#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৩
#আদওয়া_ইবশার
মিষ্টি এক সকাল। বাতাসে হালকা শীত শীত আমেজ। শৈত্যপ্রবাহ খুব বেশি দূরে না। এইতো আর কিছুদিন। হেমন্ত মশাই এখনই তল্পিতল্পা গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদায় নেবার। তার বিদাইয়ের খুশিতে শীত মহাশয়’ও ধুমধাম প্রস্তুতি নিচ্ছে নাইয়োর আসার। মানুষজনকে এখনই সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে জানিয়ে দিচ্ছে তার আগমনী বার্তা। সকাল সকাল দৃষ্টি বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে কাওকে কিছু না বলেই। উদ্দেশ্য আজীজ শিকদারের পার্টি অফিস। ভেবেছিল সকাল সকাল নিশ্চিন্তে নিজের কাজ সমাপন করে বাসার কেউ তার অনুপস্থিতি বোঝার আগেই আবার ফিরে যাবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে এতো তাড়াতাড়িই করে ফেলেছে যে,পার্টি অফিসে এখনো তালা ঝুলছে। নেতা আসার আগেই দুয়ারে জনতা এসে হাজির। কতক্ষণ অফিসের সামনে চিন্তিত বদনে পায়চারি করে কাটিয়ে দেয় দৃষ্টি। কাটায় কাটায় ঠিক দশটা বাজতেই দূর থেকে দেখতে পায় কয়েকজন লোক এদিকেই এগিয়ে আসছে। মুখ গুলো দৃষ্টি গতকাল সমাবেশে দেখেছে। তাই আর চিনতে অসুবিধা হয়নি ওনারা এই পার্টি অফিসের লোক। দ্রুত পায়ে কিছুটা আড়ালে সড়ে দাঁড়ায় দৃষ্টি। লোক গুলো অফিসে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই সেখানে উপস্থিত হয় আজীজ শিকদার। সাথে রক্তিম শিকদার নেই দেখে একটু আশ্বস্ত হয় দৃষ্টি। চট করে বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে। দ্রুতগতিতে দুই,তিন পা এগিয়ে আবার থেমে যায় অজানা এক সংকোচে। নিজ মনেই ভাবে কাজটা কি তার ঠিক হচ্ছে? একটু বেশিই কি পাগলামি হয়ে যাচ্ছেনা! পরোক্ষনে আবারও নিজ মনেই ভাবে, ভালোবাসা আর যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য সব করা যায়। এই দুটো জায়গায় ভয়, লজ্জা, সংকোচ থাকলে কখনো জয়লাভ করা যায় না। মন থেকে সমস্ত ভাবনা ঝেড়ে মাথা ঝাকায় দৃষ্টি। বুক ফুলিয়ে দম নেয় দীর্ঘক্ষণ। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে হালকা করে। মনে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে যায় অফিসের প্রবেশদ্বারে। দরজার সামনে যেতেই আটকে দেয় একজন। ঘাবড়ে যায় দৃষ্টি। প্রায় আজীজ শিকদারের বয়সী একজন লোক দরজায় হাত ঠেকিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। জানতে চায়,
“কি ব্যাপার! কি চায় এখানে?”
একটু অপ্রস্তুত দেখায় দৃষ্টিকে। কি বলবে ভেবে পায়না। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“জ্বি মানে! আজীজ শিকদারের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
কিছু একটা ভেবে আবারও প্রশ্ন করে লোকটা,
“আজীজ শিকদারের কাছে কি দরকার?”
ঠিক তখনই ভিতর থেকে কোনো এক পুরুষালী গলা শুনতে পায় দৃষ্টি। বলছে,
“কি ব্যাপার জাফর ভাই! কার সাথে কথা বলছেন? কে এসেছে?”
তৎক্ষণাৎ দৃষ্টির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা উত্তর দেয়,
“একটা মেয়ে এসেছে। বলে কি না আপনার সাথে দেখা করবে।”
কথাটা শুনতে পেয়ে আজীজ শিকদার নিজেই বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে সালাম দেয় দৃষ্টি। হাসি মুখে সালামের জবাব দেয় আজীজ শিকদার। দুই পা এগিয়ে এসে স্বহাস্যে জানতে চায়,
“বলো মা! আমার কাছে কি দরকারে এসেছো তুমি?”
কন্ঠে একটু অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করে দৃষ্টি বলে,
“আপনার সাথে আমার একটা জরুরী কথা ছিল স্যার। যদি অনুমতি দিতেন তবে বলতাম!”
মেয়েটার এতো নম্র আচরণ দেখে মুগ্ধ হয় আজীজ শিকদার। অভয় দিয়ে বলে,
“আচ্ছা! যা বলার বলো। কিন্তু এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে লোকে মন্দ ভাববে। নির্ভয়ে তুমি ভিতরে এসে আমার সাথে বসে সবটা বলতে পারো,
আজীজ শিকদারের সাবলীল আচরণে দৃষ্টির এতোক্ষণের অস্বস্তিটা যেন কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়। প্রফুল্ল চিত্তে আজীজ শিকদারের পিছন পিছন ভিতরে গিয়ে মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে। একবার পুরো রুমটাতে নজর বুলিয়ে দেখে নেয় মানুষজনের উপস্থিতি। আজীজ শিকদার সহ ইতিমধ্যেই সাত-আটজন চলে এসেছে। এতো গুলো মানুষের সামনে কথাটা বলতে একটু অস্বস্তিদায়ক অনুভূতি হলেও জড়তা ভেঙ্গে বলে দৃষ্টি,
“আপনার কাছে আমার একটা আবদার আছে স্যার।”
“কি আবদার?”
জানতে চায় আজীজ শিকদার। দৃষ্টি আবারও বলে,
“আপনি তো এবার এমপি পদে নির্বাচন করছেন! প্রায় সব জনগণের দুঃখ-কষ্ট দেখে ওনাদের আশ্বস্ত করেছেন নির্বাচিত হবার পর সব সমস্যার সমাধান করবেন। একজন সাধারণ জনগণ হিসেবে আমারও আপনার কাছে একটা আবদার আছে। যদিও আমি আপনার এলাকার ভোটার না। এমনকি এখনো কোনো এলাকারই ভোটার হয়নি। তবে আমার খালার বাসা এখানে। আপনি যদি আমার আবদারটা রাখেন তবে আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আমার খালামনির বাসার সব গুলো ভোট পাইয়ে দিব।”
দৃষ্টির এমন কথায় একটু অবাক হয় আজীজ শিকদার। মেয়েটাকে দেখে ওনি প্রথমেই একটু হলেও বুঝতে পেরেছিল একটা চঞ্চল পাখি। তবে প্রথম দিকের একদম নম্র আচরণ দেখে আবার মনে হয়েছিল মেয়েটা একদম শান্তশিষ্ট। এখন আবার কথা শুনে মনে হচ্ছে চঞ্চলা হরিণী। একেক সময় একেক রকম মনে হচ্ছে। ভাবনায় পরে গেছেন আজীজ শিকদার মেয়েটাকে ঠিক কি বলে আখ্যায়িত করবেন! দৃষ্টিকে নিজের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের ভাবনাটা এক পাশে রেখে আবারও হেসে জবাব দেন আজীজ শিকদার,
“আচ্ছা! আগে বলো শুনি তোমার কি আবদার। যদি সাধ্যের মাঝে হয় তবে অবশ্যই রাখব।”
“না না! আগে বলা যাবেনা। আবদারটা খুব বেশি কিছু না। অবশ্যই আপনার সাধ্যের মধ্যেই। আপনি আগে কথা দিন আমার আবদার রাখবেন তবেই আমি বলব।অন্যথায় বলার পর যদি আপনি না রাখেন তবে আমি খুব কষ্ট পাব।”
দৃষ্টির কথার ধরনে শব্দ করে হেসে ফেলেন আজীজ শিকদার। দলের অন্য লোক গুলোর মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে কাজ ফেলে বাচ্চা এক মেয়ের সাথে নেতার এমন খোশগল্পে তারা বিরক্ত। তবে সেদিকে দৃষ্টি বা আজীজ শিকদার কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
“আচ্ছা রাখব। এবার বলো শুনি কি আবদার!”
এবার একটু নড়েচড়ে বসে দৃষ্টি। আবারও উপস্থিত সকলের দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে নেয় সকলকে। পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নেয়। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে একদমে বলে,
“আমি আপনার ছেলে রক্তিম শিকদারকে ভালোবাসি। কিন্তু আপনার বদরাগি ছেলে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্যই দিচ্ছেনা। সে কখনো বুঝতেই চায়না আমার অনুভূতি গুলোকে। নিরুপায় হয়ে এখন আপনার কাছে এসেছি আমি। আমার আবদারটা হলো আপনি যদি এমপি পদে জিততে পারেন তবে আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিবেন। দয়া করে এখন আবার আমাকে ভুল বুঝে আপনার ছেলের মতোই দূর দূর করবেন না। আমার এই আবদার আপনাকে রাখতেই হবে।”
কি বলবে আজীজ শিকদার! নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে একদম স্তব্ধ। শুধু আজীজ শিকদার একা না। উপস্থিত প্রতিটা মানুষেই বাকরুদ্ধ। একটু আগে যেন দৃষ্টি কোনো আবদার রাখেনি। সরাসরি একটা বো মা ফাটিয়েছে পার্টি অফিসে। যার কবলে পরে প্রত্যেকেই অনুভূতিশূণ্য জড়বস্তুর ন্যায় ঠাই বসে আছে নিজ নিজ জায়গায়। পাঁচ মিনিট, মিনিট। ঠিক এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে কতক্ষণ হয়েছে সেদিকে কারো খেয়াল নেয়। দৃষ্টি নিজেও সাহস জুগিয়ে ফট করে কথা গুলো বলে দিলেও এখন ভয়, লজ্জায় জড়োসড়ো। মাথা নিচু করে খিঁচে চোখ বন্ধ রেখে কলিজা ফাটানো একটা ধমক খাবার অপেক্ষায়। তবে দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে কানে পৌঁছায় আজীজ শিকদারের শান্ত গলা,
“তোমার নাম কি মা?”
মাথাটা কিঞ্চিৎ উচু করে এক পলক তাকায় আজীজ শিকদারের মুখের দিকে। পরপর আবারও নিচু মস্তকে মিনমিনে স্বরে জবাব দেয়,
“দৃষ্টি। দৃষ্টি মেহেজাবিন।”
“বাড়ি কোথায়?”
“ময়মনসিংহ। বাবা সাদেক দিলোয়ার। মা দিলশান আরা। আমরা দুই ভাই বোন। আমি এবার ভার্সিটি এডমিশন দিয়েছি। আপাতত রেজাল্টের অপেক্ষায়। আর আমার ভাই দিহান সে ক্লাস ফাইভ এর স্টুডেন্ট।”
এক নাগাড়ে কথা গুলো গড়গড় করে বলে থামে দৃষ্টি। আবার এক পলক আজীজ শিকদারের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
“আপনি হয়তো আবারও আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতেন। তাই আগেই বলে দিয়েছি সবকিছু। কিছু ভুল করে থাকলে স্যরি।”
আজীজ শিকদারের থমথমে মুখে এবার একটু হাসি দেখা দেয়। আবারও প্রশ্ন করেন,
“বয়স কত তোমার।”
“কিছুদিন আগেই আঠারো হয়েছে।”
“আর আমার ছেলের বয়স কত জানো?”
দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে না জানায় দৃষ্টি। একটু চুপ থেকে আজীজ শিকদার বলেন,
“এই ডিসেম্বরে ত্রিশ পূর্ণ করে একত্রিশে পা রাখবে। তোমার থেকে গুণে গুণে বারো বছরের বড়।”
এরপর আরও একটু থামে। গভীর একটা নিশ্বাস নিয়ে স্বরণ করিয়ে দেয় নির্মম এক সত্য,
“তাছাড়া সবথেকে বড় কথা আমার ছেলে বিবাহিত। পাঁচ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় ওর স্ত্রী মা রা গেছে। এখন তুমি বলো। রক্তিম বিবাহিত। তোমার আগেই তার জীবনে এক নারীর আগমন ঘটেছে। হয়তো সে এখন পৃথিবীতে নেই। তবে তাকে ঘিরে যে স্মৃতি গুলো তৈরি হয়েছিল সেগুলো এখনো তাজা। যে পুরুষের সবটা জুড়ে তোমার আগে অন্য এক নারীর বসবাস ছিল তাকে তুমি মানতে পারবে?আর তোমার পরিবার! তারা কখনো তোমার মতো এতো অল্প বয়সী সুন্দরী একটা মেয়েকে কখনো আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে? তোমার বয়সটা অল্প মা। এই পৃথিবীর ভালো-মন্দ কিছুই এখনো জানোনা তুমি। আমি চাইনা তোমার মতো ফুটফুটে একটা চাঁদ আবেগপ্রবল হয়ে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে মৃ ত্যু র আগ পযর্ন্ত জীবন নিয়ে আফসোস করুক। তোমার জীবনটা মাত্র শুরু। এখনই ঠিক-ভুল কোনো কিছু বিচার না করে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবেনা।”
সম্পূর্ণ কথা গুলো অত্যন্ত মনযোগ সহকারে শুনে দৃষ্টি। কিয়ৎক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে মাথা উচু করে বলে,
“আমি আপনার ছেলের অতীত সম্পর্কে প্রথম থেকেই সব জানি স্যার। আমার ঐসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কারণ যা ছিল তা অতীত। অতীত ধরে বসে থাকলে আমাদের চলেনা। তবুও যদি ওনার স্ত্রী বেঁচে থাকতো আর যদি ওনারা সেপারেশনে থাকত আমি তবুও আপনার ছেলের পিছু ঘুরতাম না এটা ভেবে যে, হয়তো কোনো একদিন দুজন সব ভুলে আবার এক হতে পারে। কিন্তু এখন তো সে সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এসব জেনে বুঝে কখনো কারো প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়না স্যার। বয়স ভেদেও কখনো ভালোবাসা আসেনা। আমি শুধু জানি আমি আপনার ছেলেকে ভালোবাসি। এবং সেই ভালোবাসার গভীরতা ঠিচ কতটুকু হলে একটা মেয়ে এভাবে নির্লজ্জের মতো সেই ছেলেটার বাবার সামনে বসে অকপটে সবটা স্বীকার করতে পারে একবার ভাবুন। আর বাকী রইল আমার পরিবারের কথা। আমার পরিবারের যদি মনে হয় ঐসব অতীত, সমাজ সম্পর্ক, বয়স এগুলোর ঊর্ধ্বে তাদের মেয়ের সুখ তবে অবশ্যই মানবে। আপনি শুধু বলুন আপনি আমাকে নিজের ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন কি না আর আপনার ছেলেকে মানাবেন কি না। বাকীটা আমার পরিবারের দিক সম্পূর্ণ আমি সামলে নিব।”
সর্বদা শান্ত মস্তিষ্কে সব কিছু সামাল দেওয়া আজীজ শিকদার এবারও শান্ত। নিজের একমাত্র বাউন্ডুলে ছেল কেন্দ্রিক এতো বড় একটা ঘটনার পরও যথেষ্ট শান্ত দেখাচ্ছেন তাকে। অল্প বয়সী একটা মেয়ে এভাবে সম্পূর্ণ নিয়ম নীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসার লোভে ছেলের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখছে। বিষয়টা উপস্থিত সকলের কাছে অষ্টম আশ্চর্য মনে হলেও আজীজ শিকদারকে এমন নির্লিপ্ত দেখে তারা আরও বিস্মিত। হজম হচ্ছেনা বিষয়টা কারো। দৃষ্টির মতো অন্য সবাই ভেবেছিল হয়তো মেয়েটাকে ধমকে বের করে দিবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। আজীজ শিকদার আবারও প্রমাণ দিল নিজের ধৈর্যের। এবং সব শেষে সবাইকে একদম অবাকতার চরম পর্যায় পৌঁছে দিয়ে বলল,
“আচ্ছে বেশ! তুমি যদি তোমার পরিবারকে মানাতে পারো আর আমার ছেলের সাথে সংসার করতে পারো। তবে আমি কথা দিচ্ছি, নির্বাচনের পর এই বিষয়ে রক্তিমের সাথে কথা বলব আমি।”
আজীজ শিকদারের কথাটা বলতে দেরি। কিন্তু দৃষ্টির ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির উল্লাসে এক ফালি হাসি উকি দিতে একটুকুও দেরী করেনি। বরং চিকন ঠোঁট দুটোর সাথে হেসে ওঠে নির্মল চোখ দুটোও। এক লাফে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেওয়ার মতো করে বলে,
“আমার শশুর সবার ভাই।”
অফিসে থাকা অল্প বয়সী ছেলে গুলো হয়তো এই আধ পাগল মেয়েটার এমন স্লোগানে মজা পায়। যার দরুন নিজেরাও মিটি মিটি হেসে বলে,
“আজীজ ভাই, আজীজ ভাই।”
চলবে……..
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৪
#আদওয়া_ইবশার
সময় বহমান। প্রতিটা সূর্যাস্তের সাথে গত হচ্ছে এক একটা দিন। দৃষ্টি, তুসীর ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তুসী বহু সাধনার পর নিজের জন্য একটা আসন জয় করে ফেলেছে। কিন্তু ব্যর্থ দৃষ্টি। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের জন্য আসন তৈরী করতে পারেনি। তবে এই নিয়ে দৃষ্টির মনে কোনো প্রকার আফসোস নেই। কিন্তু মেয়ে চান্স পায়নি এই নিয়ে সাদেক সাহেব আর দিলশান আরা’র আফসোসের অন্ত নেই। একই সমবয়সী দৃষ্টি তুসী দুজন খালাতো বোন। তুসীর বাবা সামান্য একজন সরকারি কর্মকর্তা আর মা গৃহিনী। আর দৃষ্টির বাবা ব্যবসায়ী মানুষ হলেও যথেষ্ট উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। মা একজন সরকারি কলেজের প্রভাষক। এই বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে গেলে আত্মীয়-স্বজন সবাই নিশ্চিত দিয়ে বলতো তুসী চান্স না পেলেও দৃষ্টি ঠিকই চান্স পেয়ে যাবে। কিন্তু হলো তার সম্পূর্ণ উল্টোটা। মেয়ের এই ব্যর্থতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দিলশান আরা। মেয়ে চান্স পায়নি এই দুঃখের থেকেও বড় দুঃখ কর্মস্থলের পরিচিতদের, আত্মীয়-স্বজনের সামনে মুখ দেখাবে কিভাবে? মেয়েটা যে শেষ মুহূর্তে এসে এতো বড় একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির মাঝে ফেলবে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি দিলশান আরা। চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরে আছে বিছানায়। বিকেলের দিকে দৃষ্টি দিহানকে সাদেক সাহেব গিয়ে নিয়ে এসেছে ঢাকা থেকে। বাড়িতে এসেই অপরাধি মুখে মায়ের সামনে উপস্থিত হয়েছিল দৃষ্টি। তবে মেয়ের সাথে একটা শব্দ পযর্ন্ত উচ্চারণ করেনি দিলশান আরা। কতক্ষণ মা’কে মানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি দিলশান আরা। বাবা কথা বললেও তার কথায় মন খারাপের লেশ ঠিক বুঝতে পেরেছে দৃষ্টি। দিহানটাও আসার পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। বাড়ির থমথমে পরিস্থিতি দেখে লাফালাফির সাহস পাচ্ছেনা।
নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে বুক ফুলিয়ে দম ছাড়ে দৃষ্টি। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য মনে মনে সম্পূর্ণ দায়ী করে রক্তিম শিকদারকে। ঐ পাতি নেতার চিন্তায় বিভোর থেকেই তো দৃষ্টির এডমিশন প্রস্তুতি খারাপ হয়েছে। হবে নাই বা কেন!সর্বক্ষণ মাথার মাঝে পোকার মতো ঘুরঘুর করেছে। এমনকি পরীক্ষার হলে গিয়ে পর্যন্ত ঐ গুন্ডাটার কথা ভেবেছে। এসবের মাঝে দৃষ্টির রেজাল্ট বড়সড় একটা লাড্ডু হবেনা তো কি হবে! পাষাণ পুরুষটা তার আলাভুলা মনটা কেড়ে নেবার পাশাপাশি শান্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। এরপরও তার প্রতি একটু দয়ার নজর দিচ্ছেনা। কোন আদলে গেলে দৃষ্টি ঐ পাষন্ড পুরুষটার অমানবিক আচরণের সুষ্ঠ বিচার পাবে?
গোটা একটা সন্ধ্যা কেটে যাবার পর রাতের খাবারের সময় গম্ভীর মুখাবয়বে মেয়ের দিকে তাকায় দিলশনা আরা। মায়ের ফোলা চোখ দুটো দেখে এবার একটু মন খারাপ হয় দৃষ্টির। সর্বক্ষণ সব কিছু নিয়ে দাম্ভিকতার চূড়ায় রানীর হালে বসে থাকা মা’টা যে তার এমন রেজাল্ট কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা বুঝতে পারে দৃষ্টি। অপরাধবোধে মায়ের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারেনা। মাথা ঝুকিয়ে তাকিয়ে থাকে প্লেটের দিকে। ক্ষণকাল পর শুনতে পায় মায়ের গম্ভীর্য আওয়াজ,
“পাবলিকে হয়নি তাই বলে এটা ভেবোনা আর কোনো চেষ্টা না করেই তোমাকে আমি সাধারণ কোনো কলেজে ভর্তি করিয়ে দিব। সাত কলেজের জন্য প্রস্তুতি নাও। এবার অন্তত আমার মান-সম্মানের দিকটা ভেবে হলেও পড়াই একটু মনযোগ দিয়ো।”
হতাশার একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে দৃষ্টির বুক চিড়ে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় নিরবে খেয়ে যাচ্ছেন সাহেব সাহেব। নিরব থেকেই যেন মেয়েকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ওনি নিজেও স্ত্রীর কথায় একমত। এই মানুষ দুটো আজীবন শুধু সম্মান আর টাকার পিছনেই ছুটল। একটাবার হয়তো কখনো ভাবেনি ছেলে-মেয়ে দুটো কি চায়। স্কুল,কলেজ এমনকি সাবজেক্ট পযর্ন্ত নিজেরা বাছাই করে দিয়েছে। একবারও এটা ভাবেনি তাদের চাপিয়ে দেওয়া সাবজেক্টে মেয়েটা কতটুকু পারদর্শী। উল্টো যদি নিজে থেকে কিছু বলতে যেতো তখন শুনিয়ে দিতো সেই চিরপরিচিত কথা, “বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায়না। আমরা যা করি তোমাদের ভালো ভেবেই করি।” দৃষ্টি বুঝেনা এই চাপিয়ে দেওয়া জিনিস গুলোতে তারা সন্তানের ভালো কোথায় খোঁজে পায়! তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। কারণ জানে সে মুখে একটা কথা উচ্চারণ করলে সেটা নিয়ে পরবর্তীতে বাবা-মায়ের মাঝে তর্কবিতর্ক এক পর্যায়ে ঝগড়ায় রূপ নিবে। তার থেকে ভালো চুপ থাকা।
****
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন আজ। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে নির্বাচনী আমেজ। প্রতিটা কেন্দ্র থেকে শুরু করে রাস্তায় রাস্তায় আইন শৃংখলা বাহিনী টহল দিচ্ছে। সকলের একটাই আশা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হোক ভোটদান। সুষ্ঠ একটা নির্বাচন হোক। রক্তিম সহ তার দলের সকল ছেলেরা প্রতিটা কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখছে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কি না। তবে এখন পযর্ন্ত সব ঠিকঠাক। নিয়মতান্ত্রিক ভোটদান চলছে প্রতিটা কেন্দ্রে। লিয়াকত বিল্লার লোকজন এখন পযর্ন্ত কোনো ব্যঘাত ঘটায়নি। বিষয়টা রক্তিমের কাছে ঠিক লাগছেনা। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। ২ নং ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে এসব নিয়েই ভাবছিল রক্তিম। ঠিক তখনই মেহেদী এসে উপস্থিত হয়। রাস্তার এক পাশে বাইক রেখে চিন্তিত মুখে অগ্রসর হয় রক্তিমের দিকে। মেহেদীর চিহ্নিত মুখ দেখে রক্তিম নিজেও একটু চিন্তিত হয়। জানতে চায়,
“ঐদিকে সব ঠিকঠাক? না কি কোনো ভেজাল করেছে?”
“আপাতত সব শান্ত। কিন্তু চিন্তার বিষয় তো এটাই। তোর কি মনে হয় লিয়াকত বিল্লা এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ! যে একটা হাঁচি দিতে গেলেও নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে সে কি না নির্বাচনের দিন গুহাই বসে আছে! আর ঐ শু’য়’র মাসুম বিল্লাও ভ্যানিস।”
এতোক্ষন নিরবে যা নিয়ে ভাবছিল সেই একই চিন্তা মেহেদীর মাথায়। ডান হাতে ঘন দাড়িতে আবৃত গাল চুলকে রক্তিম বলে,
“ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতি শান্তই থাকে। সবাইকে সচেতন থাকতে বল। শা’লা কা পু রু ষে র জাত কা পু রু ষ। এদের কাজই হলো পিছন থেকে ছুরি মা রা।”
রক্তিমের কথায় সম্মতি জানায় মেহেদী। মাথা ঝাকিয়ে বলে,
“হয়তো ভেবেছে প্রথমে শান্ত থেকে আমাদের বুঝাবে কোনো ঝামেলা করবেনা। এটা নিশ্চিত হয়ে যখন আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব তখনই হামলে পরবে। শা লা র এতো বুদ্ধি থাকে কোথায়?”
এই প্রেক্ষিতে আর কিছুই বলেনা রক্তিম। ভাবুক হয়ে জানতে চায়,
“ধামসোনা ইউনিয়নের দিকে কারা কারা আছে? ঐদিকে কিন্তু ভোটার বেশি। সব ঠিকঠাক আগাচ্ছে কি না খোঁজ নে।”
***
বিকেল চারটা পযর্ন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের পর এখন একে একে সকল কেন্দ্রে ভোট গণনা চলছে। আস্তে আস্তে একেক কেন্দ্র থেকে ফলাফল প্রকাশ পাচ্ছে। এক কেন্দ্রে একজন জয়ী হলে অপর কেন্দ্রে হচ্ছে অন্যজন। সঠিক খবর এভাবে জানা সম্ভব না। যতক্ষণ পযর্ন্ত মোট ভোট গণনা শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পযর্ন্ত কিছুই বলা যাচ্ছেনা। তুমুল উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তার সাথে পার হচ্ছে প্রতিটা সেকেন্ড। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। নির্বাচন অফিসের সামনে খোলা জায়গায়, স্কুল মাঠে, কলেজ মাঠে প্রতিটা খোলা জায়গায় ভীর জমিয়েছে সকল দলের লোকজন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা সময় প্রকাশিত হয় ফলাফল। পাঁচ লক্ষ পয়তাল্লিশ হাজার সাতশত শুরুটি ভোটের মধ্যে তিন লক্ষ একুশ হাজার ছয়শত তিরাশি ভোট পেয়ে জয় লাভ করেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজীজ শিকদার। অন্যদিকে ক্ষণকালীন সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী লিয়াকত বিল্লা পেয়েছে এক লক্ষ বাইশ হাজার নয়শত নিরানব্বই ভোট। বাকি ভোট গুলো পেয়েছে অপজিট তিন দলের প্রার্থীরা।
ফলাফল ঘোষণার পরপরই উল্লাসে মেতে ওঠে আজীজ শিকদারের দলের লোকজন। রাকিব, শান্ত, জাবির সহ দুই-একজন মিলে আজীজ শিকদারকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। ছেলেদের এমন পাগলামিতে মুচকি হাসে আজীজ শিকদার। চোখে-মুখে প্রাপ্তির উচ্ছাস নিয়ে তাকায় দূরে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। পাষাণ হতে হতে ছেলেটা এতোটাই পাষাণ হয়ে গেছে যে এতো বড় একটা জয়ের পরও কেমন শান্ত স্থির নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে আছে সকলের অলক্ষ্যে। আজীজ শিকদারের দৃষ্টি লক্ষ্য করে মেহেদী তাকায় সেদিকে। এগিয়ে গিয়ে মুখে হাসি নিয়ে কাঁধ চাপড়ে বলে,
“কি রে বেটা! জিতে গেলি তো। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মিষ্টির অর্ডার দে তাড়াতাড়ি।”
“হার-জিতের কিছুই তো এখনো হয়নি। খেলা সবে শুরু। ভুলে গেছিস ঠিক কোন উদ্দেশ্যে মেয়র সাহেবকে এমপি বানালাম? তাছাড়া আমার কাছে কিছুই ঠিক লাগছেনা। দেখিস নি ফলাফল জানার পরও কেমন শান্ত ভঙ্গিতে জায়গা ছাড়ল লিয়াকত বিল্লা। নিশ্চিত কোনো না কোনো নিরব ফাঁদ পেতে রেখেছে।”
“কিন্তু কি সেটা?”
মুখ থেকে হাসি সড়িয়ে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে মেহেদী। তার এমন বোকার মতো প্রশ্নে কপাল কুঁচকায় রক্তিম,
“সেটা জানতে পারলে কি এখনো এভাবে বসে থাকি? তুই যেখানে আমিও সেখানে। তবে জানব কিভাবে ঐ শা লা কোন ফাঁদ পেতেছে? না কি আমি তার মেয়ের জামাই যে আমাকে সব বলে দিবে!”
ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসে মেহেদী। মাথা ঝাকিয়ে বলে,
“দেখ ভাই!শুধু শুধু ঐ দৃষ্টি নামের বাচ্চা মেয়েটার মন ভেঙ্গে লিয়াকত বিল্লার ডা ই নি মেয়ের দিকে নজর দিস না। পরে দেখা যাবে বাচ্চা মেয়েটার অ ভি শা পে বাসর রাতেই লিয়াকত বিল্লার ডা ই নি মেয়ে তোর রক্ত চু ষে খাবে।”
হুট করে দৃষ্টির প্রসঙ্গ আসতেই বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে মনে মনে এও ভাবে আজ কিছুদিন যাবৎ মেয়েটা একদম বিরক্ত করছেনা তাকে। এমনকি চোখের সামনেও আসছেনা। আধ পাগল মেয়েটার আবার কোনো বিপদ হলো না তো! রক্তিমকে নিশ্চুপ দেখে মিটিমিটি হাসে মেহেদী। টিটকারি মেরে বলে,
“কি রে! বাসরের কথা শুনে আবার কল্পনা করা শুরু করে দিয়েছিস না কি? তা সেই কল্পনার বাসরে তোর সাথে বউ সাজে কে? দৃষ্টি!”
চলবে…