#দহন
#শেষ_পর্ব
#Nishan_Bunarjee
পীর সাহেবের মৃত্যু সবাইকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল। সবার একমাত্র আশার আলো পীর সাহেবের মারা যাওয়ায় নিভে গেল। এবার বুঝি গ্রামটা ধ্বংস হবে সেটা নিশ্চিত।
কিন্তু পীর সাহেবের হাত থেকে একটা চিঠি পেলেন ইমাম সাহেব। চিঠিটা পীর সাহেব মরার পূর্বে নিজের হাতে লিখেছেন। চিঠিতে পীর সাহেব লিখেছেন,
ইমাম সাহেব, আপনার কাছে আমি এমন একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম যেখানে আমি ব্যতীত কেউ থাকবেনা। কারণ ছিল, আমি জানতাম যে আজ রাতেই আমার মৃত্যু হয়ে যাবে। যদি আমার সাথে অন্য কেউ ঘুমোতেন তাহলে তারও মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। সেই দুরাত্মা টা এতটাই শক্তিশালী যে আমার পক্ষে তাকে নষ্ট করা সম্ভব ছিলনা। কেননা সে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। আর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা আত্মা প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হতে থাকে। ঊর্মির সাথে সাথে অনেক বড় অন্যায় হয়েছে। তার এবং তার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য সে গোটা গ্রামের লোকজনকে দোষী মনে করে। তাই সে এই গ্রামটিকেই শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু কেউ আসবে যে আপনাদেরকে রক্ষা করবে। তাই আশাহত হবেননা। সবথেকে শক্তিশালী হলেন সৃষ্টিকর্তা। উনার উপর আস্থা রাখুন উনিই সব ঠিক করবেন…
পীর সাহেব যখন চিঠিটা লিখে শেষ করলেন তার কিছুক্ষণ পরই পীর সাহেবের সামনে ঊর্মির দুরাত্মার আবির্ভাব ঘটে। পীর সাহেব ঊর্মির আত্মাকে দেখে একদম ভয় পাননি। স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
তুই কেন নিষ্পাপ গ্রামবাসীদের ক্ষতি করছিস? তারা তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি। যারা ক্ষতি করেছে তাদের সবাই তো প্রায় শেষ। তাহলে কেন তুই এই ধ্বংসযজ্ঞকে থামাচ্ছিস না?
ঊর্মি ভয়ংকর হাসি দিয়ে বলল,
সব গ্রামবাসীরাই দোষী। তাদের কাউকে আমি ছাড়বোনা। সবাইকে আমি মেরে ফেলব। আর তকেও বলেছিলাম চলে যা কিন্তু তুই যেতে চাসনি। তুই বুঝি তোর মৃত্যুই চাস।
কথাগুলো বলেই ঊর্মি তার ধারালো নখের আঘাতে পীর সাহেবকে মেরে ফেলল। কিন্তু পীর সাহেব জানতেন যে উনার মৃত্যু অবধারিত তাই উনি মৃত্যুর পূর্বেই এই চিঠিটা লিখে যান।
ইমাম সাহেব গ্রামবাসীদের সামনে চিঠিটা পড়লেন। চিঠিতে লেখা কথাগুলো শুনে তারা ভয় পেয়ে গেল। বুঝতে পারলো ঊর্মির মনে কি পরিমাণে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। আর এই আগুন তাকে অনেক শক্তিশালী করে তুলেছে। হয়তো তাকে দমন করা সম্ভব না। কিন্তু পীর সাহেব চিঠিতে লিখে গেছেন যে কেউ আসবে এই গ্রামের রক্ষার্থে। কে সে? সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কে সে? কিন্তু সবাই কথাটি বিশ্বাস করে নেয় কারণ পীর সাহেব অনেক কথাই বলেছেন যা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
দিনদিন ঊর্মির ধ্বংসযজ্ঞ সীমার বাইরে যেতে লাগল। দৈনন্দিন মেয়েরা মারা যাচ্ছে। এমনকি রবিন বাবু এবং তার মেয়েও বেঁচে নেই। গ্রামটা যেন শ্মশানে পরিণত হয়ে গেছে। সবদিকে দিনের পর দিন মৃত্যুর খবর বেড়ে চলেছে। এমন অবস্থায় গ্রামের মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে ঊর্মির নিকট বন্দনা শুরু করে। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষের মনে হাহাকার আর চোখে জল। গ্রামবাসীরা ঊর্মির কাছে ক্ষমা চাইতে চাইতে বলল,
আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দাও। আমরা সবাই তো নির্দোষ! আমাদের মেয়েরা তো কিছুই করেনি। তারা তোমার ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন তাদেরকে তুমি শাস্তি দিচ্ছ? দয়া করে এসব নির্দোষ মেয়েদের মেরোনা…!
তখনই আকাশ থেকে বিকট হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। ভয়ঙ্কর হাসি। হাসিটি ঊর্মির ছিল। তার হাসি শুনা যাচ্ছিল কিন্তু সে আকাশে অদৃশ্য ছিল। হাসতে হাসতে একপর্যায়ে সে সকল গ্রামবাসীকে বলল,
তোরা নির্দোষ? হাহাহা…! কেমন লাগছে এখন যখন তোদের মেয়েরা কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছে? কেমন লাগছে? ঠিক তেমনটাই লেগেছিল আমার বাবা-মায়ের যখন তোরা আমাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলেছিলি। আমিও তো নির্দোষ ছিলাম কিন্তু তখন তো তোরা কেউ এগিয়ে এলিনা আমাকে বাঁচাতে!
গ্রামের লোকেরা আকুতি মিনতি করে বলল,
আমরা তো কেউ ই সত্যতা জানতাম না। গ্রামের প্রধানরা অপরাধীদের সাথে মিলে অন্যায় করেছে তোমার সাথে। তারা তো তাদের প্রাপ্য শাস্তি টুকু পেয়েই গেছে। তাহলে এখন এই নির্দোষ মানুষগুলোকে তো ছেড়ে দাও…
– হাহাহা…! কেউ বাঁচবে না, কেউ না!
ঊর্মি গ্রামবাসীদের কথা মেনে না নিলনা। দিনকাল যতই যেতে লাগলো গ্রামের অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগলো। দিনের মর দিন মৃত্যুর তান্ডব চলছে। মানুষের চোখের সামনে মানুষ মরছে। গ্রামবাসীরা ভয়ে ভয়ে দিনাতিপাত করছে। আশাহীন হয়ে সবাই বেঁচে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
একদিন গ্রামে একজন সাধুর আবির্ভাব ঘটলো। বয়স প্রচুর হবে। ১০০ এর ঊর্ধ্বে। কিন্তু শরীরে এখনো ব্যপক তেজ। চোখমুখের দিকে তাকালে অদৃশ্য আলৌকিক শক্তির অনুভব হয়। সাধুবাবা গেলেন গ্রামের মন্দিরে। মন্দিরের পন্ডিত সাধুবাবা কে দেখে অবাক। এর আগে কখনো উনাকে দেখা যায়নি এই গ্রামে। সাধুবাবাকে পন্ডিত জিজ্ঞেস করলেন,
বাবা, আপনি কোত্থেকে এসেছেন? এর আগে তো কখনো এই গ্রামে আপনাকে দেখিনি!
সাধুবাবা মৃদু হেসে বললেন,
সাধু-সন্ন্যাসীদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই পন্ডিত মহাশয়। তাঁরা একজায়গায় বাস করেনা। যখন যেখানে ইচ্ছে বিচরণ করে। কিন্তু পন্ডিত মহাশয়, এই গ্রামে ঢুকার পর একটা অশুভ অনুভূতি হল। গ্রামে মনে হচ্ছে কয়েকদিন থেকে অশুভ ঘটনা ঘটছে…
সাধুবাবার কথা শুনে পন্ডিত মহাশয়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। তিনি বললেন,
ঠিক বলছেন বাবা। গ্রামে অশুভ শক্তির নজর আছে। সে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করে দিতে চায়।
পন্ডিত সাধুবাবা কে সবকিছু খুলে বললেন। সাধুবাবা তখন পন্ডিত মহাশয়কে বললেন,
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। উনার উপরে কেউ নেই। আত্মাও পরমাত্মার অধীন। আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাইব। ঈশ্বর যদি চান তাহলে এই অশুভ শক্তির বিনাশ হবেই।
পন্ডিত মহাশয়ের মনে একটা আশার আলো জাগলো। উনি সাধুবাবা কে নিয়ে গ্রামের লোকজনের সম্মুখে গেলেন। গ্রামের মানুষ সাধুবাবার কথা শুনে বললেন,
সাধুবাবা, এই দুরাত্মা টা অনেক শক্তিশালী। সে এত সহজে নষ্ট হওয়ার নয়। তার ক্ষমতা অসীম।
সাধুবাবা আবারো মৃদু হেসে বললেন,
সব ক্ষমতার উৎস ঈশ্বর। উনিই অসীম ক্ষমতার অধিকারী। আপনারা উনার উপর বিশ্বাস রাখেন। এই অশুভ শক্তির বিনাশ নিশ্চিত।
গ্রামের মানুষের মনে সাধুবাবার কথাগুলো জায়গা করে নিল। সবাই আবার বিশ্বাসে বিশ্বাসী হলেন। সাধুবাবা মন্দিরে গেলেন সকল গ্রামবাসীদেরকে নিয়ে। তারপর সাধুবাবা পন্ডিত মহাশয়ের সাহায্যে একটা যজ্ঞের আয়োজন করলেন। শুরু হল সেই অশুভ শক্তির আহবান। যজ্ঞ শুরুর কিছুক্ষণ পরপরই চারিদিকে বিকট হাসির আওয়াজ ভেসে উঠলো। হাসির প্রতিধ্বনি এতটাই জোরালো ছিল যে গ্রামের কোণা কোণায় আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামবাসীরা আরেকবার ঊর্মির অশুভ অবয়বকে দেখতে পেল। ঊর্মির অশুভ আত্মাটি হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,
এখন তুই এসেছিস আমাকে বিনাশ করবি বলে! তুই জানিস না তোর আগেও একজন এসেছিল। সে ভেবেছিল আমাকে ধ্বংস করে দিবে। সে নিজেই নিজের মৃত্যুর দিকে দৌড়াচ্ছিল। আমি তাকে বলেছিলাম চলে যেতে কিন্তু সে যায়নি। তাই চিরকালের জন্যই তাকে যেতে হল। তুইও বাঁচবি না।
সাধুবাবা হাসলেন। বললেন,
সব জানি। সেই পীর সাহেবের কথা সবকিছুই আমার জানা। কিন্তু তুই জানিস না যে পীর সাহেবকে মেরে তুই নিজের ধ্বংসের বীজ বপন করেছিস। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে তুই অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিস কিন্তু নির্দোষ মানুষের প্রাণ নিয়ে তুই নিজেকেই শক্তিহীন করছিলি। তারপর যখন পীর সাহেবের মতো পুণ্যাত্মা কে তুই হত্যা করলি তখন তোর শক্তি আরোও ক্ষীণ হয়ে গেলো। তুই অশুভ শক্তি হয়ে একটা পুণ্যাত্মা কে হত্যা করে নিজের বিনাশ নিজেই করেছিস।
ঊর্মির দুরাত্মা কথাগুলো শুনে বিকট হাসি দিতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সে নিজেকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে দেখে আর্তনাদ করে উঠলো। হাসির আওয়াজ ততক্ষণে চিৎকারে পরিণত হয়ে গেলো। সাধুবাবা তখন বললেন,
তোর সাথে অন্যায় হয়েছে কিন্তু তুই যা করছিস তাও তো অন্যায়। তোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় তো গ্রামবাসীদের দোষ নেই।
– কিন্তু আমার সাথে যে ছেলেগুলো জোরপূর্বক অপকর্ম করেছে তারা তো দোষী।
– তাদের সবাইকে তুই মেরে ফেলেছিস। তাদের সাহায্যকারীরাও এখন আর বেঁচে নেই। তাহলে কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিস তুই?
– কারণ এই গ্রামের মানুষেরা সবাই দোষী। তারা তখন সেই মানুষের কথায় বিশ্বাস করে আমাকে আর গর্ভের সন্তানকে মেরেছিল যারা আমার সাথে অন্যায় করেছিল।
– তাদের সামনে তোকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল যার ফলে তারা তকে মারধর করেছিল।
– সেটা কি ঠিক ছিল?
– না। কিন্তু তারা তাদের ভুল মেনে নিয়েছে। এখন তাঁরা তোর কাছ ক্ষমা চাচ্ছে। আর ক্ষমাপ্রার্থী কে ক্ষমা করে দেয়াই উচিৎ।
– ঠিক আছে। কিন্তু গ্রামবাসী যদি আমার একটা শর্ত রাখে তাহলেই আমি চলে যাব।
– কি শর্ত?
– গ্রামে যদি কখনো মেয়ের সাথে জোরপূর্বক অপকর্ম করা হয় তাহলে তার যাচাই করে অপরাধীকে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। নইলে আমি আবার ফিরে আসব।
গ্রামের সবাই তখন এক হয়ে বললেন,
আমরা সবাই সেই অন্যায়কারীদেরকে কঠোর শাস্তি দিব। কিন্তু দয়া করে আমাদের কে ক্ষমা করে দিয়ে এবার চলে যাও।
ঊর্মির আত্মা যেন এবার একটু শান্তি পেল। সে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু সাথে এটাও বলে গেল, যদি সেইসব ছেলেগুলোকে শাস্তি না দেয়া হয় তাহলে সে আবার ফিরে আসবে।
ঊর্মি চলে গেল। গ্রাম আর গ্রামের লোকজন এখন বিপদমুক্ত। কিন্তু গ্রামবাসীরা এবারও ভীষণ অবাক হলেন। সাধুবাবা হুট করেই যেন কোথায় চলে গেলেন। একদম নিখোঁজ। কোত্থেকে উনি এসেছিলেন আর কোথায় তিনি গেলেন তার খুঁজ কেউ লাগাতে পারেনি আর।
———–সমাপ্ত———
(অবশেষে, কেমন লাগলো #দহন গল্পটা জানাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে)