#দৃষ্টির_আলাপন
#অন্তিম_পর্ব
#আদওয়া_ইবশার
সুখের দিন গুলো অতি দ্রুত কেটে যায়।মনে হয় মিনিট পাড় হয় সেকেন্ডের গতিতে। দিন পাড় হয় ঘন্টার গতিতে। আফসোস হয়,সুখ সুখ স্বপ্নীল মুহূর্ত গুলো আর একটু দীর্ঘ হলো না কেন?আর দুঃখের দিন গুলো হয় সুদীর্ঘ। এক একটা সেকেন্ড ও যেন মনে হয় পুরো একটা দিনের সমান। যদিও এটা আমাদের মনের ধারণা।বাস্তবিক অর্থে প্রতিটা দিনই সমান। কিন্তু সুখ-দুঃখের দিনের দীর্ঘতায় বিস্তর তফাৎ অনুভূত হয় আমাদের লোভী মানব মনের কারণে। মন যে সর্বদা সুখ সন্ধানী!তার অল্প সুখে হয়না। পেয়েও আরো পেতে চায়। আর না পাওয়ায় তো আফসোসের কোনো অন্তই থাকেনা। আশা ভঙ্গের যন্ত্রণায় দীর্ঘ মনে হয় দিবস-রজনী। ঠিক এমন কিছু মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার কারণেই সুখের সময় মনে হয় দ্রুত শেষ হয়ে যায় আর দুঃখের সময় দীর্ঘ।
স্বপ্নময় তিনটা দিন কুয়াকাটায় কাটিয়ে ব্যস্ত নগরীতে ফিরে এসে আবারও যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। দিন যায় পূর্বের রুটিনে। সুখ-দুঃখের রঙিন দোলনায় দোলে দোলে বিদায় নেয় দিন,মাস। স্মৃতির পাতায় যুক্ত হয় সাগর কন্যার তীরে কাটানো স্বর্ণালী সেই দিন গুলো। অলস- বিষন্ন বিকেলের অবসর সময়ে এক কাপ চা হাতে জানালার পাটাতনে বসে দৃষ্টি ডুব দেয় সেই স্মৃতির মাঝে। ইচ্ছে হয় টাইম ট্রাভেলে চরে আবারও চলে যাক সেই সুখময় অতীতের তিনটা দিনে। যে তিনটা দিন ছিল শুধুই রক্তিম-দৃষ্টির। নব নির্বাচিত পাষাণ এমপি সাহেবের ছিলনা কোনো ব্যস্ততা, ছিলনা ভালোবাসা প্রকাশে লুকোচুরি,কপটতা। কিছু স্নিগ্ধ,শীতল অনুভূতিতে দুজনারই মন ছিল ভরপুর।
নিস্তেজ বিকেলের মায়াময় সৌন্দর্যে বিভোর দৃষ্টির ঘোর কাটে ইতির ডাকে,
“ভাবি! তুমি এই সময় এভাবে মন ম’রা হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? জানোনা তোমার মন খারাপ হলে আমাদের পুচকেটারও মন খারাপ হবে!”
ছোট ননদের কথায় স্মিত হাসে দৃষ্টি। বাইরের থেকে নজর সরিয়ে হাত রাখে পেটে। সেদিকে তাকিয়েই বোকার মতো প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা আপু! এই ছোট পেটে ও কিভাবে থাকছে? কষ্ট হচ্ছেনা বুঝি! তোমার সময় তো দেখেছিলাম তোমার পেট কত উঁচু হয়েছিল। কিন্তু আমার দেখো। এখনো পেট-পিঠ এক জায়গায় হয়ে আছে।”
হু হু করে হেসে ওঠে ইতি। এগিয়ে এসে দৃষ্টির গালে হাত ছুঁয়ে বলে,
“এতো অধৈর্য হচ্ছো কেন? একটু সবুর করো। সবে তো দেড় মাস পরলো। আর এক-দুই মাস যাক। তখন দেখবে পেট ফুলে একদম ফুটবল হয়ে গেছে।”
আজ দুদিন হলো দৃষ্টি জানতে পেরেছে তার মাঝে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একটা প্রাণ। তাদের ভালোবাসার সেতু বন্ধন দৃঢ় করতে খুব শিগ্রই কোল জুড়ে আসবে পবিত্র সেই প্রাণ। খবরটা জানাজানি হবার পর শিকদার মঞ্জিলে যেন আবারও ছড়িয়ে পরে খুশির আমেজ। সুখের সামিয়ানায় ডেকে যায় সমস্ত অতীত বিষাদ। দৃষ্টি নতুন করে আবিষ্কার করে এক পাগল রক্তিমের। যার মাঝে হঠাৎ বাবা হবার খবর শুনেই ভর করেছে অদ্ভূত বাচ্চামো স্বভাব। কাজ পাগল যে রক্তিম দিন-রাত বেমালুম ভুলে পরে থাকতো বাইরে, সেই রক্তিমকে এখন দৃষ্টি ঠেলেও বাইরে পাঠাতে পারেনা।ভোটে জেতার পর থেকে তার মাঝে জনসেবার যে টানটান উত্তেজনা টুকু ছিল, সেটা যেন মলিন হয়ে গেছে বাবা হবার আনন্দের কাছে। ইচ্ছে করে সমস্ত দায়বদ্ধতা এড়িয়ে সারাদিন অপলক বসে দেখুক তার সন্তান কিভাবে ঐটুকু একটা মেয়ের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠে। রক্তিমের এমন বাচ্চামো স্বভাব দেখে ক্ষণেক্ষণে অবাক হয় দৃষ্টি। অঘাত বিস্ময় নিয়ে দেখে যায় আমূল পরিবর্তন হওয়া মানুষটাকে। আজকেও সকাল থেকে পার্টি অফিস থেকে দলীয় কাজের জন্য একের পর এক বার্তা আসছিল। কিন্তু রক্তিমের মাঝে কোনো ভাবাবেগ ছিলনা। একের পর এক ফোনকলে টিকতে না পেরে অবশেষে কতক্ষণ আগে রাজ্যের বিরক্তি আর দ্বিধা নিয়ে বাড়ি ছাড়ে। যাবার সময় বারবার করে বলে যায়, কোনোরকম খারাপ লাগলেই যেন দৃষ্টি সাথে সাথে তাকে ফোন করে। তার এমন উচাটন দশা দেখে মুখ টিপে অগোচরে হাসে দৃষ্টি। সম্মতি জানিয়ে বিদায় দেয় তাকে। রক্তিমের কথা স্বরণ হতেই আবারও আনমনে হাসে দৃষ্টি। ইতির সাথে পা বাড়ায় রুমের ভিতর। ঠিক তখনই ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে কাকলির মা। দৌড়ে আসায় হাঁপাতে হাঁপাতে জানায়,
“ভাবি জান! জলদি নিচে যান। গিয়া দেখুন কারা আইছে।”
“কারা এসেছে?”
কাকলির মায়ের অস্থিরতা দেখে উৎসুক হয়ে জানতে চায় ইতি।
“নতুন কুটুম আইছে গো আপা নতুন কুটুম আইছে। জলদি জলদি ভাবিরে নিয়া নিচে আসেন। আমি গেলাম। মেলা কাম আছে আমার।”
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল,তেমনই ছুটে যায় কাকলির মা। পিছন পিছন উৎসুক ভঙ্গিতে দৃষ্টি, ইতিও হলরুমের দিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ি ডিঙিয়ে কিছুটা নেমে আসতেই হলরুমের সবটা স্পষ্ট দেখা যায়। যেখানে দাঁড়িয়ে বর্তমানে থমকে আছে দৃষ্টি। কাকলির মায়ের বলা নতুন অথিতি আর কেউ নয়। সয়ং দৃষ্টির বাবা মা সাদেক সাহেব, দিলশান আরা আর ছোট ভাই দিহান। এতোদিন পর ওরা আবার কেন এসেছে! আবারও কি তাকে নিয়ে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে! বাবা-মায়ের সাথে লড়ার মানসিকতা যে এই মুহূর্তে দৃষ্টির নেই। সন্তান আসার সুখের সংবাদটুকু দৃষ্টি চায়না পারিবারিক ঝামেলায় মলিন হয়ে যাক।দৃষ্টির মনের ভয় বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না ইতির। কাধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলে,
“ভয় পাচ্ছো! বোকা মেয়ে,একদম ভয় পাবেনা। এমনও তো হতে পারে ওনারা তোমার মাতৃত্বের খবর শুনে এসেছে। কোনো মা-বাবা নিজের মেয়ের মা হবার সংবাদ শুনে রাগ পোষে দূরে থাকতে পারেনা। হয়তো ওরাও পারেনি। তাই ছুটে এসেছে। এবার দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ননদের কথায় ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় দৃষ্টি। তবে মনের ভয় এখনো দূর হয়নি। বুক কাঁপছে অজানা সংশয়ে। রক্তিমও বাড়ি নেই। আজ যদি বাবা-মা জোর করে হলেও তাকে নিয়ে যায়, তবে কে আটকাবে তাদের! দুরু দুরু মনে বাবা-মায়ের সামনে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। দেখতে পায় বাবা-মায়ের সাথে ছোট ভাইটাও কেমন অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দিলশান আরা’র কঠিন চোখ দুটো নোনা জলে সিক্ত। ধীর গতিতে মেয়ের সামনে এসে দু হাতের আজলায় মলিন মুখটা তুলে ধরে কান্নায় রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলে ওঠে,
“কবে এতোটা বড় হয়ে গেলে! আমার তো এখনো মনে হয়,মাত্র কিছুদিন আগে আমার মেয়েটা আমার কোলে এসেছিল। সে মেয়েটা আজ এতো বড় হয়ে গেছে,যে কি না নিজের ভালোবাসার জন্য বাবা-মায়ের সাথে লড়তে শিখেছে। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে জয় করে সুখের সংসার গড়েছে। দুদিন পর আবার সেই মেয়েটাই মা হবে। সত্যিই এতো বড় কবে হলে?”
বহুদিন পর মায়ের আদুরে স্পর্শে নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হয় দৃষ্টি। কেঁদে উঠে শব্দ করে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আজ অন্তত আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। বিশ্বাস করো, তোমাদের থেকে দূরে থাকতে খুব কষ্ট হয় আমার। হাজার সুখের মাঝে থেকেও মনে হয় কি যেন একটা হারিয়ে ফেলেছি। প্রাপ্তির ঝুলিটা এখনো পরিপূর্ণ হয়নি আমার।”
মেয়ের কান্না আজ আর নিরবে সহ্য করতে পারেনা দিলশান আরা। মান-অভিমানের খেলাই ওনার কঠিন সত্তাটাও আজ হার মেনে নিয়েছে। বুকে জড়িয়ে নিয়েছে মেয়েকে। দূর্বল হয়ে গিয়েও নিজেকে দৃঢ় কঠিন রাখার প্রয়াস চালিয়ে কাঠিন্য স্বরে বলে,
“তোমার মাঝে যে প্রাণটা বেড়ে উঠছে সে তো নিষ্পাপ। আমার নাতি-নাতনি। শুধুমাত্র ওর জন্যই আজ তুমি ক্ষমা পেলে। আমি আমার সন্তানদের কাছে কঠোর মা হলেও নাতি-নাতনির কাছে মিষ্টি নানি হতে চাই। বন্ধু হতে চাই তাদের। নেহাত নাতি-নাতনির সাথে খেলার লোভ সামলাতে পারিনি দেখেই খবরটা শুনে সব রাগ ঝেড়ে ছুটি এসেছি।”
দিলশান আরা’র কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রত্যেকে। নতুন করে খুশির জোয়ার আসে সবার মাঝে। মুহুর্ত ব্যবধানে সৃষ্টি হয় উৎসব মুখর পরিবেশ। কাকলির মা,ইতির সাথে রেহানা বেগম অসুস্থ শরীর নিয়েও লেগে যায় রান্নার কাজে। এতোদিন পর বাড়িতে নতুন কুটুম এসেছে। তাদের আদর-যত্নে কমতি থাকলে কি হয়! ফাঁকে ইতি ভাইকে ফোন করে ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়। শশুর শাশুড়ি এসেছে, এটুকু শুনেই রক্তিম গুরুত্বপূর্ণ মিনিং মাঝ পথে ভেস্তে দিয়ে বাড়ি মুখি হয়। অস্থিরতা-চিন্তায় রাস্তাও যেন আজ শেষ হয়না। বুকের ভিতর অজানা এক ভয় বাসা বাঁধে। কোনো ক্রমে যদি তার সুখের পাইরাটাকে ওনারা তার থেকে কেড়ে নেয়! দ্বিতীয়বার নিঃস হয়ে রক্তিম বাঁচবে কিভাবে?
বুকে সুখের পাইরা হারানোর তীব্র ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরে মেহমানদারির এলাহি কান্ড দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয় রক্তিম। রুদ্ধশ্বাসে ডেকে ওঠে এই প্রথম দৃষ্টির নাম ধরে। তার ডাকে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে ইতি। দৃষ্টিকে কোথাও না দেখে রক্তিম চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ও কোথায়?”
ভাইয়ের অস্থিরতা দেখে মিটমিটি হাসে ইতি। বলে,
“উপরে গিয়ে দেখো। রুমে আছে।”
আর কোনো জবাবের আশায় না থেকে দুতলায় ছুট লাগায় রক্তিম। নিজেদের রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছে দৃষ্টি।পাশেই বাবা ভাই বসে তার একের পর এক সুখের গল্প শুনে যাচ্ছে সন্তুষ্ট চিত্তে। নিমিষেই যেন রক্তিমের বুক থেকে ভারী ওজনের কিছু একটা সড়ে যায়। স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যেতে নিলেই সাদেক সাহেব গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে,
“চোরের মতো পালাচ্ছো কেন? ভিতরে আসো। কথা আছে।”
সহসা থমকে দাঁড়ায় রক্তিম। শশুরের মুখ থেকে চোরের মতো পালানোর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়। হতবাক হয়ে ভাবে, শেষ পযর্ন্ত কি না শশুর তাকে চোরের সাথে তুলনা দিল! দেশের গণ্যমান্য একজন এমপি সে। এটা কি শশুর ভুলে গেছে? না কি জানেনা সে যে বিপুল ভোটে এমপি পদে জয় লাভ করেছে! ভাবনায় দাঁড়ি টেনে অসন্তুষ্ট বদনে রুমের ভিতর পা বাড়ায় রক্তিম। ভার মুখে সালাম জানায় শশুর,শাশুড়িকে। সাদেক সাহেব শব্দ করে সালামের জবাব দিলেও দিলশান আরা মেকি রাগের ভাব নিয়ে বিমুখ হয়ে মনে মনে জবাব দেয়। শাশুড়ির দাম্ভিকতা দেখে রক্তিম কোণা চোখে দেখে নেয়। মনে মনে ভাবে,
“এমন আগুনের গোলার পেট থেকে তার বউয়ের মতো ঠান্ডা পানির কলস কিভাবে জন্ম নিলো!”
দৃষ্টি মা আর স্বামীর নিরব প্রতিদন্দ্বীতা দেখে অসহায় মুখে বাবার দিকে তাকায়। সাদেক সাহেব ইশারায় মেয়েকে আশ্বস্ত করে জামাইকে বসতে বলে।
“বসো।”
“এভাবেই ঠিক আছি। বলুন আপনি।”
ভার মুখে জবাব দেয় রক্তিম। সাদেক সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করেন,
“দেখো যা হয়েছে তা তো হয়েই গেছে। এখন এসব ধরে রেখে আর কোনো লাভ নেই। বরং ক্ষতি হবে আমাদের অনাগত নাতা-নাতনির। ছোট বাচ্চাটা পৃথিবীতে এসেই দেখবে তার নানার বাড়ির সাথে বাবার বাড়ির দন্দ। এটা আমরা চাইনা। তোমরা হয়তো ভাবছো আমি বা আমার স্ত্রী খুব কঠিন মনের মানুষ। তোমাদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছি আমরা। কিন্তু একজন বাবা-মায়ের স্থান থেকে আমরা ঠিক ছিলাম। এটা হয়তো এখন বুঝতে পারবেনা। বাবা হচ্ছো তো। আল্লাহর রহমতে আমার নাতি বা নাতনি যায় হোক পৃথিবীতে আসুক। একটু একটু করে আদর যত্নে বড় হোক। তখন বুঝতে পারবে বাবা-মায়ের কাছে সন্তান কি রত্ন। আমরা বাবা-মায়েরা সন্তান নিয়ে কত স্বপ্ন দেখি। হাজারো স্বপ্ন দেখা সেই সন্তানই যখন সমস্ত স্বপ্ন ভঙ্গ করে দেয়, তখন কতটা কষ্ট লাগে তা একজন বাবা-মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবেনা। যায় হোক। সব মন থেকে বাদ দিয়ে মেয়ের মা হবার খবর শুনেই ছুটে এসেছি আমরা। পারলাম না রাগ ধরে রাখতে। চিন্তায় অস্থির হয়েছি,মেয়েটা এমন অবস্থায় কেমন আছে, কি করছে,শশুর বাড়িতে যত্ন কেমন পাচ্ছে। আমি যেমন নানা হবো তেমন তুমিও বাবা হবে। এতোদিন আমার মেয়েকে কিভাবে রেখেছো কতটা সুখে রেখেছো সেসবের হিসাব আমি চাইবনা। আমি শুধু এখন তোমার কাছে একটা জিনিসই চাইব। সেটা হলো,আমার মতো তুমিও একজন যোগ্য বাবা হবে। ছন্নছাড়া জীবন রেখে যেভাবে সংসারমুখি হয়েছো, আশা করি সেভাবেই বাবার দায়িত্বটাও যথাযথ পালন করবে। সন্তানের সবথেকে কাছের বন্ধু হবে।”
শশুর কথায় কতক্ষণ নিরব থেকে ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয় রক্তিম,
“আপনাদের মেয়েকে কতটা সুখে রাখতে পেরেছি তা না হয় নিজেদের মেয়ের মুখ থেকেই শুনে নিবেন। আর আমার সন্তানের সবথেকে কাছের বন্ধু আমিই হব। শ্রেষ্ঠ বাবা হব আমি তার ইন শা আল্লাহ। আমার যে অপূর্ণতা গুলো ছিল তার সবটুকু পূর্ণতা আমার সন্তানকে দিব। আপনারা শুধু দোয়া করবেন আল্লাহ যেন সুস্থ্যভাবে আমার সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখায়।”
জনসভা,পার্টির মিটিংয়ে লম্বা লম্বা ভাসন দেওয়া রক্তিম শিকদার শশুর শাশুড়ির সামনে এটুকু কথা বলেই হাপিয়ে উঠেছে। কেমন যেন এক অস্বস্তিতে গাট হয়ে আছে অন্তঃকোণ। উত্তেজনায় গুলিয়ে যাচ্ছে সব কথা। শশুরকে এলোমেলো জবাব দিয়ে রুম ছাড়তে নিলেই শাশুড়ির কথায় থেমে যায় আবারও। রেহানা বেগম কাট কাট স্বরে জানিয়ে দেয়,
“আমার মেয়ের বেলায় আমি কাউকে ভরসা করিনা। এই সময় মেয়েদের মেন্টালি সাপোর্ট প্রয়োজন পরে অধিক। যত্নে রাখতে হয়। এখানে কে কতটুকু যত্ন করবে তা নিয়ে আমি দ্বিধায় আছি। আমি আমার মেয়েকে সাথে নিয়ে যাব। বাচ্চা হবার আগ পযর্ন্ত ও আমার সাথেই ময়মনসিংহ থাকবে।”
হুট করেই যেন রক্তিমের মাথায় বাজ পরে শাশুড়ির এহেন কথায়। আৎকে উঠে জোর গলায় বলে,
“কখনোই না। বাচ্চা হবার আগ পযর্ন্ত ও এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেনা। আমি আমার বাচ্চার বেড়ে উঠা কাছ থেকে দেখব। অনুভব করব দশ মাস ও কিভাবে একটু একটু করে বড় হয়। ওর প্রতিটা মুভমেন্ট খুব কাছ থেকে ফিল করার অধিকার আমার আছে। কারণ আমি ওর বাবা।”
রক্তিমের পাগলামিতে দৃষ্টি চোখ বড় বড় করে তাকায়। বাবা-মায়ের সামনে অকপটে কিভাবে এসব বলে দিল এই লোক! একটুও লজ্জা সরম নেই। নিজে নির্লজ্জ হয়ে দৃষ্টিকে লজ্জার সাগরে ডুবাচ্ছে। রক্তিমের সরাসরি নাকোচ করাই খ্যাপে যায় দিলশান আরা। শক্ত কন্ঠে বলে,
“আমিও ওর নানি। আমারও অধিকার আছে কাছ থেকে ওর বেড়ে ওঠা দেখা।”
“তাহলে আপনিই থেকে যাক আমাদের এখানে।”
নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয় রক্তিম। তার এহেন জবাবে চিরবিরিয়ে উঠে দিলশান আরা,
“আমি কেন তোমার বাড়িতে থাকব? তোমার যদি এতোই বাচ্চার বেড়ে উঠা দেখার শখ থাকে, তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবে। আমি না।”
“ঘর জামাই হবার ইচ্ছে বা রুচি কোনোটাই আমার নেই।”
“মেয়ের শশুর বাড়িতে থাকার রুচিও আমার নেই।”
মুখ ঝামটে জবাব দেয় দিলশান আরা। স্মিত হেসে রক্তিম বলে ওঠে,
“তাহলে আর কি! আপনি থাকুন আপনার বাড়িতে। আমি আমার বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি আমার বাড়িতে।”
তড়িৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে কঠোর স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে দিলশান আরা,
“একদম বেয়াদবের মতো তর্ক করবেনা। আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব।”
“আচ্ছা! আমিও দেখি, কার দৌড় কতদূর।”
হেয়ালি স্বরে জবাব দিয়ে অলস ভঙ্গিতে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় রক্তিম। মেয়ে জামাইয়ের সাথে তর্কে না পেরে মেয়ের দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিলশান আরা। ঝাঝালো স্বরে বলে,
“দেখেছো! দেখেছো তো কেমন বেয়াদব ছেলের জন্য আমাদের ছেড়ে এসেছো! গুন্ডা-মাস্তান আজীবন গুন্ডা-মাস্তানই থাকে। যে ছেলে শাশুড়িকে নূন্যতম সম্মান দিতে জানেনা সেই ছেলেকে আমি কিভাবে মেয়ের জামাই হিসেবে মানব?”
জামাই-শাশুড়ির যুদ্ধ দেখে বোকার মতো শুধু তাকিয়ে থাকে প্রত্যেকে। অসহায় দৃষ্টি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ জানায়,
“ইয়া মাবুদ! এ কোন মসিবতে ফেললে আমায়? দুজনের যু’দ্ধে আমি কার পক্ষে যাব?”
জনম ত্যাড়া রক্তিমের কাছে অবশেষে দিলশান আরা’কে হার মেনে মেয়ের শশুর বাড়ির আপ্যয়নে সন্তুষ্ট হয়ে বিদায় নিতে হয় সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। তবে ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে রেহানা বেগম কথা দিয়েছেন দিলশান আরা’কে কিছুদিন পর দৃষ্টিকে পাঠাবে তাদের কাছে থেকে আসার জন্য। সেই আশ্বাস নিয়েই মেয়ের ভরা সংসার, সুখ দেখে আরও সুখের অধিকারী হবার দোয়া দিয়ে বিদায় নেয় তারা। পারিবারিক ঝামেলার সমাপ্তি ঘটায় বহুদিন পর যেন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে দৃষ্টি। চঞ্চলতা ফিরে আসে আবার তার মাঝে। মুখ থেকে যেন হাসি সড়ছেই না।
****
নিস্তব্ধ রাতের আকাশ জুড়ে তারার মেলা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় থৈ থৈ করছে চারপাশ। দূর আকাশের ঐ রূপালী চাঁদটা মিটিমিটি হেসে বারান্দায় নিবিড় আলিঙ্গনে বসে থাকা দুজন সুখী মনব-মানবীর গায়ে লেপ্টে দিচ্ছে তার আলো। রক্তিম ঘোর লাগা চোখে অপলক দেখে যাচ্ছে তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে। যার সৌন্দর্য্য মনে হচ্ছে দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। মা হবার সংবাদ শোনার পর থেকে মনে হয় সৌন্দর্য্য আরও দ্বিগুণ হয়েছে। এই যে,এই মুহুর্তে চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধ মুখটা কেমন দ্যুতি ছড়াচ্ছে! অমোঘ মায়ায় বাঁধছে রক্তিমকে। ভালো লাগার আবেশে শিহরিত হয়ে রক্তিম আরও নিবিড়ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় দৃষ্টিকে। ফিসফিসিয়ে ডেকে ওঠে,
“দৃষ্টি!”
প্রণয় পুরুষের মুখে এই নিয়ে দুইবার নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনেছে দৃষ্টি। সামান্য এইটুকু বিষয়েই বেহায়া লজ্জা এসে ঝেকে ধরেছে তাকে। কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে সব কিছু । সেই প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি। এক ছাদের নিচে এতো গুলো দিন কাটানোর পর আজ মনে হচ্ছে তারা নব্য প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। আনমনে দৃষ্টি অতীতের সেই মিষ্টি প্রেমের যন্ত্রণাময় দিন গুলোর বর্ণনা দিতে থাকে রক্তিমকে। চোখে এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে রক্তিম দেখে যায় তার মায়ার রাজ্যকে। নিরবে শুনে যায় দৃষ্টির আলাপন। মন বলে,তুমি বলে যাও। আমি দিবস-রজনী বিভোর হয়ে শুনে যাব তোমার আলাপন।
****
পরিশিষ্ট
হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে প্যারালাইজড মা’কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে ডাক্তারের সিরিয়ালের অপেক্ষায় জেরিন। চোখে-মুখে তার বয়সের ছাপ, রাত জাগা ক্লান্তি। বিষন্নতায় ছেয়ে আছে সর্বাঙ্গ। যে অঙ্গের সৌন্দর্য্য ছিল এক সময় তার অহংকার, আজ ঝং ধরেছে সে অঙ্গে। যে রূপের আগুনে এক সময় ছাড়খাড় করেছিল দুই পুরুষকে,আজ সেই রূপ ঢাকা পরেছে চোখের নিচের কালো দাগে। দেশে ফেরার পর মামার বাড়িতে ঠাই না হওয়ায় দুদিন এক বান্ধবীর বাসায় থেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জীবন যুদ্ধে হার মেনে চাকরি নিতে হয় একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। মাস জুড়ে হাড় ভাঙা খাটুনির পর যে টাকা গুলো হাতে আসতো তা দিয়ে মূল্য বৃদ্ধির বাজারে ঠিকঠাক তিন বেলা খাবারও জুটতোনা। সেখানে সামলাতে হয়েছে তাকে সংগ্রামের বিরুদ্ধে লড়া কেস, মায়ের চিকিৎসার খরচ, বাড়ি ভাড়া সমস্ত কিছু। নিজের সাথে নিজেই হেরে গিয়ে বারবার চেষ্টা করেছে আ ত্ম হ ত্যা র।কিন্তু পরোক্ষনে মনে হয়েছে সৌন্দর্যের অহংকার আর লোভের বশবর্তী হয়ে যে পাপ সে করেছে, সেই পাপের শাস্তিই তো দুনিয়ায়তেই শুরু হয়ে গেছে। আ ত্ম হ ত্যা র মতো পাপ কাজ আবার বেছে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল কিভাবে পুড়বে সে!তার থেকে বরং দুনিয়াতেই কিছুটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাক। যে অ মানু ষে র জন্য নিজের এই পরিণতি তার শাস্তিও দেখে যাক। জেরিন দেখেছে সংগ্রামের শাস্তি। উচ্চ আদালত তাকে দশ বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত করেছে। দূর থেকে সেই সংবাদ শুনেছে রক্তিমও। আড়ালে নিজ চোখে দেখেছে জেরিনের করুণ পরিণতি। স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে হৃদয় শীতল করেছে বেঈমান গুলোর পরিণতি দেখে।
ওয়েটিং রুমের একপাশে মা’কে রেখে তাদের সিরিয়াল কখন আসবে জানার জন্য রিসিপশনের দিকে এগিয়ে যায় জেরিন। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রিসিপশনিস্ট মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞেস
করতে যাবে ওমনি দৃষ্টিগোচর হয় একটু দূরেই এক সুখী দম্পতি। থমকে যায় জেরিন সেখানেই। জমে যায় বরফের মতো। অতীতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া রক্তিম শিকদার আজ কতটা সুখী!কি সুন্দর হাসি মুখে নিজের অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে আগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো ডাক্তার দেখাতে এসেছিল।এই সুন্দর চোখ শীতল করা দৃশ্যটাতো জেরিনের বেলাতেও হতে পারতো। দৃষ্টির জায়গায় থাকতে পারতো সেও। ভাগ্য ফেরে আজ সব হারালো। নিঃস করতে গিয়ে পরিপূর্ণতা দিল রক্তিমকে। নিজে ডুবে মরল দুঃখের সাগরে। নিজ কর্মে হারিয়ে ফেলা যক্ষের ধনটাকে আজ অন্য একটা মেয়ের সাথে এতো সুখী দেখে পুড়ে যাচ্ছে অন্তর। তবুও কিছুই করার নেই। পাপের বোঝা ভারী করতে চায়না আর। তাই পাপী নজরটা সড়িয়ে এনে বহু কষ্টে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানায়,”হে খোদা! ভালো রেখো ওদের।”
সমাপ্তি