দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১৭+১৮

0
459

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৭
#আদওয়া_ইবশার

সকাল হয়েছে অনেক্ষন। কিন্তু পাখিরা আজ ব্যর্থ তাদের কিচিরমিচির রব তুলে রক্তিমের ঘুম ভাঙ্গাতে। সারা রাত দৃষ্টি নামক উটকো ঝামেলাটা কিভাবে ঘাড় থেকে দূর করবে এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই নির্ঘুম কেটেছে। তবে কোনো হদিস মিলেনি। অবশেষে ব্যর্থতাকে বরণ করে ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় রক্তিম। যার দরুন আজ এতো বেলা হওয়ার পরও ঘুমাচ্ছে সে। অন্যথায় ঠিক ফজর ওয়াক্তেই চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়। তার এই অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিল ক্যাডেট কলেজ থাকাকালিন সময়ে। এরপর মিলিটারী চাকরি সূত্রে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে সেই অভ্যাসটা একেবারে পাকাপুক্ত ভাবে থেকে যায় রক্তিমের জীবনে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের সৈনিক জীবনের এমন আরও কিছু অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে রক্তিমের জীবনে। এই যেমন প্রতিদিন ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে ওঠে কমপক্ষে এক ঘন্টা সময় নিয়ে মর্নিং ওয়াক করবে। নেই শুধু চাকরিটাই। রক্তিম ওঠেনি দেখে আজ মেহেদীরও ওঠার কোনো নাম গন্ধ নেই। সেও পরে পরে ঘুমাচ্ছে।হঠাৎ ফোনের তীব্র শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে রক্তিমের। ঘুম ঘুম চোখে কপাল কুঁচকে পাপড়িদ্বয় অল্প ফাঁক করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়। বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় আবারও। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,

‌”এতো সকাল সকাল ফোন করেছেন কেন?”

ছেলের এমন জবাবে ফোনের অপর পাশে থেকে কপাল কুঁচকায় আজীজ শিকদার। সাথে কিছুটা অবাক হয় এটা ভেবে যে ছেলেকে কখনো ছয়টা পযর্ন্ত বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেনি সেই ছেলে আজ এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছে! তাও আবার এখন বলছে এতো বেলাকে সকাল! কিছুটা চিন্তিত হয় আজীজ শিকদার। জিজ্ঞেস করে,

“কয়টা বাজে দেখেছো? তোমার জন্য সকাল এখনো অপেক্ষা করে নেই। অনেক আগেই সে বিদায় নিয়েছে। তুমি হঠাৎ এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছো কেন? শরীর ঠিক আছে?”

বাবার কথায় এবার দু-চোখের পাতা পুরোপুরি আলগা হয় রক্তিমের। কান থেকে ফোন নামিয়ে সময় দেখে বিস্মিত হয় অনেকটাই। আশ্চর্য! সে এতো বেলা অব্দি ঘুমিয়েছে! বিষয়টা যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা। ঘাড় কাত করে পাশে তাকিয়ে দেখে মেহেদীও এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শরীরটা কেমন মেচমেচ করছে রক্তিমের। এটা নিশ্চয়ই অনিয়ম করে এতো বেলা অব্দি ঘুমানোর ফল। অলসতা ঝেড়ে তৎক্ষণাৎ শোয়া থেকে ওঠে বসে। বাবাকে জবাব দেয়,

“আমার শরীরের আবার কি হবে?গন্ডারের চামড়ায় যেমন কখনও আঘাত লাগেনা। তেমন আমার শরীরেও কখনো অসুখ বাঁধেনা। রাতে একটু দেরীতে ঘুমিয়েছিলাম তাই ওঠতে বেলা হলো। তা আপনি বলুন কেন ফোন দিলেন? সব ঠিকঠাক! না কি কেউ আবার কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছে?”

“সব ঠিকঠাক আছে। ফোন করেছি রেডি হতে বলার জন্য। দ্রুত ওঠে ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আমরা আজই ময়মনসিংহ যাব দৃষ্টির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

অচিরেই যেন রক্তিমের মাথায় ধুম করে মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরে। সদ্য জাগ্রত হওয়া শান্ত মস্তিষ্ক তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেনা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কতক্ষণ স্থবির হয়ে বসে থেকে স্থিমিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“আজকে না মা’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা! তো ওখানে যাবেন কখন?”

“সকালটা এখন হয়নি বাবা। গুণে গুণে একেবারে সাড়ে চার ঘন্টা আগে সকাল হয়েছে। আর ডাক্তারেরাও আপনার মতো সারারাত রাজকার্য শেষ করে দশটায় ঘুম থেকে ওঠে দুটোই রোগী দেখতে বসেনা। ডাক্তার দেখিয়ে কতক্ষণ আগেই এসেছি।”

জবাবে শুধু ছোট্ট করে “ওহ্” বলে রক্তিম। পূনরায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানতে চায়,

“ডাক্তার কি বলেছে?”

“হুট করে এতো বড় একটা আঘাত মস্তিষ্ক নিতে পারেনি। ভয়টা মন-মস্তিষ্ক দখল করে নিয়ে একেবারে মানসিক রোগীতে পরিণত করে রেখেছে। ধীরে ধীরে সঠিক কাউন্সেলিং আর চিকিৎসায় ঠিক হবে।”

বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রক্তিম। হতাশাগ্রস্থ হয়ে ডান হাতে মুখের একপাশ ঘষতে থাকে বারবার। সুস্থ্য স্বাভাবিক মা’কে মানসিক রোগীতে পরিণত করার জন্য অজান্তেই মনটা নিজেকেই দায়ী করে। এক ভালোবাসা নামক অভিশপ জীবনটাকে নরক করে দিয়েছে একেবারে। পূণরায় আবার কিভাবে রক্তিম নিজেকে সেই নরকের মাঝে নিয়ে যাবে? কেন বুঝতে চাইছেনা বাবা, ঐসব প্রেম, ভালোবাসা, সংসার অন্যদের জীবনে সুখ এনে দিলেও তার জীবনে শুধু কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়না। গত দুটো বছরে এই ভবঘুরে ছন্নছাড়া জীবনটাতেই তো মানিয়ে নিয়েছে রক্তিম নিজেকে। সময়ের সাথে সাথে পুরনো সেই ক্ষতটাতেও হালকা প্রলেপ পরতে শুরু করেছে। সেই প্রলেপ ছুটিয়ে ক্ষতটাকে নতুন করে তাজা করতে কেন ওঠেপরে লেগেছে আজীজ শিকদার আর ঐ মেয়েটা?

“আমাকে শান্তিতে থাকতে দেখে কি সত্যিই আপনার ভালো লাগছেনা? কেন বাবা হয়েও বারবার ঐ বিভীষিকাময় জীবনের দিকে ঠেলছেন?”

অসহায় কন্ঠে জানতে চায় রক্তিম। গম্ভীর্যতার দেয়াল ডিঙিয়ে এতোদিন পর ছেলের এভাবে অসহায় স্বরের কথা শুনে আজীজ শিকদারের মনটা অশান্ত হয়। ভিতরে ভিতরে সন্তানের অসহায়ত্বে গুড়িয়ে যায় বাবা নামক সত্তাটা। বুকের ভিতর হাহাকার করে ছেলেটার একটু সুখ দেখতে। ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেলেও মুখে তা প্রকাশ করেনা আজীজ শিকদার। কঠোর স্বরে উত্তর দেয়,

“যা খুশি ভাবতে পারো। তোমার ভাবনায় আমার চেষ্টা থেমে যাবেনা। সন্তানের ভালোর জন্য বাবা-মা’কে অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে যেতে হয়। যা এই মুহূর্তে আমি করছি। এই যাত্রায় শেষ। আমাকে এই শেষ চেষ্টাটুকু করতে দাও। কথা দিচ্ছি, এবার যদি আমি ভুল হই তবে আর কখনো তোমার সামনে কোনো আবদার নিয়ে যাবনা। তোমার যেভাবে খুশি সেভাবেই চলতে পারবে।”

কঠোর চিত্তে কথাগুলো বলতে চাইলেও শেষ পযর্ন্ত কঠোরতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় আজীজ শিকদার। শেষের কথাগুলোতে রক্তিম স্পষ্ট টের পায় বাবার ব্যকুলতা। যার দরুন সে নিজেও আর কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনা। এই দুটো বছর যাবৎ মানুষ গুলো তার থেকে তো আর কম কষ্ট পায়নি। কষ্টের আঘাত সহ্য করতে না পেরে বর্তমানে একজন মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। আরেকজন এখনো সন্তানের মঙ্গল কামনায় তৎপর। একেই বুঝি বলে বাবা-মা! যারা সন্তানের থেকে শত কষ্ট পাবার পরও তাদের ভালোর কথা ভাবতে ভুলেনা। এই যাত্রায় কেন যেন বাবার মুখের উপর না শব্দটা ছুড়ে দিয়ে তাকে কষ্ট দিতে বিবেকে বাঁধে রক্তিমের। কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ছাড়াই আস্তে করে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

এতোক্ষনে ঘুম ভেঙ্গে গেছে মেহেদীর। আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠে বসে। পরপর দুটো হাই তুলে তাকায় রক্তিমের দিকে। দেখতে পায় কেমন নির্জীবের মতো মাথাটা নত করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে রক্তিম। তার এমন নির্জীবতায় খুব একটা অবাক হয়না মেহেদী। বৈশাখ থেকে চৈত্র বারো মাসেই তো এই ছেলে এমন নিঃস্পৃহ। এর এমন জড় বস্তুর মতো আচরণের জন্য নতুন করে কিছু ঘটতে বা ঘটাতে হয়না। কথাটা ভেবে অলস শরীরটা আবারও লুটিয়ে দেয় বিছানায়। ঠিক তখনই রক্তিম আগের অবস্থানে থেকেই শান্ত ভাবে বলে,

“ওঠে রেডি হো। বেড়োতে হবে আমাদের।”

একটু কপাল কুঁচকায় মেহেদী। তার জানা মতে আজকে তো কোনো কাজ থাকার কথা না। কাজের মাঝে শুধু একটাই অকাজ আছে। সেটা হলো মোড়ের দোকানে বসে কাপের পর কাপ চা শেষ করা আর সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে বায়ু দোষণ করা। সেটার জন্য নিশ্চয়ই এতো তাড়া দেওয়া না! তবে কেন? প্রশ্নটা মাথায় রেখে জানতে চায়,

“কেন? কোথাও যাবি না কি?”

বসা থেকে ধীরেসুস্থে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম।আলনায় এলোমেলো হয়ে থাকা কাপড়ের স্তুপ থেকে বেছে একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ময়মনসিংহ যেতে হবে। নব নির্বাচিত এমপি সাহেবের আদেশ দ্রুত বেড়িয়ে পরতে হবে।”

হঠাৎ ময়মনসিংহ কেন যেতে হবে ভেবে পায়না মেহেদী। কোথায় ভেবেছিল আজকে এতোদিন পর একটু মনের সুখে পরে পরে ঘুমাবে। কিন্তু এই বাপ-ছেলের যন্ত্রণায় সেটাও আজ হয়ে ওঠলনা। চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে না চাইতেও ওঠে যায় মেহেদী। রক্তিমের পাশাপাশি নিজেও কিছুটা পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রাস্তায় দাঁড়ানোর দুই মিনিটের মাথায় দেখতে পায় এমপি সাহেবের গাড়ি তাদের সামনে এসে উপস্থিত। ড্রাইভারের পাশের সিটটা ঝটপট দখল করে নেয় রক্তিম। মেহেদী কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে উপায় না পেয়ে পিছনের সিটে আজীজ শিকদারের পাশে গিয়ে বসে। ঠিক তখনই দেখতে পায় আজীজ শিকদার কেমন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটু অপ্রস্তুত হয় মেহেদী। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কতক্ষণ উঁশখোঁশ করে অপ্রস্তুত হেসে সালাম জানায়। শব্দ করে সালামের জবাব দেয়না আজীজ শিকদার। মনে মনে জবাব দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। এতে যেন মেহেদী আরও একটুর অপ্রস্তুত হয়। ভাবে এই মহান হৃদয়ের অধিকারী এমপির চোখে সে আবার কোন ভুল করে বসল?

***
ময়মনসিংহ শহরে স্বগৌরবে অবস্থানরত দৃষ্টিদের একতলা বাড়িটার বাহিরের সৌন্দর্যটায় যেন আশেপাশের উচু দালান গুলোকে হার মানাতে বাধ্য। বাড়ির নকশা, চারদিকের পরিবেশ এটুকু দেখেই যে কেউ বলে দিতে পারবে অত্যন্ত রুচিশীল কোনো মানুষের বসবাস এখানে। ভিতরের পরিবেশটাও ঠিক সেটাই বহন করে। সাদেক সাহেব মনের ইচ্ছে পুরোটা উজাড় করে মন মতো ডিজাইনে সুদক্ষ কারিগর দিয়ে তৈরী করেছেন নিজের ছোট্ট প্রাসাদটা। পূণরায় সেটা দিলশান আরা মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। দুজনের যৌথ ইচ্ছেতে পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে এই স্বপ্ন নিবাস। যে নিবাসের একমাত্র স্বপ্নচারিনী দিলশান আরা। যার কাজই হলো নিজের স্বপ্ন গুলোকে পূর্ণতা দান করার জন্য নিজের পাশাপাশি স্বামী, সন্তানদেরকেউ সেই পথে পরিচালনা করা। সর্বদা নিজের বাড়িতে দাম্ভিকতার সাথে নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেওয়া দিলশান আরা হয়তো কখনো ভুল করেও ভাবেনি তার জীবনে এমন কোনো দিন আসতে পারে, যেদিন তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে বাইরের কিছু মানুষ তার কথার বিরোধীতা করে জয় ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। ভাবনাতীত সেই দিনটাই বোধহয় আজ। দুপুরের একটু পরপর কলেজ ছুটির পর বাড়িতে এসেছিল দিলশান আরা। এসে প্রতিদিনের মতোই সবার আগে ছেলে-মেয়ে দুটোর খোঁজ নিয়ে চলে যায় নিজের রুমে। ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় লাগানোর সাথে সাথেই বেজে ওঠে ডোরবেল। দৃষ্টি-দিহান দুজনই তখন দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমাচ্ছিল। কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও ওঠে যায় দিলশান আরা। সদর দরজা খুলে দিতেই বাড়িতে প্রবেশ করে একে একে এলাকার নবনির্বাচিত এমপি, সিটি কর্পোরেশনের মেয়ের সহ আরও কিছু গন্যমান্য রাজনৈতিক ব্যক্তি। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে দিলশান আরা। হুট করে কোনো কারণ ছাড়াই এতো এতো রাজনৈতিক দলের লোক তার বাড়িতে ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভূত লাগে। সেই সাথে মনের কোণে সঞ্চার হয় অল্প ভীতি। ভাবে নিজেদের অজান্তে আবার কোনোভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যায়নি তো!

“আমরা যদি ভুল না করি তবে এটাই তো সাদেক সাহেবের বাসা তাইনা!”

শুভ্র পাঞ্জাবী পরিহিত আজীজ শিকদার ঠোঁটের কোণে স্মতি হাসি নিয়ে সরল কন্ঠে জানতে চায়। একটু ধাতস্থ হয় দিলশান হয়। মনে মনে অল্প ঘাবড়ালেও মুখবিবরে তা প্রকাশ করেনা। স্বভাবজাত নিজের শিক্ষক জীবনের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেই বলে,

“জ্বি। এটাই সাদেক সাহেবের বাসা। আমি ওনার ওয়াইফ। তবে আপনারা হঠাৎ আমাদের বাসায় সঠিক কি কারণে বুঝতে পারলাম না। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বললে ভালো হতো।”

“এসেছি যখন সব কিছুই বলব। তবে আমরা কি বসে কথা বলতে পারি? আর হ্যাঁ। সাদেক সাহেবকে ডাকলে একটু ভালো হয়। আপনাদের দুজনের সাথেই আমাদের কিছু কথা আছে।”

“নিশ্চয়ই। বসুন আপনারা। সাদেক সাহেব বাসায় নেই। অফিসে। আমি ওনাকে আসতে বলছি।”

“জ্বি ধন্যবাদ।”

মুচকি হেসে কথাটা বলে একে একে সাথে নিয়ে আসা রাজনৈতিক দলের প্রত্যেককে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেন আজীজ শিকদার। তবে রক্তিম মেহেদী এখনো সেই দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে। রক্তিমের চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি। সে এখানে আসতে রাজি হয়েছিল কারণ জানত তার বাবা কখনো এই প্রস্তাবে দৃষ্টির বাবা-মাকে রাজি করাতে পারবেনা। দৃষ্টি যেদিন প্রথম তার সাথে দেখা করে সেদিনই অতি সচেতন রক্তিম শিকদার তার সম্পর্কে সকল খোঁজ খবর নিয়ে রাখে। এটা ভেবে, মেয়েটাকে আবার নতুন কোনো চাল শিখিয়ে বিরোধী দল পাঠিয়েছে কি না। তখনই সাদেক সাহেব এবং দিলশান আরা’র যে ব্যক্তির সন্ধান রক্তিমে পেয়েছিল সেটা থেকেই নিশ্চিত ছিল সে এমন সচেতন দুজন বাবা-মা কখনো তাদের মেয়ের জন্য এই প্রস্তাব মানবেনা। হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে আজীজ শিকদারকে। কিন্তু কে জানত লোকটা যে নিজের রাজনৈতিক পাওয়া খাটিয়ে একেবারে দলবল নিয়ে এসে হাজির হবে? এখন নিশ্চয়ই এই মানুষ গুলোকে নিজেদের ক্ষমতার দাপটে হাত করে নিবে। কথাটা ভেবেই মনে মনে অস্থির হয় রক্তিম। অন্যদিকে মেহেদীর চোখে-মুখে হতবুদ্ধিতার লেশ। সে এখন পযর্ন্ত এটাই বুঝতে পারছেনা এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কি। এমনকি এটাই যে তার গুন্ডা বন্ধুকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহসী মেয়ে দৃষ্টির বাসা এটাও এখন পযর্ন্ত জানতে পারেনি।

চলবে……

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৮(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। স্ত্রীর ফোন পেয়ে সাদেক সাহেব তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে বাসায়। তবে ঘটনার বিস্তারিত বুঝতে পারেনা কিছুই। এখন পযর্ন্ত সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা ছাড়া সঠিক উদ্দেশ্যের কথা কেউ জানায়নি। পরিচয় পর্বের মাঝেই সাদেক সাহেব জানতে পারে নিজের এলাকার মেয়র, এমপির সাথের অপরিচিত লোক গুলোর একজন সাভারের এমপি এবং এমপি পুত্র সাথে তার বন্ধু। হুট করে কোনো আগামবার্তা ছাড়া নিজের এলাকার রাজনৈতিক সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে অন্য এলাকার এমপিও উপস্থিত বিষয়টা ক্রমশই গভীর চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে দৃষ্টির মা-বাবা দুজনকেই। কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি কারণে ওনারা সরাসরি বাসায় এসে উপস্থিত হতে পারে। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ভাবনা-চিন্তা একপাশে রেখে সাদেক সাহেব সৌজন্য হেসে বলেন,

“আপনাদের মতো এতো সম্মানীয় ব্যক্তি আমার বাসায় এসেছে বিষয়টা সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ঠিক কি কারণে হঠাৎ আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের বাসায় আসলেন বিষয়টা ক্লিয়ার করলে হয়তো আমাদের সবার ভালো হতো।”

সাদেক সাহেবের কথায় উপস্থিত সকলেই একটু নড়েচড়ে বসে। আজীজ শিকদার নিজের পাশে বসা ময়মনসিংহ আসনের এমপি মাজহারুল ইসলামকে ইশারায় কথা শুরু করতে বলেন। কৃত্রিম কাশির শব্দ তুলে মাজহারুল ইসলাম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে শুরু করেন,

“দেখুন ভাই সাহেব হতে পারি আমরা বর্তমানে নিজেদের এলাকার এমপি পদে আছি। তবে আমি-আপনি আমরা সবাই তো সাধারণ মানুষেই তাই না! আপনারা যদি আমাদের ভোট না দিয়ে এলাকার ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব না দিতেন তবে তো আর আমরা এই দায়িত্ব পেতাম না। তাই বলছিলাম আমাদের স্বাভাবিক মেহমান হিসেবে গ্রহণ করলেই আমরা খুশি হবো। তাছাড়া আমাদের আজকে এখানে আসার উদ্দেশ্যটাই আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করার জন্য।”

আত্মীয়তার জন্য ওনারা এই বাসায় বাসায় এসেছে! কিন্তু কিরকম আত্মীয়তা? সঠিক বুঝতে পারছেনা সাদেক সাহেব। দিলশান আরা, সাদেক সাহেব সন্দিহান চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। মাজহারুল ইসলাম আবারও বলে ওঠেন,

” যাইহোক। বাকী কথা টুকু না হয় আজীজ ভাই আপনি নিজেই বলুন।”

মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আজীজ শিকদার। সরাসরি সাদেক সাহেবের তাকিয়ে বলেন,

“আপনার মেয়ে দৃষ্টি মেহজাবিন কিছুদিন আগে সাভারে বেড়াতে গিয়েছিল আপনার বড় শ্যালিকার বাড়ি। সেখানেই ওর সাথে আমার দেখা হয়। প্রথম বার দেখেই আপনার মেয়েকে আমার ছেলের জন্য মনে ধরে। আমি সবসময় সব কথা সরাসরি বলতে পছন্দ করি ভাইজান। তাই ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে সরাসরিই বলে দিচ্ছি। আপনার বাসায় আমি আমার ছেলে রক্তিম শিকদারের জন্য আপনার মেয়ের হাত চাইতে এসেছি।”

দৃষ্টি নামটা শোনা মাত্রই লাফিয়ে ওঠে মেহেদী। হতবাক দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। এটা যে তার বন্ধুর প্রেমে দিওয়ানি হওয়া সেই মেয়েটার বাড়ি তা এতোক্ষনে মাত্র জানতে পারল মেহেদী। কিন্তু কিভাবে কি হলো? ঐ মেয়ের খোঁজ আজীজ শিকদার অব্দি কিভাবে পৌঁছালো? আর রক্তিমেই বা সব জেনেও কিভাবে রাজি হলো এখানে আসতে? তবে কি ভিতরে ভিতরে বন্ধু তার আবারও প্রেমে মজলো? কিন্তু কখন? দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা একসাথে থেকেও সে একটুও টের পেলনা কেন? আচ্ছা সে না হয় মেনে নিল রক্তিম মেয়েটার প্রেমে পরেনি। আজীজ শিকদার নিজ উদ্যোগে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তারপরও তো এখানে একটা কিন্তু থেকে যায়। আজীজ শিকদার যদি নিজ উদ্যোগেই এই পর্যন্ত আসে তবে রক্তিম কিভাবে আসল? সে তো এতো সহজে বাবার কথায় রাজি হয়ে চলে আসার পাত্র না। তাছাড়া এই মুহুর্তে রক্তিমের চোখ-মুখ দেখেও মনে হচ্ছেনা সে আগে থেকে কিছু জানতনা বা তাকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে কি! আর কিছুই ভাবতে পারেনা মেহেদী। মাথা এখনই পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে তার। এতো বড় একটা ঘটনা বদ হজম হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বহু কষ্টে মেহেদী তা চেপে রাখছে। ঘটনা পুরোটা না জেনে মুখ খোলা ঠিক হবেনা।

এমন কিছু আবদার নিয়ে যে মানুষ গুলো ওনার বাসায় এসেছে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি তারা সাদেক সাহেব। দিলশান আরা কথাটা শোনা মাত্রই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই ইশারায় থামিয়ে দেয় সাদেক সাহেব। স্ত্রীকে শান্ত হয়ে বসতে ইশারা করে ওনি নিজেই স্মিত হেসে বলেন,

“মেয়ের বাবা হয়েছি,বিবাহ যোগ্য মেয়ে ঘরে আছে এমতাবস্থায় প্রস্তাব আসাটাই স্বাভাবিক। তবে ভাইসাহেব, আমাদের মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে আমরা প্রস্তুত নই। মেয়ে পড়ছে পড়োক। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। তাকে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই বিয়ে নিয়ে ভাববনা আমরা।”

“প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে মেয়েরা তো বিয়ের পরেও হতে পারে। তাছাড়া আজকালের যুগে আমার মনে হয় মেয়েদের আঠারো হলেই যোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই বাবা-মায়ের জন্য ভালো। কারণ ছেলে-মেয়েরা বড় হলে কলেজ-ভার্সিটিতে গিয়ে বাবা-মায়ের আড়ালে ভুল কোনো সম্পর্ক বা অন্য কিছুতে জড়িয়ে পরে কি না এই সম্পর্কে কিন্তু আমরা সবসময় অবগত থাকিনা। সেকারণেই…”

“মাজহারুল ইসলাম নিজের কথা শেষ করার আগেই দিলশান আরা বলে,

“বিয়ে দিয়ে দিলেই যে মেয়ে কোনো খারাপ কাজে বা সম্পর্কে জড়াবেনা এটার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? যে মেয়ের এমন সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছে থাকে তাকে শুধু বিয়ে কেন সে যদি দুই-তিন বাচ্চার মা’ও হয়ে যায় তবুও সে অবৈধভাবেই সম্পর্ক রাখবে। ভুল পথে পা দিবে। আর যে মেয়ের এমন কোনো ইচ্ছে না থাকে সে মেয়ে বিয়ের আগেও কোনো সম্পর্কে জড়াবেনা বিয়ের পর তো কথায় নেই। তাছাড়া আমার মেয়েকে এখন বিয়ে দিলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাব এর মানে কি? আমার মেয়ে নিয়ে যদি আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে তবে সেটা বিয়ে না দিলেও থাকবে বিয়ে দিলেও থাকবে। আর সবথেকে বড় কথা আমাদের মেয়ের কি করলে ভালো হবে কি করলে খারাপ হবে এটা বোঝার জন্য আমরা এখনো বেঁচে আছি। আপনাদের কষ্ট করে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা। অনেক দূর থেকে এসেছেন আপনারা, নিজেদের অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত সাথে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আপনারা আসতে পারেন।”

মুখের উপর সরাসরি এমন একটা জবাব ছুড়ে দেওয়াই উপস্থিত সকলের মুখে অসন্তুষ্টির রেশ থাকলেও রক্তিম নির্বিকার। দিলশান আরা’র কথা গুলো অন্য সবার মতো তার কাছে কটূক্তি মনে না হয়ে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর বাণী মনে হচ্ছে। সে আগে থেকেই এমন একটা ধারণা করেছিল। মেয়ের বাবা-মা এখনো ছেলে সম্পর্কে জানলোই না। তার আগেই এমন প্রতিক্রিয়া! আর ছেলে সম্পর্কে যখন সবটা জানবে তখন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? সেই প্রতিক্রিয়া দেখার পর আজীজ শিকদারের মুখটাই বা কেমন দেখাবে? আজীজ শিকদার কি খুব বেশি অপমানিত বোধ করবে না ঐসব কটূক্তি গায়ে মাখবেনা! ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসির রেখা ঝুলিয়ে মাথা নত করে সেসব ভাবনায় মশগুল রক্তিম। ঠিক তখনই কর্ণগোচর হয় আজীজ শিকদারের কথা। দিলশান আরা’র কথায় একটুও অপমানিত হবার না হয়ে স্বহাস্যে আজীজ শিকদার বলেন,

“সে নাহয় বুঝলাম আপা। কিন্তু আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে যে একে অপরকে ভালোবাসে! এখন আপনি কি বলবেন? এই মুহুর্তে কি আমাদের উচিৎ না তাদের নামহীন সম্পর্কটা মেনে নিয়ে বৈধতার সাথে নতুন একটা নাম দেওয়া! এখন যদি আমরা এটা না করি তবে হয়তো একদিন আগে হোক বা পরে, মানুষ ওদের মেলামেশা দেখে নানান কথা রটাবে। বাবা-মা তুলেও মন্তব্য করবে। বলবে কেমন বাবা-মা? ছেলে-মেয়েদের এভাবে ছেড়ে দিয়েছে। তখন কি সেসব শুনতে বা দেখতে ভালো লাগবে আপনাদের?”

কথাটা শোনা মাত্র সাদেক সাহেব, দিলশান আরা যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকেও অধিক বিস্মিত রক্তিম। আজীজ শিকদার কি বলল এসব? তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে মানে? রক্তিম কখন ঐ মেয়েকে ভালোবাসতে গেল? সে পারেনা একেবারে মেয়েটার গলা চেপে ধরে শ্বাস রোধ করে মে রে ফেলেতে। সেখানে কি না বলল রক্তিম ঐ মেয়েকে ভালোবাসে! মুহূর্তেই শান্ত মেজাজ উত্তপ্ত হয় রক্তিমের। ছলাৎ করেই যেন পায়ের রক্ত সব মাথায় ওঠে যায়। মেজাজ খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বাঁধা পরে যায় আজীজ শিকদারের কঠিন দৃষ্টির কাছে। না চাইতেও শান্ত হয়ে যায় শরীরের উত্তপ্ত রক্ত কণিকা। সে যতই খারাপ হোক। আর যতই বাবার অবাধ্যতা করুক। সবটাই তো নিজের এলাকায় করেছে। এখন এরকম অন্য এক এলাকায় এমন সম্মানীয় মানুষ গুলোর সামনে বাবার কথার অবাধ্য হতে মন সাই দেয়না রক্তিমের। সবার অলক্ষ্যে আগোচরে চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সামলে নেয় নিজেকে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটা দেখার।

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৮(শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

নিজের মেয়েকে ঘিরে এমন একটা কথা শুনে বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠে দিলশান আরা’র। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আজীজ শিকদারের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকে। পরক্ষনে নিজেকে সামলে জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,

“একদম ফালতু কথা বলবেন না আমার মেয়েকে ঘিরে।সেই তখন থেকে কিসব অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন! আমি আগেই বুঝতে পারছিলাম আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন কিছু একটা অশান্তি করার জন্যই। আমার বাড়িতে বসে আমার মেয়ে সম্পর্কে এমন একটা কথা বলার পরও আমি যথেষ্ট আন্তরিক ব্যবহার করছি আপনাদের সাথে। সম্মানের সহিত বলছি, দয়া করে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। অন্যথায় আপনাদের সাথে ঠিক কতক্ষণ আন্তরিকতা বজায় রাখতে পারব তা সঠিক বলতে পারছিনা।”

আজীজ শিকদার এখনো শান্ত। কথাগুলো একদম গায়ে লাগেনি, এমন একটা ভান করে বোঝানোর স্বরে বলে,

“আহা! এতো রেগে যাচ্ছেন কেন আপা? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। ভালোবাসা পবিত্র একটা শব্দ। এটাতে খারাপ কি পেলেন? তাছাড়া আমি যতটুকু জানি আপনাদেরও ভালোবাসার বিয়ে। ভালোবাসা খারাপ হলে তো নিশ্চয়ই আপনাদের মতো দুজন শিক্ষিত মানুষ ভালোবেসে সংসার গড়তেন না! তবে এখন কেন মেয়ের ভালোবাসার কথা শুনে এমন রিয়েক্ট করছেন?”

চমকের পালা যেন শেষই হচ্ছেনা সাদেক সাহেব, দিলশান আরা’র। লোক গুলো কেমন আসার পর থেকেই একের পর এক বুক কাঁপানো আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে! সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, ওনারা এটা জানল কিভাবে যে তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছে? সাদেক সাহেব, দিলশান আরা তো কখনো এই কথাটা নিজের ছেলে-মেয়ের কান পযর্ন্ত পৌঁছাতে দেয়নি। ওনাদের পৈত্রিক ভূমি ময়মনসিংহের তারাকান্দা গ্রামের হাতে গুণা কয়েকজন মানুষ ছাড়া তো এই কাহিনী শহরের কেউ জানেনা। বহু বছর আগেই সেই অতীত গ্রামে ফেলে জীবিকার তাগিদে আর অল্প আয়েশী জীবনের আশায় ছুটে এসেছিল এই শহরে। তাহলে এই গোপন তথ্য কিভাবে জানল লোকগুলো! তবে কি ওনারা এখানে আসার আগেই সব খবরাখবর জেনেই এসেছে! রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত মানুষ গুলো এমনিতেই ধূর্ত হয়। এরা সর্বদা নিজেদের পাওয়ার খাটিয়ে অসম্ভবপ্রায় কাজকেও সম্ভব করে নেয় এক চুটকিতেই। তবে কি এবার এই মানুষ গুলোর ক্ষমতার কাছে নত হতে হবে তাদের? মেয়ের জন্য যে প্রস্তাব এনেছে মেনে নিতে হবে তা! কথা গুলো যত ভাবছে ততই অস্থির হয়ে ওঠছে দিলশান আরা। একটা মাত্র মেয়ে তাদের। সেই মেয়েটাকে কিছুতেই তারা রাজনীতি নামক নোংরা শব্দের সাথে জড়িত মানুষ গুলোর হাতে দিবেনা। তাছাড়া কোথায় তাদের বসবাস ময়মনসিংহ আর ছেলের বসবাস ঢাকার সাভারে! তারা না জানে ছেলে সম্পর্কে, আর না জানে ছেলের পরিবার সম্পর্কে। হুট করে মস্তিষ্কে ছেলের কথা স্বরণ হতেই তড়িৎ শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে তাকায় দিলশান আরা। মুখে দাড়ি-গোঁফ আর অপরিপাটি চুলের বেহাল অবস্থায় আপাত দৃষ্টিতে যে কেউ দেখলে প্রথমেই বলে দিবে,এলাকার বড় ভাই টাইপ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো গুন্ডা ধাচের ছেলে। বয়সটাও তো কম মনে হচ্ছেনা। কিন্তু মুখ ভর্তি দাড়ি আর মাথা ভর্তি এলোমেলো চুলের ভীরে লুকিয়ে থাকা শ্যাম পুরুষের সুডৌল চেহারাটা নজরে পরলে যে কোনো মেয়ে মুগ্ধ হতে বাধ্য, এই কথাটা মানতে হবে। তবে যায় হোক, কিছুতেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না। তাছাড়া এটাও বিশ্বাসযোগ্য না, দৃষ্টি নিজের থেকে এতো বড় একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে।

দিলশান আরা’র ভাবনা গুলোকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা রাগত স্বরে সাদেক সাহেব বলে ওঠেন,

“ফাজলামি করতে এসেছেন আমার বাড়িতে? আমরা কি করব না করব, আমাদের সন্তানেরা কি করবে না করবে সেটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারা যতই ক্ষমতাশীল মানুষ হয়ে থাকুন না কেন, কারো ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কেউ দেয়নি আপনাদের। দেখুন, আপনাদের মতো মানুষের সাথে আমার ঝামেলা করার কোনো শখ নেই। আমি অতি সাধারণ মানুষ সাধারণ ভাবেই জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। দয়া করে আমার পরিবারে জটিলতা সৃষ্টি করবেন না।”

“জটিলতা আমরা না আপনারা সৃষ্টি করছেন। একটা সহজ বিষয়কে সহজ ভাবে মেনে নিলেই তো সব মিটে যায়। কেন শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে বিষয়টাকে জটিল করছেন? তাছাড়া যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে দুজন দুজনকে ভালোবাসে সেখানে আপনারা কিন্তু কোনোভাবেই বাঁধা দিতে পারবেন না। কোনো ঝামেলা ছাড়া বিষয়টা মেনে না নিয়ে আইনি পদক্ষেপের দিকেও যদি যান তবে সেখানেও কিন্তু কোনো বাঁধা দিতে পারবেনা তারা। কারণ আপনাদের মেয়ে রাজি এই প্রস্তাবে। আর তার বয়স’ও বর্তমানে আঠারো ছাড়িয়েছে। এখন আর তার উপর নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবেননা। কোট-কাচারি করেও যখন লাভের লাভ কিছুই হবেনা তাই বলছি, আত্মীয়তার আগেই দুই পরিবারে তিক্ততার সৃষ্টি না করে বিষয়টা মেনে নিন। এতে সম্মান, সম্পর্ক দুটোই ঠিক থাকবে।”

এমপি মাজহারুল ইসলামের কথার ধরনে দৃষ্টির বাবা-মা এবার স্পষ্ট বুঝে যায় এরা সহজে দমার পাত্র না। আঁটঘাঁট সব বেঁধেই এসেছে। এক একটা কথার পিঠেই সু-স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে আইন’ও তাদের আশ্রয় দিবেনা। এবার যেন দিশেহারা দুজনেই। সর্বদা নিজের কঠোর ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে মাথা উচিয়ে চলা দিলশান আরা’র চোখে-মুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। সেই অসহায়, উস্থির চিত্তে তাকায় স্বামীর দিকে। সাদেক সাহেব নিজেও ভেবে পায়নি কি বলে দমাবে এদের। স্ত্রীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আদেশ ছুড়ে,

“দৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে আসো। যা শোনার ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই। বাইরের কোনো মানুষের থেকে নিজের মেয়ে সম্পর্কে কিছু শুনে বিশ্বাস করে নিব,এতোটাও অপদার্থ বাবা আমি না।”

সাহেক সাহেবের কথায় মনে মনে হাসে আজীজ শিকদার। নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শরীর নাড়িয়ে আরেকটু আয়েশ করে বসে। আমুদে কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে বলে,

“হ্যাঁ তাই করুন। মেয়ের মুখ থেকে সবটা শোনার পর আশা করি আপনারা কোনো আপত্তি করবেন না।”

সন্দেহের পালাটা যেন ধীরে ধীরে সত্যি হবার সংকেত দিচ্ছে। দিলশনা আরা সাদেক সাহেব এই পর্যায়ে নিজের মেয়েকে নিয়েই সন্দিহান হয়। লোকটা যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে দৃষ্টির থেকে জানার কথা বলছে এতেই প্রমাণ হয়ে যায় ওনারা যা বলছে তা পুরোটাই সত্য। এই কথা শোনার পর রক্তিম নিজেও ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়। ঐ বেশরম মেয়ে যেভাবে রাস্তা-ঘাটে তাকে ভালোবাসার কথা জানান দেয় সেভাবে যদি এখানেও সবার সামনে বলে দেয়! তবে সব শেষ। আজীজ শিকদারকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা আর। ফের ঐ আগুনে ঝাপ দিতে হবে তাকে।

নিজের রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সবটাই শুনছিল দৃষ্টি। দিলশান আরা মেয়েকে ডাকতে এসে তাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে। তবে ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্ত ভাবে আহবান জানায় ড্রয়িং রুমে যাওয়ার জন্য। দুরুদুরু মনে চুপচাপ মায়ের পিছন পিছন ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। আগে থেকেই জানত সে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তবে তখন এটা জানতনা সেই পরিস্থিতি যে তাকে এতোটা ভিতু করে দিবে। বুকটা কেমন ধরফর করছে। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে। দৃষ্টি উপস্থিত হতেই আজীজ শিকদার অভয় দিয়ে বলে,

“মা! কোনো ভয় পেয়োনা। তুমি সরাসরি নির্ভয়ে তোমার মনের কথা বলো। তুমি কি আমার ছেলেকে ভালোবাসো? বিয়ে করতে চাও ওকে! যদি চাও তবে তোমার মা-বাবার কাছে বলে দাও। বাকীটা আমি সামলে নিব।”

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্পাত কঠিন মুখের মানুষটার দিকে এক পলক তাকায় দৃষ্টি। যে মানুষটাকে প্রথম দেখায় মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে অষ্টাদশী দৃষ্টি। এতো করে ভালোবেসেও পাষাণ মানুষটার মনে নিজের জন্য একটু মায়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। তবুও তাকে পাওয়ার জন্যই কিশোরী প্রাণ ব্যাকুল আজও। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে মা-বাবার দিকে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় তারাও উৎসাহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উপস্থিত প্রতিটা মানুষ ব্যকুল হয়ে আছে দৃষ্টির মুখের একটা কথা শোনার জন্য। যে কথাটা এক পক্ষকে জিতিয়ে দিতে পারলেও হারিয়ে দিবে অপরপক্ষকে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নেয় দৃষ্টি। বুকে অদম্য সাহস যুগিয়ে বলে দেয় মনের কথা। নিজেকে প্রমাণিত করে আরও একবার বেহায়া হিসেবে। একটু ভালোবাসার লোভে ভেঙ্গে চুড়মাড় করে দেয় মা-বাবার আশা ভরসা।

“হ্যাঁ। আমি রক্তিম শিকদারকে ভালোবাসি। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমার ভালোবাসার সুন্দর একটা পরিণয় চাই আমি।”

নিজের কথাটুকু শেষ করার আগেই স্বপাটে চড় বসিয়ে দেয় দিলশান আরা। আকস্মিক এতো গুলো মানুষের সামনে মায়ের থেকে থাপ্পড় খেয়ে স্তব্দ হয়ে যায় দৃষ্টি। গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। দিলশান আরার হঠাৎ এমন আক্রমণে রক্তিম সহ উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বিস্মিত। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আজীজ শিকদার। গলা উচিয়ে বলে,

“এতো গুলো মানুষের সামনে কিভাবে আপনি এতো বড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেন? এই আপনি একজন কলেজের সম্মানিত প্রভাষক? আপনার থেকে এমন কিছু আশা করা যায়না আপা।”

অত্যধিক রাগে-ক্রোধে অন্ধ দিলশান আরা। এতো দিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা সম্মান অহংকার সবটাই মনে হয় মেয়ে নিজের ভালোবাসার কথা জাহির করে শেষ করে দিয়েছে। অধিক রাগে কাঁপছে দিলশান আরা। হাত উচিয়ে আজীজ শিকদারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“একদম চুপ থাকবেন আপনি। আমার মেয়েকে আমি মা র ব না কে টে টু ক রো টু ক রো করে নদীতে ভাসিয়ে দিব সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার বাসা থেকে এক্ষুণি বেড়োবেন আপনারা। নইলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।”

“ডাকুন পুলিশ। দেখি কোন আইন আপনার সাপোর্ট করে। ভুলে যাবেন না এখন আপনার মেয়ে সাবালিকা। তাকে শাসন করতে গিয়ে ভালোবাসা জাহির করার অপরাধে অপশাসন করতে পারেন না। ।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় আঠারোই হলো অধিকার দাবি করে মাথা তোলার সময়। আপনার মেয়ে এখন নিজের যেকোন বিষয়ে নিজেই মতামত নিতে পারবে। হোক সেটা ভালোবাসা-বিয়ে কিংবা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে। আইন অনুযায়ী তা বৈধ। বাবা-মা হিসেবে এখন আপনাদের সন্তানের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। যদি না দিন তবে সেটাই হবে আইনবিরূদ্ধ। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে আশা করি এই ধারণা টুকু আপনাদের আছে।”

এক কথা দুই কথা হতে হতে কিছুক্ষণের মাঝেই দৃষ্টি হয়ে যায় বিড়াট এক ঝামেলা। যে ঝামেলার নিরব দর্শক দৃষ্টি, রক্তিম, মেহেদী। বহু কথা কাটাকাটির পর আজীজ শিকদার নিজ তাগিদে থানা-পুলিশ করতেও পিছুপা হয়না। অবশেষে আইন, নীতি আর মেয়ের মুখের একটা বয়ান হার মানতে বাধ্য করে সাদেক-সাহেব দিলশান আরা’কে। বাবা-মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে এক সময় দৃষ্টি বদলে ফেলতে চায় নিজের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আজীজ শিকদার সেটা হতে দেয়না। দৃষ্টির হাবভাব দেখেই ধূর্ত মস্তিষ্ক বুঝে যায় তার মনোভাব। ঘটনা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে প্যাচিঁয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সেই মুহূর্তেই কাজী ডেকে ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক বিয়ের কার্যক্রম সমাপন করবে। ময়মনসিংহ থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সহ রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে দৃষ্টির মা-বাবা সকলের উপস্থিততে অল্প সময়ের ব্যবধানেই ইসলামের দৃষ্টিতে এক হয়ে যায় দৃষ্টি -রক্তিম। মাঝখানে যদিও রক্তিম নিজেও ভেজাল করতে চেয়েছিল কিন্তু আজীজ শিকদার নিজের সুপ্ত মস্তিষ্কের ধূর্ত চালে সামলে নেয় সবটা। নিজের ছেলের নিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের আশায় জীবনে প্রথম জয় ছিনিয়ে আনে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এতো গুলো মানুষের উপস্থিতি, তর্কবিতর্কে পুরোটা সময় একটা ঘোরের মাঝে ডুবে ছিল দৃষ্টি। কবুল বলার সময় টুকুতেও শুধু কাজির কথায় কলের পুতুলের মতোই মুখ ফুলে পরপর তিনবার শব্দটা উচ্চারণ করে আপন করে নেয় ভালোবাসার মানুষটাকে। পুরো ঝামেলা শেষ হতে হতে দিন পেরিয়ে রাত গভীর হয়। সে রাতেই পুত্রবধূ সমেত বিদায় নিতে প্রস্তুত হয় আজীজ শিকদার। বিদায় শব্দটাও কর্ণগোচর হবার পরও সচল হয়না দৃষ্টির মস্তিষ্ক। তবে শেষ সময়ে এসে মায়ের কথায় ঘোর কাটে দৃষ্টির। শক্ত চোয়ালে বুকে পাথর চেপে দিলশান আরা মেয়েকে বলেন,

“ভালোবাসার মানুষকে চেয়েছো। বাবা-মায়ের সম্মানের বলি দিয়ে সেটা ছিনিয়ে নিয়েছো। বাবা-মায়ের সম্মান, ভালোবাসার থেকেও যখন নিজের ভালোবাসা তোমার কাছে বেশি প্রিয় মনে হয়েছে, তবে জেনে রেখো। ঠিক যে মুহূর্তে মুখে কবুল শব্দ উচ্চারণ করে ঐ ছেলেকে স্বামী হিসেবে মেনেছো। সেই মুহুর্তেই আমি তোমাকে আমার মেয়ে হিসেবে মন থেকে বাদ দিয়েছি। ভুলে গিয়েছি আমার কোনো মেয়ে ছিল। আমরা যে তোমার বাবা-মা আশা করি তুমিও সেটা ভুলে যাবে। আজকের পর থেকে এই বাড়ির কারো সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।”

মায়ের কথা গুলো শেষ হতে না হতেই কান্নায় ভেঙে পরে দৃষ্টি। মেঝেতে লুটিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে চিৎকার করে বলে,

“আমি না হয় তোমাদের চোখে একটা ভুল করেই ফেলেছি। তাই বলে তোমরা আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবে? তুমি তো আমার মা! তুমি কিভাবে আমাকে এই কথা বলতে পারো? আমি তো শুধু আমার ভালোবাসাটুকুই চেয়েছি তোমাদের কাছে। এটা অন্যায়! আর কোনোদিন আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাইবনা। তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই চলব। তবুও আমাকে এতো বড় শাস্তি দিয়োনা প্লিজ।”

মেয়ের কান্নায় দিলশনার আরা না গললেও সাদেক সাহেব একটু নরম হয়। চোখে ভেসে ওঠে আজ থেকে তেইশ বছর আগে দিলশান আরাকে বিয়ে করে তিনি নিজেও ঠিক এভাবেই মায়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পরেছিল। বারবার আর্জি জানিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটাকে মেনে নেওয়ার। কিন্তু সেদিন কেউ তাদের মেনে নেয়নি। নববধূকে নিয়ে খালি হাতে পারি দিতে হয়েছিল এই অচেনা শহরে। সেদিন সাদেক সাহেবের মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে পাষাণ মা-বাবা বুঝি তার নিজের মা-বাবা।প্রকৃতির কি অদ্ভূত নিয়ম! আজ সেই তেইশ বছর আগের একই ঘটনা মনে হচ্ছে নিজের চোখের সামনে ঘটছে। নিজের জায়গায় দেখতে পাচ্ছেন মেয়েকে আর বাবা-মায়েয জায়গায় নিজেকে। আচ্ছা! সেদিন যে সাদেক সাহেব ওনার বাবা-মাকে পৃথিবীর শ্রেষ্টা পাষাণ বাবা-মা বলে মেনে নিয়েছিল। আজ কি তবে তার মেয়েটাও তাকে সেই কাতারে ফেলল তাদের! ফেলে আসা সেই দিনটার কথা স্বরণ হয়েই যেন সাদেক সাহেব একটু নরম হয়। ভরসার একটা হাত বাড়িয়ে দেয় মেঝেতে বসে ডুকরে কাঁদতে থাকা মেয়ের মাথায়। তড়িৎ কান্নার বেগ কমে দৃষ্টির। মেঝে থেকে নজর সরিয়ে উপরে তাকায়। দেখতে পায় বাবা নামক বট বৃক্ষটা আজ এতো কিছুর পরও কি সহজে তার মাথার উপর ছায়া দিচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে আবারও ডুকরে ওঠে দৃষ্টি। অস্ফুট স্বরে ডাকে, “আব্বু!” বেদনা মিশ্রিত অল্প হাসেন সাদেক সাহেব। মেয়েকে টেনে মেঝে থেকে তুলে আগলে নেয় দুই-হাতে। বলে,

“যা চেয়েছো পেয়েছো। এবার বাবা হিসেবে আমার একটাই চাওয়া। সুখে থাকো। মায়ের কথায় কষ্ট পেয়োনা। একটু বেশি রাগ হয়েছে তো তাই এমন বলেছে। রাগ পরলে ঠিকই সবটা মেনে নিবে।”

বিভিন্ন কথায় মেয়েকে শান্ত করে এগিয়ে যায় আজীজ শিকদারের দিকে। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই রক্তিম বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। তাকে না পেয়ে আজীজ শিকদারের হাতেই তুলে দেয় আদরের একমাত্র মেয়েকে।

“ভাই সাহেব! যা হবার তা তো হয়েই গেছে। মানুষের জীবনে এরকম ছোট বড় কত ঘটনাই ঘটনা। ঐসব মনে রাখবেন না দয়া করে। সম্পর্ক যেহেতু একটা হয়েই গেছে তখন না হয় সব ভুলে নতুন করে সম্মানের সাথে মেনে নিলাম সবটা। আসলে আমারই ভুল হয়েছে। আগেই যদি মেয়ের কথা মেনে তার সুখেই সুখী হয়ে সবটা মেনে নিতাম তবে এতোটা ঝামেলা হতনা। সেইজন্য আমি লজ্জিত। ক্ষমা করবেন আমাকে। সেই সাথে একটাই অনুরোধ। আমি আপনার ছেলের ভরসায় না। আপনার ভরসায় আমার মেয়েকে আপনাদের সাথে দিচ্ছি। জানিনা আমার মেয়ের ভালোবাসা কতটা ঠিক বা ভুল। তবে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন যে কখনো ভুল হয়না সেটা জানি। আমি আশা রাখব সেই পবিত্র সম্পর্কের জোরেই আমার মেয়ে আপনার ঘরে সুখে থাকবে। আপনি আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করেই আগলে রাখবেন। কখনো কোনো ভুল করলে বাবা হিসেবে শাসন করবেন। আর যদি কখনো বোঝা মনে হয় তবে কষ্ট করে আমাকে একটা খবর দিবেন। আমি আমার মেয়েকে অতি আদরে আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে আসব।”

আজীজ শিকদারের মুখে জয়ের হাসি। তবে বিয়ে শেষ হতেই ছেলেটা এভাবে চলে যাওয়ায় একটু বিব্রতও হচ্ছেন। এতো ঝামেলার পর ছেলেটার এমন ব্যবহারে না জানি দৃষ্টির মা-বাবার মনে কেমন ধারণা তৈরী হয়েছে! কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব ভেবে কিছু হবেনা। সেদিক থেকে ভাবনা সরিয়ে নিজেও সাদেক সাহেবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় পুরো ঘটনার জন্য। এরপর আশ্বস্ত করেন দৃষ্টিকে তিনি সবসময় নিজের মেয়ের মতোই রাখবেন। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দিবেননা। অবশেষে বাবার থেকেই অল্প শান্তনা আর অফুরন্ত দোয়া নিয়ে পা বাড়ায় দৃষ্টি নতুন জীবনে। সে জীবনে দৃষ্টির জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করে আছে জানা নেই তার। রক্তিম আদও তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে কি না তাও জানা নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে শুধুমাত্র ভালোবাসা পুঁজি করেই অগ্রসর হয় দৃষ্টি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে