দৃষ্টিভ্রম পর্ব-০৮

0
813

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ০৮||

নিস্তব্ধ পায়ে বিছানায় গিয়ে বসে হাম্মাদ। ছায়া মানব দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের। কিছুক্ষণ নীরব সময় কাটিয়ে পাশেই শুয়ে পড়ে সে। আলতোভাবে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ছায়া মানব রাতের আঁধারে মিলিয়ে যায়।

সকালে ঘুম ভাঙতেই হাম্মাদকে নিজের পাশে ঘুমাতে দেখে শতরূপা। রাতে কখন আসলো বুঝতেই পারেনি। চোখ ভীষণ জ্বলছে তার। হাম্মাদকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে অনেক শান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে হাজার পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। মনের মধ্যে প্রশ্নেরা উঁকি দেয়৷ রাতে সে কোথায় গিয়েছিল! সবাই কেনই বা এত তাড়া করে চলে গেল! সপ্রশ্ন মনে বিছানা ছাড়ে সে। কোনো আওয়াজ না করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ভেজা চুল মুছে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও নিজের মোবাইলটা পায় না। হাম্মাদ তখনও বিছানায়। তাই সম্পূর্ণ বিছানায় খুঁজতে পারে না। ধীর পায়ে হেঁটে নিচে রান্নাঘরে চলে আসে। রানু মেয়েটা নাস্তার আয়োজন করছে।কথা, কাজে অনেক স্মার্ট মেয়েটা। কী সুন্দর পোষাক তার। নিশ্চয়ই এর বেতন অনেক হবে।

তাকে দেখতেই মেয়েটা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ম্যাম, আপনি এত তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন যে!”

শতরূপা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে উত্তরে বলে, “আসলে আমার তো সকাল বেলা অফিসে যেতে হয়, সেজন্যে তাড়াতাড়ি উঠার অভ্যাস হয়ে গেছে। তা কী তৈরি করছো তুমি?”

“ম্যাম…”

“তুমি আমাকে বারবার এভাবে ম্যাম ডাকবে না তো। আপু ডাকবে ঠিকাছে?”

“কিন্তু…”

“কোনো কিন্তু নয়, আপু ডাকবে ব্যাস।”

রানু ছলছল চোখে তাকায় শতরূপার দিকে। মূহুর্তেই কতটা আপন করে নিল তাকে। এভাবে সবাই বলতে পারে না। লোকে তো উলটা স্যার, ম্যাম ডাকার জন্য কথা শোনায়। শতরূপা রানুর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল, “কী হলো? কোথায় হারিয়ে গেলে? বললে না যে কী নাস্তা তৈরি করছো!”

“আসলে ম্যা… না, মানে আপু স্যার তো সকালে তেমন কিছু খান না। উঠেই বাইরে চলে যান ব্যায়াম করতে। ফিরে এসে দুইটা ডিম, পাউরুটি আর এক গ্লাস দুধ খেয়ে অফিসে চলে যান।”

“ওহ আচ্ছা! এজন্যেই তোমার স্যার দেখতে এমন।”

শব্দ করে হেসে দেয় রানু৷ নতুন বউয়ের থেকে এত সুন্দর ব্যবহার সে আশা করেনি।

“আচ্ছা সরো আজ আমি নাস্তা বানাই।”

“কিন্তু আপু, আপনাকে নাস্তা বানাতে দিলে স্যার অনেক রাগ করবেন।”

“এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব আমি সামলে নেব।”, বলেই শতরূপা নাস্তা বানাতে লেগে যায়।

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বলে একটা বয়স পর ঘরের সম্পূর্ণ কাজ শিখে নিয়েছে। রান্না সে বেশ ভালোই পারে। কতবার রান্না করে বাবার থেকে সুনাম পেয়েছে সে। তার হাতের রান্না নাকি ঠিক তার দাদীর মতোন। আজকে তার স্পেশাল রেসিপি হলো, পরটা, মাংস আর মিষ্টির মধ্যে পায়েশ।

হাম্মাদ উঠেই বাইরে বেরিয়ে যায়। ঘন্টাখানেক পর ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে। নাস্তার টেবিলে বসেই ডাক লাগায়, “রানু…রানু… এখনো নাস্তা লাগানো হয়নি কেন টেবিলে?”

শতরূপা টেবিলে নাস্তা দিতেই হাম্মাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। পরটার প্লেট আর মাংসের বাটি মেঝেতে ছুঁড়ে মারে।

“হু দ্য হেল আর ইউ? তোমার সাহস কী করে হয় এসব করার? রানু… রানু…”

রানু দৌড়ে আসে। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে তার। হাম্মাদ তাকে শাসিয়ে বলল, “আমার সকালের নাস্তায় কী চাই, না চাই তুমি জানো না? কোন সাহসে অন্য কাউকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিয়েছ?”

“স্যার, আপু জোর করছিল তাই…”

“আপু! কার আপু? কিসের আপু! কল হার ম্যাম। সে এখানে ছ’মাসের মেহমান মাত্র। পরিবারের কোনো পার্মানেন্ট সদস্য নয়। সো, বি কেয়ারফুল।”

শতরূপা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। ভয়ে থরথর কাঁপছে। নিশ্বাস যেন গলার কাছে এসে আটকে আছে।

হাম্মাদ চোখের সামনে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে শতরূপা। নিজের চোখের দেখাকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে ভ্রম হয়েছে কোনো, দৃষ্টিভ্রম। যে হাম্মাদকে সে দেখেছে, জেনেছে তখনকার তার মাঝে আর এখনকার তার মাঝে কোনো মিল নেই৷ রাজ্যের পার্থক্য দু’জনের মধ্যে। কোথাও সুতো পরিমাণ মিল খুঁজে পাচ্ছে না সে। এসব কী বলে গেল সে!

রানু এসে পানি এগিয়ে দেয়। ইতস্তত করে বলল, “স্যারের কথায় মন খারাপ করবেন না। তিনি রেগে গেলে এমন উলটা পালটা কথা বলেন। আবার যখন রাগ পড়ে যায় তখন সব ঠিক হয়ে যায়। আপনি চিন্তা করবেন না আপু। স্যার এলেই দেখবেন সুন্দর করে কথা বলবেন আবার।”

শতরূপা কোনো উত্তর দেয় না। এক দৌড়ে উপরে উঠে যায়। সম্পূর্ণ রুম এলোমেলো করে মোবাইল খুঁজে কিন্তু শত খুঁজেও মোবাইলটা আর পায় না। আরেক দৌড়ে নিচে নেমে আসে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রানু তাকে বসতে বলল। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে মৃদুস্বরে বলল, “তো…মার কাছে মোবাইল আছে?”

রানু ম্লানমুখে জবাব দেয়, “না আপু। আসলে ঘরের ভেতর মোবাইল চালানো নিষেধ করে দিয়েছেন স্যার। কিন্তু ল্যান্ডলাইন আছে। আপনি চাইলে সেখান থেকে যাকে ইচ্ছা কল করতে পারেন।”

তেমন কারো মোবাইল নম্বরই মুখস্থ নেই তার। কেবল বাড়ির আর বোনের নম্বরটা মুখস্থ। কিন্তু এই মূহুর্তে তাদেরকে সে এসব কথা জানাতে চাচ্ছে না। হুট করে বিয়ে করেছে। আবার যদি এখন আচমকা এসব বলে তাহলে বাড়িতে সমস্যা হবে। তাছাড়া হাম্মাদের এমন ব্যবহারের কারণ জানতে হবে তাকে। শত চেষ্টা করেও শায়ানের নম্বরটা পুরোপুরি মনে করতে পারলো না সে। শায়ানের সাথে কথা বলা উচিত কিন্তু পারে না। বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে হবে তাকে আজ।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে গেটে তালা ঝুলছে। দারোয়ান বন্দুক হাতে বসে আছে পাশ ঘেঁষে।

সে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গেট বন্ধ কেন? একটু খুলে দিন ভাইয়া। আমার বাইরে যাওয়া প্রয়োজন।”

দারোয়ান তাকে দেখে এগিয়ে এসে রূঢ়ভাবে বলল, “স্যরি ম্যাম, ভেতরের কারো বাইরে যাওয়া নিষেধ আছে। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে বলুন আমি আনিয়ে দিচ্ছি।”

“প্লিজ গেটটা খুলে দিন। আমাকে বাইরে যেতে হবে। আপনি পারবেন না আমার নিনিস এনে দিতে।”

“দয়া করে আপনি ভেতরে যান। নাহলে স্যার জানতে পারলে সমস্য হবে।”, বলেই দারোয়ান গিয়ে সোজা হয়ে নিজের জায়গায় বসে রয়।

কোনো উপায় না পেয়ে ঘরের ভেতর চলে আসে সে। এদিক সেদিক পায়চারি করছে। রানুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হাম্মাদ এসব কী বলে গেল! তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আমি কল্পনাও করতে পারছি না।”

“আপনি মিছেমিছি চিন্তা করছেন। স্যার বাহির দিক দিয়ে যতটা শক্ত ভেতর থেকে ততটাই নরম। রাগ অনেক বেশি তার। তিনি আসলে রাগের মাথায় কী থেকে কী বলে ফেলেছেন। দেখবেন এসে নিজেই কত সুন্দরভাবে কথা বলবেন।”

শতরূপা উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “কখন আসবেন হাম্মাদ?”

“স্যার তো দুপুরে এসে খেয়ে অফিসে যান আর একেবারে রাতে আসেন। তবে মাঝেমধ্যে দুপুরে খেতে আসেন না আবার কখনো কখনো রাতেও আসেন না বাসায়। বাইরে কোথাও থাকেন। তবে আজ আসবেন আপনি চিন্তা করবেন না।”

শতরূপা হাম্মাদের অপেক্ষায় রুমে গিয়ে বসে। সব প্রশ্নের জবাব চাই তার। যতক্ষণ না জবাব পাচ্ছে ততক্ষণ সে শান্তি পাবে না। সারাদিন রুম, বারান্দা, ছাদ, এদিক- সেদিক করেই কাটিয়ে দেয়। সকাল থেকে খায়নি দেখে রানু অনেক চেষ্টা করে তাকে খাওয়ানোর। কিন্তু খাবার টেবিলের উপর থেকে থেকে ঠান্ডা হয়।

রানুর ডাকে চোখ খুলে তাকায় শতরূপা। শোয়া থেকে চট করে উঠে বসে। ঘড়ির কাটায় দশটা বেজে পনেরো মিনিট। বিকেলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল আর এখন চোখ খুলেছে। সারাদিন খায়নি বলে পেটের ব্যথায় সোজা হয়ে বসতে পারছে না।

রানুকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, “হাম্মাদ এসেছেন?”

মৃদু হেসে সে উত্তর দেয়, “যা বলেছিলাম। স্যার আপনার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। চলুন তাড়াতাড়ি।”

তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে আসে সে। পরনের শাড়িটা একদম অগোছালো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। হাম্মাদ তাকে দেখে বলল, “বসো। সারাদিন খাওনি যে? এভাবে থাকলে শরীর খারাপ করবে যে। তখন তো নিজেরই ক্ষতি।”

এতটা স্বাভাবিক কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। হাম্মাদ তাকে প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। শতরূপা খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী এমন ভুল করেছিলাম আমি যে আমার সাথে এমন ব্যবহার করলেন? আমার কী দোষ ছিল? আমাকে কেন এত কথা শোনানো হলো? ছ’মাসের মেহমান বলতেই বা আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?”

হাম্মাদ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল, “ছোট্ট মনে খুব বেশি প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে না?”

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে