#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৪
#আদওয়া_ইবশার
ঋতু পাল্টেছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে প্রতিটা জিনিসে। নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। জরাজীর্ণ গাছপালা ছেয়ে গেছে কচি পাতায়। শিমুল,পলাশের আগুন রাঙা রূপের বাহার, কোকিলের কুহুতান, বুনোফুলের মাতাল ঘ্রাণ জনমানবের মনে প্রেমের গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। প্রকৃতির নতুনত্ব যেন মানব মনেও নতুনত্বের ছোঁয়া দিয়েছে। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী সময়ে অসময়ে ভালো লাগার আবেশে গুনগুনিয়ে গেয়ে যাচ্ছে, “বসন্ত এসে গেছে”। প্রিয় ঋতুর মন ভুলানো রূপ, সাথে ভালোবাসার মাস। দুইয়ে মিলে শহর জুড়ে সে কি আনন্দোচ্ছ্বাস!
প্রকৃতির সাথে বিস্তর পরিবর্তন আসে মানব জীবনেও। কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এসেছে দৃষ্টি-রক্তিমের জীবনেও। দৃষ্টির চান্স হয়েছে কবি নজরুল সরকারি কলেজে। রক্তিমের নির্দেশেই মেহেদীর সাথে গিয়ে যথাসময়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে এসেছে। আগের থেকেও উন্নতি হয়েছে রক্তিমের শারীরিক অবস্থার। একটু একটু করে সচল হচ্ছে অচল পেশী। সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ আর দৃষ্টির ভালোবাসার জুড়ে নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারছে। হাটা-চলা এখনো অন্যের নির্ভরতায় করতে হয়। ডাক্তার জানিয়েছে একুটুও খুব শিঘ্রই সম্ভব হবে। রেহানা বেগম এক প্রকার বাধ্য হয়েছে শিকদার মঞ্জিলে ফিরে যেতে। কিছুদিন আগেই কাকলির মা এসে জানিয়ে যায় আজীজ শিকদার ভিষণ অসুস্থ। হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুই-একটা কথা বলতেই হাপিয়ে যায়। শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। খাওয়া-দাওয়ার ভিষণ অনিয়ম। সব মিলিয়ে সজ্জাশায়ী। এমতাবস্থায় একজন এমপির দায়িত্ব পালন করা বড্ড দুরহ। দুদিন আগেই পদত্যাগ করেছে নিজ ইচ্ছায়। যে মানুষের নিজের পরিবারকে আগলে রাখার ক্ষমতা নেই, সেই মানুষ কিভাবে গোটা একটা উপজেলার মানুষদের সুখে-দুঃখে আগলে রাখবে?তাছাড়া যে সন্তানকে বেঁধে রাখতেই নিজের পূর্ব পরিকল্পনা না থাকা সত্বেও নিজেকে বসিয়েছিল এমপি আসনে। সেই সন্তানেই যখন থাকলনা, তখন কেন এই আসনে বসবে?
রেহানা বেগম যে মানুষটার সাথে এতো গুলো বছর এক ছাঁদের নিচে সংসার নামক মায়ার জালে আটকা পরে কাটিয়ে দিয়েছে অনায়াসে। সেই মানুষটার এমন দুর্দিনের সংবাদ শুনে মনটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। বাবা নামক বট বৃক্ষটা যতই আঘাত দিক। এমন একটা খবর শুনে তাকে হারানোর ভয়ে তবুও বুক কাঁপে রক্তিমের। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বুকের ভিতরটা দিন শেষে নিজের সাথে বেঈমানি করে সেই বাবা নামক বট বৃক্ষের দুর্দশা শুনে উচাটন শুরু করে। রক্তিম চেয়েও পারেনা জন্মদাতার প্রতি মন থেকে পুরোপুরি ঘৃণার সৃষ্টি করতে। কোথাও যেন ফাঁকফোকরে অল্প টান থেকেই যায়। রক্তের টান! সে টান কি আর মৃত্যুর আগে নিঃশেষ হতে পারে! দুঃখ-কষ্ট, অভিমানের পাহাড় পুরোপুরি না ভাঙলেও দুটানায় ভুগতে থাকা মা’কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয় শিকদার মঞ্জিলে। এতো গুলো বছর যে মানুষটার ছত্রছায়ায় থেকেছে, সেই মানুষটাকে শেষ বয়সে একটা ভুলের জন্য নিঃসঙ্গতার মতো এতো বড় শাস্তি দিতে না পারলেও পুরোপুরি সঙ্গও দিতে নারাজ রেহানা বেগমের মন। শিকদার মঞ্জিলে ফিরে গেলেও খুব একটা কাছঘেষেনা আজীজ শিকদারের। অপরের মতো দূর থেকে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন দেখে যায়। কাকলির মায়ের হাতেই সময় মতো পাঠিয়ে দেয় খাবার,ঔষধ। রাত হলেও আগের মতো আর স্বামীর পাশে ঘুমানোর জন্য আসেনা। আলাদা হয়েছে বিছানা। আজীজ শিকদার’ও কোনো অভিযোগ করেনা। মেনে নেয় সকলের নিরব প্রতিশোধ। ভেবে নেয় এটাই তার ভবিতব্য। সন্তানদের ভালো করতে গিয়ে মস্ত বড় যে ভুল করেছে, সেই ভুলের কাছে এই নিরব প্রতিশোধ তেমন কিছুই না। এর থেকেও জঘন্য শাস্তি দিলেও হয়তো কম হয়ে যাবে। আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় স্ত্রী-সন্তানকে বলতে,এমন নিঃসঙ্গতার মতো অসহনীয় শাস্তির থেকে মেরে ফেলুক একেবারে। কিন্তু পারেনা।ভয় হয়। এটুকু বলতে গিয়েও যদি আবার কোনো ভুল হয়ে যায়! যে মানুষ ভালো করতে গিয়েও অজান্তেই সন্তানের খারাপ করতে পারে, সে মানুষ আর কি’ই বা ভালো করতে পারে! যে ভালো সুন্দর, সুস্থ্য একটা পরিবারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারে। যে ভালো সন্তানকে আলোর পথ থেকে টেনে অন্ধকার নিয়ে যেতে পারে, সে ভালো করার থেকে না করাই শ্রেয়। আয়ুষ্কাল আছেই বা আর কতদিন! যেটুকু সময় অবশিষ্ট আছে, সেটুকু না হয় এভাবেই প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলাই কাটিয়ে দিল। শেষ বয়সে এসে আত্মগ্লানিতে জ্বলে,পুড়ে ছাই হোক অন্তর। তবুও ভালো থাকুক সন্তান।
বাবা অন্তঃপ্রাণ ইতিটাও এখন আর বাবার সাথে মন খুলে কথাও বলতে চায়না। ইচ্ছে হলে শশুর বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে এসে এক নজর বাবাকে দেখে যায়। অথচ ভাইকে ঠিকই রোজ একবার হলেও এসে দেখে যায়।ভাইয়ের করুণ পরিণতির দায় বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে কোমল হৃদয়টা বাবার প্রতি পাষাণ বানাতে গিয়ে পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও যেটুকু পেরেছে ইতি মনে করে সেটুকুই বাবার জন্য বিরাট বড় শাস্তি। দূরহ যন্ত্রণা সইতে না পেরে আজীজ শিকদার একদিন ইতিকে বলেছিল,
“মা!এখন আর এই পাপী বাবাকে বাবা বলে ডাকতেও ইচ্ছে করেনা?”
প্রত্যুত্তরে নির্বাক দৃষ্টিতে ইতি ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া বাবা নামক এক পরাজিত সৈনিকের দিকে তাকিয়েছিল কতক্ষণ। পরপর অসহায় কন্ঠে জানতে চেয়েছিল,
“এটুকু মিথ্যের আশ্রয় না নিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? মিথ্যে যে কখনো সুফল বয়ে আনেনা পেলে তো তার প্রমাণ! তাছাড়া যে ছেলেকে বাঁচাতে এতো বড় মিথ্যের আশ্রয় নিলে সেই ছেলে আজ কোথায়? বাবার এমন অসুস্থতার সময় পাশে নেই কেন সে? কেন আমার অসুস্থ ভাইটা আজ বিছানায় পরে ছটফটায় বাবা নামক ধ্বংস কারিগরের দুর্দিনের খবর পেয়ে! আমার ভাইটাকে এতো বড় শাস্তি না দিলেও পারতে। পাপ ঢেকে যে পাপের রাজ্য গড়েছো সেই পাপের রাজ্যের অভিশাপ তো এখন নিজের উপরেই আসবে। এটুকু তোমার প্রাপ্য।”
****
রক্তিমকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছে দৃষ্টি, মেহেদী। সকলের মনটা আজ বড্ড ফুরফুরে। ডাক্তারের কথায় অন্যরকম এক প্রশান্তি কাজ করছে মনে। রক্তিম পুরোপুরি সুস্থ্য। এখন নিয়মিত প্রেশারের ঔষধ গুলো খেয়ে গেলেই হবে। এর থেকে বড় খুশির সংবাদ তাদের জীবনে আর কি হতে পারে! হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে কিছু পথ আসতেই জ্যামে পরেছে। গাড়ির বিশাল লম্বা লাইন। মনে হয়না আধা ঘন্টার আগে জ্যাম ছুটবে। গাড়ির ভিতরে থেকেই মনের সুখে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে থাকে দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে বিজয়ের হাসি। হঠাৎ চোখ যায় ফুটপাতের পাশে সাড়ি সাড়ি ফুলের দোকানে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সেদিকেই। অপলকে দেখে যায় কিছু জোড়া শালিকের খুনশুটি। মনে ইচ্ছে জাগে, সেও রক্তিমের হাত ধরে হারিয়ে যাবে ঐ ফুলের রাজ্যে। হাজার ফুলের ভিতর থেকে রক্তিম ভালোবেসে একটা ফুল ছিনিয়ে নিবে তার জন্য। যত্ন নিয়ে গুজে দিবে খোপা করা রেশম, কালো চুলের ভাজে। কিন্তু মনে হয়না দৃষ্টির এই ইচ্ছেটাকেও কখনো পূর্ণতা দিবে গম্ভীরমুখো পাষাণ শিকদার। এই পাষাণটাকে ভালোবেসে তার সাথে থাকতে হলে হয়তো মনের সকল ইচ্ছেকেই এভাবে অচিরেই মনের গহীনে দাফন করতে হবে। তবুও চেষ্টা তো একটু করতেই পারে! ভেবেই রক্তিমের দিকে ঘুরে তাকায়। রক্তিম অপজিটে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজ ভাবনায় ধ্যানমগ্ন। দৃষ্টি ভেবে পায়না সারাক্ষণ এতো কি ভাবে মানুষটা! তাকে যে এতো ভাবে চিন্তা করার জন্য বারণ করা হচ্ছে, সে গায়েই লাগাচ্ছেনা কারো কথা। চিন্তায় চিন্তায় আবারও স্ট্রোক করে একদম সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে চিরনিদ্রিত হয়ে তবেই হয়তো এই চিন্তা ছাড়বে।
গলা খাঁকারি দিয়ে রক্তিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় দৃষ্টি।ধ্যান ভঙ্গ হয়ে ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। ইশারায় জানতে চায়, “হয়েছে কি?”
একটু নড়েচড়ে বসে দৃষ্টি। সময় নিয়ে জানতে চায়,
“খারাপ লাগছে আপনার?”
শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দেয় রক্তিম। পরমুহূর্তে দৃষ্টি আবারও জানতে চায়,
“কিছু খাবেন?”
আগে শুধু ভ্রু দ্বয় কুঁচকে থাকলেও এই প্রশ্নে চোখ-মুখ’ও কুঁচকে নেয় রক্তিম। বিরক্তি ভঙ্গিতে বলে,
“বাচ্চা মনে হচ্ছে আমাকে?”
“শুধু কি বাচ্চাদেরই খিদে লাগে? বড়দের খিদে লাগেনা?”
“তিন বেলার বদল ছয় বেলা খাওয়ার মানুষ আমি না।”
জবাব দিয়ে আবারও মুখ ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করে রক্তিম। দৃষ্টি রক্তিম যাতে শুনতে পারে এমন ভাবেই বিরবিরিয়ে উচ্চারণ করে,
“খাবে কিভাবে ছয় বেলা! জনম কিপ্টা একটা। তিন বেলা যে খায় এটাও বোধহয় না খেয়ে বেঁচে থাকার পলিসি থাকলে খেতনা। বাপ জন্মে এমন কিপ্টা লোক দেখিনি আমি।”
কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়ে খ্যাপে যায় রক্তিম। চোখ পাকিয়ে তাকায় দৃষ্টির দিকে। জানতে চায়,
“কয় বেলা না খাইয়ে রেখেছি? কোন চাওয়াটা অপূর্ণ রেখেছি, যার জন্য এমন কথা মুখে আসছে?”
এই একটা কথা শোনার জন্যই তো এতোক্ষনের এতো প্যাচাল! অবশেষে সুযোগ পেয়ে চোরা হাসে দৃষ্টি। পরোক্ষনে হাসিটা বিলীন করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“বিয়ের পর থেকে এখন পযর্ন্ত যে স্বামী দশ টাকার একটা বকুল ফুলের মালাও এনে দিলনা, সে আবার জানতে চায় কোন চাওয়া অপূর্ণ রেখেছে! একেই বলে চোখ থাকিতেও অন্ধ।”
ফুলের দোকানে নজর যেতেই রক্তিম ঠিকই টের পায় দৃষ্টির হা-হুতাশের কারণ। তবুও কিছু বলেনা। শান্ত দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হতাশ হয় দৃষ্টি। সামান্য দশ টাকার একটা বকুলের মালা কিনে দিলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো! বউয়ের ইচ্ছে জানার পরও কিভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে! দৃষ্টিরই ভুল। বেহায়া মন জানে, পাষাণতুল্য মানুষটা সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকে, তার ইচ্ছে গুলোকে গলা টিপে হত্যা করে পৈশাচিক আনন্দ পাবার জন্য। তবুও কেন মন অযথা আশা রাখে! জ্যাম ছুটে গেছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে আপন গতিতে। বাকিটা পথ দৃষ্টির অভিমানী মন মুখ ফিরিয়ে রেখেছে রক্তিমের থেকে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছে ঠিকই আবার স্বামীর সেবায় বোধ হয়ে থেকেছে। ব্যস্ত পায়ে ছুটাছুটি করে যা যা লাগবে নখদর্পণে রেখেছে।
****
দিনের আলো একটু একটু করে ম্লান হচ্ছে। শহরের অলিতে গলিতে জ্বলে উঠেছে নিয়ন বাতি। ব্যস্ত শহর জুড়ে শুরু হয়ে গেছে আলোর মেলা।স্বাভাবিক হাটা-চলার শক্তি ফিরে পেতেই রক্তিম নিজ মর্জিতে চলা শুরু করে দিয়েছে। সাহেব এখন বোধহয় আবার ভুলে গেছে ঘরে তার বউ আছে। তাকেও একটু আধটু সময় দিতে হয়।ইচ্ছে হয় তারও স্বামীর সাথে বসে দু-দন্ড গল্প করতে। মহা ব্যস্ত মানুষের এসব ভাবার সময় কি আর আছে!মন খারাপের পসরা সাজিয়ে বহুদিন পর বই খুলে বসেছে দৃষ্টি। নতুন বইয়ের পাতা না উল্টানো হলেও সময় তো আর থেমে থাকছেনা। সে নিজ গতিতে ঠিকই এক একটা নতুন দিনকে পুরোনো করে আরও নতুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই হুট করে হয়তো কোনো দিন এয়ার ফাইনাল দোরগোড়ায় কড়া নাড়বে। নিরুপায় দৃষ্টি তখন বইয়ের অভিশাপে ফেল্টুস দৃষ্টির উপাধি পেয়ে যাবে। সমস্ত চিন্তা একপাশে রেখে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে পড়াই মনযোগ দেয় দৃষ্টি। টানা দুই ঘন্টা পড়েই হাপিয়ে যায়। বইয়ের সাথে এতোদিনের বিচ্ছেদে মস্তিষ্কে ঝং ধরেছে। আস্তে আস্তে সে ঝং সাড়াতে হবে আবার। নইলে সর্বনাশ। এটুকু সময় পড়েই গলাটা মনে হচ্ছে শুকিয়ে গেছে। বড্ড চায়ের পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে যে এক কাপ চা করে আনবে সেই সাহস টুকুও নেই। বাড়িটা এমন এক জায়গায়, চারপাশ মনে হয় একেবারে জনমানবশূন্য। এমন ভুতুড়ে পরিবেশে কোনো মেয়েরই সাহস হবেনা সন্ধ্যার পর একা ঘর থেকে বের হতে। রাত বিরাতে চায়ের পিপাসা মিটানোর জন্য হলেও মনে হচ্ছে ঘরের ভিতর একটা চুলার ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও ঘন্টা দুয়েক পর বাড়ি ফিরে রক্তিম। ক্লান্তশ্রান্ত চেহারা। গায়ের সাদা শার্টটা ঘামে ভিজে চুপচুপে। এমন হাল দেখে অবাক হয় দৃষ্টি। কন্ঠে অঘাৎ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
“এমন অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে কোথায় মাটি কাটতে গিয়েছিলেন। কি পরিমাণে ঘাম ঝরছে শরীর থেকে!”
কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই শরীর থেকে শার্ট খুলতে খুলতে জবাব দেয় রক্তিম,
“দোকান পরিষ্কার করে এসেছি। কালকে মাল আসবে।”
বিস্ময়ের মাত্রা এবার যেন আকাশ ছোঁয়া দৃষ্টির। জানতে চায়,
“কিসের দোকান?”
এবার একটু বিরক্ত হয় রক্তিম। নিচু ধমকের সাথে বলে,
“একসাথে এতো জবাব দিতে পারবনা।অবস্থা কি চোখে দেখাই যাচ্ছে। একটু দম ফেলতে দাও।”
থমথম খেয়ে চুপ হয়ে যায় দৃষ্টি। দৌড়ে গিয়ে আলনা থেকে কাপড় এগিয়ে দেয়। মিনমিন করে জানতে চায়,
“গোসল করবেন?”
“হ্যাঁ।” ছোট্ট করে জবাব দেয় রক্তিম। তৎক্ষণাৎ এতোক্ষনের একা বাইরে যাবার ভয়টাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছুটে যায় কলবারে। চাপকল চেপে বালতি অর্ধ ভর্তি করতেই পৌঁছায় রক্তিম।
“আমি তুলছি। সরো।”
সাথে সাথে দ্বিমত পোষণ করে দৃষ্টি। মাথা ঝাকিয়ে বলে ওঠে,
“একদম না। মাত্র কয়েক দিন হলো সুস্থ্য হয়েছেন। এখনই এই হাতে এতো চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবেনা। তবুও কিসের কি দোকান পরিষ্কারের নাম করে না জানি কতটুকু বল খাটিয়েছেন।”
আর কোনো প্রত্যুত্তর করেনা রক্তিম। চুপচাপ সাইডে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে দায়িত্বশীল এক বধূকে। যে বধূ স্বামীর শত তাচ্ছিল্যতা মুখ বুজে সহ্য করেও অটুট নিজ দায়িত্বে। কখনো এক বিন্দু কার্পন্যতা করছেনা। না আছে চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। গোসল শেষে দুজনে একসাথে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেড়ে রক্তিম বারান্দায় বিছিয়ে রাখা শীতল পাটিতেই শরীর ছেড়ে কাত হয়ে শুয়ে পরে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে লিলুয়া বাতাসের সাথে থৈ থৈ জোৎস্নার আলো লুটিয়ে পরছে। পূর্ণ চন্দ্রিমার আলোয় এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভর করেছে চারপাশে। হৃদয় শীতল করা বাতাস, আর এক ফালি চাঁদের আলো, এর থেকেও সুন্দরতম মুহূর্ত আর কি হতে পারে! দুজন কপোত-কপোতির এক মায়াময় স্মৃতি তৈরির জন্য এমন একটা পরিবেশের থেকে উত্তম দ্বিতীয়টা নেই।
ঝটপট চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দেয় দৃষ্টি। অভিজ্ঞ হাতে দু-কাপ চা করে নিজেও বসে পরে রক্তিমের পাশে। একটা কাপ নিজের কাছে রেখে অন্যটা বাড়িয়ে দেয় রক্তিমের দিকে। চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে নিরবে অনিন্দ সুন্দর মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে ব্যস্ত দুজন। কিছু পল অতিবাহিত হবার পর নিরবতার জাল ছিড়ে রক্তিম। শান্ত কন্ঠে চাঁদের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলতে শুরু করে,
“আমি আর মেহেদী মিলে অনেক আগে থেকেই একটা বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম। মাঝে এতো কিছু ঘটে যাওয়ায় তখন সেটা সম্ভব না হলেও ইচ্ছেটা জীবিত ছিল। আপাতত বাজারের একটু ভিতরে স্বল্প ভাড়ায় দুটো দোকান রেখেছি। স্টক মালের ব্যবসা শুরু করছি। ইচ্ছে আছে বড় কিছু করার। আমার মতো হাজারটা না হলেও দুই-একটা ছন্নছাড়া রক্তিমের কর্মসংস্থান গড়ার।স্বপ্ন দেখবনা বলেও আবার একটু স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হলো আর কি। ভাগ্যকে না হয় শেষ একটা সুযোগ দিয়েই দেখলাম।”
“আর আমাকে?” নিরবে রক্তিমের কথা গুলো শুনে আচমকা প্রশ্নটা করে বসে দৃষ্টি। হঠাৎ এমন একটা প্রশ্নে একটু চমকায় রক্তিম। মুহূর্ত ব্যবধানেই দুজনের দৃষ্টির মিলন ঘটে। ভরাট স্বরে রক্তিম বলে,
“আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অতীতের গল্পটা একজনের কাছে বলার ইচ্ছে ছিল। হবে সেই একজন?শুনবে আমার সেই বিষাক্ত অতীত?”
“কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছেন?”
“উঁহু। গল্পছলে উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।”
“অতীতের সবটা তো জেনেই গেছি। তবে কোন গল্পে উত্তর দিবেন?”
স্মিত হাসে রক্তিম। বলে,
“কিছু কিছু জানার মাঝেও হাজার অজানা লুকিয়ে থাকে। আমি সেই অজানাটাই জানাতে চাই। হালকা করতে চাই বুকের ভিতরটা।”
রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে অন্যদিকে তাকায় দৃষ্টি। কিঞ্চিৎ ভয়ের সঞ্চার হয় মনে। ভাবে ভালোবাসার মানুষের লুকানো অতীত জানার পর মন জমিনে আবার না জানি কোন বিষ ফোড়া সৃষ্টি হয়!দ্বিধান্বিত মন নিয়েই পূণরায় তাকায় রক্তিমের দিকে। কাঁপা স্বরে বলে,
“আপনার যদি মনে হয় আপনার সেই লুকানো অতীত শোনার যোগ্য আমি, তবে বলতে পারেন। যে অতীত জানালে আপনার মন হালকা হবে, সেই অতীত শুধু একবার না, বারবার জানতে রাজি আমি।”
আবারও নিরবতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। পিছনে দু-হাত ভর করে দূর আকাশের মুক্ত ঝরা আলো ছড়ানো সেই নিটোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলতে শুরু করে সেই অতীত। হৃদয় পুড়ে ছাই হওনা সত্বেও যে অতীত যত্ন করে মনের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল এতোদিন।,
“আমি তখন সদ্য ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের কলেজের অপজিটেই আরেকটা কলেজ ছিল। সেখানেই একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে দেখা হয় এক রূপবতীর সাথে। যার রূপের ঝলকে প্রথম দেখাতেই খুব বাজে ভাবে আটকে গেছিলাম আমি। প্রতিদিন এক নজর দেখার জন্য হলেও ছুটে যেতাম সেই কলেজে। একদিন লক্ষ্য করলাম মেয়েটা আমাদের কলেজ গেটের সামনে দিয়েই যাতায়াত করে। সেই থেকে সকাল বিকেল নিয়ম করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মুগ্ধ নয়নে দেখতাম সাদা ইউনিফর্ম পড়নে এক শুভ্রপরীকে। মেয়েটাকে কখনো আমি সাজতে দেখিনি। ঠোঁটে স্বাভাবিক কৃত্রিম রং লাগানোও কখনো দেখিনি। সেই অতি সাধারণ মেয়েটার সৌন্দর্যের মায়াতেই দিনের পর দিন বোধ হচ্ছিলাম আমি। একটা সময় বুঝতে পেরেছিলাম মন ভালোবেসেছে মেয়েটাকে। তাকে পাবনা ভাবলেই দম বন্ধকর পরিস্থিতি অনুভব করতাম। কেমন যেন পাগল পাগল লাগত নিজেকে। কিন্তু সাহস হতনা কখনো মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলার। অবচেতন মন ভাবতো যদি মেয়েটা ভুল বুঝে! সময় এভাবেই যাচ্ছিলাম। এক পাক্ষিক ভালোবাসা বুকে নিয়ে তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম আমি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমি কলেজের গেইটের সামনে অপেক্ষায় ছিলাম তাকে এক নজর দেখব বলে। সেও এসেছিল ঠিক সময়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলেও গিয়েছিল। এরপর হুট করে আবার পিছু ফিরে এগিয়ে আসে আমার দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে অবলীলায় জানতে চেয়েছিল, “আপনি কি প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখুন?” সেই মুহুর্তে যে কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি তা আমি ছাড়া কেউ জানেনা। কতক্ষণ মেয়েটার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে সত্যটাই বলে দিয়েছিলাম। পরপর মেয়েটা আবারও প্রশ্ন করেছিল, “কিন্তু কেন?” বুকে কাঁপন নিয়েই সেদিন সাহস করে বলে দিয়েছিলাম ভালোবাসি আমি তাকে। প্রত্যুত্তরে মেয়েটা আমার দিকে চুপচাপ কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। হতাশ হয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম হয়তো তার আমাকে পছন্দ নই। যদি পছন্দ হতো তবে নিশ্চয়ই এভাবে উপেক্ষা করতে পারতনা। এই ঘটনার পর আরও মাস খানেক কেটে যায়। মেয়েটার কোনো জবাব না পেয়ে হতাশ হয়েও রোজকার নিয়ম আমি বদলাতে পারিনি। না পেরেছিলাম তার প্রতি সৃষ্টি হওয়া ভালোবাসা মুছে ফেলতে। নিয়ম করে সেই সকাল দুপুর গেটের সামনে অপেক্ষায় থাকতাম এক নজর দেখার। মাস খানেক পর এক সন্ধ্যায় হুট করে আমার হোস্টেলের দারোয়ান রুমে খবর নিয়ে যায় কেউ একজন আমার জন্য রাস্তায় অপেক্ষায় আছে। কিছুটা অবাক হয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম এই সময় তো আমার সাথে কারো দেখা করতে আসার কথা না। বাবা আসলে ফোন করে আগেই বলে দিত। ভাবতে ভাবতেই নিচে যায়। সেখানেই অপেক্ষা করে ছিল আমার জন্য সবথেকে বড় একটা চমক। তখন বোকা মন বুঝতে পারেনি সেই চমকটাই ছিল আমার জীবন ধ্বংসের এক টুকরো আলামত। আলো-আধারির সন্ধ্যায় সেই মেয়েটা বধূ বেশে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার পাশে। কৃত্রিম সাজের ছোঁয়া লাগা মুখটাই ছিল রাজ্যের ভয়। বারবার এদিক সেদিক দেখছিল। আর আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম সেই ভিতু নব বধূ সাজে অপরূপা মোহিনীকে। অঘাৎ বিস্ময় জন্মেছিল মনে। সে এভাবে বধূ বেশে আমার হোস্টেলের সামনে কেন আসবে? তার সামনে দাঁড়ানোর পর সেই জবাব পেয়েছিলাম আমি। ছোট বেলায় তার বাবা মারা যায়। তখন না কি তার বয়স ছিল দেড় কি দুই বছর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সেই ছিল। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে যুবতী বয়সে তার মা একা টিকতে পারেনি স্বামীর বাড়ি। বিধবা মেয়ে মানুষ একা থাকাটা এই সমাজে মুখের কথা না। কিছু চরিত্রহীন শকুনের নজরে টিকতে না পেরে আশ্রয় নেয় বাপের বাড়ি। ভাই-ভাবি প্রথম প্রথম একটু ভালো ভাবে দেখলেই মেয়ে যত বড় হচ্ছিলো, খরচ বাড়ছিল আবার সবার চোখের কাটা হচ্ছিলো। একাদশ শ্রেণি পযর্ন্ত মা এক প্রকার যুদ্ধ করেই পড়িয়েছিল তাকে। এরপর আর পারছিলনা ভাই-ভাবির সাথে। জোর করে মেয়ের মতামত ছাড়াই অর্থের লোভে এক বিবাহিত বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করে। সেটা মানতে না পেরেছি সেদিন সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে। জানতে চেয়েছিল আমি তাকে সত্যিই ভালোবাসি কি না। যদি ভালোবাসি, তবে যেন সেদিন সেই মুহূর্তে তাকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব নেই আমি। না হয় আজীবনের জন্য হারাতে হবে। হারিয়ে ফেলার কথা শুনে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। তখনই ফোন করি বাবার কাছে। কোনো আবদার রাখি প্রথম বারের মতো। আমার ভালোবাসার পূর্ণতা চাই তার কাছে। বাবা সেদিন আমার একটা কল পেয়েই ছুটে গিয়েছিল। আমাকে আর তাকেও অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল। সেই মুহূর্তে বিয়েটা করলে আমার ডিফেন্স হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কখনো তা পূর্ণতা পাবেনা। ভালোবাসার কাছে সেদিন আমার স্বপ্নের মূল্য ফিকে হয়ে গিয়েছিল। জানিয়ে দিয়েছিলাম যেকোন মূল্যে আমি তাকে চাই। নিরুপায় হয়ে বাবা ওনার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর সহযোগীতায় লুকিয়ে আমাদের বিয়েটা সম্পন্ন করে। তাও শুধু ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক। প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যতদিন পযর্ন্ত আমার চাকরি না হচ্ছে আর যতদিন পযর্ন্ত চাকরির পর আমি বিয়ের অনুমতি না পাচ্ছি ততদিন আমরা একসাথে থাকতে পারবনা। সে আমাদের বাড়িতেই আমার আত্মীয় হিসেবে থাকবে। আর আমি থাকব হোস্টেলে। মেনে নিয়েছিলাম দুজনেই সেই কথা।
সময় গুলো খুব ভালোই যাচ্ছিল আমাদের। বাবা আবার তাকে সাভারে নতুন করে কলেজ ভর্তি করিয়ে দেয়। সে বাড়িতে আর আমি হোস্টেলে। ফোনালাপে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো আমাদের। শিক্ষা জীবন শেষে চাকরি পাবার পর আমাদের দূরত্ব বাড়ল আরও। আগে যাও কিছুদিন পর পর ছুটিতে বাড়ি গেলে দেখা হতো, সেটাও হচ্ছিলনা। ট্রেনিং অবস্থায় চট্টগ্রাম ক্যান্টলম্যান্ট থাকতে হয় আমাকে। সেই সময় বুঝতে পারি সেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এভাবে সময় যেতে যেতে চাকরি জীবনে কেটে যায় আরও দুই বছর। এরপর ক্যাপ্টেন থেকে পদোন্নতি হয় আমার। একজন আর্মি মেজর হিসেবে পরিচয় পাই নিজের। ওহ হ্যাঁ! এর মাঝেই বিয়ের অনুমতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন সে রাজি ছিলনা। পরীক্ষার অযুহাতে আরও কিছুটা সময় চেয়েছিল। তবে সে যে আমার স্ত্রী তা আর গোপন থাকেনা। ছড়িয়ে পরে পুরো এলাকায়। এরপরই এক সময় আমি নিজেই ধৈর্য্যহারা হয়ে তাকে চাপ দেই আবার বিয়ের। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রী হলেও আইনত স্বামী-স্ত্রী ছিলাম না। দূরত্বটা আমার আর সহ্য হচ্ছিলনা। কি আর করব! রক্তে-মাংসে গড়া পুরুষ মানুষ বলে কথা। হরমোনাল কারিশমার কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছিলাম। একসময় সেও রাজি হয়। আনন্দের আমার অন্ত থাকেনা। লম্বা একটা ছুটি নিয়ে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি যেতে যেতে মাঝ রাত হয়। বাবাকে জানিয়ে দেই আগেই আমি আসছি। আর কাওকে জানাইনি। ভালোবাসাকে সারপ্রাইজ দিব ভেবেছিলাম। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকেই তার সাথে থেকে সমস্ত চাওয়া পূরণ করব। কিন্তু সেদিন তাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই যে মস্ত বড় এক সারপ্রাইজ পেয়ে যাব ভাবিনি কখনো। চুপিচুপি মধ্য রাতে বাবার সহযোগীতায় ঘরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে যাবার সময় হঠাৎ একটা রুমের সামনে থমকে যায়। একের পর এক শিৎকারের শব্দে কান গরম হয় আমার। আমার জানা মনে বাড়িতে তখন মা-বাবা, সংগ্রাম, ইতি আর সে ছাড়া অন্য কেউ নেই। সেখানে এমন একটা ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে! বোধশক্তি হারিয়ে দরজায় অল্প আঘাত করতেই খুলে যায়। দুজন মানুষ খেলায় এতোটাই মত্ত ছিল দরজা লাগানোর চিন্তাটাও মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে নিজের ছোট ভাই আর প্রাণপ্রিয় নারীটাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে এক মুহুর্তের জন্য সব ভুলে গিয়েছিলাম আমি। মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচ থেকে সমস্ত কিছু সড়ে গেছে। ডুবে যাচ্ছি আমি কোনো এক অতলে। তখনও ওদের কোনো হুশ নেই। নিজেদের মতো ব্যস্ত তারা। যখন আমি নিজের বোধ ফিরে পায় তখন অনুভব করে পায়ের রক্ত আমার সব মাথায় উঠে গেছে। আমি পাগল হয়ে গেছি। মগজে কোনো এক রাক্ষুসে পোকা তান্ডব চালাচ্ছিল। সেই তান্ডবে স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে যায় রান্নাঘরে। চোখের সামনে ধারালো বটি দেখে সেটা নিয়েই আবার ফিরে আসি। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে এক এলোমেলো কয়েকটা কুপ দিয়েই চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাই আমি। পরদিন নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। হাতে-পায়ে শিকল পরানো। মাথার কাছে পুলিশ দাঁড়িয়ে। জ্ঞান ফিরতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সেখানেই খবর পায় বিশ্বাসঘাতক দুটো মারা গেছে। খবরটা আমার বাবা নিজেই দেয়। সেই বাবা যে এতো বড় একটা মাইন্ড গেইম খেলতে পারে আমার সাথে ভাবিনি কখনো। যাক নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম সুখের সংসার গড়ার। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিয়ে যাকে সেইফ রাখতে রিস্ক নিয়ে বিয়ে করেছিলাম ছাত্র কালে। সেই ভালোবাসার মানুষটাকেই যখন নিজের ভাইয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছিলাম তখন আমি ভেবেছিলাম হয়তো মরেই গেছি। কিন্তু বিধাতা বাঁচিয়ে রেখেছিল ভাগ্যে আরও যে কষ্ট গুলো ছিল সেগুলো সহ্য করার জন্য।”
চলবে….
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৫
#আদওয়া_ইবশার
কিছু অতীত থাকে, যার আবছায়া দিন গুলো মানব মন স্বরণ করে খুশির জোয়ারে গা ভাসায়। আবার কিছু অতীত থাকে, যে অতীতের ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্রাংশ স্বরণ হলেই নিভৃতে পুড়ে ছাই হয় অন্তর। নতুন করে তাজা হয় পুরোনো ক্ষত। বহুদিন পর মনের মাঝে চাপা রাখা সত্য গুলো ভরসার কাওকে পেয়ে উন্মোচন করে নির্বিকার বসে আসে রক্তিম। তার মাঝে এমন কোনো ভাবাবেগ নেই যা দেখে পাশের জন বুঝতে পারবে বিবর্ণ অতীত নতুন করে তার হৃদয়ে দগদগে ঘা সৃষ্টি করেছে। অথচ অন্তর জানে, মানুষটা উপর থেকে নির্লিপ্ত থাকলেও ভিতরটা তার পুড়ে ছাই হচ্ছে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোটার মতো এক একটা অশ্রুকণা অবলীলায় ঝরে পরছে দৃষ্টির আক্ষিকোণে। যতই কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে ততই যেন কান্নার বেগ বাড়ছে। অবুঝ মন বারবার প্রশ্ন তুলছে, কেন তার ভালোবাসার মানুষটাই ভুল মানুষকে ভালোবাসলো? এক জীবনে একটা মানুষের ভাগ্যে কি বিধাতা এতোটাই দুঃখ লিখে রাখে? না কি একমাত্র তার ভালোবাসার মানুষটার ভাগ্যই এমন! বুকটা যেমন জ্বলছে রক্তিমের কষ্টে, তেমন করেই জ্বলছে এই ভেবে,অতীতে একজনকে রক্তিম পাগলের মতো ভালোবাসতো। যাকে পাবার আশায় নিজের শখ, স্বপ্ন ধুলিসাৎ করতেও প্রস্তুত ছিল সে। আর আজ দৃষ্টির হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার এক বিন্দু পরিমাণ মূল্যটুকুও নেই তার কাছে। এজন্যই হয়তো বলে, আমি যাকে চাই সে আমাকে চায়না, আবার সে যাকে চায়, সেও তাকে পায়না। নিয়তির নিষ্ঠুর খেলাই ভালোবাসা আজীবন অধরা। বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় ভাড়ী গোটা পৃথিবীর বিশুদ্ধ বাতাস। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিম দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“এবার বলো, হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে আগলে রাখার প্রতিদানে যে মানুষটার মন আজ একের পর এক আঘাতে জর্জরিত, সে মানুষটা কিভাবে নতুন করে ভালোবাসতে পারবে? দ্বিতীয়বার ভালোবাসার মতো সাহস,শক্তি কোনোটাই আমার নেই।”
কোলের উপরে রাখা হাত দুটোর দিকে নজর রেখে দৃষ্টি কান্নার ঢোক গিলে বলে,
“আপনাকে ভালোবাসতে হবেনা। শুধু আমার প্রতি এক বিন্দু দয়া দেখিয়ে আপনার পাশে থাকতে দিন। আমাদের দুজনের জন্য আমার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট।”
কথাটুকু শেষ করে ক্ষণকাল বিরতি নিয়ে স্মিত হেসে আবারও বলে ওঠে দৃষ্টি,
“এই ভালোবাসার খেলাই আমার আর আপনার মাঝে অদ্ভূত একটা মিল খোঁজে পাচ্ছি আমি।বলুন তো কি?”
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় রক্তিম। ক্ষীণ স্বরে জানতে চায়,
“কি?”
দৃষ্টি আবারও বলে ওঠে,
“অতীতে আপনি যেমন একটা মানুষকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন, ঠিক সেভাবেই বর্তমানে আমিও আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। জেরিনের কাছে আপনার ভালোবাসার কোনো মূল্য ছিলনা। যার কারণেই সে আপনাকে ছেড়ে যেতে পেরেছে। বর্তমানে আপনার কাছেও আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। এতে কি অনুমান করা যাচ্ছে? এই ভালোবাসার খেলাই যদি আবারও কারো ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে থাকে তবে সেটা আমি। কারণটা আপনার হয়তো খুব ভালো করেই জানা। যে মানুষ ভালোবাসতে পারে, সে কখনো ঠকাতে পারেনা। ভালোবাসা না থাকলেই ঠকানোর প্রশ্নটা আসে। আমার হৃদয়ে তৈরি হওয়া আপনার প্রতি অনুভূতির প্রগাঢ়তা কতটুকু,তা আমি হয়তো ভাষায় বলে বোঝাতে পারবনা। তবে এতটুকু বলতে পারি,এই প্রগাঢ় অনুভূতিদের হৃদয় থেকে উপরে ফেলার সাধ্যি আমার নেই। সেখানে ঠকানোর প্রশ্ন আসে কিভাবে!”
প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেনা রক্তিম। কতক্ষণ নিরব থেকে আবারও একটা দির্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমি জীবনটাকে সব দিক থেকেই একটা সুযোগ দিতে চাই। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে ঠকতে ঠকতে এই পর্যায়ে এসে হয়তো ঠকে যাওয়ার ভীতিটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারবনা।আর না পারব ভালোবাসতে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আগলে রাখব।যা চাইবে সব পাবে। শুধু ভালোবাসা ছাড়া।পারবে আমার সাথে ভালোবাসাহীন সম্পর্ক গড়তে?”
এক একটা দির্ঘশ্বাসের সাথে একটা মানুষের ভিতরে দলা পাকিয়ে থাকা কষ্ট গুলো যদি বাষ্পের মতো না বেরোতে পারত,তবে হয়তো বুকে কষ্টের পাহাড় সৃষ্টি হয়ে বেঁচে থাকা দুরহ হয়ে যেত। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দৃষ্টি নিজেকে শান্ত করে রক্তিমের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
“এই পৃথিবীতে সব মানুষের সংসার ভালোবাসা দিয়ে হয়না। একশোর মাঝে যদি বিশজন দম্পতির সংসারে ভালোবাসা খোঁজে পান, তবে বাকী আশিজন দম্পতির সংসারই দেখবেন ভালোবাসাহীন। তবুও তারা দিব্যি হাসি মুখে সংসার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকে। কিসের জুড়ে জানেন!মায়ার জুড়ে।আমার জানামতে সংসার দুই ধরনের হয়। একটা ভালোবাসার সংসার, আর একটা হলো মায়ার সংসার। আমি আপনাকে সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস সবই দিব। বিনিময়ে আপনি শুধু আমাকে একটু মায়া দিবেন। ঐ মায়ার জালে আটকা পরেই আমি থেকে যাব আমৃত্যু। আমাদের দুজনের সংসারটাকে সুখ দিয়ে মুড়িয়ে রাখার জন্য আমার ভালোবাসা আর আপনার একটু মায়াই যথেষ্ট।”
কথারা বোধহয় এবার পালিয়েছে দুজনের থেকেই। আবারও নিরবতায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। কিন্তু মন তার ভাবনাঘরে তালা দিতে সক্ষম হয়নি। পাশাপাশি বসে থাকা দুজন মানুষের মনের মাঝে চলছে এলোমেলো অন্তহীন কিছু ভাবনা। এই অসম সম্পর্কটা কি আদও তারা শেষ অব্দি টিকিয়ে রাখতে পারবে? আজকাল রক্তিম মনের ঘরে মেয়েটার জন্য ভালোবাসা খোঁজে না পেলেও অদ্ভূত একটা টান অনুভব করে। এই টান কিসের ভেবে পায়না সে। “কায়া দেখলে মায়া বাড়ে”কথাটাই হয়তো ঠিক। ভালোবাসা সৃষ্টি না হলেও মায়ার সৃষ্টি ঠিকই হয়ে গেছে। দৃষ্টিও হয়তো এটাই চেয়েছিল। মানতে হবে মেয়েটা বড্ড চালাক। সে হয়তো জানত এই পাষাণ শিকদারের পাথর মনে ভালোবাসা তৈরী না হলেও, ঠিক একদিন মায়া তৈরী হবে। সেই মায়ার টানেই পাষাণ মন ঘর বাঁধতে চাইবে।না হলে কি আর মুখ বুজে শত অপমান সহ্য করে দাঁত খিঁচিয়ে পরে থাকত মেয়েটা!
“আমার মস্তিষ্কে একটা দুষ্টু পোকা বাস করে। পোকাটা অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে থাকলেও হুটহাট জাগ্রত হয়ে তান্ডব শুরু করে। যে তান্ডবের মুখে তুমি নিজেও এর আগে দুই-একবার পরেছো। ভবিষ্যতে আরও পরবে। পারবে তো শেষ পযর্ন্ত এই খিটখিটে, বদমেজাজী মানুষটার পাগল পাগল অত্যাচার গুলো সহ্য করে থেকে যেতে?”
রক্তিমের কথা গুলো দৃষ্টির এবার একটু অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে লোকটা তাকে ভয় দেখানোর পাইতারা করছে। যেমন দেখায় ছোট বাচ্চাদের ভূত-পেত্নির ভয়। বাঁকা চোখে তাকায় দৃষ্টি রক্তিমের দিকে। বলে,
“কালকে আমাকে একটা রেঞ্জ এনে দিয়েন তো।”
কিসের মাঝে কি? ভালোবাসা না পাবার শোকে পাগলটাগল হয়ে গেল না কি মেয়েটা!
“রেঞ্জ দিয়ে কি করবে?”
গা ঝাড়া দিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। চায়ের কাপ দুটো যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলে,
“ঐযে বললেন না! আপনার মাথায় না কি একটা পোকা বাস করে। ভাবছি রেঞ্জ দিয়ে আপনার মাথার চান্দি খুলে পোকাটাকে বের করে আবার মাথা ঠিকঠাক সেট করে নাট-বল্টু টাইট দিয়ে ফেলব।”
এমন একটা অদ্ভূত কথায় রক্তিম বিরক্ত হতে গিয়েও অল্প শব্দ করে হেসে ফেলে। হঠাৎ পুরুষালী ক্ষীণ হাসির শব্দে দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ পিছন ঘুরে তাকায়। কিন্তু তার তাকানোর আগেই রক্তিম ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি বিলীন করে গম্ভীরমুখো রূপ ধারণ করে। দৃষ্টি সাবক হরিণের ন্যায় চোখ দুটো বড় বড় করে হতবাক চাহনি নিক্ষেপ করে রক্তিমের দিকে। কন্ঠে অঘাত বিস্ময় নিয়ে জানতে চায়,
“একটু আগে কে হাসল?”
“ফালতু কথা রেখে ঘুমাও গিয়ে।”
চোরা হাসে দৃষ্টি। শ্রাগ করে বলে,
“হাসল কে বলুন আগে। কি বিশ্রী হাসির শব্দ! আমি শিওর ঐটা কোনো মানুষের হাসি ছিলনা। নির্ঘাত কোনো শয়তান হেসেছিল। বাপরে বাপ! একটুর জন্য আমার হার্ট ফেল হয়নি।”
দৃষ্টি যে সবটা বুঝেও এমন ফাজলামি জুড়েছে ঠিক ধরে ফেলেছে রক্তিম।ঘাড় বাঁকা করে তাকায় রক্তিম। মুখের ভঙ্গিমাতে গম্ভীরতা এটে বলে,
“যাবে না কি কানের নিচে একটা লাগাবো?”
কোথায় ভেবেছিল ফাজলামি করার একটা সুযোগ পেয়ে সেটা কাজে লাগিয়ে মন খারাপিটাকে বিদায় করবে। উল্টো এখন মনে হয় এই গুরুগম্ভীর লোকটার সাথে ফাজলামি করে মন ভালো করার বৃথা চেষ্টার থেকে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকা অতি উত্তম হবে। কথাটা ভেবে মুখ ঝামটে ঘরের ভিতর পা বাড়ায় রক্তিম। কন্ঠে অল্প অভিমানের আভাস নিয়ে বলে,
“গেলাম আমি ঘুমাতে। কারো যদি ইচ্ছে হয় তবে সারা রাত না ঘুমিয়ে বাড়ি পাহারা দিক। এবার অসুস্থ হলে আমিও আর ধারেকাছে ঘেঁষবনা। দেখব কিভাবে কি করে।”
কপট রাগি ভঙ্গিমায় রুমে এসে বিছানায় পা তুলে ওঠে বসে দৃষ্টি। তখনই চোখ যায় টেবিলে বইয়ের উপর রাখা তাজা বেলি ফুলের মালা। নিমিষেই চোখ দুটো বৃহদাকৃতির হয়ে যায়। কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থেকে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পরে। মালাটা হাতে নিয়ে বিস্মিত নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলে চমৎকার হাসি। গলা উঁচিয়ে রক্তিমকে শুনিয়ে বলে ওঠে,
“কি গো! কোথায় আপনি? দেখে যান কি সর্বনাশা কান্ড ঘটে গেছে। শয়তান তার বিটলামি হাসি উপর দেওয়ার পাশাপাশি আমাকে বেলি ফুলের একটা মালাও উপহার দিয়েছে।”
স্মিত হাস্যে রক্তিম শীতল পাটি থেকে ওঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে অল্প হাসির রেখাটুকু ঠোঁটের কোণে ধরে রেখেই ঘরের ভিতর পা বাড়ায়। দৃষ্টির পিছনে দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত রেখে রগর করে বলে,
“শয়তানের মনে হয় তোমাকে ভালো লেগে গেছে। প্রেম করতে চায়। তাই ফুল দিয়ে ইমপ্রেস করতে চাইছে।”
তড়িৎ পিছন ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ইনডাইরেক্টলি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে না কি?ইশ! একদিনে এতো চমক! এবার বোধহয় সত্যি সত্যি অতি খুশিতে হার্ট এটার্ক হয়েই যাবে।”
দৃষ্টির হাতে থাকা মালাটা লক্ষ্য করতে গিয়ে রক্তিমের চোখে পরে তার হাতের চিকন দুটো চুড়ির দিকে। মনে পরে দৃষ্টিই একদিন বলেছিল এই চুড়ি দুটো সে প্রথম যেদিন বউ হয়ে শিকদার মঞ্জিলে পা রেখেছিল সেদিন রেহানা বেগম নিজ হাতে পারিয়ে দিয়েছিল। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আবারও গম্ভীর্যতায় ছেয়ে যায়। কাটকাট ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দৃষ্টির দিকে। হাতে থাকা মালাটা নিজের হাতে নিয়ে রেখে দেয় টেবিলে। পরপর যত্ন করে চুড়ি গুলো খুলে দিতে দিতে বলে,
“ঐ বাড়ির আর কি কি আছে তোমার কাছে?”
রক্তিমের হঠাৎ এমন আচরণে প্রথমে একটু অবাক হলেও পরমুহূর্তে দৃষ্টি বুঝে যায় আসল ঘটনা। প্রশ্নের উত্তরে বলে,
“আপনি?”
চোখ পাকিয়ে তাকায় রক্তিম। কপট রাগি ভাবে বলে,
“সবসময় ফাজলামি ভালো না।”
“আরেহ! ফাজলামি কোথায় করলাম? আপনি তো ঐ বাড়ির ছেলেই। এই চুড়ি গুলো আপনার মা প্রথম দিন পরিয়ে দিয়ে বলেছিল হাত থেকে যেন কখনো না খুলি। মুরুব্বিরা বলে বউয়ের হাতে চুড়ি না থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়। শাশুড়ির কথা রাখতে গিয়ে আর খুলিনি হাত থেকে। এরপর ইতির বিয়ের সময় যে গয়না গুলো দিয়েছিল সেগুলো তো ঐ বাড়িতেই আলমারিতে খুলে রেখে দিয়েছিলাম। এখন আমার কাছে ঐ বাড়ির জিনিস চুড়ি আর মানুষ আপনি এই দুটো ছাড়া আর কিছুই নেই। তাহলে বলব কি?”
শীতল দৃষ্টিতে রক্তিম কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“যদি জন্ম পরিচয়টা সত্যি সত্যি মুছে ফেলা যেতো, তবে সেটা অনেক আগেই করে ফেলতাম। আজকে শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, আমার অতীত বা একমাত্র ইতি ব্যতিত ঐ বাড়ির কোনো সদস্য নিয়ে আমি যেন তোমার মাঝে কোনো কৌতূহল না দেখি। ঐ বাড়ির মানুষ, জিনিস সব থেকেই দূরে থাকবে।”
কিছু কিছু জিনিস নিয়ে কখনো মজা করা খাটেনা। কথাটা না ভেবেই মজা করা ঠিক হয়নি দৃষ্টির। অথবা মানুষটার ভালো মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছে। ভেবে মাথা নিচু করে নেয় দৃষ্টি। অস্ফুটে বলে,
“স্যরি।”
চোখ দুটো বন্ধ করে লম্বা দুটো নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে রক্তিম। মাথা থেকে অতীতের ভাবনা চিন্তা গুলো ঝেড়ে ফেলে। চুড়ি দুটো টেবিলের এক কোণে রেখে বেলি ফুলের মালাটা হাতে তুলে নেয়। দৃষ্টির একটা হাত টেনে নিয়ে মালাটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“হাত খালি থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়, এমন কুসংস্কার তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ে কিভাবে কানে নেয়? এসব কুসংস্কার যেন আর কখনো মানতে না দেখি।”
অল্প মন খারাপ যেটুকু উঁকি দিয়েছিল, রক্তিমের আলতো পরশে সেটুকু যেন হুট করেই লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেছে। মন জমিন ছেয়ে গেছে সুখ সুখ আবেশে। অধর কোণে আবারও উন্মোচিত হয় প্রাপ্তির হাসি। একদিনে সত্যিই না চাইতেও একটু বেশিই সুখ পেয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি। রক্তিম যে সেই দুপুরের ইচ্ছেটুকু স্বরণে রেখে রাতে চুপিচুপি ফুল নিয়ে হাজির হবে কল্পনাও করেনি দৃষ্টি। এখন আবার সে নিজেই যত্ন হাতে পেচিয়ে দিচ্ছে! এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কল্পনাতীত সুখটা যখন হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়, মন তখন ঠিক কতটা আনন্দিত হয় তা একমাত্র ঐ কল্পনাতীত সুখ পাওয়া মানুষটা ছাড়া আর কেউ জানেনা। সৃষ্টিকর্তা এবার বোধহয় সত্যিই দৃষ্টির দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে! দৃষ্টি-রক্তিম দুজনের জীবন থেকে এবার হয়তো সমস্ত অন্ধকার এভাবেই দূর হবে। উজ্জীবিত হবে এক সুখময় আলোকিত দিন। খরাপ্রবণ মন জমিনে ঝুমঝুমিয়ে বর্ষণ নেমে আসবে।
চলবে….
(রি-চেইক দেইনি। অনেক ভুল থাকতে পারে। একটু মানিয়ে নিবেন )