#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২১
#বর্ষা
জারিফের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হয়েছে।এত দ্রুত সব হয়ে গেল যা বলার বাইরে। অবশ্য মৃত্যুদন্ড না হয়ে যাবৎ জীবন কারাদন্ডও হতে পারতো! জারিফের মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০,বাংলাদেশ অনুযায়ী। কেননা ব্রিজের নিচে যাকে রেপ করা হয়েছিলো সে আত্মহত্যা করেছে। খোঁজ মিলেছিলো সেই মেয়ের পরিবারের।তারা সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি রেখেছে।মেয়েটার মোবাইলটাও হস্তান্তর করেছে।
জারিফের মৃত্যুদন্ডের সংবাদ শোনা মাত্রই আদালত থেকে বেরিয়ে জোভান হামলে পড়েছে কুহেলিকার উপরে।একেতো পাবলিক প্লেস , তার ওপর আদালত।ফায়দা লুটে নেয় কুহেলিকা।অন্য জায়গায় যদি আঘাত করে তাহলে সেটা হয়তো তাকে আসামী করবে। কিন্তু এখন তো জোভানই হামলা করেছে তার ওপর তাও আদালতে।কুহেলিকা জোভানের গোপনাঙ্গ বরাবর হিল পায়ে লাত্থি মারে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জোভান।
পুলিশ সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিলো প্রায় জোভানকে ধরতে।একটা মেয়ের গলা চিপে ধরেছে পুলিশ কি কিছুই করবে না!কুহেলিকা কাঁশতে থাকে।লাত্থি তো মেরেছে সর্বশক্তি দিয়ে।তবে এখন ওর নিজেরই মাথা ঘুরাচ্ছে,দম বন্ধ হয়ে আসছে,শ্বাস নিতে পারছে না।নাহিনের নিষেধ মান্য করা উচিত ছিলো।নাহিন আদালতে আসতে নিষেধ করেছিলো তাকে।
পুলিশ সদস্যরা ধরাধরি করে দু’জনকেই হসপিটালে আনে। যেহেতু পাব্লিক প্লেসে হয়েছে এমনটা তাই খুব দ্রুতই সংবাদ মাধ্যমেও প্রচারিত হতে থাকে এই ঘটনা।
নাহিন মিটিং এ ব্যস্ত।তবে ওর মা বারবার ফোন দিয়েই চলেছে।দুই দেশে সময়ের পার্থক্য আছে। সিঙ্গাপুর তো দুই ঘন্টা এগিয়ে।জরুরি অবস্থায় আজই গিয়েছে সে।দুইদিন থাকতে হবে। নতুন প্রজেক্টের কাজে।কুহেলিকাকেও আসতে বলেছিলো।তবে কুহেলিকা নাসরিন সুলতানার বাহানা দিয়ে আর যায় না।তবে কে জানো পন্ডিতের মাথায় কি ঘুরছে!
নাসরিন সুলতানা একাধারে ছেলেকে বলেন কি হয়েছে।নাহিন তো পাগল হয়ে যায়। মিটিং তো শেষই ।ছুটে বেরিয়ে যায় মিটিং রুম থেকে। উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ।তবে আজকের আর ফ্লাইট নেই বাংলাদেশের। নাহিনের ইচ্ছে হচ্ছে সব ভেঙে লুটিয়ে দেওয়ার।তখনই নাহিনের ফোনে ভেসে ওঠে কুহেলিকার নাম্বার।
”এই মেয়ে আমার একটা কথাও তোমার ভালো লাগে না তাই না!সব সময় বেশি পন্ডিতি করতে কে বলছে তোমায়!আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো কিভাবে বাচতাম আমি”
নাহিন একাধারে কথা বলে।ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় কুহেলিকা বলে,
”এতো দ্রুত কিছু হবে না।শুনুন কিসের জন্য ফোন দিয়েছি।”
”কিসের জন্য?”(নাহিন)
”আমি মিষ্টার জোভানের নামে কেস করবো”(কুহু)
”করো”(নাহিন)
”আমার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তুমি থাকো।আর শোনো প্রজেক্টের কাজ যেন ঠিক ভাবে চলে। প্রজেক্টে ভুল হলে তোমার খবর আছে”(কুহু)
”ইয়েস বস”
নাহিনের শেষ কথায় কান্না যেমন প্রতিয়মান।ঠিক তেমনি হাসিটাও বিদ্যমান। সবচেয়ে ভয়ংকর অনুভূতি একসাথে হাসি-কান্নার মাঝেই যে লুকিয়ে।কুহেলিকা ফোন কেটে দেয়।দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকায়।ওমা,কাকে দেখছে ও!কায়েস মির্জা এসেছেন।কান্না ভেঙে পড়েন।কুহেলিকার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে থাকেন।কুহেলিকা ক্যানোলা হাতে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে টুলে বসায়।হাত দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।তবে সেদিকে পাত্তা দেয় না কুহেলিকা।
”মারে আমাকে ক্ষমা করে দিস।তোর থেকে অনেক সত্য লুকিয়েছি।এই লুকিত সত্যের বোঝ যে আর বইতে পারছি না। আজ যখন তোকে হারানোর খবর শুনলাম মনে হলো রুহটা বেরিয়ে গেলো।আত্মগ্লানিতে ডুবলাম সত্য লুকানোর।আজ তোকে সব বলতে চাই।”
কায়েস মির্জার চোখে জল।কুহেলিকা জানে তিনি কি বলতে চলেছেন।তবে কুহেলিকাকে অবাক করে কায়েস মির্জা আরো গভীরের তথ্য বলতে লাগলেন,
”দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার।এখনো স্পষ্ট স্মরণে আছে। তানজিল চৌধুরী আর ডায়ানা দেশে আসলো।ওহ তোকে তো বলাই হয়নি ওরা কারা।ওরাই তোর আসল মা-বাবা। চৌধুরী বংশের ছেলে তোর বাবা তানজিল চৌধুরী।তাই তোর সব কাগজেও চৌধুরী আর ডাকেও চৌধুরী।
তুই তখনও ভূমিষ্ঠ হোসনি।তোর বাবা হয়তো আমাদের চিনতে পারেনি।তবে কাসেম ভাই তোর বাবাকে চিনে ফেলেছিলো।তোর বাবা কক্সবাজার গিয়েছিলো ঘুরতে।আর আমরাও ফ্যামিলি পিকনিকে গিয়েছিলাম সেখানে।আব্বা যাননি।
তানজিলের সাথে কাসেম ভাইয়ের ধাক্কা লেগেছিলো। তানজিল তখন যুবক।রক্ত টগবগে।ভাইয়ের দোষ থাকা সত্ত্বেও ভাই অগ্রাহ্য করে তানজিলকে মারতে গেলে তানজিল হাত মুচড়ে ধরে।সেদিন থেকেই যেন ঝামেলার সূত্রপাত হয়।
তার একবছর কয়েকমাস পর আমরা গেলাম কোরিয়ায়। তুই ভূমিষ্ট হয়েছিস।আব্বাই নিয়ে গেল আমাদের। তানজিলকে দেখে ভাইয়ের মনে পড়লো সেই অপমানের কথা।আর ভাইয়ের অপমান মানে আমার অপমান এমনই ছিলো তখন আমার ধারণা।
তোর মতো মিষ্টিকে তখন মনে জায়গাও দেইনি।ফিরে আসলাম দেশে।কয়দিন পরেই খবর এলো তোদের ওখানে সবাই মারা গেছে।জাস্ট তুই বেঁচে আছিস।আব্বা তোকে নিয়ে আসলো।তবে জানিস তো এই হামলার পেছনে সম্পূর্ণ ভাবে আমিই দায়ী!”
কুহেলিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।কায়েস মির্জা নিজের অপরাধ শিকার করেছে!কায়েস মির্জা একা করেছে এমনটা!কেন করলো।সেই অপমানের কারণে! সেই ক্ষুদ্র অপমানের কারণে এতো বড় স্টেপ!কুহেলিকার ভাবনার মাঝেই কায়েস মির্জা আবারো বলতে শুরু করেন,
”তুই হয়তো ভাবতে পারিস আমি খুন করেছি অপমানের প্রতিশোধ। আসলে এমনটা নয়।দেশে আসার পর আব্বা জানালেন যে আমরা শুধু মির্জা বংশের সম্পত্তি পাবো। চৌধুরী বংশের সম্পত্তি তিনি লিখে দেবেন তানজিলকে।
এমনিতেও সেই অপমান তার ওপর আবার সম্পত্তি না পাওয়ার ক্ষোভে আমার বিবেক লোপ পায়।ভাইয়ের উত্তেজনামূলক কথাবার্তায় আমি পাগলপ্রায় হয়ে উঠি তোদের রক্ত ঝড়াতে। ভাইয়ের খাস লোক টিংকুর সাহায্যে কোরিয়ায় লোক পাঠাই।ততদিনে তোরা ওখান থেকে চলে এসেছিস।তারপর আমি বহু কষ্টে তোদের ঠিকানা জোগাড় করে সেখানে লোক পাঠাই।সিলিন্ডার ব্লাস্টের প্ল্যান ছিলো।তবে তোদের সিলিন্ডারের ব্যবস্থা তো ছিলো না।তাই গুলিবিদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করি।আর তাতেই সফল হই।তবে তুই কোনো ভাবে বেঁচে যাস।
আর এদিকে তোদের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি পাই আমার সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েটার মৃত্যুতে।ক্ষোভ যেন তোর প্রতি আরো বাড়ে।একেই হারিয়েছি সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান।তার ওপর আব্বা তোকে এনে জানায় তুই পাবি তার সব সম্পত্তি।তোর আঠারো বছর হওয়ার আগে যদি তোর কিছু হয় তবে সেই সবসম্পত্তি সরকারের হাতে চলে যাবে।তাই তোকে মানুষ করার দায়িত্ব নিলেও উদ্দেশ্য ছিলো তোকে হত্যা করা।”
কুহেলিকা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে।কায়েস মির্জা চোখের পানি মুছে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন,
”রুমানা আর জুলফিকারকে ছেড়ে দিস মা। ওদের অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। খোঁজার চেষ্টা করিস না।ভালো থাকিস।আর অভাগা,শয়তান এই লোকটাকে পারলে ক্ষমা করিস।ক্ষমা করিস মা”
কুহেলিকার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে।চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুরা।কায়েস মির্জা চলে যায়।কুহেলিকা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।ওর ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদার।পারছে না ও।নিরব অশ্রু বিসর্জন দেওয়াই যেন হয়ে উঠেছে ওর লক্ষ্য।
তানজিল চৌধুরী কেবিনে প্রবেশ করে দেখতে পান মেয়ের হাত দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।ক্যানোলা চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে।সে ছুটে যায় মেয়ের কাছে। কাসফিয়া চৌধুরীও এসেছে। ভাইয়ের হায়হুতাশের শব্দে দ্রুত এগিয়ে আসে এদিকে। উদ্দেশ্য ছিলো কুহেলিকাকে দেখা।তবে আরো গুরুতর অবস্থায়!
কাসফিয়া চৌধুরী দ্রুত হাত থেকে ক্যানোলা বের করে হাতে ড্রেসিং করার ব্যবস্থা করেন।ব্যান্ডেজ করে দেন হাত।কুহেলিকা জ্ঞানহীন।বুক ফেটে যাচ্ছে তানজিল চৌধুরীর। বোনের সামনে মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতেও পারছেন না তিনি। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।জানা যায় কায়েস মির্জা আত্মগোপন করেছেন। স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আজ অব্দি করা তার অপরাধ সমূহের।তবে ঢাকাতেই কেন!
হঠাৎ তানজিল চৌধুরী ছুটে বেরিয়ে যায়। সিসিটিভি রুমে এসে সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে আকুতি মিনতি করে ভিডিও ফুটেজ দেখে।মেয়ের এই অবস্থার পেছনে কে দায়ী বুঝতে পারে। তবে বুঝতে পারে মেয়ে তার এই দূরাবস্তাতেও মায়ের খুনির শাস্তি পাইয়ে দিয়েছে।
তানজিল চৌধুরী ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কাসফিয়া চৌধুরী অবাক হোন ভাইয়ের এই কাজে। লজ্জায় পান ভাইয়ের কি তবে অল্প বয়সের এই মেয়েকে ভালো লাগলো নাকি! নিজের চিন্তায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানান। তানজিল চৌধুরী মেয়েকে রেখে বোনের হাত ধরে বলে ওঠে,
”আপা আমার মেয়েকে তুই বাঁচা।ও আপা ও যে আমার মেয়ে।আমার মেয়ের জীবন ভিক্ষা দে আপা।ওর জানি কিছু না হয় আপা”
কাসফিয়া চৌধুরী হতভম্ব।তার ভাই আর তার ভাস্তি তার থেকেই তাদের পরিচয় কি সূক্ষ্মভাবে গোপন করলো! কাসফিয়া চৌধুরী রাগ করেন না।তবে মনে প্রশ্নটা থেকেই যায় কুহেলিকা যদি তানজিলের মেয়ে হয় তবে কায়েসের মেয়ে কোথায়!
চলবে কি?