দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৪২+৪৩

0
509

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪২
#আদওয়া_ইবশার

বৃষ্টির বেগ কমার বদলে এখন পযর্ন্ত বেড়েই যাচ্ছে। পুরো শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত। মোমবাতির অল্প আলোয় খাবার পর্ব চুকিয়ে ডাইনিং, রান্নাঘর সব গুছিয়ে রুমে এসেছে দৃষ্টি। রক্তিম অনেক আগে এসেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে নাক-মুখ ডেকে শুয়ে পরেছে। এইটুকু সময়ের মাঝেই জ্বরের কবলে শরীর উত্তপ্ত। পাতলা এক কাঁথায় শীত নিবারণ করা দুস্কর হয়ে পরেছে। রুমে দৃষ্টির আভাস পেয়ে আদেশ ছুড়ে দেয়,

“আলমারি থেকে পাতলা কম্বলটা বের করে দাও।”

হাতে চিরুনি নিয়ে সবেই চুল গুলো আচড়ে বিনুনি করতে নিয়েছিল দৃষ্টি। এর মাঝেই রক্তিমের আদেশ পেয়ে ভ্রু কাঁচকে নেয়। মুখের আদলে ফুটে ওঠে বিরক্তির রেশ।

“এখন কম্বল লাগে কেন? বীর পুরুষ না! বীরত্ব দেখিয়ে তো খুব চলে এসেছিল ভিজেপুড়ে। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা কিভাবে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে সেই ফন্দি। আল্লাহ মনে হয় আমার কপাল থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার রেখা মুছে দিছে।”

চাপা স্বরে বকতে বকতে কম্বল বের করে শীতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা রক্তিমের গায়ে জড়িয়ে দেয় দৃষ্টি। বউয়ের শাসন পূর্ণ মনোভাবের কথায় চোখ বন্ধ রেখেই মিটি মিটি হাসে রক্তিম। এতোটুকু একটা বাচ্চা বউ!পরে থাকে সর্বদা রক্তিমের হাঁটুর নিচে।অথচ সাহস কত বেড়েছে দেখো! রক্তিমকে বকতে আসে!মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও দৃষ্টির মন ঠিকই স্বামীর সামান্য জ্বরে চিন্তায় অস্থির। ভালো ভাবে গায়ের সাথে কাঁথা, কম্বল দুটোই জড়িয়ে দিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“জলপট্টি দিয়ে দিব।”

” এতোটাও গুরুতর হয়নি এখনো।”

চোখ বন্ধ রেখেই মিহি স্বরে জবাব দেয় রক্তিম। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি হতাশ স্বরে বলে,

“মেডিসিন’ও নেননি। আগেভাগেই একটা নাপা বা প্যারাসিটামল খেয়ে নিলে ভালো হতো না।”

“জ্বরই তো এখনো আসেনি। বহুদিন পর বৃষ্টিতে ভিজায় একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। সকাল হতে হতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এতো চিন্তার কিছুই হয়নি। শুয়ে পরো।”

বিরক্তি ভাবটা আবার এসে হানা দেয় দৃষ্টির মুখে। হাত বাড়িয়ে রক্তিমের কপাল ছুঁয়ে কোমল স্বরটা কিছুটা গম্ভীর করে বলে,

“কপালে যদি একটা চাল রেখে দেই ফুটে ভাত হয়ে যাবে। তবুও বলছে জ্বর নেই।থাকগে। আমার কি! বাচ্চা না কেউ। নিজের ভালো নিজে না বুঝলে আমারও এতো ঠেকা পরেনি শুধু শুধু চেঁচিয়ে গলা ব্যথা করার।”

মুহূর্তেই বন্ধ চোখের পাপড়ি খুলে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। ভাবুক সুরে বলে,

“দিন দিন পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা টিপিক্যাল বউদের মতো হয়ে যাচ্ছো না! এমন খোঁচা মেরে কথা বলার স্টাইল কোথা থেকে রপ্ত করেছো? আমার বাড়িতে তো কেউ এভাবে খোঁচাখুঁচি করেনা!”

একেতো বিরক্তিতে মন-মেজাজ ঘেটে আছে, তার উপর আবার এমন গা জ্বালানো কথায় মুহূর্তেই তেতো ওঠে দৃষ্টি। মেজাজ দেখিয়ে বলে,

“পুরোনো হচ্ছি না! এখন তো সব কিছুই আমার বস্তির মেয়েদের মতো লাগবে।ভালো কথাও খোঁচা মারা কথা মনে হবে। আমিও বা পাগলের মতো কি বলছি! ভালো ছিলামই বা কবে? সেই শুরু থেকেই তো ঘাড়ের উপর মস্ত বড় এক বোঝা। সমস্ত বিরক্তির কারণ। যে সর্বদা বিরক্তির কারণ তার ভালো কথা,ভালো আচরণ সবই খারাপ মনে হবে। খুবই স্বাভাবিক।”

দৃষ্টির আচরণে অন্যদিনের মতো আজ কেন যেন রক্তিমের একটুও বিরক্তবোধ হচ্ছেনা। উল্টো কেমন যেন এক ভালো লাগা কাজ করছে। মনে হচ্ছে স্বাভাবিক কোনো দুষ্টু-মিষ্টি দম্পতির মতোই মধুর এক সম্পর্ক তাদের। অবশ্য দৃষ্টির দিক থেকে তো সেই প্রথম থেকেই সম্পর্কটা সুন্দর। শুধু রক্তিমই নিজের গম্ভীরর্যতার খোলস ছেড়ে বের হতে পারছিলনা। জৈবিক তাড়নায় অর্ধাঙ্গীকে কাছে টেনে নিলেও,তাকে ঘিরে মায়ার জাল তৈরী হলেও কেমন যেন সুতো ছেড়া ভাব ছিল। সেই ভাবনায় বোধহয় এবার পরিহার করার সময় এসেছে। মুহূর্ত এসেছে খুব কাছ থেকে দুটো মন একে অপরকে অনুভব করার। ঠোঁটের কোণে মিটি মিটি হাসি ধরে রেখেই আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রক্তিম।জেগে ওঠে এতোদিন দমিয়ে রাখা ভিতরের দুষ্টু সত্তাটা। ফাজলামি স্বরে বলে,

“আমার কপালে একটা চাল রেখে ভাত ফোটানোর ভাবনা রেখে নিজের মাথায় এক হাড়ি চাল রেখে দাও। দেখবে ঘরের সবার এক বেলা খাবারের ভাত হয়ে যাবে। কিছুটা গ্যাস বিল’ও কমে যাবে।”

কথা শেষ করে অসল ভঙ্গিতে অর্ধ শোয়া হয়ে বসে আবারও রগর করে বলে ওঠে,

“এতো ঘন ঘন মুড সুয়িং হচ্ছে কেন তোমার বলো তো!কোনো খুশির খবর-টবর আছে না কি? না মানে, নাটক সিনেমায় তো এমনটাই দেখায়, বউরা প্রেগনেন্ট হলে এভাবে হুটহাট মুড সুয়িং হয় তাদের।”

হুট করে এমন একটা অপ্রত্যাশিত কথায় দৃষ্টি চমকায়। ভড়কে যাওয়া ভাবে চোখ দুটো বড় বড় করে অবাক নেত্রে তাকায় রক্তিমের দিকে। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে অপলক তাকিয়েই থাকে চোখে-মুখে চাপা দুষ্টুমির আভাস নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। পরিচিত মানুষটার একদম অপরিচিত আচরণে মুখের ভাষা হারায়। নিরেট মস্তিষ্কে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে যায় অতি পরিচিত চির গম্ভীর স্বভাবের মানুষটার বদলে যাওয়া রূপ। অবচেতন মন ভেবে পায়না,এটা কি তার স্বপ্ন না বাস্তব! সকালেও তো মানুষটা তার চিরায়ত স্বভাব অনুযায়ী গম্ভীরর্যতার খোলসে আবৃত ছিল। হঠাৎ এই আমুল পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব! উঁহু, এটা সত্য হতে পারেনা। এ নিশ্চয়ই দৃষ্টির দেখার ভুল, শোনার ভুল। দৃষ্টিকে এমন বিহ্বল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে রক্তিম। ফিচেল স্বরে ভ্রু নাচিয়ে আবারও বলে ওঠে,

” এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে? ঘুমাতে আসো।”

পাল্টা কোনো জবাব দিতে পারেনা দৃষ্টি। পিছন ঘুরে ফাঁকা মস্তিষ্কে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের কাছে। সম্পূর্ণ চুলে বিনুনি করে শেষ প্রান্ত বাঁধার জন্য রাবার ব্যান্ড নিতে গিয়ে আবিষ্কার করে টেবিলের এক পাশে ছোট্ট এক প্যাকেট পরে আছে। যার পুরোটা ভিজে নাজেহাল অবস্থা। ভাবুক নয়নে সেদিকে তাকিয়ে চুল বেঁধে হাতে তুলে নেয় প্যাকেটটা। ভাবে, এখানে তো বৃষ্টির ছটা আসার কথা না। তবে এটা ভিজল কিভাবে? আর এটা রাখলোই বা কে? সে তো কিছু কিনে আনেনি।সমস্ত ভাবনা চিন্তা একপাশে রেখে প্যাকেট খুলে ভিতরের জিনিসটা বের করতেই আরও এক দফা চমকায় দৃষ্টি। বিমূড় হয়ে তাকিয়ে থাকে প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসা তাজা বেলি ফুলের মালার দিকে। অত্যধিক বিস্ময়ে পূণরায় মায়াবী চোখ দুটো বৃহদাকৃতি ধারণ করে। অল্প অল্প করে ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয় মুক্ত ঝরা হাসি। অপ্রত্যাশিত এই ক্ষুদ্র অথচ অতিশয় সুখ সুখ অনুভূতির জোগান দেওয়া উপহারে হুট করেই যেন দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় মন জমিন। ভালো লাগার আবেশে ছেয়ে যায় অন্তঃকোণ। ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি ধরে রেখেই দৃষ্টি ঘুরে তাকায় রক্তিমের দিকে। মনের আনন্দ টুকু বহুকষ্টে দমিয়ে রেখে বারান্দার দরজার কাছে এগিয়ে যায়। ঘুট্ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশ পানে তাকিয়ে মিছেমিছি কিছু একটা খোঁজার প্রয়াস চালায়। সেদিকে তাকিয়ে রক্তিম ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে জানতে চায়,

“এই অন্ধকারে ঐদিকে কি দেখো?”

“দেখছি আর বোঝার চেষ্টা করছি চাঁদ আজকে কোন দিক দিয়ে উঠেছে।”

ঠোঁট কামড়ে হাসি সংবরণ করে ভাবুক স্বরে জবাব দেয় দৃষ্টি। এমন জবাবে হালকা কুঁচকে রাখা ভ্রু দ্বয় এবার বাজে ভাবে কুঁচকে নেয় রক্তিম। কিছু বলতে উদ্যত হয়,ঠিক তখনই দেখতে পায় দৃষ্টির হাতে থাকা বেলি ফুলের মালাটা। সাথে সাথে জ্বিভের ডগায় থাকা কথাটা হজম করে নেয়। চোরা হেসে জবাব দেয়,

“চাঁদের অস্তিত্ব আজ মেঘের আড়ালে ডেকে গেছে দেখতে পাচ্ছোনা। তাছাড়া প্রতিদিন যেদিক দিয়ে উঠে আজকেও তো সেদিকেই উঠবে।”

তড়িৎ ছুটে এসে রক্তিমের পাশে বসে পরে দৃষ্টি। উৎফুল্ল হেসে বলে ওঠে,

“এমনটা হলে তো আপনার স্বভাবের এতো পরিবর্তন হবার কথা না। চাঁদ যদি তার নিয়ম অনুযায়ী একই দিক থেকে উদিত হয়, তবে আপনি কিভাবে নিজের স্বরূপ পরিবর্তন করলেন?”

দৃষ্টির এমন প্রশ্নে রক্তিম নিজেও হেসে ওঠে। জবাব দেয়,

“চাঁদ একটি উপগ্রহ, আর আমি হলাম সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের সাথে চাঁদের তুলনা চলে না কি! মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। কিন্তু গ্রহ,উপগ্রহ তো তাদের নিয়মের বাইরে চলবেনা।”

“তাহলে কবি-সাহিত্যিক বা প্রেমিকরা তাদের ব্যক্তিগত নারীদের চাঁদের সাথে তুলনা করে কেন?”

অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে জানতে চায় দৃষ্টি। রক্তিম আবারও হাসে। যা দেখে দৃষ্টি অপ্রসন্নতা ভুলে ফের চমকায়। হলো কি আজকে পাষাণটার? কারণে অকারণে এমন হাসছে কেন? বিষয়টা একদম হজম হচ্ছেনা দৃষ্টির। কেমন যেন খটকা লাগছে। সন্দিঘ্ন নজরে তাকিয়ে যেই এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতে যাবে ওমনি রক্তিম প্রফুল্লচিত্তে প্রত্যুত্তর করে দৃষ্টির প্রশ্নের,

“সেটা তো একটা উপমা মাত্র।পুরুষেরা তার ব্যক্তিগত নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় চাঁদের সাথে তুলনা করে। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো! ব্যক্তিগত নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঐসব চাঁদ তারার সাথে তুলনা করে পুরুষ নিজেদের নির্বোধ পরিচয় দেয়। প্রকৃত পক্ষে বোধজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ কখনো ঐসব অযাচিত ভাবনা ভাবতে পারেনা। কারণ কারো সৌন্দর্য কখনো অন্য কারো সাথে তুলনা করা যায়না। আল্লাহ তার প্রতিটা সৃষ্টিকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছে। তোমার মাঝে যেটুকু সৌন্দর্য আল্লাহ দান করেছে তা কি ঐ চাঁদকে দিয়েছে? অথবা ঐ চাঁদের মাঝে যেটুকু সৌন্দর্য আছে সেটুকু তোমার মাঝে নেই। সত্যিকার অর্থে তো চাঁদের কোনো আলোয় নেই। সূর্য তাকে যেটুকু আলো ধার দেয় সেটুকুতেই সে নিজেকে সুন্দর হিসেবে প্রকাশ করে। তার মাঝে ধারকৃত ঐ আলোটুকু না থাকলে তো আমরা তাকে মস্ত বড় আকাশের বুকে খোঁজেই পেতাম না। তবে কেন শুধু শুধু আমি আমার ব্যক্তিগত নারীর সৌন্দর্য ঐ পরনির্ভরশীল চাঁদের সাথে তুলনা করব?যে আমার ভুবনোহিনী, তার সাথে অন্য কারো তুলনা হবে কিভাবে? আমার ব্যক্তিগত নারীর মাঝে আমি যেটুকু সৌন্দর্য খোঁজে পেয়েছি,সেটুকু অন্য কোনো মানব,প্রাণী বা বস্তুর মাঝে খোঁজে পাইনি দেখেই শুধু তাকে দেখেই আমার চোখ মুগ্ধ হয়। মনে প্রশান্তি বয়ে যায়। নশ্বর পৃথিবীটাকে মনে হয় এক স্বর্গরাজ্য। তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা করে আমি তাকে কখনো ছোট করবনা।”

মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিকে তাকিয়ে থেকে রক্তিমের প্রতিটা কথা শুনে যায় দৃষ্টি।শেষোক্ত কথা গুলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে কি না, সেটা বুঝতে না পারলেও কেমন যেন এক শিরশিরে অনুভূতি বয়ে শরীর জুড়ে। এক মুঠো লজ্জা এসে রাঙিয়ে দেয় মুখাবয়ব। পলকেই প্রিয় পুরুষের জন্য মনে নতুন উদ্যমে ভালোবাসার জন্ম নেয়। আড় চোখে চেয়ে দেখতে পায় রক্তিম নিবিড় নয়নে অপলকে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। যে দৃষ্টির কবলে পরে হঠাৎ করেই মুচড়ে ওঠে বুকের ভিতর। অজানা এক ভয়ংকর শিহরণে হৃৎপিন্ড ধুকপুক শব্দ তুলে। অসহনীয় সুখ সুখ অনুভূতির পীড়ায় পৃষ্ঠ হয়ে তড়িৎ উঠে যায় দৃষ্টি। পিছন ঘুরে বুকে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে হৃৎপিন্ডের অবাধ গতিবিধি। বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে নিভু নিভু জ্বলা মোমবাতিটা নিভিয়ে ক্রস্থ পায়ে পূণরায় বিছানায় এসে শোয়ার জন্য বালিশ ঠিক করতে করতে ব্যাঙ্গ করে বলে,

“পুরো দুনিয়ায় একমাত্র আপনিই বোধজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ। আর বাকী সবাই নির্বোধ।”

নিজের মতো করে জবাব দিয়েই অশান্ত মনে পাশ ফিরে শুয়ে পরে দৃষ্টি। তার ছটফটানি অনুভূতির দোদুল্যতা বুঝতে পেরে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে রক্তিম। পরপর মাথা তুলে এক নজর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তার দিকে ঝুঁকে শ্লথ কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আমি কি সরাসরি বলেছি আমি বাদে বাকী সব পুরুষ নির্বোধ? তোমরা নারীরা যে এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছো,তা কি জানো? স্ত্রীর সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হয়ে পৃথিবীর সকল পুরুষ কোনো না কোনো এক সময় নির্বোধে পরিণত হয়। ঠিক সেই সময়টাতেই পুরুষ বোধ-জ্ঞান শক্তি হারিয়ে স্ত্রীর সৌন্দর্যের তুলনা করে অন্য কিছুর সাথে। যেমনটা এই মুহূর্তে আমার করতে ইচ্ছে করছে।”

রুদ্ধশ্বাসে দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে থাকে সেভাবেই। বহুল আরাধ্য পুরুষের মুখ থেকে যে স্বীকারোক্তি শোনার আশায় এতোদিন তৃষ্ণার্ত ছিল শ্রবণেন্দ্রিয়, আজ সেই পুরুষের থেকে এতোটুকু শুনেই বেসামাল মন নিজের সাথে বিদ্রোহ শুরু করেছে। বাকীটা শোনার পর না জানি তার সুখের মরন হয়! দৃষ্টি শুনতে চায়না আর কোনো স্বীকারোক্তি। পাষাণ পুরুষের প্রগাঢ় অনুভূতি সহ্য করার মতো আর এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। দৃষ্টির এমন নাজুক অবস্থা দেখে যেন রক্তিম আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে নিজের অনুভূতির জানান দিতে। প্রণয়ানুভূতির ভার যেন আজ হৃদয়ে নতুন করে চাপ দৃষ্টি করেছে। যে চাপ সড়াতে না পারলে শ্বাসরোধ হয়ে মারা পরবে সে। দৃষ্টিকে এক টানে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে গালে গাল ঘষে নিবিড় আলিঙ্গনে মিশে গিয়ে আবারও বলতে শুরু করে,

“যে আমার অন্ধকার পৃথিবীর মাঝে এক টুকরো আলো হয়ে জীবনে এসেছে, ঘুচিয়ে দিয়েছে জীবন থেকে সমস্ত অন্ধকার। যার ছোঁয়ায় জীবন্ত লাশে পরিণত হওয়া আমার মাঝে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে,যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া হৃদয়ে প্রশান্তির বর্ষণ নেমেছে, তাকে আজ এক গুচ্ছ শুভ্র বেলি ফুলের সাথে তুলনা করে নিজেকে নির্বোধ হিসেবে পরিচয় দিতেও কোনো দ্বিধা নেই আমার। ভালোবাসি শুভ্র ফুল। আমার নিজের কাছেই নিজেকে পরাজিত হতে বাধ্য করেছো তুমি। মায়ার বাঁধনে বেঁধে সেই বাঁধনটাকে ছিন্ন করে নবউদ্যমে ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছো আমাকে। অপ্রিয় থেকে প্রিয় হওয়া ব্যক্তিগত ফুল, শুনে রাখো আজ তুমি,এই পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ তোমার সান্নিধ্যে নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছে। শক্ত,পাথুরে হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফুটেছে। এবার সেই ফুলটাকে সতেজ রাখার দায়িত্ব তোমার। যতদিন নিঃশ্বাস চলে, ততদিন যেন ঝরে না পরে এই ফুল।”

চলবে….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪৩
#আদওয়া_ইবশার

সারা রাতের ঘন বর্ষণ শেষে সূচনা হয়েছে স্নিগ্ধ এক ভোরের।গাছের পাতা থেকে এখনো বৃষ্টির মতো টুপটাপ পানি ঝরে পরছে। সবুজ ঘাসের ডগায় লেপ্টে আছে সেগুলো শিশির বিন্দুর মতো। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর। তবুও ইচ্ছে জাগছে খালি পায়ে ভেজা ঘাসের গালিচা মারিয়ে হেঁটে যেতে বহুদূর। দীর্ঘ প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করতে ভেজা মাটির পাগল করা সোঁদা গন্ধ। যে গন্ধে নাম না জানা এক ভালো লাগার আবেশে ছেয়ে যায় মন। ইচ্ছে করে বারবার প্রলম্বিত প্রশ্বাসের সাথে সবটুকু ঘ্রাণ শুষে নিতে। গায়ের পাতলা চাদরটা আরও একটু শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কাঁদা মাটিতে খালি পায়ের ছাপ ফেলে দৃষ্টি এগিয়ে যায় শিকদার মঞ্জিলের পিছনের দিকে। চোখ জুড়ে তার নিদারূণ মুগ্ধতা। ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির এক নির্মল হাসি। প্রকৃতির লিলুয়া বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে মনের মাঝেও বয়ে যাচ্ছে এক অদম্য খুশির শিরশিরে মাতাল হাওয়া। বর্ষণমুখর রাত শেষ হলেও শেষ হয়নি এখনো সে রাতের রেশ।অদৃশ্যভাবে এখনো কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা রক্তিমের প্রতিটা প্রেমময় বাক্য।সেই বাক্য গুলোতেই বিবশ এখনো সর্ব সত্তা। সে কি এক ঘোরলাগা মুহুর্ত!ভালো লাগার,ভালোবাসার এক বর্ষণের রাত!যে রাতের প্রতিটা মুহূর্ত মানসপটে ভেসে উঠতেই পুলকিত হচ্ছে অন্তঃকোণ। ভাবনার অতলে ডুবে থাকা দৃষ্টির ঘোর কাটে হঠাৎ কাকলির মায়ের ডাক কর্ণগোচর হওয়ায়। পেছন থেকে কিছুটা উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে ডেকে যাচ্ছে,

“ও ভাবি! ভাইজান বমি করতাছে। তাড়াতাড়ি আসেন।”

মুহূর্ত পল স্থির থেকে কথাটা শুনেই ঘরের দিকে ছুট লাগায় দৃষ্টি। মধুর স্মৃতিচারণের সাথে স্নিগ্ধ সকালটাকে উপভোগ করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল রক্তিমের কথা। রাতে রক্তিম মুখে অস্বীকার গেলেও দৃষ্টি ঠিক তার গায়ের উষ্ণতায় জ্বরের পরিমাপটা বুঝতে পেরেছিল।কিন্তু মন পুরুষের উষ্ণ আলিঙ্গন আর বশীভুত করা মন্ত্রের ন্যায় এক একটা বাক্যে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের বোধ শক্তি। রক্তিমের সাথে নিজেও জাগতিক সমস্ত কিছু ভুলে পাড়ি জমিয়েছিল ভালো লাগার ভিন্ন এক রাজ্যে।একদম ভুলে গিয়েছিল রক্তিমের শারীরিক অবস্থার কথা। যে পুরুষটা তার প্রাণ, সেই পুরুষটার প্রতিই কিভাবে বেখেয়ালি হয়ে গিয়েছিল সে?ভাবতেই এখন নিজের প্রতি নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।দায়িত্ব জ্ঞানহীন মনে হচ্ছে তার নিজেকেই।কর্দমাক্ত পায়ে নিজেদের রুমে ঢুকেই কাকলির মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়াশরুমে ছুটে যায় দৃষ্টি। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রক্তিম সিন্কের সামনে পানির ট্যাব ছেড়ে ঝুঁকে কুলকুচি করছে। ছেলেকে পেছন থেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রেহানা বেগম।কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে অপরাধি মুখ করে দৃষ্টি বলে,

“কষ্ট হচ্ছে বেশি?”

পানির ট্যাব বন্ধ করে দৃষ্টির দিকে ঘুরে তাকায় রক্তিম। শরীরটা কেমন দূর্বল হয়ে আসছে! মনে হচ্ছে এখনই বুঝি ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যাবে। দূর্বল স্বরে দৃষ্টিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহানা বেগম পুত্রবধূকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,

“রাতে ওকে ঔষধ দাওনি? আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম না,ওর জ্বর খুব খারাপ! অন্য কোনো অসুখ কাবু করতে না পারলেও এই জ্বর একদিনেই কাবু করে ফেলে। জন্মের পর থেকে যতবার জ্বর এলো প্রতিবার এভাবে বমি-টমি করে একাকার করেছে। দশ-পনেরো দিন না ভোগে কখনও সুস্থ্য হয়না।”

দৃষ্টি শাশুড়িকে কি জবাব দিবে এখন? বলবে যে তার গুনধর পুত্র জনম ত্যারা পন্ডিতি করে ঔষধ খায়নি,উল্টো মাছি তাড়ানোর মতো করে জ্বরটাকে উপেক্ষা করে প্রেমকথনে ব্যস্ত ছিল! না কি এটা বলবে,শরীরের দিকে নিজেও পাত্তা দেয়নি, সাথে দৃষ্টিকেও ভুলিয়ে-ভালিয়ে চিন্তাধারা ঘুরিয়ে রেখেছিল অন্য দিকে! রক্তিমের ক্লান্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিরবে সবটা দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেয় দৃষ্টি। মিনমিনে স্বরে শাশুড়িকে জানায়,

“আমার ভুল হয়ে গেছে মা। আসলে আমি বুঝতে পারিনি এক রাতেই এতোটা নাজুক হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম সকালে জ্বর না সাড়লে তখন একটা টেবলেট খাইয়ে দিব।”

বলাবাহুল্য দৃষ্টির প্রতি রেহানা বেগমের অল্পস্বল্প অভিমান সৃষ্টি হয়েছে। এতোদিনের দেখে আসা সংসারের প্রতি দৃষ্টির দায়িত্ব পালনের পরিধি দেখে ভেবেছিল ছেলের সামান্য অসুখেও সে যথেষ্ট যত্নশীল হবে। সেই ভাবনাতেই রাত থেকে নিজেও আর ছেলের ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু সকাল হতেই ছেলের এমন বেহাল দশা দেখে না চাইতেও দৃষ্টির প্রতি চাপা একটা রাগের আভাস পাচ্ছে নিজের মাঝে। তবুও আর কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রক্তিম মুখ খুলে,

“আমি ঠিক আছি মা। বমিটা হয়ে এখন আরও ভালো লাগছে। এতোক্ষন ভিতরে পাক খাচ্ছিল। তাছাড়া রাতে সে টেবলেট বের করে দিলেও আমিই খাইনি।”

আড়চোখে একবার শাশুড়ির রুষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নজর লুটিয়ে নেয় দৃষ্টি। শাশুড়ির এমন কাট কাট ভাবটা যেন তার অপরাধবোধের মাত্রাটা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্বামীর প্রতি অবহেলা,অযত্নের দায়ে হীনমন্যতায় ভুগছে নিজ মনেই। দৃষ্টির যেখানে কিছুটা হেয়ালীপনা ছিল,সেখানে শাশুড়ির হঠাৎ এমন কঠোর রূপ দেখাটা স্বাভাবিক। কথাটা ভেবে সে নিজেও আর কোনো প্রত্যুত্তর না করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। পরিস্থিতি সামলাতে রক্তিম নিজেই আবারও বলে উঠে,

“খিদে পেয়েছে আমার। কিছু খেতে দাও।”

রক্তিমের কথায় সচকিত হয় দৃষ্টি। রক্তিমকে কিছুটা সাপোর্ট দিয়ে রুমে নিয়ে এসে বিছানার দিকে তাকাতেই নজরে পরে চাদরটা নষ্ট হয়ে গেছে। বমির বেগ সামলাতে না পেরে বিছানা কিছুটা নষ্ট করে ফেলেছে রক্তিম। মেঝেও নোংরা হয়ে আছে। এক পলক রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঝটপট চাদর পাল্টে নতুন এক চাদর বিছিয়ে দিয়ে পূণরায় বাথরুমে ছুটে যায়। বালতি ভরে পানি এনে তড়িৎ মেঝে পরিষ্কার করে ছুটে রান্নাঘরের দিকে। কয়েক মিনিটের মাথায় এক বাটি স্যুপ নিয়ে চঞ্চল পায়ে রুমে ঢুকে আবারও। রক্তিমের পাশে বসা রেহানা বেগম কিছুটা গম্ভীর সুরেই হুশিয়ার জানিয়ে দেয়,

“আস্তে দৌড়াও।পরে-টরে গিয়ে কোমর ভেঙে বিছানায় পরে থাকলে কিন্তু তোমাদের দুজনকে টানার শক্তি আমার নেই।”

সাথে সাথেই চলার গতি কমিয়ে দেয় দৃষ্টি। ধিমি পায়ে রক্তিমের কাছে এগিয়ে আসে। রেহানা বেগম ছেলের পাশ থেকে উঠে রুম ছেড়ে যেতে যেতে আবারও বলে যান,

“পুরোটা খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে দিও।”

উপর-নিচ মাথা ঝাকিয়ে শাশুড়ির কথায় সম্মতি দিয়ে রক্তিমের থেকে অল্প দূরত্বে বসে চামচ দিয়ে ধোয়া উঠা গরম স্যুপটা নাড়াচাড়া করতে থাকে দৃষ্টি।রেহানা বেগম রুম ছাড়তেই রক্তিম বলে ওঠে,

“মায়ের কথায় কষ্ট পেয়েছো?”

তৎক্ষণাৎ দৃষ্টির হাত থেকে যায়। মাথা উঁচিয়ে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে ভ্রুক কুঁচকে বলে,

“কষ্ট পাব কেন?মা কি আমাকে বকেছে? আর যদি বকেও থাকে,সেটা আপনার জন্যই বকেছে। মা তো আর জানেনা কার দোষ কার গুণ।”

স্মিত হেসে দৃষ্টির বাড়িয়ে দেওয়া এক চামচ স্যুপ মুখে তুলে নেয় রক্তিম। ফের বলে,

“রাতে জ্বর ছিলনা তো অযথা ঔষধ খাব কেন?”

কোনো কথা বাড়ায়না দৃষ্টি।জনম ত্যারা লোকটার সাথে অহেতুক কথা বলে সুন্দর,ফুরফুরে মেজাজটা নষ্ট করতে চায়না।রক্তিমও কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য ছাড়াই পুরোটা স্যুপ খেয়ে ঔষধ খেয়ে নেয়। নিরবে খাওয়ানোর কাজ সম্পন্ন করে নোংরা হয়ে যাওয়া চাদর নিয়ে দৃষ্টি এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে। ঠিক তখনই বাধ সাজে রক্তিম,

“এটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

“নোংরা হয়ে গেছে। ধুয়ে দিব।”

“আমার বমি পরিষ্কার করবে!ঘেন্না লাগবেনা তোমার?”

চলন্ত পা স্থির করে চোখ দুটো ছোট ছোট করে রক্তিমের দিকে ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। কোমরে এক হাত রেখে মহা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“যখন প্যারালাইজড হয়ে পরে ছিলেন, তখন কে পরিষ্কার করেছে আপনাকে?ঐ সময় যদি কোনো ঘেন্না ছাড়াই আপনার প’টি পরিষ্কার করতে পারি, তো এখন কেন ব মি পরিষ্কার করতে পারবনা? আমি বলেছি একবারও যে আমার ঘেন্না হয়? না কি আমার চেহারায় এমন কোনো ছাপ পেয়েছেন? আজাইরা কথা বলে আমার সুন্দর মেজাজটা নষ্ট করবেন না একদম।”

বিভীষিকাময় পঙ্গুত্ব বরণ করে রাত-দিন বিছানায় পরে থাকা সেই দিন গুলোর কথা মনে হতেই নিশ্চুপ বনে যায় রক্তিম। অপলক তাকিয়ে দেখে যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তমান ধৈর্য্যমানবীকে। নতুন করে অনুভব করে তার ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। এমন আষ্টাদশী একটা মেয়ের মাঝেও সৃষ্টিকর্তা এতোটা ভালোবাসা, মায়া দিতে পারে? কত শত নারীই তো আছে,যারা সুস্থ্য স্বামীর সাথে বছরের পর বছর এক ছাঁদের নিচে থেকেও সেই স্বামী বিকলাঙ্গ হবার পর অন্য পুরুষের হাত ধরে তাকে ছেড়েছে। আর এই মেয়ে কি না শুধু ভালোবাসার টানে নিজের জীবনের সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে কাধে তুলে নিয়েছিল পঙ্গু স্বামীর দায়িত্ব। তাও সেই স্বামী, যে কি না বারবার তাকে অবহেলা আর অপমানের সাগরে ডুবিয়ে রেখেছে। সেই দিন গুলোর কথা মনে হলে রক্তিম আজ নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হয় বারবার। অপরাধবোধে ভারী হয় বুক।

রক্তিমকে আনমনে তার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় বিলীন হতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় দৃষ্টি। মৃদু স্বরে জানতে চায়,

“কি ভাবছেন?”

স্মৃতির দরজায় তালা ঝুলে রক্তিমের। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে স্মিত হেসে জবাব দেয়,

“কিছুনা।চাদর এভাবেই রেখে আগে খেয়ে আসো। বেলা অনেক হয়েছে।”

বরাবরের মতোই রক্তিমের এই অল্প যত্নেই তুষ্ট দৃষ্টি।নির্মল হেসে সম্মতি জানিয়ে বাধ্য স্ত্রীর মতোই চলে যায় ডাইনিং এ।রক্তিম ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পরে।পাড়ি জমায় আবারও ভাবনার জগতে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে