দুজনা পর্ব-০৭

0
712

#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৭

আদিল ঠিক তার পরদিনই গ্রামে চলে আসে।তারপর আমি এবং আদিল ওই বাড়িতে যাই।আদিল ঘরের ভেতর ঢুকতেই আমার শাশুড়ী মা কোথা থেকে এসেই আদিলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেন!খুব কাঁদেন!আর কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

“ক’টা মাস আমার সাথে কথা বলিস নি তুই?আমার কথা কি একবারো তোর মনে পড়ে নি!?মাকে কীভাবে বুলতে পারলি তুই!”

আদিল উনার মাকে শুধায়,
“কেঁদো না মা।আসলে ভাগ্য সহায় ছিল না এই বাসার কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে।”

শাশুড়ী মা আদিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন
শাশুড়ী মায়ের মুখটা খুব শুকনো।চোখজোড়ার শীতল চাহনি।দেখেই বুঝা যাচ্ছে শাশুড়ী মা আদিলের জন্যে এই কয়দিন খুব মন খারাপ করেছেন।সবকিছুর উর্ধ্বে আদিল উনার সন্তান।আর সন্তানদের জন্যে মা-বাবার একটু হলেও মন কাঁদে।হয়তো তা প্রকাশ করে, বা করে না।এমন সময় আদিলের ভাই আসে।অত্যন্ত ব্যস্ততা ভঙ্গিতে সোফায় বসতে বসতে বলে,

“আসছিস তুই?কি নাকি হিসেবনিকেশ আছে? বুঝা,আমিও বুঝাই।আমার কল এসেছে খুলনা থেকে।সেখানে যেতে হবে জরুরী।তাও আসতাম না,খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। তোর ধাপাধাপিতে আসতে হলো!এবার তাড়াতাড়ি বল কি বলবি!”

আদিল বসলো ওর ভাইয়ের সামনের সোফায়।বললো,

“ব্যবসা তো খুব জমজমাট যাচ্ছে তোমার,না?”

আদিলের ভাই মুখটা অন্যদিকের রাখা দৃষ্টিটা এবার বৈচিত্র্যময় ভঙ্গিমায় ভরে যায়।আদিল হালকা করে গলা ঝাঁড়ে এবার মায়ের দিকে তাকায়।বলে,
“মা তুমি ওখানে বসো।আজ আমাদের যা কথাবার্তা হবে সবকিছুর তুমি সাক্ষী থাকবে।আর সাক্ষ্যও দেবে।”

এমন সময় আমার জা এবং ননদ আসে।জা বলে,
“মা কি সাক্ষ্য দেবে!মায়ের সাক্ষ্য দেওয়ার মতন কি আছে!”

আদিল ওর ভাবীর কথাটা উপেক্ষা করে গেলো।মায়ের দিকে আবার তাকালো।শাশুড়ী মা যেয়ে বসলেন।আমি আদিলের কাছাকাছিই দাঁড়িয়েছিলাম। আদিল বলে,

“তোমার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে তা তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে আর তা তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।যাইহোক এবার আসল কথায় আছি,এই যে ব্যবসা টা করছো ব্যবসাটা কি আগে বাবার ছিল না?”
“মানে কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”
“আগে আমার কথার উত্তর দাও!”

আমার ভাসুর এবার চিৎকার চেঁচামিচি করে উঠেন,
“এই সংসারের পেছনে আমার ষোঁল বছরের পরিশ্রম।যা ইনকাম করেছি সব এই সংসারের পেছনে ঢেলেছি।আমার সবকিছু এই সংসারে!আর তোদের ব্যবহারে আমিতো মানুষ না।আস্ত একটা রোবট!”

শাশুড়ী মা বলেন,
“আহা চিৎকার চেঁচামিচি করছিস কেনো?ঠান্ডা মাথায় বল।দেখ ও কি বলে।আর তুই বলবি।”
“দেখো মা আমি তো তোমার ছেলেকে কিছু বলিনি। উনার কথাবার্তা দেখো।”
“কি দেখবে?কি?এই মায়ের পেছনে আমার প্রতি মাসে মাসে সাত হাজার করে দেওয়া লাগছে।ওষুধ সব আমি খাইয়েছি!”

পাশ থেকে ননদ বলে,
“আমিও। মায়ের ওষুধে আমারও অনেক টাকা ছিল।”

আদিল বলে,
“আমার আগে কথা ত শুনবে।কথা শুনে তর্কাতর্কি করছো কেন?প্রিয়াদের বাসায় সেদিন খুব গরদ নিয়ে গিয়েছিলে আমার সাথে বোঝাপড়া করবে।আমিও করতাম।এখন তা করছো না।ঝগড়া করবে?”

“আমি ঝগড়া করছি না।ঝগড়া তুই করতে চাচ্ছিস।বাবা মারা যাওয়ার পর তোর সব খরচ আমি চালিয়েছি।তোর বিয়ের পরও তোর খরচ আমি চালিয়েছি।এই পরিবারটাও আমি চালিয়েছি!আর তুই না কি না বলিস আমার সাথে তোর বোঝাপড়া আছে!সাহস কত।সব বোঝাপড়া ত আমার তোর সাথে আসে।”

আদিল বললো,
“ভাইয়া তুমি একটু থামো।আমি বলতেছি।’

শাশুড়ী মা,
” আদনান থাম।শোন ও কি বলে।”

আমার ভাসুরের নাম “আদনান”।
ভাসুরের ক্ষিপ্রতা কিছুটা কমে এলে এবার আদিল বলে,
” আমি তোমার অনেক খরচ করেছি।তার হিসেব আমার কাছে।আমি তোমার সব শোধ করে দিব।আর আপুর জামাইয়েরও।”
“কবে দিবি!কবে?খুব তো দেমাক দেখাস!বাহ!”
“সেটার রাস্তা তুমি করবে।”
“মানে?”
“বিজনেস টা বাবা আমাকে এবং তোমাকে দিয়েছিল।সেখানের মালিকানা অর্ধেক তুমি,আর অর্ধেক আমি।কিন্তু যদি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে যাই,বাবা বিজনেস টা আমার নামেই দিবে বলেছিল।কারণ,বাবা তোমার নামে ব্যাংকে ত্রিশ লাখের মতন রেখেছিল ব্যবসা করার জন্যে।আর বাবা মারা যাওয়া মাত্রই সেই টাকা তুমি কি করেছো তার হিসেব এখন আমাদের কাছে নেই।বাবার ব্যবসাটারও হিসেব নেই।অথচ,সেই আমার পাওয়া হকটা তুমি নিয়ে নিলে।নিয়েছো,ভাই।নিতে পারো।এবার যেটা বলতাম,প্রিয়ার সাথে আমার বিয়ের পর আমি তোমার সেখানে গিয়েছিলাম।তুমি সেখানে আমাকে লেবারের মতন ব্যবহার করেছে।তোমাকে বলেছি আমাকে কিছুটা দায়িত্ব দিতে।দাও নি।আমি তোমার সব টাকা নিয়ে ভেগে যাবো,আবার দায়িত্ব দিলে তোমার থেকেও ধনী হয়ে যাই কিনা।যাইহোক বাদ ওসব কথা।আর আপু?তোমার স্বামীও আমার সাথে এইরকম ব্যবহার করেছে।সে কুলিদের সাথে আমাকে কাজ করতে দিয়েছে।এবার তুমিই বলো মা!তুমি যে বলতে প্রিয়া আমাকে নিয়ে আসে গ্রামে?প্রিয়া আনে নি।ও কখনো আমাকে বলে নি আসতে।আমিই চলে আসতাম শুধুমাত্র তোমার বড়ছেলের,আর দুলাভাইয়ের ব্যবহারে!হয়তো প্রিয়া এখন জানলো আমি কেন তখন ঘনঘন চলে আসতাম।আমিও কি সংসারের কথা ভাবি না?ভাবি!খুব ভাবি!কিন্তু সংসার ধরার মতন আমার হাতে কিছু নেই।খুব ইচ্ছে ছিল ব্যবসা করবো,একজন বিজন্যাসম্যান হবো।কিন্তু ডিগ্রীর সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছোটখাটো চাকরি জয়েন করি।এখন কি আর চাকরি আছে মা?”

আদিলের কথা শুনে আমার চোখজোড়া বসে গেল।স্বামীর মনে এত কষ্ট অথচ কখনো জানলাম না।আদিলের কথায় সবাই চুপ হয়ে গেলো!ভাসুর উসখুস করছেন।উসখুশ শ্লথে এনে মিনিট দুয়েক পর বলেন,

“বাবা মারা যাওয়ার সময় তোকে দেখতে বলেছে।আর বাবা কিছুই বলেনি।”
“হ্যাঁ,কিন্তু তার আগে বাবা যে হিসেব করে গেছে তোমার আমার সম্পত্তি নিয়ে?”
“বাবা মৃত্যুর সময় সব সরিয়ে নিয়েছে।আমাকে তোর হাতে রেখে গেছে।তোকে বাবার স্নেহে দেখতাম।এটাই!”
“করেছো স্নেহ?!”
“কম করেছি!?কম করলে সংসারে এত খরচ কে দিয়েছে শুনি!”
“শুনি না তোমার খরচ!তবে একটা কথা শুনে রাখো ভাই,পৃথিবীর সবাই স্বার্থন্ধেষী!আপন-পরের বিশ্লেষণ এরা বুঝতে চায়না।দোয়া করি আজীবন সুখে থাকো।চলে প্রিয়া?”

বলে আদিল বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।শাশুড়ী মা কাদতেছেন।
“আদিল?বাবা?আদনান?আমিতো এসবের কিছুই জানতাম না।আদিল কি বলতেছে!”
“সব অভিনয় আর মিথ্যে তোমার ছেলের!”

————————————————–
গোনে গোনে দুইটা বছর কোনোমতে আমাদের কেঁটে গেল।আমি বাচ্চাদের পড়িয়ে এসে ভারী পেঁটটা নিয়ে আমার ছোট্ট খুপরির মতন এসে বসলাম।খুব পানির পিপাসা পেয়েছে।শক্তি নেই উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে জগ নিয়ে পানি ঢেলে খেতে।মা পাশের রুমে শুয়ে আছে।মাকে যে ডেলে বলবো,”মা, এক গ্লাস পানি দাও।”
সেই অবস্থা টা নেই।আমাদের কোনো অবস্থা ই নেই এখন আর।এই দুইটা বছর খুব কষ্টে যাচ্ছে আমাদের।আমরা শহরের একটা গলির ছোট্ট ছোট্ট খুপরির মতন দুইটা রুমের বাসায় থাকি।
সেদিনের পর আদিল আমাকে এবং আমার মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।গ্রামে আর যায়নি।ওর ইচ্ছে আর যাবেও না।এখানে এখন আমি আশপাশের মহল্লার কয়েকটা বাচ্চা পড়াই।সকাল থেকে শুরু করি সন্ধে পর্যন্ত।আদিলও কোম্পানিতে খাটছে খুব।তবে বেতন নাই।আগের থেকে আরো খারাপ অবস্থা।
কোম্পানিটিতে লোকসান হচ্ছে খুব যার কারণে এম্প্লিয়িদের বেতন বাড়ার বদলে কমে যাচ্ছে।সংসার টা এখন আমার সাপোর্টেই চলে অনেকটা।সেই সময় ইন্টার পাশ করেছি।সেই টুকু দিয়ে পোলাপান দের পড়াই।আমার মায়ের অবস্থাও ভালো না খুব একটা বেশি।চোখে তেমন এখন আর দেখেন না।কানেও বেশি শুনেন না।বাবার শোকে,সংসারের অভাব-অনটনে কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছেন দিনেক দিন।আমি খাটের একহাতে শরীরের ভর রেখে আস্তে উঠে দাঁড়াই।পানি খাই।পেঁটে হাত বুলাই।বুলাতেই নড়ে উঠে পেঁটটা।পেঁটের দিকে তাকাতে তৃপ্তিময় হাসি ফুঁটে ঠোঁটে।আমার শরীরের এই আরেকটা মানুষের বসবাস!সাতমাস চলতেছে আমার।মেয়ে হবে কিনা ছেলে হবে তা জানি না।ভাবছি এবার টিউশনের টাকাগুলো হাতে পেলে আল্ট্রাসনোগ্রাফিটা করিয়েই নিব।এবার আর খরচের কথা ভাববো না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে