নিশিতা প্লিজ চোখটা ভালোভাবে মোছ। চোখ মুছে ঐদিকে গিয়ে বস, আমি খাবার কিনে আনি। আশেপাশের লোকে ভাববে আমি তোকে মেরেছি।
– এমন একটা স্যাড মুভি রিকমেন্ড কে করেছে তোকে? তুই জানিসনা আমার সিনেমা দেখে ভ্যা ভ্যা করার স্বভাব আছে।
নিশিতার কথা শেষ না হতেই পেছন থেকে কে একজন বলে ওঠে, আরে ফারিয়া যে? কতদিন পর দেখা?
– তামিম ভাইয়া, আপনি এখানে?
আমরা তো ঢাকা এসেছি অনেকদিন। বাবার পোস্টিংও এখন ঢাকায়। আর আমার চাকুরীও। তোমাদের ফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছে বলে মা ফোন করতেও পারেনা। দাঁড়াও আগে তোমাদের বাসার নাম্বার দাও। মা খুবই বোর ফিল করে ঢাকাতে।
– ওহ, পরিচয় করিয়ে দেই আমার বান্ধবী নিশিতা। নিশিতা, উনি তামিম ভাই। বলেছিলাম না আমার ক্লাস সেভেন পর্যন্ত কুমিল্লা থাকার কথা। তামিম ভাইরা আমাদের পাশাপাশি বাসার প্রতিবেশী ছিলেন।
তোমার বান্ধবী মানে নিশিতা আপনি ঠিক আছেন তো?
– ওহ ভাইয়া, ও সিনেমা দেখে একটু কেঁদে টেদে ফেলে আর কি মাঝে মাঝে। আপনি আর এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওকে বিব্রত করে দেবেননা প্লিজ।
এতো মন খারাপের সিনেমা হলে দেখার কি দরকার? আমাদেরটা দেখতে পারেন চাইলে। সেরকম কমেডি।
নিশিতার রাগী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কথা থামিয়ে দেয় তামিম। আচ্ছা আমি বরং আজ আসি। কথা হবে পরে।
‘ কেমন হতচ্ছাড়া ভাইরে তোর? আসেন কমেডি সিনেমা দেখি। আমার খুশী আমি সিনেমা দেখে কাঁদবো নাকি হাসবো।’
– আচ্ছা হয়েছে তো থাম। চল হাফ টাইম শেষ। সিনেমা শুরু হলো বলে।
নিয়তির অমোঘ ইচ্ছেতেই বুঝিবা তামিমের সাথে আবারও দেখা হয়ে যায় নিশিতার। বসুন্ধরার ফুডকোর্টে। পায়ে ব্যথা, এদিকে বাসার সবাই শপিংয়ে ব্যস্ত থাকায় নিশিতা একা এসে বসে একটা টেবিলে। ছুটির দিন বলে এমনিতেও উপচে পড়া ভীড়ে বসার জায়গা পাওয়াই দায় হয়েছিল।
‘আপনার চেয়ার দুটো কি ফাঁকা? বসতে পারি? আর কোথাও বসার জায়গা পাচ্ছিনা।’
গলার স্বরে চমকে মোবাইলের স্ক্রীন থেকে চোখ তুলে তাকায় নিশিতা।
‘আপনি ঐ যে সেদিন দেখা হলো ফারিয়ার সাথে, ওর বান্ধবী না?’
নিশিতার খুব বলতে ইচ্ছে করে জ্বি না আমি সে না। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, আপনার মেমোরি দেখছি খুব ভালো। বসুন কেউ বসেনি এখানে।
এক টেবিলে মুখোমুখি বসলে তো আর কথা না বলে থাকা যায়না। আর ততক্ষনে নিশিতার খাবারও চলে এসেছে। টুকটাক কথাবার্তা চলতে থাকে যার বেশীরভাগই গল্প না জমার মতই। কারণ দুজনের আগ্রহ বিপরীতধর্মী বিষয়ে। দুজনের কেউ কিছু না বললেও একে অপরের খাবারের দিকে তাকিয়ে যে দৃষ্টি দেয় তাতে দুজনের খাবারের পছন্দের পার্থক্য না চাইতেও বড় প্রকট হয়ে ওঠে। খাওয়া কোনরকমে শেষ হতেই তাই নিশিতা আমি আসি বলে উঠে পড়ে টেবিল থেকে।
সপ্তাহ কয়েক পার না হতেই আবারও দেখা। এবার বেইলী রোডের নাটকপাড়ায়। দৃশ্যপট আলাদা হলেও নিশিতা বা তামিম দুজনেই অবাক হয় এতোবার কেন একই মানুষের সাথে দেখা হতে হবে?
– আরে নিশিতা যে? আবারও দেখা?
হুম নাটক দেখতে এসেছিলাম। আপনিও বুঝি?
– মঞ্চনাটক? আমার এতো ধৈর্য্য নেই বাবা। আমি বন্ধুদের সাথে খেতে এসেছিলাম। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি কোথায় যাবেন? চলেন নামিয়ে দেই।
ধন্যবাদ। আমি একাই যেতে পারবো।
তারপর আর দেখা হয়না বেশ কয়েক মাস। এই ফাঁকে নিশিতার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। বান্ধবীরা মিলে রেজাল্টের আগে দূরে বেড়াতে যাবে, সেই প্ল্যান করতেই ফারিয়ার বাসায় একত্র হওয়া। সব বান্ধবীদের বিয়ে হচ্ছে হবে করছে, এই সুযোগ শেষবারের মতো ঘুরে আসার।
ঘটনাক্রমে সেদিন ফারিয়ার বাসায় উপস্থিত ছিল তামিমের মা বাবা। নিশিতারা বিদায় নেয়ার সময় পরিচয় করাতে নিয়ে আসে ফারিয়া।
দুদিন পর রাতের খাবারের সময় নিশিতার বাবা মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন। জানা যায় বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তামিমের বাসা থেকে। সেদিন ফারিয়াদের বাসায় নিশিতাকে দেখে ছেলের বাবামায়ের নিশিতাকে পছন্দ হয়েছে।
– বাবা, আমার বিয়ে করতে কোন আপত্তি নেই। তবে এই ছেলেকে না।
কেন কি সমস্যা এই ছেলের? বায়োডাটা তো বেশ ভালো। ফারিয়ার বাবা নাও বেশ রিকমেন্ড করলো।
– বাবা আমি যদি উত্তর মেরু হই এই ছেলে দক্ষিন মেরু। অন্য কেউ থাকলে বলো ভেবে দেখি।
মেয়ের অসম্মতিতে কথা আর সামনে আগায়না। বরং জানিয়ে দেয়া হয় তামিমের বাসায় নিশিতার বাসার অপারগতার কথা।
সপ্তাহখানেক পরে নিশিতার নামে কুরিয়ারে এক চিঠি উপস্থিত। প্রেরক স্বয়ং তামিম হাসান।
না করে দেয়ার পরও ঐ লোকের এতো সাহস, চিঠি পাঠায়? গজগজ করতে করতেই চিঠি খোলে নিশিতা।
নিশিতা,
অনলাইন, মোবাইলের যুগে কেউ চিঠি লিখে বলে আপনি আমাকে ব্যাকডেটেড ভাবতেই পারেন। আমার অবশ্য চিঠি লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায় মাথায় আসেনি। সামনাসামনি দেখা হলে হয়তো আবার কিছু একটা অমিল বেরিয়ে যাবে। আর মেসেজে হয়তো আমার মনের ভাবটুকু সেভাবে বোঝাতে পারবোনা বলেই কলম তুলে নেয়া।
বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন শুনে খুব একটা অবাক হইনি। আপনার সাথে আমার চিন্তাভাবনা বা পছন্দ অপছন্দের বেশ ফারাক। সেটা যে কয়বার দেখা হয়েছে প্রতিবারই ভীষণ প্রকট ছিল। তবু কি জানেন নিজের সম্পর্কে বোধহয় সবারই একটু উচ্চ ধারনা থাকে তাই এভাবে মুখের ওপর না করে দেয়াতে একটু মন খারাপ করেছি।
আমি গান শুনতে খুব পছন্দ করি। সেদিন সেই মন খারাপের সময়ে কোইনসিডেন্টালি যে গানটা বাজছিল রুমে সেটাই মূলত আমাকে এই চিঠি লেখার প্রেরণা যোগায়।
আমি লালন ভালবাসি
তুমি জিবরানের কবিতা,
আমার ভালো লাগে দিনের আলো
তোমার রাতের মৌনতা।
আমরা দুজন দুরকম
তবু কোথা যেন মিল অন্যরকম।
গান শোনার অভ্যাস থাকলে শুনে দেখতে পারেন। ভালো লাগবে।
আপনার সাথে আমার যতবার দেখা হয়েছে আমাদের মতের অমিলগুলো নিয়েই আমরা এমন ব্যস্ত ছিলাম যে বলার সুযোগ হয়নি আপনার ঐ প্রথমদিনের কান্নাভেজা ফোলা ফোলা চোখগুলোর মায়ার ঘোর আমার আজো কাটেনি। বসুন্ধরার ফুডকোর্টে কিংবা বেইলী রোডের ফুটপাতে আপনার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছিল বুঝি মনের অজান্তেই। তাইতো বাবা মা যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে আমাদের অমিলগুলো জেনেও বায়োডাটাটা আমিই তৈরী করে দেই।
রিজেক্ট করে দিয়েছেন দুঃখ নেই কিন্তু আবার আবেদনের সুযোগ পাওয়ার কি কোন সম্ভাবনা আছে? বলছিনা আমি আপনার মতো করে নিজেকে পাল্টে নেব। তবে আপনার পাশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টাটুকু অন্তত করবো। সুযোগ দেবেন কি?
– দ্য মোস্ট এলিজিবল বাট রিজেক্টেড ব্যাচেলর। (একটা হাসি আর একটা স্যাড ইমো হবে এখানে)
…………..
স্যার, আপনের একটা চিঠি আসছে, আপনের টেবিলে রাখসি।
প্রেরকের জায়গায় কারো নাম নেই। কে দিলো চিঠি? ভেতরেও কোন সম্বোধন বা ইতি নেই। তবু চিঠির ভাষা জানিয়ে দেয় এই চিঠির অপেক্ষাতেই যে দিন গুনছে তামিম।
‘গান শোনা এবং চিঠি লেখা এই দুটো স্বভাবজাত মিল থাকার কারণে প্রোবেশনারী পিরিয়ডের জন্য আপনাকে মনোনীত করা হলো। মানিয়ে নেয়ার পরীক্ষা দিতে চাইলে আজ বিকেলে বেইলী রোডের নাটকপাড়ায় সেদিনের জায়গায় দেখা হতে পারে।’
আচ্ছা নাটকপাড়ায় আজ কি নাটক চলছে? দুটো টিকেট কি আগেভাগেই বুকিং দিয়ে দেবে নাকি তামিম?
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস