#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১১
#আদওয়া_ইবশার
সারাদিনের দৌড়-ঝাপের পর ঘরে ফিরে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় রক্তিম। উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। মেহেদী হাতে থাকা খাবারের প্যাকেটটা টেবিলের এক কোণে রেখে নিজের গা থেকে ঘার্মাক্ত শার্ট ছাড়াতে ছাড়াতে জিজ্ঞেস করে রক্তিমকে,
“শুয়ে পরলি যে! খাবি না?”
“খিদে নেই। তুই খেয়ে নিস।”
চোখ বন্ধ রেখে ওভাবেই শুয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে জানিয়ে দেয় রক্তিম। ভ্রু কুঁচকায় মেহেদী। জানতে চায়,
“তা কি খেয়ে পেট ভরেছিস? সিগারেটের ধোয়া!”
জবাব দেয়না রক্তিম। চুপচাপ সেভাবেই পরে থাকে বিছানায়। শরীর ক্লান্ত থাকায় এটুকু সময়েই তার চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে এবার একটু বিরক্ত হয় মেহেদী। বলে,
“খাবি না ঠিক আছে। তাই বলে কি শার্টটাও পাল্টাবিনা? বাইরে থেকে এসেই ল্যাদার মতো শুয়ে পরছিস! তোর গা থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। ওঠ, দ্রুত শার্ট পাল্টে ফ্রেশ হয়ে ঘুমা। নইলে তোর ঘামের দুর্গন্ধে আমার ঘুম হারাম হবে আজ।”
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে থেকেই ঠোঁট টেনে হাসে রক্তিম। নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলে,
“যার ভিতরে পুরোটাই গন্ধযুক্ত নর্দমা হয়ে আছে। তার আর শরীর পরিষ্কার করে কি হবে? সেই তো ভিতরের দুর্গন্ধযুক্ত আবরণ থেকেই যাবে।”
নিস্পল চোখে রক্তিমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহেদী। ক্রস্থ পায়ে বাইরে থেকে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পরে রক্তিমের পাশে। খাবারের প্যাকেটটা টেবিলে ওভাবেই পরে থাকে অবহেলায়। রক্তিমের কথায় মেহেদীর’ও খাবার ইচ্ছে মিটে গেছে। বিকেলের ঘটনা গুলো স্বরণ হয় মেহেদীর। একজন মা কতটা উন্মাদ হলে এভাবে নিজের সন্তানকে আঘাত করতে পারে!
****
রক্তিম শিকদারের কাছে এতো বাজে ভাবে অপদস্থ হবার পরও দমে যায়নি দৃষ্টি। মনের কোণে অল্প অভিমান জমা হলেও তা ঝেড়ে ফেলে পরোক্ষনেই এটা ভেবে, ঐ পাষাণ পুরুষটার মনে তার জন্য এখনো ভালোবাসার জন্ম হয়নি। যার হৃদয়ে ভালোবাসা নেই তার আচরণে কষ্ট পেয়ে পিছু হটা নেহাত বোকামি ছাড়া কিছুই না। দৃষ্টি হাল ছাড়েনি। ভয় পেয়ে পিছিয়েও যায়নি। সময়ে অসময়ে দাঁড়িয়ে গেছে রক্তিম শিকদারের সামনে ভালোবাসা জাহির করতে। নিষ্ঠুর মানুষটার মন জয় করতে না পারলেও সেই দিনের মতো এমন ঐদ্ব্যত্য আচরণ আর পায়নি। কোনো এক অজানা কারণে রক্তিম দ্বিতীয়বার মেয়েটার সাথে বাজে আচরণ করতে পারেনি। হয়তো মনের কোণে কোথাও একটু অনুতপ্ততার লেশ উকি দিয়েছিল। অনুভব করতে পেরেছিল তার থেকে বয়সে এতো ছোট একটা মেয়ের কথায় উত্তেজিত হয়ে এতোটা খ্যাঁপাটে আচরণ করাটা ঠিক হয়নি। মেয়েটার বয়স কতই বা হবে! সতেরো কি আঠারো। এর থেকেও বেশি হলে ঊনিশ। এই বয়সী মেয়েরা বড্ড আবেপ্রবল হয়। এরা ঠিক ভুল বিচার করতে জানেনা। চোখের সামনে যা ভালো লাগে তাই নিজের করতে মরিয়া হয়ে যায়। দৃষ্টি মেয়েটাও ঠিক তেমন ধরনের মেয়েই। আবেগে গা ভাসিয়ে এসেছে রক্তিম শিকদারকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। ঘটে যদি বুদ্ধি-সুদ্ধি কিছু থাকত তবে নিশ্চয়ই দেশে হাজার হাজার সুদর্শন ছেলে থাকতে রক্তিমের মতো এমন চালচুলোহীন একটা গুন্ডা, মাস্তানকে প্রেমের প্রস্তাব দিতনা।
ফুরফুরে এক বিকেল। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ডুবি ডুবি ভাব করছে। আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূর আকাশের দিকে আনমনে তাকায় দৃষ্টি। দিনের শেষ প্রহরে আকাশের এমন আগুন রাঙা সাজ দেখে ভাবে, একেই বুঝি বলে গোধূলি লগ্নের কনে দেখা আলো। ঊর্ধ্বগগণ থেকে মুখ সরিয়ে পাশে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় দিহানের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত তুসী। ছেলেটা যা দেখছে সেটা সম্পর্কেই জানতে চাচ্ছে। এটা কার বাসা, ওটা কার গাছ একের পর এক প্রশ্ন করতে করতে পাগল বানিয়ে ফেলছে তুসীকে। মুচকি হাসে দৃষ্টি। ভাইটা তার বরাবরই প্রশ্ন করতে পারদর্শী। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকায় দৃষ্টি। বেহায়া মনটা না চাইতেও হয়তো খোঁজে বেড়ায় অতি প্রিয় একটা মুখ। যদি একবার দেখা পেত নির্লজ্জ চোখ দুটোর তৃষ্ণা মিটতো হয়তো।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা দূর চলে এসেছে তারা। বাসার গলি পেরিয়ে একেবারে মেইন রোডের কাছাকাছি। চারিদিকে পোস্টার, মাইকিং এর উচ্চ শব্দ জানান দিচ্ছে কাছেই হয়তো কোথাও একটা জনসমাবেশ হচ্ছে।
দৃষ্টি শুনেছে রক্তিম শিকদারের বাবা এমপি পদে নির্বাচনে লড়ছেন। সেটাও না কি ছেলের জেদে। কথাটা মনে পরতেই আনমনে প্রশ্ন করে তুসীকে,
“তুসু! রক্তিম শিকদারের বাবার নাম যেন কি?”
আবার সেই রক্তিম শিকদার! এই মেয়ে কি রক্তিম শিকদার ছাড়া আজ-কাল কোনো কথা খোঁজে পায়না? বিরক্ত হয় তুসী। অনিহা নিয়ে আঙুল তুলে দেয়ালে লাগানো একটা পোস্টার দেখিয়ে বলে,
“নিজেই দেখে নে।”
তুসীর হাত অনুসরণ করে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় সাদা-কালো পোস্টারে হাস্যজ্জল এক মুখ। গাল জোরে শুভ্র দাড়ি। ঠোঁটে লেগে আছে নির্মল হাসি। কপাল কুঁচকায় দৃষ্টি। ভাবে, লোকটা কি সুন্দর হাসে!অথচ এই লোকের ছেলে ওমন গুমরা মুখো কেন? বোনের দেখাদেখি দিহানও একটু এগিয়ে এসে পোস্টারে নজর দেয়। গুটি গুটি বাংলা অক্ষরে লেখা গুলো শব্দ করে পড়ে। পরোক্ষনে ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা আপু! ঐ রক্তিম শিকদার কে?”
মাথা কাত করে ঠোঁট চেপে হাসে দৃষ্টি। বলে,
“সিনেমায় হিরো দেখিস না! রক্তিম শিকদার হলো সেই হিরো। তবে সিনেমার না রিয়েল হিরো।”
দৃষ্টির এমন কথায় মুখ বাকায় তুসী। বিরবির করে বলে,
“হিরো! হাহ্! রাক্ষসের হিংস্র থাবা থেকে কোনোমতে জান নিয়ে ফিরে এসেও এখনো শিক্ষা হয়নি। নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার!”
বোনের জবাবে অবাক হয় দিহান। বাচ্চা ছেলেটার মনে কৌতূহল জাগে বোনের ভাষায় সেই রিয়েল হিরো রক্তিম শিকদারকে নিয়ে। আবার অল্প একটু সন্দেহও হয়। বোন না আবার তাকে ছোট ভেবে মিথ্যা বলে বোকা বানাতে চাইছে। চোখ পিটপিট করে জানতে চায়,
“ওনি কি সত্যিই হিরো? তুমি দেখেছো ওনাকে? আচ্ছা বলো তো শুনি রিয়েল হিরো দেখতে কেমন?”
ঠোঁট চেপে আবারও হাসে দৃষ্টি। শরীর দুলিয়ে বলে,
“মুখে শুনে কি আর বুঝা যায় কেমন হিরো? বাস্তবে দেখা আর মুখে শোনার মাঝে বিস্তর তফাৎ।”
“তাহলে আমি দেখব সেই হিরোকে।”
“সত্যি দেখবি?”
সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করে দৃষ্টি। ঘনঘন উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে সাই জানায় দিহান। প্রফুল্ল হাসে দৃষ্টি। কাধ ঝাকিয়ে বলে,
“ঠিক আছে। চল তাহলে রিয়েল হিরো দেখিয়ে নিয়ে আসি তোকে।”
ভাই-বোনের কথোপকথন শুনে কপাল চাপড়ায় তুসী। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“জাহান্নামে যা তোরা দুইটা। আমি কিছুই বলবনা। কিন্তু খবরদার! তোদের সাথে আমাকে টানবিনা।”
কথা শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়না তুসী। দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরে উল্টো পথে। সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাকায় দৃষ্টি। হাক ছেড়ে বলে,
“যা যা। যেখানে খুশি সেখানে যা। কি ভেবেছিস?তোর মতো মেয়ে আমার সাথে না থাকলে রক্তিম শিকদারের খোঁজ পাবনা! আমার ভাইকে তার হবু দুলাভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে তবেই বাসায় যাব আমি।”
স্কুল মাঠে বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে আজীজ শিকদারের পক্ষ থেকে। উত্তাল জনগণের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বুক টানটান করে চিরায়িত গম্ভীর স্বরে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে রক্তিম শিকদার। উৎসুক জনগণের নজর সেদিকেই। বাবার হয়ে রক্তিম শিকদার নিজে জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা রাখছে এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে। গিজগিজ করা মানুষের ভীড় ঠেলে একপাশে ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড়ায় দৃষ্টি। জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার স্মিত হাসি। বক্তৃতার মাঝে মাঝে একটু বিরতি নিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে রক্তিম। শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ দেহে কালো শার্টটা ঘামে চিটচিটে হয়ে আছে। দূর থেকেই তা দৃষ্টির চোখে ভাসে। সেদিকে নজর রেখেই ভাইয়ের হাতে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে দৃষ্টি। এক হাত উচিয়ে ইশারায় দেখায়,
“রিয়েল হিরো দেখতে চেয়েছিলি না! ঐ দেখ রিয়েল হিরো।”
মঞ্চে বক্তব্যরত শ্যামাঙ্গ পুরুষটার দিকে তাকায় দিহান। অপলক চোখে কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রক্তিমকে পরখ করে বলে,
“এই লোক তো আধ বুড়ো। গায়ের রংটাও কালো। একে তোমার কাছে হিরো মনে হয়?”
বিস্ময়ে চোখ দুটো বৃহদাকৃতির হয় দৃষ্টির। যে পুরুষটার প্রেমে দিন-রাত মজে থাকে দৃষ্টি। সেই পুরুষটার সম্পর্কে নিজের ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়। অসহায় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওনাকে তোর সত্যি সত্যি বুড়ো মনে হয়? আর কালো বলছিস কাকে? মোটেও ওনি কালো না। শ্যাম বর্ণের শ্যামাঙ্গ পুরুষ ওনি। ওনার গায়ে এই রংটাই কত সুন্দর মানিয়েছে! শ্যাম বর্ণ না হয়ে গায়ের চামড়া সাদা হলে বরং আরও কুৎসিত দেখাত।”
বোনের যুক্তি গুলো মানতে নারাজ দিহান। চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আরে ধুর! তুমি তো দেখি হিরোই চিনোনা। আবার আমাকে নিয়ে আসছো হিরো দেখাতে! শুনো, হিরোদের চোখ হবে সুন্দর ভাসা ভাসা। হিরোরা না হাসলেও তাদের চোখ হাসবে। আর চুল হবে স্টাইল করে কাটা। জেল দিয়ে চুল গুলো সেট করা থাকবে। আর না হয় সিল্কি চুল গুলো কপালে ঢেউ খেলবে। দাড়ি থাকবে ট্রিম করে কাটা। আর ওনাকে দেখো! চুল গুলো কেমন পাগলের মতো আউলাঝাউলা হয়ে কাকের বাসার মতো দেখাচ্ছে। মনে হয় কতদিন ধরে শ্যাম্পু করেনা। মুখ ভর্তি দাড়ি- গুফ। দাড়ি গুলো যদি আর কয়েক ইঞ্চি বড় আর সাদা হতো তবে একদম রবীন্দ্রনাথের মতো লাগত। ওনাকে কোনোভাবেই হিরো বলা যায়না। তবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিরহী কবিতা লেখা কবি বলা যায়।”
এতটুকু একটা ছেলের মুখে এমন বিশদ বর্ণনা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টি। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের মুখের দিকে। শেষ পযর্ন্ত কি না নিজের মায়ের পেটের ভাইটা তার পছন্দকে এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল! এই দুঃখ কিভাবে মেনে নিবে দৃষ্টি?
চলবে…..
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১২
#আদওয়া_ইবশার
হঠাৎ করেই রক্তিমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাকিবের নজর যায় দৃষ্টির দিকে। দেখতে পায় বাচাল মেয়েটা একটা পিচ্চি ছেলের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। কথা বললে ভুল হবে। এক প্রকার আঙুল উচিয়ে তর্ক করে যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে নিম্নোষ্ঠ কামড়ে ভাবে রাকিব, আধ পাগল মেয়েটা এই ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেটাকেও রেহাই দিলনা। নিশ্চয়ই এখানে এসেছিল আবার রক্তিম শিকদারকে জ্বালাতে। কিন্তু এতো গুলো মানুষের মাঝে রক্তিমের নাগাল না পেয়ে এই বাচ্চা ছেলেটার মাথা নষ্ট করছে। এই মেয়ের এলেম আছে বলতে হয়। বারবার রক্তিম শিকদারের কাছে অপদস্থ হয়েও ঘুরেফিরে তার পিছেই আসবে।
দৃষ্টির থেকে নজর ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দলের অন্যান্য ছেলেদের অবস্থান দেখে নেয় রাকিব। মেহেদী সহ সকলেই রক্তিমের আশেপাশেই আছে। তাছাড়া পুলিশ ও আছে এখানে। রক্তিম শিকদার বা আজীজ শিকদারের উপর ভরা মঞ্চে আচমকা হামলা করার কোনো পরিস্থিতি নেই। নিশ্চিত হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত দিয়ে নেমে পরে মঞ্চ থেকে। লাফিয়ে কয়েক কদমে ঠিক দৃষ্টির পিছনে এসে দাঁড়ায়। স্ব-হাস্য স্বরে বলে,
“কি ব্যাপার ললনা! রক্তিম শিকদার মনে হয় ডোজ কম দিচ্ছে তোমাকে! গলা টি’পা এন্টিডোজ তোমার মতো পুঁচকে ভালোবাসা নামক ভাইরাসরে ঘায়েল করতে পারলনা। বড়োই ভাবনার বিষয়।”
আচমকা পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে কপাল কুঁচকে পিছন মুখে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় রাকিব দাঁত কপাটি বের করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিরক্ত হয় দৃষ্টি। চোখ পাকিয়ে বলে,
“এই আপনার সাহস তো দেখি কম না! জনসভার এতো এতো কাজ রেখে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছেন। ফাঁকিবাজ চামচা একটা।”
চামচা সম্বোধনে আজকে আর রাগেনা রাকিব। বিগলিত হেসে বলে,
“একটু সাইডে আসো। কথা আছে।”
“কি কথা?”
সন্দিহান কন্ঠে জানতে চায় দৃষ্টি। উত্তরে রাকিব তাড়া দিয়ে বলে,
“আরে আসোই না! না আসলে শুনবা কেমনে?”
“কি কথা এখানেই বলুন।”
দৃষ্টির কন্ঠে স্পষ্ঠ রাকিবের কথায় সাথে যাবার অনিহা প্রকাশ পাচ্ছে। রাকিব বলে,
“এতো গুলো মানুষের সামনে বলা যাবেনা। সিক্রেট কথা।”
খ্যাঁটখ্যাঁটে চামচার হঠাৎ এমন ভালো মানুষী আচরণ! হজম হয়না দৃষ্টির। নিশ্চয়ই বদটা মনে মনে কোনো শয়তানি ফন্দি এটেছে তাকে নাস্তানাবুদ করার। তবে সেও জানেনা দৃষ্টি কেমন চিজ। উল্টাপাল্টা কিছু করলে সাথে সাথেই চেঁচিয়ে সভায় উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে দিয়ে গণধুলাই খাইয়ে ছাড়বে দৃষ্টি। নাক-মুখের নকশা পাল্টে গেলে ঠিক বুঝবে দৃষ্টির সাথে ইতরামি করার সাজা কেমন ভয়ানক। কথাগুলো ভেবে নিজেকে একটু আশ্বস্ত করে দিহানের হাত টেনে এগোই দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ রাকিব বলে,
“সাথে আবার এই মসিবত টেনে আনছো কেন? ঝগড়া শেষ হয়নি এটার সাথে?”
চোখ পাকায় দৃষ্টি। রাগি স্বরে বলে,
“কোন সাহসে আমার ভাইকে মসিবত বলছেন আপনি? আর একবার আমার ভাইকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে একেবারে মাথা ফাটিয়ে দিব।”
একটু ভড়কায় রাকিব। থমথম খেয়ে বলে,
“এটা তোমার ভাই! আমি আরও ভাবছিলাম ঝগড়া করার জন্য কোনো বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছো। তা ভাইকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছো কেন?”
সত্যি কথাটা বলতে গিয়েই টুপ করে জ্বিভের ডগা পযর্ন্ত বেরিয়ে আসা কথাটা গিলে নেয় দৃষ্টি। কপট রাগি ভাবে বলে,
“তা জেনে আপনার কি? কিজন্য ডেকেছেন আগে সেটা বলুন। আপনার মতো এতো আজাইরা প্যাচাল পারার সময় নেই আমার।”
বাব্বাহ্! বলে কি মেয়ে। এতো দেখি ভূতের মুখে রাম নাম। যে মেয়ে পারলে দিন-রাতের চব্বিশ ঘন্টায় রক্তিম শিকদারের পিছনে ঘুরে নিজের আজাইরা সময় কাজে লাগায়। সে না কি আবার বলে তার সময় নেই। কথাটা মনের মাঝেই চেপে রাখে রাকিব। এই হাফ পাগল মেয়ের সাথে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা। যা বলতে এসেছে সেটা সম্পূর্ণ করে দ্রুত কেটে পরাই মঙ্গল। সচেতন চোখে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখে নেয় কেউ তাদের দেখছে কি না। নাহ্! আপাতত কারো ধ্যান এদিকে নেই। সকলেই রক্তিম শিকদারের কথা গিলতে ব্যস্ত। আবারও দু-পাটি দাঁত বের করে হাসে রাকিব। দৃষ্টির দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“শুনো সুন্দরী! তোমারে একটা ভালো বুদ্ধি দেই। ঐ জড় বস্তুর ন্যায় ইস্তাপ কঠিক হৃদয়ের অধিকারী রক্তিম শিকদারের পিছনে অযথা সময় নষ্ট না করে একটু আমার দিকে দেখো। তুমি রাজি থাকলে আমাদের প্রেম জমে ক্ষীর হইতে বেশিক্ষণ লাগবেনা। ঐসব প্রেমের ব্যাপারে ভালো ধারণা আছে আমার। কথা দিচ্ছি একদম ঠকবানা।”
কথাটা শেষ করে আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে রাকিব। রাগে গা-পিত্বি জ্বলে ওঠে দৃষ্টির। ঝাড়ি মেরে বলে,
“যেই না চেহারা তার নাম রাখছে আবার পেয়ারা। সাহস কত বড়! রক্তিম শিকদারের ভাবি স্ত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়! আবার দাঁত বের করে হাসে! কি বিচ্ছিরি হলুদ দাঁত! আমার তো দেখেই বমি চলে আসছে। মুখ বন্ধ করুন।”
গরম গরম এমন একটা অপমানে থমথম খেয়ে যায় রাকিব। তৎক্ষণাৎ মুখের হাসি হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়। কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বিরবির করে বলে,
“তার চেহারা থেকে মনে হচ্ছে ডালিমের রস বেয়ে বেয়ে পরছে। নেহাত আমি ভদ্র একটা ছেলে দেখে একটা মেয়ের ভালোবাসা না পাবার কষ্টে একটু বুক জ্বলেছে আমার। সহমর্মিত দেখিয়ে তাই প্রেমের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর এই মেয়ে বিনিময়ে আমার কচি চেহারা আর সুন্দর হাসিটা নিয়ে অপমান করল! অভদ্র, অসভ্য মেয়ে জাতি কোথাকার।”
নিজেকে একটু ধাতস্থ করে গলা উচিয়ে চোখ রাঙিয়ে আবারও বলে রাকিব,
“এই মেয়ে! তুমি জানো রোজ রোজ কতশত মেয়েরা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়? সেই শত শত মেয়ের ক্রাশকে তুমি এইভাবে অপমান করলা! আমার প্রেমিকারা যদি এই কথা জানতে পারে তোমার চুল একটাও আস্তো থাকবেনা বলে দিলাম।”
মুখ বাকায় দৃষ্টি। ব্যঙ্গ করে বলে,
“খালি কলসি সবসময় বাজে বেশি। ধন্যবাদ বিষয়টা আবারও প্রমাণ করার জন্য।”
পূণরায় অপমান! এসব কি মেনে নেওয়া যায়? যে ছেলেটাকে এক প্রকার রক্তিম শিকদারের বাঁ-হাত বলা চলে সেই সুদর্শন ছেলেটাকে এভাবে অপমান করছে মেয়েটা। এর প্রতিশোধ তো নিতেই হয়। কিন্তু কিভাবে নিবে? ভাবতে ভাবতেই চক করে মাথায় আসে কয়েকমাস আগেই না তার নাম্বারে এক অচেনা মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিল! সেটা দেখিয়েই তো এই মেয়ের মুখের উপর অপমানের জবাব ছুড়ে দেওয়া যায়। ভেবেই পকেট হাতের ফোন বের করে বলে,
“আমি ফাঁকা কলসি না! খারাও। দেখাইতেছে কে ফাঁকা কলসি আর কে ভরা কলসি। এই যে দেখো। দেখো এইটা কি। মেয়েরা ফোনে পযর্ন্ত প্রেমের প্রস্তাব দিয়া আমারে পাগল করে ফেলে। আর তুমি রক্তিম শিকদারের পিছনে বেহায়ার মতো ঘুরেও পাত্তা পাওনা। সেই তুমি কি না আমারে ফাঁকা কলসি বলো! এবার দেখো কে ফাঁকা কলসি আর কে ভরা কলসি।”
চোখের সামনে ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা ম্যাসেজটা দেখার পর রাকিবের কোনো কথায় আর দৃষ্টির মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। অবাক নেত্রে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। এ তো সেই ম্যাসেজ। যেটা রক্তিম শিকদারকে দিয়েছিল দৃষ্টি। বিনিময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ফিরতি ম্যাসেজ ও পেয়েছিল। আর ভেবেছিল রক্তিম শিকদার কিভাবে তাকে এমন ম্যাসেজ ছিল। কিন্তু ঘটনা যে একেবারে উল্টো এটা কে জানতো? রক্তিম শিকদার সেদিন তার সাথে তো বড় একটা বেঈমানি করল! নিজের নাম্বার বলে তাকে এই চামচা রাকিবের নাম্বার দিল?
দৃষ্টি-রাকিব দুজনের কারোর কোনো কথার আগা-মাথা বুঝতে পারছেনা দিহান। অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে তাদের কান্ড। এর মাঝে বোনকে আবার এমন ফিজড হয়ে থাকতে দেখে একটু চিন্তিত হয়। ভাবে এই লোকটা আবার খারাপ কিছু দেখাল কি না তার বোনকে। কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ছেলেটা। দৃষ্টির হাত ঝাকিয়ে বলে,
“আপু! আমার আর হিরো দেখার ইচ্ছে নেই। চলো আমরা ফিরে যায়।”
চোখ-মুখ থমথমে দৃষ্টির। অপলকে এখনো তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। তা দেখে বিজয়ের হাসি হাসে রাকিব। স্বগর্বে বুক ফুলিয়ে বলে,
“কি? প্রমাণ দেখে এখন মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে?”
অস্বভাবিক থমথমে দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকায় দৃষ্টি। শক্ত কন্ঠে বলে,
“আপনাদের পাতি নেতা রক্তিম শিকদার যে কতটা লয়্যাল তার লয়্যালিটির প্রমাণ আজকে আমি দিব। কঠিন বোঝাপড়া আছে রক্তিম শিকদারের সাথে আমার।”
নির্বাচনের আর মাত্র দুদিন বাকী।জনসভা শেষে বাবার সাথে নিরবে কিছু আলোচনা সাড়তে সোজা পার্টি অফিসে চলে যায় রক্তিম। এতো এতো মানুষের মাঝে দৃষ্টি আর সাহস করে ওঠতে পারেনি রক্তিমের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। তবে পিছু নিয়েছে ঠিকই। স্কুল মাঠ থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র দুই মিনিটের পথ অতিক্রম করলেই পার্টি অফিস। মেইন রোড সংলগ্ন অফিসটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে অন্য এক বুদ্ধি আঁটে দৃষ্টি। মত পরিবর্তন করে। রক্তিমের সাথে আর দেখা করবেনা। যা করার কালকেই করবে। কথাটা ভেবে কুটিল হেসে ভাইকে নিয়ে প্রস্থান করে দৃষ্টি। বাসায় পৌঁছনোর আগ পযর্ন্ত পুরোটা পথ দিহান বোনকে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখে ফেলেছে। রক্তিম শিকদার কে? ঐ বুড়ো লোকটাকে কেন তার বোনের চোখে হিরো মনে হয়? আর ঐ ছেলেটাই বা কে যে তার বোনের সাথে এতোক্ষন ঝগড়া করল! এতো এতো প্রশ্নের জবাবে দৃষ্টি শুধু একটা কথায় বলেছে,
“সময় হলে সব জানতে পারবি।”
বোনের জবাবটা ঠিক পছন্দ হয়নি দিহানের। অসন্তুষ্ট মুখে হাঁটতে হাঁটতে কিছু একটা ভেবে নিজ থেকেই অল্প চমকায়। হাঁটার গতি থামিয়ে বোনের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,
“আপু! তুমি কি ঐ বুড়ো লোকটার প্রেমে পরেছো?”
ভাইয়ের এমন প্রশ্নে থমথম খেয়ে যায় দৃষ্টি। আমতা আমতা করে বলে,
“আরে ধুর! এমন কিছুই না। প্রেম-ভালোবাসার বুঝিস কিছু তুই? অযথা না বুঝে পাকনামি করবিনা একদম।”
দিহানের ঠিক বিশ্বাস হয়না কথাটা। সে ছেলেটা ছোট হতে পারে। কিন্তু আজ কালকার ছেলে-মেয়েরা কি এতো অবুঝ হয় না কি? তারা ক খ শিখার আগেই প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে। আর দিহান কি না তার বোনের হাবভাব দেখেও বুঝবেনা বোন ঐ বুড়ো লোকটার প্রেমে পরেছে কি না!
চলবে…..