয়ে গিয়েছে। দুদিন পরে সেও মা হবে! কোনো এক অজানা কারনে সে খুশি হয়েছে।

কেবিনের এক কোনায় রোদেলা থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আদিলকে দেখে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে সে। আদিল ভয় পেয়ে একটা ঢোক গিলে ফেলে। রুহুল আমিনের কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম বাবা।”
মাথা উঠিয়ে রুহুল আমিন আদিলকে দেখে। তারপর সালামের উত্তর দেয়। মেঘলার দিকে তাকিয়ে সালাম দিলে মেঘলাও সালামের উত্তর দেয়। ভয়ে ভয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আদিল মৃদু স্বরে বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম আপু।”

রোদেলা সালামের উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ায় শুধু। তাশরিফ বলে,”বৃষ্টিকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। ওকে এখনি নিয়ে যেতে পারবো বাড়িতে।”

রোদেলা বলে ওঠে,”আমার বোনকে আমি আমাদের সাথে নিয়ে যাবো। ও এখন থেকে এই কয় মাস আমাদের কাছে থাকবে।”

তাহমিনা অবাক হয়ে বলে,”তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে মানে? ও আমাদের বাড়ির বৌ। এই অবস্থায় তোমাদের বাড়িতে যাবে কেনো? ওর স্বামীর বাড়িতে যাবে।”

রোদেলা কন্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,”আপনার গুণধর ছেলে তো আমার বোনের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এখন এই অবস্থায় আমাদের কাছে রাখলে একটু ভালোভাবে পড়তে পারবে। ওর ইয়ার লস যাক তা আমি চাচ্ছি না।”

তাহমিনা ভ্রু কুঁচকে ফেলে,”তোমার বোনকে দিয়ে আমি এই অবস্থায় কাজ করাবো নাকি যে ওর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে? ওর কাজ হবে শুধু খাওয়া আর পড়া। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখো কখনো ওকে দিয়ে কাজ করাই কি না কোনো, জিজ্ঞেস করো তোমার বোনকে।”

তাশরিফ একবার মায়ের দিকে আর একবার রোদেলার দিকে তাকিয়ে তাদের ঠান্ডা যুদ্ধ দেখতে থাকে। দু’জনেই সমান জেদী। এদের মাঝখানে পরে ভবিষ্যতে তাশরিফকে চিড়া চ্যাপ্টা হতে হবে তা তাশরিফ বেশ বুঝতে পারছে।
আদিল মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বৃষ্টিকে কিছুতেই এই অবস্থায় কাছ ছাড়া করবে না। কিন্তু জোর খাটিয়ে বলার সাহস ও পাচ্ছে না সে।
আফতাব হাসান বলে,”বৃষ্টি কোথায় থাকবে তা পরে দেখা যাবে। আগে মেহমান নিয়ে বাড়ি যাই কি বলিস তাশরিফ?”

_হ্যা। সেটাই।
তাশরিফ হেসে বলে। রোদেলা বলে,”আমরা কোথাও যেতে চাচ্ছি না এখন। বৃষ্টিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবো।”

তাহমিনা চেঁচিয়ে ওঠে,”এই মেয়েটা তো ভীষণ জেদি। মুরব্বিদের মুখের উপর কথা বলছে কিরকম।”
রুহুল আমিন রোদেলাকে ধমকের সুরে বলে,”কি হচ্ছে রোদেলা।”

রোদেলা বাবার কথা গায়ে না মেখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই বল। তুই কোথায় যাবি। আমাদের সাথে যাবি? নাকি ওনাদের সাথে যাবি?”

বৃষ্টি সবার মুখের দিকে তাকায়। এতদিন পরে মেজো আপু তার কাছে এসেছে এখন যদি মেজো আপুকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে কেমন হবে! মেজো আপু আবারো কষ্ট পাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি নিচু স্বরে বলে ওঠে,”আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে যেতে চাই আপু।”

রোদেলা বোনের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। আদিল খুশি হয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”এই না হলে আমার বৌ!”

***
হসপিটাল থেকে রোদেলারা বাড়িতে চলে আসে। আফতাব হাসান যদিও অনেকবার বলেছিলেন তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা। তারা যায়নি।
রোদেলার মেজাজ ঠিক নেই। বৃষ্টির ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার,সেই সাথে হিংসাও হচ্ছে খুব। কয় মাসের মধ্যে ওই বাড়ির লোক এতোটা আপন হয়ে গেলো বৃষ্টির!
আয়েশা সিদ্দিকা দরজা খুলে দিলে রোদেলা সরাসরি নিজের ঘরে চলে যায়। মেঘলা বসার ঘরে ঢুকে দেখে সুহা আর সিরাত সোফাতে বসে আছে। সে আয়েশার দিকে তাকায়। আয়েশা বলে,”অনেকক্ষণ হলো এসেছে দুজন। তোমার কথা বারবার বলছে,তুমি কখন আসবে জিজ্ঞেস করছে। ওদের দাদী এসেছিলো নেওয়ার জন্য এইমাত্র। যায়নি।”

মেঘলা সিরাত আর সুহার দিকে তাকিয়ে হাসে। ওরাও হাসে।

“নাও এটাও খাও।”
তাহমিনা বৃষ্টির প্লেটে আরো এক পিস মাংস তুলে দিয়ে বলে। বৃষ্টি মাথা নিচু করে খাচ্ছে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে কারো মুখের দিকে তাকাতে।
আফতাব হাসান বলে,”রাগ যখন পরেই গিয়েছে ওনাদের একদিন দাওয়াত করে দে তাশরিফ। বৃষ্টির কাছে ওনাদের আসা যাওয়া থাকবে, বৃষ্টির ভালো লাগবে।”

তাশরিফ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তাহমিনা বলে,”মেজো মেয়েটাকে আমার একটুও ভালো লাগলো না। অনেক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করলো দেখলি। বড় টাকে ঠিকঠাক মনে হলো।”

তাশরিফ মাকে চোখ রাঙানি দেয়। বৃষ্টি কিছু বলে না শাশুড়ির কথায়,খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায় ঘরে। আদিল বৌয়ের পিছু পিছু যায়। তাশরিফ কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,”মা এভাবে বৃষ্টির সামনে কেন বললে? বৃষ্টির খারাপ লাগে না?”
_বৃষ্টির খারাপ লাগেনি। কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তোরই খারাপ লেগেছে।
তাশরিফ থতমত খেয়ে যায়। তাহমিনা বলতে থাকে,”কেনো ভুল বলেছি নাকি? বলে কিনা আমাদের বাড়ির বৌকে তাদের কাছে নিয়ে রাখবে। মামার বাড়ির আবদার নাকি?

_বাদ দাও না মা। বৃষ্টি খুব ছোটো তো তাই তাদের টেনশন হচ্ছে।

_হুম বুঝলাম।
আদিলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা বলে,”দেখেছিস গাধাটা না খেয়েই বৌয়ের পিছু পিছু রুমে চলে গেলো। এতো পুরো বৌ পাগলা হয়েছে!

তাশরিফ হাসে। তাহমিনা বলে,”তুই হাসছিস কেনো। তোর বিয়ে তো মনে হয় এই জন্মে আমি দেখে মরতে পারবো না ‌। আদিলকে সবসময় বলতাম তোর পা ধোয়া পানি খেতে। এখন তোকে বলছি, ছোটো ভাইয়ের পা ধোয়া পানি খা যা।”

তাশরিফ শুকনো হাসি হাসে। মনে মনে বলে,”ঠিক বলেছো মা। এজন্মে আমার বিয়ে হয় কি না সন্দেহ।”

***
মেঘলার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। মাইনুল সেদিন যেসব বাজে কথা শুনিয়ে দিয়ে গিয়েছে তারপর থেকে সাদাফের সামনে মেঘলা পরেনি। কিন্তু এই নিষ্পাপ বাচ্চা দুটো তাকে বারবার সাদাফের সম্মুখীন করে দিচ্ছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাদাফ নিচু স্বরে বলে,”সুহা সিরাত কে নিতে এসেছি। মা বললো ওরা আপনার কাছে।”

_হু।
মৃদু স্বরে বলে মেঘলা।
_ডেকে দিন ওদের।
_ওরা ঘুমিয়ে গিয়েছে।

সাদাফ মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সাদাফ খানিকটা বিব্রত মুখ নিয়ে ভেতরে ঢোকে। মেঘলা আঙ্গুল দিয়ে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলে,”ওরা ওই ঘরে ঘুমিয়ে আছে।”
সাদাফ ধীরপায়ে মেঘলার ঘরে যায়। এভাবে একজন ভদ্রমহিলার শোবার ঘরে ঢুকতে তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না। মেঘলা পিছু পিছু এসে বলে,”দুজনকে একসাথে কিভাবে নিয়ে যাবেন? আমি একজনকে পৌঁছে দিয়ে আসবো?”

_আপনি পারবেন না। আমি সুহাকে নিচে রেখে এসে সিরাতকে নিয়ে যাচ্ছি।

সাদাফ ঘুমন্ত সুহাকে কোলে করে নিয়ে যায়। মেঘলা সিরাতের মাথার কাছে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর সাদাফ আসে। সিরাতকে কোলে উঠানোর আগে মেঘলার দিকে একপলক তাকায় সে। নিচু স্বরে বলে,”আমার বাচ্চা দুটো আপনাকে খুব বিরক্ত করে।”

মেঘলা একটা হাসি দিয়ে বলে,”অসুবিধা নেই। আমার জীবনে তো বিরক্ত করার মতো কেউ নেই। আর কখনো হবেও না।”

***
“এখানে কি হচ্ছে?”

রোদেলা পা বাড়িয়ে এপার্টমেন্টের কেয়ার টেকার রিয়াজের দিকে এগিয়ে যায়।
রিয়াজ রোদেলার দিকে ভীত চোখে চায়। এই আপাটাকে সে প্রচন্ড ভয় পায়। যখন তখন,যাকে তাকে চড় থাপ্পড় মারে।

বেবী রোদেলাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে,”আপা দেখেন এই রিয়াজ আমাকে দেখলেই বেবী ট্যাক্সি বলে ডাকে।”

রোদেলা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলে,”তুমি বেবীকে বেবী ট্যাক্সি বলো কেনো? এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি। সালমান সাদাফের কাছে জানাতে হবে নাকি?”
রিয়াজ ভয় পেয়ে বলে,”না আপা,না আপা,আমি তো একটু মজা করছি। আর করবো না।”
রিয়াজ দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যায়। রোদেলা বেবীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ফের যদি তোমাকে বিরক্ত করে সোজা সাদাফ ভাইয়ের কাছে বলবে। ঠিকাছে?”
বেবী মাথা নাড়ায়। রোদেলা বলে,”এখন কোন বাসায় কাজের পালা?”
_চার তলায়, ডাক্তার সাহেবের ফ্ল্যাটে। আপনাদের ফ্ল্যাটে পানি দিয়ে এসেছি।

“ঠিকাছে” বলে রোদেলা সামনের দিকে পা বাড়ায়। বেবী পেছন থেকে ডেকে ফেলে,”আপা।”

রোদেলা তাকায়। বেবী বলে,”একটা কথা ছিলো।”
_কি বলো।
রোদেলা বেবীর দিকে তাকিয়ে আছে। বেবী এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বলে,”আগে কসম কাটেন আমি যে আপনাকে বলছি তা কাউকে বলবেন না। আমার চাকরি চলে যাবে তাহলে।”

রোদেলা বলে,”আচ্ছা ঠিকাছে বলবো না।”
বেবী রোদেলার আরো কাছে এগিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে,”মেঘলা আপাকে নিয়ে এই বিল্ডিং-এর অনেক লোকে আজেবাজে কথা বলে।”

রোদেলা হতভম্ব হয়ে যায়,”আজে বাজে কথা বলে মানে? কি বলে?”

_দুই তলার স্যারের বৌ আর চার তলার ডাক্তার সাহেবের বৌ সেদিন বলছিলো মেঘলা আপা নাকি সাদাফ ভাইজানের গায়ে পরতে চায়। তার বাচ্চা দুইটাকে হাত করে তার গলায় ঝুলে পরতে চায়।

রোদেলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সে কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। বেবী বলতে থাকে, “চার তলায় যে সীমা আপারা আছে না? তারা নাকি বলাবলি করছিলো মেঘলা আপা প্রায়ই খালি বাসায় সাদাফ ভাইয়ের কাছ যায়। সীমা আপাদের কাজের মেয়ে শেলী আমাকে বলেছে। সারাদিন মেঘলা আপা আর সাদাফ ভাইকে নিয়ে কেচ্ছাকাহিনী বলে।”

রোদেলা নিশ্চুপ হয়ে থাকে। বেবী বলে,”আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি আপা,তাই আপনাকে বললাম। দয়া করে আমার নাম বলবেন না আপা।”

_ঠিকাছে। বলবো না। তুমি যাও।
অস্ফুট স্বরে বলে রোদেলা। বেবী চলে যায়। রোদেলা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে।

***
মেঘলা দরজা খুলতেই সিরাত সুহা তার উপরে ঝাপিয়ে পরে। মেঘলা দুজনের ওজন সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরে যায়। তারপর তিনজনই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। হাসি থামিয়ে মেঘলা বলে,”এখন না তোমাদের স্কুলে থাকার কথা? এখানে কি করছো? ”
_আজ স্কুলে যাইনি আন্টি।
_ওমা,তা কেনো?
_আজ বাবার বার্থডে। আমরা বাবাকে সারপ্রাইজ দেবো তাই বাবার জন্য গিফট কার্ড বানাচ্ছি। বাবাকে বলেছি আজ পেটে ব্যাথা আমাদের। তাই স্কুলে যাবো না।
_একসাথে দুজনের পেট ব্যাথা? এটা বাবা বিশ্বাস করেছে?

সুহা গম্ভীর হয়ে বলে,”না। প্রথমে বিশ্বাস করেনি। পরে মিথ্যা করে কান্না করেছি, তারপর বিশ্বাস করেছে।”

মেঘলা হাসে। তারপর সুহার নাক টিপে দিয়ে বলে,”তা আমার কাছে কি দরকারে এলে? আমি কি করতে পারি?”

_তুমি গিফট কার্ড বানিয়ে দেবে আমাদের। চলো চলো এক্ষুনি নিচে চলো।
মেঘলার হাত ধরে সুহা টানতে থাকে। মেঘলা চিন্তায় পরে যায়। সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাড়িতে এখন কে কে আছে তোমাদের? তোমার বাবা আছে?”
সিরাত বলে,”না। শুধু দাদী আছে। বাবা তো কোথায় চলে গিয়েছে।”
মেঘলা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সাদাফ বাড়িতে নেই। তাহলে তো যাওয়াই যায়।

অফিসে গিয়ে রোদেলা শুকনো মুখ করে বসে আছে। বেবীর থেকে যা শুনেছে তাতে রোদেলা একটুও স্বস্তি পাচ্ছেনা। তাদের সাথেই এমনটা কেনো হচ্ছে বারবার! মেঘলা আপুর সরলতা মেঘলা আপুর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আপুকে অপদস্থ হতে দেখতে পারবে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আজ বাসায় গিয়েই সালমান সাদাফকে জানিয়ে দেবে তারা তার ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবে। এই কথা গুলো যদি ঘুনাক্ষরেও মেঘলা আপু শুনতে পায় তবে আপু ভীষণ কষ্ট পাবে। তার আগে এখান থেকে তাদের চলে যাওয়াই ভালো।

***
সাদাফদের ফ্ল্যাটে ঢুকে মেঘলা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাদের দাদী কোথায়?”

_দাদী ঘুমিয়েছে। দুপুর হলেই দাদী ঘুমিয়ে যায় আর নাক ডাকে।
কথাটি বলেই সিরাত হাসে। মেঘলাও হেসে ফেলে। সুহা মেঘলার হাত ধরে টানতে টানতে তাদের ঘরে নিয়ে যায়,”এসো আন্টি। কালার পেপার গুলো বাবার ঘরে। এসো।”

মেঘলা অস্বস্তি নিয়ে পা বাড়ায়। দরজা ঠেলে যেই না ভেতরে ঢুকবে অমনি ভেতর থেকে সাদাফ বলে ওঠে,”সুহা সিরাত,এভাবে দরজা খোলা রেখে উপরে গিয়েছিলে কেনো?”

মেঘলা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। সাদাফ একটা ট্রাউজার পরে আছে,খালি গায়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দরজার দিকে তাকিয়ে মেঘলাকে দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে যায়।

মেঘলা বিব্রত হয়ে ঘুরে যায়। সাদাফ তড়িঘড়ি করে একটা টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে নেয়। সিরাত আর সুহাও অবাক হয় তাদের বাবাকে দেখে। বাবা তো বাইরে গিয়েছিলো। এখানে কিভাবে এলো? এখন তো তাদের প্ল্যানের কথা বাবা জেনে যাবে!

মেঘলা অস্বস্তি নিয়ে বলে,”ওরা টেনে এনেছে আমাকে, আপনার জন্য গিফট কার্ড বানিয়ে দিতে।”

সুহা আর সিরাত কপাল চাপড়ে চেঁচিয়ে বলে,”আন্টি তুমি বাবাকে বলে দিলে !”

মেঘলা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ঘাবড়ে গিয়ে সে বলে দিয়েছে সুহা সিরাতের গোপন কথা। সে তার দোষ ঢাকতে বলে,”কোনো সমস্যা নেই সুহা সিরাত,গিফট কার্ড বানাবো বলেছি। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে বানিয়ে তারপর সারপ্রাইজ দেবো। চলো বানিয়ে দেই।”
সুহা সিরাতের হাত ধরে মেঘলা বসার ঘরের দিকে যায় রঙ্গিন কাগজ গুলো নিয়ে।

সুহা সিরাত মন খারাপ করে বসে আছে। মেঘলা ওদের শান্তনা দিয়ে বলে,”দেখবে এমন সুন্দর গিফট কার্ড বানাবো যে বাবা চমকে যাবে। লাফিয়ে উঠে বলবে “ওয়াওও”!

দু’জনেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। মেঘলা পেন্সিল বক্স থেকে একটা লাইটার উঠিয়ে ওদের দিকে তাকায়,”এটা এখানে কেনো? এটা কার?”

_বাবার ড্রয়ার থেকে চুরি করেছে সুহা।
সিরাত ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে।

মেঘলা নিজের কাজে মন দেয়। কি করবে সে সেটাই বুঝতে পারছে না। কাগজ কেটে ফুল বানাতে থাকে সে। অবাঞ্ছিত টুকরো কাগজ গুলি পাশে স্তুপ করে রাখে।

সুহা সিরাত ক্যান্ডেল গুলো বের করে একটা বক্স থেকে। তাদের বার্থডেতে বাবা এনেছিলো, সেখান থেকেই এগুলো বেঁচে গিয়েছে। তারা দাদীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।
মেঘলার দিকে তাকিয়ে সিরাত বলে,আন্টি ক্যান্ডেল গুলো জ্বালিয়ে দেবো?
_না হাতে লেগে যাবে।
_তুমি জ্বালিয়ে দাও তবে।
মেঘলা লাইটার দিয়ে একটা ক্যান্ডেল জ্বেলে দেয়। সুহা সিরাত বাকি ক্যান্ডেল গুলো জ্বালাতে থাকে। হঠাৎ একটা লাল রঙের ক্যান্ডেল নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। দু’জনেই ক্যান্ডেলটা জ্বালানোর জন্য ইচ্ছুক। ক্যান্ডেলটা ধরে টানাটানি করছে দুজনে। মেঘলা ওদের থামাতে চেয়ে সামনে এগোতেই মেঘলার হাতের ধাক্কা লেগে একটা জ্বেলে রাখা ক্যান্ডেল কাত হয়ে পরে যায় কাগজের উপরে। কাগজগুলো চোখের পলকেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।

মেঘলা দিশেহারা হয়ে বাচ্চা দুটোকে আগলে নিয়ে পিছিয়ে যায়। দেখতে দেখতে সবগুলো কাগজ জ্বলে ওঠে। মেঘলা একটা বিকট চিৎকার দেয়। সাদাফ নিজের রুম থেকে প্রায় ছুটে আসে। মেঘলা বাচ্চা দুটোকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে শক্ত করে। সাদাফ হতভম্ব হয়ে যায়, দিকবিদিক শূন্য হয়ে একটা ফুলদানি দিয়ে আগুন চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তার হাতে আগুনের আঁচ লেগে যায়।
জাহানারা ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে আসে। একটা পানির বোতল এনে আগুনে ঢেলে দেয়। মেঘলা আতংকিত হয়ে সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতটা পুড়ে গিয়েছে কিছুটা বোধ হয় লোকটার। মুখটা কেমন যন্ত্রনায় নীল হয়ে গিয়েছে।

আগুন নিভে গিয়েছে। মেঘলা দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বাটিতে পানি নিয়ে আসে। সাদাফের কাছে এসে তার হাতটা টেনে বাটির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়।

সাদাফ মেঘলার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ আগে সুহা সিরাতকে আগলে ধরে মেঘলার দাঁড়িয়ে থাকা,এখন আবার সাদাফের কেয়ার নেওয়া। সবকটা দৃশ্য সাদাফের মনে অদ্ভুত একটা অনুভুতির সৃষ্টি করে দেয়। হঠাৎ তার মনের কোনো একটা স্থান থেকে কেউ বলে ওঠে,”খারাপ হয় না সাদাফ! কেউ এভাবে সুহা,সিরাত আর তোমার কেয়ার নিলে সত্যিই খারাপ হয়না। ”

***
” স্যার শুনুন”

তাশরিফ পিছনে ফিরে তাকায়। তার পেঁচা মুখী তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে খুশি হয়ে যায়। ব্যাপার কি! আজ সূর্য কোনদিক থেকে উঠলো!
রোদেলা তাশরিফের কাছে চলে আসে। তাশরিফের চোখে চোখ রেখে বলে,”বাসায় যাচ্ছেন?”
তাশরিফ মনে মনে বলে,”হ্যা। তবে আপনি চাইলে কাজী অফিসে যাবো এখন।”
কিন্তু মুখে বলে,”হ্যা। কেনো?”
_আমি বৃষ্টির জন্য কিছু হেল্থ ড্রিংকস আর ফল কিনে দিতে চাচ্ছিলাম। কষ্ট করে নিয়ে যাবেন একটু?

তাশরিফ হেসে বলে,”বাড়িতে ওর জন্য এগুলো সব কিনে রেখেছি আমি।”
_আপনি কিনে দিয়েছেন বলে আমি কিনে দিতে পারবো না?

_না না তা কেনো। অবশ্যই পারবেন।
_তাহলে চলুন,পাশেই একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। ওখানে যাই।
রোদেলা হাঁটতে থাকে,তাশরিফ বাধ্য ছেলের মতো রোদেলার পিছু পিছু হাটে।

লিস্ট দেখে দেখে সবকিছু উঠিয়ে শপিং কার্টে রাখতে থাকে রোদেলা। তাশরিফ চুপচাপ তাকে দেখছে। কখনোও যদি তাদের বিয়ে হয় তাহলে এভাবে দুজন একসাথে শপিং করবে। সেদিনের কথা কল্পনা করে আনমনে হাসে তাশরিফ।

“আরে তাশরিফ যে।”
তাশরিফের কলেজের এক বান্ধবী পেছন থেকে ডাকে। তাশরিফ ঘুরে তাকায়। মেয়েটি বলতে থাকে,”সাথে কে? ভাবী নাকি? বিয়ে করলি কবে?”

তাশরিফ থতমত খেয়ে যায়। তার এই বান্ধবী একটু ফটর ফটর বেশি করে।‌ তাশরিফ মেয়েটিকে কিছু বলতে যাবে তখন মেয়েটি আবারো বলে,”এখানে ম্যাটার্নিটি জোনে কি করছিস? কার জন্য কিনছিস এসব? প্রেগন্যান্ট কে? ভাবী প্রেগন্যান্ট?”

তাশরিফ তার বান্ধবীকে চোখ রাঙানি দিয়ে থামিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েটি চলে গেলে তাশরিফ রোদেলাকে বলে,”বুঝতে পারেনি।”

রোদেলা ঠান্ডা গলায় বলে,”বুঝতে না পারলে এতো কথাই বা বলতে হবে কেনো? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো আপনারা সব বন্ধুরাই কি সস্তা ধরনের রসিকতা করার স্পেশাল কোর্স করেছিলেন কোনো ইনস্টিটিউট‌ থেকে?”

চলমান……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে