দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৩০+৩১

0
512

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩০
#আদওয়া_ইবশার

অশান্ত মস্তিষ্ককে কোনোমতে শান্ত করে একটানা তিন ঘন্টার পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরিয়েছে দৃষ্টি। আদালতে কি হয়েছে ভাবনা, চিন্তায় বুকের ভিতরটা অবিরাম কাঁপছে। রাস্তায় শিক্ষার্থী সহ অভিভাবকদের উপচে পরা ভীড়। ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে পরিচিত কোনো মুখ খুজতে ব্যস্ত দৃষ্টি। মিনিট দুইয়েক পাড় হতেই দেখতে পায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে রাকিব এগিয়ে আসছে তার দিকে। দ্রুত পা চালিয়ে দৃষ্টি নিজেও এগিয়ে যায় সেদিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথমেই জানতে চায়,

“কি হয়েছে কোর্টে? ওনার জামিন হয়েছে তো?”

দৃষ্টির প্রশ্ন রাকিবের কানে গেল কি না কে জানে! প্রশ্ন দুটো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাকিব ভাঙা স্বরে বলে,

“ভাই হাসপাতালে। জ্ঞান নাই। অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাড়াতাড়ি আসেন।”

বলতে বলতেই রাকিবের চোখে জমে থাকা অশ্রুজল টুপটাপ ঝরে পরে কার্নিশ বেয়ে। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। এতোক্ষনের বুকের ভিতরের অস্থিরতাটা এবার যেন শ্বাস রোধ করে নেয়। মনে হয় পৃথিবীতে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বড্ড অভাব। হাঁসফাঁস করে দৃষ্টি। পাগলের মতো হাটু গেড়ে বসে পরে সেখানেই। সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে বেজে ওঠে বিধ্বস্ত এক কিশোরীর আর্তনাদ। বুকে জমে থাকা কষ্ট গুলো একে একে বেরিয়ে আসে প্রতিটা চিৎকারের সাথে। ছোট্ট হৃদয়ে কষ্টের বোঝাটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেছিলো। সেই ভার সহ্য করতে না পেরে জনসম্মুখেই হিতাহিত জ্ঞান ভুলে দুঃখ বিলাসে মেতে উঠেছে। মাঝ রাস্তায় এক কিশোরী মেয়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদে জনগণ বিমূঢ়। অবাক নেত্রে শুধু তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে বিধ্বস্ত দৃষ্টিকে। রাকিব বুঝতে পারে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খুব বড় এক ভুল করে বসেছে। এখন এই ভঙ্গুর হৃদয়ের মানবীকে কিভাবে সামলাবে সে? ইতিমধ্যে দৃষ্টিকে ঘিরে জটলা বেঁধে গেছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জানতে চাইছে, কি হয়েছে? আবার কেউ কেউ দূর থেকেই মায়া মায়া দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে দুঃখবিলাসিনীকে। কয়েকজন মহিলার সহযোগীতায় একটা সিএনজি ঠিক করে দৃষ্টিকে তুলতে সক্ষম হয় রাকিব। হাসপাতালে যাবার পুরোটা সময় চিৎকার করে কেঁদে গেছে দৃষ্টি। অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বারবার বলেছে। বুঝতে পারেনি রাকিব। বিষাদের প্রলেপ ঘেরা মুখটা দেখে কি যে মায়া হয় রাকিবের! এতোদিন এই মেয়েটাকে দেখলেই তার রাগ হতো। ইচ্ছে হতো পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়া করার। তবে আজ খুব করে চাইছে কোনো এক জাদুবলে ঘুচে যাক বিষাদিনীর সমস্ত বিষাদ।

হাসপাতালের সামনে সিএনজি থামতেই পাগলের মতো ছুটে যায় দৃষ্টি। জ্ঞানশূণ্য হয়ে যেদিকে দুচোখ যাচ্ছে সেদিকেই ছুটছে। রাকিব কোনোমতে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত বেগে এসে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই দৃষ্টির একটা হাত শক্ত করে ধরে নেয়। বলে,

“এমন পাগলামি করবেন না। মানুষ খারাপ বলছে।আমার সাথে আসুন। ভাই চতুর্থ ফ্লোরে। এখানে না।”

রুদ্ধশ্বাসে রাকিবের সাথে লিফটের ভিতর দাঁড়িয়ে যায় দৃষ্টি। এতোক্ষন যাবৎ এক সুরে চিৎকার করে কান্নার ফলে নেতিয়ে গেছে। গলা চিরে এখন আর চিৎকারের শব্দ আসছেনা। তবে ফোঁপানোর শব্দটা রয়ে গেছে। লিফট চতুর্থ ফ্লোরে থামতেই দুজন সমান গতিতে কয়েক লাফে আইসিইউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দৃষ্টি দেখে নেয় শক্ত খোলসে আবৃত প্রতিটা পুরুষের চোখে আজ অশ্রু। মেহেদী, জাবির, শান্ত সহ আরও কিছু পরিচিত-অপরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে। পাশেই চেয়ারে শরীর ছেড়ে বসে আজীজ শিকদার। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে নিঃশব্দে। আজীজ শিকদারের দেখা পেয়ে দৃষ্টি যেন এবার একটু ভরসা খোঁজে পায়। ছুটে গিয়ে জানতে চায়,

“বাবা!ওনি কোথায়? কি হয়েছে ওনার? আমি দেখব। একটাবার দেখব শুধু।”

কান্নায় এইটুকু সময়েই গলা বসে গেছে দৃষ্টির। কন্ঠস্বর কেমন রুক্ষ শুনাচ্ছে। কোনো জবাব দেয়না আজীজ শিকদার। কতক্ষণ জবাবের আশায় তাকিয়ে থেকে ধৈর্য্যহারা হয়ে মেহেদীর কাছে ছুটে যায় দৃষ্টি। অনুরোধের স্বরে বলে,

“ভাইয়া! আপনিও চুপ করে থাকবেন না প্লিজ। বলুন ওনি কোথায়? আমি শুধু একবার দেখব। আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে আর টেনশন দিবেন না। নিতে পারছিনা আমি আর এসব। মরে যাব। একদম মরে যাব।”

কথা গুলো বলতে বলতেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে দৃষ্টি। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে সমস্ত কিছু। মেঝেতে লুটিয়ে পরার আগেই ধরে নেয় মেহেদী। তড়িৎ দুজন নার্স ডেকে ধরাধরি করে একটা কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখে জানায় অত্যন্ত দুর্বল শরীর। স্ট্রেস বেশি হয়ে গেছিল। এতো ধকল সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। মাঝ সাগরে ডুবতে গিয়েও যেন ডুবছেনা কেউ। কেমন একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই যেন বিপদ। একটু একটু করে ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গছে প্রত্যেকের। ক্ষীণ হচ্ছে আশার আলো। রক্তিম-দৃষ্টির গল্পের শেষ পরিণতি কি এটাই? হঠাৎ আসা এই ঝড়েই কি নিঃশেষ হবে তাদের অসমাপ্ত গল্প। দুচোখ জুড়ে হাজার স্বপ্ন বুক ভরা আশা নিয়ে ছন্নছাড়া রক্তিমকে ভালোবেসেছিল যে মেয়েটা, সৃষ্টিকর্তা কি তার ভাগ্যে বিয়ে পরবর্তী দিন গুলোতে এক বিন্দু সুখ রাখেনি? এ কেমন নিষ্ঠুর বিচার তার?

বুক চিরে হতাশার নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর। দুহাতে মুখ ঢেকে কতক্ষণ চুপ থেকে অন্যদের উদ্দেশ্যে বলে,

“রক্তিমের কথা আপাতত বাড়িতে যেন আর কেউ না জানে। দুজনকে সামলাতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকীদের সামলানোর ধৈর্য্য আমার আর নেই।”

দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসে আইসিইউ থেকে। উদগ্রীব হয়ে ছুটে যায় সকলেই। ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে ডাক্তারকে। অধৈর্য হয়ে মেহেদী জানতে চায়,

“কি অবস্থা ওর? ভালো আছে তো! জ্ঞান ফিরেছে? রিপোর্ট কি এসেছে?”

আস্তেধিরে মুখ থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক খুলে প্রতিটা উৎসুক মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে ডাক্তার। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে জানায়,

“সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল। স্ট্রোক হয়েছে। ডান পাশ প্যারালাইজড।আর ঘন্টা খানেক অবজারবেশনে রাখব। এরপর কেবিনে শিফট করব।”

হঠাৎ যেন প্রতিটা মানুষের মাথায় মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরেছে। শরীর ছেড়ে দেয় প্রত্যেকে। দুহাতে মুখ ঢেকে চোখের জল ছেড়ে দেয় মেহেদী। অশান্ত মন গুলো শান্ত হবার বদলে নতুন করে চোরাঝড়ের সম্মুখিন হয়ে আরও অশান্ত রূপ নিয়েছে। নিভু নিভু জ্বলা আশার প্রদিপটা ঝুপ করেই নিভে গেছে।এটুকুই কি বাকী ছিল? একটা মানুষের জীবনে আর কতভাবে দুর্দশা দিবেন সৃষ্টিকর্তা? একের পর এক আঘাতে মৃতপ্রায় জীবনটা এমন নির্জীবের মতো পরে থাকার থেকে না হয় মরেই যেতো। মৃত্যু অন্তত রেহাই দিত এই অভিশপ্ত জীবন থেকে। কিন্তু হায়! মৃত্যও যেন রক্তিমকে উপহাস করছে। সেও দেখতে চাচ্ছে একটা মানুষ এক জীবনে ঠিক কতটা দুঃখ সইতে পারে।

মুখ থেকে হাত সরিয়ে পাগলের মতো মাথার চুল খামচে ধরে মেহেদী। শরীর কাঁপিয়ে হাটু মুড়ে নিঃশ্বের কান্নায় ভেঙ্গে পরে। হাতের উল্টো পিঠে সিক্ত চোখ মুছে এগিয়ে আসে জাবির। এক হাত মেহেদীর কাধে রেখে ধরা গলায় বলে,

“ভাই! আপনি এভাবে ভেঙ্গে পরলে আমরা কি করব? রক্তিম ভাইয়ের পর তো আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। আর ভাবি! ভালোবাসার কাঙ্গাল ঐ মেয়েটাকে কে সামলাবে? আপনার কাধে যে এখন অনেক বড় দায়িত্ব। একজন ভাই হয়ে ভাবির পাশে ছায়ার মতো থাকতে হবে। ভাইকে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলতে হবে। আমরা ভাইকে খুব বেশিদিন বিছানায় পরে থাকতে দেখতে পারবনা। সবাই মিলে খুব তাড়াতাড়ি ভাইকে সুস্থ্য করে তুলব। আমাদের এতো গুলো মানুষের মনের জোর মিথ্যে হতে পারেনা। ভাই সুস্থ্য হবে। আবার আগের মতো পুরো সাভার জোরে রাজ করে বেড়াবে।”

ক্ষনকাল পর নিজেকে শান্ত করে ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মেহেদী। শীতল চোখে তাকায় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা আজীজ শিকদারের দিকে। নিস্তেজ ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,

“এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি তাইনা! এবার শান্তি পেয়েছেন তো? মনের জ্বালা মিটেছে? নিজের সন্তানকে তিলে তিলে নিজ হাতে মেরেছেন। দেহের মৃত্যু না দিয়ে মনের মৃত্যু দিয়েছেন। এক কুলাঙ্গারের জন্য এক স্বপ্নবাজ ছেলের স্বপ্ন গুলো গলা টিপে হত্যা করেছেন। এখন তো আপনার খুশির অন্ত থাকবেনা। আর কোনো লুকোচুরির ও প্রয়োজন পরবেনা। আদরের কলিজার টুকরা চরিত্রহীন ছেলে আর পুত্রবধূ নিয়ে নিশ্চিন্তে নিজ গৃহে শান্তিতে থাকতে পারবেন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখনো এখানে? যান না! দ্রুত যান। রক্তিম নামের গলার কাটা আজ নিথর দেহে পরে আছে হাসপাতালের বেডে। এই খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা অতিব জরুরি।”

কথা গুলো শোনা মাত্রই অত্যাধিক রাগে কিড়মিড়িয়ে সর্বসম্মুখে আজীজ শিকদার থাপ্পড় বসিয়ে মেহেদীর গালে। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে,

“একদম চুপ! বেয়াদব! একজন বাবাকে বিচার করার ক্ষমতা কবে হয়েছে তোমার? সংগ্রাম যেমন আমার সন্তান তেমন রক্তিম ও আমার সন্তান। বরং সংগ্রামের থেকেও রক্তিমের প্রতি আমার টান একটু হলেও বেশি। কারণ সে আমার বড় সন্তান। তার জন্যই আমি প্রথম বাবা হবার অনুভূতি চিনেছি। প্রথম বাবা ডাক শুনেছি ওর মুখ থেকে। সবাই শুধু একপাক্ষিক ভাবে ওর দিকটাই দেখছো। কারণ ওর দুঃখ গুলো দৃশ্যমান। আর আমার! আমি তো বাবা। বাবাদের কোনো দুঃখ,কষ্ট প্রকাশ করতে নেই। আজ কেউ আমাকে বুঝবেনা। আমার ছেলেও না। বুঝবে সেদিন। যেদিন নিজেরা বাবা হবে। একজন বাবা ছাড়া কখনও অন্য কেউ একজন বাবার দুঃখ বুঝতে পারেনা। সব কিছু ছাপিয়ে আজ সত্যিই আমি অপরাধি। সন্তানদের ভালো করতে গিয়ে, একটা শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে গিয়ে আজ আমি একজন আদর্শ বাবা থেকে নিকৃষ্ট বাবাতে পরিণত হয়েছি।”

নিরব কান্নার সাক্ষী বহন করছে আজীজ শিকদারের রক্তিম, ফোলা দুটো চোখ। কাঁপছে পুরো শরীর। জোর গলায় এতো গুলো কথা বলায় হাঁপিয়ে গেছে। বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কিছুই বলতে পারেনা আর। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পরে চেয়ারে। দুহাতে মুখ ঢেকে ছোট বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ভালো করতে গিয়ে ছোট্ট একটা ভুলের কারণে আজ এতো গুলো মানুষের জীবন বিপন্ন। যে ছেলের আঙুল ধরে টুকটুক করে হাঁটা শিখিয়েছিল ছোট্ট কালে। আজ সেই ছেলে পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় নিথর হয়ে পরে আছে। শুধুমাত্র নিজের ভুলের কারণে। একটা সময় যে ছেলের গোপন কথার সিন্ধুক ছিল, আজ সেই ছেলের দুঃখের সিন্ধুক হয়ে গেল। তালাবদ্ধ সিন্ধুক খুলে ছেলেকে ভাসিয়ে দিল দুঃখের সাগরে। বাবা-ছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বদলে নিঃশেষ করে দিল একেবারে। বাবা হয়ে নিজে হেঁটে বেড়াবে, আর ছেলে পরে থাকবে বিছানায়! কিভাবে সহ্য করতে এই দৃশ্য? ছেলের অচল দেহ দেখার আগে আল্লাহ মৃত্যু দিক এই পাপি বাবাকে। উঠিয়ে নিক পৃথিবী থেকে বাবা নামক ঘৃন্য মানুষটাকে।

****

রক্তিমকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আপাতত কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার ফলে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে একদম চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। দ্বিতীয়বার কোনো কিছু নিয়ে হাইপার হলে ধুকধুক নিঃশ্বাসটাও হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে হৃৎপিন্ডটা সচল থাকলেও ডান সাইডের পাশাপাশি পুরো শরীরটাই অকেজো হয়ে যেতে পারে। বিপদ এখনো উত পেতে আছে। যত সাবধানতা অবলম্বন করা যায় ততই ভালো। আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করার সময় দূর থেকে একবার রক্তিমের নিথর দেহটা দেখার সুযোগ হয়েছে একবার। ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে দ্বিতীয়বার কেবিনে গিয়ে দেখার সাহস কেউ করেনি।

রক্তিমকে কেবিনে শিফট করার কতক্ষণ পরই দৃষ্টির জ্ঞান ফিরে। পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে মাথার উপর সাদা ছাঁদ। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পরে যায় একে একে সমস্ত ঘটনা। সাথে সাথে ধরফরিয়ে ওঠে বসে। তখনই বা-হাতে ব্যথা অনুভব হয়। চোখ কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ক্যানুলায় স্যালাইন চলছে। দাঁত চেপে এক টানে ক্যানুলা খুলে ওঠে বসে। ক্যানুলায় বেকায়দায় টান লাগায় গলগলিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই দৃষ্টির। দৌড়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নার্স আটকে দেয় তাকে। বলে ওঠে,

“ম্যাম প্লিজ এভাবে ছুটবেন না। আপনার শরীর দুর্বল। আবারও মাথা ঘুরিয়ে পরে যেতে পারেন।”

দৃষ্টি শুনেনা কারো কথা। দুর্বল শরীরেই কিভাবে যেন শক্তি এসে ভর করে। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় নিজেদের। ছুটে গিয়ে থামে মেহেদীর সামনে। হাপিয়ে যাওয়া স্বরে বলে,

“কোথায় ওনি?”

ফ্যালফ্যাল নয়নে দৃষ্টির মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহেদী। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে কি যেন ভাবে। পরোক্ষনে চোখ খুলে দৃষ্টির হাত দুটো স্ব-স্নেহে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম সুরে বলে,

“দৃষ্টি! বোন তুমি তো অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে তাইনা? আমি ভাই হয়ে তোমার কাছে একটা আবদার রাখি! আমার আবদারটা ফেলে দিওনা প্লিজ। নিজেকে শক্ত করো। একমাত্র তুমি ছাড়া ঐ অভাগাটার আর কেউ নেই। তোমাকেই সবটা সামলাতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে। তুমিতো রক্তিমকে ভালোবাসো। এখন তুমিও যদি এমন ভেঙ্গে পরো অসুস্থ হয়ে যাও তবে রক্তিমকে কে দেখবে? বোন প্লিজ! শক্ত করো নিজেকে।”

একদম শান্ত দৃষ্টি।শীতল চোখে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থমকে যাওয়া কন্ঠে জানতে চায়,

“বেঁচে আছো তো!”

আৎকে ওঠে মেহেদী। তড়িৎ মাথা ঝাকিয়ে বলে,

“কিসব আজেবাজে ভাবছো! এমন কিছুই হয়নি। স্ট্রোক হয়েছে। এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলেছে আর কোনো টেনশন নেই। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তো। তাই ঘুমাচ্ছে। তুমি যাও। দেখে আসো। তবে ডেকো না। নিজে থেকে উঠলে তখনই কথা বলো।”

হঠাৎ দৃষ্টির এমন অস্বভাবিক শান্ত কন্ঠের এমন ভয়াবহ একটা কথায় মেহেদী বাকিটুকু বলার সাহস পায়না। কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের থেকে অনুমতি নিয়ে দৃষ্টিকে দেখার সুযোগ করে দেয়। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বুকটা মুচড়ে ওঠে দৃষ্টির। বলিষ্ঠ সুদেহী শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে। দাড়ি ভর্তি মুখটা কেমন ফ্যাকাশে! ধূসর ঠোঁট দুটো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের ভিতরের অশান্ত ঝড়টা আবারও টের পায় দৃষ্টি। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়। শরীরটা আবারও দুর্বল হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। অপলক তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাশে মুখটার দিকে। বুকের ভিতর কান্না আটকে রাখা দায় হয়ে পরছে। সব ভেঙ্গেচূরে তোলপাড় হচ্ছে। কিছুতেই পারছেনা নিজেকে সামলাতে। মুখে ওড়না গুজে ব্যর্থ হয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। অশান্ত মন সৃষ্টিকর্তাকে শুধু বলে, হে আল্লাহ! ধৈর্য্য দাও আমাকে। বাড়িয়ে দাও সহ্যক্ষমতা।

চলবে……

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩১
#আদওয়া_ইবশার

দুচোখ বন্ধ করে নিস্তেজ ভঙ্গিতে বিছানায় পরে আছে রক্তিম। ঘন্টা খানেক আগে ঘুম ভাঙ্গে তার। ভারী চোখ খুলে এক পলকের জন্য শুধু দেখেছিল সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় দৃষ্টিকে। এরপর সেই যে চোখ বন্ধ করেছে, ডাক্তারের ডাকেও কোনো সাড়া দেয়নি। একবার শুধু অস্ফুট স্বরে বলেছিল, তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। মুখের ডান পাশটাও অল্প একটু বেঁকে গেছে রক্তিমের। কথা কেমন জড়িয়ে আসে। ডাক্তারের মুখ থেকেই দৃষ্টি জানতে পারে রক্তিমের প্যারালাইজড এর বিষয়টা। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। না ফেলেছে এক ফোঁটা চোখের জল। অতি শোকে পাথর, কথাটাই যেন ফলেছে দৃষ্টির ক্ষেত্রে।শান্ত কন্ঠে শুধু ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিল,

“পুরোপুরি সুস্থ্য হবার সম্ভাবনা কতটুকু?”

ডাক্তার যখন জানতে পারে পেশেন্ট রক্তিম শিকদারের স্ত্রী এই অল্প বয়সী দৃষ্টি মেয়েটা,তখন কিছু সময়ের জন্য থমকায়। সহানুভূতির নজরে তাকায় কিশোরী মেয়েটার দিকে। ভাবে এটুকু একটা মেয়ে! এই বয়সে তো তার বই, বন্ধু-বান্ধব নিয়েই মেতে থাকার কথা। অথচ সেই মেয়েটাই কি না ভাগ্যের ফেরে আজ প্যারালাইজড স্বামীর সবথেকে কাছের অভিভাবক! নিশ্চয়ই সুস্থ্য স্বাভাবিক স্বামীর ঘরে দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল। হাতে হাত রেখে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে দুজন। স্বামীর কাধে মাথা রেখে চোখ বুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিবে। ছোট, বড় সমস্ত আবদার, আহ্লাদ পূরণ করবে স্বামী। কিন্তু আজ! স্বামী নামক মানুষটা তার নির্ভরতার স্থান হবার বদলে উল্টো সেই আজ স্বামীর নির্ভরতার স্থান। অল্প বয়সেই স্বামী সুখ থেকে বঞ্চিত হলো মেয়েটা। কাধে তুলে নিতে হবে পঙ্গু স্বামীর সকল দায়িত্ব। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল ডাক্তার আসলাম হাজারী। স্মিত হেসে ভরসা দিয়ে বলেছিল,

” আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলোনা মা। চিকিৎসা এক ধারা আর মনের জোর আরেক ধারা। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো। নেগেটিভ কোনো কিছু মাথায় না এনে সবসময় পজেটিভ ভাবো। তোমার স্বামীর যা সিচুয়েশন এর থেকেও আরও ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের পেশেন্ট ও সুস্থ্য হয়েছে। পুরো শরীর প্যারালাইজড পেশেন্টদের ও আমি সঠিক চিকিৎসায় রেগুলার ফিজিওথেরাপি আর সঠিক যত্নে হাঁটতে দেখেছি। সেখানে তোমার স্বামীর কন্ডিশন এতোটাও খারাপ হয়নি। ডান পাশ একেবারেই অকেজো না। অল্প নড়চড় হয়তো করতে পারবে।তোমার স্বামীও সুস্থ্য হবে ইন শা আল্লাহ। হয়তো একটু সময় লাগবে। কিন্তু আল্লাহ চাইলে অবশ্যই সুস্থ্য হবে।”

মলিন মুখে ডাক্তারের কথা গুলো মন দিয়ে শুনে দৃষ্টি। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। চুপচাপ চেম্বার থেকে বেরিয়ে রক্তিমকে রাখা কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। নিশ্চুপে দরজার নব ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকে একটা টুল টেনে নিরবে বসে পরে রক্তিমের মাথার কাছে। কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেয় রক্তিমের অবশ ডান হাতটা। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকে,

“জেগে আছেন?”

দৃষ্টির ডাকে সময় নিয়ে চোখ খুলে তাকায় রক্তিম। অষ্টাদশীর লাবন্যময় মুখে আজ কোনো লাবন্যতা খোঁজে পায়না রক্তিম। চুপচাপ খুটিয়ে খুটিয়ে অপলক চোখে দেখে যায় দৃষ্টির মলিন মুখটা। বিয়ের এতোদিন পর এই প্রথম রক্তিম হয়তো পূর্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েছে। আজ তো দৃষ্টির চেহারায় এক রাশ মলিনতা ছাড়া কিছুই নেই। তবে এই বিষাদ ঘেরা মুখে অপলকে কি দেখছে রক্তিম? ম্লান হাসে দৃষ্টি। আদুরে পরশে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

“ঘুম পাচ্ছে আরও?”

দৃষ্টির ডাকে হুশ ফিরে রক্তিমের। তড়িৎ মুখ ফিরিয়ে কাত হয়ে শুতে চায়। ঠিক তখনই অনুভব করে ডান পাশটা ঠিকভাবে নাড়াতে পারছেনা। বল প্রয়োগ করতে গেলেই কেমন ঝিমঝিম করছে। অসহনীয় এক পীড়া দিচ্ছে। বারকয়েক চেষ্টার পরও যখন ব্যর্থ রক্তিম, তখনই বিমূঢ় চিত্তে দৃষ্টির দিকে তাকায়। অস্পষ্ট ভাবে বলে,

“আমার হাতে-পায়ে কি হয়েছে?”

মুখ বেকে যাওয়ার ফলে কথা জোরালো শুনালেও বুঝতে পারে দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ চঞ্চলতায় ছেয়ে যায় দৃষ্টির চোখ দুটো। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট দুটো জ্বিভের ডগায় ভিজিয়ে স্মিত হেসে বলে,

“তেমন কিছুনা। তখন না কি কোর্টে মাথা ঘুরিয়ে পরে গেছিলেন! ঐ সময় একটু ব্যথা পেয়েছেন। ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। আপনি এতো অস্থির হবেন না প্লিজ!”

কথাটা বিশ্বাস হয়না রক্তিমের। পরে গিয়ে ব্যথা পেলে এমন অবশ অবশ লাগবে কেন হাত-পা? তাও শুধু এক পাশ। নড়তে না পেরে ছটফট করে রক্তিম। তার এমন ছটফটানি দেখে দৃষ্টি ব্যর্থ হয় চোখের জল আটকে রাখতে। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ওঠে ফুপিয়ে। দিশেহারা হয়ে ছুটে যায় বাইরে। মেহেদীর সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুনয় করে বলে,

“ভাইয়া প্লিজ ওনাকে সামলান। আমি পারছিনা। আমি, আমি কি বলব? কোন মুখে বলব যে আপনি হাঁটা-চলার শক্তি হারিয়েছেন? আমি আর পারছিনা। আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি যান। গিয়ে কিছু একটা বলুন। আপনার কথা ঠিক শুনবে।”

মেহেদীর পিছন পিছন আজীজ শিকদার ছুটে যায়। বাইরে দৃষ্টির কাছে ঝাপসা চোখে দাঁড়িয়ে থাকে জাবির, শান্ত। রাকিব দরজার কাছে আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করে ভিতরের পরিস্থিতি। মেহেদীর সাথে আজীজ শিকদারকে দেখা মাত্রই একদম শান্ত হয়ে যায় রক্তিম। থেমে যায় এতোক্ষনের সকল ছটফটানি। শরীরের ব্যথা ছাপিয়ে অনুভূত হয় বুকের ভিতর জ্বলছে। শারীরিক যন্ত্রণার থেকেও বেশি পীড়া দিতে শুরু করে মনের যন্ত্রণা। চোখের পাতায় একে একে ভেসে ওঠে আদালতের প্রতিটা ঘটনা। অসহনীয় ব্যথার উদ্বেগ হয় মাথায়।ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে সামলানোর চেষ্টা করে নিজেকে। যেই আজীজ শিকদার পা বাড়ায় তার কাছাকাছি আসতে, ওমনি সচল বা-হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় রক্তিম। হাপিয়ে যাওয়া কন্ঠে কাঠিন্যতা মিশিয়ে চোখ খিঁচিয়ে বলে মেহেদীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ওনাকে চলে যেতে বল। সহ্য হচ্ছেনা আমার ঐ চেহারা।”

এমন একটা আচরণেই বোধহয় আশা করেছিল আজীজ শিকদার। এতো বড় একটা ঘটনার পর আর কি ই বা আশা করা যায়। তবুও দমেনা আজীজ শিকদার। ভুল যখন করেছে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে। ফোঁস করে একটা দম ছেড়ে নিষেধ সত্বেও এগিয়ে যায় আজীজ শিকদার। বোঝানোর সুরে বলে,

“বাবা আমার কথাটা শুন। আমাকে একটা সুযোগ দে।”

“সুযোগ! কিসের জন্য? যেটুকু বেঁচে আছি সহ্য হচ্ছেনা? একেবারে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে পুতে রাখতে চাচ্ছেন? কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একটুও মরতে চাইনা। আগে চাইলেও এখন আর চাইনা। বাঁচতে চাই। বেঁচে থেকে নিজ চোখে দেখতে চাই আমার আশেপাশে থাকা মানুষ গুলো আর কতভাবে আমাকে আঘাত করতে পারে। আর আমিও কতটুকু সহ্য করতে পারি। একসময় জীবনের প্রতি অনিহা ছিল। আর এখন জীবনের প্রতি জেদ ছাড়া কোনো অনিহা নেই।”

এটুকু বলেই হাপিয়ে যায় রক্তিম। শরীর ছেড়ে শুয়ে থেকে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে কতক্ষণ। তড়িৎ বেগে মেহেদী এগিয়ে যায় তার দিকে। একটা হাত নিজের দু-হাতে মুঠোয় নিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে,

“ভাই প্লিজ চুপ থাক। তোর শরীর ভালো না। আর কথা বলিস না। যা বলার সুস্থ্য হয়ে বলিস। ওনাকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। চলে যাবে ওনি। তুই একটু শান্ত হো।”

আবারও অশান্ত ভঙ্গিতে মাথা কাত করে বা-হাত ঝাড়ি দিয়ে মেহেদীর থেকে ছাড়িয়ে নেয় রক্তিম। ঠেলে একটু দূরে সড়াতে চায়। মেহেদীও কোনো জোর ছাড়াই ঝটপট সড়ে দাঁড়ায়। এভাবে বল প্রয়োগ করলে যদি আবার কোনো ক্ষতি হয়! অস্পষ্ট স্বরেই রক্তিম চিৎকার করে বলতে থাকে,

“আপনার জন্য। একমাত্র আপনার জন্য আমার তিলে তিলে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার নষ্ট হয়েছে। ছোটবেলা থেকে ডিফেন্সের যে স্বপ্ন দেখে কিশোর বয়স থেকে যুবক হয়েও দিন-রাত এক করে নিজেকে মিলিটারী হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম। সেই স্বপ্ন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন আপনি। খুনি না হয়েও গায়ে খুনের তকমা লাগিয়েছি।যে মুহূর্তে সামরিক বাহিনী আমাকে বহিঃষ্কার করেছিল,ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ভিতরে কি চলছিল আপনি কোনোদিন জানবেন না।আমার শরীর থেকে যখন একে একে কঠোর সাধনার ফল হিসেবে পাওয়া প্রতিটা ব্যাজ খুলে নিয়েছিল সেই মুহূর্তেই আমি রক্তিম বেঈমান স্ত্রী আর ভাইয়ের বিশ্বাস ঘাতকতায় যে আঘাত পেয়েছিলাম তা ভুলে গিয়েছিলাম।নিজের স্বপ্ন গুলোকে দাফন করে প্রাণহীন দেহটা নিয়ে যখন বাড়ি ফেরেছিলাম, চেয়েছিলাম মায়ের কোলে মাথা রেখে মনে জমে থাকা দুঃখ গুলো একটু লাঘব করতে। কিন্তু এতোটাই কপাল পোড়া ছিলাম আমি যে, নিজের মায়েই মৃতপ্রায় হৃদয়টা নতুন করে কথার আঘাতে ক্ষতবীক্ষত করেছিল। জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছিলাম তখন। একজন মিলিটারী মেজর থেকে গুন্ডাতে পরিণত করেছেন আপনি আমাকে। আমার আজকের এই ছন্নছাড়া জীবনের জন্য একমাত্র দায়ী আপনি। বাবা হয়ে পুরো সমাজের কাছে আমাকে খুনি বানিয়েছেন আপনি। শুধু আপনার জন্য যে মা আমাকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করল সেই মা দুটো বছর মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। যে সমাজের মানুষ গুলো একসময় আমাকে দেশ রক্ষক ভেবে সম্মান জানাতো,আজ সেই সমাজের মানুষ গুলোই আমাকে দেশের আবর্জনা ভেবে উপরে ফেলতে চায়। কেন করলেন এমনটা? দিনশেষে সমস্ত ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে দিলেন?আমার জীবনটা নষ্ট করার জন্য এই সব কিছু আপনি আর আপনার ছেলে মিলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছেন তাই না!আপনাদের পরিকল্পনা সফল। এখন আর কিছুই নেই আমার। নিঃস একেবারে। এবার অন্তত রেহাই দিন আমাকে। ভুলেও আর কখনো মুখ দিয়ে আমাকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিবেন না। আপনার মতো মানুষকে বাবা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার থেকে নিজেকে জা র জ হিসেবে পরিচয় দেওয়া আমার জন্য অধিক সহজ।”

সমস্ত কথা ছাপিয়ে শেষের কথাটাই বারবার প্রতিধ্বনিত হয় আজীজ শিকদারের কানে। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু ছেলের ব্যথাতুর মুখের দিকে। সত্যিই কি আজীজ শিকদার এতোটাই দোষী হয়ে গেল! যে দোষের কারণে আজ নিজেকে জা র জ বলতেও রক্তিমের বুক কাঁপলনা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রক্তিমের। মাথার অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ-মুখ বিকৃত করে মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হচ্ছে। দিকবিক না পেয়ে মেহেদী দৌড়ে ডাক্তারকে নিয়ে আসে। কেবিন থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে নিজের মতো করে চিকিৎসা চালিয়ে যায় ডাক্তার।

রক্তিমের চিৎকার শুনে তখনই ছুটে যায় দৃষ্টি। কিন্তু দরজা পেরিয়ে ভিতরে যাবার শক্তি পায়না। রক্তিমের মুখ নিঃসৃত এক একটা কথা অসাঢ় করে দেয় দৃষ্টিকে। স্তব্ধতার রেশ এতোটাই ভারী ছিল যে এখনো বিমূঢ় হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। উত্তেজিত হয়ে রক্তিম আবার অসুস্থ হয়ে পরেছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। কানে এখনো বেজে যাচ্ছে রক্তিমের অস্পষ্ট এক একটা কথা। আজীজ শিকদার বুকে পাহাড়সম দুঃখ চেপে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে। ছেলের সামনে থেকে এভাবে উত্তেজিত করে শারীরিক অবস্থার অবনতি করে আর দোষী হতে চায়না। চোখের আড়াল হলে ছেলে যদি ভালো থাকে তবে তাই হোক। এই পাপি মুখ আর কখনো না দেখুক ছেলে।

ডাক্তারের কথায় স্তব্ধতার রেশ কাটে দৃষ্টির। মস্তিষ্ক সচল হয়। ডাক্তার হাজারী কেবিন থেকে বেরিয়ে রাগত স্বরে বলে ওঠে,

“আগেই বলেছিলাম আপনাদের,পেশেন্ট যাতে কিছুতেই হাইপার না হয়। কি একটা কন্ডিশন হয়েছিল এখন ধারণা আছে আপনাদের? আবারও ঘুমের ইনজেকশন পুস করে শান্ত করতে হয়েছে। আমার অনুমতি ব্যতিত আর কেউ যদি কেবিনে ঢুকেন তবে এই রোগীর দায়িত্ব আমি আর নিবনা। এটা হাসপাতাল। পারিবারিক ঝামেলা মিটানোর জায়গা না। আর পেশেন্ট ও রক্তে, মাংসে গড়া মানুষ।কোনো রোবট না। আশা করি এই দিকটা মাথায় রেখে এখন থেকে যা করার করবেন।”

কথা গুলো বলে ডাক্তার হাজারী দুজন নার্সকে কেবিনের সামনে কড়া নজরদারির দায়িত্ব দিয়ে চলে যায়। সাথে সাথেই দৃষ্টি মেহেদীর দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কি হয়েছিল কোর্টে? ওনি কেন বাবার সাথে এমন আচরণ করছে?”

বুক ফুলিয়ে একটা দম নেয় মেহেদী। প্রস্তুত হয় একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে। সংক্ষেপে পুরো ঘটনা খুলে বলতেই অবাকতার চরম পর্যায় পৌঁছে যায় দৃষ্টি। ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে মেহেদীর মুখের দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আজীজ শিকদারের মতো একজন মানুষ নিজের ছেলের সাথে এতো বড় মিথ্যাচার করতে পারে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে