#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৮
#বর্ষা
নাহিন রেগে আগুন হয়ে আছে।এই বাড়ির মানুষগুলো কতটা নির্লজ্জ হলে এমন কাজ করতে পারে নাহিন ভেবে পায় না।কুহেলিকা এখনো পৌঁছায়নি। কোথায় গেলো মেয়েটা?ফোনও অফ।নাহিনের চিন্তার মাঝেই তার রুমে আসে মিসেস রাইসা জুনায়েদ মির্জা।সঙ্গে তার রোহানী।রাইসা এগিয়ে এসে খোঁজ খবর নেয়,নাহিন ভদ্র ভাষায় জবাব দেয়।তবে রেগে যায় রাইসার পরবর্তী কথাগুলো শুনে।
—নাহিন ভাই তুমি এতো সুদর্শন তোমার পাশে কি কুহেলিকাকে মানায়?
রাইসার কথায় চোখ তুলে তাকায় নাহিন।রাগ যে উঠেছে তা দাঁত চেপে সহ্য করছে।সে দেখতে চায় এই পরিবার কতটা নামতে পারে তা।রাইসা আবারো বলে ওঠে,
—আমাদের রোহানী এখানে থেকে মাস্টার্স করছে। একদম লাখে একটা মেয়ে।তো..
—তো?
—তুমি তো অবিবাহিত। আমাদের রোহানীও অবিবাহিত, সুন্দরী,স্মার্ট।তোমার সাথে কিন্তু রোহানীকেই মানায়!
—তাই?
—হুম।
—আমি কোনো মডেল নই যে আমার ম্যাচিং কাউকে লাগবে।আর আমি কোনো মডেলকে বিয়েও করতে চাই না।আমার কাছে আমার কুহেলিকাই সেরা।সেই থাকবে এবং সেই আছে।ভুলেও দ্বিতীয়বার আমার সামনে আসবেন না আপনারা।
নাহিনের ধমকে ভয় পেয়ে বেরিয়ে যায় রাইসা আর রোহানী।তবে রোহানীর ভেতরটা জ্বলছে। কেননা আজ অব্দি সেই শুধু রিজেক্ট করেছে কিন্তু এই প্রথম সে রিজেক্টেড হয়েছে।রোহানী ক্রোধে,লজ্জায়,অপমানে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সশব্দে দরজা লাগায়।নাহিন বিরবির করে বলে ওঠে,
—বেয়াদব।
—কাকে বেয়াদব বলছেন মহাশয়?
কুহেলিকা ক্লান্ত ভাবে এগিয়ে এসে নাহিনের সামনের চেয়ারে বসে।নাহিন মোবাইলে সময় দেখে।রাত দশটা পনেরো মিনিট।নাহিনের মেজাজ খারাপ হয়।এই মেয়েটা এখানে এসে কি অনিয়ম করছে।নাহিন রাগ দেখানোর পূর্বেই কুহেলিকা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,
—আমার আপনাকে প্রয়োজন নাহিন,আমার আপনাকে চাই,আমি আপনাকে অনুভব করতে পারি নাহিন। আপনি কি আমার হয়েই থাকবেন সারাজীবন?
নাহিনের রাগ গলে পানি হয়ে যায়।কুহেলিকার ক্লান্ত বাক্যগুলোও কত মায়াবী লাগছে। ভালোবাসার মানুষের সবই কি মায়াবী লাগে এমন!নাহিন কুহেলিকার মায়া আচ্ছন্ন থাকা অবস্থাতেই বলে ওঠে,
তোমার দীর্ঘপল্লবে আপনার দৃষ্টিতে শুভদৃষ্টি,
হরিণী চোখে হারিয়েছি হৃদয় বারিবারি।
তোমার নাম খুদিত আপনার চিত্তে,
আটকেছি তোমার আপনাতে অসময়ে।
তোমার কথিত প্রতিটি বাক্যে,
পেয়েছি আপন ঠিকানা খুঁজে!
তোমার নিখুঁত স্বীকারোক্তিতে,
হারিয়েছে আপনার আপনিকে!
কুহেলিকা ক্লান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
—ডিনার করেছেন?
—তুমিই তো মাত্র ফিরলে।
—তাহলে আরেকটু ওয়েট করুন।ফ্রেশ হয়ে এসে একেবারে নিচে যাবো।
—হুম
নাহিনের জবাব শোনা মাত্রই বেরিয়ে যায় কুহেলিকা।আজ প্রচন্ড ধকল গিয়েছে ওপর দিয়ে। বিকেলের দিকে বের হওয়ার সময় কুহেলিকার গাড়ির ব্রেকফেল হয়েছিলো তবে কুহেলিকার সন্দেহ কেউ ব্রেকফেল করিয়েছিলো।মাথায় হিজাব বাঁধা বিধায় বোঝা যাচ্ছে না তার ব্যান্ডেজটা। অবশ্য সে ব্যান্ডেজ খুলে আসতে চাইছিলো তবে যারা তাকে উদ্ধার করেছে তারা দেয়নি।
গাড়ি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে একদম মুমুর্ষ অবস্থা।যেন আগে থেকেই কেউ গাড়ির অন্তর্পাঠগুলোর মুমুর্ষ অবস্থা করে রেখেছে।গাড়ির তেল ফাটা স্থান দিয়ে বেরতে থাকে।সিটবেল লক হয়ে গেছে বিধায় একদমই বের হতে পারছিলো না সে।দরজা কোনো মতে খুলেও ভেতরে আটকে সে।নিভু নিভু চোখ যেন গাড়ির অক্সিজেনে স্লিপিং গ্যাস দেওয়া।
তখনই কিঞ্চিত দূরে কালো রঙের গাড়ি থামে।বেরিয়ে আসে দুই নর-নারী। পুরুষটি দ্রুত সিলবেট টানতে থাকে। একপর্যায়ে ভেঙে খুলে যায়।গাড়ির তেলও যেন বাঁধ হীনভাবে গড়িয়ে চলেছে।তারা দুজনে সম্মুখে কুহেলিকাকে গাড়ি থেকে বের করে ছুটে দূরে চলে আসে।গাড়িতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়।
হসপিটালে জ্ঞান ফিরলে কুহেলিকা দেখতে পায় নাহিদ খানকে। অচেনা মানুষদের থেকে ঘাবড়ে যায় সে।তারপর গাড়ির ঘটনা স্মরণে আসতেই নিজের চারপাশ দেখে।অজ্ঞান হওয়ার পূর্বে যে তাদের দেখেছিলো তা কিঞ্চিত হলেও স্মরণে আসে।
—এখন ঠিক আছো তুমি?
কুহেলিকা তাকিয়ে থাকে নিরুত্তর নাহিন খানের দিকে।নাহিদ খান আবারো বলে ওঠেন,
—বয়সে তুমি আমার সন্তানতুল্য তাই তুমি করেই বললাম।
—আমি এখানে?(কুহু)
—তোমার মাথা থেকে অনেক ব্লিডিং হচ্ছিলো।ইমেডিয়েটলি ট্রিটমেন্ট লাগতো তাই নিয়ে এসেছিলাম.(নাহিদ খান)
কুহেলিকা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে।তারপর অনুরোধে সুরে বলে,
—আমাকে কি আপনার ফোনটা কিছু সময়ের জন্য দিতে পারবেন?
—অবশ্যই এই নেও।
—ধন্যবাদ।
কুহেলিকা ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা হাতে নেয়।ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বলে।কুহেলিকা নিজের পোশাকেই আছে অর্থাৎ বেশিক্ষণ হয়নি এখানে সে তাই দ্রুত আরেক জায়গায় কল দিয়ে বলে ওঠে,
—ক্লিন এভরিথিং এট ফাস্ট।
নাহিদ খান শেষের কথাটা বুঝতে পারেননা।তবে প্রশ্ন করে বিব্রতও করেন না।কুহেলিকা মোবাইল ফিরিয়ে দেওয়ার পরপরই সফিয়া প্রবেশ করেন হাতে খাবারে প্যাকেট।তিনি যেন কুহেলিকার বহুদিনের পরিচিত এমন করেই কুহেলিকাকে বলে ওঠেন,
—মা,জ্ঞান যখন ফিরেছে যাও দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।একা না পারলে চলো আমি তোমায় সাহায্য করছি।তারপর কিছু খেয়ে নিবে।
কুহেলিকার চোখে পানি চিকচিক করতে থাকে।আজ প্রথম কোনো নারীকে দেখে তার মা,মা ফিলিংস আসছে। ইচ্ছে হচ্ছে জাপটে ধরে বললে আমি আপনাকে আম্মু ডাকতে চাই।তবে তা যে সে চাইলেও করতে পারে না। একেই তারা কৃতজ্ঞতা করেছে তার ওপর।তারপর আবার অচেনা।হয়তো আজ দেখা হলো কাল হারিয়ে যাবে দূরে।
ফ্রেশ হয়ে আসতেই কুহেলিকা দেখে নাহিদ খান বাইরে গিয়েছেন।সফিয়া পাশে বসে ওর। কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
—আমি মিসেস সফিয়া,ওয়াইফ ওফ নাহিদ খান।তোমার নাম কি আম্মু?
কুহেলিকা অবাক হয় নাহিদ খান নামটা শুনে।নাহিনের নামের সাথে প্রায় পুরো নামটারই মিল রয়েছে।তবে মুহুর্ত কয়েক বাদেই স্বাভাবিকভাবে নেয় সে নামটা। কেননা একরকম নাম থাকতেই পারে।কুহেলিকা স্বাভাবিক স্বরে মিষ্টি হেসে বলে,
—কুহেলিকা চৌধুরী,গ্রান্ডডটার অফ কোহিনুর চৌধুরী।
কোহিনুর চৌধুরী নামটা শোনামাত্রই সফিয়ার মুখটা কেরকম একটা হয়ে ওঠে।কুহেলিকা মানে খুঁজে পায়না।তবে তারা নাম্বার আদান-প্রদান করে যদিওবা কুহেলিকার ফোন তার কাছে নেই বরং আগুনে ঝলসে গেছে।তবে সিম তো তোলাই যাবে।সফিয়া কুহেলিকাকে গাড়ি আসার পরও অনেকক্ষণ ধরে বেঁধে বসিয়ে রাখে,আদর করে,গল্প করে,মায়া বাড়ায় যেন বহুদিনের তৃষ্ণা মেটায়।
কুহেলিকার ধ্যান ভাঙে কান্নার শব্দে।বাড়িভর্তি মানুষ কান্না করছে কেন?তাহলে কি প্রাণ উড়ে গেলো!কুহেলিকা দ্রুত নিচে আসে।সিনান মায়ের বুকে লেপ্টে কাঁদছে। মৃত্যুদশায় মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে কায়ফা।কি সেই নির্মম যন্ত্রণা!কুহেলিকারই রুহ কেঁপে ওঠে কায়ফার যন্ত্রণা দেখে। প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়ার শেষ সময়ে কায়ফা কুহেলিকাকে ডেকে বলে ওঠে,
—বোন আমায় মাফ করে দিস।আমার সিনানকে মায়ের ভালোবাসা দিস আর..
আর বলতে পারে না কায়ফা।চারপাশে কান্নার আওয়াজ যেন আরো তীব্র হয়।সিনানকে ছাড়িয়ে আনে কুহেলিকা। বুকে শক্ত করে আগলে রাখে।চারবছরের বাচ্চা হয়তো মারা যাওয়া বোঝে না তবে চোখের সামনে মায়ের যন্ত্রণা দেখেই পীড়িত সে। বাচ্চাটা তো বুঝলোও না তার মা হারিয়ে গেছে তার থেকে চিরদিনের মতো।
সাফিন কাঁদছে।দীর্ঘ অপরাধ বোধে কাঁদছে সে। বুকের ভেতর দুরুম দুরুম করে কেউ যেন হাতুড়ি পেটা করছে।হারিয়ে ফেললে মানুষ মূল্য বোঝে।সাফিনেরও হয়েছে সে দশা।সাফিনের মরে যেতে মন চাচ্ছে।বিরবির করে বলছে,
—কায়ফা তুমি না মরে আমি মরলেও তো পারতাম। আমাদের ছেড়ে কেন স্বার্থপরের মতো চলে গেলে।
সবাই ভাবছে কি এমন রোগ ছিলো মেয়েটার যে সুস্থ সবল মেয়েটা রোগা হতে লাগলো,চেহারা নষ্ট হয়ে গেলো,অরুচির দেখা দিলো, কন্ঠস্বর অন্যরকম হয়ে গেলো।রুমানা আফরোজ যেন এসবের মাঝেও চিৎকার করে বলে উঠলেন,
—কুহেলিকাই আমার মেয়ের খুন করছে আমি জানি।আমি ওকে ছাড়বো না।আমি নিজের হাতে খুন করবো ওকে।
কুহেলিকা সরে দাঁড়ায়।যদিও এখন কিছু বলা ঠিক হবে না।তবুও সে বলে কেননা এদেরকে যে অপরাধবোধে ভোগাতেই হবে।আদরের মানুষটাও একসময় বড্ড ফেলনা হয়ে যায় যার প্রমাণ কায়ফার করুণ এদশা।কুহেলিকাকে কাঁপতে দেখে নাহিন শক্ত করে হাত ধরতেই।কুহেলিকা বাকিদের দিকে তাকিয়ে ধমকে বলে ওঠে,
—মেয়েটা গত ছয়মাস যাবৎ অসুস্থ দেখেও হসপিটালে নিতে আপনার কষ্ট লাগে।আর এখন মারা গেছে আমি খুন করেছি তাইতো! আপনাদের সবার অবহেলায় মরেছে কায়ফা আপু।কায়ফা আপু ব্রেন ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে। আফসোস ডক্টর যদি শেষ সময় দিয়ে দেওয়ার আগে আমি জানতাম।যদি জানতাম তবে যত ক্যামো লাগে করাতাম তবুও বাচ্চাটাকে অনাথ হতে দিতাম না।কায়ফা আপু তো আপনাদের সবার আদরের তাহলে তার ক্ষেত্রে কেন করলেন অবহেলা?!
চলবে কি?