#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৭
#বর্ষা
কোহিনুর চৌধুরীর লয়ারের সাথে তুমুল ঝগড়া চলছে জুনায়েদ মির্জা আর জাহিদ মির্জার।কারণ একটাই যে চৌধুরী বংশের একটা কানাকড়িও তাদের নামে নেই!জুনায়েদ তো অলরেডি পুলিশে ফোন দেওয়ার হুমকিও দিচ্ছে কেননা লয়ার ইসতেগফার হোসেন কড়াকড়ি বলে দিয়েছেন এই বাড়ির বর্তমান উত্তরসূরী কুহেলিকা চৌধুরী।চাইলে কুহেলিকা তাদের রাখতেও পারে আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেরও করে দিতে পারে!
রুমানা আফরোজ কুহেলিকার কাছে গিয়ে নরম স্বরে অনুরোধের বাচনভঙ্গিমায় বলে ওঠেন,
—মা তুই বল এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাবো!আর তুই তো আমাদেরই মেয়ে তোর কাছে থাকার অধিকার তো আমাদের আছেই তাই না বল।
—বাহ,বাহ আন্টি কিছুক্ষণ পূর্বেও না এই মেয়ের সাথে নিকৃষ্ট আচরণ করলেন।আর এখনই আপনাদের মেয়ে হয়ে গেল!
নাহিনের কথায় রুমানা আফরোজ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা সম্পূর্ণ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বলে ওঠেন,
—এই ছেলে বেশি কথা বলো তুমি! আমাদের পারিবারিক বিষয়ে একদম নাক গলাবে না।
—নাহিন আমার ভবিষ্যৎ স্বামী অর্থাৎ আমার ফ্যামিলির অংশ।সো তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে ভুলবেন না।
সাফিন কুহেলিকার কথার মাঝে বা’হাত ঢুকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,
—এতো যে স্বামী স্বামী করছো এখনো বিয়ে হয়নি।দেখবে তোমাকে সহ্য করতে না পেরে কয়দিনের মাথাতেই এই ছেলে পালাবে।
নাহিন কুহেলিকার দিকে তাকায়।কুহেলিকাকে হাসতে দেখে থমকে যায় সে।সে তো ভেবেছিলো তার প্রেয়সী এই কথাটার প্রতিবাদ করবে।নাহিনের আঘাত পাওয়া হৃদয়ের অনুভূতি বোঝার পূর্বেই কুহেলিকা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
—দীর্ঘ সাতবছর যেই ছেলেটা আমায় আগলে রাখলো,আমায় সুন্দর জীবন,সম্মান দিলো সে কি আদৌ আমায় ছেড়ে যাবে!যে ছেলে আমায় এতো বছরেও একা রেখে পালায়নি সেই ছেলে আগামীতেও যে পালাবে না তার নিশ্চয়তা অবশ্যই আছে ইনশাআল্লাহ।
সাফিন চুপ হয়ে যায়।তবে নতুন করে আবারো কিছূ বলে ওঠার পূর্বেই লয়ার বলে ওঠে,
—কুহেলিকা মা সব কাগজপত্র তো দিলামই এখন তুমি দেখো কি করবে!আমি চলি তাহলে।
—আচ্ছা আংকেল। আল্লাহ হাফেজ
কুহেলিকা বিদায় জানায় ইসতেগফার হোসেনকে।প্রধান ফটক অব্দি এগিয়ে দিতে দিতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েক কথাও সম্পূর্ণ হয় তাদের।তবে তা যে খুব গোপনীয় তা কন্ঠের নমনীয়তা এবং হ্রসতায় পরিবেষ্টিত।
***
কুহেলিকা বাড়িতে নেই।নিহান রয়ে গিয়েছে বিশ্রামের জন্য। পাশাপাশি আজ সকালেই পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে।সাফিন স্যার দেখে ওদেখা করে নাহিনের পায়ের ওপর চেয়ার তুলে দিয়েছিলো।
—ওফস সরি নাহিন আমি তোমায় খেয়ালই করিনি।খুব কি লেগেছে!
—সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি।
—আমি সত্যি তোমায় খেয়াল করিনি গো।
নাহিন নিজেকে শান্ত রাখলেও তার মনের মানুষ সহ্য করেনি। বরং ঠাস করে বলেই দিয়েছিলো।
—স্যার আপনি বয়স্ক হচ্ছেন তারই লক্ষণ হিসেবে এতো বিশালদেহী নাহিনকেও আপনি লক্ষ্য করলেন না!
কুহেলিকার বাচনভঙ্গিমায় ব্যথার মাঝে মুখে হাসি ফুটে তার।মেয়েটা যে ব্যঙ্গ করতেই বলছে তা এখানে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারবে।তাইতো কায়ফা বলে উঠলো,
—কুহু তোর দুলাভাই খেয়াল করেনি বললো তো।তাও কেন পচাচ্ছিস তাকে!
কুহেলিকা তার অভাবনীয় মুদ্ধতা ছড়িয়ে সুপ্রশস্ত হাসি হেসে নাহিন ধরে উপরে নিয়ে যেতে যেতে বলে ওঠে,
—আমিও তো তাই বলেছি।বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় দুলাভাই খেয়াল করেনি।
সাফিন হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে।ওর এখন অসহ্য লাগে এই নাহিন নামক পুরুষটিকে।কি আছে এই পুরুষের মাঝে?হ্যা আছে সৌন্দর্য আর টাকা। সাফিনের ভাবনা মতে,নারী আটকায় পুরুষের টাকায় আর পুরুষ আটকায় নারীতে!আসলেই সে নিজেদের প্রাধান্য দিলেও অধিকাংশ নারীকে হেয় করেছে।নারী আটকায় পুরুষের যত্নে,সম্মানে, ভালোবাসায়,শ্রদ্ধায়।যার পুরোটাই কুহেলিকা পাচ্ছে নাহিনের থেকে!
কুহেলিকা নাহিনকে ঘরে রেখে পা ম্যাসেজ করে দিয়ে সেই যে গেল আর ফেরেনি এখনো।কুহেলিকা কোনো এক কারণে মির্জা পরিবারকে যে থাকতে দিয়েছে তার ধারণাও করে ফেলেছে সে। কেননা যেই মেয়ে চাইলেই খুব সহজে তাকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া মানুষদের বের করে দিতে পারে,সেই মেয়ে তাদের খাতির যত্নে রাখছে।বেশ ভাবার বিষয়!
নাহিন ঘরে বসে বিরক্ত হচ্ছিলো বিধায় একটু হাঁটাহাঁটি করতে করিডোরের দিকে যায়।রোহানীও নাচতে নাচতে সামনে না তাকিয়েই এগিয়ে আসছিলো।তা দেখে নাহিন সরে যেতে গিয়ে পায়ে আবারো ব্যথা পায়।রোহানী নিজের বামদিকে তাকিয়ে অবাক হয়।কত সুন্দর একটা ছেলে!
রোহানীকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবান্তর দেখা যায় না নাহিনের মাঝে।তবে ভেতরে ভেতরে সে প্রচন্ড রেগে যাচ্ছে।মনে মনে ভাবচ্ছে এই বাড়ির কোনো মানুষেরই বুদ্ধিমত্তা ভালো না।সে পড়ে আছে দেখেও এই মেয়ে একটু সাহায্য করছে না বরং হা করে তাকিয়ে আছে।দরজার হাতল ধরে দাড়াতেই রোহানী হাত বাড়িয়ে বললো,
—হায় আমি রোহানী.
—হুম..
—আরে কোথায় যাচ্ছেন পরিচয় তো দিয়ে যাবেন নাকি!
—আমি পরিচয় দিতে ইন্টারেস্টেড নই।সামনে থেকে সরুন।
—আরে আরে যাহ চলেই গেলো।তবে কে ছিলো এই হ্যান্ডসামটা?!
রোহানী ঢুলতে ঢুলতে বোনের ঘরের দিকে যায়। পথিমধ্যে রামায়সার সাথে দেখা।রামায়সা ছুটে এসে তার আন্টকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—আন্ট আমার জন্য কি এনেছো?
রোহানীও ভাগ্নিকে কোলে তুলে চকলেট দিয়ে বলে ওঠে,
—আন্ট তো জাস্ট চকলেট এনেছি বেবি সরি।
—নো প্রবলেম আন্ট
—তোমার মাম্মাম কোথায় রামায়সা?
—ঘরে।
রামায়সাকে কোল করেই রোহানী ঘরের দিকে যায়।একটা যতই খারাপ হোক না কেন বাইরের মানুষের কাছে। সেক্ষেত্রে নিজের প্রাণপ্রিয় আপির অংশের কাছে সবসময় সেরা থাকারই চেষ্টা থাকে তার। এক্ষেত্রে রোহানীও কিন্তু পিছিয়ে নেই।নিজে জন্ম না দিয়েও খালাগত অধিকারে মা হওয়ার অনুভূতি সর্বাপেক্ষা সুন্দর একটা সম্পর্ক।
****
জুনায়েদ কাউকে ফোন দিয়েছে।কিছু কথা বলছে হয়তো।তবে তা গোপনীয়।রুমটা একদম সাইলেন্ট।আর জুনায়েদ হচ্ছে সাইলেন্ট কিলার। খুব ছোটবেলায় খুব ঠান্ডা মাথায় খুনের খেলা খেলেছিলো।তবে জেল তো দূরের কথা কেউ বুঝতেই পারেনি যে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয় বরং খুন।
—শেষ করে দেও।
জুনায়েদ শেষ কথাটা বলে ফোন কান থেকে নামায়। বাঁকা হাসে।রাগে গা জ্বলছে।একে তো নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে তার ওপর আবার বাড়ি নাকি ছাড়তে হবে।মগের মুল্লুক নাকি সব।দরকার পড়লে কুহেলিকাই শেষ করে দিবে।তবুও সম্পত্তি থেকে নজর ঘোর বোকামি হবে!
জুনায়েদ বেচারা আপন মনে সবই চিৎকার করে বলছে।তার তো ধারণা কেউই শুনছে না তার কথা।তবে তার রুমেও যে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে তা হয়তো সে ভুলেই গেছে।কেউ একজন হ্যাক করেছে সেই সিসিটিভি ক্যামেরা। সম্পূর্ণ লাইভ শুনছে কি করতে চলেছে সে।
অন্ধকারে আবৃত কক্ষে বসা লোকটা জুনায়েদের হিংস্র কথাবার্তা শুনে রাগান্বিত হয়ে ওঠে। হাতের কাছের গ্লাসটা জোরে দূরে ছুঁড়ে মারে।চিৎকার করে বলে ওঠে,
—মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার খুব শখ জেগেছে মনে তাই না! মৃত্যুর কাছ থেকে ঘুরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার আর মৃত্যুর কাছে পাঠানোর দায়িত্ব তোর কৃতকর্মের।
লেপটপটা ঠাস করে বন্ধ করে বেরিয়ে যায় লোকটা।তিনি বেরিয়ে যেতেই লাইটটা জ্বলে ওঠে। কোনো এক হোটেল রুম।একটু বাদেই প্রবেশ করে কয়েকজন গুন্ডা টাইপ লোক।তবে কাউকে না পেয়ে চিরুনি তল্লাশি করে বেরিয়ে যায় তারা।
করিডোরের ওপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসে লোকটা।খুব সূক্ষ্মভাবে কিঞ্চিত জায়গাতে নিজেকে আটকে রেখেছিলো।যেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কোনো স্পাই।গুন্ডা টাইপের লোকগুলো বেরিয়ে যেতেই কাউকে ফোন দিয়ে বলে উঠলো,
—চট্টগ্রাম আসছি।
—(কন্ঠধ্বনি শোনা যায় না)
—হ্যা তারা আমাকে খুঁজছে। তবে পায়নি এখনো।চট্টগ্রাম সেভ হতে পারে।আর আমি এই সিম ফেলে দিবো নতুন সিমের ব্যবস্থা করে রেখো।রাখছি।
লোকটা কালো হুডির জ্যাকেটটা সামনে আরো টেনে নেয়।এই গরমের মাঝে হুডি!বসন্তকালেই যে গরম পরে বাংলাদেশে তা যেন অন্য দেশের গ্রীষ্মকাল।হায়রে গরম তুই গ্রীষ্মে তো ঝালাপালা করে দিবি। মানুষ তো তখন কারেন্ট না থাকায়,তোর অতিরিক্ততায় আগুনের ফুলকির রুপ ধারণ করবে।সামলাবে কে এদের?
—এক্সকিউজ মি. দিজ ইজ মাই রুম।ক্যান ইউ গিভ মি স্পেস।
মেয়েলী কন্ঠস্বরে পেছনে তাকায়।তবে গুরুত্ব না দিয়ে কিংবা সরি না বলেই বেরিয়ে যায়।মাঝবয়সী নারীটি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে।কেন জানি লোকটাকে তার খুব কাছের কেউ মনে হতে লাগে।খুব কাছের কেউ! পেছন থেকে বার কয়েক ডাকলেও লোকটা পেছনে ফিরে তাকায় না।
—সফিয়া কিছু হয়েছে? এভাবে কাকে ডাকছো?
—কাউকে না..
চিন্তিত মুখশ্রীতে ঘুরে তাকায় স্বামী নাদিম খানের দিকে। বিশিষ্ট হার্ট সার্জন নাদিম খান। নাদিম খান স্ত্রীর ওরুপ মুখশ্রীতেও অপলক তাকিয়ে থাকেন।এতো বছরেও স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা কমেনি তার।
—এমন করে কি দেখছো?
—আমার বউটাকে যে রাগলে কিংবা হাসলে কিংবা কান্না কিংবা চিন্তা করলে সবসময়ই অপরুপা লাগে তাই দেখছি।
চলবে কি?