||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১৬||
“আমাদের প্ল্যান অবশেষে সাকসেসফুল হলো।”, শতরূপার পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটা সরু পথে তাকিয়ে কথাটা বলল।
সেই ছায়া মানব। যে প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষণ তাকে চোখে চোখে রেখেছিল। শতরূপা পাশ ফিরে তাকিয়ে একটুখানি হেসে পরম যত্নে তার বুকে মাথা রাখে। কতদিন পর এই শান্তির জায়গাটা পেয়ছে সে। গাড়ি ঢাকার দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। শতরূপা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছে। কতটা মাস পর এত সুন্দর একটা দিন পেয়েছে সে। তার চুল বাতাসে দোল খেয়ে কপালের উপর লুটিয়ে পড়ছে। এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। উৎসব আপন মনেই পেছনের সিটে খেলা করছে। কিছুক্ষণ পরপর তাকে তাকিয়ে দেখছে তারা।
শতরূপা উৎসবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি আদিয়ান?”
“বাবা, মায়ের কাছে যাব। তাদের দোয়া লাগবে না? নতুন জীবন শুরু করতে বড়দের দোয়া খুবই প্রয়োজন।”
শতরূপা আবার নীরব বসে রয়। উৎসবকে সে এত সহজে পেয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি। এখনো তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে। এইতো সেদিনও সে তাকে কেবল দূর থেকেই দেখেছে আর আজ কতটা কাছে। অবশ্য অতোটা সহজেও নয়, তাকে নিয়ে আসতে কম বেগ পেতে হয়নি তাকে।
“হাম্মাদ তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছে তাই না? আর ওই মেন্টাল বউটা তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তোমার।”, বলেই আদিয়ান শতরূপার একটা হাত নিয়ে চুমু এঁকে দেয়।
“উৎসবে কাছে পাওয়ার কাছে সব কষ্ট খুবই তুচ্ছ আদিয়ান। তুমি তো জানোই কতটা পাগল হয়ে ছিলাম আমার বাচ্চাটাকে…”, বলতে বলতেই থেমে যায় শতরূপা।
কিছু একটা ভেবে আবার বলল, “আচ্ছা, তাকে এখন আমার বাচ্চা বলতে কোনো বাঁধা নেই তাই না?”
“না, আর কোনো বাঁধা নেই। তবে একটা কথা তো ভুল বলে ফেললে।”
শতরূপা তার বুক থেকে মাথা তুলে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন কথা?”
“সে কেবল তোমার বাচ্চা নয়। বলো আমাদের বাচ্চা।”
আদিয়ানের কথায় মৃদু হাসে। মনটা আজ ভীষণ খুশি। উৎসবকে পেছনের সিট থেকে সামনে নিয়ে কোলে বসায়৷ জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখাচ্ছে। বাইরের প্রকৃতি ছেলেটা এই প্রথমবার চোখ ভরে দেখছে। বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। যা দেখছে তার সম্পর্কেই প্রশ্ন করছে। অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেও ক্লান্ত হচ্ছে না শতরূপা। গল্প করার একজন সঙ্গী পেয়ে গেছে সে। যা দেখছে তাই নতুন লাগছে।
কথার ফাঁকে শতরূপা উৎসবকে জিজ্ঞেস করল, “বলো তো বাবা আজ আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
উৎসব দৃষ্টি বাইরে থেকে ফিরিয়ে আনে। তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছি মাম্মা?”
“আজ আমরা নানুবাড়ি যাচ্ছি বাবা।”
“আমি তোমার বাবা?”
“হ্যাঁ, তুমি আমার একটা মাত্র বাবা।”, বলেই উৎসবের কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দেয়।
“এই ড্রাইভার আঙ্কেল আমাদের সাথে যাবে?”
আদিয়ান উৎসবের কথায় হেসে দেয়। শতরূপাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দেখেছ, তোমার ছেলে ঠিকই তোমায় আপন করে, আমাকে পর করে দিল।”
শতরূপা মুখ টিপে হাসছে। বাবা ছেলের এসব কথা বেশ উপভোগ করছে সে। এমন একটা পরিবারই তো চেয়েছিল। আজ তার স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেল। উৎসবের গাল আলতো টেনে দিয়ে সে বলল, “উনি ড্রাইভার আঙ্কেল না সোনা, উনি তোমার বাবা।”
“আমি তোমার বাবা, আর উনি আমার বাবা?”
“হ্যাঁ এইতো, একদম বুঝে গেছ।”
উৎসব আদিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা শব্দটা তার কাছে নতুন। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমার তো পাপ্পা আছে। পাপ্পাকে কেন সাথে নিয়ে যাচ্ছি না? বাবাকে নিয়ে কী করব? বাবা এতদিন কোথায় ছিল?”
“পাপ্পা আমাদের কেউ না, সে আর আমাদের সাথে আসবে না বাবা।”
“পাপ্পা তো পাপ্পা মাম্মা। তাকে আসতে বলো।”
“আসতে বলেছি বাবা কিন্তু সে আসবে না। তোমার মাম্মা আর তোমার বাবা যাচ্ছে তো তোমার সাথে।”
“পাপ্পা আসবে না? কেন আসবে না? পাপ্পা আমাকে ভালোবাসে না?”
শতরূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে তোমার মাম্মা আর বাবা অনেক বেশি ভালোবাসে।”
“আর পাপ্পা?”
“পাপ্পা ভালোবাসে না।”
উৎসবের মনটা যেন বিষন্ন হয়ে আসে। কিন্তু এই বিষন্নতা বেশিক্ষণ থাকে না। বাচ্চাদের মধ্যে এই স্বভাবটা দারুণ ভালো। তারা বড়দের মতো ছোটখাটো কোনো বিষয়কে ধরে বসে থাকে না। অল্প সময় পরেই নতুন জিনিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই যেমন এখন শতরূপা গাড়ি ড্রাইভ করছে আর উৎসব আদিয়ানের সাথে খেলা করছে। বাবা ছেলের বেশ ভাব হয়ে গেছে।
আদিয়ান শতরূপাকে বলল, “আমি এডপশনের সব পেপার জমা দিয়ে দিয়েছি৷ উৎসবের উপর এখন আর কারো অধিকার নেই। ভাইয়া আর ভাবির থেকে কাগজে সাইন নিতে আমার খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি।”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শতরূপা। অবশেষে তাদের স্বপ্নটা পূরণ হলো। শতরূপা আর আদিয়ানের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। কলেজে থাকা অবস্থাতেই শতরূপার প্রেমে পড়ে কোর্ট ম্যারেজ করে নেয় তারা। হাম্মাদ তখন দেশের বাইরে ছিল। নতুন বউকে নিয়ে যখন বাড়িতে যায় তখন তার বাবা খুব একটা খুশি হোননি। বড় ছেলে রেখে ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলেছে বিষয়টা তার কাছে খারাপ লাগে। সমাজে লোক নানা কথা তৈরি করবে। তার কথায় আদিয়ান শতরূপাকে নিয়ে বাবার দেওয়া নতুন ফ্ল্যাটে উঠে। হাম্মাদ হুট করে বিয়ে করে ফেলায় কাউকে আর এই খবর জানানো হয় না। বিয়ের দুই বছর পর আদিয়ান জানতে পারে শতরূপা কোনোদিন মা হতে পারবে না। ভালোবাসার কাছে সন্তানের চাহিদা তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায় না। সে এতকিছু জানার পরেও শতরূপার হাত ছাড়ে না। কিন্তু শতরূপা এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করতে যায়। আদিয়ানের জীবন থেকে সরে যেতে চায় সে। সেদিন শতরূপাকে বাঁচিয়ে নিয়ে বাচ্চা এডপশনের জন্য এতিমখানায় যায় তারা দুজন। গেইটের সামনে গাড়িত পাশ দিয়ে ভেতরে যাচ্ছিল। গাড়ির জানালায় ওড়না আটকে যেতেই ভেতরে নজর পড়ে তার। তখনই প্রথম উৎসবকে দেখে শতরূপা। নিষ্পাপ হাসিটা তার মন কেড়ে নেয়। বাচ্চাটা কথাও বলতে শিখেনি তবুও মনে তার হচ্ছিল যেন তাকে দেখে মা…মা বলে ডেকেছিল। চোখের কোণে জল নিয়ে সেদিন আদিয়ানের হাত ধরে শতরূপা তার জীবনের শেষ চাওয়া পূরণ করতে বলেছিল। তার শেষ চাওয়াটা ছিল, এই বাচ্চাটার মা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। আদিয়ানও সেই চাওয়া পূরণের মিশনে নামে। কিন্তু ঘটনাক্রমে জানতে পারে এই বাচ্চা হাম্মাদের। এবং সে তার বাচ্চাকে এতিমখানাতে দিতে চাচ্ছে। তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় উৎসবকে নিজের কাছে আনবে। কিন্তু হাম্মাদের সাথে তার সম্পর্ক ভালো না, তার উপর এই বাচ্চার কথা কেউ জানতো না। হাম্মাদ কখনোই আদিয়ানকে বাচ্চার দায়িত্ব দিত না। তখন থেকেই শুরু হয় নাটক সাজানো। সবার আগে শতরূপার নকল পরিবার এবং পরিচয় তৈরি করে। হাম্মাদের সামনে নিয়ে যাওয়া। তারপর শায়ানকে ব্যবহার করে সঠিক জায়গায় পৌঁছানো। সবই ঠিকঠাক প্ল্যানমতো হয়েছে। এখন আর তাদের পেছনে কেউ নেই। ভয়েরও কিছু নেই। এতদিন শতরূপা ভয়ে ভয়ে ছিল কিন্তু আজ উৎসবকে নিয়ে মুক্ত আকাশের নিচে নেমে এসেছে।
হাম্মাদ না খেয়ে টেবিল থেকে উঠে রুমে পায়চারি করছে। অসহ্য এক যন্ত্রণা হচ্ছে তার বুকের মধ্যে। মাথাটা যেন ঝিম ধরে আছে। কোনো কিছু না ভেবেই তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিন্থিয়া বারবার পেছনে ডাকে কিন্তু তার ডাক উপেক্ষা করে সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। শতরূপাকে আশেপাশে খুঁজতে লাগে। মনে হচ্ছে শেষবার হলেও তার সন্তানকে দেখতে হবে। আর শতরূপাকেও দেখার তৃষ্ণা বুকে চেপে রেখেছে যা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। যতক্ষণ সামনে ছিল ততক্ষণ সে বুঝতে পারেনি কিন্তু এখন দূরে যাওয়ায় মনে হচ্ছে তার কিছুই নেই। সব হারিয়ে ফেলেছে। জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটাকে নিজ হাতে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে এখন সে নিঃস্ব।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা