দোলনচাঁপা পর্ব-০৫

0
537

#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫

ফাহাদের চোখ সরছে না। তুলি মেয়েটা এতো সুন্দর কেন! তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তনিমাকে দেখলে তো এমন অনুভূতি হয় না।

” এভাবে কি দেখছেন? ”

” তোমাকে, এতো সুন্দর না হলেও পারতে। ”

” কি যে বলেন আপনি!”

” সত্যি বলছি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। ”

” তাই? বাড়িতে কি হয়েছিলো? তখন অমন করে দৌড়ে চলে গেলেন। ”

” বাবা মা”রা গেছে। ”

” কি বলছেন? কিভাবে? ”

” সত্যি বলছি। বাবার খু’ন হয়েছে। ”

” কে? কিভাবে?”

” সঠিক জানি না। তনিমা আর রঞ্জুর কাজ বোধহয়। ”

” ওরা কেন মা’রবে?”

” কারণ জানা নেই। তবে বাবা মা’রা গিয়ে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। ”

” কি ক্ষতি হয়েছে? ”

” বাবা চাইছিলেন সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবেন। বাউণ্ডুলে রঞ্জুর জন্য কিছু রাখবেন না। কিন্তু এখন তো সেসব সম্ভব নয়। ”

” রঞ্জু জানতো সম্পত্তির ব্যাপারে?”

” নাহ্। বাবা শুধু আমায় বলেছিলেন। ”

” হয়তো আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনে নিয়েছিল। ”

” না রে। বাবার সঙ্গে গ্রামে গেছিলাম মাস দুয়েক আগে। তখন এসব কথা হয়েছিল। রঞ্জুর জানার উপায় নেই। ”

” পুলিশ কি বলছে?”

” পো’স্ট’ম’র্টে’ম রিপোর্ট না আসলে কিছু বলতে পারছে না। পুলিশরা অতো সহজে খু”নিকে ধরতে পারবে বলে মনে হয় না। ওদের নানাক কাজ থাকে। একটা কে”স নিয়ে পড়ে থাকার সময় কই।”

” কি করবেন এখন? পুলিশ কাকে কাকে সন্দেহ করছে?”

” জানি না। তেমন কোন কথা হয়নি। ”

” আমাকে ভুলে যাবেন না তো?”

” নাহ্, কখনোই না। বাবার ব্যাপারে সমাধান হয়ে গেলে আমরা বিয়ে করে ফেলবো। তনিমাকে ডি’ভোর্স দিয়ে দিলে হলো। মনে হয় না ও কোন প্রকার ঝামেলা করবে। জানো তুলি, বাবা আমায় অনেক ভালোবাসতেন। ”

ফাহাদের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাবার মৃ’ত্যু’র শোক সহ্য করতে পারছে না। তুলি ফাহাদের দিকে ঝুঁকে কাঁধে হাত রাখে। তুলির সান্ত্বনা পেয়ে ফাহাদের কান্না কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তুলি পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। ফাহাদকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন মানে হয় না। লোকটা উদ্দেশ্য খুব বেশি সুবিধার মনে হয় না। বেশ ক’দিন ফাহাদের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে, তারপর সময় বুঝে কে’টে পড়তে হবে। পুলিশ টের পেলে আমাকেও সন্দেহের তালিকায় ঢুকিয়ে দিবে। এই জ’ঘন্য চরিত্রের লোককে কে বিয়ে করবে!

” তুমি কি কিছু ভাবছো?”

” হ্যাঁ ভাবছি। কিন্তু মেলাতে পারছি না।”

” কি ভাবছো? ”

” বউ থাকতেও বাইরে পরকীয়া করতে হয় কেন? ”

” মানে? ”

” আরে মজা করলাম। ভাবছি আংকেলের খু’নের ব্যাপারে। গোয়েন্দা ঠিক করার কথা বললে তখন। কাউকে খুঁজে পেয়েছ নাকি?”

” না তেমন কাউকে পাইনি। তোমার পরিচিত কেউ আছে নাকি?”

তুলি ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। তারপর৷ মুচকি হেসে বলে, ” ফাহাদ তোমার বাড়িতে থাকা উচিত। এভাবে বাইরে বাইরে ঘুরলে সকলের সন্দেহ হবে, তাছাড়া পু’লি’শও তোমার উপর নজর রাখবে। ”

” পুলিশ কেন নজর রাখতে যাবে?”

” কোন কারণ ছাড়াই। সন্দেহের বশে। দেরী করো না, বাড়িতে ফিরে যাও। ”

” তোমাকে কোথায় নামিয়ে দেবো?”

” এখান দিলেও হবে, সিএনজি করে বাড়ি ফিরে যাব। ”

” না না তা কি করে হয়?”

” হয়। ”

তুলি গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। হাত নাড়িয়ে ফাহাদকে বিদায় জানায়। ফাহাদ শুকনো মুখে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। তুলির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তনিমার সঙ্গ ভালো লাগে না। বেশ কয়েকদিন ধরে ম’দের নেশাটা মাথা চাড়া দিয়েছে। নে”শার কারণে বাড়িতে ফেরা হয় না। রুবেলের বাড়িতে রাত পার হয়ে যায়। রুবেল ছেলেটা বেশ কাজের। একাই থাকে বাড়িতে, ঝামেলা করার কেউ নেই।

* * *

তুলি গাড়ি থেকে নেমে নিজের মা’কে কল দেয়। উৎসাহিত গলায় বলে, ” মনির চৌধুরী মা”রা গেছে। আমার প্র’তি’শোধ সম্পূর্ণ হলো। ”

ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ আসে না। তুলি বিচলিত হয় না। মুচকি হেসে মোবাইলটা ব্যাগে রেখে দেয়। আজ অনেক কাজ করতে হবে। চারপাশ দোলনচাঁপার গন্ধে ম-ম করছে। এখন কি দোলনচাঁপা ফোটে?

* * *

বিছানায় শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছি। বাবার খু’নের ব্যাপারে কোন হদিস পায়া যাচ্ছে না। পুলিশও তেমন কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। রিপা মেয়েটা আসার পর থেকে আমার পিছনে পড়ে রয়েছে। তাঁকেও এড়িয়ে যেতে পারছি না। মেয়েটা মাঝে অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে-ই ক্ষমতা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই। ভাইয়া ভাবীর সংসারে ফাটল ধরেছে। ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে ভাবীর কান্না থামছে না। মা-বাবাও তাঁকে শান্ত করতে পারছে না। গ্রাম থেকে কাকা আর ফুফু এসেছে। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই কান্না জুড়ে দিলো। ভাই হারিয়ে গেছে এ কথা মানতে পারছে না। অথচ বেঁচে থাকতে কখনো তেমন খাতির নজরে পড়েনি। মানুষ ম’র’লে দু’দিনের জন্য তার প্রতি ভালোবাসা বাড়ে, তারপর চিরতরে ভুলে যায়। মনে লাগলেও গায়ে লাগে না।
দুপুরে সাগর কাকাদের বাড়ি থেকে ভাত- তরকারি দিয়ে গেছে। মরা বাড়িতে নাকি রান্না হয় না। কাকিমার হাতের রান্না বেশ দারুণ। খাওয়ার সময় ভালোই লাগছিলো। উনারা চাইলে একটা রেস্তোরাঁ খুলতে পারেন। প্রচুর লোকের ভীড় হবে। আমি তো রোজই যাব।

” রঞ্জু বাবু ঘরে আছেন?”

” হ্যাঁ, ভেতরে এসো। ”

” কি করছেন? ”

” বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি আর আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছি। ”

” এতো কি ভাবছেন? ”

” আপাতত তোমার কথা চিন্তা করছি। তুমি কি সিরিয়াল দেখো?”

” কোন সিরিয়াল? ”

” যে সিরিয়ালের নায়িকারা তাঁদের প্রিয় মানুষককে বাবু বলে ডাকে। ”

” না না ওসব দেখার সময় নেই। ”

” আমার মনে হচ্ছে তুমি ওসব একটু বেশিই পছন্দ করো। সেজন্য আমার নামের শেষে বাবু শব্দটা লাগিয়ে রঞ্জু বাবু বলে ডাকো। ”

” এ মা কিসব বলছেন! শুধু রঞ্জু শুনতে কেমন কেমন লাগবে না। তাই বাবু বলি। ”

” একদমই কেমন কেমন লাগবে না। তোমাকে রিপা বাবু বললে কেমন শোনায়?”

” রিপা বলতে হবে না। শুধু বাবু বললে হবে। ”

রিপা লজ্জা পেয়ে চলে গেল। মেয়েটার মাথায় সমস্যা হয়েছে। আজ-কাল উৎভট আচরণ করছে। আগে এমন ছিলো না। মানুষ চিন্তা এড়াতে এমন কাজ করে নাকি? ভাইয়া এখনও বাড়ি ফেরেনি। কোথায় কি করছে কে জানে!

রাতে খাওয়ার সময় মনে পড়লো আগেরদিন বাবাকে দেখেছিলাম। বাবা সোফায় বসেছিলেন। ভাবীর দেওয়া পায়েসটুকু চেটেপুটে সাবাড় করছিল। কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ জ্বালা করতে আরম্ভ করলো। পানি আসবে বোধহয়।

পরেরদিন সকালে থানা থেকে কল এলো। বাবার রিপোর্ট আসতে আসতে দুপুর হয়ে যাবে। বাদশা বাবু রিপোর্ট নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসবেন। সকলে বিকাল তিনটায় বাড়ির থাকতে বলেছেন। সকলকে কথাটা জানিয়ে এলাম। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে এলো। আজ আমি নিশ্চিন্ত, অনেক বেশি নিশ্চিন্ত!
ঘুম ভাঙলো ভাবীর ডাকে, তিনটে বেজে গেছে। দারোগা বাবু চলে আসার সময় হয়েছে।
তিনটে থেকে বসার ঘরে সোফার কোণায় বসে আছি। বাদশা বাবুর আশার নাম-গন্ধ নেই। লোকটার কি সময় জ্ঞানের অভাব নাকি?

চারটে বাজতে দুই মিনিট বাকি, তখন দারোগা বাবুর আসার সময় হলো। দেদার হেসে বললো, ” একটু কাজ পড়ে গিয়েছিল, সেজন্য দেরী হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না যেন। ”

ভাইয়ার উনার কথা পছন্দ হলো না। কর্কশ গলায় বললো, ” আপনারা পুলিশের লোকেরা মনে করেন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কোন কাজ নেই। আমাদের সময় নষ্ট করলে কিছু হবে না। ”

” ফাহাদ সাহেব রেগে যাচ্ছেন কেন? তাছাড়া আপানার বাবার ক’ব’রও হয়নি। এখনই কাজের চাপ থাকলে হবে?”

” ভালো কথা মনে করিয়েছেন। বাবার লা’শ ফেরত দিবেন কখন? আমাদের তো জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ”

” কাল সকালেই পেয়ে যাবেন। এই ধরেন আটটার মধ্যেই। অনেককিছু তদন্ত করতে হয় তো। বুঝতেই পারছেন। ”

” আচ্ছা। ”

” এই দু’জন কে?’

” উনারা আমাদের কাকা আর ফুফু। ”

” ওহ আচ্ছা, কি নাম আপনাদের?’

” জ্বি আমার নাম মিজান। আর আমার বোনের নাম মনিরা। ”

” বাহ্, আপনাদের কয় ভাই-বোনের নামের শুরুটা ম দিয়ে। দারুণ ব্যাপার। ভাইয়ের সাথে কেমন সম্পর্ক ছিলো?”

” ভাই-বোনের মধ্যে মনমালিন্য হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যা-ই হোক না কেন র”ক্তের সম্পর্ক তো। ”

” আচ্ছা। শেষ কবে দেখা হয়েছে উনার সাথে?”

” দেখা হয়েছে, তা বেশ কয়েকদিন হলো। এই মাস দুয়েক। গ্রামের বাড়িতে গেছিলেন তখন। ফাহাদও সঙ্গে ছিলো। ”

” আচ্ছা। এরপরে আর দেখা হয়নি? ”

” না। আমরা হচ্ছি কাজের মানুষ শহরে বেড়ানোর সময় কই!”

” তা বটে। আপনার বোন কোন কথা বলছে না কেন?”

” কি আর কমু? ভাই হারাইয়াছি, ভাষাও ভুইলা গেছি। ”

” আচ্ছা। ফাহাদ বাবু গাড়ি করে কোথায় গিয়েছিলেন?”

” আপনাকে কে বললো আমি কোথাও গিয়েছিলাম?”

” পুলিশের কাছে এসব খবর থাকে। বলুন না কোথায় ছিলেন, এতো ইতস্তত করছেন কেন?”

” কাজ ছিলো। সমস্ত কাজের কইফেত আপনাকে দিতে হবে নাকি?”

” না না, তা কখন বললাম। আসলে আপনার বাবার মৃ’ত্যু হয়েছে দম বন্ধ হওয়ার জন্য। সোজা ভাবে বলতে গেলে উনাকে শ্বাস রোধ করে মা’রা হয়েছে। তবে উনার র’ক্তে সমান্য পরিমাণ আর্সেনিক পাওয়া গেছে। ম’রার জন্য যথেষ্ট না হলেও মৃ’ত্যুর করণ হতে পারতো। ”

” আপনার কথা বুঝতে পারলাম না। ”

বাদশা বাবু মুচকি হাসলেন। হাসির মাঝে অসংখ্য রহস্য লুকিয়ে আছে। বাবাকে মা’রার পিছনে কার হাত থাকতে পারে? আমার বি’ষে তো উনার মৃ’ত্যু হয়নি।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে