||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ০৬||
হাম্মাদের কাঁধে একটা হাত রেখে আলতো করে ধরে বসে শতরূপা। বাইক স্টার্ট দিতেই আচমকা তার গায়ের সাথে মিশে যায়। নিজেকে সামলে শক্ত হয়ে বসে রয়। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাতাসে তার চুল উড়ে আসছে মুখের উপর। রাস্তাটা এখন একটু ফাঁকা হয়ে আছে। লোকজনের আনাগোনা কম। হাম্মাদ বাইকের স্পিড কমিয়ে দেয়। ধীরেধীরে রাস্তার গা ঘেঁষে চলেছে। কতদূর যায় তার কোনো হিসেব নেই। রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে বাইক থামায়। যুবক ছেলেটা দোকান বন্ধ করতেই যাচ্ছিল। হাম্মাদকে দেখেই সে হাসিমুখে এগিয়ে আসে।
“ভাইজান, আপনে! অনেকদিন পর আইলেন। সাথে ভাবিসাব নাকি! বহেন, বহেন।”, বলেই বেঞ্চটা টেনে কাপড় দিয়ে পরিস্কার করে দিল।
“রনি…”
সে কথা শেষ করার আগেই ছেলেটা বলল, “কাপ ভালো কইরা গরম পানি দিয়া ধুইয়া, চিনি কম দিয়া ভালো কইরা এক কাপ চা দিমু, তাই তো ভাইজান?”
“একদম তাই। তবে আজ এক কাপ নয়, দুই কাপ। আর হ্যাঁ, এক কাপে দুধ-চিনি বেশি করে দিয়ে দিবা।”
শতরূপা আশ্চর্য হয়ে তাকায়। সে চা কীভাবে খায় সেটাও জানে হাম্মাদ! এত তথ্য কীভাবে জানলো! হাম্মাদকে জানার আগ্রহ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে তার। দু’জনে নিশ্চুপ বসে চা খাচ্ছে। রনি তাদের চা দিয়ে দোকান বন্ধ করে চলে গেছে।
“আমি এখানে প্রায়ই আসি। ভাবলাম আজ তোমাকে নিয়ে আসি। রনির চা অনেক দারুণ স্বাদ না?”
“আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবেন?”
“কেন দিব না? প্রশ্ন করো আগে। প্রশ্নই বলে দেবে উত্তর দিব কী দিব না।”
শতরূপা চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে বলল, “কিন্তু আমি উত্তর চাই।”
“আচ্ছা, জিজ্ঞেস করো।”
“আমাকেই কেন বেছে নিলেন আপনি? আপনার পরিবারে বিরাট অবস্থা। ঢাকায় আপনার বিজনেস বেশ ভালো। চাইলে আপনি আমার থেকে ভালো মেয়ে পেতেন। তাহলে আমাকে কেন পছন্দ করলেন?”
মাথার চুলগুলোতে আলতো হাতে পেছনে নিয়ে মৃদু হাসে হাম্মাদ। শতরূপার দিকে মাথাটা ঈষৎ বাঁকিয়ে বলল, “তিন বছর আগে আমি বান্দরবান ভ্রমণে আসি। সেদিন গাড়িতে যখন জ্যামে আটকে ছিলাম তখন দেখলাম একজন মেয়ে একটা রক্তাক্ত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এই গাড়ি সেই গাড়ির কাছে দৌড়াচ্ছে। আগ্রহ ধরে রাখতে না পেরে যখনই আমি বের হতে যাব তখনই মেয়েটা ওই বাচ্চাকে নিয়ে আমার গাড়িতে উঠে বসে। বাচ্চার মাকেও সাথে নেয়। ড্রাইভারকে বলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমরা সোজা হাসপাতালে চলে যাই। মেয়েটা সেদিন হাসপাতালের বিল দিতে না পেরে তার স্বর্ণের নাকফুল খুলে দিয়েছিল। সেদিন সেই মেয়েটার মনে অন্যের বাচ্চাকে নিয়ে যে ভালোবাসা আমি দেখেছিলাম সেই ভালোবাসাটা আমার হৃদয়ে কড়া নেড়েছিল।”
শতরূপার চোখের মণিজোড়া স্থির নিষ্পলক। হাম্মাদের বলা কাহিনীটা তার খুব পরিচিত। ক্ষণকাল থেমে সে আবার বলল, “এরপর থেকে আজ অবধি একটা রাতও ঠিকমতো আমি ঘুমাতে পারিনি। একদিন বুঝলাম আমার প্রশান্তির ঘুমের জন্য সেই মেয়েটাকে চাই। তাকে খুঁজে পেতে আমার দুইটা বছর কেটে গেল। আমি এই শহরেই ছোট্ট একটা বিজনেস শুরু করলাম। ভাগ্য কতটা সহায় হতে পারে সেদিন বিশ্বাস করলাম যেদিন মেয়েটাকে আবারো দেখতে পেলাম। তখন থেকে শুরু হলো তাকে পর্যালোচনা করা। তার সম্পর্কে সকল খোঁজ খবর নেওয়া। প্রতিটা সেকেন্ড, মিনেটের খবর। আর সেই মেয়েটাকে আমি হারাতে চাইনি। তাই তো আজ, এখন সে আমার পাশে বসে আছে।”
পকেট থেকে নাক ফুলটা বের করে শতরূপার সামনে ধরে। এই অল্পক্ষণেই নিজেকে কারো গল্পের মূল্যবান একটা চরিত্রে দেখে নিলো সে। সে জানতেই পারেনি কেউ তার জন্যে এভাবে অপেক্ষা করেছে। এত আপন করে চেয়ে গেছে তাকে। চোখের পাতা ভিজে আসে শতরূপার। কিছুক্ষণ আগেও যাকে তার বিশ্বাস করতে বুক কাঁপছিল এখন মনে হচ্ছে তার কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতে। তাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলতে। জলভরা চোখে নাক ফুলের দিকে তাকায় সে। আজও তার নাকটা খালিই আছে। স্বর্ণের নাকফুল আর কেনা হয়নি। সেদিন যখন পথশিশুর এক্সিডেন্ট করে বাইকটা পালিয়ে যায় তখন সেই বাচ্চাকে বাঁচাতে বাবার দেওয়া স্বর্ণের নাক ফুল দিয়ে দিয়েছিল। আর আজ সেটাই তার সামনে। হাতে-পা কেমন কাঁপছে। মূহুর্তের মধ্যে এত সুখ পাওয়ার ছিল বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
“অনুমতি পেলে আমি নাক ফুলটা পরিয়ে দিতে চাই তোমায়।”
সে অপ্রস্তুত গলায় বলল, “আপনি পারবেন না।”
“কে বলল? আমি পারি।”
“পারি মানে? এর আগে কাউকে পরিয়েছেন?”
“না! তা নয়, কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি পারব।”
শতরূপা চোখের জল মুছে মৃদু হাসে। খানিকটা লজ্জা এসে ভর করে তার চেহারায়। নিচের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, “তাহলে চেষ্টা করে দেখুন।”
হাম্মাদের ফোনে একের পর এক কল আসছে। কিন্তু সাইলেন্ট থাকার কারণে তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে এই মূহুর্তে এইখানেই থাকতে চায়। নাক ফুল হাতে শতরূপার কাছে যায়। খালি গলায় ঢোক গিলে সে। হাম্মাদ আলতো করে তাকে নাক ফুল পরিয়ে দেয়৷ এতদিন পর নাক ফুল পরছে তাই কিছুটা ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নেয় যে। হাতের বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে গালে বারংবার স্পর্শ করে নাকের উপর ফুঁ দেয়৷ কেঁপে উঠে পেছনে সরে যায় শতরূপা। হাম্মাদ মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়।
গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “রাত বাড়ছে, চলো যাওয়া যাক।”
শতরূপাও তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়। বাইকে চড়ে সোজা বাড়ি চলে আসে। তাকে গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে হাম্মাদ বলল, “তৈরি থেক আমার স্বপ্ন সফলের সঙ্গী হতে।”
“আমি রঙিন সুতোয় স্বপ্ন বুনে যাব, আপনি শুধু অপেক্ষা করুন।”
হাম্মাদ আজকের মতো বিদায় নেয়। শতরূপা গেট দিয়ে ঢুকবে তখনই টের পায় কে যেন পাশের বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাতের আলোয় কারো স্পষ্ট ছায়া দেখতে পায় সে। কিছুক্ষণ তাকাতেই ছায়াটা চোখের আড়াল হয়ে যায়। শতরূপা তার উদ্ভট চিন্তা ভেবে ভেতরে ঢুকে যায়।
হাম্মাদের মা-বাবা এসেছেন বিয়েতে শামিল হওয়ার জন্য কিন্তু শতরূপার মেজ বোন ছাড়া বাড়ি থেকে কেউ আসেনি। মন খারাপ করে বসেছিল সারাদিন থেকেই। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে এক সপ্তাহের। বিয়েতে তার খরচ করার মতো তেমন টাকা তার হাতে ছিল না কিন্তু হাম্মাদের কাণ্ডে সব যেন কোথায় উধাও হয়ে যায়। সে একাই সব খরচ বহন করছে। কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা এমনকি বাড়িটাও সে মানুষ পাঠিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। যদিও তার ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। হাম্মাদ কারো কথা শুনে না। অতিরিক্ত জেদি স্বভাবের সে। এই ক’দিনে শতরূপা অন্ততপক্ষে তাকে এতটুকু চিনে নিয়েছে।
বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। আজ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। এরই মধ্যে হাম্মাদের সাথে শতরূপার কথার মাত্রা বেড়ে গেছে। যখন তখন ফোনে লেগে থাকে দু’জনে। মাত্র কথা বলে ফোনটা চার্জে দেয় শতরূপা। শায়ান সেই কখন থেকেই তার খুঁজে বেশ কয়বার কল করেছে। ফোনে না পেয়ে অফিস থেকে সোজা তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে। মাঝপথে তার বাইকটা বন্ধ হয়ে যায়। এক সাইডে বাইক রেখে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগে। আচমকা একটা গাড়ি এসে তার সামনে থামে। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই শায়ানকে টেনে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা