#দহন_ফুল — ৯
অনশনের ছয় দিনের মাথায় শাশুড়ীর মনে হলো, কেউ তো আর তার রুমে উঁকি দিচ্ছে না তাই নিজে থেকে বের হওয়া উচিত । আমরা সবাই সকাল বেলা নাস্তা খেতে বসেছি। শাশুড়ীকে দেখলাম জুলজুল করে হেঁটে ডাইনিং এর দিকে আসলো। সবাই আড়চোখে দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম সুমতি হলো বোধহয়।
আশার গুড়ে পানি ঢেলে দিয়ে হঠাৎ করে উনি ঢলে পড়ে গেলেন। মাসুমা ভাবী আমি খাবার ফেলে দৌড়ে গিয়ে উঠাতে চেষ্টা করলাম। সাবির ভাইয়া, সামির চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, শ্বশুর দিব্যি আয়েশ করে নাস্তা খাচ্ছে, খাওয়া ফেলে উঠার নাম গন্ধ নেই উল্টো আরো বলছে,
— পড়ছে রে পড়ছে, কাতলামাছ কাঁদায় পড়ছে,
ওরে এতো তোয়াজ না কইরা পানিতে চুবাও ভুত ছুঁটে যাবে।
শাশুড়ীর চোখ পিটপিট করছে, আর হাত পা মাটিতে আছড়াচ্ছে।
আমার ভীষণ হাসি পেলো, অতি কষ্টে হাসি চাপলাম।
শাশুড়ীকে উঠাতে পারছি না দুই বউ, সামিরকে এগিয়ে আসতে বললাম, সে এগিয়ে এসে শাশুড়ীর মুখ খুলে জিহবা পরীক্ষা করে বললো — হাইপো হয়ে গেছে একগ্লাস কড়া মিষ্টি করে শরবত বানিয়ে নিয়ে এসো। সামির রুমে গিয়ে ইনসুলিন নিয়ে আসলো।
চুরিচামারি করে যদিও খাচ্ছিলো কিন্তু সবটা চাহিদা কি পূরণ সম্ভব? হয়তো ওষুধ খেতে ভুল করেছে তাই এই হাইপো।
সবাই ধরাধরি করে তুলে সোফায় শোয়ানো হলো। আমি শরবত নিয়ে আসলাম, কিন্তু উনি গো ধরে বসে আছেন, ভেবেছেন অবস্থা আবার উনার অনুকূলে, তাই আবার বলে দিলেন সাবির ভাইয়া বিয়েতে রাজী না হলে কিছুই খাবেন না ইনসুলিনও নেবেন না।
শ্বশুর নাস্তা সেরে উঠে তামাশা দেখছেন দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বললেন,
— দেখো দেখো দম চলে যাচ্ছে তবুও কৃষ্ণের লীলা থামার খবর নাই, বজ্জাত মহিলা।
মাসুমা ভাবী হঠাৎ এক কান্ড করে বসলেন, সাবির ভাইয়ার পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন,
— তুমি রাজী হয়ে যাও নয়তো মায়ের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
সাবির ভাইয়ার ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব অবস্থা কাটাতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। পা ঝাড়া দিয়ে সরে গেলেন,
— তোমার যা খুশি করো গর্দভ.. কোথাকার।
বলে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাসার বাইরে বের হয়ে গেলেন।
শ্বশুর বাবাও রেগেমেগে,
–তোমাদের এসব তামাশা আর সহ্য হচ্ছে না।
বলে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলে গেলেন।
ভাবী শাশুড়ীর কাছে এসে,
— আম্মা আপনি যা বলবেন তাই হবে।
বলে শাশুড়ীকে আস্বস্ত করে শরবত খাইয়ে দিলেন। সামির চুপচাপ ইনসুলিন পুশ করে নিজের রুমে চলে গেলো।
আমার ভাবীর বোকামি দেখে মেজাজ খারাপ হলো, সামিরের পিছে রুমে চলে গেলাম।
বাবা ছাড়া কারো আর পরিপূর্ণ নাস্তা খাওয়া হলো না।
রুমে গিয়ে টিভি অন করে শুয়ে রইলাম।
সাড়ে দশটার দিকে বের হয়ে দেখি ডাইনিং টেবিলে বসে শাশুড়ী বসে কি যেনো খাচ্ছেন, না দেখার ভান করে রান্নাঘরে চলে গেলাম।
বড় ভাবী যত্ন করে কিছু একটা রান্না করছে, উঁকি দিয়ে দেখি চিকেন স্যুপ, ভ্রুকুটি করলাম। ভাবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
— একটু পোকামারার ওষুধ সাথে দিলে আরো মজা হবে।
মনির মা পেঁয়াজ কাটা ফেলে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হচ্ছে,
— ছুডু ভাবী যে কি কথা কয় হাসতে হাসতে মরি… সকালেও খালুজ্বি খালাম্মারে কইলো কাতলা মাছ.. হা হা হা হা।
ভাবী মুচকি হাসলো,
— প্রভা বড়দের এসব বলতে হয় না।
— আহারে আমার মাদার তেরেসা, মানবতার মুর্তি, বিনয়ের অবতার বাংলা সিনেমার শাবানা রে… বললে রাগ হইও না ভাবী, তোমার সাথে যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে , এমনটাই হওয়া উচিত।
যাও বেশি করে খাওয়াও সাপকে দুধকলা।
বলেই ফিল্টার থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে চা বসালাম।
ভাবী আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
ভাবী স্যুপের বাটিতে নিয়ে বের হয়ে গেলো, চা নিয়ে ফেরার সময় দেখলাম,
শাশুড়ী মা ভাবীকে আপেলের টুকরো মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, ভাবীও হাসিমুখে খাচ্ছে দেখে আমার গা জ্বালা ধরলো।
— কি আদিখ্যেতা!
আমাকে দেখে শাশুড়ী ডাকলেন,
— প্রভা… মা.. এখানে এসো, আপেল খাও।
উহু গলায় মধু ঝরছে মনেমনে বললাম, মুখে বললাম,
— না মা আমি আপেল খাই না, আমার এলার্জি হয়।
— আপেল খেলে এলার্জি হয়? কখনো শুনিনি তো?
— আমার হয়।
বলেই নিজের রুমে ঢুকে গেলাম।
সারাবিকেল ঘর থেকে বেরুলাম না, সন্ধ্যায় বের হয়ে সামিরের জন্য একটু নুডলস করে নিয়ে এসে রুম বন্দী হলাম। অসহ্য লাগছে বাড়ির পরিবেশ, শাশুড়ী মা গলায় মধু ঢেলে সারাদিন এটা সেটার অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে আর ভাবী আদেশ শিরোধার্য ভঙ্গিতে পালন করে যাচ্ছে।
মনির মা বলে,
— এই মাতারী ছয়দিনের সব খানা উশুল করতাছে, বড়ভাবী কিছু কয় না দেইখা আরো বেশি বেশি করতাছে।
মাগরিবের কিছু আগে শ্বশুর বাবা একটা কাপড় ভর্তি ব্যাগ নিয়ে এসে দরজা নক করলো,
— প্রভা… মা মাসুমার দিকে খেয়াল রেখো, আমি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি, জমি সংক্রান্ত একটা ঝামেলা হয়েছে ওটা মিটমাট করে আসবো।
— বাবা ফিরবেন কবে?
— দুই তিনদিন লাগবে সারতে তারপর ফিরে আসবো। তুমি মাসুমার সাথে রাগ করে থেকো না ও পরিস্থিতির স্বীকার। আমি গ্রাম থেকে ফিরে সব সমাধান করবো।
— আচ্ছা বাবা সাবধানে যাবেন।
রাতে খাবারের সময় রান্নাঘরে গিয়ে ভাবীর সাথে হাতে সব কাজ এগিয়ে দিলাম,কিন্তু ভাবীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। তবে খেয়াল করলাম চোখ ফোলা ও লাল। রাগ লাগে তার উপর নিজের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে জানে না কেনো?
মানুষ গায়ের জোরে, বুদ্ধির জোরে, টাকার জোরে আর না হলে গলার জোরে তো টিকে থাকতেই হয়।
ভাবী কেনো বোঝে না, বিনয় এখন দুর্বলতার প্রকাশ, যতই নুয়ে থাকবে সুবিধাবাদী মানুষগুলো পিঠটাকে পা রাখার জায়গা ভেবে নেবে।
রাতে খাবার টেবিলে শাশুড়ী কথা তুললেন,
— সাবির… তাহলে তোমার মামাকে কাল আসতে বলি?
সাবির ভাইয়া কোনো প্রতিউত্তর করলো না, শাশুড়ী প্রশ্ন করে তাকিয়েই আছেন। সামির বললো,
— কেনো?
— কেনো আবার? বিয়ের কথা পাকা করতে?
— ও
— আমি চাচ্ছি ৭/৮ দিনের ভেতর কাজটা সারতে।
— এত তাড়াহুড়ো কিসের?
— শুভ কাজে দেরি করতে নেই, তাছাড়া তোর বাবা তো আর সম্মত নয় তাই যা করার আমাকেই করতে হবে। সামির বাবা তুই আমার সাথে বিয়ের কেনাকাটায় একটু সাহায্য করিস?
— না না আমি এসব পারবো না, অফিসে প্রচুর কাজের চাপ এ মাসে একদিনও আমি নষ্ট করতে পারবো না, অনলাইন অফলাইন সবভাবে কাজ করতে হবে।
— ওহ, সাবির বাবা তুই কাল ছুটি নে বাড়িতে থাকিস, তোর মামা আসবে তোকে না পেলে কি ভাববে? বিষয়টা খারাপ দেখায়।
সাবির ভাইয়া বিরক্তমুখে ভাতের প্লেট ঠেলে দিয়ে উঠে চলে যান।
সামির মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মা… যেখানে ভাইয়া রাজী নয়, বাসার কেউ রাজী নয় তোমার এসব পাগলামি না করলে চলছে না?
— নাহ… আমি যা বলেছি তাই হবে, এখন এইটা আমার জেদে পরিণত হয়ে গেছে।
— মা সব জেদ কিন্তু কল্যাণ বয়ে আনে না ক্ষতিও করে।
— চুপ করো? জ্ঞান দিতে এসো না?
সামির আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ পাতের খাবার শেষ করে উঠে পড়লো।
পরদিন বেলা বারোটা নাগাদ মামা শ্বশুর মজিদ হাওলাদার এসে হাজির, দেশি মুরগী, পুকুরের মাছ, দেশি কলা, কলার মোচা, বোতল ভর্তি দুধ, জমিনের কাঁচা তরিতরকারি দিয়ে রান্নাঘর ভরে ফেললেন। শাশুড়ীর খুশি আর ধরে না, যেনো মণিমাণিক্য নিয়ে এসেছে।
বারবার বলতে লাগলেন, ছেলের শ্বশুর বাড়ি এমন হওয়া লাগে।
মামা শ্বশুর একটু পরপর ডাকাডাকি করেন,
— কই গো মা লক্ষ্মীরা, এদিকে আসো। তুমরা সবাই কেমুন আছো?
আমি কাছে গিয়ে বললাম,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো মামা।
— আলহামদুলিল্লাহ, আমার মাইয়া কিন্তু অনেক ভালো, দেখবা তোমাগ লগে একদম মিল্লা-মিশ্যা চলবো।
বিড়বিড় করে বললাম, জ্বি জ্বি আগে আসুক হাড় মাংস যদি আলাদা না করে ফেলেছি তো আমার নাম পালটে রাখবো।
মামা শ্বশুর বললেন,
— কিছু বললা মা?
— জ্বি বললাম যে তাহলে তো খুবই ভালো, মিলেমিশে থাকারই তো দরকার।
রান্নাঘরে ভাবী সব গোছাচ্ছে, আমাকে দেখে বললো,
— প্রভা মাছটা একটু উল্টে দাও আর মাংসটা একটু নেড়েচেড়ে দাও।
আমার রাগ লাগছে গুদাম পুড়ে যাচ্ছে সে আলুপোড়া খায়, যত্তসব! রেগে বললাম,
— আমি পারবো না, তুমিই খাতির করো গিয়ে তোমার সতিনের বাপকে, আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি আমার রুমে গেলাম।
আমি একবোতল পানি নিয়ে রুমে চলে গেলাম।
ভাবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই গিয়ে নাড়তে লাগলো।
আমার সারা শরীর রাগে ফুঁসছে, একজন বেহায়ার মতো জবরদস্তি জুলুম করেই যাচ্ছে, অন্যজন টু শব্দ না করে সব সয়ে নিচ্ছে। জাস্ট বিরক্তিকর!
সাবির ভাইয়া সামির, শ্বশুর বাবা কেউ নেই, শাশুড়ী একা একাই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে নিলো। আজ তো রবিবার সামনের শুক্রবার বিয়ে । বিয়ে এই বাড়িতে হবে, বেশি লোকজন বলাবলি হবে না, মামা শ্বশুর ও তার পরিবার মেয়ে নিয়ে বুধবার এখানে চলে আসবে। বৃহস্পতিবার ছেলে মেয়ের একসাথে গায়ে হলুদ হবে আর শুক্রবার বাদ জুম্মা বিয়ের শুভ কাজ সম্পন্ন হবে।
দুপুরে খাবার খেতে বেরিয়ে এই নাটকের অংশ হলাম। মামা শ্বশুর যাবার বেলায় ভাবীকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারবার আশ্বস্ত করে গেলেন, তার মেয়ে কখনোই ভাবীর অবাধ্য হবে না, ভাবীর সাথে মিলেমিশে চলবে তাকে সম্মান করবে।
ভাবী মন খারাপ করে রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম,
— জানো ভাবী তোমার উপর প্রচন্ড রাগ হয় আমার? এখনো যদি চুপ করে থাকো তবে বিয়ে হয়ে গেলে ঠ্যাকাবে কি করে?
— প্রভা আমার মন বলছে এই বিয়ে হবে না, তাছাড়া সাবির আমাকে বলেছে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।
মনেমনে ভাবলাম, কি জানি! বিশ্বাস প্রবল হলে স্রষ্টা সাহায্য করতেও পারেন। অথৈ সাগরে পড়লে মানুষ শেষ খড়কুটো আঁকড়ে হলেও বাঁচতে চায়, হয়তো বিশ্বাসটুকুই ভাবী শেষ সম্বল।
দেখা যাক কে জেতে।
চলবে
#শামীমা_সুমি