দৃষ্টিভ্রম পর্ব-০৪

0
802

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ০৪||

কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে শতরূপার গায়ে হাত দিচ্ছেন সিদ্দিক সাহেব। অফিসের বসের এমন আচরণের জবাবে কিছুই বলতে পারছে না সে। কেবল বসে উসখুস করছে। নিজেকে তার অশালীন স্পর্শ থেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করছে। প্রতিবাদ মূলক কোনো কথা বললেই চাকরি যাবে। চুপ করে সহ্য করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই। হাম্মাদ ভেতরে ঢুকতেই হতচকিত হয়ে সরে যান সিদ্দিক সাহেব।

অপ্রস্তুত গলায় বললেন, “আরেহ! খন্দকার সাহেব আপনি!”

হাম্মাদ বুঝতে পারে এখানে যা হচ্ছিল তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। সে চুপচাপ গিয়ে সিদ্দিক সাহেবের চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে রাখে। মোবাইলটা বের করে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠিয়ে কল দিয়ে বলল, “যেই এড্রেস দিয়েছি সেই এড্রেসে চলে আয়। কাম ফার্স্ট।”

পরিস্থিতির কিছুই বুঝতে পারছে না শতরূপা। হাম্মাদ কী করতে চাইছে। সিদ্দিক সাহেব কিছু বলতে যাবেন তখনই সে বলল, “যেখানে যেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন আগামী এক ঘন্টা ঠিক সেভাবেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”

এবার সিদ্দিক সাহেব বেশ ভড়কে যান। রেগেমেগে বললেন, “মানে! পেয়েছেন কী হ্যাঁ? কয়েকটা শহরে আপনার বিজনেস আছে বলে কী দেশের মাথা কিনে ফেলেছেন?”

টেবলে থাকা পানি ভর্তি কাঁচের গ্লাস তুলে ছুঁড়ে মারে সিদ্দিক সাহেবের দিকে। গ্লাসটা তার কাঁধ ছুঁয়ে পেছনে গিয়ে পড়ে। সাথেসাথে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

“এটা কোনো মিস ছিল ভাববেন না, এটা কেবল একটা সতর্কবার্তা ছিল। পরের বার আর মিস হবে না। মাথা ফাটিয়ে দিব একদম। নির্লজ্জ ইতর লোক। অফিসের স্টাফের সাথে অশ্লীল আচরণ করতে লজ্জা করে না? আজকে টের পাবেন মেয়েদের ইজ্জতে হাত দেওয়ার নতিজা কতটা ভয়াবহ হতে পারে।”

শতরূপা এতক্ষণ নিশ্চুপ বসেছিল। এতক্ষণে সে মুখ খুলে বলল, “দেখুন আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন প্লিজ। বিষয়টা আপনি বুঝছেন না।”

হাম্মাদ টেবিলের উপর হাত দিয়ে জোরে থাবা মেরে বলল, “তোমাকে এত বুঝদার হতে হবে না। আমার যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি। এবার যা করার সেটা করব।”

হাম্মাদ আপনি সম্বোধন থেকে নেমে তুমিতে চলে এসেছে। সে রেগে গেলে তুই বলে কথা বলতেও দ্বিধা করে না। এখানে তুমি করে বলছে এটাই অনেক বেশি।

“কিন্তু, আমার চাকরিটা যে…”,

শতরূপার কথা সম্পূর্ণ হতে দেয় না। তার কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “হুশ! একদম কথা না। নাহলে এই লোকের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিব।”

“কিহ! কী আশ্চর্য কথা! পাগল হয়েছেন?”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় শতরূপা। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে তার। এই লোকটা অনেক বাজেভাবে তাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাচ্ছে। এভাবে যদি সিদ্দিক সাহেবের সাথে বাজে কোনো আচরণ করে তাহলে তার চাকরিটা এবার গেলো বলে। ভাবনাটা মনের ভেতরেই রয়ে যায় আচমকা একজন পুলিশ অফিসার সাথে দুইজন কন্সটেবল রুমে এসে ঢুকে। হাম্মাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, “কিরে, এভাবে জরুরি তলব করলি যে?”

“ওই যে সামনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এই মেয়ের… না, তোর ভাবির সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। ইভটিজিং কেইসসহ, ধর্ষণের চেষ্টা বাদ বাকি যা যা আছে সব ঠুকে দে এর নামে। কমপক্ষে যেন দশ বছরের জেল হয়। আর হ্যাঁ, এক মিনিট।”, বলেই উঠে এসে সিদ্দিকের সামনে দাঁড়ায়।

মিলনকে ডেকে বলে একটা ব্লেড নিয়ে ভেতরে আসতে। হাম্মাদের কথামতো সেও ব্লেড নিয়ে আসে। কন্সটেবল দুইজনকে বলল, “মিলনের ষাঁড়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরো দেখি।”

তার কথামতো তারা কাজ করে।

“আরে আরে কী করছেন আপনারা! ছাড়ুন আমাকে। জানেন না আমার হাত কত লম্বা। অনেক উপরে আমার হাত। সবার চাকরি আমি নাই করে দিতে পারি।”

সিদ্দিক সাহেব অনবরত আবোল তাবোল বকেই যাচ্ছেন। হাম্মাদ ব্লেড দিয়ে তার মাথার চুল এখানে সেখানে একটু একটু করে কেটে দেয়। এমনভাবে চুল কাটে যে মনে হয় ইঁদুরে খেয়ে দিয়েছে। এর থেকে একেবারে ন্যাড়া করে দিলেই ভালো হতো। শতরূপা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ সিদ্দিক সাহেবকে ভ্যানে তুলে নেয়। অফিসের সবাই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছে।

“হাম্মাদ সাহেব আপনি পস্তাবেন, খুব বেশি পস্তাবেন। দেখে নিবেন যার জন্য আজ আপনি আমাকে জেলে পাঠাচ্ছেন সে মেয়েই আপনাকে সাত সাগরের নোনা পানি খাওয়াবে আপনি টেরও পাবেন না। আমার জায়গায় আপনার আসতে সময় লাগবে না হাম্মাদ সাহেব, সাবধানে থাকবেন।”, ভ্যানে বসে চিল্লাতে থাকেন সিদ্দিক সাহেব।

ধীরে ধীরে পুলিশের ভ্যানটা চোখের আড়াল হয়ে যায়। হাম্মাদ বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। শতরূপা তার পেছন পেছন হাঁটছে। সে আবার ভেতরে এসে বলল, “আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার সাথে কথা বলব। যে যেভাবে কাজ করছেন করে যান। এখন এই পদে আপনাদের নতুন বস আসবেন এবং তিনি অবশ্যই ভালো একজন মানুষ হবেন।”

শতরূপা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর আর এক মূহুর্তের জন্যেও সেখানে দাঁড়ায় না। হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে।

শায়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কি যেন ভাবছে। তখনই হাম্মাদ ভেতরে ঢুকে। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।

“আরে স্যার আপনি! আমাকে ডাকলেই তো হতো। আমি চলে আসতাম আপনার রুমে।”

“সব কথা তো আর তোমাকে ডেকে নিয়ে হয় না শায়ান। বস তুমি। কথা আছে কিছু।”

শায়ান হাম্মাদের কথামতো বসে যায়। হাম্মাদ ক্ষীণ গলায় বলল, “এখানে এসেছিলাম একটা কারণে। তুমি সেই কারণটা ভালো মতোই জানো। কিন্তু এই শহরে বিজনেসটা তো তেমন চলছে না। দ্রুত আমাদের কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। তখন সোজা ঢাকা ফিরে যাব। দুইমাস সময় দিলাম তোমাকে। যা করার তাড়াতাড়ি করো।”

“বিষয়টা আমি দ্রুতই দেখছি স্যার। আপনি চিন্তা করবেন না। কাজ এবার হয়ে যাবে।”

হাম্মাদের ফোনে একনাগাড়ে কল বেজে যাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে শায়ানের রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। কলটা রিসিভ করেই অফিস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। তাকে এখনই বাড়ি ফিরতে হবে।

শতরূপা বসে আছে শায়ানের সামনে। এই গরমেও রাস্তার পাশে একটা টং দোকানে চা খেতে এসেছে দু’জন। চায়ের কাপে চামচ লেগে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। এই শব্দটাও বেশ মনোমুগ্ধকর শোনায়। চায়ের স্বাদ নিতে নিতে গত দিনের সব ঘটনা খুলে বলে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথাটা বলতে মুখটা একটু এগিয়ে এনে মৃদুস্বরে বলল, “জানো হাম্মাদ স্যার এমন কী করেছেন কে জানে যে একদিনেই এখন আমি সেই অফিসের বস। আমার প্রমোশন হয়ে গেছে।”

শায়ান স্মিত হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “এটা তেমন কিছুই নয়। তুমি একবার স্যারের সহধর্মিণী হয়ে গেলে দেখবে তিনি তোমাকে দুনিয়া কিনে দেবেন। যথেষ্ট ভালো একজন মানুষ উনি। বিয়েটা করে নাও, সুখী হবে।”

স্বপ্নগুলো সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে শতরূপা। এতবড় একজন মানুষ তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন তাও ভালোবেসে! সুখ বুঝি এই তাকে ধরা দিল! জীবনে সুখী হতে হলে অনেক সেক্রিফাইস করতে হয় কিন্তু মানুষ সেই সেক্রিফাইসকে লোভ নামে আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ মনে মনে সবাই লোভী। যেখনে বদ্ধ উন্মাদেরও ক্ষুধা মেটানোর জন্য টাকা চাই। সেখানে সুস্থ মানুষের চাহিদা মেটাতে টাকার জন্য একটা দিক বিসর্জন দিলে তাকে লোভী বলা হয়। সে তখন সবার নজরে খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু যাদের নজরে খারাপ হয় সুযোগ পেলে তারাও লোভ ছাড়তো না। ভেতরে ভেতরে তারাও না পাওয়ার আফসোসে পুড়ে যা কেউ দেখে না। সমাজের কথা, নিজের পছন্দের কথা একবার না হয় সে ভাবা বন্ধ করে দিল। পরিবারের কথা ভেবে এবার তাকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। জানে না এই সিদ্ধান্ত ভুল নাকি সঠিক কিন্তু তার সামনে এর থেকে ভালো পথ আর নেই। সে না খেয়ে থাকলে যে সমাজ মুখে একবেলা অন্ন তুলে দিতে পারে না সেই সমাজের কথা ভেবে জীবনটাকে সরলরেখায় আর চলতে পারবে না সে। জীবনের শুভ্র পাতায় সরলরেখা টানতে টানতে ক্লান্ত সে। এবার একটু বক্ররেখা টেনেই দেখুক কোথায় নিয়ে যায় তাকে।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে