#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৮
#আদওয়া_ইবশার
ভাইয়ের মাথার কাছে বসে চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে ইতি। একটু দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে ইতির সেই কান্না দেখে যাচ্ছে মেহেদী। আজ কতদিন পর প্রিয় মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে! তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত মুখ দেখেই তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত। মেয়েটা যে ভাইয়ের শোকে কান্নায় অস্থির সে কান্নাটুকু চোখে পরছেনা মেহেদীর।একদম কাটায় কাটায় সাতদিন হয়ে গেছে রক্তিম হাসপাতালে এডমিট। যে ছেলে মেডিসিনের তীব্র গন্ধে এক ঘন্টা স-জ্ঞানে হাসপাতালে টিকতে পারেনা সেই ছেলে আজ টানা সাতদিন যাবৎ দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে পরে আছে হাসপাতালের বেডে। সেটাও শুধুমাত্র আজীজ শিকদারের শর্তে। সেদিন ছেলের মুখে আগামী নির্বাচনে এমপি পদে দাঁড়ানোর কথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে শর্ত জুড়ে দেয় কয়েকটা। প্রথম শর্ত ছিল যতদিন ডাক্তার বলবে ততদিন রক্তিমকে হাসপাতালে থাকতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। উত্তরে রক্তিম কিছুক্ষণ মৌন থেকে প্রথম শর্তে রাজি হয়েছিল। সাথে এটাও জানিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় শর্তে দুনিয়া উল্টে গেলেও সে রাজি হবেনা। নিরুপায় হয়ে তখন আজীজ শিকদার মেনে নেই। ছেলে তার হাসপাতালে থাকতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। অন্যথায় দেখা যেতো জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই বারণ-কারণ না মেনেই চলে যেতো হাসপাতাল ছেড়ে।
একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে ইতির মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর নাক টানার শব্দ হচ্ছে। রক্তিম বারবার বারন করা সত্বেও কান্না থামাচ্ছেনা দেখে এবার একটু বিরক্ত হয় সে। তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“আমি তো মরে যায়নি ইতু। এতো কান্না কেন করতে হচ্ছে? অসুস্থ হয়ে যাবি এবার।”
ভাইয়ের মুখে মরার কথা শুনে আৎকে ওঠে ইতি। কপট রাগ দেখিয়ে শাসনের স্বরে বলে,
“তুমি কখনো আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিবেনা ভাইয়া? সবসময় দুশ্চিন্তায় ফেলে রাখো। এখন আবার আজেবাজে কথা বলছো! এবার কিন্তু তোমার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে আমার।”
বোনের রাগ দেখে অল্প হাসে রক্তিম। বলে,
“ঠিক আছে। আর উল্টাপাল্টা কিছু বলবনা। তবুও এবার কান্না থামা। আমি এখন একদম ঠিক আছি। অনেক্ষন হয়ে গেছে এসেছিস। বাড়ি যা এবার। মা দুশ্চিন্তা করবে তোকে নিয়ে।”
মায়ের কথা স্বরণ হতেই আরও এক দলা বিষাদ এসে ইতির মনে ভীর করে। বুঝে পায়না সে তাদের মা এতো হারামি কিভাবে হলো? সন্তানের এমন মরন দশা শুনেও কোনো মা পারে বুকে পাথর বেঁধে ঘরে বসে থাকতে! অন্য কোনো মা না পারলেও তাদের মা পেরেছে। ইতি যখন গিয়েছিল রেহানা বেগমকে জিজ্ঞেস করতে হাসপাতালে আসবে কি না, তখন রেহানা বেগম অত্যন্ত শীতল কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল, “মরে গেলে খবর দিও। শেষ দেখা দেখে আসব।” মায়ের জবাবে বুক কেঁপেছিল ইতির। বিস্ফোরিত নয়নে টলমলে অশ্রু নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। খোঁজে পায়নি কিছু বলার ভাষা। সেই হৃদয়হীন, পাষাণ মায়ের কথা মনে পরতেই অভিমানে ফেঁপে ওঠে অষ্টাদশী ইতির মন জমিন।
“ঐ পাষাণ মহিলার কারো জন্য কোনো দুশ্চিন্তা হয়না। যাবনা আমি বাড়িতে এখন।”
বোনের অভিমানী কথায় আবারও একটু হাসে রক্তিম। তবে এবারের হাসিটা ছিল বেদনামিশ্রীত ক্লেশের হাসি। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কিছুটা উদাস চিত্তে জবাব দেয়,
“এভাবে বলতে নেই ইতু। মা তো মা’ই হয়। মা আবার কখনো পাষাণ হতে পারে না কি? ওনি আমাদের দশ মাস গর্ভে ধরে যে যন্ত্রণা সহ্য করে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন তার ঋণ এই তো আমরা দিতে পারবনা। পাষাণ কিভাবে বলি সেই মানুষটাকে? ওনি ওনার দিক থেকে একদম ঠিক। আমাকে নিয়ে অযথা ওনাকে কষ্ট দিস না। তুই ছাড়া বর্তমানে মা’কে দেখে রাখার কেউ নেই।সেই তুই এই যদি ওনাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলিস তাহলে যাবে কোথায় ওনি?”
উত্তরে কিছু বলেনা ইতি। শুধু নিরবে অশ্রু ঝরে যায় আবারও পল্লব বেয়ে। হাসপাতালে আরও কিছুটা সময় একান্তে ভাইয়ের সাথে কাটানোর পর ইতিকে মেহেদীর সাথে পাঠিয়ে দেয় রক্তিম বাড়ি যাবার জন্য। মন না চাইলেও ভাইয়ের বারণে আর থাকতে পারেনা ইতি। ইতিকে দেখার পর থেকেই একটু কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছিল মেহেদী। কিন্তু রক্তিমের ভয়ে তার ধারেকাছে যাবার সাহস টুকুও করতে পারেনি। শুধু দূর থেকেই ব্যকুল নয়নে অপলক দেখে গেছে প্রেয়সীকে। এবার বাড়ি পৌঁছে দেবার উছিলায় একান্তে ইতিকে একটু কাছে পাবার সুযোগ পেয়ে খুশিতে নেচে ওঠে মেহেদীর মন। প্রফোল্ল চিত্তে ইতিকে ঠিকঠাক পৌঁছে দিবে বাড়িতে এই বলে বন্ধুকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে দুজন। কারো মুখে কোনো রা নেই। মেহেদীর প্রেমিক হৃদয় ব্যকুল হয়ে যাচ্ছে প্রেয়সীকে কিছু বলতে। কিন্তু কি থেকে কি শুরু করবে ভেবে পায়না। অবশেষে ইতির কান্নার দরুন ফুলে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে এগিয়ে দেয় তার দিকে। একটু অবাক হয় ইতি। হাঁটা থামিয়ে চোখ তুলে তাকায় মেহেদীর দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,
“কি?”
একটু বিচলীত বোধ করে মেহেদী। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“চোখের পানি, নাকের পানি একাকার হয়ে মুখের দশা কি হয়েছে দেখেছো? লোকে দেখলে নির্ঘাত কোনো ভূত ভেবে ভয়ে স্টোক করে বসবে। রুমালটা দিয়ে মুখ মুছে নাও”
মেহেদীর কাঁচুমাচু মুখের পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইতি। তর্জনীর সাহায্যে নাক ঘষে দৃষ্টি ফিরিয়ে পূণরায় হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়,
“লাগবেনা। ধন্যবাদ।”
অসহায় নয়নে ইতির যাবার পানে তাকায় মেহেদী। পরপর নিজেও হেঁটে ইতির পাশাপাশি গিয়ে খপ করে ডান হাতটা নিজের বা হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আর হাঁটতে হবেনা। দাঁড়াও রিকশা ডেকে নিচ্ছি।”
“দুটো ডাকবেন।” ইতির কথা বুঝতে না পেরে জানতে চায় মেহেদী,
“হু!”
“রিকশা দুটো ঠিক করতে বলেছি।”
“কেন?”
“কারণ আপনার সাথে এক রিকশায় যাবনা আমি।”
কাটকাট স্বরে জবাব দেয় ইতি।হতাশ হয়ে মাথা নাড়ায় মেহেদী। ফুস করে দম ছেড়ে বলে,
“এক জিনিস নিয়ে কতদিন এভাবে রাগ করে থাকা যায়? তোমার কি মনে হচ্ছেনা এবার একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে!”
জবাব দেয়না ইতি। শক্ত মুখে শুধু তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। নিরুপায় হয়ে মেহেদী দুটো রিকশায় ঠিক করে। একটাতে ইতিকে উঠিয়ে দিয়ে অন্য রিকশায় নিজে ওঠে পিছু পিছু যায় ইতির।
শিকদার মঞ্জিলের সামনে রিকশা থামতেই পিছু না তাকিয়ে সোজা বাড়ির ভিতর চলে যায় ইতি। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে মলিন মুখে ভাড়া মিটিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরে মেহেদী। তখনই শুনতে পায় পিছন থেকে ইতির কন্ঠ,
“এই সামরিক বিচ্ছেদ এখন সইতে পারছেন না। তবে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ কিভাবে সহ্য করবেন?”
প্রশ্ন শুনে পিছনে ঘুরে তাকায় মেহেদী। চোখে ভাসে ইতির অশ্রুসিক্ত নয়ন। কাঁপন ধরে বুকে। অবাক হয় মেহেদী। আশ্চর্য তো! কতক্ষণ আগেই তো এই মেয়েটার চোখে ভাইয়ের জন্য অশ্রু দেখল। কই, তখন তো এভাবে মেহেদীর বুকে কাঁপন ধরেনি প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে। তবে এখন কেন এমন হচ্ছে? ঐ সু-নয়নার গভীর দুই চোখে এখনকার অশ্রুটুকু তাকে ঘিরে বলেই কি এমনটা হচ্ছে? হবে হয়তো এমন কিছু একটাই। মেহেদীকে ভাবনার সাগরে বুদ হয়ে থাকতে দেখে আবারও বলতে শুরু করে ইতি,
“আমার ভাই আমার বাবা কেমন মানুষ, আমাকে নিয়ে তাদের কেমন চিন্তা সেটা নিশ্চয়ই তুমি খুব ভালো করেই জানো। ওরা কোনোদিন তোমাকে মেনে নিবেনা। এখন হয়তো বলতে পারো আমার ভাই তো তোমার থেকেও দুই ধাপ এগিয়ে। তার সাথে থেকেই তুমি এমন হয়েছো। তবে কেন মেনে নিবেনা!উত্তরটা আমিই বলে দিচ্ছি। তোমার যে একটা ছোট বোন আছে তুমি কখনো চাইবে সেই বোনটাকে তোমার মতো কোনো এক বাউন্ডুলে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে? নিশ্চয়ই চাইবেনা। ভাইয়েরা নিজেরা হাজার খারাপ হলেও বোনের জন্য সবসময় বেস্ট কাওকেই খোঁজে। যাতে তার বোনটা সমাজের চোখে মাথা উচু করে বাঁচতে পারে। কোনো দুঃখ, কষ্ট যেন বোনকে এসে ছুঁয়ে যেতে না পারে। আমার ভাইও তেমনটাই চাইবে। আর বাবা! তার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই সহজ সত্যি গুলো আমি জানি তুমিও জানো। কেউ কখনো মানবেনা আমাদের এই অসম সম্পর্ক। তবে কেন শুধু শুধু মায়ার গভীরে তলিয়ে গিয়ে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটা আরও গাঢ় করব? তার থেকে এটাই ভালো হবেনা এখন থেকেই একটু একটু দূরে সরে গিয়ে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটা সইয়ে নেওয়া!”
এক জায়গায় জড় বস্তুর মতো ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে মেহেদী। বলার মতো কিছুই খোঁজে পায়না। ছলছল নয়নে ইতি কিছুক্ষণ মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব না পেয়ে এক ছুটে চলে যায় বাড়ির ভিতর। ঠিক তখনই অনুভব হয় মেহেদীর বুকের ভিতরে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। আস্তে করে ডান হাতটা বুকের কাছে নিয়ে চেপে ধরে। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে বিরবির করে উচ্চারণ করে,
“তোমার সাথে বিচ্ছেদের আগে মরন হোক আমার। ঐ বিচ্ছেদের হৃদয়পোড়া যন্ত্রণার থেকে বোধ করি মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ হবে আমার জন্য।”
****
পনেরো দিনের মাথায় পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে নিজের ঠিকানায় ফিরে এসেছে রক্তিম শিকদার তার সেই চিলেকোঠার মতো ছোট্ট রুমটাতে। কেটে যায় আরও কিছু সময়। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। জনগণের দোরগোড়ায় খবর পৌঁছে গেছে মেয়র আজীজ শিকদার এবার এমপি পদে নির্বাচন করবেন। শহরের আনাচে কানাচে প্রতিটা চায়ের স্টল, মোদি দোকান সব জায়গায় গরম গরম চায়ের কাপ হাতে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে তরুণ যুবক দলের মুখেও নির্বাচনী সমাচার। টানটান উত্তেজনা ছড়িয়ে পরেছে এখনই সবার মাঝে। আজীজ শিকদারকে এমপি হিসেবে পাশে পাবে খবরটাই জনগণ যতটা খুশি তার থেকেও দ্বিগুণ উত্তেজিত এটা ভেবে লিয়াকত বিল্লার সাথে টক্কর দিয়ে আদও আজীজ শিকদার জিততে পারবে কি না। এই উছিলায় আবার না শান্তিপূর্ণ সাভারের রাজপথে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। লিয়াকত বিল্লা কেমন কুটিল মনস্কের মানুষ এটা এলাকাবাসী কম বেশি সকলেই জানেন। সব জেনেও চুপ থাকে শুধু ক্ষমতার দাপটে কেউ পেরে উঠবেনা বলে। তবে এবার যেহেতু রক্তিম শিকদার নিজে তৎপর হয়ে লিয়াকত বিল্লার বিরুদ্ধে নিজের বাবাকে নির্বাচনে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই ভিত্তিতে মনের কোণে অল্প হলেও আশার আলো জ্বলছে সকলের। এবার শুধু অপেক্ষা লিয়াকত বিল্লার পতন দেখার।
****
সেদিন রক্তিমের এতো বড় একটা দুর্ঘটনার খবর শোনার পর চাইলেও ছুটে যেতে পারেনি দৃষ্টি রক্তিমের কাছে। শুধু গুমরে মরেছে সর্বক্ষণ রক্তিমের চিন্তায়। আবেগী মন লুকিয়ে লুকিয়ে কত রাত যে নির্ঘুম কেঁদে কাটিয়েছে সেই হিসেব হয়তো বেখায়ালী দৃষ্টির’ও অজানা। তার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস নিরব বাতাসকে জানিয়ে দিতো রক্তিমের জন্য কতটা হাহাকার তার বক্ষমাঝে। নিজের মনের উচাটন পরিবারের চোখে ফাঁকি দিয়ে সামলেছে দৃষ্টি নিজেই। অবচেতন মন তার বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানিয়েছে, খুব দ্রুত শেষ হোক এই আগুনের দিন। এক পশলা প্রশান্তি নিয়ে ঝুম বৃষ্টি নামুক তার শহরে অতি সত্তর।
দৃষ্টির সেই আর্জি শুনেছে বিধাতা মাস তিনেক পর। মানসিকতা, আধ্যাত্মিক অশান্তি সঙ্গে নিয়ে কোনোমতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দৃষ্টি। এরপরই মরিয়া হয়ে ওঠেছে আবারও খালার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য। মেয়ের এমন বেড়াতে যাবার জন্য ব্যাকুলতা দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছেন সাদেক সাহেব, দিলশান আরা দুজনেই। যখন দেখল মেয়ের সাথে ছেলেটাও পাগল হয়ে আছে খালার বাড়ি বেড়াতে যাবার জন্য তখন নিরুপায় হয়ে সাদেক সাহেব কাজের এক ফাঁকে ছেলে-মেয়ে দুটোকে দিয়ে আসেন ঢাকায়। তাদের গাড়িটা সাভার ঢোকার সাথে সাথেই দৃষ্টির ব্যকুল নয়ন জোড়া জানালার কাচ গলিয়ে রাস্তার আনাচে-কানাচে খোঁজে গেছে রক্তিমের গম্ভীর্যতায় ঘেরা কঠোর মুখটা। কিন্তু পায়নি কোথাও। খালার বাসায় পৌঁছনোর পরও এক জায়গার স্থির হতে পারেনি দৃষ্টি। ধুপপুক মনে শুধু খোঁজে গেছে বাইরে যাবার সুযোগ। তার এই অস্থিরতা বাইরে থেকে কেউ দেখে লক্ষ্য করতে না পারলেও ঠিক তুসী লক্ষ্য করে। কারণ দৃষ্টির এমন ব্যকুল হয়ে ঢাকায় ছুটে আসার কারণ সবার কাছে অস্পষ্ট থাকলেও তুসীর কাছে তা একদম জলের মতো পরিষ্কার। একমাত্র রক্তিম শিকদারকে একটা নজর দেখার জন্যই দৃষ্টির এতো দূর ছুটে আসা সেটা অজানা নই তুসীর। তবুও অবাক হয় তুসী। মেনে নিতে পারেনা চোখের দেখায় পরিচিত এক গুন্ডা মাস্তানের জন্য দৃষ্টির এমন অস্থিরতা। তবে কি সত্যিই ভালোবাসা মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়! তুসীর চোখে তো এই মুহূর্তে দৃষ্টিকে একদম নিঃস্বই মনে হচ্ছে। যেন নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে একদম সর্বহারা পথিক দৃষ্টি।
ছেলে-মেয়েকে খালার বাসায় পৌঁছে দিয়ে খুব বেশিক্ষন থাকেনি সাদেক সাহেব। ব্যবসার কাজে তাড়া দেখিয়ে ভাই-বোন দুজনকে সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে পরে আবার ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে। বাবা বিদায় নিতেই দৃষ্টি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে। নিজেকে স্থবির করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুই থাক বাসায়। আমি তুসুকে নিয়ে আমাদের এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে আসি। সেও ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। জানা দরকার তার পরীক্ষা কেমন হয়েছে। কাল তোকে নিয়ে আবার ঘুরতে যাব কেমন!”
বোনের জবাবে দিহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই দৃষ্টি তুসীর হাত ধরে এক প্রকার টেনে নিয়ে বেরিয়ে পরে বাসা থেকে। পিছন থেকে শিউলী বেগম হা হুতাশ করেন এতোদূর জার্নি করে এসে একটুও বিশ্রাম না নিয়ে এভাবে বেরিয়ে যাওয়ায়।
প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ অলিতে-গলিতে খোঁজ করেও রক্তিমের সন্ধান পায়না দৃষ্টি। হাঁটতে হাঁটতে হাপিয়ে গেছে তুসী। কিন্তু দৃষ্টির মাঝে ক্লান্তের লেশমাত্র নেই। সে এখনো একমনে রক্তিমকে খোজায় বিভোর। দৃষ্টির হাত টেনে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে বুক ভরে দম ছাড়ে তুসী। হাপাতে হাপাতে বলে,
“আর কতক্ষণ এভাবে খুঁজবি? ওনি হয়তো কোনো কাজে অন্য কোথাও গেছে। এভাবে পুরো দিন খোঁজেও লাভ নেই। চল বাড়ি ফিরে যায়।”
তৎক্ষণাৎ তুসীর কথার বিরোধীতা করে ওঠে দৃষ্টি। অটুট স্বরে বলে,
“না। ওনি এখানেই আছে। খোঁজে বের করবই আমি ওনাকে।”
বিরক্ত হয় তুসী। মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গিয় উচ্চারণ করে বলে,
“আরে ভাই আমার কথাটা বিশ্বাস কর তুই। তোকে তো আমি ওনাকে খুঁজতে নিষেধ করছিনা। সামনে নির্বাচন। ওনার বাবা এমপি পদে দাঁড়াবে। সেই নির্বাচনের প্রচারণার জন্যই হয়তো অন্য কোথাও গেছে।”
ক্ষীণ আশার আলোয় জ্বলজ্বল করা হৃদয় ঝুপ করে আধার নেমে আসে দৃষ্টির। তমসাচ্ছন্ন মুখটা নিচু করে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার এতো ব্যকুলতা, এতো অস্থিরচিত্তে এই এতো দূর এসে লাভ কি হলো? নিষ্ঠুর পুরুষটার দেখায় পেলনা। কে জানে কোথায় গিয়ে ঘাপটি মেরে আছে ঐ পাষাণ হৃদয়ের মানুষটা। হাতাশায় জর্জরিত হয়ে কান্না পায় দৃষ্টির। দু-চোখের কার্নিশ বেয়ে হয়তো দুই-এক ফোটা অশ্রুও গড়িয়ে পরে। আরও একবার প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধাঙ্গুলীর সাহায্যে চোখের জলটুকু মুছে নেয় দৃষ্টি। ক্ষীণ স্বরে তুসীকে বলে,
“চল।” দুই-তিন কদম হাঁটতেই হঠাৎ কানে আসে কেউ একজন ভাই বলে কাওকে ডেকে ওঠেছে। তৎক্ষণাৎ পা জোড়া থেমে যায় দৃষ্টির। অস্থিরচিত্তে ফিরে তাকায় ঐ ডাকের উৎস ধরে। ঠিক তখনই চোখে কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটা। সাথে সাথেই ভারী হয়ে আসে দৃষ্টির নিঃশ্বাস, চঞ্চলতা বাড়ে চোখে-মুখে। সেই সাথে বাড়ে হৃদয়ে চলা ধিমি আওয়াজ। তাদের থেকে কিছুটা দূরেই একটা চায়ের দোকানের সামনে বাইক থেকে নামছে রক্তিম। উষ্কখুষ্ক চুল তার এলোমেলো। চোখে-মুখে লেপ্টে আছে রাজ্যের ক্লান্তি। বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই জাবির এক কাপ চা এগিয়ে দিয়েছে রক্তিমের দিকে। সিগারেটে পুড়া ঠোঁট দুটো চায়ের কাপে ডুবিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টায় রক্তিম। ঠিক তার থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে যে তার প্রেমে মত্ত এক ব্যকুল হৃদয়ের অষ্টাদশী কন্যা তাকে দেখে চোখের তৃষ্ণা নিবারণে মত্ত সেটা কি জানে রক্তিম! মানুষটা আগের থেকে একটু শুকিয়ে গেছে বুঝি! হ্যাঁ, দৃষ্টির চোখে তো তাই মনে হচ্ছে। গভীর নয়নে খুটিয়ে খুটিয়ে নিখুঁত ভাবে রক্তিমের একদম পা থেকে মাথা পযর্ন্ত পরোখ করে নেয় দৃষ্টি। সেই সাথে খেয়াল করে তার হৃৎপিন্ডের ধুকপুক শব্দটা বেড়েই যাচ্ছে। মেসামাল হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস। কেমন করে কাঁপন ধরছে হৃদয়ে। মুখ হা করে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দৃষ্টি রক্তিমের দিকে। কাছ থেকে দেখে পূণরায় লক্ষ্য করে রক্তিমের বিস্তর পরিবর্তন। ক্লান্তির ছাপটা চোখে-মুখে স্পষ্ঠ রক্তিমের। বাতাসের দাপটে রক্তকিমের এলোমেলো চুল গুলো কপালের ডান পাশেম থেকে উড়ে যেতেই চোখে বিঁধে লম্বা একটা কাঁটা দাগ। এটা বুঝি সেই দুর্ঘটনার সময় হয়েছে ! কেমন তাজা হয়ে আছে দাগটা এখনো। মন্থর গতিতে দু-পা এগিয়ে যায় দৃষ্টি। নিজের খেয়াল ভুলে চিন্তা চেতনার উর্দ্ধে গিয়ে একদম মুখোমুখি দাঁড়ায়। দলের ছেলেদের সাথে কথায় মশগুল রক্তিম নিজের সামনে কাওকে দাঁড়াতে দেখে একটু থামে। দেখতে পায় এক রমনী দৃষ্টিতে কিছু একটা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছেনা রক্তিম। তার এই ভাবনার মাঝেই অবিশ্বাস্য এক কান্ড ঘটিয়ে দেয় দৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় রক্তিমের কপালের সেই কাটা জায়গা টুকু। সাথে সাথে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠের মতো চমকে দু কদম পিছিয়ে যায় রক্তিম। বিস্ফোরিত নয়নে রক্তিম সহ উপস্থিত সকলেই তাকায় রক্তিমের দিকে।
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৯
#আদওয়া_ইবশার
জানা নেই চেনা নেই এমন একটা মেয়ে এসে হুট করে রক্তিম শিকদারের কপাল ছুঁয়ে দিল বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে সকলের। অত্যাধিক বিস্ময়ে যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ।
“কি চাই?”
কয়েক মুহূর্তের নিরবতা টুকু চূর্ণবিচূর্ণ করে জলদগম্ভীর কন্ঠে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে রক্তিম। ঠিক তখনই যেন চৈতন্যের উন্মেষ ঘটে দৃষ্টির। বুঝতে পারে অজানা এক ঘোরের মধ্যে থেকে কেমন বোকামিটা করেছে। সহসা লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে। কয়েক পল সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা তুলে তাকায় আবার। স্বভাবে চঞ্চলতা এনে জড়তা কাটিয়ে বলে,
“নিশ্চয়ই চিনতে পারেন নি আমাকে! আচ্ছা অসুবিধা নেই। আমিই চিনিয়ে দিচ্ছি।মনে আছে তিন-চার মাস আগে আপনার কাছে এসেছিলাম একটা ছেলে আমাকে বিরক্ত করে সেই বিচার নিয়ে!”
“তা মনে থাকবেনা আবার! ভাইয়ের মনে না থাকলেও আমাদের খুব ভালো করেই মনে আছে তোমাকে।যে হারে বিনা দোষে অপমান করেছো মেয়ে তা এ জন্মে ভোলার নই”
রাকিবের কথায় চোখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় দৃষ্টি। মিটিমিটি হেসে বলে,
“এই না হলে রক্তিম শিকদারের চমচা! আপনাদের কাজই তো হলো রক্তিম শিকদার ঘটিত খুটিনাটি সব কিছু নখদর্পণে রাখা। আপনার কাজে আমি খুবই আপ্লুত মিস্টার চামচা।”
আবার! আবারও এই মেয়ে সয়ং রক্তিম শিকদারের সামনে তার ছেলেদের অপমান করে যাচ্ছে! তাও যে সে অপমান না। একেবারে সরাসরি চামচা পদবিতে অপমান। অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে আছে রাকিবের। মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দলের অন্য ছেলে গুলোকেও তার অপমানে মিটমিট হাসতে দেখে ফুঁসে ওঠে রাকিব। ঔদ্ধত্য হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই হাত টেনে আটকে দেয় মেহেদী। মজার ছলে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তা এতোদিন পর কিজন্যে এসেছো? মাঝে যে বিরাট একটা সময় পেরিয়ে গেল সেই সময় টুকুতে তো আমার মনে হয় ঐ ছেলেটার সাথে তোমার ভাব-ভালোবাসা হয়ে একেবারে বিয়ের পিরিতে বসে যাবার কথা।”
মাথাটা অল্প কাত করে লাজুক হাসে দৃষ্টি। রক্তিমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
“আপনার মুখে ফুল চন্দন পরোক ভাইয়া। যদি এমন হতো তবে আমার থেকে খুশি বোধহয় আর কেউ হতনা।”
“তারমানে একপাক্ষিক ভাব-ভালোবাসা হয়ে গেছে! তাহলে আবার রক্তিম শিকদারের কাছে কেন এসেছো?”
ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায় মেহেদী। এবার একটু তমসা দেখা দেয় দৃষ্টির মুখের আদলে। অভিযোগের স্বরে বলে,
“হোক ভাব-ভালোবাসা। তাই বলে কি ভুলে যাব ঐ লোকটা আমাকে কি পরিমাণ জ্বালিয়েছে? অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করতে নেই তাইনা ভা-ই-য়া!”
শেষের কথাটুকু রক্তিমের দিকে তাকিয়ে টেনে টেনে বলে দৃষ্টি।এবার যেন রাকিব একটু সুযোগ পেল দৃষ্টিকে নাস্তানাবুদ করার। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠল,
“ইভটিজারের উপর ক্রাশ খাইয়া তলে তলে টেম্পু চালাও আবার ভাইয়ের কাছে আসো বিচার চাইতে? দুই মুখো সাপ তো কয় এই তোমার মতো মাইয়া গুলারেই। আমি বুঝিনা বা’ল ক্যান যে বিজ্ঞানীরা তোমাদের মতো ইচ্ছাধারী রেখে অবলা প্রাণীদের দুই-মুখো সাপ বলে চিহ্নিত করল!”
আবার এই দুটোতে সেই প্রথম দিনের মতো ঝগড়া বেঁধে যাবে বুঝতে পেরে রাকিবকে ঝাড়ি দিয়ে থামিয়ে দেয় মেহেদী। সেই প্রথম দিনের মতো আজও রক্তিম নির্বিকার। চা শেষ করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। রক্তিমের হয়ে মেহেদী’ই জানতে চায়,
“আচ্ছা বলো। তা কি শাস্তি চাও সেই ছেলের? আর কে সে? এবার নাম-ঠিকানা জেনে এসেছো তো?”
“শুধু নাম-ঠিকানা নই। একদম হালচাল সবই জেনে এসেছি। তার থেকেও বড় কথা সে এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনেই আছে।”
স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয় দৃষ্টি। তার এহেন কথায় আবারও অবাক হয় প্রত্যেকে। এখানেই আছে মেয়েটার সামনে! কই এখানে তো তারা ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে কি তাদের মাঝেই কেউ সেই ছেলে! হতবম্ভ হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে প্রত্যেকে। রক্তিম ও এক নজর নিজের ছেলেদের দিকে তাকায়। সে নারী বিদ্বেষী হলেও তার দলের একটারও যে চরিত্র ঠিকঠাক নেই তা খুব ভালো করেই জানে রক্তিম। এজন্যই মেয়েটার কথা একদম ফেলে দেওয়া যায়না। এই ভেজাল দ্রুত দূর করতে শেষমেশ রক্তিম নিজেই মুখ খুলে,
“কে সেই ছেলে?”
হাত উচিয়ে রক্তিমের দিকে তাক করে দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ যেন ছোটখাট একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায় সেখানে। নিরুদ্যম প্রতিটা দৃষ্টি এসে স্থির হয় রক্তিমের দিকে। সেই সাথে রক্তিম নিজেও চমকায়। হাতে থাকা সিগারেট ঠোঁটের কাছে নিতে গিয়েও থেমে যায়। সেসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনা দৃষ্টি। নিজ মনে বলতে থাকে,
“এই লোকটাই আমাকে গত তিনটা মাস যাবৎ বিরক্ত করে যাচ্ছে। আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সবটুকু শান্তি কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন থেকে। রাতের পর রাত শেষ হয়ে যায় এই লোকের চিন্তা আমাকে ঘুমাতে দেয়না। খেতে গেলে গলা দিয়ে খাবার নামেনা। পড়তে বসলে বইয়ের পাতায় তার ছবি ভেসে ওঠে। আমাকে এতো এতো অশান্তির মাঝে ডুবিয়ে রেখে সে ঠিকই নিশ্চিন্তে গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছে। আমার প্রতি এতো বড় অন্যায় করে কি ওনি পাড় পেয়ে যাবে? আমি এর বিচার চাই। কঠোর বিচার চাই।”
এতো বড় চমক! এতো বড় ভেলকি বাপ জীবনেও দেখেনি কেউ। মাথাটা কেমন ভনভন করে ঘুরছে। নেশা না করেও মনে হচ্ছে নেশা ধরে গেছে প্রত্যেকের
আবারও বলতে শুরু করে দৃষ্টি,
“প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞা আমি জানিনা। তাই ঠিকমতো বলতেও পারছিনা আপনার প্রতি আমার এই অদ্ভুত অনুভূতির আসল নামটা কি। যেটা বলতে পারব বা বলতে চাই সেটা হলো আমার আপনাকে প্রয়োজন। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আপনাকে আমার প্রয়োজন। এলাকার সবার কাছে গুন্ডা হিসেবে পরিচিত এই আপনিটা সময়ের সাথে সাথে আমাকে একদম নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। আমার জীবনটা খুব বাজে ভাবে আপনি কেন্দ্রিক হয়ে ওঠেছে। আমি নিরুপায়। একদম অসহায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি। মনের ভিতর চলা অশান্ত ঝড়টুকু এলোমেলো শব্দে আপনার কাছে ব্যক্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছি। কিন্তু সেটাও পারছিনা। ঠিক কিভাবে কোন শব্দে বললে আপনি আমাকে বুঝবেন তা ভাবতে ভাবতেই মাথার ভিতর সব জট পেকে গেছে। আপনি কি আমার এই এলোমেলো শব্দ গুলোর মাঝে কোথাও আপনার প্রতি আমার হৃদয়ে তৈরি হওনা প্রগাঢ় অনুভূতিটুকু খোঁজে পাচ্ছেন না? যদি পেয়ে থাকেন তবে আমার হাতটা ধরুন। আপনার উষ্ণ স্পর্শে একটু বাঁচার কারণ খোঁজে নিতে দিন আমাকে। বিনিময়ে আজীবন এই ছন্নছাড়া আমিটা আমার ভিতরে জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিব আপনাকে। একবার শুধু আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরুন! কথা দিচ্ছি কখনো এই হাত ছাড়তে পারবেন না। আমি ছাড়তে দিবনা। শেষ নিঃশ্বাস পযর্ন্ত সবটুকু শক্তি দিয়ে আকড়ে ধরব আপনাকে।”
পূর্ণ দৃষ্টিতে রক্তিমের চোখের দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে দৃষ্টি। ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরে রক্তিমের দিকে বুক ভরা আশা নিয়ে। চোখে তার আকুতি। রক্তিম স্থির থাকতে পারেনা আর। দৃষ্টির হৃদয় নিংড়ানো আকুল আবেদন আর অনুভূতিতে ঠাসা চোখের চাহনি কিছুই রক্তিমকে এলোমেলো করতে পারেনা। এই সব কিছু ছাপিয়ে শক্ত, পাষাণ হৃদয়ের মানুষটাকে এলোমেলো করে দেয় এক বিবর্ণ অতীত। দৃষ্টির প্রতিটা কথার তালে রক্তিমের চোখের তারাই স্পষ্ঠ হয়ে ভাসে অতীতের টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি। হাঁসফাঁস লাগে রক্তিমের। হৃদয়ে জ্বালা ধরে। সাথে জ্বলে ওঠে চোখ দুটো। থরথর করে কেঁপে ওঠে পুরুষালী শরীরটা। একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে বুঝতে পারে তা। সহসা চোখ দুটো বন্ধ করে সর্ব শক্তি দিয়ে মুঠো করে নেয় হাত দুটো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় ঘনঘন। সে চায়না। কিছুতেই চায়না ঐ সর্বনাশা অতীত আবার সামনে আসুক। নতুন করে আবার শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত তাজা হোক। মুঠো করে রাখা হাত দুটো দিয়ে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে। পাগলের মতো আশেপাশে তাকায়। রক্তিমের এমন অস্থিরতা ভয় ধরিয়ে দেয় দৃষ্টির মনে। সাথে উপস্থিত রক্তিমের ছেলে গুলোও আৎকে ওঠে। সর্বদা শান্ত মাথায় সব কিছু হেন্ডেল করা রক্তিম শিকদার একবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খ্যাপা রক্তিমে পরিণত হলে কতটা দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে তা একমাত্র দৃষ্টি ছাড়া উপস্থিত কারো অজানা নই। অবুঝ দৃষ্টি বুঝতে পারেনা রক্তিমের হঠাৎ এমন আচরণের কারণ। কিছুটা ভয় পেলেও সেই একইভাবে হাতটা বাড়িয়ে রাখে রক্তিমের দিকে। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে মেহেদী। মনের মাঝে অল্প সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। সংকোচ নিয়েই হাত রাখে অশান্ত রক্তিমের কাঁধে। সহসা হিংস্র চোখে পিছু ফিরে তাকায় রক্তিম। কিছুটা ভয় পেয়ে কাধ থেকে হাত নামিয়ে পিছু হটে যায় মেহেদী। আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রক্তিম। জোড়ে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নেয় জ্বিভের ডগায়। এতোক্ষন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা চোখ দুটো নিমিষে একদম স্বাভাবিক, শীতল করে ফিরে তাকায় দৃষ্টির দিকে। সরাসরি রক্তিমের নজর তার দিকে পরায় একটু কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। এলোমেলো হয় ভিতরে ভিতরে। বা-হাতে পরনের জামা খামচে ধরে সামলে নেয় নিজেকে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে অটল হয়ে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের শীতল চোখে। তার এমন সাহসে অভিভূত হয় রক্তিম। চরম ভাবে আশ্চর্য হয়ে ভাবে, তার চোখে চোখ রাখার মতো এতো সাহস এই মেয়ে পেল কোথায়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেনা মুখে। ভয়ংকর শীতল কন্ঠে জানতে চায়,
“বাড়ি কোথায়?”
উত্তর দিতে গিয়ে একটু টালমাটাল হয় দৃষ্টি। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বলে,
“ময়মনসিংহ।”
“এখানে কি?”
“খালার বাসা।”
এবার যেন সবটা সচ্ছ জলের মতোই পরিস্কার হয়ে যায় রক্তিমের কাছে। বিদ্রুপাত্বক হেসে ভাবে, মেয়ে তাহলে কিছুই জানেনা তার সম্পর্কে, তার অতীত সম্পর্কে। জানলে নিশ্চয়ই আগুনের সামনে এসে বলতনা “আমাকে পুড়াও।” ঘাড় নাড়িয়ে ঠোঁট গোল করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিম বলে,
“আমার এলাকার অতিথির অসম্মান হোক তা আমি চাইনা। বেড়ানো শেষে চুপচাপ লক্ষি মেয়ের মতো বাবা-মায়ের কোলে ফিরে যাবে।”
হিমশীতল কন্ঠে ঠান্ডা হুমকি ছুড়ে বাইকে ওঠে বসে রক্তিম। যেই স্টার্ট দিয়ে এখান থেকে যেতে নিবে ঠিক তখনই শুনতে পায় দৃষ্টির অবিচল কন্ঠ,
“আর যদি না যায় কি করবেন তবে?”
এতোক্ষনের ধরে রাখা মেজাজটা আর ঠিক রাখতে পারেনা রক্তিম। তড়িৎ বাইক থেকে নেমে কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই গলা চেপে ধরে দৃষ্টির। দূর থেকে তা দেখে আৎকে ঔঠে তুসী। ফুপিয়ে ওঠে মুখে হাত দিয়ে। বলশালী হাতের বাঁধনে কন্ঠনালী চেপে আসে দৃষ্টির। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় আকম্মিক আক্রমণে। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আশ্লেষে ফেটে পরে রক্তিম। হুঙ্কার ছুড়ে বলে,
“খুন করে ফেলব একদম। দুটো খুনের রেকর্ড অলরেডি হয়ে আছে। এবার না হয় তিন নাম্বারটাও হয়ে যাবে। জানের মায়া থাকলে আর কখনো আমার সামনে আসবেনা।”
কথাটা শেষ করে এক প্রকার ছুড়ে ফেলে রক্তিম দৃষ্টিতে। গলায় রক্তিমের জানামতে খুব শক্ত করে না ধরলেও দৃষ্টির নাজুক শরীর ঐটুকু আঘাতই নিতে পারেনা। কাশির সাথে চোখ গড়িয়ে পানি পরে অনর্গল। শখের পুরুষের থেকে ভালোবাসার বদলে এমন আঘাত উপহার পাবে কল্পনায় ছিলনা তার। জ্বালা ধরে অন্তঃকরণে। তবুও হাসে দৃষ্টি। হাসি-কান্নার সংমিশ্রণে বলে,
“মারুন। ভালোই হবে আমার। ধুকে ধুকে মরার থেকে না হয় আপনার হাতে একেবারেই মরলাম। এই উছিলায় হলেও তো আপনার একটু স্পর্শ পাব। ভালোবাসার মানুষের হাতে মৃত্যু সবার ভাগ্যে জুটেনা। আমি না হয় হলাম সেই ভাগ্যবতী। যার মরন অস্ত্র হবে ভালোবাসা।”
চলবে….