দুই পথের পথিক পর্ব-০৪

0
350

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৪
#বর্ষা
সন্ধ্যালগ্নে বাড়ি ফিরেছে কুহেলিকা।হাতে,মাথায় চোটের দাগ স্পষ্ট।হালকা আঁচড় তবে ফর্সা ত্বকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।কুহেলিকা পৌঁছাতেই ড্রয়িংরুমে দেখতে পায় কায়ফাকে।ছেলেকে কোলে নিয়ে টিভি দেখছে।বাড়ির বড়রা সবাই আছে।আছে অচেনা দুইজন রমনীও।তবে আন্দাজ করেই কুহেলিকা বুঝে নিয়েছে কে তারা,নিশ্চয় এ বাড়ির বউ!

কুহেলিকা সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে নিলেই বাঁধ সাধে অপরিচিত আরেক রমনী।ওয়েস্টান ড্রেসে নিজেকে মডেল হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করছে যেন সে।পথ আঁটকে বলে ওঠে,

—এই মেয়ে কে তুমি?আর দারোয়ানই বা কিভাবে ঢুকতে দিলো তোমায়!এখনই বের হও বলছি ক্ষেত কোথাকার।

কুহেলিকা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। প্রথম দেখায় অচেনা কারো সাথে এ কেমন ব্যবহার!আবার কোথাকার কোন মেয়ে তাকে ক্ষেত বলছে।প্রকৃত অর্থে ক্ষেত তো তাকেই লাগছে।কোথায় কোন রকম পোশাকে মানিয়ে নিতে হয় সেই সামান্য বোধও তো নেই এই মেয়ের!

—রোহানী কি হয়েছে মা চিৎকার করছো কেন?

—দেখুন না আংকেল কোথাকার কোন ক্ষেত ঢুকে পড়েছে ভিলায়।এখন দোতলার দিকে যেতে চাচ্ছে।এইসবকে কোন সাহসে দারোয়ান ঢুকতে দেয় বুঝি না!

কাসেম মির্জা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কুহেলিকার দিকে।যেন বহুদিনের তৃষ্ণা মেটান‌।কুহেলিকা সালাম দিয়ে বলে ওঠে,

—বড় আব্বু কেমন আছেন?

—আলহামদুলিল্লাহ আম্মা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো আম্মা?এতদিন কোথায় ছিলে?

—আলহামদুলিল্লাহ বড় আব্বু ভালো আছি। পরিবারের কাছে ছিলাম।

কাসেম মির্জার বুকের ভেতর ছ্যালৎ করে ওঠে।রোহানী বিরক্ত মুখে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে থাকে‌।একে তো এমনিতেই বেড়াতে আসলে যেই রুমে সে থাকতো সেই রুমটায় কেউ তালা লাগিয়েছে।তারপর আবার এই মেয়ে!কাসেম মির্জা রোহানীকে দেখিয়ে বলে ওঠেন,

—কুহেলিকা এই হচ্ছে জুনায়েদের শালী রোহানী।আর রোহানী এই হচ্ছে কুহেলিকা মির্জা।

—বড় আব্বু আপনারা কাগজে কলমে মির্জা হলেও লোকমুখে কিন্তু চৌধুরী বংশের মানুষ।আর আমার কথায় আসলে আমি কাগজে কলমে চৌধুরী হওয়ার পাশাপাশি লোকমুখেও কুহেলিকা চৌধুরী নামেই পরিচিত।

কুহেলিকা আর দাঁড়ায় না সোজা নিজের কক্ষে চলে যায়।রোহানী কুহেলিকাকে যেতে দেখে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে আসে।কাসেম মির্জা তাকিয়ে থাকেন ভাস্তির যাওয়ার দিকে।ঠিকই তো বলেছে মেয়েটা।কাসেম মির্জা আর কায়েস মির্জার বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর ওনাদের খালুজান কোহিনুর চৌধুরী নিয়ে আসেন ওনাদের। নিজের বড় মেয়ে কাসফিয়ার মতো লালন-পালন করেন। লোকমুখে ছড়িয়ে যায় কায়েস ও কাসেম কোহিনুর চৌধুরীর ছোটো দুই ছেলে।তারপর থেকে চৌধুরী বাড়িতে চৌধুরী নামেই বেড়ে ওঠা।কুহেলিকা চৌধুরী নামটাই যেন সেক্ষেত্রে বেশি খাটে ওর সাথে!

কায়ফা সিঁড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।সিনান মনমরা হয়ে মায়ের বুকে লেপ্টে আছে। কেননা সাফিন কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গিয়েছে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।কায়ফা সিঁড়ি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টিভিতে দৃষ্টিপাত করে।রোহানী কান্না কান্না কন্ঠে এগিয়ে এসে জুনায়েদের বউ রাইসার নিকট গিয়ে বলে ওঠে,

—আপাই তোমার ঠিক করে দেওয়া রুমে তালা দেওয়া।আমি কোথায় থাকবো?আপা আমার কিন্তু ওই রুমটাই চাই।

—তোর রুমে তালা দেবে কে?চল তো আমি দেখছি।

রোহানী বোনের কথায় প্রাপ্তির হাসি হাসে।আজ অব্দি যা তার চাই সবই সে হাতিয়ে নিয়েছে কোনো না কোনো মাধ্যমে।রাইসা বোনকে নিয়ে রুমানা আফরোজ এর কাছে গিয়ে বলে,

—ছোট মা আপনি যেই রুম দেখিয়েছিলেন রোহানীর জন্য,সেই রুমে নাকি তালা দেওয়া।

রুমানা আফরোজের বুঝতে কষ্ট হয়না কে লাগিয়েছে তালা‌।তবে এর পাশাপাশি কুহেলিকার আজকের ব্যবহারে তিনি এও বুঝেছেন কুহেলিকাকে ওই রুম ছাড়া করা অসম্ভব।

—মা রোহানী একটু এডজাস্ট করতে হবে যে বাবু।ওই রুম পুরাতন কেউ নতুন করে হাতিয়ে নিয়েছে।

—ভুল বললেন মিসেস রুমানা আফরোজ। নিজের রুম নিজের করে নিয়েছি।অন্যের জিনিস না বলে নেওয়াকে হাতিয়ে নেওয়া বলে আর যা আমি করিনি‌।

—ছোট মা এই মেয়ে কে?

রাইসার প্রশ্নে রুমানা আফরোজ জবাব দেওয়ার পূর্বেই রোহানী ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে,
—কোথাকার যেন কোন কুহেলিকা মির্জা অফস সরি চৌধুরী!

—নাম ভালো মতো উচ্চারণ করো নয়তো কোনো শব্দ উচ্চারণ করার মতো মুখ রাখবো না।

—থ্রেট দিচ্ছো আমায়!

—না,বোঝাচ্ছি।বাই দ্যা ওয়ে তোমার জন্য আমার সময় নষ্ট হলো।আর সবাই আপনি ডাকের মর্যাদাসম্পন্ন নয়,তাই তোমাকে তুমি করে বলেছি ডন্ট মাইন্ড।

কুহেলিকা রোহানীকে এড়িয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যায়।কফির তৈজসপত্র খুঁজে কফি বানিয়ে নিজ রুমে গমন করে। রোহানী রাগে ফুঁসতে থাকে। নিজের কক্ষে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস নেয় কুহেলিকা। আজকের ধকল আর সহ্য হচ্ছে না তার।এতক্ষণ তো ভেবেছিলো কেউ তার স্মৃতি আগলে রাখতেই তার রুমটাকে আগলে রেখেছিলো‌।তবে ভুলটা ভেঙে গেল খুব শীঘ্রই।কেউ তাকে আগলে রাখতে রুমটা আগলে রাখেনি বরং নয়া আত্মীয়ের স্বার্থে ব্যবহার করেছে তার রুমটা!

অসহনীয় দূর্বলতা কাটাতে ফোন হাতে নেয় কুহেলিকা।কল দেয় কললিস্টের সবচেয়ে ওপরের নাম্বারটায় ‘নাহিন’।ওয়েটিং বলায় কুহেলিকা ফোন কেটে বিছানায় রেখে দেয়।আয়নার সামনে দাঁড়ায়। গভীরভাবে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে আঁতকে ওঠে।গলার বা পাশের গাঢ় তিলটা একদম কোহিনুর চৌধুরীর মতো!কিভাবে সম্ভব!

বহুবছর পর সাফিনকে রেস্ট্রিকশন থেকে হটিয়ে দেয় কুহেলিকা। অবশ্য এখনো সে জানে না যে সাফিনই তার দুলাভাই।জানলেই বা কি হতো! অনুভূতিগুলো তো আর পুরোপুরি মরে যেতো না। জীবনটা তো এমনই।যাকে একবার মানুষ মন থেকে ভালোবেসে ফেলে,তাকে হৃদয় থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে না।কোথাও না কোথাও একটা জায়গায় তার জন্য লুকিয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস!হোক সেটা সুখের কিংবা দুঃখের।

—কুহেলিকা বাসায় আসোনি?

সাফিনের ম্যাসেজে চমকায় কুহেলিকা।লোকটা কি তার আইডি মুখের সামনেই ধরে রেখেছিলো!কুহেলিকা ছোট্ট জবাব দেয়,

—জ্বী এসেছে।

—আমাকে ক্ষমা করে দিও কুহেলিকা।আমার কারণে তুমি হারিয়ে গেলে!আমার উচিত হয়নি তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দেওয়া।নয়তো আজ তুমি ….

সাফিন আর লেখে না‌।পরেরটুকু কুহেলিকা বুঝে নেয়।নিজ থেকেই ম্যাসেজ দেয়,

—জানেন মানুষ হচ্ছে ফিরিয়ে দিয়ে আফসোসকারী। আপনার জীবনে এখন আপনার স্ত্রী,সন্তান আছে তাদের কথা ভাবুন।আমাকে ভুলে যান।আমি নামক কেউ আপনার পরিচিত তা ভুলে যান।ভুলে যান কুহেলিকা চৌধুরী আপনাকে কখনো ইজহার করেছিলো‌।ভুলে যান সব। ভালো থাকুন।

কুহেলিকা ব্লক করে দেয় সাফিনকে।নিজেকে নিজে ওয়াদা করে,এই ব্লক আর কখনোই খুলবে না সে;পুরনো ক্ষতকে আর তাজা করে সুস্থ স্থানে আর আঘাত করবে না।কুহেলিকা থাকতে চায় সাফিনের না পাওয়া স্মৃতিতে। মানুষ পাওয়া জিনিসের তুলনায় না পাওয়া জিনিসের প্রতি বেশি কদর করে।কুহেলিকা না পাওয়া স্মৃতি হিসেবেই থাকতে চায়।

নাহিনের কল রিসিভ করতেই সে শুনতে পায় মোহ মিশ্রিত পুরুষনালী কন্ঠ।ভিডিও কল।ভেসে ওঠে হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীও।শ্যাম পুরুষের সিল্কি চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে।ঘামশ্রী মুখ কি মায়াবীই না লাগছে।বারবার বুকের দিকটায় হাত বুলাচ্ছে হয়তো গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম।কুহেলিকা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

—সরি মিটিং এ ছিলাম।কি করছো প্রিয়তমা?

—সাফিন স্যারের সাথে চ্যাটিং করলাম।বাই দ্যা ওয়ে আপনি কি অসুস্থ?

সংকোচহীন উত্তর।নাহিনের মাঝে ভাবান্তর দেখা গেল।শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—তেমন অসুস্থতা নেই,তবে খানিক বুকে ব্যথা।তবে কি কথা হলো তোমাদের?

—তেমন‌ কিছু না। শুধু কেমন আছি তা জানলেন আর কোথায় আছি তা জিজ্ঞেস করলেন!তারপর এখন ব্লক লিস্টে আছে।

কুহেলিকা মিথ্যে না বললেও সম্পূর্ণ কথাটাও জানায় না নাহিনকে।ছেলেটা সেই আটবছর যাবৎ আগলে রেখেছে তাকে।কঠিন ছেলেটার তার প্রতি এরুপ টান দেখে আগেই সবাই বলেছিলো,”কঠোর নাহিন মুনতাসির প্রণয়ে আসক্ত হয়েছে”।সত্যিই ছেলেটা দুইবছর আগে নিজের মনের কথা জানিয়েছে তাকে।কুহেলিকা হ্যা না বললেও একেবারে নিষেধ করে দেয়নি।বলেছিলো,
—যদি কখনো সম্পর্ক নামক শব্দটার প্রতি বিশ্বাস আসে,তবে আপনিই হবেন আমার জীবনের কাঙ্ক্ষিত সেই পুরুষ!

নাহিন চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দেয়।ঢগঢগ করে গ্লাসভর্তি পানি খায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,

—সাফিন স্যার যদি তোমার জীবনে ফিরে আসতে চায় তবে কি তাকে ফিরিয়ে নিবে?

—আপনার কি আমাকে তেমন মেয়ে মনে হয় যে আমি অন্যের স্বামী কেড়ে নিবো!

—সাফিন‌ স্যার বিবাহিত!তবে সে যদি বিবাহিত না হতো তবে তো তাকে নিশ্চিত ফিরিয়ে নিতে তাই না?

—কুহেলিকার মন থেকে যারা উঠে যায় তারা আর সেখানে জায়গা পায় না কখনোই।আর যারা আমৃত্যু কুহেলিকাকে আগলে রাখতে চায় কুহেলিকা তাদের মোহ-মায়ায় আবদ্ধ থাকতে চায়!

—তুমি আমার ম…

নাহিন কথা সম্পন্ন করতে পারে না।গলা কাঁপতে থাকে।নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রঞ্জক পদার্থ।মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে।কুহেলিকা চিৎকার করে ডাকতে থাকে নাহিনকে।কান্না করতে থাকে।তবে নাহিনের হুঁশ থাকে না বেশিক্ষণ।জ্ঞান হারায় সে।কুহেলিকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে কল দেয় ম্যানেঞ্জারকে।নাহিনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হসপিটালে।কুহেলিকার অন্তরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে।এশার নামাজ শেষে কয়েক রাকাত নফল নামাজ পড়ে মোনাজাতে বসে সে।ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,

—হে আল্লাহ মানুষ দুঃখ শুধু শুনতে পারে তবে তুমি তো সেই দুঃখের সমাধান দিতে পারো।আল্লাহ আমাকে ভালোবাসার মতো সবাইকেই তুমি কেড়ে নিয়েছো।নাহিনকে কেড়ে নিও না।আমি তো ভালোবাসা হারানোর ভয়েই নাহিনের কাছে কখনো ইজহার করিনি। আল্লাহ ওকে কেড়ে নিয়ো না আমার থেকে।আমি যে জীবিত লাশ থেকে জীবন পেয়েছি ওর কারণে।আমাকে আবারো জীবিত লাশ বানিয়ে দিও না আল্লাহ।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে