#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৯
#আদওয়া_ইবশার
হেডলাইটের আলোয় মধ্যরাতের অন্ধকার চূর্ণ করে সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে যাচ্ছে আজীজ শিকদারের গাড়িটা। গাড়ির ভিতরের পরিবেশ একেবারে থমথমে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। কতক্ষণ পরপর শুধু দৃষ্টির নাক টানার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফিরতি পথেও ড্রাইভারের পাশের সিটটা সবার আগেভাগে দখল করে নিয়েছে রক্তিম। পেছনের সিটে একেবারে জানালার পাশ ঘেষে বসেছে দৃষ্টি। তার পাশেই আজীজ শিকদার। এরপর মেহেদী। কবুল বলার সেই মুহুর্তের পর থেকে রক্তিমের মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও উচ্চারিত হয়নি। তার এই অস্বাভাবিক শান্ত আচরণ কারো হজম হচ্ছেনা। তিনজন মানুষের মনেই ভীতি সঞ্চার করছে। প্রকৃতি যেমন ঝড় আসার পূর্বে একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঠিক তেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে রক্তিমের মাঝে। এই নিরবতা বাদ বাকী তিনজন মানুষের মুখ থেকেও শব্দ কেড়ে নিয়েছে। দৃষ্টির যেমন বাবা-মায়ের কথা মনে হয়ে কষ্ট হচ্ছে। ঠিক তেমন তার এই পাষাণ প্রেমিক পুরুষের নিরবতাটুকু মনের কোণে প্রলয়ঙ্কারি ঝড় তুলছে। কান্নার বেগ কমে এলেও অজানা এক ভয়ে ছোট্ট আদুরে দেহটা বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠছে। ঝোঁকের বসে শত পাগলামি করে তিন কবুল পড়ে ধর্মীয় মতে আপন তো করে নিল এই মানুষটাকে। কিন্তু মানুষটার মনের ঘরে কি কখনো তার ঠাই হবে?
ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে নিজ শহরে এসে পৌঁছায় আজীজ শিকদারের গাড়িটা। শিকদার মঞ্জিলে যাবার আগে রক্তিমের সেই ছোট্ট কুঠির পেরিয়ে যেতে হয়। গাড়িটা সেখানে আসতেই এতোক্ষনে মুখ খুলে শুধু ড্রাইভারকে থামতে বলে রক্তিম। আজীজ শিকদার বুঝে যায়, আজও ছেলেটা বউ নিয়ে নিজের বাড়ি যাবেনা। সেই ছোট্ট টিনের চালার পাখির বাসার মতো ঘরটাতেই ঠাই নিবে। এ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ায়না আজীজ শিকদার। এমনিতেই ছেলের মতের বিরুদ্ধে এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ঐ ঘটনার পর ঝড় কখন কোন দিক দিয়ে এসে কোনদিকে যায় এটা নিয়েই এখনো সংশয়ে। এর উপর আবার ঐ বাড়ি যাবার কথা বলে ঘুমন্ত বাঘকে জাগ্রত করার কোনো মানে হয়না। তবে দৃষ্টিকে নিয়ে মুখ খুলেন আজীজ শিকদার। যদিও তিনি জানেননা ছেলে আজও মেয়েটার দায়িত্ব নিবে কি না। তবুও বলেন,
“আজকের রাতটুকু দৃষ্টি শিকদার মঞ্জিলে থাকবে। তোমাদের ধর্মীয় ভাবে বিয়ে হলেও আইনত এখনো বিয়েটা হয়নি। কাল কোর্টের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে ওকে তোমার ঘরেই দিয়ে যাব।”
কথাটুকু শেষ হওয়া অব্দিও অপেক্ষা করেনা রক্তিম। গাড়ি থেকে নেমে বড় বড় পায়ে ছুটে যায় নিজের ঠিকানায়। পিছনে দৌড়ে যায় মেহেদী। তবে শশুরের কথায় এতোক্ষনের আটকে রাখা দমটা যেন ফিরে পায় দৃষ্টি। বহুক্ষণ পর একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয় এই ভেবে, অন্তত আজকের রাতটুকু হলেও জল্লাদ মুখো মানুষটার থেকে দূরে থাকতে পারবে। পাষান্ডটা যেভাবে প্রথম দিনই ভালোবাসার কথা শুনে দৃষ্টির গলা চেপে ধরেছিল! সেই ঘটনার পর একে আর সহজভাবে নেওয়া বোকামি। আজ এতো বড় একটা কান্ড ঘটানোর ফলে হয়তো হাতের নাগাল পেলে একেবারে কুচি কুচি করে নদীতে ভাসিয়ে দিতো। দৃষ্টি নামক অস্তিত্বটাই একেবারে মুছে দিত পৃথিবীর বুক থেকে। তবে এভাবে কতদিন লুকিয়ে থাকবে? সেই তো কাল থেকে তার সাথেই থাকতে হবে। তখন কি করবে দৃষ্টি? কিভাবে বাঁচবে ঐ জল্লাদের হাত থেকে! বিয়ের জন্য এতো বড় একটা কান্ড ঘটানোর আগে নিজের জীবনের প্রতি মায়া কেন হলনা তার! এক চিন্তার ভিতর আরেক চিন্তা ঢুকে ঢুকে একেবারে মাথাটা জট পেকে যাচ্ছে।
ভাবনার অথৈ সাগরে দোদুল্যমান দৃষ্টি টেরই পায়নি গাড়িটা কখন এসে শশুরালয়ে ভিড়েছে। ভাবনার সুতোই টান পরে আজীজ শিকদারের ডাকে।
“এসো মা। শশুর বাড়ির মাটিতে পা রাখো। কষ্ট করে বউ না সেজেও শশুর বাড়ি চলে আসতে পেরেছো। এমন ভাগ্য কয়জন মেয়ের হয়!”
শেষের কথা গুলো স্ব-শব্দে হেসে রসিকতার ছলে বলে আজীজ শিকদার। শশুরের কথায় দৃষ্টি নিজেও মুখাবয়বে বিষাদ নিয়েই একপেশে হেসে নেমে পরে গাড়ি থেকে। গুটি গুটি পায়ে আজীজ শিকদারের পিছন পিছন এসে দাঁড়ায় সদর দরজার সামনে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথেই ভিতর থেকে খুলে যায় সিংহকপাট। দৃষ্টির চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক উচ্ছল কিশোরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখবিবর। গাল ভর্তি হেসে মেয়েটা দারুন উৎসাহের সাথে বলে,
“অবশেষে তাহলে সত্যি সত্যি অসাধ্য সাধন হলো! ভাইয়া শেষ পযর্ন্ত বিয়েটা করল বাবা!”
ইতির কথায় আজীজ শিকদার প্রশান্তিময় হাসে। বুক ফুলিয়ে বলে,
“বাপ হয়ে যদি ছেলের এটুকু জেদ ভাঙ্গাতে না পারি তবে কিসের বাপটা হলাম! তাছাড়া একজন সংসদ সদস্য বলে কথা। আমার একটা পাওয়ার আছে না! তোমার ঐ পাতি মাস্তান ভাইয়ের নাকে দড়ি দেওয়া আমার বা-হাতের খেল।”
বাবার কথায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ইতি। তড়িৎ দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ওয়েলকাম টু ইওর ইন-ল’স হাউস ভাবি। এন্ড ওয়েলকাম টু মাই ব্রাদার’স মেসসি লাইফ। মন-প্রাণ ভরে দোয়া করি, তোমার ছোঁয়ায় আমার ভাইয়ের বিষাদপূর্ণ জীবনটা যেন আবারও রঙিন হয়ে ওঠে। তুমি জানোনা, কত অধীর আগ্রহে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। প্রতিটা সেকেন্ড অপেক্ষা নামক অনলে পুড়েছি। ভেবেছি কবে আমার ভাইয়ের জীবনে এমন একটা মানুষের আগমন ঘটবে,যে আমার ভাইয়ের জীবনটা তার ভালোবাসা দিয়ে নতুন করে রাঙিয়ে দিবে। যেদিন থেকে তোমার কথা শুনেছি সেদিন থেকেই তোমাকে একনজর দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে ছিলাম।অবেশেষে আমার সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। আমার সিংহ ভাইকে ভালোবাসার মতো সেই দুঃসাহসিক বাঘিনীর দেখা পেলাম আমি। এবার সত্যি সত্যি খুশিতে আমি পাগল হয়ে যাব ভাবি।”
এক নজর চোখের দেখাই কেউ একজন যে তাকে এতোটা আপন করে নিবে ভাবেনি দৃষ্টি। কোনো অহংকার নেই, জড়তা নেই। এমন ভাবে মিশে গেল মনে হচ্ছে এর আগে আরও কতশত বার দেখা হয়েছে তার সাথে। শশুর বাড়িতে পা রেখেই নিজের বয়সী এমন বন্ধুসুলভ ননদ পেয়ে মন খারাপি ছাপিয়ে এক টুকরো খুশি ঝিলিক দেয় দৃষ্টির মনের কোণে। ইতির এতো গুলো কথার পৃষ্ঠে লাজুক হাসে সে। হাকডাক শুরু করে দেয় ইতি। তার চিৎকারে উপস্থিত হয় রেহানা বেগম। বরণ ঢালা হাতে পিছন পিছন দৌড়ে আসে কাকলির মা। নিয়মিত কাউন্সেলিং এর ফলে রেহানা বেগমের মানসিক অবস্থার আগের থেকে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আগের মতো সেই পাগলামি এখন আর করেনা। আস্তেধীরে সংসারের কাজকর্মে মন লাগছে। কথাবার্তা এখনো মন খুলে না বললেও কাজের সময় টুকটাক কথা বলেন। মাঝে মাঝেই ইতিকে ডেকে নিয়ে চুলে তেল দেওয়ার নাম করে জড়তা কাটিয়ে মা-মেয়েতে গল্পের আসর জমানোর চেষ্টা করেন। ইতিও মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা তুলে মা’কে সহজ করতে চায়। সব কিছু একটু একটু করে ঠিক হতে থাকলেও রক্তিমকে নিয়ে এখন পযর্ন্ত রেহানা বেগম কিছুই বলেনি। তার মানসিক দিক চিন্তা করে আজীজ শিকদার, ইতি তারাও এখন আর নিজে থেকে রক্তিমের কথা তুলেনা। তবে আজ ময়মনসিংহ যাবার আগে আজীজ শিকদার এটুকু বলে গিয়েছিল, “তোমার ছেলের বউ নিয়ে বাড়ি ফিরব। রেডি থেকো তাকে বরণ করার জন্য।” প্রতিউত্তরে রেহানা বেগম তখন শুধু নিরবে স্বামীর দিকে কতক্ষণ তাকিয়েছিল। কিছুই বলেনি। তবে ঠিকই সন্ধ্যায় নিজ থেকেই কাকলির মা’কে নিয়ে সাজিয়েছে বরণ ঢালা। অপেক্ষায় থেকেছে নতুন বউয়ের আগমনের। মায়ের আমুল পরিবর্তনে ইতির খুশিটা যেন আরও দ্বিগুণ হয়। মনের কোণে শিকদার বাড়ির অতি সন্নিকটিত সুখের সানাই বাজে। চোখে ভাসে হাসিখুশি একটা পরিবারের বাস্তব চিত্র।
কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই দৃষ্টিকে বরণ করে নিজের গলার সেই পুরোনো আমলের চেইনটা দিয়েই দৃষ্টিকে ঘরে তুলেন রেহানা বেগম। পাশে দাঁড়িয়ে তা মুগ্ধ চোখে দেখে প্রাণ জুড়ায় বাবা-মেয়ে। অত্যধিক খুশিতে আনন্দশ্রু ভীড় করে ইতির আক্ষিকোঠরে। বরণ শেষে রেহানা বেগম মেয়েকে আদেশ করেন,
“ওকে নিয়ে তোমার রুমে যাও।”
মাথা নাড়িয়ে মায়ের আদেশ মেনে দৃষ্টিকে এক হাতে জড়িয়ে সিড়ি ভেঙ্গে দুতলায় নিজের রুমে নিয়ে যায়। লম্বা জার্নি আর কান্নার ফলে শরীর অত্যধিক ক্লান্ত দৃষ্টির। ইতি সেটা বুঝতে পেরে দৃষ্টিকে ফ্রেস হয়ে অল্প কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিতে বলে। তবে দৃষ্টি খেতে নারাজ। কোনোমতে ফ্রেস হয়ে দ্বিধা জড়তা দূরে ফেলে শরীরের অল্প আরামের আশায় শুয়ে পরে। ঠিক তখনই রুমে এসে উপস্থিত হয় রেহানা বেগম। নিখুঁত কারুকার্য খচিত চিকন দুটো চুড়ি এনে দৃষ্টির হাত টেনে পড়িয়ে দিয়ে বলে,
“বউ মানুষের হাত খালি থাকতে নেই। দেখতেও ভালো দেখায় না,মুরুব্বিরাও ভালো বলেনা। স্ত্রীর হাত খালি থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়।আজ কালের যুগের ছেলে-মেয়েরা এসব নিয়ম না মানলেও আমরা এখনো মানি। এগুলো যেন কখনো হাত থেকে খোলা না হয়।”
নিজের কথার পৃষ্ঠেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন রেহানা বেগম ছেলের অমঙ্গল চায়না। অথচ এই মানুষটাই কিছুদিন আগেই মা হয়েও দিন-রাত মুখে ছেলের মৃত্যু কামনা করতো। মানসিক ব্যাধি মানুষকে ঠিক কতটা বদলে দিতে পারে! মায়ের আজকের এক একটা আচরণ এতোদিনে ইতির মনে তৈরি হওয়া অভিমান গুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। অশান্ত মনে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। শাশুড়ির কথায় বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সাই জানায় দৃষ্টি। এরপর ননদ শাশুড়ির জোরাজোরিতেই অল্প হলেও মুখে তুলে শশুর বাড়ির অন্ন। বউ সাজ বিহীন, স্বামী বিহীন কাটিয়ে দেয় শশুর বাড়ির প্রথম রাত।
****
পরদিন যথাসময়ে কোর্ট ম্যারেজ সম্পন্ন হয় দৃষ্টি রক্তিমের। সাদেক সাহেব ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি কোর্টে গিয়ে উপস্থিত হয়। সাথে আসে তুসীর বাবা। সেখানের কার্যক্রম সম্পাদন শেষে শিকদার মঞ্জিলে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যেতে হয়। তবে এক ফোঁটা পানিও মুখে তুলেন না। শিকদার মঞ্জিলের প্রতিটা সদস্যের আন্তরিক ব্যবহারে এতোটুকু নিশ্চিত হয় মেয়ে তার এখানে সুখেই থাকবে। তবুও একমাত্র মেয়েকে এতো দূরে রেখে যেতে বাবার মন মানেনা। শিকদার মঞ্জিলে যতটা সময় থেকেছে পুরোটা সময় জুড়ে প্রতিটা মানুষকে হাত জোর করে অনুরোধ করেছে তার মেয়েটাকে যেন একটু দেখে রাখে। তবে মেয়ে জামাইয়ের সাথে আজও কোনো কথা হয়না। কোর্টের ব্যস্ত সময়টুকুতে রক্তিম শুধু এক ঝলক দেখা দিয়ে নিজের কাজ শেষ করে কারো দিকে না তাকিয়ে আবারও ফিরে যায়। তার এমন ব্যবহারে সাদেক সাহেবের মনে অল্প শংসয়ের দানা বাঁধে। আজীজ শিকদার তা বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে নেয়, শশুরের সামনাসামনি হতে ছেলে লজ্জা পাচ্ছে এটা বলে।
বাবা বিদায় নিতেই দৃষ্টি নিজেও প্রস্তুত হয় স্বামীর বর্তমান ঠিকানায় যাবার জন্য। ইতির সাথে টুকটাক কথার মাঝে এটুকু বুঝতে পেরেছে সেই ঘটনার পর থেকে রক্তিম নিজের বাড়ি ছাড়া হয়েছে। এরপর আর কখনো এক রাতের জন্যও সে এ বাড়িতে এসে থাকেনি। যেখানে স্বামী নেই,সেখানে দৃষ্টি কিভাবে থাকবে! একমাত্র রক্তিমের জন্যই তো এতোকিছু করে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা। বিয়ের পরও যদি ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে থাকতে হয় তবে এতো কিছু করার মানে হয়! তাছাড়া দূরে থেকে কখনো ঐ পাষাণতুল্য প্রেমিকের মনে নিজের জন্য ভালোবাসার ফুল ফোটাতে পারবেনা দৃষ্টি। যা করার কাছাকাছি থেকেই করতে হবে। কথায় আছে না, “কায়া দেখলে মায়া বাড়ে”! দৃষ্টিও দেখতে চায় দিন-রাত সর্বক্ষন চোখের সামনে থাকার পরও রক্তিম কিভাবে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।
****
চারিদিকে ইট-সিমেন্টের বেষ্টনী থাকলেও উপরে টিনের চালার তিন কামরার মুটামুটি ধরনের একটা ঘর। সামনের দিকে বারান্দা আছে। বারান্দার গ্রিলে মরিচা ধরেছে। একটা রুমের দরজা ব্যতিত বাকী দুটো রুমের দরজায় তালা ঝুলে আছে। বাড়ির প্রকৃত মালিক বউ-সন্তান নিয়ে বিদেশে থাকেন। বৃদ্ধা মা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন বাড়িটা ওনিই দেখাশোনা করেছে। সেই বৃদ্ধা মারা যাবার পর বাড়ির অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়েছিল। এলাকার কিছু বখাটে বারান্দার তালা ভেঙ্গে সন্ধ্যার পর জোয়ার আসর বসাতো। একবার তো ঘরের তালা ভেঙ্গেও সব লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়িটা রাকিবের দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়র। রক্তিম যখন নিজের জন্য নিরিবিলি একটা বাসস্থান খোঁজ করছিল তখন রাকিব নিজ থেকেই তার সেই আত্মীয়র সাথে কথা বলে নামমাত্র ভাড়ায় বাড়িটা ঠিক করে দেয়। বাড়ির মালিক ভাড়ার চিন্তায় না গিয়ে বাড়িটা কারো তত্ত্বাবধানে ভালো থাকবে এটা ভেবেই দিয়ে দেয়। পুরো বাড়িটাই নিজের মতো করে ব্যবহার করার অনুমতি পেলেও রক্তিম নিজের প্রয়োজনে শুধুমাত্র একটা রুমের তালা খুলে সেটাই ব্যবহার করছে। অন্য দুটো রুমে কি আছে না আছে সেটাও দেখার প্রয়োজন মনে করেনি রক্তিম।
ইতির পিছন পিছন রক্তিমের ব্যবহার করা রুমটার ভিতরে ঢুকে দৃষ্টি। চারদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখতে পায় যা-তা অবস্থা রুমের। আসবাবপত্র বলতে মাত্র একটা চৌকি, একটা টেবিল, আর একটা আলনা। পুরো আলনা জুড়ে এলোমেলো হয়ে আছে কিছু ছেলেদের পোশাক। মেঝেতে ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে সিগারেটের ফিল্টার। বিছানার মাঝেও দেখা যাচ্ছে দুই-একটা পরে আছে। ঘরের এমন বেহাল অবস্থা দেখে হতাশ দৃষ্টি আনমনে কিছুটা জোরেই বলে ফেলে,
“নে দৃষ্টি। তোর জামাই তোর জন্য ফুলের বদলে সিগারেটের ফিল্টার দিয়ে বাসার সাজিয়েছে। তোর সিগারেটময় বাসর।”
দৃষ্টির কথায় হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা ইতির। কোনোমতে নিজের হাসিটা আটকে বলে,
“কষ্ট পেয়োনা ভাবি। একটু ধৈর্য্য ধরে আমার ভাইটাকে সঠিক পথে নিয়ে আসো। তখন দেখবে পায়ের উপর পা তুলে খাবে তুমি। কষ্টের ফল সর্বদা মিষ্টি হয়।”
ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে দৃষ্টি। হতাশ মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলে,
” মনে হচ্ছে তোমার ভাইকে বিয়ে করেছি ভালোবাসা পাবার জন্য। এক গাধা পিটিয়ে গরু বানানোর দায়িত্ব নিতে এতো ইতিহাস সাজিয়ে বিয়ে করলাম।”
দৃষ্টির কথায় ঠোঁট টিপে হাসে ইতি। মজার ছলে বলে,
“গাধা পিটিয়ে গরু করতে হবেনা। গরু পিটিয়ে মানুষ করতে পারলেই হবে।”
“তোমার কি মনে হয় তোমার ভাই এখনো গরু উপাধিতে আছে? সেই কবেই তো মানুষ থেকে গরু রেখে একেবারে গাধায় পরিণত হয়েছে। তা না হলে কি আর আমার মতো একটা সুন্দরী মেয়ের ভালোবাসা পাবার পরও পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়? একে মনে হয় আমার পক্ষে মানুষ করা সম্ভব হবেনা। গাধা থেকে গরুতে পরিণত করার মাঝেই না জানি আবার আমাকেই হাতে পরকালের টিকেট ধরিয়ে দেয়।”
ননদ ভাবি মিলে কতক্ষণ সময় কাটিয়ে না চাইতেও চলে যায় ইতি। পুরো দুপুর শেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পথে। তবুও এখনো রক্তিম আসার কোনো খবর নেই। তিমিরাচ্ছন্ন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে আলোর মিছিল। ইতি বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর দৃষ্টি কতক্ষণ বাড়িটা টুকটুক করে ঘুরে দেখে আবারও রুমে ফিরে আসে। একা একা কিছুই ভালো লাগছেনা। কতক্ষণ বসে থেকে টুকটাক কাজে হাত লাগায়। প্রথমে আলনাটা গোছানোর জন্য কাছে যেতেই বিশ্রি ঘামের গন্ধ নাকে লাগে। নাক কুঁচকায় দৃষ্টি। একটা শার্ট হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো ভাবে, এতোদিন গল্প উপন্যাসে পুরুষের গায়ের গন্ধ নিয়ে কত উপমা শুনেছে। প্রেমিক পুরুষের শরীর থেকে না কি মিষ্টি বুনোগন্ধ ছড়ায়। যে গন্ধে মাতাল হয় প্রেমিকার তনুমন। বক্ষজুড়ে সৃষ্টি হয় তুলপার। আর এখন বাস্তবতা তার নাকে এ কোন বুনোগন্ধ ঠেলে দিল! এ গন্ধে তো দৃষ্টি মাতাল হবার আগেই জ্ঞান হারাবে। হতাশ দৃষ্টি। স্বামীর ঘরে পা রেখেই মেয়েটা হতাশ। তবুও কি আর করা। নিজে থেকেই যখন এই অদ্ভূত মানুষটাকে আপন করেছে তখন তাকেই হয় এই মানুষটার বদ অভ্যাস গুলো পরিবর্তন করাতে হবে। না হয় তার সকল ভালো-খারাপ আপন করে নিতে হবে। ঐ উটকো ঘামের গন্ধেই নিজেকে খোঁজে নিতে হবে মাতালতা।
চলবে….
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২০
#আদওয়া_ইবশার
[আজকের পর্বে গল্পের প্রয়োজনে কিছু স্থানে অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সেজন্য]
রাত তখন বারোটা। মেহেদীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে রক্তিম। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই থমকে যায় দুজনে। দুজনেরই নজর বিদ্ধ হয় বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা দৃষ্টির দিকে। সাথে সাথে সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নেয় মেহেদী। ঘরের আনাচে কানাচে তাকিয়ে দেখতে পায় একদম পরিপাটি। আলনায় স্তুপ হয়ে থাকা কাপড় গুলো সুন্দরভাবে ভাজ করা। বিছানাটা টানটান করে গোছানো। মেঝেতে এক বিন্দু ধুলো পযর্ন্ত মনে হচ্ছে নেই। মুচকি হাসে মেহেদী। চারিদিকে নজর বুলিয়ে ভাবে, অগোছালো রক্তিমের ঘর গোছানোর দায়িত্বটা প্রথম দিনই নিয়ে নিয়েছে তার ঘরণী। এবার নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে অগোছালো রক্তিম শিকদারকে গোছাতে পারলেই হলো। রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মেহেদী দেখতে পায় সে এখনো শান্ত দৃষ্টিতে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। রক্তিমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুক খুক করে কাশে মেহেদী। মুখ ভরে হেসে বলে,
“আজ থেকে আপনার সাথে আমার থাকার মেয়াদ শেষ। এখন থেকে বন্ধু রেখে বউয়ের সাথেই বিছানা শেয়ার করুন। বেস্ট অফ লাক।”
কথাটা বলে আর দাঁড়ায়না মেহেদী। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে একেবারে বাড়ির আঙ্গিনা থেকেই বিদায় নেয়। রক্তিম সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে আবারও দৃষ্টির দিকে তাকায়। এক পা দু-পা করে এগিয়ে একেবারে দৃষ্টির মুখের কাছাকাছি গিয়ে থামে। টেবিলের কাছে থাকা কাঠের চেয়ার টেনে বসে। ফের তীক্ষ্ম নজর স্থির করে দৃষ্টির দিকে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট পার হয়। রক্তিমের পলক পরেনা। কিছুক্ষণ পর নড়ে ওঠে দৃষ্টি। ঘুমটা এখনো তার জোরালো হয়নি। গতরাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে খুব বেশিক্ষণ জেগে থাকতে না পেরে বিছানায় হেলান দিয়ে রক্তিমের জন্য অপেক্ষামান অবস্থাতেই ঘুমের জগতে তলিয়ে যায়। ঘুমের মাঝেই অনুভব হয় কেউ তার দিকে শাণিত নজরে তাকিয়ে আছে। সহজা পাতলা ঘুমটা ছুটে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় রক্তিমের তিক্ষ্ম নজর। হুট করে ফাঁকা মস্তিষ্ক বিষয়টা ধরতে পারেনা। ফ্যালফ্যাল নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুরো বিষয়টা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই লাফিয়ে ওঠে দৃষ্টি। গায়ের ওড়না ঠিক করে জড়োসড়ো হয়ে বসে। আমতা আমতা করে বলে,
“ইয়ে, কখন এসেছেন?”
জবাব দেয়না রক্তিম। সেই আগের মতোই তিক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির মুখের দিকে। ঐ নজরের তোপে পরে হাঁসফাঁস করে দৃষ্টি। অস্বস্তিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজেকে আরও একটু গুটিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালায়। অজানা এক ভয়ে বুকের ভিতর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই গর্জে ওঠে কিছু একটা। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজায়। নিজেকে প্রস্তুত করে রক্তিমের ক্রোধের অনলে ভস্ম করতে। দৃষ্টিকে ভয় পেতে দেখেও দমেনা রক্তিম। বরং আরও একটু ঝুকে আসে দৃষ্টির মুখের দিকে। সাথে সাথে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় দৃষ্টি। কানে ভাসে রক্তিমের হিমশীতল কন্ঠ,
“খুব শখ ছিল রক্তিমের বউ হবার! ওফস! বউ না তো। বেড পার্টনার হবার। ঠিক বললাম তো!”
কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে দৃষ্টির। কেঁপে ওঠে বন্ধ চোখের পাপড়ি। দুহাতে আকড়ে ধরে বিছানার চাদর। কাঁপা কন্ঠে বলে,
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার ভালোবাসার অপমান করবেন না।”
‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো নিজের কান দুটো চেপে ধরে রক্তিম। ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে,
“এই মেয়ে চুপ! একদম চুপ। ঐ মুখ দিয়ে দ্বিতীয়বার ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করলে একেবারে জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব।”
অশান্ত ভঙ্গিতে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম। স্বজোরে চেয়ারে লাথি বসায়। কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। বন্ধ চোখ দুটো আরও খিঁচিয়ে নেয়। দরজার সামনে গিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয় রক্তিম। দুই হাতে টেনে ধরে মাথার চুল। পাগলের মতো কতক্ষণ ঘরময় পায়চারি করে আবারও এগিয়ে যায় দৃষ্টির দিকে। ঝুঁকে গিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরে দৃষ্টির নরম গাল দুটো। আৎকে ওঠে দৃষ্টি। বন্ধ চোখের পাপড়ি খুলে অসহায় চোখে তাকায় রক্তিমের দিকে। তার ঐ অসহায় নয়নের আকুতি একটুও টলাতে পারেনা পাষাণহৃদয়ের ক্রোধ। বরং হাতের চাপ আরও একটু জোরালো হয় দৃষ্টির কোমল গালে। দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত চোয়ালে রক্তিম বলে ওঠে,
“কিভাবে পারিস? কিভাবে পারিস তোরা শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার জন্য ভালোবাসার মতো পবিত্র নামটা ব্যবহার করে সেটা অপবিত্র করতে? কি বুঝিস তোরা ভালোবাসার? তোদের মতো ছলনাময়ীর ভালোবাসা মানেই তো শুধু শরীরের ক্ষিদা। এটা ছাড়া তোদের কাছে ভালোবাসার ভিন্ন কোনো সজ্ঞা আছে? কেন, কেন তোদের মতো পতিতার জন্ম কোনো পতিতালয়ে না হয়ে এই শুদ্ধ সমাজের শুদ্ধ পরিবারে হয়? শুধুমাত্র আমাদের মতো কিছু ছেলেদের বুকের বা-পাশে ছুরি বসানোর জন্য! একটা বাগানের মতো সুন্দর পরিবারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার জন্য! বিনিময়ে কি পাস তোরা? ঐ শরীরের ক্ষিদে মিটানোর পৈশাচিক আনন্দ! এটা তো পতিতাবৃত্তি করেই মিটাতে পারিস। তবে কেন একটা পুরুষকে ভালোবাসা নামক বিষাক্ত অনুভূতি দিয়ে জীবন্ত লাশে পরিণত করিস তোরা?”
সহ্য হয়না দৃষ্টির। একের পর এক বিষাক্ত কথার বাণ শ্বাস আটকে দেয় দৃষ্টির। কান চেপে ধরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
“চুপ করুন। চুপ করুন প্লিজ। আমার আর সহ্য হচ্ছেনা এসব। একটুও নিতে পারছিনা আপনার কথা গুলো। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”
কিশোরী হৃদয়ের অনুভূতি গুলো যেন এক মুহুর্তের জন্য ফিকে হয়ে যায় রক্তিমের অপবাদ গুলোর কাছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে দৃষ্টি। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে গাল থেকে রক্তিমের হাত সড়ানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে রক্তিমের আঘাতের উদ্দেশ্যে করা স্পর্শটুকুও মনে হচ্ছে দৃষ্টির পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। উন্মাদের মতো গাল থেকে হাত সড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তবুও থামেনা। আচড়ে খাঁমচে নিজের গাল নিজেই রক্তাক্ত করে। এক পর্যায় দৃষ্টির পাগলামি দেখে রক্তিম নিজেই দূরে সরে যায়। দু-পা পিছিয়ে চুপচাপ ভঙ্গিতে দেখে যায় বিধ্বংসী দৃষ্টিকে। হ্যাঁ বিধ্বংসী। এই মুহুর্তে যে কেউ দেখলে দৃষ্টিকে বিধ্বংসীই বলবে। উদ্ভ্রান্তের মতো রক্তিম দূরে সরে যাবার পরও এখনো কেমন নিজেই নিজের গাল নখের আঘাতে ক্ষতবীক্ষত করে যাচ্ছে! এক সময় বুঝতে পারে রক্তিম তার থেকে দূরে সরে গেছে। ক্ষণকাল একটু থামে দৃষ্টি। পূণরায় হাতের উল্টোপিঠ কামড়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতায় কি বীভৎস শোনায় দৃষ্টির সেই চিৎকার! কান্নারত অবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল আপনাকে ভালোবাসা। সবথেকে বড় পাপ আমি করেছি আপনাকে ভালোবেসে। আগে যদি জানতাম এই ভালোবাসায় এতো বেদনা তবে নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দিতাম। তবুও ভালোবাসা নামক নরকে ঝাপ দিতাম না।”
একটু থামে দৃষ্টি। প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্না আটকানোর। ঠোঁট কামড়ে ধরে চিৎকার করা কান্নাটা বন্ধ করতে পারলেও চোখের অশ্রু বন্ধ হয়না। বন্ধ হয়না বুকের ভিতরের জ্বলন। সৃষ্টিকর্তার এ কেমন বিচার? নিষ্পাপ হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার পরও কেন এমন অপবাদ পেতে হয়! তার অবুঝ হৃদয়ের ভালোবাসায় তো কোনো স্বার্থ ছিলনা। সেই শুরু থেকে একদম নিঃস্বার্থভাবে সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছে পাষাণ মানুষটাকে। বিনিময়ে কি অবহেলাটুকু যথেষ্ট ছিলনা? সাথে কেন আবার যোগ হলো কথার আঘাত। কিভাবে পারল মানুষটা তার পবিত্র ভালোবাসায় অপবিত্রতার কালিমা লেপ্টে দিতে?
মুখ হা করে বড় বড় দম ফেলে দৃষ্টি। সময় নিয়ে নিজেকে একটু শান্ত করে তাকায় রক্তিমের দিকে। ফের নিবরি অশ্রু গড়িয়ে পরে দৃষ্টির গাল বেয়ে। দুহাতে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুটুকু মুছে ঠোঁট কামড়ে বেদনামিশ্রিত হেসে বলে,
“আমি বেহায়া। বড্ড বেহায়া আমি। অবশ্য আপনার সাথে দেখা হবার আগে এতোটা বেহায়া ছিলাম না। যেই আপনার সাথে দেখা হলো,সেই আমি দৃষ্টি পুরোটাই বদলে গেলাম। আমার অস্তিত্ব আমার ব্যক্তিত্ব পুরোটাই ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য বলয় গ্রাস করে নিয়েছে। বানিয়ে দিয়েছে আমাকে আস্তো এক বেহায়া। যদি বেহায়া না হতাম, তবে কখনো আজ এখানে আপনার স্ত্রী হয়ে বসে থাকতাম না। আর না আপনার এতো গুলো অপবাদ সহ্য করতাম। আগে জানতাম ভালোবাসা মানুষকে ব্যক্তিত্ববান বানায়। কিন্তু যখন নিজে ভালোবাসলাম! তখন দেখলাম একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে পুরোপুরি বেহায়াতে পরিণত করার নামই হলো ভালোবাসা। একবার যখন বেহায়া হয়েই গেলাম। তবে আর কি! না হয় নিলাম সহ্য করে আপনার সমস্ত অপবাদ। যদি আরও কোনো অপবাদ দেবার থাকে দিতে পারেন। বিশ্বাস করুন!কোনো অভিযোগ তুলবনা আপনার প্রতি। শুধু আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে ধৈর্য্য চাইব। আর অপেক্ষায় থাকব সেই দিনের, যেদিন আপনি নিজে আমাকে আকড়ে ধরবেন। মুখ ফোটে বলতে না পারলেও অনুশোচনায় ভুগবেন আমাকে দেওয়া আজকের অপবাদ গুলোর জন্য। সেদিন আমি ঠিক ভালোবাসার জোরে বুঝে নিব আপনার বুকের ভিতরে জ্বলতে থাকা অনুশোচনার আগুন। তবে একটুও উপহাস করবনা। আর না দিব আপনাকে বেশিক্ষন সেই আগুনে পুড়তে। স্ব-যত্নে আমার ভালোবাসার শীতল পরশে নিভিয়ে দিব সেই আগুন। উত্তপ্ত হৃদয়ের প্রতিটা কোণায় কোণায় বিছিয়ে দিব ভালোবাসা নামক শীতল পাটি।
চলবে….