দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৩৮+৩৯

0
528

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৮(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

পুনঃনির্বাচনী সকল কার্যক্রম সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বাবার পদত্যাগের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছে রক্তিম শিকদার। সর্বদা ন্যায়ের পথে চলা রক্তিম শিকদারকে প্রার্থী হিসেবে পেয়ে জনগণও মহা খুশী। নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে এখন পযর্ন্ত জনগণ নিরলসভাবে রক্তিমের পক্ষে কাজ করে গেছে। তাদের একটাই আশা, অরাজকতার ছোবলে বিপর্যস্ত সাভার আবার রাজকতা ফিরে পাবে। অলিতে-গলিতে যে অশান্তি, মাদক ব্যবসা, আর নারী ব্যবসার আতঙ্ক ছড়িয়ে পরেছে, তা দূর করে নতুন করে শান্তিপূর্ণ সাভার গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে রক্তিম শিকদার। জনগণের এই আস্থা আর ভরসার জায়গা টুকু নিজের মাঝে বুঝতে পেরে রক্তিম আর পিছুপা হতে পারেনি। কিছুটা সংশয়,দ্বিধা আর কিছুটা উদ্দীপনার মাঝে দোদুল্যমান থেকেই রাজনীতির মাঠে নেমেছে। তবে রক্তিমের এমন সিদ্ধান্ত যেদিন থেকে দৃষ্টি জানতে পারে সেদিন থেকেই ঘোর বিরোধীতা করে গেছে। রক্তিম তাকে বুঝাতে গিয়েও ক্লান্ত। দৃষ্টির এক কথা, ছোট্ট এক জীবনে রক্তিমকে সে আর কোনো কষ্ট পেতে দেখতে পারবেনা। না পারবে নিজে আর কোনো যন্ত্রণা সহ্য করতে। রাজনীতি নামক মরন ফাঁদ মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিকতা কেড়ে নেয়। সর্বক্ষণ মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে পথ চলতে হয়। শুধু যে রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তিরই জীবন ঝুকিপূর্ণ হয় এমনটাও না। তার আশেপাশে থাকা প্রতিটা মানুষের জীবন থাকে ঝুকির মুখে। মৃত্যু ভয়ে তটস্থ হয়ে কাটাতে হয় প্রতিটা মুহূর্ত। রক্তিম সব জেনে শুনে কেন আবার দুঃখকে জীবনে ডেকে আনছে! বিষয়টা মানতে পারেনা দৃষ্টি। এই নিয়ে নির্বাচনের শুরু থেকেই দুজনের মাঝে মনোমালিন্যতা। রাগচটা, জনম ত্যারা রক্তিমের সাথে মতবিরোধীতা করতে গিয়ে বরাবরের মতোই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতাকে বরণ করে চুপচাপ তার সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হয় দৃষ্টির।প্রিয় মানুষটাকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া অভিযোগ গুলো মনের মাঝে চেপে রেখেই মানসিক যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে বোবার মতো দেখে যায় প্রতিটা পদক্ষেপ।

সারাদিন ভোট গ্রহণের পর এখন গণনা চলছে। লোকাল টিভি চ্যানেল গুলোতে নির্বাচনী সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। জনগণের মাঝে টানটান উত্তেজনা। রাস্তার পাশের চায়ের স্টল, ঘরে সব জায়গায় টিভির সামনে বসে সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়,কখন ফলাফল প্রকাশ হবে। রক্তিম নির্বিকার।নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতেই সে বসে আছে নিজের দোকানে। যাকে নিয়ে জনগণের এতো মাতামাতি সেই এমন নির্বিকার! এটা কেমন দেখায়? সে তো নিশ্চিন্তে দোকানে বসে আছেই সাথে নিজের সাঙ্গপাঙ্গদেরও বসিয়ে রেখেছে। মেহেদীও আজ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে বন্ধুর পাশে দিন পাড় করেছে। রাকিব, জাবির ভিতরকার উত্তেজনায় এক জায়গায় স্থির বসে থাকতে পারছেনা। উশখুশ করছে কিছু বলতে। কিন্তু রক্তিমের ভাবলেশহীন আচরণে সাহস পাচ্ছেনা। রক্তিমকে ঘিরে দোকানের আশেপাশেও ছোটখাট এক জটলা বেঁধে আছে। অবশেষে সন্ধ্যার অল্প কিছুক্ষণ পর সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। প্রথমবার নির্বাচনে লড়ে জনগণের অগাধ ভালোবাসা আর আস্থায় বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে রক্তিম শিকদার। ফলাফল প্রকাশের পর পরই যুব সমাজ আনন্দ মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পরেছে রাস্তায়। বন্ধুরা সব উত্তেজনায় জাপ্টে ধরে রক্তিমকে। মেহেদী রক্তিমের পিঠ চাপড়ে মুক্ত হাসিতে বলে ওঠে,

” কি রে শালা! এতো বড় একটা জয়ের পরও এখনো এমন ভাবলেশহীন হয়ে আছিস কেন? খুশিতে আমারই নাচতে ইচ্ছে করছে, আর তুই এখনো মুখ কঠিন করে বসে আছিস!”

ভ্রু কুঁচকায় রক্তিম। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

“যেভাবে বলছিস মনে হচ্ছে পায়ের উপর পা তুলে ফুল বিছানায় বসে খাওয়ার লটারি পেয়েছি। নির্বাচনে জিতে এমপি হয়ে নির্বোধেরাই খুশী হয়। আমি কোনো নির্বোধ না যে, পুরো সাভারের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়ে লাফালাফি করব।”

দায়সারা ভাবে জবাব দিয়ে চুপচাপ দোকান থেকে বেরিয়ে যায় রক্তিম। দোকানের সামনে তৈরী হওয়া উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বল্প কথায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করে চলে যায় ভীড় ঠেলে। পথের সঙ্গী বাইকে চড়ে ছুটে বাড়ির দিকে।

দৃষ্টিও খবর পেয়ে গেছে, তার স্বামী বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয় লাভ করেছে। কিন্তু এই জয় মনে আনন্দ দিতে পারছেনা। বরং সময়ের সাথে সাথে অজানা ভয় কামড়ে ধরছে বুকের ভিতর। তবুও রক্তিম বাড়ি আসতেই দৃষ্টি দরজা খুলে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

“অভিনন্দন নব নির্বাচিত এমপি সাহেব। আমার বুকের ভিতর আজন্ম ভয়ের বসতি গড়ে নিজেকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করায় আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ।”

রক্তিম দৃষ্টির দিকে কতক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

“তোমার কি মনে হচ্ছেনা সিম্পল একটা বিষয় নিয়ে তুমি অযথা হাইপার হচ্ছো।”

দীর্ঘক্ষণ উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে দৃষ্টি।ব্যথিত কন্ঠে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

“আমি আসলেই একটু বেশি বেশিই করি। আসলে কি বলুন তো, আমি বয়স কম,ইমম্যাচিউর। ম্যাচিউরিটির ছিটেফোঁটাও নেই আমার মাঝে। তাই এমন করি। প্রতিনিয়ত নিজের কাজে নিজেই বুঝিয়ে দিচ্ছি, আমি আসলে আপনার যোগ্য না। আমার মতো এতো অল্প বয়সী, অতি আবেগী একটা মেয়ের কোনো যোগ্যতা নেই আপনার স্ত্রী হবার। এই বিষয়টা আগেই আমার বোঝা উচিৎ ছিল। কিন্তু না বুঝে আবেগে ভেসে গিয়ে নিজেও ফেঁসেছি আপনাকেও ফাঁসিয়েছি।”

এমন জবাবে চোয়াল শক্ত হয় রক্তিমের। রাগে কপালের দুপাশের রগ ফুলে ওঠে। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে পাগল প্রায় দশা হয়।কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধমকে ওঠে,

“আর একবার মুখ দিয়ে ঐসব উল্টাপাল্টা কথা উচ্চারণ করলে জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব একদম। কি ভেবেছিস তোরা? আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবিনা তোরা?”

একটু থেমে হিংস্র গতিতে এগিয়ে আসে একদম দৃষ্টির নিকটে। হাত দিয়ে দৃষ্টির মুখ চেপে ধরে আবারও বলে ওঠে,

“এতো আবেগ কেন তোদের? এতোদিন পর এসব কথা আসছে কেন? কি বলেছিলাম আমি, মনে নেই? বল কি বলেছিলাম। সত্যি বলতে তোরা সব মেয়েরাই এক। তোরা সবাই শুধু পুরুষের মন নিয়ে খেলত জানিস। তুইও ঐ বেঈমান জেরিনের মতোই হবি। আজকে যখন মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পেরেছিস আমার প্রতি আবেগ ছিল, তখন কাল নিশ্চয়ই সেই আবেগ ঝেড়ে ফেলে আমাকেও ছেড়ে যেতে পারবি।”

কথা গুলো শেষ করে দৃষ্টিকে এক প্রকার ছুড়ে ফেলে চলে যায় রক্তিম। মেঝেতে বসে মুখে হাত চেপে কান্নায় ভেঙ্গে পরে দৃষ্টি। বুঝতে পারে নিজের অজান্তেই রক্তিমকে কত বড় আঘাত করেছে। যে আঘাতে রক্তিমের বুকের ভিতরের শুকনো ক্ষতটাকে আবারও তাজা করেছে। দৃষ্টি তো চাইনি এমনটা হোক। এমন কিছু বলতেও চাইনি। শুধু চেয়েছিল নিজের দুশ্চিন্তা গুলো, অভিমান গুলো প্রকাশ করতে। রক্তিমকে একটু বুঝাতে সে দৃষ্টিকে ঠিক কতটা অবহেলা করছে। কিন্তু এভাবে যে সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে একটুও বুঝতে পারেনি। মাত্রই তো তাদের সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হয়েছিল। ক্ষণিকের জন্য সুখের পাইরা ধরা দিয়ে আবার কেন উড়াল দিল? খুব কি দরকার ছিল দুজনের মাঝে সামান্য বিষয়ে এই ভুল বোঝাবুঝিটা!

রাত গভীর হয়। ঘড়ির কাঁটা টিকটক শব্দ তুলে তুমুল উৎসাহের সাথে নতুন দিনের সূচনা করতে ব্যস্ত। রাত জাগা অলক্ষুণে পেঁচাটা কোনো এক গাছের ডালে বসে করুণ সুরে ডাকছে। সাথে নিশাচর দুই-একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে কেমন একটা গা ছমছমে মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছে। রাগে অন্ধ হয়ে রক্তিম সেই যে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে এখন পযর্ন্ত লাপাত্তা। এতোক্ষন নিজের দুঃখ আর অপরাধবোধে বিলীন থেকে দৃষ্টির রক্তিমের বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তা না হলেও এখন হচ্ছে। স্বামীর চিন্তায় অস্থির হয়ে ভুলে গেছে নিজের শোক। ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর যেতেই আৎকে ওঠে। রাত বাজে আড়াইটা। এই এতো রাতে কোথায় আছে রক্তিম? কোনো বিপদ-আপদ হলো না তো! পাষাণটা এতো অমানবিক কেন? স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া-মনমালিন্যতা হতেই পারে। তাই বলে তাকে সারারাত বাড়ির বাইরে থাকতে হবে? সে কেন বুঝেনা দৃষ্টির অস্থিরতা? এ জন্মে কি আর কখনো বুঝবে, তাকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া গভীর প্রণয়ের জোরেই তাকে হারানোর ভয় দৃষ্টিকে কাবু করে রাখে! এই মাঝ রাতে এখন কি করবে দৃষ্টি? কিভাবে খোঁজবে মানুষটাকে! কান্নার ফলে আগে থেকেই মাথা ব্যথা। এখন আবার চিন্তায় মনে হচ্ছে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। দুই হাতে কতক্ষণ মাথার চুল খামচে ধরে থম ধরে কতক্ষণ বসে থেকে ফোন হাতে নেয়। একের পর এক কল দিতে থাকে রক্তিমের নাম্বারে। কিন্তু ঐ পাশের পাথুরে মানবের হৃদয়ে একটুও দয়া হয়না তার প্রতি। রিসিভ হয়না কল। রিং বেজে বেজে কেটে যায়। গুণে গুণে পনেরোটা কল দিয়ে ক্ষ্যান্ত হয় দৃষ্টি। হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবে, এখন কি করবে? একবার কি অন্য কাওকে ফোন করে দেখবে? কিন্তু এতো রাতে কাকেই বা ফোন দিবে? মেহেদী! না না,তাকে ফোন দেওয়া যাবেনা। এই মাঝ রাতে দৃষ্টির ফোন পেয়ে নিশ্চয়ই বুঝে যাবে তাদের মাঝে কিছু হয়েছে। দৃষ্টি চায়না তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভিতরকার কোনো ঘটনা বাইরের কেউ জানোক। ভেবে ভেবে কোনো কূল না পেয়ে ফের রক্তিমের নাম্বারেই আবার কল দিতে থাকে। এর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। রাতের নিস্তব্ধতার জাল ছিঁড়ে হঠাৎ দরজায় এমন ঠকঠক শব্দ হওয়ায় ভয়ে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে দৃষ্টির। মেঝেতে বসে থেকেই কোনো আওয়াজ না করে কাঁপা হাতে আবারও ডায়াল করে রক্তিমের নাম্বারে। তৎক্ষণাৎ দরজার ঐ পাশে পরিচিত এক ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। বন্ধ দরজার দিকে দৃষ্টি কতক্ষণ বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বুঝতে পারে দরজার অপর প্রান্তে তার অতি আপন রাগচটা, খ্যাপাটে মানুষটা ছাড়া আর কেউ না। তড়িৎ বসা থেকে ওঠে এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় রক্তিমের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে নরম সুরে বলে,

“কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন না একা একা রাতে আমার ভয় লাগে! আমি অন্যায় করেছি তো! রাগ হয়েছিল আপনার ইচ্ছে হলে মারতেন, বকতেন। সব মুখ বুঝে সহ্য করে নিতাম। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে কেন? আপনি জানেন না স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ছোটখাট ঝগড়া হলেও দূরে যেতে নেই! এতে দুজনের মাঝে শয়তান এসে ভর করে।”

দৃষ্টির অশ্রুসজল মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশ কেটে রক্তিম ঘরে ডুকে পরে। গা থেকে শার্ট খুলতে খুলতে ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয়,

“গেটের পাশেই ছিলাম।”

গেটের পাশেই ছিল! তার মানে দৃষ্টির থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। এতো কাছাকাছি থেকে এভাবে ভয় দেখানোর কোনো মানে আছে! কেমন নিষ্ঠুর আচরণ এগুলো! দৃষ্টি কিছু বলতে গিয়েও পিছিয়ে আসে। পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো না। যা বলতে হবে মুখ সামলে ভেবে-চিন্তে। নিজেকে দমিয়ে নিচু স্বরে দৃষ্টি বলে,

“ভাত দিচ্ছি। হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।”

“খেয়েছি।” ছোট্ট করে জবাব দিয়ে হাত-মুখ না ধুয়েই বালিশ টেনে উপুড় হয়ে শুয়ে পরে রক্তিম। দৃষ্টি সন্দিহান হয়ে জানতে চায়,

“কোথায় খেয়েছেন?”

এবার বিরক্ত হয় রক্তিম। কিছুটা রাগের আভাস ধরে রেখে বলে,

“বাজারে খাবারের অভাব?”

চলবে….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৮ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ খাবার ভর্তি প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি। কতক্ষণ পর পর নরম সুরে খাওয়ার জন্য তোষামোদ করে যাচ্ছে রাগের চূড়ায় আসন গেড়ে বসে থাকা অর্ধাঙ্গকে। কিন্তু তার কোনো হেলদুল নেই।এমন ভাবে শুয়ে আছে দেখে যে কেউ ভাববে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার এমন গা ছাড়া ভাব দেখেও হার মানতে নারাজ দৃষ্টি। ভিতরের সত্ত্বা বারংবার চেঁচিয়ে বলছে, কেমন স্ত্রী তুই? না পারিস স্বামীকে বশে আনতে, না পাস এক বিন্দু গুরুত্ব তার কাছে। এখন কি রাগটাও ভাঙ্গাতে পারবিনা? এতো অকর্মণ্য একটা মেয়ে হয় কিভাবে! অসহায় নয়নে কতক্ষণ রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি আবারও অনুরোধের সুরে বলে ওঠে,

“কথা দিচ্ছি,আর কখনো এমন হবেনা। আপনার কোনো কাজে আমি বাঁধা দিবনা। কখনো ঐসব উল্টাপাল্টা কথাও বলবনা। প্লিজ খেয়ে নিন।”

বিকারশূণ্য রক্তিম। দৃষ্টি দমে না। বিভিন্ন ভাবে তাকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে এভাবে অবিরত কথা বলায় রক্তিমের চোখে ঘুম ধরা দিতে গিয়েও উড়ে যায়। শেষ পযর্ন্ত বিরক্ত হয়ে কপট রাগী ভাব নিয়ে পাশ ফিরে দৃষ্টির দিকে গরম চোখে তাকায়। শীতল স্বরে হুমকি ছুড়ে,

“কানের কাছে আর একবার ঘ্যানঘ্যান করলে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে যাব। শুয়ে আছি এটাও ভালো লাগছেনা,আবার বাইরে থাকলেও একের পর এক ফোন দিয়ে পাগল বানাচ্ছো। চাচ্ছোটা কি?”

“খেয়ে নিলেই আমি আর কিছু বলিনা।”

মিনমিনে স্বরে জবাব দেয় দৃষ্টি। রক্তিমের কঠোর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে মাথা নত করে আবার অসহায় কন্ঠে বলে ওঠে,

“এই শেষ বারের মতো মাফ করে দিলে কি হয়? বলছি তো আমার ভুল হয়েছে, আর কখনো এমন হবেনা।”

দৃষ্টির অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে এবার বুঝি পাষাণের হৃদয় একটু নরম হয়। ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে ওঠে যায়। চলন-বলনে রাগের আভাস টুকু ধরে রেখে ধুপধাপ পা ফেলে বাইরে গিয়ে হাত-মুখে পানি ছিটিয়ে আসে। দৃষ্টির হাত থেকে ছু মেরে প্লেট নিয়ে বসে পরে বিছানার এক কোণে। আঙ্গুলের ডগা ভাতে ডুবিয়ে জলদগম্ভীর আওয়াজ তুলে বলে,

“এই শেষ রাতে আমি আর কোনো নাটক চাচ্ছিনা। পেটে ক্ষিদে থেকে থাকলে নিজের প্লেট নিয়ে আসো।”

বহুক্ষণ পর দৃষ্টির বিষাদ ঘেরা মুখে অল্প খুশির ঝিলিক দেখা দেয়। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট হাসি। এই যে তার সামনে অর্ধাঙ্গ রূপে যে মানুষটা রাগের অগ্নিকুণ্ড মাথায় নিয়ে বসে আছে, এই মানুষটার কঠোরতার শক্ত খোলসে আবৃত নরম হৃদয়ের সন্ধানটা সে নিজেই অজান্তে দৃষ্টিকে ছোট ছোট কাজে-কর্মে দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ভাব তার সর্বদা ঠিকই গুরুগম্ভীর। প্রথম দর্শনে হয়তো কারো সাধ্যি নেই তার কঠোর ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যত্ন গুলো পরখ করা। দৃষ্টির সেই সাধ্য হয়েছে। তাকে ভালোবেসে আগলে রাখার দায়িত্ব পেয়েছে। খুব কাছ থেকে চিনতে পেরেছে। তার বাঃহিক রূপ ছাড়িয়ে ভিতরটাকে অনুভব করার বৈধ অনুমতি পেয়েছে। এক জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই দৃষ্টির। এক রোখা, বদমেজাজি,গুরুগম্ভীর মানুষটার থেকে পাওয়া হঠাৎ হঠাৎ ছোট ছোট অমূল্য খুশির বাহক যত্ন গুলো পাওয়ার লোভে না হয় চরম লোভী হয়ে আজীবন তার সাথে থেকে যাবে। সহ্য করে নিবে তার রাগের অগ্নিতাপ। দিন শেষে তো সে নিজেই বৃষ্টিময় প্রেমের শীতল পরশে পুড়ে যাওয়া হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দিবে। তবে ক্ষণিকের জন্য পুড়লে ক্ষতি কি!

দুজনে চুপচাপ খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে শেষ রাতে ক্লান্ত চোখ দুটোকে একটু বিশ্রাম দিতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। রক্তিম সোজা হয়ে চোখের উপর হাত রেখে নির্বিকার শুয়ে থাকলেও শান্ত থাকতে পারেনা দৃষ্টি। উশখুশ করে বারবার নড়েচড়ে ওঠে। ভাবে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে কি না এখনো রেগে আছে না কি!কিন্তু রাগচটার রাগের পারদ নেমেছে কি না তা জানতে গিয়ে যদি আবার হিতে বিপরীত হয়ে যায়! দৃষ্টির অস্থিরতা বুঝতে পেরে রক্তিম প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“সকাল হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী। ঘুমাতে দাও। তুমি সারারাত না ঘুমিয়ে দিনভর ঘুমালেও কোনো অসুবিধা হবেনা। কিন্তু আমার দায়িত্ব, ব্যবসা সব লাটে উঠবে। নড়াচড়া না করে নিজেও পারলে ঘুমাও আমাকেও ঘুমাতে দাও।”

প্রণয় পুরুষের প্রশস্ত বুকে মিশে থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে দৃষ্টি। রক্তিমের রাগ একটু হলেও পরেছে বুঝতে পেরে নির্মল হাসে। লোমশ বুকে আলগোছে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,

“ভালোবাসি গুন্ডা সাহেব।” রক্তিমের ওষ্ঠপোটে স্বচ্ছ হাসির রেখে দেখা দেয়। শক্ত হয় হাতের বাঁধন। নিজেও আলগোছে দৃষ্টির কপালের এক পাশে ঠোঁট ছুঁয়ে জানিয়ে দেয় অব্যক্ত কিছু অনুভূতির কথা।

****
শপথ গ্রহণের পর থেকে রক্তিমের ব্যস্ততা বেড়েছে। রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা ব্যবসার দিকেও নজর দেওয়ার ফুসরত নেই।দোকানের ভার পুরোটা ছেড়ে দিয়েছে রাকিব,জাবির,শান্তর হাতে। তারাও অতি উৎসাহের সাথে পালন করে যাচ্ছে নিজেদের দায়িত্ব।ইদানিং মেহেদীও চেষ্টা করে প্রতিদিন একবার হলেও দোকানে এসে ঘুরে যেতে। বাড়িতে বসে যতটুকু করা সম্ভব সেটুকুও করছে।একের পর এক সংসদীয় কার্যক্রম, মিটিং,জনসভা, এলাকার উন্নয়নের পিছনে ছুটে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে রক্তিমকে বাড়ি ফিরতে হয় রাত করে।দৃষ্টির একা থাকতে অসুবিধা হয় বিষয়টা স্বরণে রেখে তার ব্যবস্থাও নিয়েছে। ছন্নছাড়া রক্তিমের যে চায়ের স্টলে দিন পাড় হতো সেই স্টলের মালিক রমিজ মিয়া দশ বছরের মেয়ে শায়লাকে প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে এসে দিয়ে যায় দৃষ্টির কাছে। শায়লা পাশে থাকায় দৃষ্টির একা থাকার ভয়টাও দূর হয় সাথে শায়লার পড়াশোনাও ঠিকঠাক হয়। যে বিষয় গুলো বুঝতে না পারে যত্ন সহকারে বুঝিয়ে দেয় দৃষ্টি। এছাড়াও শায়লার সমস্ত পড়াশোনার খরচ বহন করছে রক্তিম। বাজারের সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গেলেও চায়ের স্টল গুলো এমনিতেই রাত বারোটা-একটা অবধি খোলা থাকে। রমিজ মিয়া দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাবার পথে আবার মেয়েকে সাথে নিয়ে যায়। এর মাঝে রক্তিমও চলে আসে। রাত-বিরাতে দৃষ্টির বাথরুমের প্রয়োজনের বিষয়টাও মাথায় রেখে বারান্দার এক পাশে নতুন করে পাকা বাথরুমের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হাজার ব্যস্ততার পরও রক্তিম দৃষ্টির বলার আগেই স্ত্রীর প্রতি নিজের দায়িত্ব গুলো পালন করতে কোনো অবহেলা করছেনা। যে মেয়েটার আদুরে পরশে ছন্নছাড়া রক্তিমের জীবনের গতিবিধিতে বিশদ পরিবর্তন এসেছে, অল্প পরিসরে হলেও সুখ ধরা দিয়েছে হাতের মুঠোয়, সেই হৃদয়স্পর্শীর প্রতি দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করা কি সাজে! শত ব্যস্ততা আর কাজের চাপের ভীড়েও সেই ছোট্ট টিনের চালার ঘরে সুখে-শান্তিতে কেটে যাচ্ছে রক্তিম-দৃষ্টির দিন গুলো। একজনের প্রকাশিত ভালোবাসা অপরজনের অপ্রকাশিত মায়ার বাঁধনে গড়ে ওঠেছে মায়াময় এক সংসার। যে সংসারের আনাচে-কানাচে আভিজাত্যের ছোঁয়া না থাকলেও সুখের কোনো অন্ত নেই। যে আরাধ্য সুখের কাঙ্গাল ছিল রক্তিম, যে ভালোবাসার পাগলিনী ছিল দৃষ্টি সেই সুখ-ভালোবাসা দুটোই খোঁজে নিয়েছে দুজন দুজনার মাঝে।

পার্টি অফিসে অনুভূতিশূণ্য জড়বস্তুর মতো বসে আছে রক্তিম। টেবিলের উপর অবহেলায় পরে থাকা ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। কতক্ষণ আগেই মেহেদী ফোন করে জানিয়েছে আজীজ শিকদারকে মাঝ রাতে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো না। হার্টের অবস্থা করুণ। ডাক্তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা। মাঝ রাতে মেহেদী শাশুড়ির ফোন পেয়ে ছুটে গিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। সেই রাত থেকেই না কি বারবার রক্তিমকে এক নজর দেখতে চাইছে। শেষ বারের মতো মাফ চাওয়ার সুযোগ চাইছে। ঘটনা বিস্তারিত শোনার পর থেকেই রক্তিম স্তব্ধ। বিকারশূণ্য হয়ে বসে আছে এক জায়গায়। থমকে যাওয়া রক্তিমের স্তম্ভিত ফিরে আবারও রিংটোনের শব্দে। এবার কলটা এসেছে আদরের বোনের নাম্বার থেকে। রক্তিম চেয়েও উপেক্ষা করতে পারেনা। নিশ্চল ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কানে ঠেকায়। সাথে সাথে অপর পাশ থেকে ভেসে আসে ইতির গগনবিদারী চিৎকার,

“আমার বাবা আর নেই ভাইয়া। ভাইয়া রে আমার বাবা নেই।”

আর কিছুই শুনতে পারেনা রক্তিম। হাত ফসকে ফোনটা পরে যায় মেঝেতে। মস্তিষ্ক উদ্দিপনা যোগাতে ব্যর্থ হয়। বিহ্বল হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে জড়বস্তুর ন্যায়। মিনিট অতিক্রম হতেই কাচের দরজা ঠেলে ধরফরিয়ে রুমে ডুকে জাবির। রক্তিমকে স্থির বসে থাকতে দেখে কাঁপা স্বরে ডেকে ওঠে,

“ভাই!”
কোনো সাড়া নেই রক্তিমের। মস্তিষ্ক বোধহয় এবারও ব্যর্থ অনুভূতি সঞ্চারে। জাবির ছুটে এসে রক্তিমের কাধ ঝাকিয়ে আবারও ডেকে ওঠে,

“ভাই শুনতে পারছেন না! ভাই চাচা মারা গেছে। ও ভাই! কিছু তো বলেন।”

তড়িৎ বিদ্যুৎ পৃষ্ঠের মতো চমকে ওঠে রক্তিম। বুকের ভিতর নিদারূণ এক ব্যথার উৎস খোঁজে পায়। প্রশস্ত দেহটা বলহীন হয়ে ভেঙ্গে পরত চায়। কথা বলার শক্তি টুকুও পায়না। কুচকুচে কালো মণির আশেপাশে চোখের রগ গুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে ভয়ংকর হয়ে আছে। সেই রক্ত লাল চোখ দুটো মেলে শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে জাবিরের দিকে। বাবা নেই! এসব কি বলছে এরা? সে চেয়েছিল বাবা নামক মানুষটার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে শুধু তার ভুল গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে। কিন্তু তাই বলে বাবা এভাবে তার মনে অভিমান পুষে দুনিয়া থেকে চলে যাবে! এভাবে এতিম বানিয়ে দিবে রক্তিমকে! আর কিছুই ভাবতে পারেনা রক্তিম। চোখে জমাট বাঁধা অশ্রু বাঁধ ভাঙ্গে। অনর্গল গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা ভাসে। মনে হয় পৃথিবীটা ঘুরছে। ভেঙ্গেচুড়ে একাকার হচ্ছে মন।

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৯
#আদওয়া_ইবশার

বিরান শূণ্য শিকদার মঞ্জিল আজ মানুষের পদচারনায় গমগমে। চারিদিকে আপন মানুষের হাহাকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আগর বাতির কড়া ঘ্রাণে মো মো করছে চারপাশ। পুরো এলাকা জুড়ে মাইকিং হচ্ছে একটি শোক সংবাদ। পাপের রাজ্য থেকে বিদায় নিয়েছে এক পাপী মানব। চিরমুক্তি পেয়েছে দুঃখ-কষ্ট, একাকিত্ব আর আত্মগ্লানি থেকে।বাবা ছেলের পুরো ঘটনা জানার পর যে মানুষ গুলো মুখ ভরে নিন্দা করেছিল প্রকাশ্যে-গোপনে, আজ সেই মানুষ গুলোই মুখে আফসোসের সুর তুলে গাইছে গুণগান। কিন্তু এই গুণগান, সহধর্মিণীর হৃদয়বিদারক চিৎকার, সন্তানদের বুক ফাঁটা আর্তনাদ, এর কিছুই কি শুনতে পারছে আজীজ শিকদার? দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দেবার পর এই হাহাকার, আফসোস, আত্মচিৎকার নিশ্চয়ই শোনার কথা না!সে ঘুমিয়েছে। চিরনিদ্রিত আজ সে জাগতিক সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে।শুরু হয়ে গেছে আপন মানুষের মাঝে তার চিরবিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ।যে মানুষটাকে কেন্দ্র করে এতো এতো আয়োজন,সে আজ প্রাণহীন নিথর দেহে পরে আছে বাড়ির আঙ্গিনায়। উত্তাল জনগণ কেউ বলছেনা,ঐ তো ঐ উঠোনে এলাকার প্রাক্তন মেয়র অথবা এমপি শুয়ে আছে। লাশ নামক এক ভারী শব্দে ঢাকা পরেছে নশ্বর পৃথিবীর দানে পাওয়া সম্মান,মর্যাদা, অহংকার। উঠোনে পেতে রাখা চৌকিতে চাদরে ঢাকা দেহটাকে সবাই শুধু দূর থেকে দেখে বলছে, ঐটা লাশ। আজীজ শিকদারের লাশ। এক পাপিষ্ঠের লাশ। যে পাপিষ্ঠ সন্তানের ভালো করতে গিয়ে করেছে খারাপ।শেষ সময়ে এসে হয়েছে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ থেকে বহু বছর আগে যাকে চিরসঙ্গী করে বধূ রূপে এনেছিল নিজ ঘরে, কথা দিয়েছিল মৃত্যু সময়েও থাকবে একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। সেই চিরসঙ্গী স্ত্রীও বুঝলনা প্রাণপ্রিয় স্বামীকে। শেষ বয়সে পাশে থাকার বদলে সন্তানের জীবন ধ্বংসের কারণ দর্শিয়ে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে।যে সন্তানদের সুখের কথা ভেবে, সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায়, সুস্থ্য স্বাভাবিক একটা জীবন দেবার আশায় কাটিয়েছে একের পর এক নির্ঘুম রাত। বিসর্জন দিয়েছে নিজের সুখ-শান্তি।সেই সন্তানরাও তাদের ভালোর আশায় করা অতি ক্ষুদ্র একটা ভুলকে আকাশসম ভেবে ছুড়ে ফেলেছে বাবা নামক পুরোনো বট গাছটাকে। আজ তার বিদাইয়ের সানাই বাজতেই সেই স্ত্রী-সন্তান পুড়ছে দহনের আগুনে। আফসোস করে মরছে,কেন শেষ বয়সে এসে এমনটা করল! দুইদিনের দুনিয়ায় বাঁচেই বা কয়দিন? কিসের বড়াই,কিসের অহংকার,কিসের রাগ-জেদের বশবর্তী হয়ে ছিন্ন করেছিল বাঁধন? এ আজন্ম আফসোস কি কাওকে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে দিবে? রক্তিম যদি বাবার করা ভুলটাকে ক্ষমা করে শেষ কালে তার পাশে থাকতো তবে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? হয়তো কোনো ক্ষতি হতনা। তবে সৃষ্টিও হতনা আজকের এই গল্প।

বাবার লাশের পাশে শরীর ছেড়ে মাটিতে বসে আছে রক্তিম। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাদরে ঢাকা নিথর দেহটার দিকে। চারদিকে কি হচ্ছে, কে কি বলছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছেনা। বাবা নামক বট বৃক্ষটাকে হারিয়ে আজ যে সে নির্জীব,নিষ্প্রাণ। ভাবছে সৃষ্টিকর্তা তাকে কতটা দুর্ভাগা করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। আজ বাবার মৃত্যুর পর যে ভুলটাকে অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছে, সেই ভুলের কারণেই বাবার শেষ ইচ্ছটুকুও পূরণ করতে পারলনা। পারলনা শেষ বারের মতো বাবার মুখের একটা কথা শুনতে। ইতি কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। তার এই অবস্থায় অতিরিক্ত শোক-কান্না অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ বুঝতে পেরে মেহেদী ডাক্তার ডেকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে। রেহানা বেগম কাঁদতে কাঁদতে এখন একদম নিশ্চুপ। দেখে মনে হচ্ছে অতি শোকে পাথর চেপেছে বুকের ভিতর। স্মৃতি মায়ের পাশে বসে কেঁদে যাচ্ছে। দৃষ্টি নিরব কান্নাকে সঙ্গী করে প্রতিবেশী মহিলাদের সাথে কোরআন খতম দিতে বসেছে। মাগরিব বাদ আজীজ শিকদারের জানাজা ঘোষণা করা হয়েছে। উঠোনের এক পাশে বড় পাতিলে বড়ই পাতা দিয়ে গরম পানি করা হচ্ছে। তার পাশেই কাপড়ে ঘেরাও দিয়ে গোসলের জায়গা বানানো হয়েছে। মসজিদের ইমাম সাহেব রক্তিমের কাধে হাত রেখে বলে,

“বাবা! তোমার বাবা চিরদিনের জন্য যে ঘরটাতে ঘুমাবে,সে ঘরটা তুমি নিজের হাতে যত্ন নিয়ে বানিয়ে দাও। আর তো কখনো বাবার জন্য দোয়া ছাড়া কিছুই করতে পারবেনা। শেষ সুযোগটা কাজে লাগাও।”

নিষ্প্রভ চোখ দুটো থেকে আবারও গড়িয়ে অশ্রুকণা।অনুতাপের আগুনে ঝলসে গিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে শব্দ করে। বাবা তো চেয়েছিল তাকে আরও একটা সুযোগ দিতে। শেষ বারের মতো সন্তানের সাথে কথা বলতে। তখন কেন এতো নিষ্ঠুর হয়েছিল রক্তিম?কেন আল্লাহ তাকে একটু বোধশক্তি দিলনা? কেন সব ভুলে ছুটে গেলনা জন্মদাতার ডাকে? এই অনুতাপের আগুন বুকে নিয়ে কিভাবে কাটাবে রক্তিম বাকিটা জীবন? রাকিব,জাবির,শান্ত সবার চোখেই চিকচিক করছে অশ্রুজল। কেউ বুঝে পাচ্ছেনা কিভাবে নিজেদের সামলাবে, আর কিভাবেই বা কি বলে শান্তনা দিবে শোকাহত মানুষ গুলোকে। রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সবসময় ভাই, বন্ধুর মতো পাশে থাকা মানুষ গুলো আজও রক্তিমের পিছু ছাড়েনি। আপন রক্ত যেখানে চূড়ান্তভাবে বেঈমানি করে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে, সেখানে রক্তেমর কোনো টান না থাকা সত্বেও আত্মার টানে তারা ঠিক এখনো রয়ে গেছে কাছেপিঠে। হয়তো মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত এভাবেই থেকে যাবে। রক্তিমকে কোনো মতো শান্ত করে রাকিব, জাবির,শান্ত তিনজন নিয়ে গেছে কবরস্থানে। রক্তিম নিজেও কিছুটা বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেকে শক্ত করে লেগে যায় কবর খোড়ার কাজে। যত্ন নিয়ে তৈরী করে বাবার শেষ ঠিকানা। কবর খনন শেষে বাবার শেষ গোসলটাও নিজে করাবে বলে জানায়। এলাকার মুরুব্বিদের সহযোগীতায় উষ্ণ গরম পানিতে বাবার শেষ গোসল সম্পন্ন করে,কাফন চড়িয়ে নিজেও গোসল সেড়ে শ্রুভ্র পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নেয় বাবাকে চিরবিদায় দেওয়ার জন্য। রেহানা বেগমের গা থেকে রঙিন কাপড় খুলে সাদা কাপড় পড়িয়ে লাগিয়ে দেয় বিধবা তকমা। শেষ বারের মতো প্রাণহীন মুখটা সবাইকে এক নজর দেখিয়ে খাটিয়াটা ঢেকে দেয় শামিয়ানা দিয়ে। দহনের যন্ত্রণা বুকে চেপে রক্তিম কাধে তুলে নেয় বাবার লাশের খাটিয়া। আপন আত্মীয়র কান্নায় ভারী হয় আবার আশপাশ। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মাটির নিচে চাপা পরে যায় আজীজ শিকদারের অস্তিত্ব। মুছে যায় পৃথিবীর বুক থেকে।

জানাজা শেষে একে একে বিদায় নেয় কাছের-দূরের আত্মীয় গুলো। নিষ্প্রাণ বাড়িটাতে বুকে যন্ত্রণার আগুন চেপে থেকে যায় শুধু খুব কাছের কিছু মানুষ। উঠোন জুড়ে এখনো আগর বাতির ঘ্রাণ। যে পাতিলে গরম পানি করা হয়েছে সেই পাতিলটাও পরে আছে সেখানেই। যে চৌকিটাতে গোসল করানো হয়েছে সেটাও একই জায়গায় আছে। শুধু ফাঁকা পরে আছে লাশ রাখার জায়গাটা। শুনশান হয়ে আছে একটু আগের কোলাহলপূর্ণ বাড়ি। দুতলার একটা রুম থেকে ক্ষণেক্ষণে সঙ্গী হারানোর গুনগুন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। একদিকে শাশুড়ি আরেকদিকে অন্তঃসত্ত্বা ননদ, দুজনকে সামলাতে গিয়ে এখন পযর্ন্ত রক্তিমের খোঁজ টুকু নেওয়ার সাধ্যি হচ্ছেনা দৃষ্টির। ভিতর ভিতর শুধু ছটফট করে যাচ্ছে মানুষটার মনের অবস্থা উপলব্ধি করে। পাড়া-পরশির বাড়ি থেকে প্রয়োজনের থেকেও অধিক খাবার চলে এসেছে। বাঙ্গালী মানুষ অন্য কিছু না পারলেও প্রায় সব এলাকায় এটা খুব ভালো পারে তারা। মৃত বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে স্বজনপ্রীতি দেখানোর বেলায় কারো থেকে কেউ পিছিয়ে থাকেনা। রাত আটটার দিকে শাশুড়িকে অল্প কিছু খাওয়াতে সক্ষম হয়ে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে বড় ননদকে পাশে রেখে ছুটে যায় ছোট ননদের রুমে। মেহেদী ইতির পাশেই ছিল। দৃষ্টিকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে খাবারের প্লেট রেখে তাকে পাঠিয়ে দেয় রক্তিমের কাছে। বলে,

“ওকে আমি সামলাতে নিব। খাবার রেখে তুমি রক্তিমের কাছে যাও। ও ভালো নেই দৃষ্টি। তার পাশে এখন তোমার থাকা প্রয়োজন।”

বেদনামিশ্রীত শুকনো হেসে সায় জানিয়ে খাবার রেখে এই বাড়িতে নিজেদের জন্য বরাদ্ধকৃত রুমের দিকে পা বাড়ায় দৃষ্টি। হালকা ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা আস্তে করে খুলে ভিতরে ঢুকে দেখতে পায় শান্ত ভঙ্গিতে বিছানার এক কোণে বসে আছে রক্তিম। পাশেই জাবির, শান্ত বিভিন্ন কথার ছলে শান্তনা দেবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। অল্প আওয়াজ করে দৃষ্টি নিজের অস্তিত্ব জানান নিয়ে জাবিরদের উদ্দেশ্যে বলে,

“বড় আপু আপনাদের খেতে ডাকছে ভাইয়া। সকাল থেকেই সবাই না খেয়ে আছেন। এভাবে খাওয়া-দাওয়া ভুলে পরে থাকলে তো লাভের লাভ কিছুই হবেনা। উল্টো নিজেরাও অসুস্থ হয়ে পরব।”

জাবির,শান্ত রুম ছাড়তেই রক্তিমের দিকে তাকায় দৃষ্টি। দৃষ্টির আসার আভাস পেয়েও সে এখনো নির্জীব বসে।জানাজা পড়ে আসার পর থেকে এখনো মাথা থেকে টুপিটাও খুলেনি। এক দিনেই কি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! বেদনার ছোঁয়ায় কঠোরতায় ঘেরা মুখটাই যেখানে এতোটা বিধ্বস্ত, তবে না জানি মনস্তাপে ভিতরটা কিভাবে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে! ভাবতেই দৃষ্টির সিক্ত নয়ন জোড়া অশ্রুসজল হয়। প্রাণ প্রিয় অর্ধাঙ্গের মর্মবেদনায় মুচড়ে ওঠে নিজের বুকটাও। শুকনো ঢোক গিলে কান্না চেপে ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে আসে দৃষ্টি। আলগোছে মাথা থেকে টুপিটা খুলে একপাশে রেখে এলোমেলো চুলের ভাজে ডুবিয়ে দেয় নরম হাত দুটো।ঐটুকু ভরসার ছোঁয়া পেয়ে বহু কষ্টে চেপে রাখা যন্ত্রণা ঠিকরে বেরিয়ে আসে রক্তিমের। এক ঝটকায় দৃষ্টিকে সামনে এনে কোমর জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো পেটে মুখ গুজে কেঁদে ওঠে শরীর কাঁপিয়ে। অস্ফুট স্বরে অভিযোগ জানায় নির্মম ভাগ্যের প্রতি,

“ভাগ্য আমার সাথে এমন নিষ্ঠুর খেলা কেন খেলছে?কি পাপ করেছিলাম আমি? কেন বারবার আমার জীবনটাই এভাবে এলোমেলো হচ্ছে? এই এতিম শব্দটারই বুঝি কমতি ছিল আমার জীবনে?নিজের ভাগ্য দোষে আজ সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব। এতোদিন দূরে থাকলেও জানতাম আমার মাথার উপর ঠিক বাবা নামক ছায়াটা আছে। কিন্তু আজ থেকে জানতে হবে আমার কিছুই নেই। যে গাছের পাতা সে গাছটা আমাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে অবহেলায় ফেলে রেখে চলে গেছে। ঝরে গেছি আমি ঢাল থেকে। আমি কেন এতো খারাপ হলাম? এ জগতে কি আমার মতো এমন নিষ্ঠুর সন্তান দ্বিতীয়টা আছে? বাবার শেষ ডাকটাকেও উপেক্ষা করলাম আমি। পারলাম না তাকে মন ভরে বাবা বলে ডাকতে।এই আফসোস নিয়ে আমি কিভাবে পাড় করব বাকিটা জীবন?”

পুরুষ মানুষের কান্না যে এতো করুণ হয়, তা রক্তিমকে কাঁদতে না দেখলে হয়তো জানতোই না দৃষ্টি। নিজের থেকেও বেশি যে মানুষটাকে ভালোবেসেছে তার এমন করুণ দশা কিভাবে সহ্য করবে সে? রক্তিমের এক একটা আর্তনাদের সাথে হোল ফুটছে দৃষ্টির বুকের ভিতর। ঠোঁট কামড়ে ফুপিয়ে কেঁদে থুতনি ঠেকায় রক্তিমের মাথায়। দুই হাতে আকড়ে ধরে প্রশস্ত দেহটা। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। কোমর থেকে রক্তিমের হাত ছাড়িয়ে তার পাশে বসে দুই হাতের আজলায় তুলে নেয় কান্নারত মুখটা। জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে ভাঙা স্বরে বলে,

“আপনি এভাবে ভেঙ্গে পরলে আমাদের কি হবে? মা, ইতি আপু,স্মতি আপু আমাদের সবার একমাত্র অভিভাবক এখন আপনি। বাবা যে আপনার কাধে অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে গেছে। ওদের সবাইকে ভালো রাখার, দেখে রাখার দায়িত্ব এখন আপনার। জীবনে মানুষ অনেক ভুল করে, সেই ভুল থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়। তাছাড়া আপনি যা করেছেন তা তো আপনার দিক থেকে দেখতে গেলে কোনো ভুল খোঁজে পাওয়া যাবেনা। আপনি তো জানতেন না এভাবে অসময়ে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। ভাগ্য বলেই মেনে নিন সবটাকে। নিজেকে সামলান। মনোবল শক্ত করুন। এভাবে ভেঙ্গে পরলে কি বাবা ফিরে আসবে? জন্ম যার আছে মৃত্যু তার নিশ্চিত। আজ হোক কাল একদিন না একদিন আমাদের সবাইকেই তো মরতে হবে। পুরোনো কিছু আপন মানুষ হারিয়ে কিছু নতুনের আগমনে হাসি-আনন্দ, দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করেই কাটিয়ে দিতে হবে আমাদের পুরোটা জীবন। বাবাকে অবহেলা করে যে অনুতাপের আগুনে পুড়ছেন, বাবার শোকে এখন আবার মা’কে অবহেলা করে একই অনুতাপে নতুন করে পুড়বেন না প্লিজ!”

দায়িত্ব! সত্যিই তো আজ না চাইতেও এই সংসারের এই সংসারের প্রতিটা মানুষের দায়িত্ব নিজ থেকেই চলে এসেছে রক্তিমের কাধে। এতোদিন যে বাবা থাকার সুবিধা গ্রহণ করে দেদারসে দিন পাড় করেছে দায়িত্বহীন হয়ে। কিন্তু এখন তো বাবা নামক সেই অবহেলিত মানুষটা আর নেই। তবে তার দায়িত্ব গুলো ঠিকই রয়ে গেছে। এবং তা বর্তেছে সন্তান হিসেবে রক্তিমের কাধে। অনুতাপের আগুনে পুড়ে হৃদয় ছাআ করে এই এতো এতো দায়িত্বের ভার কিভাবে বহন করবে রক্তিম! বাবাকে অবহেলা করার প্রতিশোধ হিসেবে এতো বড় শাস্তি দিতে পারলেন তিনি! দুহাতে অশ্রু মুছে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে নিরব পদচারনায় চলে যায় মায়ের রুমে। পিছন পিছন কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ছুটে যায় দৃষ্টি। মা’কে ঘুমাতে দেখে উল্টো ঘুরে ঘুরে আসে দুই বোনের রুমে। একে একে পুরো নিস্তব্ধ বাড়িটা হেঁটে হেঁটে কিছু সুখ সুখ অবহে ঘেরা স্মৃতি কুড়িয়ে চলে যায় আজীজ শিকদারের সবথেকে প্রিয় জায়গা স্টাডি রুমে। টেবিলের উপর দেখতে পায় বাবার চশমাটা অবহেলায় পরে আছে। সাথে আধ খাওয়া চায়ের পেয়ালা। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাবার কতক্ষণ আগেও বোধহয় বাবা স্টাডি রুমে এক কাপ চায়ের সাথে সময় পাড় করেছে। এই রুমটাতে ঢুকতেই যেন হাট করে খুলে রাখা উত্তরে জানালার ফাঁক গলিয়ে আসা স্মৃতির হাওয়া জড়িয়ে ধরে রক্তিমকে। একে একে মনে করিয়ে দেয় অতীতে রুমটাতে বাবার সাথে কাটানো কিছু টুকরো টুকরো মধুর মুহূর্ত।পূরণীয় ঝাপসা হয়ে আসে চোখ দুটো। জ্বলেপুড়ে ছাই হয় ব্যথিত হৃদয়। ভেঙ্গে আসে শরীরটা। খিঁচে বন্ধ করে নেয় চোখ দুটো। বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরে উষ্ণ জল। বিরবির করে জপে, “এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে আমার মতো আর কোনো পাপী সন্তানের জন্ম না হোক। অনুতাপের অগুনে ভস্ম না হোক আর কারো জীবন।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে