||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১৫||
শায়ান শতরূপার সাথে কথা বলার জন্য বারবার কল দিচ্ছে কিন্তু রিং হচ্ছে না। শতরূপা জানেই না হাম্মাদ টেলিফোনের লাইন কেটে রেখে দিয়েছে। নতুন চাকরিতে যোগদান করেছে শায়ান তাই ছুটিতেও যেতে পারছে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার সেখানে না গেলে হবে না। যেভাবে হোক ছুটি নিয়ে যেতে হবে। শতরূপাকে সবকিছু খুলে বলতে এদের জাল থেকে বের করে আনতে হবে তার। এই ফাঁকে তড়িঘড়ি করে ডিভোর্স পেপার তৈরি করিয়ে নেয় হাম্মাদ। আগামীকালই শতরূপাকে পেপারটা দিয়ে দেবে। গত এক মাসে শতরূপার সাথে বেশ মিশে গেছে উৎসব। এক সপ্তাহ ধরে সে এখানেই আছে। রানু আছে বাচ্চার খেয়াল রাখার জন্য কিন্তু শতরূপা তাকে কিছুই করতে দেয়নি। সে নিজেই সব করেছে। এই বন্দি ঘরে একজন সঙ্গি পেয়ে সে যেন আরো মুক্তমনা হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছেমতো কথা বলে দুজন। তাদের কতশত গল্প, যেন কত জীবনের পরিচয়। কেউ দেখলে বুঝবেই না তারা মা আর সন্তান নয়৷ মনে হচ্ছে শতরূপার গর্ভের সন্তান। উৎসব জন্মের পর থেকে মায়ের আদর পায়নি। তার মা কে সেটাই সে জানে না। হাম্মাদ তার দেখাশোনা করায় তাকেই তার কাছের কেউ বলে জানে। মা বলে যে কেউ পৃথিবীতে আছে সেটা তার জানা ছিল না। অথচ আজ সেই ছেলেটা মাম্মা বলে অস্থির হয়ে থাকে। শতরূপা সারাক্ষণ তাকে কোলে কোলে রাখে। উৎসবও যেন তাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। মাম্মা ডাকটা শুনতেই হৃদয়টা জুড়িয়ে আসে তার। এত গভীরভাবে তার হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি কেউ যতটা উৎসব করেছে।
অসম্ভব দুষ্টুমি করে উৎসব। ঘরটা মাথায় তুলে রাখে। সকালবেলা শতরূপা তাকে খাওয়াচ্ছিল। উৎসব দৌড়ে হাম্মাদের পেছনে লুকিয়ে যায়। তার প্যান্ট ধরে বলল, “পাপ্পা, পাপ্পা দেখ, মাম্মা আমাকে কিসব খাওয়াচ্ছে।”
হাম্মাদ মেঝেতে বসে বলল, “বাবা, ওগুলো খাবার। খাবার না খেলে তুমি শক্তিশালী কীভাবে হবে? যাও মাম্মামের কথার অবাধ্য হয় না। ভালো ছেলের মতো খেয়ে নাও। পাপ্পার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
দেরি হয়ে যাচ্ছে কথাটা শুনেই উৎসব বুঝে যায় তার পাপ্পা এখন বেরিয়ে যাবে। সে শতরূপার কাছে এসে লুকায়। সে তাকে বাহুডোরে নেয়। ড্রাইনিং টেবিলের উপর বসিয়ে গল্প বলতে বলতে খাওয়াতে লাগে।
উকিলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে হাম্মাদ। গাড়িতে বসে বসে ভাবনায় পড়ে যায়। এই কদিনে সে উপভোগ করছে তার ঘরটা পরিপূর্ণ সংসার হয়ে এসেছে। স্ত্রী, সন্তান এটাই তো চেয়েছিল সে। কিন্তু এই সংসার তার নয়। সে কেবল একটা অংশ, যে অংশ ছেড়ে খুব শীঘ্রই চলে যাবে। অথচ সে চাইলেই সংসারটাকে ঠিক আপন করে রাখতে পারতো। কিন্তু তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই।
রাতে ডিভোর্স পেপার নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। অনেকদিন পর সিন্থিয়া এসেছে এখানে। সিন্থিয়াকে দেখামাত্র উৎসব শতরূপার আড়ালে লুকায়। ছেলেটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। শতরূপা তাকে কোলে তুলে নেয়। কাঁধে মাথা রেখে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখে সে৷
সিন্থিয়া সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসেছে। হাম্মাদ শতরূপাকে বলল, “উৎসবকে রানুর কাছে দাও।”
“আপনাদের জরুরি কোনো কথা থাকলে আপনারা বিশ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি তাকে ঘুম পাড়িয়ে আসছি।”, বলেই শতরূপা রুমে চলে যায়।
সিন্থিয়া জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ছাই ফেলে বলল, “দেখেছ মেয়ের তেজ কত! আমার ছেলেকে কী সে আমার চাইতে বেশি ভালোবাসে সেটা দেখাচ্ছে?”
কথাটা শুনে হাম্মাদ তার কাছে এসে বলল, “প্রশ্নটা না হয় নিজেকেই করে দেখ। জবাবটা তো তোমার জানাই আছে।”
সিন্থিয়া থতমত খেয়ে যায়। আসলেই তো সে উৎসবকে জন্ম দিয়েছে বিপদে পড়ে। কিন্তু কখনো তো ভালোবাসতে পারেনি। ছেলে তার হলে কী হলো এই কদিনে সে বুঝতে পেরেছে শতরূপার তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসে।
বিশ মিনিট বলে ত্রিশ মিনিটের মাথায় শতরূপা ড্রয়িং রুমে আসে। হাম্মাদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সিন্থিয়া। গলা খাঁকারি দিয়ে ভাবে তারা হয়তো স্বাভাবিক হয়ে বসবে। কিন্তু না, সিন্থিয়া সেভাবেই শুয়ে থাকে। উঠে বসে না। শতরূপা সোজা গিয়ে তাদের সম্মুখে সোফায় বসে।
“আমাকে মুক্ত করার কাজ কী সম্পূর্ণ?”
হাম্মাদ অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সে কিছুই বলেনি অথচ মেয়েটা কীভাবে এতটা দৃঢ়ভাবে বলতে পারে! সিন্থিয়াও কিছুটা অবাক হয় কিন্তু ধরা দেয় না তাদের সামনে।
হাম্মাদ ইতস্তত করে বলল, “সব কাগজ তৈরি। তুমি সাইন করে দিলেই মুক্ত।”
“আপনি সাইন করেছেন?”
“না এখনো করিনি, কিন্তু…”
“কিন্তু কী? আগে আপনি সাইন করুন, তারপর আমিও সাইন করে দিব। আমি আজই এখান থেকে চলে যেতে চাই।”
“যাওয়ার এত তাড়া তোমার?”
হাম্মাদের কথায় যতটা অবাক শতরূপা হয় তার চেয়ে বেশি অবাক হয় সিন্থিয়া। শোয়া থেকে উঠে বসে সে। হাম্মাদের কপালে হাত রেখে জ্বর মেপে জিজ্ঞেস করলো, “বেবি, আর ইউ ওকে?”
“ইয়াহ বেইবস, অ্যাম ফাইন।”, হাম্মাদের কণ্ঠস্বর অদ্ভুত শোনায়।
সে তড়িঘড়ি করে পেপারে সাইন করে শতরূপার দিকে এগিয়ে দেয়। শতরূপা পেপারটা পড়ে বলল, “আমি এখানে সাইন করে দিব কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
সিন্থিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তীর্যক কণ্ঠে বলল, “এসে গেলে তো আসল জায়গায়? জানতাম ডিভোর্স পেপারে সাইন দেওয়ার সময় আসলেই কিছু না কিছু গণ্ডগোল বাঁধাবেই। দশ লক্ষ টাকা কম হয়ে গেল তাই না? পনের লক্ষ? নাকি বিশ লক্ষ চাই এখন?”
চেকবুক বের করে বিশ লক্ষ টাকার একটা চেক সাইন করে শতরূপার মুখের উপর মেরে বলল, “নাও, দশ কথা ছিল আরো দশ বেশি দিলাম। আরো এমাউন্ট প্রতি মাসে তোমার একাউন্টে জমা হবে। এবার সাইন করে ছেলেটাকে নিয়ে বিদেয় হও।”
শতরূপা চেকটাকে এক পলক দেখে। এই টাকার কতই না খেলা দেখল সে! মৃদু হেসে চেকটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেয়। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে কলমটা এর উপরে রেখে বলল, “আপনারাও মুক্ত, আমিও মুক্ত। টাকা দিয়ে সব কেনা যায়, মায়ের ভালোবাসা না। টাকার জন্য সব বিক্রি করা যায় কিন্তু সন্তানকে না।”
রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকে। শরীর কাঁপছে তার। কিছুটা রাগ আর কিছুটা কষ্টে। হাম্মাদ আর সিন্থিয়া সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। নিজের জামা-কাপড় যা নিয়ে এসেছিল সব গোছাতে লাগে। উৎসবের কোনো কাপড় নেবে না সে৷ ভোরবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। এবার নিশ্চয়ই দারোয়ান তাকে আটকাবে না। সারারাত উৎসবের মাথার পাশে বসে রয় শতরূপা। ভোরের আলো চারদিকে ছড়াতেই যে লাগেজ সাথে নিয়ে এসেছিল সেই লাগেজটা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। নিচে গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান গেট খুলে দেয়।
শতরূপা মৃদু হেসে বলল, “আজ আপনার স্যার গেট খুলে দিতে বাধা দেননি তাই না?”
দারোয়ান অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, “ছোট সাহেবের খেয়াল রাখবেন আপা। এরা জালিম, এরা ভালোবাসা বুঝে না। ভালো থাকবেন আপনি।”
হাসি বিনিময় করে রাস্তায় নেমে আসে সে। গন্তব্য খুব অচেনা নয়। চেনা জায়গাটাতেই যাচ্ছে। যেখানে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে দিনের পর দিন।
হাম্মাদ অস্থিরতায় রাত কাটিয়েছে। সারা রাতে চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সিন্থিয়া পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। তারাদের সাথে জেগে ছিল সে। ভোররাতে চোখ কখন যে বন্ধ হয়ে আসে বলতেই পারে না। চোখ খুলে সিন্থিয়াকে তার পাশে পায় না। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখে তাকে বসে নাস্তা করছে। সেও পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
রানু পানির জগ রেখে বলল, “স্যার আমার হিসেব করে দিন। আমি এই চাকরিটা আর করছি না।”
সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই হাম্মাদ পেছন থেকে বলল, “কেন কী হয়েছে তোমার আবার? আর ঘর এত নীরব যে? বাকিরা কোথায়? উৎসব আর শতরূপা?”
সিন্থিয়া স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলল, “যেখানে থাকার কথা সেখানেই।”
“মানে!”
“চলে গেছে স্যার। যেটা আপনি চেয়েছিলেন সেটাই হয়েছে। ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেছে তারা।”
হাম্মাদের মাথাটা ঝিম ধরে আছে। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। প্লেটে খাবার যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে আছে। মুখে তোলার শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন, কেউ বুকের উপর ভারি পাথর রেখে দিয়েছে। অথচ এটাই তো চেয়েছিল সে। তার চাওয়াটাই তো পূরণ হলো। তবে কেন এই পিছুটান! কিসের জন্য? উৎসব নাকি শতরূপা?
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা