#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪০
#আদওয়া_ইবশার
শীতের রুক্ষতা শেষে যেমন বসন্তের ছোঁয়ায় প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন সাজে। পাতা ঝরা গাছে গজিয়ে ওঠে নতুন পাতা,ফুল,কলি। মানুষের জীবনেও তেমন বিষাদ ঘেরা দিন শেষে অন্ধকার রাতের পর উঁকি দেয় ঝলমলে সূর্য। যার আলোয় নিবারণ হয় রাতের নিকশ অন্ধকার। সূচনা হয় নতুন এক দিনের। আগের দিনটা তলিয়ে যায় অতীত গহ্বরে। কিছু বিষাদীত দিন স্থান নেয় স্মৃতির পাতায়। যা মাঝে সাজে স্বরণে এসে চিনচিনে ব্যাথার সৃষ্টি করে মন গহীনে। একে একে দিন ফুরিয়ে কেটে যায় যেমন প্রতিটা ঋতু, তেমন করেই চলে যায় মানুষের জীবন অন্তিম মুহূর্তের দোরগোড়ায়। কারো মৃত্যু বা বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় জীবন থেমে থাকেনা। একদিন, দুইদিন, তিনদিন, জীবদ্দশায় আমরা যতই ভাবি এই আপন মানুষটার প্রাণ পাখি উড়ে গেলে তার সাথে আমার প্রাণ পাখিটাও উড়ে যাবে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব তৎক্ষণাৎ, সেই আপন মানুষটার মৃত্যুর দিন আমাদের যতটা যন্ত্রণা অনুভব হয়, মনে হয় যে জীবন এখানেই থেমে গেছে, মৃত্যু আমাকেও হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। কিসের জীবন কিসের জিন্দিগী! যেখানে আপন মানুষটা নেই, সেখানে আমিও থাকবনা। এই যন্ত্রণাটুকু,এই উপলব্ধিটুকু সময়ের সাথে সাথে ঠিকই ক্ষীণ হয়ে যায়। বেঁচে থাকি দিব্যি তার শূণ্যতাটুকু অন্য কারো পূর্ণতায় ভুলে গিয়ে, অথবা জীবনের তাগিদে। কথায় আছে মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় না কি সৃষ্টিকর্তা স্বজনদের বুকে পাথর চাপা দিয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় অতি আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রণা। হয়তো সেই কথাটাই ঠিক।না হয় কিভাবে আমরা হারানোর মৃত্যসম যন্ত্রণা ভুলে জীবনে অগ্রসর হই! কেন থেমে থাকেনা আমাদের জীবন! চোখের জল ফুরিয়ে গিয়ে আবার কিভাবে দেখা দেয় ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা! আমাদের মানব জীবনে দুটো জিনিস বিরাট পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়। একটা জন্ম আর একটা মৃত্যু। এই দুটো শব্দ অসাধ্যকে সাধন করে। এক নব জীবনের সূচনায় অনেক সময় আমরা অতীতের হিংসে-বিদ্ধেষ ভুলে এক হই। তেমন করেই কারো মৃত্যুতে মান-অভিমান সব ভুলে এক হই আবারও। সবার জীবনটাকে নতুন করে আরও একটা সুযোগ দেবার চেষ্টা করি। দুই দিনের দুনিয়ায় প্রতিটা প্রাণিই তো ক্ষণিকের অতিথি। তবে কেন এই অস্থায়ী জীবন কেন্দ্র করে এতো এতো অহংকার, এতো গরিমা আর এতো অভিমান! যতদিন নিঃশ্বাস নিতে পারি থাকিনা মনের কালি দূরে রেখে সব ভুলে এক সাথে। ছোট্ট এক জীবনের প্রাপ্তির ঝুলিটা কেন শুধু শুধু আফসোস দিয়েই পূর্ণ করব! বাবার মৃত্যুর পর ঠিক তেমনটা ভেবেই শিকদার বাড়িতে থেকে গেছে রক্তিম-দৃষ্টি। সব ভুলে কাধে তুলে নিয়েছে নিজেদের দায়িত্ব। যে মানুষটা চলে গেছে তার শূণ্যতা পূরণ না হলেও তাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা সহজ হয়েছে সবারই। রক্তিম সাংসদের দায়িত্ব, একজন সন্তানের দায়িত্ব, একজন ভাইয়ের দায়িত্ব, একজন স্বামীর দায়িত্ব ছোট বড় প্রতিটা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে জীবন বাজি রেখে। এই এতো এতো দায়িত্বের ভীড়ে পরে এখন আর বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ না করার অনুতাপ খুব একটা পুড়াতে পারেনা। দৃষ্টি নিজ হাতে তুলে নিয়েছে প্রায় ধ্বসে পরা শিকদার গৃহের দায়িত্ব। সেও নিজের জায়গা থেকে একজন স্ত্রী, একজন পুত্রবধূ ,ভাবীর দায়িত্ব নিরলসভাবে পালন করে যাচ্ছে। স্বার্থহীন ভালোবাসা দুহাতে উজাড় করে দিয়ে ক্ষয়ে পরা সংসারটাকে জোড়া লাগাচ্ছে অল্প অল্প করে। তাকে দেখে এখন আর মনে হয়না সে কোনো অষ্টাদশী কন্যা। মনে হয় পাক্কা এক গৃহিণী। যার গৃহ সামলানোর অভিজ্ঞতা অনেক গুলো বছরের। যে সুনিপুণ হাতে সামলে নিতে পারে গোটা এক পরিবারকে। রক্তিমের মাঝে মাঝে বড্ড আফসোস হয় তার অষ্টাদশী বধূটাকে হারিয়ে ফেলায়। ইচ্ছে হয় কড়াভাবে শাসন করে বলোক,
“এই মেয়ে! কি সব হাবিজাবি রান্না-বান্না আর মশলা-পাতি নিয়ে সারাদিন হেঁশেলে পরে থাকো? সর্বক্ষণ শুধু সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসের কথায় বলে যাও। কেন! মাঝে মাঝে সেই আগের মতো একটু আধটু প্রেমময় কথা বলতে পারোনা! দুই-একটা প্রণয় বাক্য আমার দিকে ছুড়ে দিলে কি তোমার সংসারের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?”
মনের মাধুরী মিশিয়ে অভিযোগ গুলো প্রস্তুত করে ঠোঁটের কাছে নিয়ে যখন পা বাড়ায় দৃষ্টির কাছে গিয়ে ছুড়ে দিতে, ঠিক তখনই একজন পূর্ণ বধূর রুপ দেখে থমকায়। চমকায় তার হাতের জাদুতে প্রাণহীন বাড়িটাকে একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পেতে দেখে। মন বলে,এই সাংসারিক কর্তব্যপরায়ণ বধূটাও বন্দ না। তার হাতের ছোঁয়া পেয়েই তো রক্তিম নতুন এক জীবন পেয়েছে, শিকদার মঞ্জিল হয়েছে অল্প-স্বল্প প্রানোচ্ছল, মা পেয়েছে নিঃসঙ্গ জীবনে সময় কাটানোর সঙ্গী, বোন গুলো পেয়েছে দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো বান্ধবী রূপী ভাবি। সর্বপোরি সে পেয়েছে একজন যোগ্য জীবন সঙ্গীনি। এই নারীর প্রতি সে কিভাবে অভিযোগ রাখবে! যে নারী সর্বক্ষণ ভালোবাসা বিলানোতে ব্যস্ত,কখনো বিনিময় হিসেবে একটু সঙ্গ ছাড়া অঘাত ভালোবাসার আবদার করেনি। সে নারীর প্রতি অভিযোগ রাখা একদম শোভা পায়না।
এমনভাবেই দৃষ্টির মনেও মাঝে মাঝে কিছু অভিযোগ হানা দেয় রক্তিমের প্রতি। মানুষটা সর্বক্ষণ ব্যস্ত শুধু তার দায়িত্ব পালনে। এই দায়িত্ব গুলো একপাশে সরিয়ে এক-আধবার দৃষ্টির দিকে তাকাতে পারেনা!এই যে,শুধু তাকে ভলোবেসে দৃষ্টি নিজের শখ-আহ্লাদ সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে হাতে তুলে নিয়েছে পুরো সংসারের দায়িত্ব, এর বিনিময়েও কি মানুষটা পারেনা ভুল করেই একদিন মিথ্যে মিথ্যেই ভালোবাসি বলতে? কিন্তু পরোক্ষনেই অভিযোগ গুলো হাওয়ায় ভেসে যায় এই ভেবে,ছন্নছাড়া এক পথিক যে সংসারের প্রতি ঝোঁক ফিরিয়ে এনেছে,তাকে ঠাই দিয়েছে নিজের ঘরে নিজের পাশে, গোটা সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে বিশ্বাস করে তার হাতে,এই তো অনেক। তবে কেন অবুঝ মন মাঝে মাঝে এতো উচাটন করে?ভালোবাসার বিনিময়ে যে ভালোবাসা পেতে হবে এমন কি কোনো কথা আছে!রক্তিম মুখে ভালোবাসি না বললেও তো শত ব্যস্ততার মাঝেও তার খোঁজ ঠিক সময় বের করে নেয়। ছোট্ট ছোট্ট কিছু আদুরে যত্নের মাঝে বুঝিয়ে দেয় পাষাণ হৃদয়ে মায়া ছাড়িয়ে ভালোবাসার বিজ বপন হয়েছে। মানুষটা ভালো আছে,পরিবার নিয়ে সুখে আছে, নিজের দায়িত্ব গুলো নিজ তাগিদে পালন করতে শিখেছে এই অনেক। আর কিছুই চাওয়ার নেই দৃষ্টির।
বর্তমানটাকে অতীতে ফেলে আসার পর একে একে প্রতিটা মানুষের জীবনে বিশদ পরিবর্তন এসেছে। ইতি-মেহেদীর কোল জুড়ে তাদের ভালোবাসার সেতু বন্ধন দৃঢ় করতে এসেছে এক পুতুল কন্যা। যার পুতুল পুতুল চেহারার দিকে তাকিয়ে ভুলে যায় তারা এই পার্থিব দুনিয়ার নিষ্ঠুরতা। পবিত্র কোমল এই প্রাণের আগমনে কিছুটা প্রানোদ্দীপনা ফিরে পেয়েছে শিকদার মঞ্জিল। শশুর বাড়ির সবার সাথে সম্পর্ক সহজ হয়েছে ইতির। বিয়ে করেছে রাকিব,শান্ত। জাবিরের সানাই ও বেজে গেছে। আগামী শুক্রবার তার বিয়ে। যে বিয়েতে স্ব-পরিবারে আমন্ত্রিত শিকদার মঞ্জিল। রক্তিম,মেহেদী, জাবির, রাকিব, শান্তর স্বপ্নের ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে। নিজ প্রতিষ্ঠানে গুটিকয়েক বেকারের কর্মসংস্থান গড়ে দেওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে রক্তিমের। পাঁচজন মিলে একটু একটু করে দাঁড় করিয়েছে ইলেকট্রিক ডিলারশিপ ব্যবসা। যেটাতে বর্তমানে তাদের পাঁচজনের পাশাপাশি আরও গুটিকয়েক বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। রক্তিম রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে বর্তমানে শুধু নাম মাত্র সেই ব্যবসার মালিক। পুরোটাই দেখাশোনা করছে বাকী চারজন। কালেভদ্রে যদি জনগণের সেবা করে সময় বের করতে পারে তবে শো-রুমে তার পদধূলি পরে। তার ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে সে নিজেই বহুবার চেয়েছিল ব্যবসা থেকে সড়ে আসতে। কিন্তু দেয়নি আত্মার আত্মীয় সেই দুঃসময়ের সঙ্গী গুলো। তাদের এক কথা, রক্তিমের প্রয়োজন নেই ব্যবসার দিকে তাকানোর। সে শুধু দূর থেকে তাদের বুদ্ধি দিলেই হবে। তারা তার সেই মেধাশ্রম আর নিজেদের কায়িক শ্রমের মাধ্যমেই সফলতার শীর্ষে পদচারনা করবে একদিন।
****
শুক্রবার দিনটা সমস্ত চাকরিজীবি মানুষের ছুটির দিন হলেও ব্যবসায়ী আর রাজধানীর সাথে জড়িত মানুষদের প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ততম দিন। সেই সকালে শুধু এক কাপ চা পেটে চালান করে বেরিয়েছিল রক্তিম, এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। কিন্তু তার আসার কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে মা-বউকে বলে গিয়েছে সময় মতো তৈরী হয়ে থাকার জন্য, সে বারোটার দিকে এসেই তাদের নিয়ে রওনা দিবে জাবিরের বিয়েতে। দৃষ্টিও ভেবেছিল হয়তো অন্যান্য দিন কথা দিয়ে সময় মতো আসতে না পারলেও আজ প্রাণপ্রিয় ছোট ভাই সমতুল্য বন্ধুর বিয়ের উছিলায় ঠিক আসবে। কিন্তু দৃষ্টিকে পুরো হতাশার সাগরে ডুবিয়ে ব্যস্ত এমপি সাহেব লাপাত্তা। মোবাইল ফোন নামক যন্ত্রমানবটাও তার কোনো সন্ধান দিতে পারছেনা। খুশি মনে সকাল সকাল সমস্ত কাজ সেড়ে শাশুড়ি-বউ মিলে তৈরী হয়েছিল বহুদিন পর কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে সামিল হবে বলে। দৃষ্টি সংসারের কাজ থেকে বিরতি নিয়ে নিজেকে সাজিয়েছিল মনের মাধুরী মিশিয়ে। ভারী শাড়ি-গয়না আর প্রসাধনীর অল্প-স্বল্প ছোঁয়ায় নিজেকে ভিন্ন রূপে সাজিয়ে আয়নায় প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসেছিল। ভাবছিল এই প্রথম রক্তিম দৃষ্টিকে এমন সাজে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে! একটু কি নিজের গন্ডি পেরিয়ে এসে প্রশংসা করবে! না কি এক নজর দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিবে! না কি শুধু চোখে মুগ্ধতা মিশিয়ে অপলক তাকিয়েই থাকবে! নিজের মনগড়া এমন শত শত ভাবনায় নিজেই লজ্জার সাগরে ডুবে তৈরী করে ফেলেছিল এক কল্পনার জগত। যে জগতে বিলীন হয়ে ভুলে গিয়েছিল সময়ের কথা। শাশুড়ি মা যখন চিন্তিত বদনে রুমে এসে জানিয়ে যায় সময়ের হিসাব আর ছেলের অপরাগতার কথা, তখনই কল্পনার জগতে বিশাল এক তালা ঝুলিয়ে বাস্তবে ফিরে আসে দৃষ্টি। সেই থেকে অপ্রসন্ন মনে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে রক্তিমের নাম্বারে। কিন্তু সাহেব এতোই ব্যস্ত যে বারবার রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কল। কিন্তু একবারও রিসিভ করার সময় পাচ্ছেনা।ঘড়ির কাঁটা যখন জানান দেয় দুপুর তিনটা বেজে গেছে, তখন এক দলা বিষাদ অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পরে দৃষ্টির কাজল কালো চোখের কোণ বেয়ে। রাগ-অভিমানের মিশেলে অসহনীয় বুকে চিনচিনে ব্যাথা ধরা এক পরিস্থিতির মুখে পরে মুছে ফেলে সমস্ত সাজ-সজ্জা। শাড়ি খুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় সুতির থ্রি-পিস। নিজেকে স্বাভাবিক করে ছুটে শাশুড়ি মায়ের রুমে। মলিন মুখটাকে হাসি খুশী করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে,
“মা! আপনার ছেলে হয়তো কোনো জরুরী কাজ আটকে গেছে। বিয়েতে যাওয়া বোধহয় আর হবেনা। আসুন আমরা খেয়ে নেই। এমনিতেই আপনার দুপুরের ঔষধ খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে।”
পুত্রবধূর মেকি হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানটুকু চোখে বিধে রেহানা বেগমের। বোকা মেয়ে ভেবেছে ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখলেই বুঝি পাক্কা অভিনেত্রীদের মতো অভিনয় করে সত্য লোকানো যাবে। মেয়েটা হয়তো এটা জানেনা, রেহানা বেগম নিজেও বহু বছর আগের অতীতে এমন শত শত দিন ফেলে এসেছে। প্রিয় অর্ধাঙ্গের থেকে সময় না পাবার যন্ত্রণাটাও উপলব্ধি করে এসেছে। কথা দিয়ে কথা না রাখলে যে কষ্টটা হয় তা বুঝে রেহানা বেগম। আজীজ শিকদার নিজেও তো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছেলের মতোই ওনিও এমন কত শত আশা দেখিয়ে নিরাশা করতেন রেহানা বেগমকে! অতীত স্বরণ হতেই সাথে জড়িত মানুষটার কথাও স্বরণ হয়। অতীতের সেই তাগড়া মানুষটা আজ আর নেই। একটা বছর পাড় হয়ে গেছে এই পৃথিবীর বুক থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। কিন্তু এখনো মানুষটার কথা মনে হলে চিৎকার করে কেঁদে বুক ফাঁটাতে ইচ্ছে হয় সেই হারিয়ে ফেলার দিনটার মতোই। মনে হয় বেঁচে থাকাই বৃথা। তবে সন্তান গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে বাঁচার সম্বল পেয়ে সামলে নেয় নিজেকে পূণরায়। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় রেহানা বেগম। দৃষ্টির কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আর একটু দেখি মা! রক্তিম হয়তো জরুরী কাজে আটকে সময় মতো আসতে পারেনি। কিন্তু আসবে ঠিক। আমার ছেলে কথা দিয়ে কখনো কথা রাখেনা এমন হতেই পারেনা।”
শুকনো হাসে দৃষ্টি। তাড়া দিয়ে বলে,
“সে আসলে দেখা যাবে। যখন আসবে তখন না হয় যেতে পারলে যাব। কিন্তু এখন আপনার খেয়ে নেওয়াটা জরুরী। সময় মতো ঔষধ না খেলে কাজ হবে কোনো?”
পুত্রবধূর যত্নে সন্তুষ্ট রেহানা বেগম। মাঝে মাঝে এই অল্প বয়সী মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় সৃষ্টিকর্তা হয়তো এই মেয়েটাকে তার ছেলের বউ হিসেবে ঠিক করে রেখেছিল দেখেই অতীতে সেই ভয়াবহ ঘটনাটা ঘটেছিল। মাঝে মাঝে কিছু খারাপের পিছনেও কিছু ভালো লুকিয়ে থাকে। সেই সময় যদি জেরিন সংগ্রামের এমন ঘটনা সামনে না আসতো তবে কি রক্তিম কখনো জেরিনকে ছাড়তো? আর দৃষ্টিই কি আসতে পারতো এই বাড়িতে বউ হয়ে!
দুজন মিলে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে গল্পগুজবে পাড় করে দেয় পুরো বিকেল। দিনের তেজস্ক্রিয় সূর্যটা তেজ হারিয়ে একটু একটু করে ঢলে পরে পশ্চিমাকাশে। গোধূলির রং ছড়িয়ে পরে সজীব প্রকৃতিতে। অস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যায় প্রকৃতি। দৃষ্টি গল্পের আসর ছেড়ে ওঠে যায়। বৈদ্যুতিক আলোয় পুরো বাড়িটাকে আলোকিত করে শাশুড়ির নামাজ আদায় করে চুপচাপ নিজ রুমে চলে আসে। বাতি নিভিয়ে রুমটাকে অন্ধকার করে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে। বিশাল আকাশটাতে রূপালী থালার মতো চাঁদকে ঘিরে হাজারো নক্ষত্রের মেলা বসেছে। মাঝে মাঝেই শুভ্র মেঘমালা এসে ঢেকে দিচ্ছে নিটোল চাঁদটাকে। এ যেন চাঁদ-মেঘের খুনসুটি। দূর আকাশে নির্নিমেশ তাকিয়ে সেসব দেখে যাচ্ছে দৃষ্টি।ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাসে ভারী হচ্ছে আশপাশ। অতর্কিতে পিছন থেকে ভেসে আসে পরিচিত এক কন্ঠস্বর,
“এখনো রেডি হওনি? দেরী হয়ে যাবে তো আমাদের। দ্রুত আসো।”
আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি হঠাৎ ডাকে ক্ষাণিক চমকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায় কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে রুম। যে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন সু-পুরুষ শুভ্র পাঞ্জাবীর উপর থেকে মুজিব কোট খুলতে ব্যস্ত। সেই দুপুর থেকে রেডি হয়ে যার জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ধৈর্য্যহারা হয়ে একের পর এক ফোনকলেও কোনো হদিশ পেলনা, সেই এখন বাড়ি এসে জানতে চাচ্ছে এখনো কেন রেডি হয়নি!এই মানুষটা কি আদও নিজের ছন্নছাড়া ভাব টুকু পুরোপুরি দূর করতে পেরেছে! যদি পারতোই তবে এতো গুলো ফোন কল পেয়েও এভাবে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারতনা। নিশ্চয়ই বাড়িতে কোনো অঘটন ঘটেছে কি না এমন চিন্তা একটু হলেও হতো। বারান্দায় থেকেই দৃষ্টি শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ফোন কোথায় আপনার?”
“চার্জে লাগিয়েছি মাত্রই। কেন কোনো প্রয়োজন?”
পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয় রক্তিম। তেতে ওঠে দৃষ্টি। তড়িৎ রুমে এসে রক্তিমের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,
“আপনার মাঝে কি সিরিয়াসনেস বলতে কিছুই নেই? না কি শুধু আমার বেলাতেই এমন!”
এক টানে গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে দৃষ্টির হাতে ধরিয়ে দেয়। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,
“বিনে রেখে দাও। বিয়ে থেকে এসে সময় করে ধুয়ে দিও।”
দৃষ্টি বুঝতে পারে রক্তিম আবারও তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছে।আঁখি যুগল উষ্ণ জলে সিক্ত হয়। গাল বেয়ে তা গড়িয়ে পরার আগেই মুছে নেয় ঝটপট।পাঞ্জাবীটা যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে। রক্তিম গোসল সেড়ে রুমে এসে দৃষ্টিকে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাক ছাড়ে। সাড়া দেয়না দৃষ্টি। তবে মিনিট সময়ের ব্যবধানে উপস্থিত হয় রুমে। কিছুটা রাগী ভাব ধরে রেখেই জানতে চায়,
“হয়েছে কি?”
“রেডি হচ্ছোনা কেন?”
“যখন রেডি হয়ে অপেক্ষায় বসে ছিলাম তখন কোথায় ছিলেন? আর বিয়ে দিনে হবার কথা, তো এই রাতে গিয়ে কি করব? ডেকোরেশনের কাজ গোছাতে যাব?”
“কে বলেছে বিয়ে দুপুরে?”
“আপনি নিজেই তো বলেছেন?”
“কখন বললাম?”
“সকালে যাবার সময় কি বলেছিলেন?”
ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
“সকালে বলেছিলাম রেডি হয়ে থাকতে। আমি সময় মতো এসে নিয়ে যাব। একবারও এটা উল্লেখ করিনি বিয়ে দুপুরে। আর ঘরে ইনভাইটেশন কার্ড নেই? তুমি কি অন্ধ না কি অক্ষরজ্ঞানহীন?”
থমথমে মুখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। আসলেই তো!এখানে তো রক্তিমের পাশাপাশি নিজের নির্বুদ্ধিতার দোষটাও সমান। সে যদি একবার কার্ড হাতে নিয়ে পড়ে দেখতো তাহলে এতো কাহিনী হতনা। তবে এটাও ঠিক, রক্তিমকে যে এতো গুলো কল দেওয়া হলো সে কেন ধরলনা!এতে কি আবারও তার ছন্নছাড়া পরিচয় পাওয়া গেলনা! আজ যদি কল গুলো কোনো বিপদে পরে দেওয়া হতো আর রক্তিম এমন করতো তখন কি হতো?ভেবে নিজেও কিছুটা ব্যাঙ্গাত্বক ভাবে বলে,
“আমি না হয় অন্ধ,অক্ষরজ্ঞানহীন। কিন্তু আপনি তো হাই এডোকেটেড,প্রচুর ব্রিলিয়ান্ট,দায়িত্ববাম মানুষ। আপনার ফোনে যে একটা মানুষ লাগাতার এতো গুলো কল দিল আপনি কি সেটা চোখে দেখেন নি? মানুষ তো প্রয়োজনেই ফোন করে। প্রয়োজনের সময় যখন ফোন কাজে লাগবেনা, তখন সেই ফোন সাথে রাখার কি প্রয়োজন!”
“ফোন আমার কাছে থাকলে তো রিসিভ করব! মিটিংয়ে ছিলাম আমি।”
ভাবলেশহীন জবাব রক্তিমের। দৃষ্টি পূণরায় প্রশ্ন করে ওঠে,
“তো মিটিং শেষে ফোন হাতে নেননি? তখন দেখেন নি এতো গুলো কল দিয়েছি?”
রক্তিম এবার যারপরনাই বিরক্ত। আসার পর থেকে কেমন আসামিদের মতো জেরা শুরু করেছে!
“তখন তো বাড়িতে আসার জন্যই বের হয়ে পরেছি। আধা ঘন্টার ব্যবধানে বাড়িতে চলেও এসেছি। যায় হোক,মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে আপনার কল এড়িয়ে যাওয়ার মতো এতো বড় ভুল আর করবনা। এবার দয়া করে রেডি হবেন?”
“কোথাও যাচ্ছিনা আমি।”
অভিমানে ঠাসা উত্তর টুকু ছুড়ে আবারও রুম ছাড়তে উদ্যত হয় দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ হাত ধরে আটকে দেয় রক্তিম। বোঝানোর স্বরে বলে,
“বললাম তো আর এমন হবেনা। যাও, দ্রুত রেডি হও।”
ঝাড়ি মেরে রক্তিমের হাত ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দৃষ্টি,
“পারবনা। একবার রেডি হয়ে সব ধুয়ে-মুছে একটু পর আবার রেডি হবার মতো এতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। মা’কে নিয়ে আপনি চলে যান।”
রক্তিম নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কিছু একটা ভাবে। পর মুহূর্তে মুচকি হেসে বলে,
“আসো, আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি। তোমার এতো কষ্ট করতে হবেনা। শাড়ি কোনটা পরবে বলো।”
বলতে বলতে রক্তিম কাবার্ডের সামনে গিয়ে দৃষ্টির শাড়ি গুলো হাতিয়ে দেখতে থাকে। ভাবনায় পরে যায় দৃষ্টি। বলে কি এই লোক! সত্যিই সে দৃষ্টিকে রেডি করিয়ে দিবে! দৃষ্টির ভাবনার মাঝেই রক্তিম নিজের পছন্দমতো একটা শাড়ি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। একবার শাড়ির দিকে আর একবার দৃষ্টির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলে ওঠে,
“এটাই পারফেক্ট মানাবে। চলো জামা খুলে ব্লাউজ-পেটিকোট পরে নাও।”
লক্ষণ খুব একটা ভালো ঠেকছেনা বুঝতে পেরে দৃষ্টি এক টানে শাড়িটা নিয়ে নেয় রক্তিমের হাত থেকে। ক্রস্থ পায়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। রক্তিম ফিচেল হেসে নিজের কাজে মন দেয়। বউয়ের ত্যারা ঘাড়ের রগ কিভাবে সোজা করতে হয়, এসব টেকনিক খুব ভালো জানা আছে তার।
****
ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।ছলনার সম্পর্কটা যে শেষ পযর্ন্ত বিচ্ছেদে রূপ নিবে কে ভেবেছিল তা! দেশপ্রেমি, সৈনিক প্রেমিকের হাত ছেড়ে সুখের আশায় আকড়ে ধরেছিল তারই ভাইয়ের হাত। মনে ছিল ভালোবাসার থেকেও বেশি আয়েশি জীবনের লোভ। লোভ! হ্যাঁ লোভই তো। সংগ্রাম তাকে প্রথম থেকেই গল্প শুনিয়েছিল বিদেশে সেটেল হবার। গরিব-দুঃখি দেশের ধূলোবালি আর অভাবের জীবন পাড় করা জেরিনও সংগ্রামের গল্প শুনে স্বপ্ন দেখতো এক আয়েশি জীবনের। যে জীবনে কোনো অভাব-অনাটন থাকবেনা। আজীবন পায়ের উপর পা তুলে খাবে। যখন যা খুশি তাই করবে। যেটা রক্তিমের মতো সাধারণ একজন সৈনিকের সাথে থেকে পাবেনা। একজন ডিফেন্সের মাসিক বেতনই বা কত হয়! তাদের তো বিয়ের বাজারে মূল্য শুধু সরকারি চাকরিজীবির খেতাবের জন্য আর রিটায়ার্ডের পর যে মোটা অঙ্কের ভাতাটা পায় তার জন্যই।এটুকু দিয়ে কি আর রাণীর হালে বসে খাওয়া যাবে! তাছাড়া জেরিনেরও ইচ্ছে ছিল তার স্বামী সর্বক্ষণ তার পাশে থাকবে।শুধু তাকে কেন্দ্র করেই নতুন এক পৃথিবী গড়বে।কিন্তু রক্তিমের সাথে থাকলে তা কখনোই হতনা।প্রথমত স্বপ্নের পেশা কখনো ছাড়তনা রক্তিম।বছরে একবার কি দুইবার বাড়ি এসে স্ত্রীর প্রতি হয়তো একটু ভালোবাসা দেখাতো। চার-পাঁচদিন কি এক সপ্তাহ থেকে আবার চলে যেতো।দ্বিতীয়ত বাবা-মা ভক্ত রক্তিম বাবা-মা’কে একা বাড়িতে রেখে স্ত্রীকে নিজের সাথেও নিতনা।সব কিছু ভেবেই রক্তিমের অল্প মায়াটুকু নিঃশেষ করে ঝুকেছিল সংগ্রামের প্রতি। প্রথম প্রথম চাওয়া অনুযায়ী ভেসেছিল সুখের সাগরে। এরপর যে জীবনের গল্পটা এভাবে বদলে যাবে ভাবেনি কল্পনাতেও।
অশ্রু সিক্ত নয়ন মেলে সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে থাকা সংগ্রামের দিকে তাকায় জেরিন। কাঁপা স্বরে বলে,
“মাঝ পথে এভাবে আমাকে ছেড়ে দিতে পারোনা তুমি। এই ভিনদেশে আমি তোমার ভরসাতেই এসেছি। সেই তুমিই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলে কি হবে আমার?এতো নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করতে পারছো তুমি?”
অত্যধিক বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ কুঁচকায় সংগ্রাম। ঝাঝালো স্বরে বলে,
“দুধের শিশু না তুমি। আমার থেকেও ভালো বুঝো সব কিছু। কয়েক বছর আগে যেমন ভাইয়ের হাত ছেড়ে আমার হাত ধরতে পেরেছো,এখনো ঠিক আমার হাত হারিয়ে গেলে অন্য কারো হাত পেয়ে যাবে। তোমাদের মতো মেয়েদের জন্য শুভাকাঙ্খীর অভাব আছে না কি? রাস্তায় নামো, দেখবে খদ্দেরের অভাব নেই।”
টলমলে চোখের অশ্রু কণা এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে অনায়াসে। মৃদ্যু কাঁপন ধরে পুরো শরীরে। রাগে-দুঃখে চেঁচিয়ে ওঠে জেরিন,
“মুখ সামলে কথা বলো।আমি যদি খারাপ হই তবে খারাপের গুরু তুমি। আজ থেকে তিন বছর আগে আমাকে কিভাবে নিজের বশে এনেছো ভুলে যেওনা সেই কথা।”
রগড় করে হাসে সংগ্রাম। বসা থেকে ওঠে এসে জেরিনের দিকে ঝুকে ফিচেল স্বরে বলে,
“কিছুই ভুলিনি ডার্লিং। কিভাবে তুমি আমেরিকা আসার লোভে পরে নিজের শরীর দেখিয়ে আমাকে বশ করেছিলে সব মনে আছে। তোমারও মনে আছে নিশ্চয়ই!শরীর তো এখনো ফিটফাট। আমার উপর এপ্লাই করা একই পন্থা কোনো আমেরিকানের উপর করতে পারো। সাদা চামড়ার শা লা গুলোর এমনিতেই বাঙ্গালী ললনাদের প্রতি ঝোক বেশি। দেখবে তোমার নাগরের অভাব হবেনা। আমার মতো ভাগ্য ভালো থাকলে সাথে ফ্রি গ্রিনকার্ড’ও পেয়ে যেতে পারো।”
শারীরিক আঘাতের থেকেও কথার আঘাত একটা মানুষকে সবথেকে বেশি কষ্ট দিতে পারে। আজ তা আবারও প্রমাণ পেল জেরিন। সংগ্রামের এক একটা কথা শরীরে মনে হচ্ছে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।এই কথার আঘাতে বেঁচে থেকে বারবার মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে মনে হয় মরে যাওয়া ঢের সহজ।আর তর্কে জড়ানোর সাহস হয়না জেরিনের।ঘোলা চোখে ডিভোর্স পেপারের দিকে তাকিয়ে কাঁপা হাতে সই করে দেয়। ছোট্ট একটা কলমের খোঁচায় শেষ করে দেয় পাপের রাজ্যে গড়া সম্পর্কের বন্ধন। কাগজটা সংগ্রামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“মুক্তি দিলাম। তবে মনে রেখো এটাই তোমার শেষ মুক্তি না।পাপের রাজ্য যেমন আমাকে সুখী করতে পারেনি তেমন তোমাকেও পারবেনা।যতটা দোষ আমি করেছি তার সমান দোষী তুমিও। আমার প্রায়শ্চিত্ত প্রায় শেষের পথে,এখান থেকেই শুরু হবে তোমার পালা।”
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেনা জেরিন। শূণ্য হাতে বেরিয়ে যায় সুখের আশায় তৈরী পাপের রাজ্য থেকে। তার চলে যাওয়ায় কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সংগ্রামের। মাথা থেকে যেন মস্ত এক বোঝা নেমেছে। হাফ ছেড়ে ফুরফুরে মনে নিজেও বেরিয়ে পরে এপার্টমেন্ট ছেড়ে। মেইন রোডে যেতেই দেখতে পায় স্থানীয় পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে রেড এলার্ট জারি করেছে। ঘটনা কি ঘটেছে জানার জন্য কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া এক রক্তাক্ত পরিচিত মুখের আদল দেখে থমকে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
চলবে…..
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪১
#আদওয়া_ইবশার
দলীয় মিটিং শেষে নিজের জন্য বরাদ্ধকৃত রুমে এসে বসেছে রক্তিম। সেক্রেটারী তৌফিকের এগিয়ে দেওয়া ঠান্ডা পানির গ্লাস এক নিঃশ্বাসে শেষ করে তাড়া দেয় আরও এক গ্লাস পানির জন্য। পরপর দুই গ্লাস পানি পান করে গরমে অতিষ্ঠ হওয়া তৃষ্ণার্ত প্রাণটাকে শীতল করে চেয়ারে গা এলিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করতেই বিপ বিপ শব্দ তুলে নিজের গুরুত্ব জানান দেয় ফোন নামক যান্ত্রিক বস্তুটা। কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধে কপাল কুঁচকায় রক্তিম। রাজনীতিতে আসার পর থেকে দু-দন্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ারও জো নেই এই ফোনের জন্য। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে টেবিলে অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই দেখতে পায় মরহুম বাবার পার্সোনাল এসিস্টেন্ড রহমত উল্লাহ নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে ফোন রিসিভ করে সালাম জানায়,
“আসসালামু আলাইকুম।”
ফোনের অপর পাশ থেকে বিনয়ী স্বরে সালামের জবাব দেয় রহমত উল্লাহ নামক ব্যক্তি। পরপর রক্তিম বলে ওঠে,
“হ্যাঁ চাচা,বলুন। অসময়ে হঠাৎ ফোন দিলেন! কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
কতক্ষণ মৌন থেকে রহমত উল্লাহ জবাব,
” আসলে বাবা, একটু আগেই সাভার থানার থেকে ফোন এসেছিল।”
রক্তিমের কপালে চিন্তার বলিরেখা দেখা দেয়। উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়,
“থানা থেকে! কিন্তু কেন? কি বলল তারা? বাবার কোনো আইনি ঝামেলা ছিল না কি?”
আসল ঘটনা বলতে গিয়ে অল্প দ্বিধান্বিত হয় রহমত উল্লাহ। সেই সাথে মনে কাজ করে কিছুটা ভীতি। তবুও না বলে উপায় নেই। তার কাজ যেটা সেটা করতেই হবে। গত দশটা বছর একটানা তিনি আজীজ শিকদারের পাশে ছায়ার মতো থেকেছেন। যত ব্যবসায়ীক, রাজনৈতিক আর পারিবারিক ঝামেলাপূর্ণ কাজ-কর্ম সব কিছুতেই আজীজ শিকদার চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছেন তাকে। বাবার চলে যাওয়ার পর রক্তিম সেই দায়িত্ব গুলো ওনার থেকে কেড়ে না নিয়ে উল্টো সম্পূর্ণ ভাড় ছেড়ে দিয়েছে তার কাধে। এমন বিশ্বাসের স্থানে থেকে ওনি পারেননা বিষয়টা গোপন করে যেতে। তাই মনে কিছুটা ভীতি কাজ করলেও সাহস সঞ্চার করে বলেন,
“স্যারকে নিয়ে কোনো ঝামেলা না। আমি সম্পূর্ণটা বলছি বাবা। তুমি সবটা শুনে এরপর যা বলার বলো। আগেই উত্তেজিত হয়ে যেওনা। এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ।”
কুঁচকে থাকা কপাল এবার আরও খানিক বাজে ভাবে কুঁচকে নেয় রক্তিম।গভীর চিন্তায় বোধ হয় স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনক্ষম কোষ। এতোক্ষনের শান্ত-স্বাভাবিক স্বরটাও পাল্টে গিয়ে শুনায় রাশভারী। ভরাট গলায় বলে,
“আচ্ছা বলুন। শুনছি আমি।”
ফোনের অপর প্রান্তের রহমত উল্লাহ এখনো কিছুটা দ্বিধায় এই ভেবে, কথা গুলো ফোনে বলার থেকে সামনাসামনি বলা ভালো হবে কি না! আজীজ শিকদার নিরব-শান্ত, সরল মনের মানুষ হলেও ছেলে রক্তিম শিকদার যে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আজীজ শিকদারের সাথে যেকোন বিষয়ে নির্দ্ধিধায় আলোচনা করতে পারলেও ওনার ছেলের সাথে সামনাসামনি বসে স্বাভাবিক ভাবে আলোচনা করার সাহস এখনো হয়ে ওঠেনি। সেখানে এই ভয়াবহ বিষয়টা নিয়ে সামনে বসে আলোচনা করার সাহস কিভাবে হবে? তাই যতটুকু সম্ভব ফোনের মাধ্যমে বলেই ক্রোধের স্বীকার হতে বাঁচার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবুও এখন ফোনে বলতে গিয়েও কেমন জড়তা কাজ করছে। একেবারে কাল ঘাম ছুটে যাবার দশা। নিজের ভিতরের অস্থিরতা আর উত্তেজনা টুকু কোনোমতে দমিয়ে বলতে শুরু করেন রহমত উল্লাহ,
“গত পনেরো দিন আগে জেরিন রোড এক্সিডেন্ট করে। আলাঙ্কার স্থানীয় পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরদিন কিছুটা সুস্থ্য হলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের সময় জেরিন স্বীকারোক্তি দেয় ওর এক্সিডেন্ট পূর্বপরিকল্পিত। সেদিনই না কি সংগ্রামের সাথে ওর ডিভোর্স হয়। ভারতীয় এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে সংগ্রাম জেরিনকে ডিভোর্স দেয়। সেটা জেরিন মানতে না পেরে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করেছিল। এর আগেও না কি ঐ ভারতীয় মেয়েটার সাথে পরিচয় হবার পর থেকে সংগ্রাম বহুবার চেষ্টা করেছে জেরিনকে মেরে ফেলার। প্রতিনিয়ত শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে। জেরিনের এক্সিডেন্টের পর থেকে সংগ্রামও তাদের এপার্টমেন্ট থেকে পালিয়ে যায়। শহরের আনাচে-কানাচেও তাকে খোঁজে পাওয়া যায়না। জেরিনের স্বীকারোক্তি আর সংগ্রামের পালিয়ে বেড়ানো, সব মিলিয়ে বাজে ভাবেই ফেঁসে যায় সংগ্রাম। পশ্চিমা দেশের আইন কতটা কঠোর জানোই তো। তাদের একদিনও সময় লাগেনি সংগ্রামকে ধরতে। ওখানকার স্থানীয় জেলে পনেরো দিন রেখে বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ করে গতকালই সংগ্রামকে সাভার থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে জেরিনকেও দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ ঐ দেশে তার কোনো গার্ডিয়ান নেই।তাছাড়া দুজনই বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের কেসটা বাংলাদেশ পুলিশকেই হেন্ডেল করতে হবে। সংগ্রাম আমেরিকা যাবার পর তার কোনো প্রয়োজন পরলে সরাসরি আমার কাছেই ফোন করত। আজীজ স্যার’ই তাকে নিষেধ করেছিল সরাসরি ওনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। সেজন্যই বোধহয় পুলিশের কাছেও অভিভাবক হিসেবে আমার কথা বলেছে সে। সংগ্রামের সাথে কথা হয়েছে আমার এক মিনিটের মতো। শুধু বলেছে যে করেই হোক স্যারকে যেন বলি ওর জামিনের ব্যবস্থা করতে।”
অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে পুরো ঘটনা শুনে যায় রক্তিম। এতো বড় একটা ঘটনা তাও সেই বেইমান দুজন মানুষকে ঘিরে। ভিতরে ভিতরে রক্তিম এলোমেলো হলেও বাইরে তা একবিন্দু প্রকাশ করেনা। অপর দিকে রক্তিমের ক্রোধের স্বীকার হওয়ার ভয়ে রহমত উল্লাহ’র অবস্থা সূচনীয়। ধরাস ধরাস শব্দ হচ্ছে বুকের ভিতর। ভয়ের চোটে গলা শুকিয়ে কাঠ। রক্তিম ওনাকে সম্পূর্ণ ভড়কে দিয়ে হিম শীতল কন্ঠে বলে,
“বাবা যে মারা গেছে সেই খবর সে জানেনা এখনো?”
যেখানে রহমত উল্লাহ ভেবে রেখেছিল সংগ্রাম, জেরিনকে নিয়ে কথা বলায় রক্তিম বোধহয় তার বুক ফেরে এক টানে কলিজা বের করে নেওয়ার মতো তান্ডব চালাবে, সেখানে রক্তিমের এমন বিকারহীন হিমশীতল কন্ঠ শুনে চমকায়, থমকায়। ছোট ছোট চোখ দুটো বৃহদাকৃতি ধারণ করে। ভড়কে গিয়ে কয়েক পল নিশ্চুপ থেকে বিমূঢ় স্বরে বলে,
“না বোধহয়। আমি ছাড়া তো আর কারো সাথে যোগাযোগ নেই তার। আমিও বলার সুযোগ পাইনি। তাই বোধহয় জানেনা। জানলে তো আর তার জামিনের জন্য স্যারকে বলার জন্য বলতনা।”
মুখ ভরে তৃপ্তির হাসি হাসে রক্তিম। হঠাৎ করে তার এতো আনন্দ লাগছে! মনে হচ্ছে যেন, বুকের ভিতর চেপে থাকা পাথরটা হুট করেই সড়ে গেছে। বহুদিন পর নিজেকে হালকা অনুভব হচ্ছে। বুক ভরে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। কিছু একটা ভেবে মুহূর্তেই আনন্দ উল্লাস টুকু গিলে নেই শক্ত চোয়ালে জানতে চায়,
” ঐ কালনাগিনী এখন কোথায়? খোঁজ জানেন কিছু?”
রূপক অর্থে ব্যবহৃত শব্দটা দ্বারা রক্তিম যে জেরিনকে বুঝিয়েছে চট করে ধরতে না পারলেও একটুক্ষন ভেবেই বুঝে যায় রহমত উল্লাহ। সাথে সাথে জবাব দেয়,
“আমি খোঁজ নিয়েছি বাবা। ওর মামার বাড়ি ছাড়া তো আর যাবার কোনো জায়গা নেই। তাই মামার বাড়িতেই গিয়েছিল। কিন্তু যেখানে বোনের কোনো জায়গা নেই, সেখানে ভাগ্নির জায়গা হবে কিভাবে? জেরিনের মা অনেক আগে থেকেই না কি প্যারালাইজড হয়ে ঘরে পরে ছিল। পরে ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে ভাইয়ের ছেলেরা। জেরিন ঐ বাড়িতে যাবার পর দরজার সামনে থেকেই তাড়িয়ে দেয় তাকে। আপাতত এক বান্ধবীর বাসায় আছে। চাকরির খোঁজ করছে। একটা চাকরি পেলেই না কি মা’কে নিয়ে আসবে বৃদ্ধাশ্রম থেকে।”
ওষ্ঠ যুগল ছড়িয়ে প্রগাঢ় হাসে রক্তিম। উৎফুল্ল বদনে টেবিলে থাকা পেপার ওয়েট বৃত্তাকারে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“একটা কথা জানেন কি চাচা”
“কি কথা বাবা?”
আবারও মুখ থেকে হাসি সরে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয় রক্তিমের। ধীর কন্ঠে বলে,
“পাপ কখনো বাপকেও ছাড়েনা। আমি অপাত্রে ভালোবাসা দান করে যেটুকু শাস্তি পাবার পেয়েছি। আমার বাবাও নিজের ভুলের মাসুল দিয়েছে শেষ বয়সে একাকিত্বের মর্মবেদনা সহ্য করে। তো ওরা কিভাবে পাড় পাবে? পাপের প্রায়শ্চিত্ত যেখানে শেষ,পাপির বিনাশ সেখানেই শুরু। মানসিক কষ্টে জর্জরিত হয়েও আমার অবচেতন মন কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়নি। আজ হয়তো আল্লাহ আমাকে সেই প্রতিদানই দিচ্ছেন। পুরোপুরি সন্তুষ্ট করেছেন আমাকে।পাপিষ্ঠ গুলোর পরিণতি শুনিয়ে আমার যে কতটা উপকার করেছেন আপনি, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। আমার এতোদিনের ধিকধিক করে জ্বলা তুষের আগুন শীতল হয়েছে। ভাটা পরেছে হৃদয় চরের সর্বগ্রাসীর জোয়ারে। পাপিষ্ঠের পরিণতি জানিয়ে আমার বুকের ভিতরটা শীতল করায় আপনার প্রতি আমি রক্তিম আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
হতবিহ্বল রহমত উল্লাহ। যে উন্মাদের উন্মাদনার ভয়ে বুকে তার এতো কাঁপাকাঁপি, সেই উন্মাদ আজ এতো সাধু! বিষয়টা এমন হয়ে গেলনা, যে হুট করেই ধাউ ধাউ করে জ্বলা আগুন পানিতে রূপ নিয়েছে! এ কি আদও সম্ভব? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রহমত উল্লাহ’র। সাথে এও ভাবছেন, অযথায় এতোক্ষন এতো কাঁপাকাঁপি করে হার্টের বারোটা বাজালো। যে বাঘের ভয়ে জঙ্গল ছেড়ে বাড়ি এসে লুকানো, সেই বাঘই বাড়ি বয়ে এসে বলে, “আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া মামা। আমাকে দেখে ভয় পেয়োনা বাছা।” কথাটা হাস্যকর হলেও কিছুটা এমনই ঘটে গেছে।
“থানা থেকে আবার যদি কেউ ফোন করে কিছু জানতে চায়, বলে দিবেন সংগ্রাম নামের কাওকে চিনেন না। আর হ্যাঁ, ঘটনাটা যেন ভুলেও শিকদার মঞ্জিলের আর কারো কানে না যায়। বিশেষ করে আমার মা। আমি চাইনা আর কোনো কালো ছায়া আমার পরিবারের উপর পরুক। বাবা যেমন আপনাকে বিশ্বাস করতো। আমিও তেমন আপনাকে বিশ্বাস করে দায়িত্বটা দিলাম। আশা করি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা হবেনা।”
রক্তিমের কথায় হুট করেই রহমত উল্লাহ’র ভাবনার সুতোই টান পরে। সম্পূর্ণ কথা শুনে সাথে সাথে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দেয়,
“এক কালে তোমার বাবা আমার মালিক ছিল। এখন ওনার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার মালিক। জীবদ্দশায় তিনি যেমন আমাকে ভরসা করে কখনো ঠকেনি, তুমিও ঠকবেনা। যার নুন খাব তার পিঠে-পিছে ছুরি চালানোর আগে আজরাইল যেন আমার জান কবজ করে নেয়।”
***
সারাটা দিন আবহাওয়া গুমোট ছিল।ভ্যাবসা গরমে উষ্টাগত মানব প্রাণ। সন্ধ্যার পর ঝড়ো হাওয়ায় শীতল হয়েছে প্রকৃতি। ঘন্টা খানিক তুমুল বাতাসের পর শুরু হয়েছে টুপটাপ বৃষ্টি। রাত বাড়ার সাথে বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। সদর দরজা হাট করে খুলে রেখে হল রুমে চিন্তিত ভাবে পাইচারি করে যাচ্ছে দৃষ্টি। পাশেই সোফায় বসে আছেন রেহানা বেগম। তিনিও ছেলেকে নিয়ে অল্প চিন্তিত। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে না জানি কিভাবে বাড়ি আসে! সামান্য ঝড়ো বাতাসেই শহরের বুকে রাস্তার পাশে হুটহাট চোখে পরা দানবাকৃতির গাছ গুলোর ডালপালা যেভাবে ভেঙ্গে পরে, প্রতি বছরই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা শোনা যায়। এসব দেখে-শুনে কি আর নিশ্চিন্তে ঘরে খিল এটে বসে থাকা যায়? দৃষ্টির চঞ্চল চোখ জোড়া একবার সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বৃষ্টির গতি এতোটাই যে,দরজার বাইরের এক হাত দূরেও সব ঝাপসা। হাতে থাকা ফোনটাও চার্জের অভাবে মরার মতো নিশ্চুপ হয়ে আছে। কলেজ থেকে এসে ঘরের কাজ করতে গিয়ে আর ফোনের দিকে নজর দেওয়ার সময় হয়নি। যখন নজর যায়, তখন আবার পুরো শহর ঝড়ের জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন।এদিকে নিষ্ঠুর ঘড়িটাও টিংটিং শব্দ তুলে জানিয়ে দিচ্ছে রাত গভীর হবার বার্তা।পাষাণ শিকদার বোধহয় এই এক জীবনে দৃষ্টিকে কখনো টেনশন ছাড়া অন্য কিছুই দিতে পারবেনা। এই টেনশনে টেনশনে দৃষ্টি যেদিন দুনিয়া ছাড়বে, পাষাণ সেদিন বুঝবে তার জীবনে দৃষ্টি কি অমূল্য রত্ন ছিল। চিন্তার ফাঁকে শাশুড়ির দিকে নজর যায় দৃষ্টির।মানুষটা স্বামী শোকে বয়সের আগেই যেন একদম বুড়িয়ে গেছে। অসুখে জর্জরিত দেহ-মন। এই মানুষটা ছেলের চিন্তায় এতো রাত অবধি জেগে আছে! নিজের থেকেও শাশুড়ির জন্য বেশি মায়া হয় দৃষ্টির। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবে, সে না হয় পরের মেয়ে বউ হয়ে ঘাড়ে ঝুলেছে। তাই তাকে টেনশনে রাখতে পাষাণটার ভালো লাগে। কিন্তু এই বয়স্ক রোগা মানুষটা তো তার নিজের মা। দৃষ্টির কথা না ভাবলেও এই অসুস্থ মানুষটার কথা ভেবেও তো একটু সময়মতো বাসায় ফিরতে পারে! গরু-ছাগল যেমন কখনো মানুষ হয়না, তেমন এই জনম ত্যারা তেদড়টাও বোধহয় কখনো ভালো হবেনা। আজীবন এমনই নিষ্ঠুর, নির্দয় থেকে যাবে। দৃষ্টির ভাবনার আমুল পরিবর্তন হয় হঠাৎ এক ছায়ামানবকে দরজার দিকে দৌড়ে আসতে দেখে। আবছায়া মানুষটাকে দেখে প্রথম দফায় অত্যধিক ভয়ে হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠলেও, কাছাকাছি আসতেই পরিচিত মুখের সন্ধান পেয়ে শান্ত হয়। একেবারে কাক ভেজা হয়ে ঘরে ঢুকেছে রক্তিম। রেহানা বেগম ছেলের এই অবস্থা দেখেই হাই হাই করে ওঠেন,
“এ কি অবস্থা? গাড়ি থাকতে তুই ভিজে আসলি কেন? এই বৈরী আবহাওয়ায় জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে তোর?”
দৃষ্টির এগিয়ে দেওয়া তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে জবাব দেয় রক্তিম,
“গ্যারেজে গাড়ি রেখে এইটুকু আসতে আসতেই ভিজে গেছি।পুরো পথ ভিজে আসলে আমার অস্তিত্ব খোঁজে পেতে না কি!”
সহসা কপট রাগি ভঙ্গিতে বিরবিরিয়ে ওঠে দৃষ্টি,
“পুরো পথ ভিজে না এসে মহারাজ খুব উপকার করেছেন আমাদের।আসুক আজ জ্বর, একদম ঘর থেকে বেরিয়ে যাব আমি। দেখি কে সেবা করে!”
বিরবিরিয়ে কথা গুলো বললেও রক্তিমের মনযোগ দৃষ্টির রাগি মুখটার দিকে থাকায় ওর ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গিতেই বুঝে যায় সব কথা। দাঁতে নিম্নষ্ঠ চেপে নিঃশব্দে হেসে ওঠে রক্তিম। সেই দুপুর থেকে তার কি যে এক রোগ হলো! কারণে অকারণে ঠোঁটের কোণে আপনাতেই হাসি চলে আসছে। অতি বিরক্তিকর কোনো কিছু চোখের সামনে আসলেও মন থেকে খুশি ভাব বিলীন হচ্ছেনা। তার পাগল বউটা যদি তার হঠাৎ পরিবর্তিত এই রূপ দেখে, ঠিক থাকতে পারবে তো তখন? না কি অতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে অ্যাটাক-ফ্যাটাক করে বসবে! ভেবে তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে আরও এক দফা হেসে নিল রক্তিম। পরপর দৃষ্টির দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে জানতে চায়,
“কিছু বললে আমাকে?”
ত্যাড়ছা চাহনিতে রক্তিমের দিকে তাকায় দৃষ্টি। মোমবাতির হলদে অগ্নিশিখায় গম্ভীরমুখোর মুখটা কতটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে! মোহাবিষ্ট হয় দৃষ্টি। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষটার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে অপলক। দৃষ্টির এমন চাহনির তোপে পরে রক্তিম আড়চোখে তাকায় মায়ের দিকে। যে আপাতত দরজা আটকাতে ব্যস্ত। এদিকে ঘুরেই ছেলের দিকে পুত্রবধূকে এভাবে মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখলে সর্বনাশ! জুড়ে জুড়ে কেশে ওঠে রক্তিম। গলা খাঁকারি দিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,
“দ্রুত খাবার দাও। আমি চেইঞ্জ করে আসছি।”
হুশ ফিরে দৃষ্টির। একটু আগের কথা স্বরণ হতেই লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরে গাল জুড়ে। ঝুকে যায় শিরদ্বারা। যেন লজ্জাবতী কোনো মানবের ছোঁয়ায় লজ্জায় মিশে গেছে মাটির সাথে।
চলবে….
(রি-চেইক দেইনি। ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন।)