#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৮
#আদওয়া_ইবশার
পুরো দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিষয়বস্তু একটাই। সাভারের নব নির্বাচিত এমপি আজীজ শিকদারের বড় ছেলে একজন খুনি। নিজের ছোট ভাই এবং সহধর্মিণীকে নিজ হাতে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করেছিল আড়াই বছর আগে। সেই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সয়ং এমপি আজীজ শিকদার। সবটা জানার পরও মেয়র থাকা কালীন সময়েই ক্ষমতা আর টাকার জোড়ে সত্যকে মিথ্যে প্রমাণ করে খুনি ছেলের দোষ ঢেকেছে। একজন খুনিকে ইন্ধন দিয়ে সে নিজেও সমান অপরাধী। এমন একজন মানুষ কিছুতেই এমপি হতে পারেনা। যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় সে কিভাবে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে? ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে নোটিশ চলে এসেছে,ঘটনা যদি সত্য প্রমাণিত হয় এবং ছেলের বিরুদ্ধে যদি আজীজ শিকদার সাক্ষী না দেয়, তবে এমপি পদ থেকে বাতিল করা হবে। চারদিক থেকে সকল চাপ একসাথে আসতে শুরু করেছে। আর প্রেস মিডিয়া তো আছেই। মিডিয়ার লোকজন যেন শিকদার বাড়ির আশেপাশে প্রতি মুহূর্ত উত পেতে থাকে। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে পরে আজীজ শিকদার হতাশায় জর্জরিত। ছেলেকে বাঁচাবে না নিজে বাঁচবে না কি মিডিয়ার সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে জনগণের মুখ বন্ধ করবে? সর্বদা নিরব, শান্ত থেকে নিজের বুদ্ধিমত্বা কাজে লাগিয়ে যেকোনো অনুকূল পরিস্থিতি সামলে নেওয়া আজীজ শিকদার আজ কোনো কূল খোঁজে পাচ্ছেনা। একের পর এক ঘটনায় মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। শুধু আজীজ শিকদার একা না। রক্তিমের সাথে চলা প্রতিটা ছেলে বর্তমান পরিস্থিতির জাতাকলে বুদ্ধিহীন। তবুও কেউ থেমে নেয়। মেহেদী, রাকিব, জাবির, শান্ত প্রত্যেকে নিজেদের মতো সমাধান খোজার চেষ্টায় মত্ত।ভাইয়ের খবর শোনার সাথে সাথেই ইতি নিজের নতুন সংসার ছেড়ে ছুটে আসে শিকদার বাড়ি। এখন পযর্ন্ত মেহেদী নিজেও শিকদার বাড়িতে পরে আছে। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর এমন একটা অবস্থায় কিছুতেই স্থির থাকতে পারেনি।
নিস্তেজ হয়ে স্টাডি রুমে বসে আছে আজীজ শিকদার। উত্তরে জানালার থাই গ্লাস সড়ানো। পৌষের সকালের হীম হাওয়া এসে শরীর কাঁপিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কোনো হুঁশ নেই আজীজ শিকদারের। এক ধ্যানে জানালা গলিয়ে দৃষ্টি যতদূর যাচ্ছে স্থির তাকিয়ে নিজ ভাবনায় মত্ত।শান্ত রুমটাতে অশান্ত হাওয়া নিয়ে একসময় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরে মেহেদী। সাথে জাবির। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে আজীজ শিকদারকে,
“বাবা!” ভাবনাচ্যুৎ হয় আজীজ শিকদার। নির্বাক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেহেদীর দিকে। শীতল স্বরে জানতে চায়,
“কিছু জানতে পেরেছো?”
মেহেদীর চোখের দৃষ্টি চঞ্চল। অত্যধিক উত্তেজনায় বুকের ভিতরটাও ধরফর করছে। বার কয়েক ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজানোর প্রয়াস চালিয়ে বলে,
“যা ভেবেছিলাম তাই।”
কথাটা শুনে কিছুটা ধাতস্থ হয় আজীজ শিকদার। বসা থেকে ওঠে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,
“কিভাবে বুঝলে? সন্দেহজনক কিছু পেয়েছো?”
“থানায় যে কনস্টেবলটাকে টাকা খাইয়ে হাত করেছিলাম! খবরটা ওনিই জানিয়েছে। কাল রাতে লিয়াকত বিল্লা থানায় গিয়েছিল। তাছাড়া রাকিবকে যে পাঠিয়েছিলাম জেরিনের মামার বাড়ির দিকে লক্ষ রাখতে। রাকিব নিজেও আজ সকালে লিয়াকত বিল্লাকে জেরিনের মামার সাথে দেখেছে।”
চিন্তায় ভাজ হয়ে থাকা কপালদ্বয় মসৃণ হয় আজীজ শিকদারের। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে বক্র হাসির রেখা। মাথা ঝাকিয়ে বললেন,
“জানতাম। সাবেক এমপি সাহেব ছাড়া এতো ধূর্ত বুদ্ধি আর কার হবে!”
“আজকে রক্তিমের সাথে একবার দেখা করতে চাচ্ছিলাম বাবা। এখন মনে হচ্ছে থানায় যাওয়াটা অতি আবশ্যক। শু য়ো র টা না জানি কাল রাতে কোন কু-মতলবে থানায় গিয়েছিল।”
মেহেদীর মুখে গালি শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হয় আজীজ শিকদার। মুখে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বলে,
“আহ্! যাবে ভালো কথা। কিন্তু মুখ খারাপ করো কেন? আর কার সামনে কি বলতে হয় সব খেয়ে বসে আছো না কি? আমি তোমার শশুর কথাটা মনে হয় ভুলে গেছো!”
অত্যাধিক উত্তেজনায় মেহেদী সত্যিই ভুলে গিয়েছিল তার সামনে অন্য কেউ না,সয়ং নিজের শশুর দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ একটা গালির বিপরীতে এমন মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার মতো অপমানে কাঁচুমাচু মুখ লজ্জায় মাথা নত করে রাখে মেহেদী। তখনই শুনতে পায় আজীজ শিকদারের আদেশ,
“বউমাকে সাথে নিয়ে যেয়ো। দুদিন থেকে মেয়েটা বারবার অনুরোধ করছে একবার তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। একবার দেখা করতে পারলে হয়তো একটু সামলাতে পারবে নিজেকে।”
তৎক্ষণাৎ মুখ উঁচিয়ে বিরোধীতা করে ওঠে মেহেদী,
“অসম্ভব বাবা। ভাবিকে সাথে নিয়ে গেলে আপনার খ্যাঁপা ছেলে লকআপের ভিতর থেকেই আমার গলা টিপে ধরবে।”
“কিছুই করবেনা। সবসময় সবার মন-মানসিকতা এক রকম থাকেনা। তাছাড়া মেয়েটার কথাও একবার আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ।খাওয়া,ঘুম সব ভুলে ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে। এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবে।”
শশুরের সাথে কথায় না পেরে হার মেনে নেয় মেহেদী। রাজি হয় দৃষ্টিকে সাথে নিতে। নিয়ে তো যাবে। তবে আদও রক্তিমের সাথে দেখা করাতে পারবে কি না কে জানে!
****
আধ ঘন্টার মাঝেই মেহেদীর সাথে থানায় উপস্থিত হয় দৃষ্টি। চোখ দুটো তার তৃষ্ণার্ত। বুকের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরপুর। যখন থেকে শুনেছে রক্তিমের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবে তখন থেকেই প্রচণ্ড অস্থিরতা, ছটফটানিতে মনের অবস্থা বেগতিক।সাভার মডেল থানার সামনে গাড়ি থামতেই দৃষ্টি মেহেদীকে রেখেই এক প্রকার দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পরে। পিছন পিছন ছুটে যায় মেহেদী।কয়েক জায়গায় ঘুষ আবার কয়েক জায়গায় বিভিন্ন ফরমালিটিস পূরণ করতে করতে আরও আধ ঘন্টা সময় চলে যায়। দৃষ্টির যেন এবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতোটুকু দেরীও তার সহ্য হচ্ছেনা। অত্যধিক উত্তেজনায় শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো। অনুমতি পেতেই মেহেদীকে পিছনে ফেলে দৌড় লাগায় দৃষ্টি। দৃষ্টির এমন পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় মেহেদী। কোনোমতে বুঝিয়ে কিছুটা শান্ত করে ধীরস্থির ভাবে এগিয়ে যায় রক্তিমকে রাখা সেলের দিকে। নির্দিষ্ট সেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরের চিত্র দেখে থমকে যায় দুজনেই। দৃষ্টির এতোক্ষনের এলোমেলো শ্বাস-প্রশ্বাস টুকু এবার বন্ধ হবার জোগাড়। অস্থিরতা কাটিয়ে বুকের ভিতর শুরু হয় ঝড়ের তান্ডব। নির্বাক মেহেদীও একই ভাবে অত্যধিক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেলের ভিতর এক হাঁটু ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। মাত্র ছয়দিন হয়েছে রক্তিম জেলে। এই ছয় দিনেই নিষ্ঠুর গুলো কিভাবে অত্যাচার চালিয়েছে তার উপর! ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তের দাগটা দূর থেকে দেখেও মনে হচ্ছে এখনো তাজা হয়ে আছে। কেমন নিস্তেজ শক্তিহীনের মতো চোখ দুটো বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রাণহীন এক শরীর। মেহেদীর নির্বাক দৃষ্টি ওক সময় ঝাপসা হয়। মানতে কষ্ট হয় বন্ধুর এমন পরিণতি। কতটা নির্দয়ের মতো অত্যাচার চালিয়েছে অমানুষ গুলো! ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে ওঠে। দৃষ্টির ফোঁপানোর শব্দে মেহেদীর ঘোর কাটে। তটস্থ ভঙ্গিতে একবার আশেপাশে তাকিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে রক্তিমকে। কে ডাকছে কন্ঠটা ধরতে পারেনা রক্তিমের বেদনায় পৃষ্ঠ মস্তিষ্ক। শরীরের পীড়ার কাছে সব কিছুই ঝাপসা আজ। বহু কষ্টে বন্ধ চোখের পাপড়ি দ্বয় আলগা করে মাথা অল্প সোজা করে রক্তিম।নিভু নিভু দৃষ্টিতে ভাসে দুজন মানুষের প্রতিবিম্ব। কিন্তু মানুষ দুজন কে, তা ঝাপসা দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়না। রক্তিমের এমন বেহাল দশায় মেহেদীর চোখে অশ্রু বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পরে। সাথে সাথেই আবার শার্টের হাতায় চোখ দুটো মুছে নেয়। একবার কান্নারত দৃষ্টিকে দেখে নিয়ে আবারও ডাকে রক্তিমকে। এতোক্ষন পর এবার রক্তিমের অসাঢ় মস্তিষ্ক মেহেদীর কন্ঠ চিনতে পারে। চোখের দৃষ্টিও অল্প পরিষ্কার হয়। ভেসে ওঠে পরিচিত দুটো মুখ। দৃষ্টিকে এখানে দেখে খানিক উত্তেজিত হয় রক্তিম। বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে কোনোমতে টলতে টলতে এগিয়ে আসে লোহার শিকল দিয়ে তৈরি দেয়ালের নিকট। ডান হাতে একটা শিক ধরে নিজের ব্যালেন্স টুকু বজায় রাখার চেষ্টা করে ব্যথাতুর কন্ঠে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
“ওকে কেন নিয়ে এনেছিস?”
রক্তিমের এমন ব্যথাতুর নিস্তেজ কন্ঠ এবার যেন দৃষ্টিকে একেবারে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। নিঃশব্দের কান্নাটা রূপ নেয় উচ্চ রুলে। তৎক্ষণাৎ পাশে থাকা কনস্টেবল হালকা ধমকের সাথে বলে ওঠে,
“এটা জেলখানা। আপনাদের রঙ্গতামাশা করার জায়গা না। আলগা পিরিতি দেখাইতে আসলে ঐটার সাথে সব কয়টারে ভরে রাখব।”
কনস্টেবলের কথা সবার কানে গেলেও কোনো প্রত্যুত্তর করেনি কেউ। কারণ পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে। এমন শত অপমান মুখ বুজেই সহ্য করতে হবে। দৃষ্টি ঠোঁট কামড়ে কান্নার শব্দ আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সেলের ফাঁক গলিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রক্তিমের ঠোঁটের কোণের রক্ত টুকু ছুঁয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ হালকা ব্যথা সেই সাথে দৃষ্টির হঠাৎ এমন একটা কাজে বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে রক্তিম। চোখ তুলে কান্নারত দৃষ্টির মুখের দিকে তাকায়। রক্তিমের ঠোঁটের কোণের রক্ত টুকু হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে লাগিয়ে আবারও হাতটা বাইরে নিয়ে আসে দৃষ্টি। টকটকে লাল রক্ত কতক্ষণ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে দেখে জানতে চায়,
“এতোটা নির্দয়ের মতো কিভাবে মেরেছে ওরা আপনাকে? খুব কষ্ট হয়েছে আপনার, তাইনা!”
শরীরের যন্ত্রণা থেকেও মনের যন্ত্রণা তীব্র রক্তিমের। দৃষ্টির এমন প্রশ্নে নির্বাক তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। রক্তাক্ত ঠোঁটের কোণে যন্ত্রণামিশ্রীত হাসি ফুটিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,
“এক নারী জাতি আর কত রূপ দেখাবে? একজন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে আনন্দ পায়। আরেকজন শরীরে অল্প আঘাতের সন্ধান পেয়ে তীব্র বেদনায় ছটফটানি প্রকাশ করে।”
বুকের ভিতরে থাকা যন্ত্রণাটা যেন এবার শরীরের যন্ত্রণা ম্লান করে দিয়েছে। তীব্র এক দহনে বুকের ভিতরটা চৌচির। জ্বিভের ডগায় রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বেদনার ঢোক গিলে রক্তিম। কন্ঠে দৃঢ়তা আনার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে বলে,
“আর কখনো এখানে আসবেনা। আমার চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা। আমি ভালো আছি। বাড়ি যাও। পড়াই মন দাও। মাত্র দুদিন পর এডমিশন টেস্ট। এবার যদি চান্স হারিয়ে নিজের মা-বাবার কাছে আমাকে দোষী করেছো তবে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। আমি যেন জেলের ভিতর থেকেও শুনতে পায় চান্স হয়ে গেছে।”
এই প্রথম! বিয়ের এতোদিনে এই প্রথম রক্তিম কন্ঠে অধিকার খাটিয়ে দৃষ্টিকে শাসনের সুরে কিছু বলেছে। তাও এমন একটা মুহূর্তে এসে, যে মুহূর্তে দৃষ্টি পারছেনা রক্তিমের এমন আচরণে খুশী হতে, পারছেনা চোখের সামনে দেখা রক্তিমের করুণ পরিণতি ঘুচিয়ে দিতে। বুকের ভিতরটা যে কি অসহ্য যন্ত্রণায় নিঃশেষ হচ্ছে!মনে হচ্ছে বিষাক্ত কোনো এক পোকার বাস এই বুকে। যে পোকা কামড়ে ধরে বুকের মাঝে নিজের সমস্ত বিষ উগলে দিচ্ছে। সেই বিষে নীল হচ্ছে হৃৎপিন্ড। চোখের সামনে শখের পুরুষের এমন নির্মম পরিণতি সহ্য হচ্ছেনা কিছুতেই। ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পুরো বিশ্বকে জানান দিতে, তার ভালোবাসার মানুষের শরীরের প্রতিটা আঘাত তার হৃদয়ে এক একটা অগ্নিপাতের সৃষ্টি করছে। যে অগ্নিপাতে দগ্ধ হচ্ছে মন জমিন। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এ মন জমিনে কি আর কখনো বসন্তের কোকিল উড়বে? ভালোবাসার গান গাইবে? না কি সারাজীবন ডাহুকের আর্তনাদ ভেসে আসবে!
জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে বহু কষ্টে সামলায় দৃষ্টি। তবে কান্নারা কি আর এতো সহজে বিদায় নিতে চায়! দৃষ্টি পারেনা কান্না আটকাতে। সেভাবেই কান্নায় রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলে,
“এবার আমি ঠিক চান্স পেয়ে যাব। আমার স্বামী এই প্রথম আমার থেকে কিছু একটা আশা করছে। আমি কিভাবে সেটা অপূর্ণ রাখি! বাড়ি গিয়ে সব ভুলে মন দিয়ে পড়ব। তবে আমি চাই আমার এই খুশির সংবাদটা আপনি জেলের ভিতরে থেকে না, মুক্ত আকাশের নিচে থেকে শুনবেন। রেজাল্ট পাবলিশড হবার আগে আপনার জামিন না হলে লাগবেনা আমার চান্স। কিসের পড়ালেখা কিসের কি? যে জীবনে আপনি নেই সেই জীবনের থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়। আচ্ছা! একটা কথা বলুন তো। মানুষ বলে মন থেকে কাওকে ভালোবাসলে না কি তাকে পাওয়া যায়। আমিও পেয়েছি আপনাকে। মন থেকে ভালোবেসেছি দেখেই পেয়েছি। কিন্তু যে পাওয়ায় বারবার হারানোর ভয় তাড়া করে বেড়ায়, সেই পাওয়ার কি কোনো মূল্য আছে! আমি কেন আপনাকে পেয়েও পেলাম না এখনো? আল্লাহ কিসের শাস্তি দিচ্ছে আমাকে? আমার যে আর সহ্য হচ্ছেনা এই যন্ত্রণা। যখনই মনে হয় আপনাকে আমি পেয়েও হারিয়ে ফেলছি তখনই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার। মনে হয় পুরো পৃথিবীটা থমকে গেছে। ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন?”
কথা গুলো বলতে বলতেই মুখ ঢেকে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরে দৃষ্টি। রক্তিম নির্বিকার। শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন নিয়েও নির্বাক তাকিয়ে সামনের দিকে। একদিকে বন্ধুর নির্মম পরিণতি অপরদিকে দৃষ্টির পাগলপ্রায় দশা। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর। এই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া বর্তমানে হয়তো তাদের আর কিচ্ছু নেই। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে দৃষ্টিকে বুঝিয়ে থানার বাইরে গাড়িতে রেখে মেহেদী আবারও রক্তিমের কাছে আসে। দেখা করার জন্য যি সময় টুকু পেয়েছিল তার মধ্যে হাতে আরও পাঁচ মিনিন অবশিষ্ট আছে। এর মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা সেড়ে ফেলতে হবে। দ্রুত কদমে আবারও রক্তিমকে রাখা সেলের কাছে এসে নিচু স্বরে রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়,
“ঐ স্কাউন্ড্রেলটা কাল রাতে না কি থানায় এসেছিল!”
“হু” ছোট্ট করে জবাব দেয় রক্তিম। রাগে চিড়বিড়িয়ে ওঠে মেহেদী। চোয়াল শক্ত করে জানতে চায়,
“শু য়ো র টা আসার পরই কি তোর উপর এভাবে অত্যাচার চালিয়েছে? কোনো রিমান্ড ছাড়া কিভাবে এমন টর্চার করে তারা? সালার সব কয়টা বা*** দালাল। একবার শুধু তোকে বের করে নেই। প্রত্যেককে দেখে নিব। একটাকেও ছাড়বনা।”
শ্লেষাত্মক হাসে রক্তিম। নিজের প্রতি নিজেই বিদ্রোপ করে বলে,
“দুটো খুনের আসামি হয়েও দীর্ঘ আড়াই বছর আরামছে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছি। তোর কি মনে হয় ওরা উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কেস রি-ওপেন করেছে? আলরেডি এমপি সাহেবের উপর চাপ আসতে শুরু করে দিয়েছে। এই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সয়ং এমপি সাহেব। বাতাসের গতিতে এটা সবার কাছেই পৌঁছে গেছে। তাছাড়া লিয়াকত বিল্লার মতো ক্রিমিনাল যেখানে হাত লাগিয়েছে সেখানে আমার মুক্তির আশা কিভাবে করিস? ছেড়ে দে আমার আশা। শুধু শুধু মরিচিকার পিছনে ঘুরে নিজেদের জীবনটা নষ্ট করিস না। মৃত্যুর ভয় আমার নেই। যদি থাকতোই তবে হয়তো এতো সহজে এই হাতে দুটো শরীর থেকে প্রাণ আলাদা করতে পারতাম না। আমার মৃত্যুতেই আমার মুক্তি। আমিও এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি চাই। শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই।”
রক্তিমের নির্লিপ্ত কন্ঠের এমন ভয়াবহ কথায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে মেহেদীর। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনের মতোই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। বুকের ভিতর সৃষ্টি হয় নাম না জানা এক তোলপাড়। শিক ধরে রাখা রক্তিমের হাতটা এক হাতে শক্ত করে ধরে মেহেদী। শক্ত মনোবলে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“একদম ঘাবড়াবিনা। ভুলে যাবিনা তুই আজীজ শিকদারের ছেলে রক্তিম শিকদার। এতো সহজে তোর পতন হতে পারেনা। আরও অনেক বছর বাঁচতে হবে তোকে। তোর মনে নেই, আমরা দুজন যে প্ল্যান করেছি ব্যবসা শুরু করব! ছন্নছাড়া জীবনটাকে বিদায় দিয়ে আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচব আমরা। নিজেদের পাশাপাশি এলাকার প্রতিটা বেকার ছেলের কর্মসংস্থান গড়ব। তুই ছাড়া এগুলো কিভাবে হবে? আমাকে প্লিজ মাঝ পথে ফেলে চলে যাস না। তোকে বাঁচতে হবে। আমাদের দুজনের একসাথে দেখা এখনো কত কত স্বপ্ন অপূর্ণ! সেগুলোর পূর্ণতা দিতে হবে। দৃষ্টি মেয়েটা শুধু তোকে ভালোবেসে নিজের পরিবার ছেড়েছে। তোকে যেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে আসে, ঐদিনই দৃষ্টির মা-বাবা এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে। মেয়েটা যায়নি। কি বলেছিল জানিস! তুই নাকি ওর মানসিক শান্তি। ছন্নছাড়া,গুন্ডা রক্তিম শিকদারকে ভালোবেসে সে নিজের পরিবার ছাড়তে পেরেছে যেহেতু।এখন খুনি রক্তিম শিকদারকেও ভালোবেসে দুঃখ গুলোকেই সুখ ভেবে একটা জীবন পাড় করে দিতে পারবে। একবার ঐ মেয়েটার কথা ভাব। পৃথিবীতে সব মেয়ে খারাপ হয় না। সবাই ছলনা করেনা। যদি কতরোই, তবে তোর আমার মা-বাবা এখনো একসাথে এক ছাঁদের নিচে থাকতনা। তাদের সংসারটা এমন সুন্দর পরিপূর্ণ হতনা। পৃথিবীতে দৃষ্টির মতো মেয়েরা আছে বলেই ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।ঐ খাঁটি হিরেকে আর কাঁচ ভেবে পায়ে ঠেলে দিস না। ঐ মেয়েটার ভালোবাসার মূল্য চুকানোর জন্য হলেও তোকে এই চৌদ্দশিকের ভিতর থেকে বের হতে হবে। আর তোর বাবা-মা! তাদের একমাত্র ছেলে এখন তুই। তুই ছাড়া ওদের আর কেউ নেই। ঐ দুটো মানুষের বুড়ো বয়সের হাতের লাঠি তুই। নিজের পরিবারের কথা ভেবে হলেও হার মেনে নিস না। মনে বিশ্বাস রাখ। ইন শা আল্লাহ তোর মুক্তি হবেই।”
চলবে…….
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৯
#আদওয়া_ইবশার
জেলা জজ আদালতে আজ দশটায় রক্তিমের
কেস উঠবে। কাকতলীয় ভাবে আজকেই দৃষ্টির এডমিশন এক্সাম। কি করবে দৃষ্টি? পরীক্ষা দিতে যাবে! না কি আদালতে কি রাই ঘোষণা হয় তা শুনতে যাবে? স্রোতের টানে দৃষ্টি যেন খেয় হারিয়ে মাঝ সাগরে ডুবতে যাচ্ছে। সারাটা রাত ছটফট করেছে একই ভাবনায়। আদালতে কি হচ্ছে না হচ্ছে এসব চিন্তায় না পারবে ভালো করে পরীক্ষা দিতে আর না পারবে পরীক্ষা না দিয়ে স্ব-শরীরে আদালতে উপস্থিত থাকতে। এই এক এডমিশন এক্সামকে কেন্দ্র করে এখন শুধু মা-বাবার স্বপ্ন পুরণ না। সাথে যুক্ত স্বামীর প্রথম চাওয়া। দৃষ্টি কিভাবে পারবে তার প্রিয় মানুষের প্রথম চাওয়া টুকু অপূর্ণ রাখতে! হাজার দ্বিধা-দন্দ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত স্থির করে পরীক্ষা সে দিবে। আজীজ শিকদার তাকে আশ্বস্ত করেছে রক্তিম মুক্তি পাবেই। দেশে এমন কোনো আদালত এখনো তৈরি হয়নি যে রক্তিম শিকদারকে সাজা দিবে। দৃষ্টি জানে আজীজ শিকদার শুধুমাত্র তাকে আশ্বস্ত করার জন্যই মনগড়া কথা গুলো বলেছে। যেখানে বিপক্ষ দল রক্তিমের বিরুদ্ধে খুনের সমস্ত প্রমাণ ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে সেখানে কিভাবে রক্তিম নির্দোষ প্রমাণিত হবে? তাছাড়া রক্তিম নিজেও না কি কোনো ভনিতা ছাড়াই স্বীকারোক্তি দিয়েছে খুন দুটো সে করেছে। এর পরও কি আর কোনো আশা থাকে রক্তিম নির্দোষ প্রমাণ হবার?
বেদনায় পৃষ্ঠ মন, মস্তিষ্ক নিয়েই যথাসময়ে মেহেদীর সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। মানসিক অশান্তিকে সঙ্গী করেই পা বাড়াই একটু ভালো কিছুর আশায়। এতো এতো অনিশ্চয়তার মাঝেও মন বলে কিছু একটা মিরাক্যাল হবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের পর নতুন সূর্য কিরণ ছড়াবে। একটা খারাপ দিনের পরই একটা ভালো দিনের সূচনা হয়। সেই ভালো দিনটা দৃষ্টির জীবনে খুব শিগ্রই আসবে। সৃষ্টিকর্তা একজন মানুষের ভাগ্যে সবসময় দুঃখ রাখেনা। বিভিন্ন অনুকূল পরিস্থিতির মাধ্যমে বান্দার ধৈর্যের পরীক্ষা নেই। সেই ধৈর্যের পরীক্ষায় দাঁত খিঁচিয়ে সফল হতে পারলেই সুখের দিনের সন্ধান পায় মানব জাতি। পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই দৃষ্টি মেহেদীকে তাড়া দেয়,
“ভাইয়া! আপনি এবার কোর্টে চলে যান। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারব।”
দৃষ্টিকে বোঝানোর সুরে মেহেদী বলে,
“তুমি এতো হাইপার হয়ে যেওনা। ওখানে বাবার সাথে রাকিব, জাবির, শান্ত সবাই আছে। বাবা যখন একবার বলেছে রাই আমাদের পক্ষেই আসবে তখন একদম নিশ্চিত থাকো তুমি। ভালো করে মন দিয়ে পরীক্ষাটা দাও বোন প্লিজ। মনে করো এটাই রক্তিমের মন জয় করার তোমার শেষ চান্স। ধরে নাও কেন্দ্র থেকে বের হয়েই শুনতে পারবে রক্তিম মুক্তি পেয়ে গেছে। মাথা থেকে সমস্ত বাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলো।”
ম্লান হাসে দৃষ্টি। তাকে সবাই কেমন বাচ্চাদের মতো ট্রিট করছে! ছোট বাচ্চাদের যেমন খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখে, তেমন করেই প্রতিটা মানুষ তাকে শান্তনার বাণী শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখছে। পরিস্থিতি যে এতোটাও ভালো না সেটা বোঝার মতো বয়স দৃষ্টির হয়েছে। এটা হয়তো সবাই ভুলে গেছে। তবুও দৃষ্টি মনের ছটফটানি মুখে প্রকাশ করে মানুষ গুলোকে হতাশ করেনা। চুপচাপ শুধু শুনে যায় এক একটা শান্তনার বাণী। পা বাড়াই হলের ভিতর। অস্থির মনে বাইরে অপেক্ষমাণ মেহেদী। আদালতে কি হচ্ছে সেই চিন্তায় স্থির থাকতে পারেনা। দৃষ্টিকে বুঝিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে চলে যায় জেলা আদালতের দিকে। ভাবে দৃষ্টির পরীক্ষা শেষ হবার আগে পরিস্থিতি বিবেচনা করে আবারও চলে আসবে। মেয়েটা এই মিথ্যেটুকুই জানোক, মেহেদী তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
*****
দুই পক্ষের উকিলের একের পর এক যুক্তিপূর্ণ বয়ান, সাক্ষীদের সত্য-মিথ্যা সাক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে তর্ক-বিতর্কে আদালত ভবনে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিরোধী দলের উকিল সবশেষে প্রধান সাক্ষী হিসেবে খুনের প্রত্যক্ষদর্শী আজীজ শিকদারকে জেরা করার অনুমতি চায় বিচারকের কাছে। অনুমতি প্রধান করা হলে আজীজ শিকদারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। বিপরীত পাশের কাঠগড়ায় রক্তিম নির্বাক মাথা তুলে এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলের দিকে এক নজর তাকিয়ে আজীজ শিকার ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে সত্য শপথ করেন। সাথে সাথে বিপক্ষ দলের উকিল একের পর এক যুক্তি দেখিয়ে আজীজ শিকদারের মুখ থেকে, খুন দুটো রক্তিম করেছে কথাটা বের করার প্রয়াস চালাই। মাথা উঁচিয়ে আজীজ শিকদার বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলে ওঠে,
“রক্তিম শিকদার খুন করেনি।”
“তবে খুন গুলো কে করেছে? একজন এমপি হয়ে নিজের ছেলের দোষ ঢাকার জন্য এভাবে জনসম্মুখে মিথ্যে বলতে একবারও আপনার ভয়ে বুক কাঁপছেনা? তাছাড়া খুনি রক্তিম শিকদার যেমন আপনার ছেলে, তেমনই তো সে যাদের খুন করেছে তাদের মধ্যে একজন সংগ্রাম শিকদার সেও আপনার ছেলে। এক ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক ছেলের হত্যাকারীকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছেন না! বাবা হয়ে কিভাবে পারছেন নিজের ছেলের খুনিকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা বয়ান পেশ করতে? আজ না হয় ভরা আদালতে মিথ্যা বলে ছেলেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এরপর!বিবেকের ধ্বংসনে বাঁচতে পারবেন তো?”
বিরোধী দলের উকিলের যুক্তিপূর্ণ কথায় একটুও টলেনি আজীজ শিকদার। বরং আগের চেয়েও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ স্বরে বলে,
“যদি মিথ্যে বলতাম তবে অবশ্যই বুক কাঁপতো। মিথ্যে বলিনি দেখেই বুক কাঁপেনি। আর না কখনো বিবেকের ধ্বংসনের স্বীকার হব।”
“আপনি যে মিথ্যে বলছেন না তার কি প্রমাণ? আসামি নিজেও তো স্বীকার করছে সে খুন করেছে। তবে!”
“সবসময় আমাদের জানা আর দেখা সঠিক হয়না। চোখের দেখাও অনেক সময় মিথ্যে হয়। আর মনের বিশ্বাস ও।”
“এতোক্ষনে একটা সত্য কথা বলেছেন। আসলেই অনেক সময় চোখের, দেখা-মনের দৃঢ় বিশ্বাসও মিথ্যে হয়। যেমন আপনি এই মুহুর্তে নিজের চোখে দেখেছেন আপনার ছেলে খুন করেছে তবুও বলছেন সে খুন করেনি। সেটাও আবার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে জোর গলায় বলছেন। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত কি হবে? সেই আপনার প্রখর আত্মবিশ্বাস মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে রক্তিম শিকদারের ফাঁসি না হয় যাবৎজীবন কারাদণ্ড হবে।”
“আর যদি উল্টো রক্তিম শিকদার নির্দোষ প্রমাণিত হয়?”
ঠাট্টার ছলে হাসে বিরোধী দলের উকিল। রগড় করে বলে,
“চোরের মায়ের বড় গলা, কথাটা আবারও সত্য প্রমাণিত করতে চাইছেন এমপি সাহেব। কি লাভ শুধু শুধু কোর্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করে? সত্যিটা বলে দিন। অযথা আর সময় নষ্ট করবেন না।”
উকিলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারও এক নজর নির্বাক রক্তিমের দিকে তাকায় আজীজ শিকদার। পরমুহূর্তে বিচারকের দিচ্ছে তাকিয়ে জোর গলায় বলে ওঠে,
“মহামান্য আদালত! আমার ছেলে রক্তিম শিকদারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। আমার ছেলে কাওকে খুন করেনি। আমার ছোট ছেলে সংগ্রাম শিকদার এবং বড় ছেলের স্ত্রী জেরিন দুজনের কেউ খুন হয়নি। ওরা দুজনেই বেঁচে আছে।”
ভরা আদালতে হুট করেই যেন বড়সড় এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে আজীজ শিকদার। কথাটা শোনা মাত্রই রক্তিম চমকে বাবার মুখের দিকে তাকায়। উপস্থিত প্রতিটা মানুষের দৃষ্টি অবিশ্বাস্য। এমন একটা মনগড়া কথার কি আদও কোনো ভিত্তি আছে? কিসব পাগলের প্রলাপ বকছে আজীজ শিকদার! উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে আশ্চর্যের চরম শিকড়ে পৌঁছে দিয়ে আজীজ শিকদার আবারও বলে ওঠে,
“মানুষের কাজেই হলো তিলকে তাল বানিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। যেমনটা ঘটেছে আমার পরিবারের সাথে। আমার বড় ছেলের স্ত্রী জেরিন আর আমার ছোট ছেলে সংগ্রাম শিকদারের মাঝে দেবর-ভাবির সম্পর্ক ছাপিয়ে এক সময় অবৈধ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। রক্তিম তখন সামরিক বাহিনীতে যুক্ত ছিল। তার বছরে হাতে গুণা কয়েকটা দিন সুযোগ হতো নিজের পরিবারের সাথে কাটানোর। বাকী পুরোটা বছর কাটাতে হতো সামরিক বাহিনীর ঘাটিতে। এমন অবস্থায় রক্তিমের স্ত্রী জেরিন রক্তিমের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে সংগ্রামের দিকে ঝুকে যায়। দুজনেই দুজনের সম্মতিতে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে। নিজের আপন ভাইয়ের সাথে স্ত্রী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। কথাটা জেনেও হয়তো কোনো পুরুষ পারবেনা সহজে মেনে নিতে। যেমনটা পারেনি রক্তিম শিকদার। রাগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আক্রমণাত্মক হয়ে আঘাত করেছিল স্ত্রী এবং ভাইয়ের উপর। তবে সেই আঘাতে দুই-একদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা ছাড়া তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। রক্তিম হয়তো দ্বিতীয়বার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওদের উপর আক্রমণ করতে পারে। এটা ভেবেই আমি পরবর্তীতে তাদের দুজনকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেই। এদিকে সবাই জানে সংগ্রাম শিকদার এবং জেরিন দুজনেই মৃত। এটা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিলনা মহামান্য আদালত। নিজের ছেলেদের বাচানোর জন্য আর পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য আমি নিরুপায় হয়ে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম। তবে মিথ্যে যে খুব বেশিদিন গোপন থাকেনা তা আজ আবারও প্রমাণ পেলাম। যে ছেলেদের বিপদের ভয়ে এতো বড় একটা সত্যকে মিথ্যে দিয়ে ঢেকেছিলাম। আজ সেই ছেলের বিপদের জন্যই সত্যটাকে সকলের সামনে তুলে ধরতে হয়েছে। আমার এই মিথ্যের জন্য আজ যদি আমার কোনো শাস্তি হয় সেটাও আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। নির্দ্বিধায় আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। সাথে এও জানাচ্ছি পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে বিপদ মুক্ত রাখার জন্যই আমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। আমার ছেলে রক্তিম শিকদার নির্দোষ। দোষী যদি কেউ হয়ে থাকে তবে সেটা আমি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমি দোষী। আমার দোষ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।”
কথা গুলো শেষ করেই দলের একজন ছেলেকে ইশারায় কিছু একটা বলেন আজীজ শিকার। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে আদালতে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয় সংগ্রাম শিকদার এবং রক্তিমের প্রথম স্ত্রী জেরিন। উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বাকহারা। এতোদিনের ভুল ধারণাটা হঠাৎ সবার সামনে মিথ্যে বলে প্রমাণ হওয়াই স্তব্ধ প্রত্যেকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এতোক্ষনের কোলাহলপূর্ণ ভবন এক লহমায় নিস্তব্ধ। রক্তিম পলকহীন তাকিয়ে আছে আজীজ শিকদারের দিকে। মস্তিষ্ক অসাঢ় হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আদালতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ সংগ্রাম, জেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে তাকায়নি একবারের জন্যও। ছেলের এমন শীতল দৃষ্টির কাছে আজীজ শিকদার নতজানু। কিছুতেই পারছেনা আজ ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। না পারছে মাথা তুলতে।
এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মিনিট পাঁচেক পার হবার পর আবারও আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। যাদের খুনের দায়ে আসামিকে দোষী সাভ্যস্ত করা হচ্ছিলো সেই তাদের স্বীকারোক্তিতেই রক্তিম নির্দোষ প্রমাণিত হয়। সংগ্রাম, জেরিন দুজনেই নত মস্তকে স্বীকার করে নেয় তাদের ভুল। জানিয়ে দেয় রক্তিম নির্দোষ। জেরিন অকপটে স্বীকার করে, রক্তিমের সাথে তার ভালোবেসে বিয়ে হলেও বিয়ের পর এক সময় উপলব্ধি করে রক্তিম আসলে তার ভালোবাসা ছিলনা। স্রেফ মোহ ছিল। মামার সংসারে বোঝা হয়ে থাকাই শেষ পযর্ন্ত কোনো কূল না পেয়ে রক্তিমকেই ভালোবাসা ভেবে বিয়ে করে নেয়। কিন্তু বিয়ের পর ধীরে ধীরে বুঝতে পারে রক্তিম আসলে তার ভালোবাসা না। তার মোহ। আর সংগ্রাম হলো তার সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার জেড় ধরেই সমাজের প্রতিটা মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে আজও তারা একসাথে ভিনদেশে সংসার পেতে ভালো আছে।
আদালতে পুরোটা সময় রক্তিম একমাত্র আজীজ শিকদারের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কান দুটো তার খোলা থাকলেও আকস্মিক এমন একটা ধাক্কায় অসাঢ় মস্তিষ্ক হয়তো জেরিন বা সংগ্রাম কারো কথায় ধরতে পারেনি। আর না পেরেছে নিশ্চল মস্তিষ্ক শরীরে কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি করতে। বিচারকের মুখে রক্তিম নির্দোষ কথাটা শোনার পরও কারো মুখে এক বিন্দু হাসি ফুটেনি। সকলের মস্তিষ্কে একটাই ভাবনা, এরপর কি হবে? রক্তিম আর কতক্ষণ এমন নির্বাক থাকবে? আবার কোনো বিপদ আসতে চলেছে সামনে?
বিচার কার্য শেষ হতেই একে একে সকলেই বিদায় নেয়। আজীজ শিকদারের আদেশে যে লোক জেরিন, সংগ্রামকে কোর্টে হাজির করেছিল সেই লোকের সাথেই তারা আবারও চলে যায়। যাবার সময় দুজনেই এক পলক শুধু তাকিয়ে দেখে যায় নির্বাক রক্তিমকে। রক্তিম একই ভাবে নিশ্চল কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। ইন্সপেক্টর এসে তাড়া দেয় কেস নিষ্পত্তির কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করার জন্য।রক্তিমের কোনো হেলদুল হয়না।মেহেদী চিন্তিত মুখেই বসা থেকে ওঠে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। ভয় জড়ানো মনেই শুকনো ঢোক গিলে রক্তিমের হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। রক্তিম যেন এক কলের পুতুল। মেহেদী তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে প্রাণহীন এক পুতুলের মতোই সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তার এমন অস্বভাবিক নির্লিপ্ততায় ভয় হয় উপস্থিত প্রতিটা মানুষের। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে ছেলেটা?এক বিপদ শেষ হবার সাথে সাথেই আবার না কোনো অঘটন ঘটে যায়।
কোর্টের সমস্ত কার্যক্রম সমাপন করে আজীজ শিকদারকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় মেহেদী। জানায় রক্তিমকে নিয়ে কিছুক্ষণ অন্য কোথাও থেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে তারা। আজীজ শিকদার অপরাধী চোখে ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বিদায় নেয় আদালত প্রাঙ্গন থেকে। মেহেদী রক্তিমের হাত ধরে এগিয়ে যায় অন্য একটা গাড়ির দিকে। গাড়ির কাছাকাছি যেতেই হুট করে শরীরের শক্তি হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে রক্তিমের বলিষ্ঠ দেহটা। তৎক্ষণাৎ অজানা এক ভয়ে, আতঙ্কে নীল হয়ে ওঠে মেহেদীর মুখ। জাবির, শান্ত, রাকিব দৌড়ে এসে মাটিতে লুটিয়ে থাকা রক্তিমের দেহটা আগলে নেয়। জড়বুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেহেদীকে তাড়া দিয়ে বলে,
“দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ভাইকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে। দেরী হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।”
চলবে….