#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৫
আজকে দুইদিন হয়ে গেলো আমাদের বাসায় এসেছি।সেইদিন শাশুড়ী মায়ের ওমন কথায় আর থাকতে ইচ্ছে হয়নি।সবার সামনেই ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসি।আমার চলে আসাতে আমার শ্বশুরবাড়ির কারোই ওতটা ভ্রুক্ষেপ হয়নি!তবে আমার ননদ একটা কথা বলেছিল তখন আমার শাশুড়ী মাকে,,
” মা?ও যদি চলে যায় তাহলে বাসার কাজ করবে কে!”
আমি চাকরানী!আমাকে মাইনে বেতনে রেখেছে সবাই।আমি ওই বাড়ির বউ না!চোখজোড়া পানিতে আবারো টিপটিপ করে উঠে।ওড়নার কোণা দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে মোড়া থেকে উঠে বাবার ঘরে আসি।বিছানায় শুয়ে থাকা বাবার কংকাল দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ!ভেতরটা কেঁদে উঠে আবার।এই কষ্টটা ওই কষ্টটা থেকেও বেশি!খুব বেশি!আজ আমার বাবা যদি সুস্থ থাকতেন,বাবার অনেক টাকা থাকতো শ্বশুর বাড়ির সবার কাছে আজ ভালো থাকতাম!
———————————————————
পাঁচদিনের মাথায় হঠাৎ আমার শাশুড়ী মা কল করলেন আমার ফোনে।স্ক্রিনে উনার নাম্বারটা দেখে যদিও অবাক হলাম কিছুটা, তবে নিজের স্বার্থব্যতীক কলটা যা ছিল না তা আমি নিশ্চিত ছিলাম।কল রিসিভ করি।সালাম দিই।সালামের জবাব নিয়ে বলে উঠেন,
“বাসায় আসবে কবে?বাসায় আসার যে নামগন্ধ দেখছি না তোমার!ব্যাপার কি!”
কথাগুলো খুবই নমনীয় ছিল।আরো বেশি অবাক হলাম।ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বললাম,
“জ্বী, যাবো!”
“কবে আসবে?”
“দেখি।”
“এত দেখাদেখির সময় নাই।স্বামীর বাড়ি।চলে আসবে।রাখলাম!”
আমি চুপ করে রইলাম।শাশুড়ী মা কল কেটে দিলেন।তবে শাশুড়ী মায়ের কথাগুলো এভাবে বলার কারণটা বের করতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না।আদিল আবার কল করতেই পরিষ্কার হয়ে যাই।আদিল শাশুড়ী মাকে সাত হাজার টাকা পাঠিয়েছে আজ সকালে।আর টাকাগুলো ধার করেই দিয়েছে আদিল।যদিও আদিল তার ধার করার ব্যাপারটা তার মাকে বলে নি।তাছাড়া বললেও কি লাভ হত!আমি এ’কদিনে উনাকে যতটুকু বুঝলাম উনার কাছে টাকাই সব।টাকা থাকলে সম্পর্ক, না থাকলে দূরসম্পর্ক!
আজ আদিল টাকা দিয়েছে তাই আমাকে যেতে বলেছে।আমি আদিলকে বলি তার মা আমাকে তাদের বাড়িতে যেতে বলেছে।আদিল বললো,
“যেয়ে বেড়িয়ে আসো তাহলে ক’দিন।”
আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাসলাম!আমার হাসিটা আদিলের একদমই ভালো লাগলো না।আতঙ্কের মতন হয়তো ওর কাছে লাগলো।সচকিত মস্তিষ্কে বলে উঠলো সাথে সাথে,
“কি হয়েছে প্রিয়া?যাবে না কেন?”
টাকা না দিতে পারে নি তাই কিছুই খেতে দেয়নি দুইদিন ওই বাড়িতে আমাকে।উনার মায়ের এই বিষয়টা আমার উনাকে বলা হয়নি।আমাদের বাসায় এসেছি বেড়াতে;অজুহাত দিয়েছি তাকে।এভাবে কত য অজুহাত দিয়েছি তাকে!কত যে মিথ্যে বলেছি!আমি হুট করে কেনজানি আদিলের কলে তখন শব্দ করে কেঁদে উঠি মনের অজান্তে!আদিল,
“হ্যালো প্রিয়া?হ্যালো?হ্যালো?কি হয়েছে তোমার!”
কি হয়েছে কি হয়েছে বলতে বলতে আদিলের বলা কথনের মাঝে আমি কল কেঁটে দিয়েছি।এখনো বাজতেছে কল।এই নিয়ে পাঁচশোর বেশি কল করেছে আদিল।আমার মায়ের ফোনেও!কিন্তু একটা ফোন থেকেও আদিলের সাথে কথা বলা হয়নি আমার!আমি জানি না!আমি কেমন জানি।আমার সাথে খারাপ, খুব খারাপ কিছএ ঘটলেও কেনজানি চুপচাপ থাকতে পার।এটা কি আমার স্বভাব নাকি মুড অফ তা জানি না,নাকি অন্যকিছু!তবে এটা সত্য আমি এখন আর পারতেছি না!আর পারতেছি না।
মা দুপুরের পর থেকেই আমার এহেন অস্বাভাবিক ব্যবহার লক্ষ করতেছেন।তবে কিছু বলছেন না,অথবা জিজ্ঞাসা করারও সুযোগ খুঁজতেছেন হয়তো তা পারছেন না!রাতের খাবার যখন আমার রুমে নিয়ে আসেন মা তখন আর চেপে রাখতে পারেননি।একপ্রকারে বাধ্য হয়েই,
“প্রিয়া মা?আদিলের সাথে কিছু হয়েছে তোর?”
পাশে বসতে বসতে।কিছু বলি নি আমি।চুপ করে থাকি।মাও চুপ করে থাকেন আমার দিকে তাকিয়ে।কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর আমি দীর্ঘ একটা হাঁক ছেড়ে ছোট্ট-ধীরে কন্ঠে বলি,
“তুমি না বলেছিলে মা শাশুড়ী মায়ের কথা স্বামীকে কিছু না বলতে।আবার স্বামীর কথা শাশুড়ী মাকে কিছু বলতে?তুমি কি জানো?এই যে স্বামীকে না বলা কথাগুলোতে শাশুড়ীর কত বড় বড় অপরাধ থাকে!”
মা আমার কথা ঠিক বুঝলেন না।বললেন,
“বুঝি নি প্রিয়া!”
থাক বাদ দাও!
——————————————–
রাত একটায় দরজায় খটখট আওয়াজ!আমি শুয়েছি মাত্র।রুমের বাইরে থেকে মায়ের হাঁটাহাঁটির আওয়াজ আসছে।কে এসেছে বলতে বলতে গিয়ে দরজা খুলে দেন।দরজা খুলেই,
“আরে আদিল বাবা যে!এতরাতে!”
আমি সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠল বসি।আদিল বলে
“জ্বী। প্রিয়া কোথায় আম্মা?”
“ও ওর ঘরেই আছে।”
আদিল হয়তো মাকে আর কিছু বলি নি
আমার রুমের দিকে চলে আসে।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে আমার দিকে তাকায়।
“এতরাতে আপনি গ্রামে চলে এলেন!”
আদিল আমার কথা অগ্রাহ্য করে আমার কাছে চলে এলো।আমার দুই কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে,
“কি হয়েছে প্রিয়া তোমার?তুমি আমার কল কেন রিসিভ করো নি!কি হয়েছে তোমার?বাসার কারো সাথে কিছু হয়েছে?বলো কিছু হয়েছে?”
আমি এখন বুঝলাম আদিল এতরাতে বাসায় আসার কারণ!মানুষ পাগল হয় শুনলাম।কিন্তু এতটা মাত্রাতিরিক্ত পাগল আদিলের মতন কাউকক দেখি নি!আমার মুহূর্তে আবার কান্না চল এলো।আদিলের বুকে মাথা রাখলাম।আদিল মাথায় হাত রাখলো।আবার বললো,
“বলো আমাকে?কি হয়েছে?প্রিয়া?প্রিয় পাখি আমার!বলো!”
আদিলের এতটা আদর মিশ্রিত কন্ঠে আমি আরো বেশিই ঠায় করতে থাকলাম ওর মাঝে।কেঁদে উঠলাম আওয়াজ করে এবার।খুব কাঁদতে থাকলাম।আদিল আর কিছু বললো না আমাকে!চুপ করে রইলো।ওর চুপ থাকাটা আমার কেনজানি অন্যরকম লাগলো।মনে হলো ও আমার ভেতরের কথা ধরে ফেলতে পেরেছে সব!
———————————————————
আদিল সব জেনে গেছে!আমার চাচীমা আদিলকে সব বলে দিয়েছে।আদিল এটা নিয়ে ওর মায়ের সাথে,বোনের সাথে এবং ভাবীর সাথে খুবব লেগেছে,
“আমার বউয়ের সাথে তোমরা যা করলে তোমরা মানুষ না।তোমরা জানোয়ার থেকেও খারাপ!টাকাই তোমাদের কাছে বড় হয়ে গেল?ও কি এই বাড়ির বউ না?ওর কি এই বাড়িতে কোনো অধিকার ছিল না?গাধার মতন চাকরানীদের মতন ওকে খাটিয়ে আবার টাকাড বড়াই দেখাচ্ছো।লজ্জা করছে না তোমাদের!এতটা নীচক, খারাপ এবং জঘন্য কেন তোমরা!ঠিক আছে এই সংসারে যত যা খরচ করেছো আমাদের পেছনে সব দিয়ে দিব!সব!তোমার মেয়ের জামাইয়ের কত টাকা খরচ হয়েছে সব হিসেব আমার কাছে আছে!আর তোমার বড় ছেলেরও!তবে,তোমার বড় ছেলের সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া আছে!”
জা বলে উঠেন,
“বোঝাপড়া মানে?কিসের বোঝাপড়ার কথা বলতেছো তুমি?”
“সেটা তোমার স্বামী আসুক!”
পাশ থেকে ননদ এবার বলে উঠেন,
“কত টাকার ক্ষমতা হয়েছে তোমার,শুনি?চলো ত আমাদের উপর।তাও জীবনে দুই বছরে কাজে লেগে এই প্রথম মায়ের হাতে সাত হাজার টাকা দিলে!আমার স্বামীর যা এই সংসারে খরচ হয়েছে তোমার সারা জীবনের পরিশ্রমেও শোধ করতে পারবে না!আবার আসছো বড়াই দেখাতে?!”
“তোমাকে কি বলেছি এই বাসায় থাকতে?আর আমাদের মাথার উপর থেকে থেকে খরচের কথা বলতে?তোমার স্বামীর বাড়ি নাই?সেখানে থাকছো না কেনো?এই বাড়িতে কি তোমার!কি এই বাড়িতে!নিজের বাড়ির পথ মাপো!তারপর খরচের কথা তুলো!দেখবো তুমি কেমন খরচ করো এখানে!”
“মা শুনেন ওর কথা!”
“আদিল?বড় বোনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“ছোট্টদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তোমার মেয়ে শেখে নি।ওহ আমিতো ভুলেই গেলাম তুমি বোধহয় শেখায় নি!”
আমি আদিলকে থামাতে গেলাম।
“দয়া করে আর তর্কাতর্কি করবেন না!রুমে চলুন!”
আমার শাশুড়ী মা,
“তুই ই তো আমার ছেলের মাথা খেলি এখন আসছিস নাটক করতে?বন্ধ কর তোর নাটক!”
“উঁচু আওয়াজে কথা বলো না মা!ভুলে যেও না ওর এই বাড়িতে অধিকার আছে!”
“প্লিজ চুপ করুন এবার!আল্লাহর ওয়াস্তে থামুন!”
“আমি যদি আর কখনো ও শুনি আমার বউকে কিছু কেউ বলেছে,বা করিয়েছে সত্যি সেদিন আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।মনে রেখো সবাই!”
বলেই আদিল সবাইকে পাশ কেঁটে রুমে চল যায়।তারপর শাশুড়ী মা, ননদ এবং জা উনারাও মুখটা আমার দিকে বাঁকিয়ে একে একে সবাই চলে যায়য়।আমি রুমে চলে আসি তারপর!আদিলের কাছে আসতেই,
“অনেক বোকা মেয়ে দেখেছি!কিন্তু তোমার মতন বোকা মেয়ে আজ দেখেছি!মানুষ এতটা বোকা হয় কীভাবে প্রিয়া?কীভাবে?এতকিছু হলো,এতকিছু ঘটলো আমাকে এর টু শব্দও শোনালে না!আমার সাথে আর কথা বলবে না।আর না!তোমার মতন বোকা মেয়েদের সাথে আমি কথা বলবো না!দূরে যাও আমার সামনে থেকে।”
আদিলের অভিমান করা দেখা হাসি চলে এলো আমার খুব!এবার আরো উনার কাছে গেলাম-দেখি উনি কতটা দূরে রাখতে পারেন! নাহ, উনি মোটেও আমাকে ঘেঁষতে দিলেন না!আরো উল্টো বলে উঠলেন,
“মার দেব!”
“দিন! দিন!আপনার হাতে মার না শুধু চুম্মাও সারাজীবন খেতে রাজি!”
বলেই সটাং শক্ত করে,খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।আর বলতে থাকলাম,
“জীবনেও আপনার থেকে দূরে সরাতে পারবেন না।এভাবে আঁটার মতন লেগে থাকবো!হু!”
এমন সময় আমার উন্মুক্ত ঘাড়ে আদিলের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম।আর রফাদফা কেঁপে উঠলাম। বুঝতে বাকি নেই স্বামী আমার অভিমান ভেঙ্গে গেছে।আর বউকে তার আদর করা শুরু হয়ে গেছে!
চলবে……