দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৩৬+৩৭

0
530

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৬
#আদওয়া_ইবশার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য আলাঙ্কা’য় আজ থেকে আড়াই বছর আগে সংগ্রাম এবং জেরিন নিজেদের বসতী গড়েছিল। অচেনা দেশে পূর্ব পরিচিত কেউ না থাকাই লাঞ্চনার কোনো অন্ত ছিলনা দুজনের। আজীজ শিকদার শুধুমাত্র দুজনকে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে হাতে অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ঐ কয়টা মূদ্রার মূল্যে পশ্চিমা দেশে তাদের দুদিন ও ভালো করে তিন বেলার খাবার জোটেনি। এমনও বহু দিন পাড় হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য শুধু পানি খেয়ে কাটিয়ে দিতে হয়েছে দুজনকে। সংগ্রাম সেই সময়টাতেই উপলব্ধি করেছিল একটা কথা। নির্বোধ বাঙালি মনে করে পশ্চিমা দেশ মানেই সুখ-শান্তি, টাকা আর টাকা। আমেরিকা, জাপান, ইতালির মতো যেকোনো একটা দেশে যেতে পারলেই বোধহয় চোখের পলকেই কোটিপতি হওয়া যায়। কিন্তু যে একবার বাস্তবতার জাতাকলে পৃষ্ঠ হয়েছে একমাত্র সেই জানে, চাকচিক্যময় দেশ গুলোতে শত শত বাঙালিদের কত হাহাকার। নিজ দেশে যে মানুষ চাইলেই পারে দুজন হেল্পিং হ্যান্ড রাখতে, তাকেও শুধুমাত্র পেটের দায়ে কাজ করতে হয় মানুষের বাসায়। অবশ্য পশ্চিমা দেশ গুলোতে কোনো কাজকে ছোট বা খাটো করে দেখা হয়না। যারা এসব ছোট-বড় কাজের তফাৎ সৃষ্টি করে, তারা এই অধম বাঙালিই। দীর্ঘ পনেরো দিন প্রচেষ্টার পর সংগ্রাম একটা রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম জব জোটাতে পেরেছিল। এরপরই না খেয়ে থাকার দিন ঘুরেছিল তাদের। নিজ ভূমিতে আপন কিছু মানুষের জীবন নরক করে দিয়ে দিব্যি সুখে কাটাচ্ছিল দিন গুলো।ভুলে গিয়েছিল জেরিন রক্তিম নামক কোনো পুরুষ ছিল তার জীবনে। যাকে চরম ভাবে ঠকিয়েছে সে। সংগ্রাম ও হয়তো ভুলে গিয়েছিল রক্তিম নামক কোনো একটা ছেলের সাথে রক্তের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের সাথে বেইমানি করে ভাইয়ের ভালোবাসা ছিনিয়ে ভাইকে ফেলে এসেছিল অনলে। পৃথিবীতে যেন তারাই সুখী। কাওকে ঠকিয়ে জীবন্ত লাশে পরিণত করে সেই ভার কাধে নিয়েও যে এতোটা সুখী হওয়া যায়, তা হয়তো তখন তাদের না দেখলে বোঝা যেতনা। তবে সুখ কি কারো জীবনে চিরস্থায়ী হয়? সুখ-দুঃখ যে একে অপরের ভাই এটা ভুলে গেলে হবে না কি? মনুষ্য জাতি একে অপরের সাথে বেঈমানি করতে পারলেও, প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা পরে সুখ-দুঃখ কখনো নিজেদের বন্ধন আলগা করেনা। তারা ঠিক তাদের নিয়ম অনুযায়ী চক্রাকারে জীবনে ঘুরতেই থাকে। যেমন করে ঘুরেছিল সংগ্রাম-জেরিনের জীবনে। প্রথম প্রথম জেরিনের প্রতি সংগ্রামের আগ্রহের কোনো কমতি না থাকলেও ধীরে ধীরেই যেন সেটা ফিকে হতে থাকে। রেস্টুরেন্টের ডিউটির অযুহাত দেখিয়ে বাইরে একের পর এক রাত পাড় করে ফেলে। মুখ ফোটে কিছু বলতে পারেনা জেরিন। প্রতিবাদ করতে গেলেই সংগ্রাম সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিত, এই দেশে তাদের টিকতে হলে ইনকাম বাড়াতে হবে। টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল। আর পরিশ্রম ছাড়া টাকা কখনো ধরা দিবেনা। টাকা ইনকাম করতে হলে সেক্রিফাইস করতেই হবে। নতুন পুরুষের মোহে অন্ধ হয়ে জেরিন প্রথম প্রথম সংগ্রামের কথা মেনে নিলেও একটা সময় ঠিক বুঝে সংগ্রাম তাকে বোকা বানাচ্ছে। তার চোখে ধুলো দিয়ে একই রেস্টুরেন্টে কর্মরত এক ইন্ডিয়ান রূপসীর প্রেমে মজেছে। সত্যটা জেরিন যেদিন জানতে পারে আনমনেই সর্ব প্রথম রক্তিম শিকদার নামক এক ব্যর্থ প্রেমিকের কথা মনে পরে। সেই সাথে কিঞ্চিৎ ভাবনার উদয় হয়, সংগ্রামের বেঈমানির কথা জেনে তার যেমন উপলব্ধি হচ্ছে রক্তিমেরও কি একই রকম উপলব্ধি হয়েছিল ! না কি বুকের বা পাশে সৃষ্টি হওয়া চিনচিনে ব্যথাটা রক্তিমের আরও প্রগাঢ় ছিল! হয়তো একটু বেশিই ছিল। কারণ রক্তিম তো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ভাইয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছিল। আর জেরিন শুধু কিছু প্রমানের ভিত্তিতে জেনেছে। ফোন নামক যান্ত্রিক ডিভাইসটাতে দুজনের কিছু আপত্তিকর মুহূর্তের স্থিরচিত্র দেখেছে। বুকের ভিতরটা তবুও কেমন পুড়ছে! আর রক্তিম! এরপর জেরিন আর তার কথা ভাবতে পারেনি। শুধু অনুভব করতে পেরেছিল কিছু একটা অদৃশ্য ভাবে তার নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছিল। শ্বাস নিতে না পেরে ডাঙায় উঠা কই মাছের মতো ছটফট করছিল। একটু স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আকুতি করছিল সৃষ্টিকর্তার নিকট।

অভার টাইম নামক বাড়তি আয়ের মনগড়া গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুৎসিত সত্যটা জানার পর জেরিন যতবার প্রতিবাদ করতে গিয়েছে, ঠিক ততবার সংগ্রামের শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে। তবুও মুখ বুজে সমস্ত অত্যাচার সহ্য করে পরে থাকতে হয়েছে তার কাছেই। এছাড়া যে কোনো উপায় ছিলনা। তার কর্মফলেই তার সমস্ত বাঁচার উপায় বন্ধ করে দিয়েছিল। কাচকে হীরা ভেবে মোহে পরেছিল তার। পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়েছিল আসল হীরেকে। সাময়ীক সুখের মোহে পরে আজীবনের জন্য নিজ হাতে খুন করেছিল ভাগ্যে থাকা রক্তিম নামক সুখ চিহ্নটাকে। সেই খুনীর তো এখন তার কর্মফল ভোগ করতেই হবে। প্রকৃতি যে প্রতিশোধ নিতে কখনো কার্পণ্য করেনা। আর সৃষ্টিকর্তাও ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। দুনিয়াতেই একটু হলেও দেখিয়ে দেয় কর্মফলের শাস্তি।

রাতা বারোটা। উদোম গায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। বডি স্প্রে হাতে নিয়ে ভুসভুস করে পুরো শরীরে স্প্রে করে একে একে গেঞ্জি, শার্ট, জ্যাকেট চাপিয়ে পরিধেয় পোশাকের উপর আবারও লাগিয়ে নিয়েছে নিজের অতি প্রিয় পারফিউমটা। যে পারফিউমের মাতাল ঘ্রাণেই এক সময় বোধ হয়েছিল জেরিন, আজ সেই পারফিউমের ঘ্রাণটাই মনে হয় সবথেকে জঘন্যতম। বুকে চাপা কষ্ট গুলো যত্ন করে বুকে রেখেই বিছানায় বসে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সংগ্রামের সাজসজ্জা। সে যখন টিপটপ রেডি হয়ে ওয়ালেট পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে রুম থেকে বেরুতে যাবে তখনই বাধ সাজে জেরিন। জোর গলায় জানতে চায়,

“কোথায় যাচ্ছো?”

ফিচেল হাসে সংগ্রাম। কাধ ঝাকিয়ে বলে,

“প্রতিদিন যেখানে যায় সেখানেই। জেনেও কেন বারবার অযথা প্রশ্ন করে নিজের ক্যালোরি লস করো?”

বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় জেরিন। হাতের মুঠোয় থাকা জিনিসটা সংগ্রামের সামনে মেলে ধরে অশ্রুসজল চোখে বলে,

“আমাদের সম্পর্কটা এখন আর আগের মতো নেই সংগ্রাম। কিন্তু তবও দেখো ভুল সময়ে আমাদের ভালোবাসার ফসল এই পৃথিবীতে আসতে চলেছে। আমরা কি পারিনা তাকে একটা সুন্দর পরিবার উপহার দিতে? সুন্দর একটা জীবন দিতে!”

জেরিনের ধরে রাখা প্রেগনেন্সি কিটের দিকে এক পলক তাকায় রক্তিম। কিটে পজেটিভ সাইন দিচ্ছে। এর মানে জেরিন অন্তঃসত্ত্বা! বিরক্তিতে সংগ্রামের মুখগহ্বর তিতো হয়ে ওঠে। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

“নাটক করবেনা একদম। এটা প্রথম না, যার কারণে এমন আবেগে ভেসে গিয়ে ইমোশনফুল হয়ে যাবে। আর কি ই বা বলছি আমি! তোমরা বাঙালি মেয়েরা তো সর্বদায় ছোটখাট বিষয় নিয়েই ইমোশনাল হয়ে পরো। যায় হোক, ঐসব আমার দেখার বিষয় না। কাজের কথায় আসি। টাকা রেখে যাব। কালকে একসময় গিয়ে এবর্শন করে এসো।”

“আর কত! আর কত সংগ্রাম? আর কত নিজের সন্তানের হত্যাকারী হব আমি? এবার অন্তত আমাকে রেহাই দাও। এর আগেও দুইবার আমাকে বাধ্য করেছো এবর্শনের জন্য। এবার যদি এমনটা করি হতে পারে আর কখনো আমি সন্তানের মুখ দেখতে পারবনা। আজীবন নিঃসন্তান হয়ে থাকতে হবে। এটা আমি পারবনা। আমারও ইচ্ছে হয় মা ডাক শুনতে।”

নিমিষেই এতোক্ষনের ফুরফুরে মেজাজটা বিগড়ে যায় সংগ্রামের। খপ করে জেরিনের মাথার ডান দিকের এক গাচি চুল খামচে ধরে। সাথে সাথে ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে জেরিন।চোখ দিয়ে ঝড়ে পরে অবিরাম অশ্রুকণা। সংগ্রাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে,

“মা**দের আবার মা হবার শখ হয় কিভাবে? তোকে যে আমি খাইয়ে পরিয়ে দয়া দেখিয়ে নিজের কাছে রাখছি এই তো অনেক। এরপর আবার আরেকটাকে দুনিয়ায় আনতে চাস? আমার কাছে থাকতে হলে আমি যা বলব তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। নইলে তোর অস্তিত্ব চিরতরে এই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলব।”

কথা গুলো শেষ করে এক প্রকার ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দেয় জেরিনকে। হাত ঝেড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। মেঝেতে পরেই বুক ফাটা আর্তনাদে ভেঙ্গে পরে জেরিন। চারপাশ ভারী হয় এক পাপিষ্ঠের পাপের শাস্তির প্রতিফলনে।

****
চুলায় ভাত বসিয়েছে দৃষ্টি। পিছন পিছন তরকারিটাও কেটে রাখছে। কলেজে একটা জরুরী ক্লাস ছিল আজ। না গেলে নাই হতো। কলেজ থেকে আসার সময় ঢাকা শহরের যানজটের বিরম্বনায় পরে দেরী হয়ে গেছে অনেকটাই। সকালে তাড়াহুড়ো করে শুধু অল্প ভাত ফুটিয়ে রাতের বেঁচে যাওয়া তরকারি দিয়েই দুজন খেয়ে নিয়েছিল। এখন এসে আবার তাড়াহুড়োয় রান্না বসাতে হয়েছে। দোকানের শত ব্যস্ততার মাঝেও রক্তিম সময় করে তিন বেলা বাড়িতে এসেই খেয়ে যায়। ডাক্তারের নিষেধ মেনে বাইরের তৈলাক্ত খাবারে হাত লাগায়না। এখন যদি বেচারা পুরো বেলা দোকানে খাটাখুটি করে ক্ষিদে নিয়ে বাড়িতে এসে খাবার না পায়, কেমন লাগবে! যদিও রক্তিম কোনো উচ্চবাচ্য করবেনা, কিন্তু তাকে সময় মতো খাবার দিতে না পেরে বেশি খারাপ তো দৃষ্টিরই লাগবে।

যাকে সময় মতো খাবার দেবার জন্য দৃষ্টির এতো তাড়াহুড়ো,পাতিলের চাল ফুটতে না ফুটতেই সে এসে হাজির। রক্তিম বারান্দায় এসে দৃষ্টির দিকে তাকাতেই থমকে যায়। অবাক, বিস্ময়ে জানতে চায়,

“কাঁদছো কেন?”

“মেরেছে?” মেরেছে! মানে কি? রক্তিম শিকদারের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবে! কার এতো সাহস?ক্রস্থ পায়ে এগিয়ে যায় রক্তিম দৃষ্টির দিকে। উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,

“কে মেরেছে?”

“পেঁয়াজ।” বটিতে পেঁতাজ কুচি করতে করতেই জবাব দেয় দৃষ্টি।দ্রুত কাজ করতে গিয়ে নজর তুলে আর তাকায়না। যদি একবার তাকাতো,তবে হয়তো দেখতে পেত রক্তিমের শান্ত চোখ দুটো সে কি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে! দৃষ্টিটা আসলেই একটু বেশিই ফাজলামি করে। যত ধরনের কু-বুদ্ধি আছে সবসময় মাথায় ঘুরে বেড়ায়। যে দিকটা রক্তিমের একদম অপছন্দ। তবে কিছুই বলেনা রক্তিম। রাগ টুকু শরীরে পিষেই চলে যায় রুমের ভিতর। কাপড় নিয়ে নিরবে আবারও বেরিয়ে চলে যায় কলপাড়ে গোসলের উদ্দেশ্যে। রক্তিমের গোসল শেষ হতে হতেই দৃষ্টির ভাত রান্না শেষ হয়ে যায়। পরপর পেঁয়াজ, কাচা মরিচ দিয়ে একটা ডিম ভেজে নেয়। রক্তিম আসতেই সামনে ধোয়া উঠা গরম ভাত আর ডিম ভাজি দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে,

“এখন এটা দিয়েই একটু কষ্ট করে খেয়ে নিন প্লিজ! ম রা র জ্যামে পরে আমার রান্নার বারোটা বেজে গেছে।”

কোনো দ্বিরুক্তি করেনা রক্তিম। চুপচাপ ভাত মাখিয়ে এক লোকমা নিজে খেয়ে দৃষ্টির কাছে গিয়ে আর এক লোকমা এগিয়ে দেয় তার মুখের দিকে।

“হা করো।”
কাজে ব্যস্ত দৃষ্টি বলে ওঠে,
“আমি এখন খাবনা। আপনি খেয়ে নিন। রান্না শেষ করে গোসল করে পরেই খাব।”

চোখ পাকায় রক্তিম। হালকা ধমকের স্বরে বলে,

“কি বলছি কানে যাচ্ছেনা!”

যত্ন করবে আবার ধমকও দিবে! এ কেমন মানুষ রে বাবা! কাজ থামিয়ে রক্তিমের দিকে ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। শান্ত ভঙ্গিতে বলে,

“আমাদের পাশের বাড়ির দাদি সবসময় একটা কথা বলত, “স্বভাব যায়না মলে, খাছালত যায়না ধুইলে।” দাদির মুখে যতবার কথাটা শুনেছি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রবাদটা খাঁটি সত্য।”

কথা শেষে রক্তিমের বাড়িয়ে রাখা লোকমাটা টুপ করে মুখে পুড়ে নেয় দৃষ্টি। আবারও মনযোগ দেয় নিজের কাজে। এদিকে রক্তিম বা হাতে প্লেট নিয়ে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“অন্যকে বলার আগে নিজের দিকটা একটু দেখে নিলে ভালো হয়। যার স্বভাব কথায় কথায় বিছার মতো ফাল মারা, সে আবার অন্যকে প্রবাদ বাক্য শোনায়। ইডিয়ট কোথাকার!”

ভেবেছিল তার মতো দৃষ্টিও সেই সকালে অল্প পরিমাণ খাওয়ার পর এখন পযর্ন্ত না খাওয়া। সে নিজে খেয়ে চলে যাবে, আর মেয়েটা রান্না শেষ করে কখন না কখন খায়!দরদ দেখিয়ে গিয়েছিল খাইয়ে দিতে। এখন মনে হচ্ছে এই বাচাল কন্যার প্রতি মায়া দেখানোটাই সবথেকে বড় ভুল। সে খাক মন চায় না খাক, ঐসব দেখতে গিয়ে শুধু শুধু আর নিজের ভালো মেজাজটা খারাপ করবেনা রক্তিম। মেয়ে মানুষ এতো চঞ্চল হয় কিভাবে! রাগে গজরাতে গজরাতে প্লেট হাতে রুমে চলে যায় রক্তিম। দৃষ্টি সেদিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

“আরেহ! এটা কি হলো? আমাকে মারার প্ল্যান করছেন না কি? দাদি বলেছিল এক লোকমা খেলে না কি সাঁতারে পরে মরতে হয়। আরেক লোকমা দিয়ে যান প্লিজ!”

কে শুনে কার কথা! দৃষ্টির কথা কানেই তুলেনা রক্তিম। চুপচাপ খেয়ে ওঠে পরে। কতক্ষণ শুয়ে অল্প বিশ্রাম নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় দৃষ্টির কাজ কতটুকু শেষ হয়েছে। চুলায় তরকারি চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি। রক্তিম আবারও বিছানায় বসতে বসতে ডেকে ওঠে,

“কাজ শেষ হলে এদিকে আসো একটু।”

এক ডাকেই চুপচাপ লক্ষি মেয়ের মতো সাড়া দিয়ে চলে আসে দৃষ্টি। রক্তিমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায় কেন ডাকা হয়েছে তাকে। আলনায় মেলে রাখা শার্টের বুক পকেট থেকে ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে আনে রক্তিম। বিছানায় উপুড় করতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক জোড়া চুড়ি, একটা চেইন,এক জোড়া নূপুর। অবাক নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। রক্তিম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দৃষ্টির হাত টেনে চুড়ি গুলো পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

“সব জেনে শুনেই চাঁদ হয়ে বামনের ঘরে এসেছো।বউকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে রাখার সাধ্য আমার নেই। রাজপ্রাসাদে রাখার সাধ্যও নেই। নূপুর দুটো রুপার হলেও বাকী গুলো সিটি গোল্ড।আপাতত এই টিনের ঘরে থেকে সিটি গোল্ড পড়েই খুশি থাকতে হবে। এর থেকে বেশি কিছু দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।”

চুড়ি দুটো পড়িয়ে দৃষ্টির পিছনে দাঁড়ায় রক্তিম। দৃষ্টি টের পায়, রক্তিমের এক একটা গরম নিঃশ্বাস আচড়ে পরছে তার উন্মুক্ত ঘাড়ের উপর। সহসা চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয়। চেইন পড়িয়ে দেওয়ার সময় রক্তিমের অল্প ছোঁয়া গায়ে লাগতেই অজানা এক শিহরণে ভারী হয়ে আসে নিঃশ্বাস। উথালপাথাল ঝড় ওঠে মন গহীনে। নাম না জানা এই ঝড়ের কবলে পরে বেসামাল অনুভূতিদের ভীড়ে পৃষ্ঠ হয় হৃদয়। ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে। সাথে কাঁপে বন্ধ চোখের পাপড়িদ্বয়। রক্তিম টের পায় নাজুক দৃষ্টির কাঁপন। অনুভব করতে পারে অনুভূতির প্রগাঢ়তা। আলগোছে চেইনের হুক লাগিয়ে দৃষ্টিকে আরও একটু নাজুক করতে পিছন থেকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে রক্তিম। এমন নিগূঢ় আলিঙ্গনে তড়িৎ চমকে বন্ধ চোখের কপাট খুলে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পেটের কাছে রাখা পুরুষালী হাতের দিকে তাকায় দৃষ্টি। তার এমন ভড়কে যাওয়া ভঙ্গিমা দেখে মিটমিট হাসে রক্তিম। মজার ছলে কাধের উন্মুক্ত অংশে সিগারেটে পোড়া ওষ্ঠদ্বয় হালকা চেপে ধরে। আৎকে ওঠে দৃষ্টি। পূণরায় খিঁচে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। বুকের ভিতরে চলা অশান্ত ঝড়ের শব্দটা যেন এবার প্রকট হয়। এ কি সর্বনাশা কান্ড শুরু করেছে রক্তিম? হুট করেই এমন নিদারুণ,নিষ্ঠুর যাতনা সহ্য করা যে কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠছে দৃষ্টির। রক্তিমের এক একটা ছোঁয়া মনে হচ্ছে গায়ে আগুনের ফুলকি ছিটাচ্ছে। শিরা-উপশিরায় ছলকে ওঠছে রক্ত। এক প্রবল উষ্ণ আবেশে ক্রমশ নেতিয়ে যাচ্ছে হৃদয়ারন্য। সইতে না পেরে ছিটকে দূরে সরে আসে দৃষ্টি। ফিচেল হাসে রক্তিম। দু-পা এগিয়ে আলগোছে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলে,

“এটুকুতেই এমন নাজেহাল অবস্থা! একটু গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিলে তো মনে হয় দুনিয়াতেই খোঁজে পাওয়া যাবেনা।”

নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে ভয়-লজ্জা, আবেশে দিশাহারা দৃষ্টি দেবার মতো জুৎসই কোনো জবাব খোঁজে পায়না। অস্পষ্ট স্বরে বিরবিরিয়ে শুধু বলে,

“আপনি প্লিজ আবার আগের মতো হয়ে যান। এই আপনিটাকে আমার বড্ড ভয় লাগছে।”

শরীর দুলিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পরে রক্তিম। হাসির শব্দে আস্তেধীরে চোখ দুটো খুলে তাকায় দৃষ্টি। ক্ষণকাল আগের কথা স্বরণ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর সাহস পায়না। ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। কি অদ্ভূত কান্ড! যে পুরুষকে পাবার আশায় এতোদিন এতো আয়োজন, এতো দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা, আজ সেই পুরুষের অল্প ছোঁয়ায় তার থেকেই পালিয়ে বাঁচতে চাইছে মন। এমন দু-মুখো সাপের মতো আচরণ কেন করছে মন!

চলবে….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৭(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

দোকানে বসে অত্যন্ত মনযোগ সহিত হিসাবের কাজে ব্যস্ত রক্তিম। মাত্র এক মাস হয়েছে দোকানটা দাঁড় করিয়েছে,এর মাঝেই রক্তিম, মেহেদী,জাবির, রাকিব, শান্ত পাঁচজন মানুষের নিরলস পরিশ্রমের ফলে ব্যবসা রমরমা। যেটুকু রক্তিমের একার উদ্যোগে করলে হয়তো সম্ভব হতনা।সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো কিছু শুরু করলে সেটাতে সৃষ্টিকর্তার রহমত থাকে। সেজন্যই বোধহয় স্বল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করা ব্যবসার প্রসার ঘটতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়নি।ইতিমধ্যে একই মার্কেটে আরও একটা দোকান ভাড়ায় নিয়ে নিয়েছে। দুই-একদিনের ভিতর সেটাতেও মাল-পত্র তুলে ফেলবে। ভেবে রেখেছে ব্যবসায় ভালো একটা পজিশন করতে পারলেই মোটা অংকের একটা লোন তুলে অন্য আরেকটা ব্যবসায় হাত লাগাবে। মানুষ তো তারা কম না। আল্লাহ চাইলে সকলে মিলে ঠিক সব দিক সামলে সফল হতে পারবে। নিজেদের পাশাপাশি ভবিষ্যতে হয়তো অন্য দুই-একজন মানুষের কর্মসংস্থান’ও গড়ে তুলতে পারবে।

হিসাবের কাজ শেষ করে নতুন দোকানটা নিয়েই সকলে মিলে আলোচনায় মজেছে। এর মাঝেই হুট করে দোকানে এসে উপস্থিত হয় পার্টি অফিসের কিছু সিনিয়র সিটিজেন। সাথে এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। হঠাৎ এভাবে সবাইকে দোকানে উপস্থিত হতে দেখে নিজেদের আলোচনা স্থগিত রেখে চুপ হয়ে যায়। অবাক নেত্রে একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম। স্বাভাবিক স্বরেই জানতে চায়,

“হঠাৎ আপনারা এখানে?”

পার্টি অফিসার বর্তমান সভাপতি আখতারুজ্জামান হেসে বলে ওঠে,

“দেখতে আসলাম তোমার দোকান কিভাবে সাজালে। কেমন চলছে ব্যবসা। তুমি নিজে তো আর চায়ের দাওয়াত দিলে না,তাই আমরাই চলে এলাম। গল্পে গল্পে হালচাল জানা হবে, সাথে চায়ের আড্ডাও হবে।”

স্মিত হাসে রক্তিম। নিজেরা ওঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। ইশারায় রাকিবকে জানায় চায়ের ব্যবস্থা করতে। তৎক্ষণাৎ রাকিব ছুটে যায় কাছের চায়ের স্টলে। দুই মিনিটের ভিতর প্রত্যেকের জন্য ট্রে ভর্তি চা নিয়ে হাজির হয়। আখতারুজ্জামান সাহেব নিজে বসে রক্তিমকেও বসতে বলে। দাঁড়িয়ে থেকেই রক্তিম জবাব দেয়,

“এতোক্ষণ পযর্ন্ত বসেই ছিলাম। এখন দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। অসুবিধা হচ্ছেনা। আপনারা বলুন কিজন্য এভাবে হুট করে আমার দোকানে আসা।”

রক্তিম নিজের কথার মাঝেই সবাইকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয়, তারা যে কোনো না কোনো এক উদ্দেশ্য নিয়েই রক্তিমের কাছে এসেছে, তা সে খুব ভালো করেই জানে। বুঝতে পেরে আখতারুজ্জামান মুচকি হাসে। ধোয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,

“বুঝতেই যখন পেরেছো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি, তখন আর কথা না বাড়িয়ে কাজের কথায় আসি। তুমি তো জানোই আজীজ ভাই শারীরিক অক্ষমতার ইস্যু দেখিয়ে পদত্যাগ করেছে। এখন আবার পুনঃনির্বাচন হবে। শুনছি লিয়াকত বিল্লা আবারও দাঁড়াবে। আমরাও শিওর নিজের ক্ষমতার দাপটে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন সেই পাবে। তার সাথে লড়ার জন্য যে সাহস আর ধীর মনোবল প্রয়োজন এমন কাউকে আমরা পাচ্ছিনা। এলাকার সচেতন মানুষ হয়ে আমরা এটাও মেনে নিতে পারবনা, লিয়াকত বিল্লার মতো একজন কুটনৈতিক মানুষের হাতে আবারও নিজেদের এলাকার দায়িত্ব বর্তাবে। আমরা আবারও আমাদের আসনের জন্য যোগ্য একজন এমপি চায়। যে নিঃস্বার্থ ভাবে এলাকার উন্নয়নের কথা ভাববে, মানুষের কথা ভাববে। আর এলাকার অধিকাংশ মানুষের চোখেই সেই যোগ্য ব্যক্তি একমাত্র তুমিই। পার্টিও তোমাকে নোমিনেশন দিবে। এর জন্য যা করতে হয় সব আমি করব। তুমি শুধু একবার সবার কথা ভেবে রাজি হয়ে যাও।”

তাচ্ছিল্য হাসে রক্তিম। শ্রাগ করে বলে,

“কৌতুক শুনাচ্ছেন না কি বুঝতে পারছিনা। লাইক সিরিয়াসলি! আমার মতো একটা গুন্ডা,মাস্তান নির্বাচন করবে, জনগণ তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করে এমপি বানাবে? সত্যিই আপনার কৌতুকটা অনেক হাস্যকর ছিল স্যার।”

রক্তিম কেমন স্বভাবের মানুষ, আর মুখ দিয়ে কেমন কথা বের করতে পারে তা জেনেই আটঘাট বেঁধে এসেছে সবাই। এমন শ্লেষাত্মক কথায় অপমান বোধ করে পিছু হটলে চলবেনা। এই ছেলের সব কয়টা ত্যাড়া কথা গরম গরম চায়ের সাথে হজম করে নিতে হবে। আখতারুজ্জামান খুব শান্ত ভঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করে,

“দেখো রক্তিম, তুমি কি জানো বা কতটুকু শুনেছো তা আমরা জানিনা। এলাকার মানুষের খোঁজ খবর রেখে আমরা যতটুকু জেনেছি, পুরো এলাকাবাসী তোমাকে একজন পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবেই জানে। ছোট-বড় যেকোন বিপদে আপদে আমাদের কথা তাদের মাথায় আসার আগে তোমার কথা আসে। সমাধানের জন্য তোমার খোঁজ করে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া প্রতিটা ছেলে-মেয়ে জানে, তাদের নিরাপত্তা দিতে তুমি কতটুকু তৎপর। তাছাড়া তোমার কাছে আসার আগেই আমরা দলবদ্ধ হয়ে সবার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি। জনগণ সবাই একই কথা বলেছে, রক্তিম শিকদার গুন্ডামি করলেও সেটা নিজ এলাকাকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্যই করেছে। লিয়াকত বিল্লার মতো অপরাজনীতি আর দুর্নীতি, মাদক ব্যবসার ঘাঁটি বেঁধে যুবক সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়নি। এতো গুলো মানুষের আশা-ভরসা তোমাকে নিয়ে। তুমি আর অমত করোনা।”

গা-ছাড়া ভাব রক্তিমের। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসিটা ধরে রেখেই বলে,

“মানুষ সত্যিই স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝেনা। যে মানুষ গুলোই একসময় আমার সামনে-আড়ালে আমাকে গুন্ডা, খুনি বলে চেঁচিয়েছে, নিজেদের ছেলে-মেয়েদের সর্বদা আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বলেছে। আজ আমার কপাল থেকে কলঙ্ক মুছে যাবার পর তারাই আমাকে বাহবা দিচ্ছে! বিষয়টা অদ্ভূত না?”

প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে সবার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে আবারও অলস ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“তবে যায় হোক। আমারও এতো কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা এতো বড় একটা অফার নিয়ে আমার কাছে এসেছেন, এতে আমি সত্যিই অভিভূত। কিন্তু সত্য কথা এটাই, আমি কোনো রাজনীতিতে জড়াচ্ছিনা। অনেক অশান্তির দিন পাড় করেছে। নিজ স্বার্থের কথা না ভেবেই এতোদিন জীবনটাকে নরকতুল্য বানিয়েছিলাম। এবার একটু স্বার্থপর হতে চাই। আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই শুধু নিজ স্বার্থের কথা ভেবে ভালো থাকতে চাই। নিজের ভুবনে নিজেকে নিয়েই সুখে থাকতে চাই।”

মুহূর্তেই শান্ত পরিবেশ হৈ হুল্লোড়ে অশান্ত হয়ে ওঠে। সকলে এক সুরে বলে ওঠে, “তারা সবাই রক্তিমকেই এমপি পদে দেখতে চায়। লিয়াকত বিল্লার মতো একটা ক্রিমিনাল আবারও এমপি হোক এটা কেউ চায়না। এবার একটু বিরক্ত হয় রক্তিম। মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বলে,

“আরে ভাই বললাম তো এসব রাজনীতিতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই। এখন কি আপনারা আমার মতের বিরুদ্ধে আমাকে ধরে, বেঁধে নির্বাচনে দাড় করিয়ে ফেলবেন? দেখুন, সুন্দর ভাবে একটা কথা বলি। পুরো উপজেলায় যে আমি ছাড়া যোগ্য প্রার্থী আর কেউ নেই, এমন হাস্যকর কথা আর বলবেন না। এতে জনগণের কাছে আপনারা হাসির পাত্র ছাড়া আর কিছুই হবেন না। এখনো সময় আছে, সবাই মিলে ভাবুন, খোঁজ করুন। যোগ্য প্রার্থী খোঁজে বের করুন। আর লিয়াকত বিল্লা যাতে এবার নির্বাচন করতে না পেরে সেই ব্যবস্থা আমি করে দিব। এবার আপনারা আসুন।”

****
জীবন সুন্দর। এই সুন্দর জীবনটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে তখনই, যখন মনের মতো জীবন সঙ্গী খোঁজে পাওয়া যায়। ইতি সুখী। পারিবারিক কলহের অসুখের ভীড়েও মেহেদীর মতো এক প্রেমিক পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে ইতি নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষটাই মনে করে। যার কাছে মেহেদী নামক আস্ত এক ভালোবাসার খনি থাকে,সে কিভাবে অসুখী হতে পারে! আজ আবার বার্তা পেয়েছে, তার মাঝে তাদের ভালোবাসার এক ছোট্ট অংশ বেড়ে ওঠছে। খবরটা যখন জেনেছে অদ্ভূত এক সুখানুভূতি ইতিকে বলয়ের মতো চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। নিজের খুশিটাকে কিভাবে প্রকাশ করবে ভেবে ভেবে মস্তিষ্ক ব্যস্ত থেকেছে। গত এক-দেড় মাস যাবৎ নিজের মাঝে বিস্তর পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল ইতি। ঠিকমতো খেতে পারতনা, খাবারের গন্ধেই পেট গুলিয়ে আসত। প্রথম প্রথম এটাকে গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম ভেবে খুব একটা পাত্তা না দিলেও, একটুতেই ক্লান্তি অনুভব করা, হঠাৎ হঠাৎ মেজাজের পরিবর্তন, পিরিয়ড মিস বিষয় গুলো লক্ষ্য করে অল্প চিন্তিত হয়েছিল ইতি। নিজের চিন্তা টুকু নিজের মাঝে রেখেই চুপ ছিল। কিন্তু যত্নশীল প্রেমিক পুরুষ মেহেদী নিজের অর্ধাঙ্গীর অসুস্থ শরীর, শুকনো মুখ দেখে চুপচাপ বসে থাকেনি। গতকালই কাজের ফাঁকে সময় বের করে বউকে নিয়ে ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার প্রাথমিক লক্ষণ গুলো ইতির মুখ থেকে জেনে তখনই মা হবার অল্প ধারণা দিয়েছিল। ইতি দেখেছিল, তখন মেহেদীর চোখে-মুখে এক অন্যরকম খুশির ঝিলিক। নিজের মাঝেও খোঁজে পেয়েছিল ভিন্ন এক অনুভূতির সঞ্চার। ডাক্তারের সাজেস্ট করা টেস্ট গুলো করিয়ে রিপোর্ট আসতে রাত হবে বিধায় ইতিতে বাসায় রেখে গিয়েছিল মেহেদী। হাসপাতাল থেকে আসার পুরোটা সময় মেহেদী রিকশায় বসে ইতির হাত ধরে কতক্ষণ পরপর বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করেছিল,

“এই ইতু!আমি সত্যিই বাবা হব? আচ্ছা! তোমার পেটের ভিতরে যে আরেকজন আছে বোঝা যাচ্ছেনা কেন? পেট তো একেবারে পিঠের সাথে লেগে আছে? কিন্তু প্রেগন্যান্ট মহিলাদের পেট তো এমন থাকেনা। তাদের পেট থাকে ফোলা। আর তোমার পেট কেমন চুপসে আছে। তবে কি ডাক্তার মিথ্যে বলেছে?”

মেহেদীর এমন বাচ্চাসুলভ প্রশ্নে ইতি রাগ করতে চেয়েও পারেনি। তবুও কপট রাগের অভিনয় করে হাসি আটকে বলেছিল,

“অদ্ভুদ মানুষ তো তুমি! ডাক্তার জাস্ট সিম্পটম গুলো জেনে ধারণা দিয়েছে। ওনি কি কোনো জ্যোতিষ যে রিপোর্ট না দেখেই শিওর হয়ে বলে দিবে? আগে রিপোর্ট আসুক, তখন সত্যটা জানা যাবে।”

তৎক্ষণাৎ মেহেদী বেজার মুখে প্রত্যুত্তর করেছিল,

“সত্যি না জেনে ডাক্তার কেন মিথ্যে আশা দিবে? এইযে খবরটা জেনে এখন আমি এতো খুশী, রিপোর্ট আসার পর যদি খবরটা মিথ্যে হয়ে যায়, তখন কি আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করা হবেনা? ঐ শালার ডাক্তারকে আমার ইমোশন নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে?”

বিপরীতে চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছিল ইতি। নিচু স্বরে ধমকে বলেছিল,

“এবার হয় আমি রিকশা থেকে নেমে যাব নইলে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব। একদম চুপ করে থাকবে।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য তখন মেহেদীকে চুপ করিয়ে রাখতে পারলেও খুব বেশিক্ষণ সম্ভব হয়নি। বাড়ি এসে ইতি একটু গতিতে হাঁটতে গেলেই চেঁচিয়ে ওঠেছে মেহেদী। হম্বিতম্বি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে। ডাক্তার বলেছে এই সময় সাবধানে থাকতে হয়। চলাফেরায় ধীরতা আনতে হবে। ভারী কাজ করা যাবেনা। দ্রুত হাঁটা চলবেনা। মেহেদীর এমন হম্বিতম্বিতে বাড়ির মানুষের থেকেও খবরটা বেশিক্ষণ চাপা থাকেনি। রিপোর্ট আসার আগেই পুরো বাড়িতে জানিয়ে দেয় তার বাবা হবার খবর। হতভম্ব ইতি তাজ্জব বনে শুধু দেখে যায় মেহেদীর পাগলামি। মুহূর্তেই বাড়ির অন্য সদস্যদের মাঝেও এক খুশির আমেজ ছড়িয়ে পরে। রাতে মেহেদী রিপোর্ট নিয়ে বাড়িতে আসার পর যেন সেই খুশিটা আরও দ্বিগুণ হয়। রিপোর্ট বলছে ইতি সত্যিই মা হবে, বাবা হবে মেহেদী। ভালোবাসার ফসল হিসেবে ছোট্ট একটা প্রাণ আসবে তাদের মাঝে। যার ছোট ছোট আদুরে হাতে ছুঁয়ে দিবে ইতি-মেহেদীকে।অনুভূতির অন্তরালে ভাসাবে দুজনকে।

চলবে….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৭ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

দুপুরে রক্তিম বাড়িতে আসার পর থেকে দৃষ্টি কোনো কথা বলছেনা। কিছু জানতে চাইলেও উত্তর দিচ্ছেনা। চুপচাপ নিজের কাজ নিজে করে যাচ্ছে। রক্তিমের কিছু প্রয়োজন হলে সেটাও এগিয়ে দিচ্ছে নিরবে। তার হঠাৎ এমন কান্ডে রক্তিম কিঞ্চিৎ অবাক হয়। চিন্তিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেও যখন কোনো জবাব পায়না, তখন বিরক্ত হয়। হালকা রাগের আভাস দেখিয়ে বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে যায়। বাইকে ওঠে বসে লুকিং গ্লাসে নিজের মুখের প্রতিবিম্ব দেখেই একটু থমকায় রক্তিম। ক্ষণকাল কিছু একটা ভেবে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। মনে পরে সকালে দৃষ্টি বারবার বলেছিল, তার এই দেবদাস লুক চেইঞ্জ করে যেন বাসায় ফিরে। চুল কেটে, দাড়ি ছাটিয়ে সভ্য মানুষ হতে হবে তাকে। কিন্তু রক্তিম পুরোনো অভ্যাস অনুযায়ী সেলুনে ঢুকে চুল কাটলেও দাড়িতে একদম হাত লাগাতে দেয়নি। এতোদিনের অগোছালো অভ্যাস হুট করে পরিবর্তন করে একেবারে সাহেব বাবু হয়ে গেলে মানুষ কি ভাববে! বলবে নতুন বিয়ে করে এখন অল্প বয়সী যুবক হতে চাইছে। রাস্তা-ঘাটে বের হলেই মানুষ ঢ্যাপঢ্যাপ করে তাকিয়ে থাকবে। এর থেকে বরং আস্তেধীরে করলে বিষয়টা কারো নজরে পরবেনা। এই যেমন আজকে চুল ছাটালো, এক সপ্তাহ পর দাড়ি গুলো একটু কাটশাট করবে। এরপর আস্তে ধিরে ক্লিন সেভ করে ফেলবে। কিন্তু বউয়ের হাড়িমার্কা মুখ দেখে মনে হচ্ছে, প্রতিদিন এই মুখ দেখার থেকে দুই-একদিন মানুষের কথা হজম করে নেওয়া সহজ হবে। আজ-কাল ঐ দেড় ইঞ্চির মেয়েটার প্রতি রক্তিম বোধহয় একটু বেশিই দূর্বল হয়ে পরছে। বাড়ি ফিরে সর্বক্ষণ তার মুখের বুলি শুনতে শুনতে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এইযে আজকেই কিছু সময় মেয়েটা কোনো কথা বলছেনা, মনে হচ্ছে যেন কি একটা নেই। মানুষ থাকতেও বড্ড নিঃসঙ্গতা অনুভব হচ্ছিলো। পাষাণ শিকদার যে একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ের মায়ায় এতো বাজে ভাবে জড়িয়ে যাবে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি। যে মেয়েটাকে প্রথম প্রথম দেখলেই মেজাজ খারাপ হতো, কথা শুনলে ইচ্ছে হলো গলা টিপে ধরে আওয়াজ চিরতরে বন্ধ করে দিতে। আজ সেই মেয়েটাকে দেখলেই রাগের বিপরীতে মনের মাঝে ভালো লাগার সৃষ্টি হয়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কাজকর্ম ফেলে দিন-রাত সেই দৃষ্টির আলাপনেই ডুবে থাকতে। তার চোখ, বাম গালে হালকা টোল পরা হাসি, রেশম কালো চুল, লাবন্যময় চেহারা সব কিছুই কেমন অদ্ভুতভাবে টানে। মনে হয় দৃষ্টি নামক মেয়েটা পুরোটাই এক ইন্দ্রজাল। যে জালে ক্রমশ জড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে রক্তিম। একদম ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করছে এক ভিন্ন রূপে। নিজের সে রূপ দেখে নিজেই ক্ষণেক্ষণে অবাক হচ্ছে। আনমনেই বারবার প্রশ্ন জাগছে, এসব কি শুধুই মায়ার জোরে হচ্ছে ! না কি ভালোবাসা? পরপর এমন ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয়ে মনে মনে যুক্তি দেখিয়ে আশ্বস্ত করে নিজেকে। তার জীবনে ভালোবাসা বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। যা আছে কিঞ্চিৎ মায়া। এই মায়ার শক্তি ভালোবাসা থেকেও প্রগাঢ়। ভালোবাসা হারিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষটার প্রতি যদি মায়া না কমে, তবে তাকে ছাড়া কখনো বাঁচা যায়না। সেই প্রখর শক্তিশালী মায়ার কবলে পরেছে রক্তিম। যে মায়া রক্তিমকে টেনে নিচ্ছে একটু একটু করে দৃষ্টির গভীরে।

দোদুল্যমান ভাবনা-চিন্তায় বিভোর হয়েই দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয় রক্তিম। ইদানিং দুটো ব্যবসার সমস্ত হিসাব-নিকাশ নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে। এদিক-সেদিন দৌড়ে ক্লান্ত হচ্ছে। তবুও রক্তিম মেহেদীকে দোকানের কাজে আটকাচ্ছেনা। তার আদরের ছোট্ট বোনটা মা হতে চলেছে। ভাবতেই কেমন অদ্ভূত এক অনুভূতি কাজ করে। আবার চিন্তা হয় বোনটার জন্য। শশুর বাড়িতে কে কতটুকু যত্ন নেই কিছুই জানেনা রক্তিম। একমাত্র মেহেদী ছাড়া ঐ বাড়ির অন্য কোনো মানুষকেও সে ভরসা করতে পারেনা। তাই মেহেদীকেই কড়া আদেশ জানিয়ে দিয়েছে, জাবির, শান্ত, রাকিবকে নিয়ে সে দোকানের দিক গুলো সামলে নিবে। মেহেদী যেন একদম দোকানমুখী না হয়। এই মুহূর্তে তার বোনের যত্ন ব্যবসার উন্নতির থেকেও বেশি জরুরি। বউ পাগল মেহেদী এমন আদেশে মনে মনে খুশিতে নেচে উঠলেও ঠাট্টা করতে ভুলেনি। ফিচেল হেসে এক চোখ টিপে বলেছিল,

“আগে জানতাম শুধু মেয়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পায়। তাও ডেলিভারির দুই-আড়াই মাস আগে। এখন দেখছি ছেলেরা বাবা হবার সংবাদ পাবার পর থেকেই পিতৃত্বকালীন ছুটি পাবে। আপনি কি দয়ালু শিকদার সাহেব! এমন সুযোগ পাব আগে জানলে প্রথম দিন থেকেই ডাউনলোড প্রসেস শুরু করে দিতাম।”

তাদের সম্পর্কটা বর্তমানে শুধু বন্ধুত্বে থাকলে হয়তো এমন জবাবে রক্তিম নিজেও দুই-একটা কথা শুনিয়ে দিতে পারত মেহেদীকে। কিন্তু আদরের ছোট বোনটাই যে বন্ধুর বউ এটা ভেবে এখন মেহেদীকে অপদস্থ করার ইচ্ছে নিঃশেষ হয়ে উল্টো নিজেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পরে। চোখ পাকিয়ে গম্ভীর আওয়াজ তুলে রক্তিম বলেছিল,

“শালা নির্লজ্জ কোথাকার! কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় আমার বোনের থেকে শিখে নিস। না পারলে বলিস নতুন করে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব।”

প্রত্যুত্তরে মেহেদী দাঁত বের করে হেসে টিপ্পনি কেটে বলেছিল,

“আমি তোমার শালা লাগিনা বন্ধু। উল্টো তুমি আমার সমন্ধী। আর লজ্জা নারীরা ভূষণ। পুরুষরা লজ্জা পেলে পাপ হয় পাপ। মেয়েদের মতো লজ্জা পেয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকলে কি মামা ডাক জীবনে শুনতে পারতা?”

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে কথাগুলো বলে ক্ষানিক পর মুখে সিরিয়াস ভাব এঁটে আবারও বলেছিল,

“এখন বুঝতে পারছি এলাকার মানুষ কেন তোকে এমপি বানাতে ওঠে পরে লেগেছে। সবাই হয়তো জানে তুই পুরুষদের অধিকার আদায়ে তৎপর। জনগণ আশায় বুক বাঁধছে রক্তিম শিকদার ক্ষমতায় আসলে পিতৃত্বকালীন ছুটির আইন পাশ হবে। সম্মানীয় হবু এমপি সাহেব, আপনার কাছে এই আমজনতার একটা দাবী আছে। পিতৃত্বকালীন ছুটির সাথে সাথে মেহেরবানী করিয়া আপনি যদি গর্ভকালীন ভাতার মতো পিতৃত্ব কালীন ভাতার ব্যবস্থা করেন, তবে আমরা সাভারবাসী আপনার প্রতি আজীবন কৃতার্থ থাকিব।”

মেহেদীর অতিরিক্ত ফাজলামিতে রক্তিম দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে পিঠে সর্ব শক্তি দিয়ে এক থাপ্পর মেরে ধাক্কিয়ে দোকান থেকে বের শাসিয়েছিল,

“আগামী এক সপ্তাহ তুই আমার চোখের সামনে আসবিনা। তোর চেহারা আমার চোখে পরলেই কাঁচা চিবিয়ে খাব।”

মেহেদীর সেদিনের ফাজলামি গুলো স্বরণ হতেই আনমনে হাসে রক্তিম। দোকানের সামনে যেতেই দেখতে পায় আজও আখতারুজ্জামান সহ কিছু লোক বসে আছে তার দোকানে। সাথে সাথে ঠোঁটের কোণের হাসি উবে গিয়ে বিরক্তিতে চোখ-মুখের রং পাল্টে যায়। থমথমে মুখে দোকানে প্রবেশ করতেই সবাই নড়েচড়ে বসে। আখতারুজ্জান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রক্তিম হাত উচিয়ে থামিয়ে দিয়ে নিজেই গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,

” এতোক্ষনে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন লিয়াকত বিল্লার বিরুদ্ধে নারী পাচার সহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার উপযুক্ত প্রমানের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে!এলাকার উন্নয়নের জন্য সংসদে পাশকৃত বিলের টাকার অর্ধভাগ তার একাউন্টে জমা হওয়ার সঠিক প্রমাণের ভিত্তিতে সরকার বাদী মামলাও হয়েছে। লিয়াকত বিল্লার কাহিনী এখানেই শেষ। যা যা অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে আজীবন জেলে পঁচে মরতে হবে। রাজনীতির মাঠে পা দেওয়ার ক্ষমতা আর নেই। এখন নিশ্চয়ই আপনাদের ভয় কমেছে? এবার দয়া করে আমার পিছু ছাড়ুন। আমার পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব না।”

“রক্তিম তুমি একবার বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো। আজকে তুমি যে সুযোগ পায়ে ঠেলে দিচ্ছো এমন সুযোগ কিন্তু বারবার আসবেনা।”

আখতারুজ্জামানের দিকে শীতল চাহনী নিক্ষেপ করে চেয়ার টেনে বসে পরে রক্তিম। অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“পার্টিতে এতো এতো সদস্য থাকতে কোন লাভে আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য ওঠে পরে লেগেছেন? নিশ্চয়ই এটা ভেবে, এলাকার প্রায় অর্ধেক মানুষ আমার অতীত কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে এমনিতেই ভোট দিবে। আপনাদের দলের হয়ে আমি নির্বাচনে লড়লে জয় নিশ্চিত। এমপি হবার পর এলাকার উন্নয়নের জন্য বরাদ্ধ যে টাকা দেওয়া হবে তার অর্ধেক অংশকে ভাগ করে সেখান থেকে এক ভাগ আমাকে দিয়ে আর এক ভাগে অনায়াসে নিজেদের পকেট ভারী করতে পারবেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে।পার্টিও ক্ষমতা হারাবেনা আবার কারো পকেটও ফাঁকা হবেনা। লাভ ক্ষতির হিসেবে আমি এতোটাও কাঁচা না, যে আপনাদের লাভের দিকটা বুঝতে আমার বেগ পেতে হবে।”

শেষের কথাটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে একটু থেমে একে একে সবার মুখের দিকে তাকায় রক্তিম। উপস্থিত প্রত্যেকের থমথমে মুখ দর্শন করে আবারও ফিচেল হাসে রক্তিম। চেয়ারে গা এলিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলে,

“পাগলও যেখানে নিজের ভালো বুঝে সেখানে আমি কিভাবে বারবার লক্ষি পায়ে ঠেলে বিদায় করি! অল্প খ্যাপাটে হতে পারি আমি, কিন্তু পাগল তো না। তাই ভাবছি করব নির্বাচন। তবে এক শর্তে।”

তৎক্ষণাৎ প্রত্যেকের উৎসুক দৃষ্টি স্থির হয় রক্তিমের দিকে। দুই হাতের আঙুল মট মট শব্দে ফোটাতে ফোটাতে রক্তিম গা ছাড়া ভাবে বলে,

“এলাকার উন্নয়নের জন্য সংসদে পাশকৃত যে অর্থ আমাকে দেওয়া হবে তার এক ভাগও পার্টির কোনো কালা চান বা ধলা চানের পকেটে যাবেনা। কোন টাকা কোন খ্যাতে ব্যয় করব পার্টির সদস্যদের পকেট কতটুকু গরম করব আর নিজের পকেট কতটুকু ভরব সেসব নিজের মর্জিতেই করব। বছর শেষে সরকারকে হিসাব আমার দিতে হবে, যদি এমপি হই আর কি। যা ঝাক্কি সামলানোর সব আমাকে সামলাতে হবে। তবে কেন শুধু শুধু পার্টির দিকে নজর দিব আমি? তাছাড়া আপনারাই তো বলছেন এলাকার জনগণের ভালোর জন্য যাতে আমি নির্বাচনে দাঁড়াই। জনগণের পাশাপাশি শুধু নিজের চিন্তাটাই করব। অন্য কারোরটা পারবনা। মোট কথা ক্ষমতা হাতে আসার পর আপনাদের সাথে আমার কোনো লেনদেন থাকবেনা। এই শর্তে রাজি থাকলে নির্বাচন করতে আমিও রাজি। অন্যথায় রাস্তা মাপেন।”

থম ধরে কতক্ষণ বসে থেকে আখতারুজ্জামান বলে,

“তুমি আমাদের যতটা স্বার্থসন্ধানী ভাবছো আমরা কিন্তু ততটাও আশা নিয়ে তোমার কাছে আসিনি। হ্যাঁ এটা ঠিক,তুমি যদি আমাদের পার্টি থেকে নির্বাচনে লড়ো তবে তোমার জয়ের পাশাপাশি আমাদের পার্টির জয় নিশ্চিত। তুমি ক্ষমতা পাবে, আমার পার্টিও ক্ষমতা পাবে। এটুকু স্বার্থসন্ধানী হয়েই তোমার কাছে আসা। দুনিয়ায় কেউ কখনো নিঃস্বার্থভাবে কিছু করেনা। তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে এই কথাটা নিশ্চয়ই ভালো জানো। যায় হোক, হাতে আরও কয়েকটা দিন এখনো আছে। ভাবো তুমি। ভেবে দেখো কি করলে ভালো হবে। যদি তোমার মনে হয় নির্বাচন করবে, তবে নির্দ্বিধায় পার্টি অফিসে চলে যেও। বাকী কথা না হয় সেখানেই হবে।”

কথা শেষ করে আর এক মুহূর্ত বসেনা কেউ। একে একে বেরিয়ে যায় প্রত্যেকে। দোকান খালি হবার পর রাকিব, জাবির,শান্ত রক্তিমকে ঘিরে বসে। অবাক হয়ে শান্ত জানতে চায়,

“ভাই! আপনি সত্যিই নির্বাচনে দাঁড়াবেন?”

“পা যখন আছে, তখন দাঁড়াতে অসুবিধা কোথায়?”

একেতো সিরিয়াস এখনো প্রশ্নের এমন ফাজলামি পূর্ণ উত্তর। দ্বিতীয়ত যার আগাগোড়া গম্ভীরর্যতায় ঘেরা, তার কি এমন মজার ছলে উত্তর করা মানায়! কিঞ্চিৎ বিরক্তবোধ করে প্রত্যেকে। ফের রাকিব বলে ওঠে,

“সিরিয়াস কথার সিরিয়াস উত্তর দিতে, এইটা আপনিই আমাদের শিখাইছেন ভাই। এখন আপনি নিজেই সিরিয়াস হইতাছেন না। এইগুলা মানা যায় না। সুন্দর কইরা উত্তর দেন তো। সত্যিই আপনি নির্বাচন করবেন?”

ঘাড় কাত করে তিনটা উৎসুক মুখের দিকে তাকায় রক্তিম। অলস ভঙ্গিমায় বলে,

“ভাবছি করব। জীবনে সব ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা ভালো। মিলিটারী বাহিনীর অভিজ্ঞতা আছে, গুন্ডা-মাস্তানের অভিজ্ঞতা আছে, খুনের অভিজ্ঞতা আছে, মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঘাতক চেনার অভিজ্ঞতা আছে।এখন রাজধানীর অভিজ্ঞতা অর্জন করা বাকী। এটা হয়ে গেলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে।”

****

দোকান বন্ধ করে বাড়ি যেতে যেতে আজ একটু বেশিই দেরী হয়ে গেছে রক্তিমের। রাত বাজে বারোটার উপরে। রক্তিম আসার আভাস পেয়ে থমথমে মুখে দরজা খুলে দেয় দৃষ্টি। সেই দুপুরের মতো এখনো হাড়িমার্কা মুখ দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে তা প্রকাশ করার আগেই দৃষ্টির চোখ-মুখের পরিবর্তন লক্ষ্য করে চোরা নজরে ভিতরে চলে যায়। ভড়কে যাওয়া ভঙ্গিতে দৃষ্টি এখনো হাট করে খুলে রাখা দরজার কাছেই স্থির দাঁড়িয়ে। চোখের সামনে এ কাকে দেখছে সে! রক্তিম সত্যিই সেভ করে সভ্য সেজে বাড়ি ফিরেছে, না কি এটা রক্তিমের ভূত! সন্দিহান নজরে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি কিছু বলতে যাবে তখনই মনে পরে, একটু আগেই সে প্রতিজ্ঞা করেছে এই পাষাণের সাথে দুদিন মৌনব্রত পালন করবে। বউকে শুনশান এক বাড়িতে মধ্য রাত পযর্ন্ত একা আতঙ্কে রাখার মজা বুঝাবে। মিনিট দশেক অতিক্রম হবার পরও দৃষ্টির কোনো সাড়া না পেয়ে রক্তিম চুপচাপ হাত-মুখ ধুয়ে আসে। বিছানায় থমথমে মুখে বসে থাকা বধূকে বলে,

“হয়েছে কি? মুখে কি সুপার গ্লো লাগিয়েছো? ফটরফটর রাণীর মুখ থেকে আজ কথা বের হয়না কেন?”

দৃষ্টি প্রতিক্রিয়াহীন। আগের মতোই চুপচাপ বসে। বিরক্তি নিঃশেষ হয়ে রক্তিমের এবার রাগ হয়। হালকা ধমকের স্বরে বলে,

“রাত বিরাতে কি নাটক শুরু করেছো? সারাদিন দোকানে খেঁটে বাড়ি এসেছি তোমার নাটক দেখার জন্য? শালার মেয়ে জাতটাই সব এক। কারণে অকারণে শুরু হয়ে যায় নাটক-সিনেমার অভিনয়।”

রাগের পারদ দৃষ্টিরও উত্তপ্ত হয়। রক্তিমের থেকেও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“মেয়ে জাত দুনিয়ার খারাপ, আর পুরুষ জাত সাধু। খুবই উদার। এজন্যই তো বাড়িতে একা একটা মেয়ে মানুষ রেখে নিশ্চিন্তে মধ্য রাত পযর্ন্ত বাজারে কাটিয়ে আসতে পারে। একা বাড়িতে কেউ মেরে ফেলে রাখল না কি পুতে রাখল সেসব তাদের ভাবনায় আসেনা।”

তাহলে এই ব্যাপার! মহারানী এখন ফুলে আছে রাত করে বাড়ি ফিরায়! ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রক্তিম দৃষ্টিকে বুঝানোর স্বরে বলে,

“আমি কি ইচ্ছে করে রাত করে বাড়ি ফিরছি? দোকানের কাজ গুলো তো শেষ করেই আসতে হবে! তোমার তো বুঝতে হবে আমি অযথা আড্ডায় মশগুল থেকে রাত করে বাড়ি ফিরছিনা। নিজেদের সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্যই দিন-রাত এক করে দোকানে খাটার ফলেই ফিরতে রাত হচ্ছে।”

প্রত্যুত্তরে নিরব থাকে দৃষ্টি। চুপচাপ খাবার এনে টেবিলে রেখে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পরে। হতাশ হয় রক্তিম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার টেনে বসে প্লেট হাতে নেয়। ভাত মাখাতে মাখাতে জানতে চায়,

“খেয়েছো?”

জবাব দেয়না দৃষ্টি। অষ্টাদশীর মন জমিনে অভিমান ভর করেছে। এ অভিমান এতো সহজে শেষ হবার নই। দৃষ্টি সব জানে রক্তিম দোকানের কাজে ব্যস্ত থেকেই রাত করে বাড়ি ফিরে। কিন্তু তার তো এটাও মাথায় রাখা উচিৎ, পুরো বাড়িতে মেয়েটা একা থাকে। দিন-কাল ভালো না। যুবতী একটা মেয়ে এভাবে এক কোণায় পরে থাকে, কখন কোন বিপদ হয়ে যায় কেউ বলতে পারে! বিপদ তো আর কাওকে আগাম বার্তা দিয়ে আসেনা। সন্ধ্যা হলেই আশপাশ নিরব হয়ে যায়। টয়লেটের চাপ পেলেই সাহস হয়না একা বের হবার। এতো নির্বোধ কেন সে? সব বুঝে, তবে এটুকু কেন বুঝেনা? দৃষ্টির জবাব না পেয়ে রক্তিম প্লেট রেখে ওঠে দাঁড়ায়। বিছানায় বসে ঠেলে উঠাতে চায়। জিদ চেপে দাঁত খিঁচিয়ে পরে থাকে দৃষ্টি। তবে শেষ অব্দি রক্তিমের দানবের জোরের সাথে তার চড়ুই পাখির মতো ছোট্ট শরীরটা পেরে ওঠেনা। এক টানে উঠিয়ে বসিয়ে দেয় রক্তিম। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে প্লেট নিয়ে ছোট লুকমা করে মুখের সামনে ধরে বলে,

“যত রাগ খাবার পরে দেখিয়ো। খাওয়া নিয়ে নির্বোধরা রাগ করে। ভালো মানুষ না।”

আর অবাধ্য হবার সাহস হয়না দৃষ্টির। বলা চলে রক্তিমের হাতে খাবার লোভ সামলাতে পারেনা লোভী মন। পাষাণটার এই ছোট্ট ছোট্ট যত্ন গুলো যে দৃষ্টির মতে নতুন করে ভালোবাসার সৃষ্টি করে। ভালো লাগার আবেশে উড়ে বেড়ায় মন জমিনের পতঙ্গ গুলো। ইচ্ছে হয় নিজেও ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে মুক্ত আকাশে। নিজের পাশাপাশি দৃষ্টিকেও খাইয়ে এটো থালা-বাটি নিজেই গিয়ে রেখে আসে। এর মাঝে আবার দৃষ্টি পিছন ঘুরে শুয়ে পরেছে। ভেবেছে কি সে! আদর করে একটু খাইয়ে দিয়েছে বলে তার এতো কঠিন অভিমান ভেঙ্গে যাবে!একদম না। আজ কিছুতেই দৃষ্টি পরাজয় মানবেনা। বলবেনা কথা ঐ নির্বোধ লোকটার সাথে।

রক্তিম কতক্ষণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও শুয়ে পরে। এক ঝটকায় দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে বুকের উপর ফেলে। আচমকা এমন কান্ডে হতভম্ভ দৃষ্টি। আতঙ্কে চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে আছে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রক্তিমের বুকে দুহাত ভর করে উপুড় হয়ে থেকে তিরতির করে কাঁপতে থাকা পলক ঝাপটে তাকায়। অবাক বিস্ময়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। দৃষ্টির মুখের কাছে পরে থাকা চুল গুলো আঙুলের ডগায় কানের পিছনে গুজে দিয়ে নিচু স্বরে রক্তিম বলে ওঠে,

“অভিমান ভালো, তবে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের অভিমান ভালো না।”

অভিমানটা এবার কান্নায় রূপ নিতে চায় দৃষ্টির। এতো বড় দায়িত্বহীনের পরিচয় দিয়ে এখন আবার বলে দৃষ্টি বাড়াবাড়ি পর্যায়ের অভিমান করেছে! সহ্য হয় এগুলো! কান্নার দমকে ঠোঁট কাঁপে দৃষ্টির। ঢোক গিলে বারবার। প্রতিটা ঢোক গিলার সাথে উঠানামা করে কন্ঠনালী। চিকন গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট দুটো আর কন্ঠনালীর দিকে না চাইতেও বারবার নজর যায় রক্তিমের। ঐ ঠোঁট দুটো টানছে। খুব বাজে ভাবেই টানছে। যতবার তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে ততবার কেমন এক নেশায় তলিয়ে যাচ্ছে। মন প্রশ্ন তুলছে, এটা কি কোনো মেয়ের ঠোঁট না কি আফিম! নিজেকে সামলে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পরছে। চোখের সামনে এমন আফিমের মতো নেশালু কিছু দেখে কোন পুরুষ নিজের চৈতন্য ফিরে পাবে! কেমন এক ঘোরের মাঝে তলিয়ে গিয়ে রক্তিম ভুলে যায় জাগতিক সমস্ত চিন্তা। নিকোটিনের ধোয়ায় কালচে ওষ্ঠদ্বয় ডুবিয়ে দেয় ঐ নেশা ধরানো গোলাপী ওষ্ঠে। চমকায় দৃষ্টি। থমকায় নয়ন। অসাঢ় হয় মস্তিষ্ক। প্রিয়তম’র এমন অপ্রত্যাশিত ছোঁয়ায় মিইয়ে যায় লাজুক লতার মতো। টগবগ করে ফুটে শরীরের রক্তকণিকা। নিকষ কালো রাতের অন্ধকারে সূচনা হয় নতুন এক গল্পের। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ দুটো নর-নারী পরম আবেশে আলিঙ্গন করে নেয় দুজনকে।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে